প্রিয়তমা পর্ব-১৪

0
356

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৪

প্রকৃতি তার নিয়মে রূপ বদলায়।শরৎকালের আদ্রতা গিয়ে প্রকৃতিতে নেমেছে হেমন্তকাল।মাঠ জুড়ে হলুদ ধানের খেলা।সেই ধান কেটে আঁটি বেঁধে পাল্লার মতো কাঁধে ঝুলিয়ে গৃহস্থের বাড়ির দিকে হাঁটছে কৃষক।ফড়িংয়ের দল উড়াউড়ি করছে ক্ষেতের উপর।হালকা শীত শীত ভাব,দিগন্ত পেরিয়ে তীর্যক ভাবে ওঠা সূর্যের মিষ্টি রোদ।গাছিরা কুয়াশা ডিঙিয়ে খেজুর গাছ চেছে রস সংগ্রহ করে।
সারা বাড়ী খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে।হাজেরা বেগম নতুন ছোট ধানের চাল রান্না করবেন রস দিয়ে।প্রীতি,ফারিহা শাশুড়ীর পাশেই আছে।এখনো প্রায় সময় হাজেরা বেগমই রান্না করে থাকেন।

রূপক যাওয়ার পর প্রীতিকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে রূপকের বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন সবাই মিলে ঢাকায় গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে।কথা অনুযায়ী ঢাকায় গেলো সবাই।রাহাতের ছোট্ট ফ্ল্যাটেই উঠলো।মনি হোস্টেল থেকে এসে সবার সাথে যোগ দিয়েছিলো।দুদিন না যেতেই প্রীতি গ্রামে ফিরে আসার জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দিলো।ওর ভালো লাগছেনা আর ওখানে থাকতে।তিনদিনের মাথায় আবার সবাই গ্রামেই ফিরে এসেছে।

সকালে খেজুর রসের পায়েস খেয়ে প্রীতি ছুটলো কলেজের পথে।রূপকের সাথে প্রতিদিনই ভিডিও কলে কথা হয় প্রীতির।দুজনের মধ্যে সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে।
কলেজের সামনে রিকশা থামতেই প্রীতি ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো।আরমিন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলো প্রীতির জন্য।তার দেখা মিলতেই টেনে আবার কলেজের গেটের বাইরে নিয়ে আসলো।

আরে তুই আমাকে এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?বিরক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো প্রীতি।
উত্তরে আরমিন বলল,আমরা আজ ক্লাস করবোনা।এক জায়গা যাবো।
প্রীতি তিরিক্ষি মেজাজে প্রশ্ন ছুঁড়লো,কোথায় যাবি ক্লাস বাদ দিয়ে?
আরমিন থেমে গিয়ে বলল,আরে বাবা এরকম রেগে যাচ্ছিস কেনো?একদিন ক্লাস বাদ দিলে তোর পুলিশ জামাই তোকে জেলে দেবেনা।
প্রীতি আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল,তার মনের জেলখানা থেকেই আমাকে বের করে দিবে যদি তার কথা না শুনি।
আরমিন তিক্ত কন্ঠে বলল,কিচ্ছু হবেনা এখন চল।
প্রীতি আরমিনের সাথেই গেলো কিন্তু কোথায় সেটা জানেনা।যেতে যেতে দুজনে একটা ঝিলের পাড়ে এসে থামলো।
আরমিন বলল,এখানে আমার বয়ফ্রেন্ড আসবে আমরা দেখা করেই চলে যাবো বাড়িতে।
আরমিনের কথা শুনে প্রীতি সিটকে সরে গিয়ে বলল,তুই থাক তোর বয়ফ্রেন্ড নিয়ে।আমি নাই বইন।একবার একথা উনার কানে গেলে আমাকে মেরে ফেলবে।
আরমিন প্রীতির হাত টেনে ধরে বলল,এরকম করিস কেনো?কিচ্ছু হবেনা।তুই না আমার বান্ধবী?আমাকে একা রেখে চলে যাবি?
আরমিনের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কারণে প্রীতি থেকে গেলো।কিন্তু বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে।ভয় কাজ করছে মনে।
ঝিলের ঢেউ খেলানো পানির দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলছে প্রীতি।

আরমিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,আসছে আসছে।
আরমিনের চেঁচানো শুনে প্রীতি ভড়কে যায়।সামনে বরাবর তাকিয়ে দেখলো দূর থেকে একটা ছেলেকে হেলেদুলে আসতে দেখা যাচ্ছে।আরেকটু সামনে আসতেই ছেলেটিকে কেমন চেনাচেনা লাগলো।ছেলেটি এসেই আরমিনের পাশে দাঁড়ালো।প্রীতি চোখ বড় বড় করে বিড়বিড় করে বলল,হাপপ্যান্ট!
আরমিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,ও আমার বয়ফ্রেন্ড আপ্পান আর ও আমার বান্ধবী প্রীতি।

আপ্পান হায় আপু বলে হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়ে থমকে গেলো।মন বলছে আপ্পান একছুটে পালা কিন্তু পা দুটো আটকে আছে।
প্রীতি কুটিল হেসে সুর টেনে বলল,কেমন আছেন ভাইয়ায়ায়া?
আপ্পান কোনোমতে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,ভভালো আছি,আপনি কেকেমন আছেন?
প্রীতি আপ্পানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল,আজ দেখছি হাপপ্যান্ট পড়েননি।
আপ্পান আচমকা দুইহাত জোড় করে বলল,প্লিজ ভাবি আমাদের বাসায় কিছু বলবেননা।
প্রীতি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,কে ভাবি?ভাইয়া আপনি কি বলছেন?
আপ্পান অসহায় কন্ঠে বলল,এরকম করছেন কেনো ভাবি?আমার সাথেতো আপনার কোনো শত্রুতা নেই।

আরমিন একবার প্রীতির দিকে একবার আপ্পানের দিকে তাকাচ্ছে।অবাক হয়ে বলল,তোমরা কি একে অপরকে চিনো?
আপ্পান আরমিনকে সব বলতেই আরমিন খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,তাহলেতো জব্বর হবে।দুই বান্ধবী পাশাপাশি বাড়িতে বউ হয়ে থাকবো।
আপ্পান বিড়বিড় করে বলল,আমার মায়ের কানে গেলে রক্ষে থাকবে কিনা সেই চিন্তায় বাঁচিনা আরেকজন এখানে উৎসব করছে।
আপ্পানের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রীতি মিটিমিটি হাসছে।আচ্ছা জব্দ হয়েছে ছেলেটা।নাহ আর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।প্রীতি আপ্পানকে আশ্বস্ত করে বলল,আমি কিছুই বলবো না তোমার আম্মুকে।নিশ্চিন্তে থাকো।

কিছুক্ষণ কথা বলে প্রীতি আরমিন আর আপ্পানকে একা ছেড়ে দিয়ে চলে আসলো।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সামনে এগোলো প্রীতি।কিছুদূর আসতেই সামনে একটা গাড়ি থামে।

আপ্পান আরমিনের সাথে কথা শেষ করে বাসার দিকে গেলো।রাস্তায় একটা ফোন পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুললো।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখলোনা।কাকে জিজ্ঞেস করবে এই ফোনটা কার?ফোনের স্ক্রিন অন করতেই রূপক আর প্রীতির একটা কাপল পিক ভেসে ওঠে সামনে।আপ্পান ভ্রু কুচকে তাকালো।মনে মনে বিরক্ত হলো প্রীতির উপর।উনি সবসময় লাফালাফি করেন।এখন ফোনটাও রাস্তায় ফেলে চলে গেলেন?আপ্পান ফোন হাতে পকেটে নিয়ে নিলো।আজকে বাড়িতে যাবে।একফাঁকে প্রীতির ফোন দিয়ে আসবে।আরো সামনে যেতেই ঘাসের উপর প্রীতির ব্যাগটাও পড়ে থাকতে দেখলো।
আপ্পানের কপালে এবার সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো।মোবাইল এক জায়গায়,ব্যাগ আরেক জায়গায় ফেলে রেখে গেলেন কোথায়?
কিছু একটা ভেবে আতকে উঠলো আপ্পান।

—————————————————————★

চলে আসো।নতুন মা**ল দেখে যাও।এমনিতেই রূপকের কারণে গতবার সব ভেস্তে গেছে।এবারতো আর দেশে নেই।এবার আর কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের।কয়েকদিনের মধ্যেই এদেরকে হস্তান্তর করা হবে।এখনো দশজনের কমতি আছে।আজ নতুন পাঁচটি টিয়াপাখি খাঁচায় বন্ধি করেছি।এখানে আসলে সারপ্রাইজ হয়ে যাবে বলে বাঁকা হাসলো লোকটি।

অপরপাশকে বিদঘুটে হাসির শব্দ শোনা গেলো।আমরা আসছি বলেই কল কেটে দিলো সে।

চোখমুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে প্রীতি।মুখে কাপড় দেওয়া।শুধু সে নয় আরো অনেকগুলো মেয়ে আছে এখানে।সবাইকে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে।সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করছে বলে মুখে কাপড় দিয়ে পেছন দিকে বেঁধে রাখা হয়েছে।সবাই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে।এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারছেনা পা বাঁধা থাকার কারণে।প্রীতিসহ পাঁচজনের চোখ বাঁধা।বাঁকিদের চোখ খোলা।নাকে বাজে একটা গন্ধ এসে ঠেকছে।অনেকদিন ধরে গোসল না করলে মানুষের শরীর থেকে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায় তেমন গন্ধ।কেমন বিদঘুটে অনুভূতি।প্রীতির হাত পা কাপছে।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে।হৃদপিণ্ড তড়িৎগতিতে লাফালাফি করছে।কোথায় আছে প্রীতি কিছুই বুঝতে পারছেনা।এই মুহূর্তে রূপক আর বাবার কথা বেশি মনে পড়ছে।

আপ্পান আর আরমিনকে একা ছেড়ে যখন প্রীতি বাসার পথে রওনা হলো তখনই ওর সামনে একটা গাড়ি থামে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনচারটা লোক নেমে প্রীতির মুখে রুমাল চেপে ধরে।এরপর আর কিছুই মনে নেই প্রীতির।ফোন হাতে ছিলো সেটা নিচে পড়ে যায়।লোকগুলোর মধ্যে একজন প্রীতির ব্যাগ নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারে।

——————————————————★

রূপক অনবরত প্রীতিকে কল করে চলেছে কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না।এখন বিকেল চারটা ছুঁই ছুঁই।এসময়তো প্রীতির হাতে ফোন থাকার কথা।
এতগুলো কল দেওয়ার পরও যখন প্রীতি ফোন তুললোনা তখন অস্থির হয়ে রূপক মায়ের নাম্বারে কল দিলেন।
এতবার প্রীতির ফোনে রূপকের কল এসেছে দেখেও আপ্পান ফোন তুললোনা।সাইলেন্ট করে রেখে দিলো।ফোন রিসিভ করে সে কি জবাব দেবে?রূপক যদি প্রশ্ন করে প্রীতির ফোন তোমার হাতে কেনো তখন সে কি উত্তর দিবে?
তারচেয়ে বরং আগে রূপকেদের বাড়িতে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে আসুক তারপর ভাবা যাবে বাঁকিটা।

আপ্পান রূপকদের বাড়িতে গেলো।হাজেরা বেগমকে দেখলেন কারো সাথে কথা বলছে।পরিস্থিতি দেখে যা বুঝলো প্রীতি বাড়িতে ফিরেনি।
আপ্পান কিছু না বলেই ফিরে আসে নিজেদের বাড়িতে।প্রীতির ফোন সুইচ অফ করে দিলো।
রূপক মায়ের ফোনে কল দিয়ে জানতে পারলো প্রীতি এখনো বাড়িতে ফেরেনি তারা এই নিয়ে চিন্তিত।রূপক উত্তেজিত হয়ে বলল,এখনো ফেরেনি মানে?কি বলছো এসব।ঠান্ডা ভাবের মাঝেই রূপক তরতর করে ঘামছে।মনের ভেতর এক অজানা ভয় উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।হাজেরা বেগম চিন্তিত কন্ঠ বললেন,আমি কখন থেকে বসে আছি ওর অপেক্ষায় কিন্তু এখনো ফিরলোনা।কোথাও যাওয়ার হলেতো আমার কাছ থেকে অনুমতি নিতো।

কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রূপক কল কেটে দিলো।প্রীতির নাম্বারে আবারো কল দিলো কিন্তু এবার ফোন বন্ধ বলছে।রূপকের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে গেলো।সোজা কল করলো ফারুখের নাম্বারে প্রীতি কোথায় আছে দেখতে। কিন্তু ফারুখও ফোন তুলছেনা।অনেকবার কল দেওয়ার পরও যখন ফোন তুললো না তখন রেগে ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন ছুঁড়ে মারলো।ফ্লোরে পড়ায় ফোনের গ্লাস ফেটে গিয়ে পার্ট পার্ট হয়ে খুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো।
দুহাতে মাথার চুল খামছে ধরলো রূপক।কয়েক সেকেন্ড যেতেই দৌঁড়ে ফোনটা তুলে নিলো।ফোন ঠিক করে সুইচ অন করতে নিলো কিন্তু অন হচ্ছেনা কিছুতেই।একটাই ফোন ছিলো ওর কাছে তাই ওটা ফেলে দিয়ে রুম থেকে বের হলো।সেখানের একজনের কাছ থেকে ফোন নিয়ে কনস্টেবল নিজামকে কল দিলো।দুবার রিং হতেই নিজাম ফোন রিসিভ করলো।রূপক আদেশ দিলো প্রীতি কোথায় আছে তাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে।

নিজাম কিছু প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই রূপক তাকে ধমকে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,আমার স্ত্রীর যেনো বিন্দু মাত্র ক্ষতি না হয়।তাহলে আমি সব জ্বালিয়ে দেবো বলে দিলাম।নিজাম শুকনো ঢোক গিললো।
এরপর তরুণকে কল দিলো।যদিও তরুণ নিজে কিছুই করতে পারবেনা তবুও ওকেও ফোন করে প্রীতির ব্যাপারে জানিয়ে দিলো রূপক।তরুণ ঢাকায় হাসপাতালে থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে দিলো।সবাই জানে তরুণ কোমায় তাই এখন তার জন্য বেরোনো রিস্কি হয়ে যাবে।

সারাদিন পেরিয়ে রাত হয়ে এলো এখনো প্রীতি বাড়ি ফেরেনি।পুরো বাড়িতে যেনো শোকের ছায়া নেমে আসলো।প্রীতির মাকে হাজেরা বেগম কল দিয়ে জানালেন।তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।রাজিব শেখ আর ফারুখকে কল দিলেন কিন্তু দুজনের ফোনই বন্ধ।

অন্ধকার বদ্ধরুমে পড়ে প্রীতি আল্লাহকে ডাকছে।নোনাপানিতে চোখে বাঁধা কাপড় ভিজে একাকার হয়ে আছে।
#চলবে……….