প্রিয় হতে প্রিয়তর পর্ব-৯+১০

0
419

#প্রিয়_হতে_প্রিয়তর
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃতাসনিম

দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার রুমে গেল বিশ্রাম নিতে,ফারাহ বাসার সামনের পুকুরের দিকে যাচ্ছিল তখনই তার ননদিনীরা তার কাছে এসে বললো,

“ভাবি ভাইয়া কে একটু বলো না আমাদের সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যেতে,কতদিন পর এলাম আবার কবে আসবো তাও তো জানি না কয়েকদিন পরই পরীক্ষা আর তো আসাই হবে না”

“হ্যা ভাবি বলেন না ভাইয়া কে”

“তোমাদের ভাইয়া কি আমার কথা শুনবে,সে তো ঘুমোচ্ছে এখন”

“আমরা বিকেলে যাবো,শুনো না ভাবি আমাদের এখানে না অনেক গুলো সুন্দর জায়গা আছে,এখান থেকে মাত্র ৭ কিমি পরেই আমঝুপি নীলকুঠী, ইকো পার্কে গিয়েছি অনেকবার কিন্তু আমঝুপি নীলকুঠী তে কখনো নিয়ে যায় নি ভাইয়া”

“হ্যা ভাবি জানেন এখানে গাংনী উপজেলা আছে সেখানেই ইকো পার্ক ওই জায়গাটাও অনেক সুন্দর”

“তোমাদের এখানে সবই সুন্দর,আমার ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যায় ”

“ভাবি বলো না ভাইয়াকে,তুমি বললে ভাইয়া না করবে না প্লিজ ভাবি”

তিনজন মিলে জোর করে ফারাহ কে জাবিরের কাছে পাঠালো,রুমে গিয়ে দেখলো মহাশয় লম্বা হয়ে শুয়ে ফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত।ফারাহ যে তার পাশে এসে বসেছে তার কোনো খবরই নেই।

“শুনন,জাহরা, বর্ষা,মেঘ একটু ঘুরতে যেতে চাইছে”

জাবির মনে হয় ওর কথা শুনলোই না,ফারাহ কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে, ওর হাত ফোন টা নিয়ে নিল,তারপর মহাশয়ের হুঁশ এলো কিছুক্ষণ চুপ করে বুঝার চেষ্টা করলো,তার সাথে কি হয়েছে,ফারাহ কোথা থেকে আসলো।জাবির উঠে বসে ফারাহকে বললো,

“ফোন টা নিয়ে নিলে কেন,তুমিই বা কখন এলে”

“এসব গেম টেম খেলা চলবে না,যখন আমি সামনে থাকবো তখন তো খেলায় যাবে না”

“তখন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে শুধু,আচ্ছা তাহলে তোমার পিছনে গেম খেলবো,দেও ফোন টা দাও আমি তোমার পিছনে বসে খেলি”

“মজা করবেন না,আপনি শুনেছেন আমি যে আপনাকে কিছু বলেছি”

“কি বলেছো,কখন বলেছো”

“যখন আপনি আপনার ফালতু গেম খেলায় ব্যস্ত ছিলেন তখন”

“তুমি আমাকে তিরস্কার করছো,কিন্তু বিষয় টা কে যদি অন্য ভাবে দেখো তাহলে বুঝবে যে আমি যখন কোনো কাজ করি অনেক মনোযোগ দিয়ে করি,দিনদুনিয়ার খবর থাকে না”

“এভাবে কাজ করা ঠিক না, সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়,আর আমি না আপনার নতুন বউ হ্যা মানছি পরিস্থিতির চাপে হঠাৎ এ বিয়েটা হয়েছে কিন্তু তাও তো আপনার উচিত আমার খেয়াল রাখা”

জাবির সোজা হয়ে সুন্দর করে বসে একটা সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললো,

“হ্যা বউ বলো তোমার স্বামী তোমার কীভাবে খেয়াল রাখতে পারে”

ফারাহ হেসে দিল জাবিরের কথা বলার ধরন দেখে,জাবিরও তার সাথে হাসতে লাগল। তারপর ফারাহ বললো,

“আমরা ঘুরতে যাবো”

“বিকেল হয়ে যাচ্ছে এখন কোথায় যাবে”

“বিকেলেই তো মানুষ ঘুরাঘুরি করে”

“জি না মেডাম,আমাদের এখানে ঘুরতে হলে সকালে বের হতে হয় আর সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসতে হয়,কারণ দেখার মতো জায়গা অনেক,সব তো আর দেখা যায় দু একটা দেখতে গেলেও একদিন সময় লাগে”

“তাহলে আমরা কাল যাবো”

“কাল তো মনে হয় আমরা ফিরে যাবো ঢাকায়”

“এতো তারাতাড়ি কেন আর কিছুদিন থাকি এখানে”

“চাকরিটা চলে যাক আমার পরে এখানেই থাকতে হবে”

“কিন্তু আমি জাহরাদের কি বলবো”

“ওহ বুঝলাম এখন এরা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে, আমিও তো বলি তুমি তো ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে না”

“কেন আমি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতে পারি না
বুঝি”

“নাহ তুমি তো বিদেশি মানুষ,এখানে যা দেখবে তার থেকে সুন্দর জায়গা তুমি লন্ডনই দেখে এসেছো”

“মোটেও না আমি এইখানের সব জায়গা ঘুরে দেখতে চায়”

“দেখো আবার আসলে”

“চলুন আজকেই যায় প্লিজ, ওরা বলছিল এখানে কোন আমঝুপি নীলকুঠী আছে সেখানে তো মনে হয় পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা থাকবে আমরা না হয় রাতে ওখানে থাকলাম,তারপর কালকে গাংনী উপজেলাটা দেখে তারপর ঢাকায় চলপ যাবো”

“কাল ভোরে রওনা হবো আমরা সকাল ১০-১১ দিকে যেন পৌঁছে যেতে পারি,তারপর অফিসে যাবো আমি”

“একদিন অফিসে না গেলে কি হবে এমন করেন কেন,ঠিক আছে যেতে হবে না”

ফারাহ রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল,জাবির বালিশে মাথা দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে আবার উঠে পড়লো বিছানা থেকে, তারপর বাইরের দিকে গেল। পুকুর পাড়ে ননদ ভাবিরা বসে গোল মিটিং করছে,ফারাহ মন খারাপ করে ওদের বললো,

“তোমাদের ভাইয়া রাজি হয়নি,আমরা নাকি কাল চলে যাবো,তাই আজ সে কোথাও যাবে না”

“কালই চলে যাবো ভাবি,আর কিছু দিন থাকি,এই বর্ষা,এই মেঘ বল না আম্মু কে আর কিছু দিন থাকবো”

“এটা কি আম্মুর সিদ্ধান্ত নাকি জাহরা,এটা তো তোমার ভাইয়ের সিদ্ধান্ত”

“তাহলে ও চলে গেলেই হয় আমরা এখানে থাকবো কিছুদিন”

“এই যে মেডামরা যান রেডি হয়ে নেন,নিয়ে যাবো ঘুরতে”

“সত্যি ভাইয়া”

“হুমম যা সময় নষ্ট করিস না”

তিনবোন দিল এক দৌড় রেডি হওয়ার জন্য, ফারাহ ওর জায়গায় বসে রইল, জাবির গিয়ে তার পাশে বসলো,

“কি হয়েছে বউ,তুমি বসে আছো কেন রেডি হবে না”

“তখন না করলেন কেন”

“ভেবেছিলাম তুমি রাগ করবে না,কিন্তু তুমি তো রাগে ফুলে গেছো,তাই রাজি হলাম যত যায় হোক বউ তো তুমি আমার একটাই,তার এতটুকু আবদার যদি না রাখি তাহলে কিভাবে হয়”

ফারাহ জাবিরের গাল দুটো টেনে দিয়ে চলে গেল রেডি হতে,জাবির গালে হাত দিয়ে ফারাহ যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

কিছুক্ষণ পর সবাই বের হলো,ফারাহ আর জাবির ম্যাচিং করে পড়েছে, জাবির পার্পেল কালার পাঞ্জাবি, ফারাহ পার্পেল কালার শাড়ি, মাথায় রজনীগন্ধার মালা লাগিয়ে দিয়েছে জাবির।কোথা থেকে এনেছে জিজ্ঞেস করলে জাবির কিছু না বলে নিজেই খোঁপায় লাগিয়ে দিয়েছে।জাহরা,বর্ষা,মেঘ আর জাবিরের ছোটবেলার একজন বন্ধু মিলে আমঝুপি নীলকুঠীর উদ্দেশ্য বের হলো।যাওয়ার পথে সবাই টুকটাক কথা বলছিল,ফারাহ জাবিরকে প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দিচ্ছিল,তাও বেচারা হাসি মুখে সব উত্তর দিচ্ছিল।

আমঝুপি নীলকুঠীতে পৌছানোর পরে চারদিকে তাকিয়ে ফারাহ চুপ করে দাড়িয়ে পড়লো,সবাই আশেপাশে দেখতে চলে গেল, ফারাহকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাবির ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো

“চলো ভিতরে দেখবে না”

“বাইরেটায় এতো সুন্দর ভিতরে না জানি কি আছে,আপনি আগে এসেছেন এখানে”

“না,এখানে আসা হয়নি এই জায়গাটা বেশ একটা ভালো না,আগে ভালো ছিল কিন্তু দিন দিন বাজে ছেলেদের আড্ডা এসে জমেছে এখানে তাই আসা হয়নি,আমাকে আসতে হলে তো এই চুনোপুঁটিসহ আসতে হয় তাই আসিনি”

“আমরা রাতে এখানে থাকবো আজকে,প্লিজ জাবির প্লিজ না করবেন না”

“বললাম তো জায়গাটা বেশি ভালো না,এমনি সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আবার তুমি রাতে থাকার কথা বলছো,চলো ভিতরটা দেখে আশেপাশে একটু দেখে চলে যাবো”

জাবির ফারাহর হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। চারপাশে মৃদু বাতাসে অন্যরকম সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে তুলেছিল।নীলকুঠীর ভিতরে গিয়ে ফারাহর ইচ্ছেই করছিল না ফিরে যেতে এখানেই রাত কাটাতে ইচ্ছে করছিল,কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই জাবির বাসায় যাওয়ার জন্য চিল্লাচ্ছে,আজানের পর সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য বের হলো,ফারাহ বললো

“আমি পানি খাবো,ভিতর থেকে খেয়ে আসি”

“বাচ্চাদের মতো কেন করছো ফারাহ,বাসায় যেতে হবে এখন,রাস্তা থেকে পানি কিনে দিবো এখন চলো গাড়িতে উঠো”

“না আমি এখনি পানি খাবো”

জাবির কিছু বলতে না দিয়ে ফারাহ আমঝুপি নীলকুঠীর দিকে যেতে লাগলো,সেখানে একটা ছোট পুকুরের মতো জায়গা ফারাহর সূর্য ডোবা দেখতে ইচ্ছে করলো তাই সে চলে এলো,জাবিরকে বললে সে কখনোই রাজি হতো না।দশ মিনিট পরে ফারাহ যেই ফিরে আসতে নিল তখনই দেখলো চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে, ঝোপঝাড়ের কারণে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না,আশেপাশের থেকে মানুষের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে, ফারাহ ভয় হতে লাগলো কেন সে এলো জাবিরের কথা শুনলো না,এখন কিভাবে ফিরে যাবে কোনদিকে যাবে।

#চলবে

#প্রিয়_হতে_প্রিয়তর
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃতাসনিম

ফারাহ আসছে না দেখে জাবির জাহরা গাড়িতে বসতে বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে মেয়ে টা কে এতোবার না করলাম যেয়ও না,তাও কথা শুনলো না চারদিকে অন্ধকার নেমে গেছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ফারাহ আবছা আলোয় সামনে আগাচ্ছিল,তখনই তার পায়ে কিছু একটা কামড় দিল,সে পা ধরে নিচে বসে পড়ল, পা ব্যাথায় সে নড়াতে পারছিল না,কিভাবে সে ফিরে যাবে এখন সে বুঝতেই পারছিল না,ব্যাথা বাড়তে থাকলে একসময় ফারাহ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

জাবির কিছুদূর এগিয়ে আসতেই ফারাহর শাড়ির আচলটা দেখতে পেয়ে ছুটে আসে,ফারাহ পড়ে থাকতে দেখে জাবিরের বুক ধরফর করে ওঠে।জাবির ফারাহর মাথা তার কোলে নিয়ে বলে

“ফারাহ কি হয়েছে তোমার চোখ খোলো,এই মেয়ে কি হয়েছে তোমার”

জাবিরের কথা ফারাহ শুনতে পেল,কোনোমতে ঝাপসা চোখে ওর দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো,কিছু বলতে গিয়েও পারলো না।জাবির ফারাহকে কোলে তুলে নিল, গাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাছাকাছি একটা হসপিটালে নিয়ে গেল, সেখানের ডাক্তার দেখলেন ফারাহকে পায়ে একটা বিষাক্ত পোকা কামড়ে দিয়েছে,তারা কিছু ঔষধ দিয়ে ফারাহকে ছেড়ে দেন,তখনও ফারাহর জ্ঞান ছিল না।

হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর সবাই জাবিরের সাথে রাগারাগি শুরু করল কেন ওকে একা ছাড়লো,বেচারাকে একে একে সবাই ঝারলো,কাউকেই কিছু বললো না জাবির চুপ করে শুনলো শুধু।

পরেরদিন ভোরে ফারাহর জ্ঞান আসলো,পাশে জাবিরের আম্মু বসে ছিলেন, ওকে তাকাতে দেখে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।সবাই এসে জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে, কিন্তু জাবির একবারের জন্য রুমেও আসেনি,পায়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে ফারাহ সারাদিন বিছানা থেকে নামতে হয়নি।কিন্তু বিকেলে তারা ঢাকা যাবে বলে সিদ্ধান্ত হওয়ায়,ফারাহ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো,কোনোমতে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো,পরে রুমে জাহরা আসায় তাকে রেডি হতে হেল্প করলো।নিচেও জাহরা ধরে নিয়ে গেল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে যখন গাড়িতে গিয়ে বসলো তখন জাবিরের দেখা মিললো,শরীফা বেগম আর জাহরা বাইরে কথা বলছিলেন বলে গাড়িতে শুধু জাবির আর ফারাহই ছিল।জাবির বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল,একবারও ফারাহর দিকে তাকাইনি, জ্ঞান আসার পর জিজ্ঞেস ও করেনি কেমন আছে।ফারাহ এক দৃষ্টিতে জাবিরের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বললো না। শরীফা বেগম আর জাহরা গাড়িতে এসে বসলে জাবির গাড়ি চালানো শুরু করে। ফারাহ তার শাশুড়ী মার সাথে বসেছেন আর জাহরা জাবিরের সাথে ড্রাইভিং সিটে বসেছে।পুরো রাস্তায় জাবির কারো সাথেই কথা বলেনি।

ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল,জাহরা আর শরীফা বেগম ফারাহকে নিয়ে বাসায় গেলেন,জাবির গ্যারেজে গাড়ি রাখতে গেলেন।শরীফা বেগম রাস্তা থেকে খাবার কিনে নিয়েছিল ওভেনে সেটা গরম করে নিল,ফারাহকে জাহরা রুমে দিয়ে আসলো।শরীফা বেগম গিয়ে ফারাহকে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে এলেন,তখনই জাবির রুমে ঢুকছিল ওকে দেখে বললেন,

“এতো দেরি করলে কেন, গাড়ি রাখতে এতক্ষণ লাগে,যাই হোক হাতমুখ ধুয়ে আসো খাবার গরম করেছি”

“খাবো না আমি”

“কেন”

“ইচ্ছে করছে না”

মাকে কিছু বলতে না দিয়ে জাবির ওয়াশরুমে চলে গেল,শরীফা বেগমও নিজের কাজে চলে গেলেন। ফারাহ জাবিরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ওয়াশরুম থেকে বের হলে প্রথমে কালকের জন্য সরি বলবে,তারপর সে অভিমান করে বসে থাকবে কেন তার সাথে একবারও কথা বললো না।কিন্তু সে যে ওয়াশরুমে ঢুকেছে আর বের হওয়ার নামই নেই।শেষে ফারাহ ঘুমিয়েই পড়লো,সে ঘুম ভাঙলো পরেরদিন সকাল ১১ টায়,পাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই মানে জাবির চলে গেছে। বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেল।তারপর খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে রুমটা গুছিয়ে নিল,তারপর শরীফা বেগমের কাছে গেলেন,তারাও আজকে দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছেন।

“আম্মু জাবির কখন অফিসে গেছে আপনাকে কি বলে গেছে”

“না,খেয়েও যায় নি ছেলেটা,রাতেও খেলেও না কি যে করি আমি ওকে নিয়ে এখন তুমি এসেছো ওকে একটু সামলাও গোছানোর চেষ্টা করো,ছেলেটা এতো অগোছালো হয়ে থাকে সবসময় কোনো কিছু সময় মতো করবে না,খাওয়া দাওয়া তো তার করাই লাগে না”

“হুমম, রাতে কখন ও আসে আম্মু”

“৭-৮ টার দিকে চলে আসে,বন্ধুদের আড্ডায় পড়ে গেলে আরো দেরি হয়,সেদিন সবাই মিলে বকেছি বলে হয়তো রাগ করেছে তাই খায়নি,আজকে আসলে আদর করে খাওয়াতে হবে”

“সবাই মিলে বকেছেন মানে কেন বকেছেন”

“তোমাকে একলা কেন ছেড়ে দিয়েছিল তাই বকেছিলাম, তুমি কি ওখানকার রাস্তাঘাট চিনো ও যে তোমার সাথে থাকলো না আল্লাহ না করুক তোমার যদি বড় কিছু হয়ে যেত তাহলে আমরা কি করতাম,তোমার বাবা মার কাছে কি জবাব দিতাম”

“আম্মু ওনার দোষ ছিল না, আমিই জোর করে গিয়েছিলাম,উনি আমাকে অনেক বার না করেছিল”

“ও তোমার সাথে গেলেই তো হতো,তাহলে আর কোনো ঝামেলা হতো না,থাক বাদ দেও আসো নাস্তা করে নেও, যদিও এখন নাস্তার খাওয়ার সময় না তাও আমরা খাচ্ছি”

“জাহরা কি কলেজে গেছে,ও খেয়ে গেছে”

“নাহ এরা ভাইবোন আমরা ঘুমে থাকতে থাকতেই উধাও, আমরাই খেয়ে নেয়,তারপর জাবিরের প্রিয় খাবার গুলো রান্না করবো তাহলে আর সে রাগ করে থাকবে না”

“জাবির কি খেতে পছন্দ করে আম্মু”

“ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে খিচুড়ি গরুর গোসত, বৃষ্টি ভাব হলেই ওর জন্য আমার এই খাবার রান্না করতে হয়,তাছাড়া ও সরষে ইলিশও খেতে পছন্দ করে আজ সেটাই রান্না করবো,জাহরা আবার ডিমের কোরমা পছন্দ করে তার পছন্দেরও একটা আইটেম রাখা উচিত, এখন তুমি বলো তোমার কি পছন্দ”

“আমার সবই পছন্দ, আপনি যা রান্না করবেন আমি তাই খাবো”

“দেখো ফারাহ তুমি এখন এ বাসার বউ আমার সাথে সবসময় থাকবে,তাই আমার সাথে ফ্রি হতে হবে তোমাকে লজ্জা পেলে চলবে না”

“নাহ আম্মু সত্যি আমি সব খাবারই পছন্দ করি, আমার আম্মু কখনো আলাদাভাবে কোনো খাবার কে পছন্দ বলাটা পছন্দ করতেন না,আমাদের সবরকম খাবারই খাওয়াতেন,আমরা সবজিটা খেতে চাইতাম না তখন সবজি আর গোসত একসাথে রান্না করতেন”

“হুমম ছোটবেলা থেকে এভাবে সব খাবার খাওয়ার অভ্যাস করলে সব পরিস্থিতিতে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়া যায়,আচ্ছা তুমি আস্তে আস্তে খাও আমি গিয়ে রান্না শুরু করি”

“আমার খাওয়া তো শেষ আমিও আসি”

“না না,খাওয়া শেষ হলে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেও এমনি অসুস্থ আবার কাজ করতে হবে না যাও মা”

“কিন্তু আম্মু আপনি একলা ”

“এতোদিন ও তো একলাই ছিলাম মা”

“এখন তো আমি আছি,তাহলে কেন আপনি একা সব কাজ করবেন”

“আচ্ছা বাবা তুমিও করো কিন্তু আগে সুস্থ হয়ে নেও তারপর আর কথা না যাও রুমে যাওও টিভি দেখো”

ফারাহ রুমেই চলে আসলো,জাবিরের রুমের জানালাটার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে নিজের বারান্দাটা দেখলো,কি থেকে কি হয়ে গেলো,কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে এসে সে যে পাশের বাসার ছেলেকে বিয়ে করে তার বাসার বউ হয়ে যাবে তা তার কল্পনাতীত।

সুটকেস থেকে তার জামা কাপড় গুলো বের করলো,তারপর জাবিরের আলমারিটা খুলতেই এক ঘূর্ণিঝড় এসে পড়লো তার উপর,সব জামাকাপড় এলোমেলো করে রাখাছিল খুলতেই সব পড়ে গেল। ফারাহ এক এক করে সব গুছিয়ে রাখলো।সব জায়গায় জাবিরের একার জিনিস সরিয়ে নিজের টাও রাখলো,সদ্য বিবাহিতা দম্পতির রুমই মনে হচ্ছে চারদিকে তাকিয়ে,রুম স্প্রে করেদিল চারদিক থেকে মনে হচ্ছিল ফুলের বাহার যাচ্ছে।

রাতে ফারাহ জাবিরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ড্রইয়িংরুমে বসে জাহরা ও কয়েকবার এসে গল্প করে গেছে। ৮ ছাড়িয়ে ৯ টা বেজে গেল তার আসার খবর নেই।জাবিরের নাম্বার ফারাহর কাছে ছিল না জাহরা কাছে চাইবে কিনা ভাবছিল,তখনই কলিংবেল বেজে উঠল, ফারাহ গিয়ে দরজা খুললো,জাবির পুরো ঘেমে একাকার হয়ে আছে।ফারাহ সাইড দিলে সে রুমের দিকে চলে যায় সোজা,রুমে পা রাখতেই সবকিছু বদলে গেছে বুঝতে পারলো,কিছু বললো না চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো,ফারাহ জাবিরের জন্য লেবুর শরবত করে নিয়ে গেল,জাবির ততক্ষণে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে পড়েছে, কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসলে ফারাহ গ্লাসটা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।জাবির ওর দিকে না তাকিয়েই ডাইনিং টেবিলের দিকে যাচ্ছিল। টেবিলে সব খাবার সাজানোই ছিল জাবির চুপ করে বসে খাবার নিতে লাগলো প্লেটে,শরীফা বেগম তখন জাবিরের বাবার সাথে কলে কথা বলছিলেন তাই সে বুঝতে পারেনি ছেলে যে এসেছে। ফারাহ গ্লাসটা রান্না ঘরে রেখে এসে জাবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ওর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল সে কিছু বললো না নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিল।

জাবির খাওয়া শেষে উঠে যাচ্ছিল তখন শরীফা বেগম এলেন,

“ভালো খেয়েছিস বাবা,কাল থেকে কিছু খায়নি আমার বাবাটা,তোর আব্বু ফোন দিয়েছিল,বলে না হয় আমি তোকে খাইয়ে দিতাম”

“এসবের দরকার নেই”

“দেখো ছেলের রাগ কত,মার সাথে এভাবে রেগে থাকতে হয়,দেখ তোর সব পছন্দের খাবার রান্না করেছি যেন তোর রাগটা শেষ হয়,তাও তোর রাগ কমলো না”

“তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই আম্মু”

“আচ্ছা ঠিক আছে রাগ না থাকলেই ভালো,রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে,ফারাহ যাও তো মা একটু জাহরা কে ডেকে আনো আমরাও খেয়ে নেয়”

জাবির রুমে চলে গেল,ফারাহ জাহরা কে ডেকে নিয়ে আসলো, খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে দেখলো জাবির ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারাতাড়ি দরজাটা আটকিয়ে জাবিরের সামমে গিয়ে দাড়িয়ে বললো

“আপনার সব রাগ আমার উপর তাই তো,আমার জন্য আপনি সবার কাছে বকা খেয়েছেন, তাই আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি প্লিজ মাফ করে দেন আমাকে আ’ম এক্সট্রিমলি সরি”

জাবির কিছু না বলে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লো।ফারাহ কোনোর রেসপন্স না পেয়ে বারান্দায় গেল আবার সেখানেও বার বার জাবির কে সরি বলছে কিন্তু সে কোনো কথা বলছে না।

“কি সমস্যা আপনার কথা বলছেন না কেন,ঠিক আছে মেনে নিচ্ছি আমার জন্য বকা খেয়েছেন আমাকেও একদিন সবার থেকে বকা খাইয়ে দিয়েন,তাও প্লিজ কথা বলুন”

“তোমার মনে হয় আমি বকা শুনেছি বলে তোমার সাথে রাগ করেছি,ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া যখন আমি তোমাকে যেতে না করেছিলাম তাও তুমি ওখানে গেলে আর ফিরে আসছিলে না আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল, তোমার যদি কিছু হয়ে যেত তখন আমি কি করতাম, জবাব কি ছিল আমার সবার কাছে, তখন কেউ জানতো না যে তুমি আমাকে পরিস্থিতির চাপে বিয়ে করছো আসলে এজন্যই তুমি আমার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করো না কারণ তুমি তো আমাকে নিজের স্বামীই ভাবো না”

“জাবির,আমি আপনাকে কেন নিজের স্বামী মনে করবো না হ্যা আমি একবার ভুল করে ফেলেছি, কিন্তু আমি তো ক্ষমাও চাইছি বার বার এবারের মতো ক্ষমা করে দেন আর কখনো এমন ভুল করবো না,আপনি যা বলবেন তাই শুনবো”

“ঘুমাও গিয়ে”

“আপনি বলুন আগে আমাকে ক্ষমা করেছেন”

ফারাহর চোখের কোণে পানি দেখে আর জাবির কিছু বললো না, ওর হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো,ডাক্তার যে ঔষধ দিয়েছে সেটা ফারাহর হাতে দিল।

“ডাক্তার মানুষকে যদি ধরে ধরে ঔষধ খাওয়াতে হয় তাহলে কিভাবে হবে,এখন চুপ করে ঘুমিয়ে পড়বে আর কোনো কথা নয়”

“না আপনি বলুন আগে”

“এখনি না বললে আমি যা বলবো তাই শুনবে”

ফারাহ মাথা নিচু করে চুপ করে গিয়ে শুয়ে পড়লো, জাবির মুচকি হেসে লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়লো।

#চলবে