প্রেমতরী পর্ব-০২

0
430

#প্রেমতরী
পর্ব :- ২
.
জেঠিমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিষ্টি মামুনের রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয়।
মামুনের মা দৌড়ে দরজার সামনে এসে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে।
হঠ্যাৎ ভেতর থেকে মামুনের চিৎকার শুনা যায়.
বাহির থেকে অনেক্ষন দরজা ধাক্কানোর পরও মিষ্টি দরজা খুলছিলো না।
মামুনের মা কোনো উপায় না পেয়ে মিষ্টির বাবা মাকে ডেকে আনে।
তারা সহ দরজা ধাক্কাতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মিষ্টি দরজা খুলে দেয়।
দরজা খোলার সাথে সাথে মিষ্টির বাবা মিষ্টিকে চড় দিয়ে বসে।
মিষ্টি গালে হাত দিয়ে দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে।
বাকি সবাই মামুনের কাছে দৌড়ে আসে।
মামুন বিছানায় শুয়ে আছে।
–কি হয়েছে বাবা? মিষ্টি কি করেছে? বল শুধু একবার, ওকে আজ আস্ত রাখবো না।(মিষ্টির বাবা)
–না চাচা, ও কিছু করেনি। আমি ওকে দেখে রেগে গিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছি। বুঝতে পারিনি যে আমার পা ভাঙা।
–ও আচ্ছা, এখন ঠিক আছিস?
–হ্যা চাচা, আমি ঠিক আছি।
–আচ্ছা তাহলে বিশ্রাম নে, আমরা আসি।
–আচ্ছা যাও।
মিষ্টি দরজার সামনে থেকে মামুনের কথা শুনছে।
আনমনেই মিষ্টি মুচকি হেসে ওঠে। এই ভেবে যে “মামুন চাইলেইতো অন্য কিছু বলে আজ মিষ্টিকে মার/বকা খাওয়াতে পারতো। কিন্তু সে ওমন কিছুই করেনি। তাহলে কি মামুন আমার ওপর রেগে নেই? ”
মিষ্টির মা বাবা মিষ্টিকে নিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে আসে।
মামুন সবসময় জানালার পাশে বসে সময় কাটায়।
জানালা থেকে মামুনদের পুকুর ঘাট টা ভালোভাবেই দেখা যায়।
মিষ্টি যখনই পুকুর ঘাটে আসে, মামুন জানালা বন্ধ করে দেয়।
মিষ্টি দুর থেকে তা দেখে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। একটা ভুলের কারনে আজ দুজনের মাঝে কতই না দুরত্ব তৈরী হয়েছে।
যেখানে দুজন সারাক্ষণ খুনশুটিতে মেতে থাকতো, একসঙ্গে সময় কাটাতো, সুখে-দুঃখ দুজন দুজনের পাশে থাকতো, সেখানে এখন সারাদিনে কেউ কাউকে দেখতে পায় না বললেই চলে।
মিষ্টির এখন মামুনের রুমে যাওয়া সম্পূর্ণ বারণ।
মিষ্টি মনে মনে ভেবে রাখে, যে করেই হোক তাকে মামুনের সাথে কথা বলতেই হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
রাতে মামুনের রুমের দরজা খোলাই থাকে, কেননা মামুন হাটতে পারে না, তাই দরজাও ভেতর থেকে লক করা হয় না।
মিষ্টি এই সুযোগটাই নেয়।
রাতে যখন সবাই শুয়ে পড়ে, তখন মিষ্টি মামুনের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
সময়টা তখন প্রায় মাঝরাত,,, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ।
মামুনের রুমের দরজা খুলে মিষ্টি রুমে ঢুকে পড়ে।
ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় মিষ্টি চুপিচুপি মামুনের পাশে গিয়ে দাড়ায়।
মামুন ঘুমিয়ে আছে, আর মিষ্টি হাটু গেড়ে মামুনের মাথার পাশে বসে পড়ে।
কিছুক্ষণ মামুনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
ওমনি মামুনের চোখ ছুটে আসে, হালকা চোখ মেলে তাকাতেই কাউকে নিজের মুখের সামনে দেখে মামুন ঘাবড়ে ওঠে।
চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় মিষ্টি এক হাত দিয়ে মামুনের মুখ চেপে ধরে।
–প্লিজ প্লিজ চিৎকার করিস না, এমনিতেই একটা অপরাধ মাথায় নিয়ে ঘুরছি, আর অপরাধী বানাস আমায় প্লিজ।
–তুই এতো রাতে এখানে?
–তোকে দেখতে এসেছি।
–না না, বের হ তুই, না জানি আমায় আবার কোন বিপদে ফেলতে এখানে এসেছিস।
–আমি এতোটা খারাপ?
–হুম, আমি তোকে একটুও বিশ্বাস করি না।
–মামুন(করুন চোখে মামুনের দিকে তাকিয়ে আছে)
–প্লিজ তুই বের হ এখান থেকে। কেউ যদি তোকে আমার রুমে দেখে তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে।
–আমায় ক্ষমা করে দে প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে।
–দিলাম ক্ষমা করে, যা বের হ।
–এভাবে বলছিস কেনো?
–কিভাবে বলবো তুই বল।
–সেই রাতে আমি তোকে যা বলেছিলাম তা বলা আমার একদম ঠিক হয়নি। আমি বুঝতে পারিনি এমনটা হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর, তোকে খুব ভালোবাসি। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
–তা তো নিজের চোখেই দেখলাম, ভালোবাসিস বলেই তো আমাকে সবার কাছে ছোট করতে চেয়েছিলি, চেয়েছিলি আমাকে ধর্ষনের মতো এমন জঘন্য অপরাধে ফাঁসিয়ে দিতে। এই যদি হয় তোর ভালোবাসা, তাহলে এমন ভালোবাসা আমি চাই না। আর আমি তোকে বিশ্বাস ও করি না। তুই নিজের খুশির জন্য যা খুশি করতে পারিস।
–তুই তো পারতি আমায় একটা থাপ্পড় দিয়ে সুধরে দিতে।
–তুই যখন ধর্ষনের মতো এমন অভিযোগ আমার দিকে তুলেছিলি তখনই আমি ওই অধিকার হারিয়ে ফেলেছি যে তোকে থাপ্পড় দিয়ে সুধরে দিবো।
–প্লিজ মামুন, শেষ বারের মতো আমায় ক্ষমা করে দে। আমি যে আর পারছি না। মরেই যাবো হয়তো।
–আমার সামনে ন্যাকা কান্না কাঁদিস না। তোর জন্য আমার মনটা গলবে না।
–তোর এই অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না রে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার, আর পারছি না।
–তুই যাবি এখান থেকে?
–আমায় কি কোনো ভাবে এই অপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়া যায় না? আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
–(মামুন চুপ করে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে মিষ্টি আসলেই ওর অপরাধের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু ওই যে, কাছের মানুষগুলো মনে আঘাত দিলে তা কি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়)
মিষ্টি আবার বলা শুরু করে,
–এই দেখ, তোকে ছুয়ে বলছি। তোকে ছাড়া আমি বাচতে পারবো না। মরেই যাবো আমি।
জানিস, একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় সম্বল কি? তার ইজ্জত। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে ২য় বার ভাবিনি, শুধু এটাই ভেবেছি যে তোকে আমি হারাতে পারবো না। তুই তো জানিসই, ছোটবেলা থেকে তোকে আমি মনে প্রানে ভালোবেসে এসেছি। কি করে পারতাম অন্য কাউকে বিয়ে করতে? আমার শুধু তোকেই চাই। যদি তোকে না পাই, তাহলে বেচে থেকেই বা কি করবো আমি। শেষ করে দেবো নিজেকে।
মিষ্টি কেঁদে কেঁদে একনাগাড়ে কথা গুলো বলে।
মামুন চুপচাপ মিষ্টির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, মেয়েটার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
–প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে, এ যন্ত্রনা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।(মিষ্টি হঠ্যাৎ মামুনের পায়ে ধরে বলতে শুরু করে)
–কি করছিস, ছাড়।
–আমায় ক্ষমা করে দে প্লিজ। আমায় ফিরিয়ে দিস না, আমি তোকে খুব খুব ভালোবাসি।
–দেখ মিষ্টি, তুই যা করেছিস, আমি তোকে তার জন্য ক্ষমা করে দিতে পারবো ঠিকই, কিন্তু তোকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে পারবো না।
–আমি কি ভালোবাসার যোগ্য না?
–তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তাছাড়া আমি তোকে কখনো ভালোবাসি নি, বাসবো ও না। কারন ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, তুই একটা সার্থপর মেয়ে, নিজের সার্থের জন্য তুই সব করতে পারিস। আর এতে কার কি হলো না হলো তাতে তোর কিছু যায় আসে না। যেমনটা সেই রাতে তুই আমার সাথে করেছিস। আমি চাই না এমন কাউকে আমার জীবনের সাথে জড়াতে।
–হ্যা আমি সার্থপর, শুধু তোকে নিয়ে আমি সার্থপর। তুই শুধু আমার, কেনো তোকে আমি হারিয়ে ফেলবো? মন থেকে, এই মন থেকেই তোকে আমি চাই। একটা বার আমায় সুযোগ দিয়ে দেখ, আমি পুরোপুরি নিজেকে বদলে ফেলবো। তুই যেভাবে চাইবি, আমি সেভাবেই চলবো। কখনো আমার দিকে ২য় বার আঙুল তুলে কথা বলবি এরকম কোনো কারন খুজে পাবি না। শুধু একটা বার আমায় এই সুযোগটা দে।
বাম হাতটা মাথার নিচে দিয়ে মামুন উপরে তাকিয়ে আছে। মিষ্টিকে কি উত্তর দেবে সেটাই ও খুজে পাচ্ছে না। মিষ্টি ছোটবেলা থেকেই মামুনের জন্য পাগল, তবে এতোটা পাগল তা মামুন কখনো কল্পনাও করে নি।
মিষ্টি ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়।
–কিছু বলবি না?
–আমি জানি না আমার কি বলা উচিত। আমাকে একটু সময় দে,
–তুই কি আমায় ভালোবাসিস না?
–জানি না।
–শেষবরের মতো আমায় বিশ্বাস করে দেখ, তোকে আমি মাথায় করে রাখবো। এতোটা ভালোবাসবো যে তুই আমাকে ছাড়া একটা মূহুর্তও কাটাতে পারবি না।
–মিষ্টি, এখন ঘরে যা, এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো।
–আমায় ক্ষমা করে দিয়েছিস?
–হুম। যা ঘরে যা।
ওমনি মিষ্টি মামুনকে জড়িয়ে ধরে।
–কি করছিস, ছাড়।
–না, তুই জানিস না, তুই আমার বুকের ওপর থেকে কত বড় একটা পাথর নামিয়ে দিয়েছিস। আমার মনে হচ্ছে আমি অনেকটা হালকা হয়ে গেছি।
–ছাড় না, কেউ চলে আসবে।
–এত রাতে কেউ আসবে না, সবাই ঘুমাচ্ছে।
–তবুও ছাড়।
–না, অনেক কষ্ট দিয়েছিস আমাকে, অনেক কাঁদিয়েছিস। কত দিন ধরে আমি ঘুমাই না, আজ তোর বুকে ঘুমাবো।
–আমি কিন্তু এখন আম্মুরে ডাক দিমু।
–এই না না, যাচ্ছি।
–যা….
মিষ্টি আলতো করে মামুনের কপালে একটা চুমু দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
নিজ বিছানায় মিষ্টি এপাশ ওপাশ করছে।
এতদিন একটা অপরাধবোধ তাকে ঘুমাতে দেয়নি, আর আজ খুশিতেই তার ঘুম আসছে না।
পরদিন সকালে মিষ্টি জেঠিমার কাছে যায়,
–জেঠিমা….
–কি?
–জানো, মামুন আমায় ক্ষমা করে দিয়েছে।
–তো?
–এবার তোমার পালা।
–কি আমার পালা?
–আমাকে ক্ষমা করে দাও।
–কাজের সময় বিরক্ত করিস নাতো, যা এখান থেকে।
–ও জেঠিমা, আমায় ক্ষমা করে দাও না।(জেঠিমার আচল ধরে বাচ্চাদের মতো করে)
–শোন মিষ্টি, তুই যেদিন কাঁদতে কাঁদতে আমাকে সবকিছু খুলে বলেছিলি, সেদিনই আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তুই তো আমার মেয়ের মতোই, ছোট বেলা থেকে আমিই তো তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি জানি আমার মেয়ে কি করতে পারে আর কি করতে পারে না। তোর দ্বারা একটা ভুল হয়ে গেছে, তার জন্য আমি রেগে নেই।
–সত্যি বলছো জেঠিমা?
–হুম সত্যি। তবে আমি তোকে একটা অনুরোধ করতে চাই।
–হ্যা বলো না।
–তুই মামুনের সাথে মেলামেশা করিস না।
–কি বলছো এসব?
–আমি ঠিকই বলছি। আর কিছুদিন পরই তোর বিয়ে হয়ে যাবে। এখন মামুনের সাথে তোর এভাবে মেলামেশা করা কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
–এই বিয়েটা ভেঙে দাও না জেঠিমা।
–সম্ভব না, তোদের কাবিন হয়ে গেছে। এখন এই বিয়ে ভাঙতে গেলে ছেলে পক্ষ তোর বাবার নামে মামলা করে দেবে।
–কি বলছো এসব? আমি তো জানিই না আমার কাবিন কখন হলো।
–আর ১২ দিন পর ছেলে দেশে আসবে, সামনের মাসেই তোর বিয়ে।
–আচ্ছা, আমিও দেখতে চাই আমার বিয়ে কেমনে হয়।
–একদম পাগলামো করবি না। এখানে দুটো পরিবার জড়িয়ে আছে।
–আমার সুখের কথা তারা কেউ ভাবে না, আসুক ওই ছেলে, দেখো আমি ওর কি হাল করি, দেখবে নিজে থেকেই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। তখনতো আর বাবার নামে মামলা করতে পারবে না।
–কি বলছিস এসব তুই?
–তুমি শুধু এটা বলো, আমি মামুনের কাছে গেলে তোমার কোনো সমস্যা হবে?
–কেনো যাবি ওর কাছে?
–ওর সেবা করতে, আমার জন্যই তো ওর এই অবস্থা, আমি চাই ওর সেবা করে ওকে সুস্থ করে তুলতে।
–ওকে দেখে রাখার জন্য ওর মা এখনো বেচে আছে, আপনাকে এত কষ্ট করতে হবে না।
–প্লিজ জেঠিমা, এমন করো কেনো?
জেঠিমা আর কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে।
মিষ্টি নাচতে নাচতে মামুনের ঘরে এসে হাজির, আজ জেঠিমাও কিছু বললো না।
মিষ্টির সাহস যেনো আরো বেড়ে গেলো।
মামুন এখনো ঘুমিয়ে আছে।
মিষ্টি ধীরেধীরে জানালা খুলে দেয়, বাহিরের আলোয় মামুনের ঘুম ভেঙে যায়।
মিষ্টিকে প্রথমে নিজের রুমে দেখে মামুন ঘাবড়ে যায়, এত সকাল সকাল মিষ্টি এখানে কি করে এলো।
বাহিরে আলো ফুটে গেছে, এমন নয় যে মিষ্টি এখানে লুকিয়ে আসতে পারবে। তাহলে ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই।
মামুন কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
মিষ্টি এখন প্রায় সময় মামুনের রুমে আসে, ওর সেবা করে,
.
.
.
চলবে……….
.
লেখক :- #A_Al_Mamun