ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৩

0
216

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৩]

রুহিয়া মুচকি হাসে।অন্তিক ভ্রুযুগল কুঁচকে ফেলে।অধর কোণে হাসির রেখা উপস্থিত রেখে রুহিয়া মৃদু স্বরে বলে,
‘আমাকে তো আসতেই হতো।যতোই হোক এটা তো আমার শ্বশুড়বাড়ি।তাছাড়া আমার স্বামী-সন্তান যেখানে আছে আমার‌ও তো সেখানেই থাকা উচিত।কি মিস্টার অন্তিক শাফায়াত আমি ঠিক বলছি তো?’

‘শাট আপ,জাস্ট শাট আপ।অনেক বলে ফেলেছো তুমি।আর একটা কথাও শোনার ইচ্ছে নেই আমার।এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে।’

উচ্চ স্বরে রুহিয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাখানা বললো অন্তিক।বিনিময়ে রমণী একটুও ভড়কে গেলো না।বরং অন্তিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ভাষায় বললো,
‘যাবার জন্য আসি নি তো।এই বাড়িতে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার‌।তাছাড়া আমি ভুল তো কিছু বলি নি সানফি আমার মেয়ে,আমি মা ওর।ও যেখানে থাকবে সেখানে আমিও থাকবো বুঝতে পেরেছেন?’

ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পুরুষটির রাগের মাত্রা।মুখমন্ডল,চক্ষুদ্বয় সব যেনো র ক্তি ম আভায় ছেয়ে যাচ্ছে।ললাটের রগগুলো দপদপ করছে,এই বুঝি বেরিয়ে আসবে।দু হাতের মুঠো শ’ক্ত করে ক্রোধ কমানোর চেষ্টা করে অন্তিক।মিসেস সাবিনা এক কদম এগিয়ে এসে বলেন,
‘ব‌উমা তো ঠিকই বলেছে অন্তিক।রুহিয়া কিন্তু এখনো তোর স্ত্রী,আর ওর এখানে থাকার অধিকার আছে।তুই ওকে এভাবে বলতে পারিস না।রুহিয়া মা তুমি এখানেই থাকবে।আবার আমার সংসারটা আগের মতো হয়ে যাবে।’

কথাখানা বলে মিসেস সাবিনা মুচকি হাসলেন।রুহিয়া হাসিমুখে উনার নিকটস্থ হলো।অন্তিক আর একমুহুর্ত স্হির না থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো।অতুল‌ও ছুটলো তার পিছুপিছু।গুঞ্জনের অধর কোণে হাসির রেখা চ‌ওড়া হলো।এত কিছুর মাঝে সানফির কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিলো।সানফি এখন রুহিয়ার কাছে গিয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি আমার মা?আমার নিজের মা তুমি?’

অন্তঃকরণ কম্পিত হলো।চোখের কোণে দেখা দিলো জলের আনাগোনা।অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে উপর-নিচ মাথা নাড়লো রুহিয়া।তৎক্ষণাৎ সানফি জড়িয়ে ধরলো রুহিয়াকে।পরম মমতায় জননী কাছে টেনে নিলো নিজ সন্তানকে।চুমুতে ভরিয়ে দিলো সানফির ছোট্ট মুখশ্রী।কান্নাভেজা গলায় বললো,
‘হ্যাঁ সোনা আমি‌ই তোমার মা।’

অস্ফুট স্বরে সানফি ডেকে ওঠে ‘মা’ বলে।রমণীর কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা নোনাজল।অধর কোণে দৃশ্যমান হয় প্রাপ্তির হাসি।পুনশ্চ সে আগলে নেয় মেয়েকে।সানফি আধো আধো স্বরে বলে,
‘আমায় কখনো ছে ড়ে যাবে না তো মা?প্রমিস করো আমায় কখনো ছে ড়ে যাবে না।’

রুহিয়া সানফির হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলে,
‘আমি তোমাকে ছে ড়ে কোথাও যাবো না সোনা প্রমিস।’

ছোট্ট মুখশ্রীতে হাসির রেখা ঝিলিক দিয়ে ওঠে।মা’কে এতদিন পর কাছে পেয়ে সানফির আনন্দের সীমা নেই।সে মা’কে নিয়ে গল্প করতেই ব্যস্ত।পক্ষান্তরে রুহিয়াও ব্যস্ত মেয়েকে আদর করতে।
______________________________
নিকষকৃষ্ণ রজনী।চারদিকে কালচে আঁধার।অন্তরীক্ষের ঝকঝকে চাঁদখানা জোর কদমে লেগেছে আঁধার দূরীকরণে।রূপালী রাঙা চাঁদের সহিত যোগ দিয়েছে তারকারাজিও।বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে পাশাপাশি বসে রয়েছে গুঞ্জন ও অতুল।গুঞ্জনের মুখশ্রীতে খানিক চিন্তার ছাপ।বিষয়খানা নজর এড়ায় না অতুলের।সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গুঞ্জনের বদনপানে।কিঞ্চিত নীরব রয় গুঞ্জন,পরক্ষণেই কৌতুহলী কন্ঠে শুধায়,
‘আচ্ছা অতুল,অন্তিক ভাইয়া আর ভাবির মধ্যে কি হয়েছিলো?কেনো ওরা এতদিন দূরে ছিলো?’

একখানা দীর্ঘ শ্বা’স ছাড়ে অতুল।গুঞ্জন নির্নিমেষ তাকায় অতুলের মুখপানে।অতুল মৃদু স্বরে বলতে আরম্ভ করে,
‘শুরু থেকে বলি।ভাইয়া মেজো খালামনির মেয়ে তানি আপুকে ভালোবাসতো।কিন্তু তানি আপু শুধুই ভাইয়াকে ইউজ করেছে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য,সে ভাইয়াকে ঠকিয়ে বিদেশ চলে যায়।ভাইয়া তখন ভীষণভাবে ভে’ঙে পড়েছিলো।ঠিক সেই সময় বাবার জোড়াজুড়িতে ভাইয়া ভাবিকে বিয়ে করে।বোঝোই তো তখন ভাইয়ার মন-মানসিকতা ভালো ছিল না।তাই অ্যাজ ইউজুয়াল সে ভাবিকে ইগনোর করতো,মাঝেমধ্যে রাগারাগিও করতো।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যায়।ওদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।ভাইয়া ভীষণ ভালোবাসতো ভাবিকে আর ভাবিও ঠিক তাই।বেশ সুখে শান্তিতেই সময়গুলো যাচ্ছিল,ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীর দুমাস পরেই সানফির জন্ম হয়।মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ার আনন্দের সীমা ছিল না।সানফির বয়স তখন সাতদিন,আমি,ভাইয়া আর বাবা সেদিন অফিসে ছিলাম।মা গিয়েছিলো খালামণির বাসায়।ভাবি বাসায় একা ছিলো।পরেরদিন ছিলো সানফির নামকরণের অনুষ্ঠান।কাজ করতে করতে হঠাৎ ভাইয়া বাসায় চলে যায় আর তারপরেই আমরা এসে দেখি ভাবি বাসা থেকে চলে গিয়েছে।কিন্তু ওদের মধ্যে ঠিক কি হয়েছিলো সেটা এখনো কেউই জানে না।’

কথাগুলো বলে হতাশ ভঙ্গিতে উঠে বসে অতুল।গুঞ্জন মৃদু স্বরে বলে,
‘আমাদের কিছু একটা করতে হবে অতুল।অন্তত সানফির জন্যে হলেও।’

অতুল উপর-নিচ মাথা নাড়ায়।গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আশ্বাসস্বরূপ বলে,
‘হুম গুঞ্জন।ভাইয়া-ভাবিকে এক করতেই হবে।’
________________________________
শুনসান রাস্তার দুধারে জ্ব ল ছে সোডিয়ামের হলুদ বাতি।ক্ষণে ক্ষণে শো শো শব্দে যাচ্ছে দু-একটা গাড়ি।গাছের পল্লবরাশি হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে।বাতাবরণে শীতল ভাব,স্পর্শ করছে জানালার নিকট দন্ডায়মান রমণীর শ’রী’র।রমণীর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তার দৃষ্টি স্হির দূর অন্তরীক্ষের শশীর পানে।নীরব,নিস্তব্ধ কক্ষে শুধু বিদ্যমান ঘড়ির কাঁ’টা’র টিক টিক আওয়াজ।মাত্র‌ই দেয়াল ঘড়িখানা পৌনে বারোটার ঘর অতিক্রম করলো।

ক্লান্ত,রুক্ষ শ’রী’র নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে প্রবেশ করলো অন্তিক।অভ্যন্তরে এসে ব্লেজারটা বিছানার ওপর রেখে ফ্যানের সুইচখানা অন করে দিলো।তৎপর টান হয়ে বিছানায় বসলো সে।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শ’রী’রখানা।কক্ষে কারো উপস্হিতি টের পেয়ে পশ্চাতে ঘুরলো রুহিয়া।শশাঙ্কের রুপালী আলো জানালার গ্রিল বেয়ে অবস্হান নিচ্ছে কক্ষে,আলোকিত হচ্ছে অন্ধকার কক্ষখানা।চাঁদের আলোয় রুহিয়ার আবছা অবয়ব দর্শন মাত্র‌ই ভূ ত দেখার মতো চমকে উঠলো অন্তিক।লহমায় উঠে দাঁড়িয়ে লাইট অন করলো সে।খানিকটা বিস্ময়ের স্বরেই ব্যক্ত করলো,
‘তুমি!তুমি আমার ঘরে কি করছো?’

শেষোক্ত কথাটা কিঞ্চিত ক্রোধমিশ্রিত স্বরেই বলে অন্তিক।বিনিময়ে ঠোঁট প্রসারিত করে রুহিয়া।ভ্রুযুগল নাচিয়ে স্বগতোক্তি করে,
‘বাহ রে স্বামীর ঘরে স্ত্রী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।দেখো আমি তোমাকে অতো আপনি আজ্ঞে করতে পারবো না,আগে তুমি বলতাম এখনো তাই বলছি।এটা তোমার ঘর সো এখানে থাকার অধিকার আমার আছে।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে অন্তিক।রুহিয়া অবুঝের ন্যায় তাকায়।অন্তিক অধর কোণে হাসির রেখা বজায় রেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
‘অধিকার,এতদিন পর মনে পড়লো অধিকারের কথা!সো ফানি ইয়ার।’

কিঞ্চিত মনক্ষুণ্ণ হয় রুহিয়া।তবে সেটাকে প্রাধান্য না দিয়ে সে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
‘অতীত তো অতীত-ই।অতীতের কথা টেনে এনে বর্তমানকে নষ্ট করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।যাই হোক তুমি ফ্রেশ হ‌ও,আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।’

বাক্যদ্বয় বলে রুহিয়া প্রস্হানের জন্য পা বাড়ালো।অন্তিক পেছন থেকে বলে উঠলো,
‘এক মিনিট।’

স্হির হলো রুহিয়ার পা জোড়া।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে।অন্তিক পুনশ্চ শান্ত স্বরে বললো,
‘তোমার এ ঘরে থাকতে হয় তো থাকো।আমি‌ এ ঘরে থাকবো না।আর হ্যাঁ আমার জন্য তোমাকে দরদ‌ও দেখাতে হবে না।’

এটুকু ব্যক্ত করেই অন্তিক দ্রুতপায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো।রুহিয়া হতাশ হলো খানিক।ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে কিয়ৎক্ষণ সেথায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে র‌ইলো।
_________________________
গেস্টরুমে এসে মাত্র ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে অন্তিক।তন্মধ্যে রুহিয়ার আগমন সেথায়।খাবারের প্লেট ও পানির গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলে রেখে রুহিয়া মৃদু স্বরে বলে,
‘খেয়ে নেও।’

কাঁচ ভা ঙা র তী ব্র ঝনঝন আওয়াজ।ভ য়ে কেঁ’পে উঠলো রমণী।বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো মেঝেতে পড়ে থাকা প্লেট ও গ্লাসের খ’ন্ডাং’শসমূহের পানে।দীর্ঘদেহী পুরুষটি চোয়ালদ্বয় শ’ক্ত করে দাঁতে দাঁত চে পে ক্রো ধিত স্বরে বললো,
‘বলেছিলাম না আমায় দরদ দেখাতে হবে না।বেরিয়ে যাও এক্ষুনি।এইসব নিয়ে বেরিয়ে যাও এই ঘর থেকে।’

ক্রোধান্বিত পুরুষটির উচ্চ স্বর শ্রবণ হতেই ফের বাক্য বিনিময় করার সাহস হয় না রমণীর।চুপচাপ বিষণ্ণ বদনে সে কাঁচের ভা ঙা টুকরোগুলো তুলতে আরম্ভ।দৈবাৎ অসাবধানতাবশত এক টুকরো কাঁচ বিঁ ধে যায় রুহিয়ার হাতের আঙুলে।ব্য থার দরুণ কঁকিয়ে ওঠে সে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও আঁখি হতে বের হয় নোনাজল।তৎক্ষণাৎ অন্তিক ছুটে যায় রমণীর নিকট।হাঁটু গেড়ে বসে রুহিয়ার হাতখানা ধরে অন্তিক উ’দ্বি’গ্ন কন্ঠে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো?উফ্ হো একটা কাজ‌ও তুমি ঠিকভাবে করতে পারো না।কতখানি কে টে গিয়েছে!’

চলবে