ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৪

0
214

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৪]

হাঁটু গেড়ে বসে রুহিয়ার হাতখানা ধরে অন্তিক উ’দ্বি’গ্ন কন্ঠে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো?উফ্ হো একটা কাজ‌ও তুমি ঠিকভাবে করতে পারো না।কতখানি কে টে গিয়েছে!’

নিষ্পলক তাকালো রমণী পুরুষটির আননপানে।তার মুখশ্রীতে এখন উ দ্বি গ্নতার ছাপ।রুহিয়া লম্বা শ্বা স নেয়।মলিন মুখে বলে,
‘আমি ঠিক আছি।সামান্য হাত‌ই তো কে টে গিয়েছে।অতো ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই।’

ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকায় অন্তিক।ধম কের সুরে বলে,
‘তুমি কি রোবট?এটাকে সামান্য বলছো!র ক্ত বেরিয়েছে কতটা দেখেছো!’

রুহিয়া মৃদু হেসে বলে,
‘যাকে সহ্য‌ই করতে পারছো না তার জন্য এতো চিন্তা একদম‌ই করা উচিত নয়।আমি নিজেরটা ঠিক করে নিতে পারবো।’

মুহুর্তেই রুহিয়ার হাত ছেড়ে দিলো অন্তিক।রুহিয়ার নিকট হতে সরে এসে বিছানায় বসে পড়লো সে।রুহিয়া ভা ঙা টুকরোগুলো তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্হান করলো।আড়চোখে তার যাওয়ার পথের দিকে একবার তাকালো অন্তিক।পর মুহুর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে দূর অন্তরীক্ষে নিবদ্ধ করে স্বগতোক্তি করলো,
‘আমি খুব করে চাই তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলোর মৃ ত্যু হোক।কিন্তু আমি পারি না।আমার মন-মস্তিষ্ক কোনো কিছু হতেই তোমাকে সরাতে পারি না।যত বেশি চাই ভুলে যেতে ততোই যেনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাই।প্রতিটাদিন‌-ই মনগহীনে তোমার জন্য নতুন নতুন অনুভূতি জন্মায়।হাজার চেষ্টা করলেও কোনোকিছুই আট কানো সম্ভবপর হয় না।’
___________________________________
নিশীথের আঁধার সরে গিয়ে ধরিত্রীতে দেখা মিলেছে প্রভাতের।শশাঙ্ক লুকিয়ে গিয়ে সুবিশাল নীলিমায় এখন রবির আধিপত্য।হলদেটে দীপ্তিতে দীপ্তিময় ভুবন।গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির কলরব।তন্দ্রা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়েছে অন্তিক।হাত ঘড়িটা পরতে পরতে পদচারণা করলো সানফির কক্ষের উদ্দেশ্যে।কক্ষের অভ্যন্তরে পা রাখা মাত্র‌ই অন্তিকের নজর গেলো বিছানার ওপর।লক্ষী মেয়ের মতো স্কুল ড্রেস পরে বিছানায় বসে আছে সানফি।রুহিয়া তার চুলগুলো দু’পাশে বিনুনি করছে।অন্তিক কপাল কুঁচকালো।পরক্ষণেই মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘বেবি আর ইউ রেডি?স্কুলে যেতে হবে তো।’

সানফি মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ইয়েস বাবা আমি একদম রেডি।কিন্তু আমি আজ মায়ের সাথে স্কুলে যাবো।তুমি বরং অফিস চলে যাও।’

বাক্যদ্বয় বলে সানফি রুহিয়াকে জড়িয়ে ধরে।মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেয় রমণী।অন্তিক সরু দৃষ্টিতে তাকায় রুহিয়ার দিকে।রুহিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নেয়।ফের বাক্য বিনিময় না করে দ্রুত পায়ে প্রস্হান করে অন্তিক।রুহিয়াও চুল বিনুনি করা সমাপ্ত করে সানফির স্কুল ব্যাগখানা নিয়ে কক্ষ হতে বাইরে আসে।বসার ঘরে চায়ের কাপ হাতে বসে রয়েছেন মিসেস সাবিনা এবং শামীম আহমেদ।অনতি দূরেই ডাইনিং টেবিলে সকালের নাস্তা করছে অতুল ও অন্তিক।গুঞ্জন তাদের খাবার এগিয়ে দিচ্ছে।রুহিয়া সেথায় গিয়ে সানফিকে চেয়ার টেনে বসায়।গুঞ্জন রুহিয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
‘ভাবি সানফির জন্য যে ব্রেকফাস্ট বানিয়েছো ওটা এনে দেবো?’

‘হুম গুঞ্জন একটু কষ্ট করে এনে দাও না বোন।’

গুঞ্জন মুচকি হেসে কিচেন থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।সানফি বিস্মিত চিত্তে বললো,
‘আলু পরোটা আমার জন্য!আলু পরোটা আমার খুব ভালো লাগে।থ্যাংক ইউ মা।’

প্রসন্ন হেসে সানফির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রুহিয়া।গুঞ্জন আর অতুলও মুচকি হাসে।অন্তিক রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠে,
‘সানফি তোমার তো গ্যা স্ট্রিকের স ম স্যা।এসব তেল জাতীয় খাবার তোমার খাওয়া হবে না।তুমি এগ আর ব্রেড খাবে।’

লহমায় মলিন হয়ে গেলো সানফির ক্ষীণ মুখশ্রী।ছোট ছোট চোখ করে গাল ফুলিয়ে সে বললো,
‘মা দেখো না বাবা কি বলছে,আমি আলু পরোটা খাবো।প্রতিদিন আমার এগ,ব্রেড খেতে ভালো লাগে না।’

রুহিয়া মুচকি হেসে সানফির গাল স্পর্শ করে।নমনীয় স্বরে বলে,
‘সোনা তোমার বাবাকে বলে দাও একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।তাছাড়া আমি এতো বেশি তেল দেই নি যে তোমার সমস্যা হবে,খুব অল্প তেল দিয়েছি।’

‘ইয়েহ কি মজা আমি আলু পরোটা খাবো।’

ফের ছোট্ট মুখশ্রীতে দৃশ্যমান হয় খুশির প্রদীপ।অন্তিক আড়চোখে একবার তাকায় রুহিয়ার বদনপানে তবে বাক্য বাড়ায় না।রুহিয়া পরম যত্নে মেয়েকে খাইয়ে দেয়।তৎপর ডাইনিং টেবিল হতে উঠে স্কুলে যাবার উদ্দেশ্যে বসার ঘরের দিকে পদচারণা করে।মিসেস সাবিনা জিজ্ঞেস করেন,
‘ব‌উমা তুমি নিয়ে যাচ্ছো সানফিকে?’

‘হ্যাঁ মা আসলে আমিও তো স্কুলে চাকরি করি,আমার‌ও ক্লাস আছে।তাই ভাবলাম ওকে আমি‌ই নিয়ে যাই।’

মিসেস সাবিনা সম্মতি দিয়ে বলেন,
‘আচ্ছা মা নিয়ে যাও।তা কিভাবে যাবে তোমরা?’

‘রিকশা,রিকশা করে যাবো মা।’

মৃদু স্বরে কথাখানা বললো রুহিয়া।চটজলদি মুখ তুলে তাকালেন শামীম আহমেদ।স্নিগ্ধ কন্ঠে বললেন,
‘সে কী!গাড়ি থাকতে তোমরা রিকশায় কেনো যাবে?অন্তিক তুমি তো অফিস যাচ্ছো,যাওয়ার পথে ব‌উমা আর দিদিভাইকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যেও।’

রুহিয়া ডানে-বামে মাথা নেড়ে বললো,
‘না না বাবা তার কোনো দরকার নেই,আমরা যেতে পারবো।’

শামীম আহমেদ শুনলেন না।উনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
‘উহু অন্তিক তুমি ওদের নিয়ে যাও।’

বাবার কথা ফেলতে পারলো না অন্তিক।বাধ্য হয়ে রাজি হলো সে।রুহিয়াও শামীম আহমেদের আদেশ অমান্য করতে সক্ষম হলো না।অন্তিক রুহিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে সানফিকে বললো,
‘সানফি আমার হাতে সময় নেই।তাড়াতাড়ি এসো।’

কথার ইতি টেনে অন্তিক সম্মুখে ঘুরে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।রুহিয়াও সবার থেকে বি দায় নিয়ে সানফির হাত ধরে সম্মুখে অগ্রসর হলো।
________________________________
মসজিদের মিনারে মিনারে ধ্বনিত হচ্ছে মাগরিবের আজান।পাখপাখালির আপন নীড়ে ফেরার অবাধ গুঞ্জন।সূর্য প্রায় ডুবন্ত।লালিমা ছেয়েছে বিস্তর গগণে।ঝুমঝুমি এক সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি।বারান্দায় আনমনে দাঁড়িয়ে রমণী।আজানের সমধুর ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র‌ই ধ্যান ভা’ঙলো তার।অবিলম্বে কক্ষে ফেরত এসে অজু করে নিলো সে।তৎপর মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে আরম্ভ করলো।

নামাজ আদায় শে ষে রান্নাঘরে আসে রুহিয়া।চুলা জ্বা’লিয়ে ঝটপট চা বানায় সকলের জন্য।মিসেস সাবিনা,গুঞ্জন এবং অতুলকে চা দিয়ে ফের রান্নাঘরে আসে সে।একখানা পাত্রে দুধ দিয়ে চুলায় বসায়।আরেকখানা পাত্রে পোলাওয়ের চাল ধুয়ে রাখে।গুঞ্জন সেথায় উপস্হিত হয়ে কৌতুহলী কন্ঠে বলে,
‘পায়েস রাঁধবে ভাবি?’

রুহিয়া এক গাল হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ গো।সানফি তো পায়েস পছন্দ করে ওর জন্য‌ই বানাচ্ছি।’

‘হুম সানফি তো পায়েস ভীষণ পছন্দ করে।আমি তোমায় একটু হেল্প করি ভাবি?’

‘না বোন তুমি সারাদিন এমনিতেই অনেক খাটুনি করো,তুমি বরং গিয়ে একটু বিশ্রাম করো।আমার দেবর সাহেবকেও একটু সময় দাও বুঝলে।’

কথাখানা বলে মুখ টিপে হাসলো রুহিয়া।গুঞ্জন কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে প্রস্হান করলো।রমণী পুনরপি মনোনিবেশ করলো আপন কাজে।
_________________________________
ঝকঝকে একখানা থালার মতো চাঁদ উঠেছে অম্বরে।চাঁদের রুপালি,স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত নগরী।বিস্তৃত অম্বরে অজস্র তারকারাজির মেলা বসেছে যেনো।বিছানার ওপর পিজরাপোলের আসামির ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব‌ই-খাতা।পাশেই সানফি বারবি ডল নিয়ে খেলা করছে।পায়েসের বাটি হাতে মেয়ের কক্ষে উপস্হিত হয় রুহিয়া।কারো উপস্হিতি টের পেয়ে মুখ তুলে তাকায় সানফি।রুহিয়ার হাতে পায়েসের বাটি দর্শন হতেই তার চোখেমুখে দৃশ্যমান হয় খুশির রেশ।পুলকিত স্বরে সে বলে,
‘পায়েস!!’

প্রসারিত হয় রমণীর ওষ্ঠ।সানফির পাশে বসতে বসতে সে বলে,
‘হুম সোনা আমি তোমার জন্য বানিয়েছি।এসো খাবে।’

হাতের পুতুলখানা রেখে মায়ের নিকট এগিয়ে এলো সানফি।রুহিয়া মুচকি হেসে মেয়েকে খাওয়াতে আরম্ভ করলো।খাওয়া শে ষে পরম যত্নে নিজ ওড়না দিয়ে সানফির মুখ মুছিয়ে দিলো।সানফি হাসিমুখে বললো,
‘খুব মজা ছিলো মা।’

রুহিয়া প্রাপ্তির হাসি দিয়ে বলে,
‘তাই তাহলে আরেকদিন বানিয়ে দেবো।তুমি তো হোম‌ওয়ার্ক করো নি সোনা!হোম‌ওয়ার্কটা করতে হবে তো।’

‘হুম আমি এক্ষুনি করছি।’

বাক্যদ্বয় বলেই পেন্সিল,খাতা নিয়ে লিখতে বসে সানফি।রুহিয়া স্বস্তি পেয়ে ধীর পায়ে কক্ষ ত্যাগ করে।রান্নাঘরে বাটিটা রেখে হাত ধুয়ে অন্তিকের ঘরে আসে সে।দেয়াল ঘড়িতে সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা।অন্তিকের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়।চটজলদি রুহিয়া ঘরখানা সুন্দরভাবে গুছিয়ে ফেললো।ঠিক তখন‌ই শুনতে পেলো মিসেস সাবিনা এবং গুঞ্জনের চেঁচা মেচি।রমণীর বোধগম্য হতে একটুও সময় লাগলো না যে আওয়াজটা সানফির ঘর হতেই আসছে।তৎক্ষণাৎ ধুক করে অন্তঃকরণ কেঁ পে উঠলো রমণীর,কাল বিলম্ব না করে সে দ্রুততার সহিত বেরিয়ে এলো।বিছানায় অচে তন অবস্থায় পড়ে আছে সানফি।গুঞ্জন হাত ধরে ডাকছে তাকে।মিসেস সাবিনা‌ও ডাকাডাকি করছেন কিন্তু সানফির জ্ঞা’ন নেই।মেয়ের এমন অবস্থা দেখে রুহিয়া ছুটে আসে।তাকে দেখে গুঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ভাবি দেখো না সানফি সাড়া দিচ্ছে না।’

লহমায় জলে ভরে গেলো রমণীর চক্ষুদ্বয়।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠলো,
‘সানফি সোনা কি হয়েছে তোমার?সাড়া দাও সোনা,মা ডাকছে তো তোমায়।’

চলবে🧡