ভালোবাসার ব্যাকরণ পর্ব-০৫

0
221

#ভালোবাসার_ব্যাকরণ💖
#লেখনীতে_মাইসারাহ_আরোহি🌸
[পর্ব ০৫]

লহমায় জলে ভরে গেলো রমণীর চক্ষুদ্বয়।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠলো,
‘সানফি সোনা কি হয়েছে তোমার?সাড়া দাও সোনা,মা ডাকছে তো তোমায়।’

তবুও সাড়া নেই সানফির।সে পূর্বের ন্যায় চোখ বুঁজে রয়েছে।সানফির ফর্সা গায়ে ছোট ছোট লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে।রুহিয়া ধপ করে বসে পড়ে সানফির মাথার কাছে।চোখের জল বাঁধ মানছে না কারোর‌ই।শামীম আহমেদ সান্ত্বনা সূচক বলেন,
‘আহ তোমরা এভাবে কান্নাকাটি কোরো না।অতুল ডাক্তারকে আনতে গিয়েছে তো,তাছাড়া আমি অন্তিককেও ফোন করেছি।ও চলে আসবে,দিদিভাই ঠিক হয়ে যাবে তোমরা চিন্তা কোরো না।’

শামীম আহমেদের কথা শেষ হতেই অতুল ডাক্তার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে।গুঞ্জন ডাক্তারকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দেয়।ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করেন সানফিকে।এর‌ই মাঝে অন্তিক‌ও চলে আসে।সে ডাক্তারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে উ দ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
‘ডাক্তার কি হয়েছে আমার মেয়ের?‌ও ঠিক হয়ে যাবে তো?’

‘আসলে এলা র্জির কারণে এমন হয়েছে।ও এমন কিছু খেয়েছে যেটাতে ওর এলা র্জি আছে,সেজন্য‌ই শরীরে লালচে দাগ ফুটে উঠেছে।তাছাড়া ওর তো শ্বা সক ষ্টের সমস্যা,শরীরে জ্ব র‌ও দেখছি হালকা।এ কারণেই জ্ঞা’ন হারিয়েছে।তবে চিন্তা নেই ইন জেক শন দিচ্ছি,কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞা’ন ফিরে আসবে।’

ডাক্তার একটা ইন জেক শন পুশ করে দিয়ে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন।প্রেসক্রি পশনটা অতুলকে দিয়ে বললেন,
‘এই ওষুধগুলো আনিয়ে নিবেন।’

‘ঠিক আছে ডক্টর আপনি আমার সাথে আসুন।’

অতুল ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে যায়।অন্তিক রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠে,
‘সানফিকে কি এমন খাবার দেয়া হয়েছে যার জন্য ওর এই অবস্থা হলো?কি খেয়েছে ও?’

মিসেস সাবিনা তৎক্ষণাৎ বলেন,
‘সানফি তো পায়েস খেয়েছে,ব‌উমা ওর জন্য পায়েস রেঁধেছিলো।ব‌উমা তুমি আবার ভুল করে পায়েসে কিসমিস দাও নি তো?কিসমিসে তো সানফির এ লার্জি।’

লহমায় রাগ যেনো অন্তিকের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।রুহিয়াকে কোনোকিছু বলার সুযোগ দিয়েই অন্তিক তাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো।ক্রমশ বাড়ছে পুরুষটির রাগের মাত্রা।চক্ষুদ্বয় দিয়ে যেনো আ গুনের ফুলকি বের হচ্ছে,দপদপ করছে ললাটের রগগুলো‌। দাঁতে দাঁত চেপে অন্তিক বললো,
‘বলেছিলাম না আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবে।তারপরেও কেনো তুমি এসেছো ওর কাছে?এসব করার জন্য এসেছো?’

আ’হত দৃষ্টিতে তাকালো রুহিয়া অন্তিকের দিকে।মৃদু স্বরে বললো,
‘তুমি ভুল বুঝছো।আমি কিছু করি নি।’

পুরুষটির রাগ এবারে দ্বিগুণ হলো।পূর্বের চেয়ে উচ্চস্বরে সে বললো,
‘কিছু করো নি মানে তোমার জন্য‌ই আমার মেয়ের এই অবস্থা।কে বলেছিল ওকে পায়েস দিতে?দরদ দেখাচ্ছো তাই না!ক‌ই এর আগে তো কখনো আসো নি এখন মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উপচে পড়ছে!’

চি ৎকার চেঁ চামেচি শুনে শামীম আহমেদ,মিসেস সাবিনা,গুঞ্জন তড়িঘড়ি করে ঘরের বাইরে এলো।শামীম আহমেদ অন্তিকের এহেন আচরণ দেখে বললেন,
‘এসব কি অন্তিক?তুমি ব‌উমার সাথে এভাবে কথা কেনো বলছো?ভুল মানুষের হতেই পারে,ও তো ইচ্ছে করে এসব করে নি।’

‘না বাবা এর চেয়ে ভালোভাবে আমি কথা বলতে পারবো না।তুমি বলে দাও আমার মেয়ের ওকে প্রয়োজন নেই।ও যেনো আমার মেয়ের আশেপাশে না আসে।ওকে এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলো।’

অন্তিক কথাগুলো বলতেই রুহিয়া আর ওখানে এক মুহুর্ত‌ও দাঁড়ায় না,কাঁদতে কাঁদতে প্রস্হান করে।
_________________________________
শুক্লা দ্বাদশীর রাত।চাঁদ ও তারাভরা অম্বর।দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ জানান দিচ্ছে এখন সাড়ে আটটা বাজে।সানফির জ্ঞান ফিরেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে।বর্তমানে সে অন্তিকের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।অন্তিক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মেয়ের মাথায়।দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়।মুখ তুলে তাকায় অন্তিক।শান্ত স্বরে বলে,
‘ভেতরে এসো।’

গুঞ্জন ভেতরে এগিয়ে এলো।তার হাতে একখানা বাটি আর পানির গ্লাস।বেড সাইড টেবিলের ওপর বাটি আর গ্লাসখানা রাখলো সে।মৃদু স্বরে বললো,
‘ভাইয়া সানফির জন্য কোকোক্রাঞ্চ এনেছি।’

অন্তিক পুনশ্চ শান্ত স্বরে বলে,
‘ঠিক আছে খাইয়ে দাও।সানফি মা একটু উঠে বসো তো।’

অন্তিক সানফিকে ধরে বালিশের সাহায্যে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো।গুঞ্জন খাবারের বাটি হাতে বসলো সানফির পাশে।অন্তিক সানফিকে উদ্দেশ্য করে মৃদু স্বরে বললো,
‘মামনির হাতে খেয়ে নাও মা।বাবা একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

সানফি ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দুদিকে মাথা নাড়ায়।অন্তিক‌ও মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে যায়।গুঞ্জন খাবারটুকু খাইয়ে দেয় সানফিকে।তৎপর ওষুধ খাইয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।বিনিময়ে একখানা মিষ্টি হাসি উপহার দেয় সানফি।গুঞ্জন মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।তন্মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসে অন্তিক।গুঞ্জন অন্তিকের পানে তাকিয়ে কিঞ্চিত জড়তা নিয়ে বলে,
‘ভাইয়া একটা কথা ছিলো।’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘ভাইয়া,ভাবির কোনো দো ষ নেই।পায়েসে কিসমিস ছিলো না,আমি নিজে দেখেছি ভাইয়া।সানফির এলা র্জি হয়েছে নাট এন্ড ফ্রুটস চকোলেটের কারণে।ভাবি এসবের কিছুই জানে না।’

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেই গুঞ্জন চলে গেলো।কিয়ৎকাল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে র‌ইলো অন্তিক।পর মুহূর্তে সানফির ডাকে ফের বিছানায় গিয়ে বসলো।
________________________________
মধ্যরাত এখন।চারিধার নিস্তব্ধ,নিঝুম।ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে দূর হতে ডাহুক পাখির আওয়াজ।সমগ্র শহর ডুবন্ত তন্দ্রার সমুদ্রে।রাত জাগা নিশাচরের মতো দু’চোখ মেলে তাকিয়ে আছে রুহিয়া।নিদ্রা নেই তার চোখে।তার মনে ব্যাকুল হয়ে আছে মেয়ে সানফির জন্য।অশান্ত হয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে সে।কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না।রুহিয়া ভাবতে থাকে হঠাৎ মস্তিষ্কে একখানা বুদ্ধির উদয় হয়।কাল বিলম্ব না করে পা টিপে টিপে ঘর হতে বের হয় সে।খুব সন্তপর্ণে গুটি গুটি পায়ে উপস্থিত হয় সানফির ঘরে।বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে সানফি।সন্তানকে দর্শন মাত্র‌ই মাতৃ হৃদয়ের তৃষ্ণা পরিপূর্ণ হয়।নিঃশব্দে রুহিয়া বসে বিছানায়।সানফির পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা নিয়ে শরীরে টেনে দেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু খায় মেয়ের কপালে।ঘুমের ঘোরে কিঞ্চিত নড়ে চড়ে উঠলো সানফি।রুহিয়া তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো।আঁখি হতে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা নোনাজল।বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা চোখের জল মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই অন্তিকের মুখোমুখি পড়লো রুহিয়া।নতমস্তকে রুহিয়া অন্তিক’কে পাশ কাটিয়ে চলে আসার প্রয়াস করলো।অন্তিক পেছন হতে শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আ’ম স্যরি।’

পা জোড়া স্হির হলো রমণীর।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে সম্মুখে দাঁড়ানো পুরুষটির মুখপানে।অন্তিকের দৃষ্টি নির্নিমেষ।রুহিয়া এগিয়ে এলো এক কদম।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘স্যরি কেনো?’

অতিরিক্ত চেষ্টায় জড়তা কাটিয়ে অন্তিক স্তিমিত গলায় বলে,
‘তখনকার ওই বিষয়টার জন্য।আসলে সানফিকে ওইভাবে দেখে আমার মা থা ঠিক ছিলো না তাই ওরকম রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলাম,আমার অতোটা রিয়্যাক্ট করা উচিত হয় নি।’

অস্তমান চন্দ্রের ন্যায় অন্তিকের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে রুহিয়া।অন্তিক ভ্রুযুগল কিঞ্চিত কুঁচকে তাকায়।রুহিয়া মৃদু স্বরে বলে,
‘একজন মা জেনেশুনে কখনোই সন্তানের ক্ষ তি করতে পারে না।সানফি আমার মেয়ে,আমার দ্বারা কখনোই ওর খা রাপ হবে না।’

চলবে
[ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।]
ধন্যবাদ ________💚