মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০২

0
722

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#দ্বিতীয়_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথেবাস্তবের কোনো মিল থাকলে তা কাকতালীয়।)

“আন্টি প্লিজ ওদের আটকাও…ওরা আমার মা কে নিয়ে চলে যাচ্ছে…মা আর কোনোদিনও ফিরবে না আন্টি।প্লিজ আন্টি…প্লি-ই-ই-জ…মা-আ-আ… “,মিনু আর জয়ি মিলে আটকে রাখতে পারেনা কিশোরী মেয়েটাকে।কান্নায় আছার পাছার করতে থাকে ও।
গলা বুজে গিয়ে নিজেদের ঝাপসা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলটা মুছতে অবধি পারেনা জয়ি আর মিনু পাগলপ্রায় মেয়েটাকে ধরে রাখতে গিয়ে।

জয়িতা এত শোকের মাঝেও অবাক হয়,অবাক হয় জয়ন্তকে দেখে।জয়ন্ত একটা কোনো সান্ত্বনা বাক্য অবধি বলেনি রাইকে।জয়ি অবাক হয়ে দেখেছে অদ্ভুত রকম শান্ত হয়ে গেছে রেশমির স্বামী।রাইয়ের আজ ওর বাবা কে কতটা দরকার জয়ন্ত কি বুঝতে পারছেনা! আজ জয়ি না এলে মিনু একা কিকরে মেয়েটা কে সামলাতো ও ভাবতেও পারছেনা।নাকি তখন জয়ন্ত এগিয়ে আসতো মেয়ের দিকে!!মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিত!

জয়ন্তর কষ্টটা জয়িতা বুঝলেও কিছুতেই মানতে পারছেনা রাইমার প্রতি ওর এই উপেক্ষাটা।বাবা ছাড়া আর কে রইলো ওই মেয়েটার জীবনে?

মাত্র আধ ঘন্টার মত রেশমিকে ওর বাড়িতে রাখা হয়েছিল।বিপদই হয়তো মানুষকে এক করে।এতদিন যে প্রতিবেশীরা মুখ বাড়িয়ে খোঁজ অবধি নেয়নি,রেশমির শেষ যাত্রায় তারা অন্তত এসে দাঁড়িয়েছিল।রেশমির মৃতদেহ সৎকার করার জন্যেও জয়ন্ত আর ঋষির সাথে দু একজন প্রতিবেশী গেল।কিন্তু জয়ন্ত কোনোভাবেই রাইকে সাথে নিলোনা।
মেয়েটার বুকফাটা চিৎকারে সমগ্র এলাকায় যেন নেমে এলো শোকের ছায়া।স্বভাব শান্ত মেয়েটা এখনো বড় হয়ে ওঠেনি,তাই পারলোনা বড়দের মত নিজের হাহাকারটা অশ্রুবিন্দুর আড়ালে লুকিয়ে চোখ মুছতে।
আত্মীয়হীন,স্বজনহীন মেয়েটা আজ সত্যি করে একদম একা আর অসহায় হয়ে পড়লো।
জয়ন্তর সাথে ওর সম্পর্ক আর পাঁচটা বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মত হলেও মায়ের সাথেই ছিল ওর আত্মার টান,যত কিছু গল্প,খুনসুটি,আলাপ-আলোচনা।হাসি-কান্না-হার-জিত সবকিছুর সঙ্গী ছিল ওর মা।তাই ষোড়শী ওই মেয়ের জীবনে যে শূন্যস্থান তৈরি হলো সেটা যে জয়ন্ত কখনোই পূরণ করতে পারবে না সেটা ও নিজে সবচেয়ে ভালো জানতো, তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল রাইয়ের কাছ থেকে।

রাইয়ের কান্না সহ্য করার ক্ষমতা জয়িতারও ছিলোনা।ওর মা বর্তমানে জীবিত,ওর সমস্ত সুখ-দুঃখের সঙ্গী।তাই মা হারা জীবন কতটা কঠিন হয়,ভাবতেও ও কেঁপে উঠলো।রেশমির মৃতদেহের পিছনে ছুটতে চাওয়া রাইমাকে ও টেনে ধরলো,তারপর টেনে নিল নিজের বুকের মধ্যে।অসহায় সর্বস্বহারা মেয়েটা আর কিছু না পেয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরলো জয়িকে।জয়ির বুকে মুখটা ঢুকিয়ে দিয়ে অবচেতন মনে অনুভব করতে চাইল নিজের মা কে।যে মনটা তখনো অবধি মানতে রাজি ছিলোনা ওর মা আর নেই,সে জয়ির গা থেকে খুঁজতে চাইলো মা মা গন্ধটা।

এক সদ্যমাতৃহারা মেয়ে অনেকটা সময় পরে ক্লান্ত হয়ে আর এক মায়ের বুকে ফোঁপাতে লাগলো।জয়ি ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো রাইয়ের মাথায়।আর ওর মায়ের শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পর তেরো বছর আগে যে হাত দুটো ছোট রাইকে প্রথম ছুঁয়েছিলো সেই হাতদুটোই আজ ওকে জড়িয়ে রাখলো জীবনের চরম দুঃখের দিনে।
হয়তো কোথাও এক অশান্ত মায়ের আত্মাও কিছুটা শান্তি পেলো এই দৃশ্যে।মমতার আবরণ চেষ্টা করলো শোকের আঘাতে কিছুটা মলম দিতে।

“দিদি এই দুধটুকু রাইকে খাইয়ে দাও।সক্কাল থেকে মেয়েটা কিছু মুখে দেয়নি।সেই রাত থাকতে উঠে পড়েছে,আমি দুধ দিতে যাচ্ছিলাম,তকনই খবরটা এলো ফোনে….আর কি গলা দিয়ে কিছু নামে,কি যে হয়ে গেল….”,জয়ি রাইয়ের বিছানায় পা ছড়িয়ে চোখ বুজে বসেছিল,দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।আর রাই সদ্য পরিচিত জয়ির কোলে মাথা দিয়ে,গায়ে ওর মায়ের চাদর জড়িয়ে চুপ করে শুয়েছিল,ওর মাথায় হাত বুলোচ্ছিলো জয়ি।জয়ন্তদের ফিরতে দেরি আছে।
মিনু চুপচাপ উঠে গিয়ে দুধ গরম করে এনে জয়িকে আলতো করে ঠেলে ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বললো।

কথা না বলে জয়িতা হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাসটা নিলো মিনুর থেকে।রাইয়ের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে আস্তে আস্তে বললো,”রাই একটু উঠে বসবি মা?এই দুধ টুকু খেয়ে নে।মিনু বলছে সারাদিন খালি পেটে আছিস,খা মা।”

প্রথমে কোনো উত্তর করলো না রাইমা।তারপর খুব ধীর গলায় শোনা প্রায় যাবেনা এরকম স্বরে শুধু বললো,”বাবা ফিরুক আন্টি।এখন গলা দিয়ে কিছু নামবে না”।

-“রাই বাবার ফিরতে অনেক দেরি হবে।তুমি কিছু না খেলে শরীর এবার খারাপ করবে।ওঠো বাবা এটুকু খাও,সোনা মেয়ে আমার।” জয়ি চেষ্টা করলো বাবা বাছা করে যদি একটু কিছু মুখে দেয়।

দীর্ঘদিন মা কে ছাড়া ছিল রাই।মিনু যতই যত্ন করুক মায়ের আদর রাই মিস করেছে দীর্ঘ একমাস প্রায়।জয়ির গলার আওয়াজে ও যেন নিজের মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেলো।চকিতে মুখ ফিরিয়ে তাকালো জয়ির দিকে।
জয়ি দেখলো রাই বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,কি যেন খুঁজচ্ছে ওর মুখের মধ্যে। কিছু হয়তো আন্দাজ করলো এক মা। ডান হাতে দুধের গ্লাস থাকায় বাঁ হাত আবার ওর মাথায় রেখে স্নেহ মেশানো কণ্ঠে বললো,”কি দেখছিস মা।পৃথিবীর সব মা’ই আসলে এক।আমিও তো তোর মা।নে এবার খেয়ে নে এটুকু,আমার কথা শোন।”
বিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো রাই জয়িতার মুখের দিকে।তারপর ওর স্বভাব অনুযায়ী কথা বাড়ালো না,চুপচাপ উঠে বসে দুধের গ্লাসটা নিয়ে মুখে ঠেকালো।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পারলোনা পুরোটা খেতে।কান্নার দমকে গ্লাসটা মেঝেতে রেখে বাথরুমে ছুটলো,হড়হড় করে বেরিয়ে এলো পেটে যাওয়া দুধের বেশিরভাগটাই।কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমের মেঝেতেই বসে পড়লো ও।

মিনু জয়ি দুজনেই ছুটে এসেছিল ওর পিছু পিছু।টেনে তুলে দেখলো সালোয়ার প্যান্ট সব ভিজে গেছে জলে।মিনু ছুটলো শুকনো জামা আনতে,তারপর ওরা দুজন মিলে অনেক কষ্টে রাইয়ের জামা বদলে দিলো,প্রকৃত অর্থে ওর যেন বাহ্যিক কোনো জ্ঞান আছে বলে মনে হলোনা। নিজের ওপর নিজেরই যেন কোনো কন্ট্রোল নেই।ছোট থেকে যাকে ঘিরে ওর জীবন ঘুরতো আজ তাকে ছাড়া ওর নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।বাবা খুব ভালোবাসে ও বুঝলেও সেই অর্থে বাবা ভক্ত ও কোনোদিনই ছিলোনা।জীবন খাতা ঠিক করে খোলার আগেই শিকড়হীন হয়ে পড়া মেয়েটা যেন চোখে অন্ধকার দেখলো।
জয়ি ওকে বুকে জড়িয়ে নিজের ওপর প্রায় ওকে নিয়ে ফিরে এলো ওর ঘরে,শুইয়ে দিলো ওর বিছানায়,কম্বলটা টেনে দিলো বুক অবধি।নিজের কপালে আড়াআড়ি হাত রেখে রাই শুয়ে থাকলেও ঘুম যে ওর আসবেনা,আর জেগে থাকলে মনে মনে গুমরোবে বুঝতে পারলো ডাক্তার জয়িতা মুখার্জী।
নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকেল প্রায় তিনটে বাজে।ওর ব্যাগে সবসময় একটা রাইটিং প্যাড থাকে,আর সঙ্গে থাকে নিজের মেডিকেল স্ট্যাম্প।
নিজের ডাক্তারি রাইটিং প্যাডে হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ আর দরকারি কয়েকটা ওষুধ লিখে ফেললো তাড়াতাড়ি।তারপর ওই কাগজটা ছিঁড়ে,তার সাথে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে মিনু কে পাঠিয়ে দিল মেডিকেল স্টোরে।

আধ ঘন্টার কম সময়ে ফিরে এলো মিনু।তখনও রাই একই ভাবে শুয়ে,কিন্তু ওর বুকের ওঠানামা বুঝিয়ে দিচ্ছে ও আস্তে হলেও ফোঁপাচ্ছে নিজের মধ্যে।

‘দুধ যেটুকু পেটে গেছে তাতেই যথেষ্ট’,মনে মনে ভাবে জয়ি।
ঘুমের ওষুধের পাতা ছিঁড়ে রাইয়ের টেবিলে রাখা জলের বোতলের জল দিয়ে খাইয়ে দেয় ওকে।তারপর ওর মাথার পাশে বসে চুলে হালকা করে বিলি কাটতে কাটতে বলে,”একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর মা।ঘুমটা তোর খুব দরকার।”
ওষুধের ঘোর এখনো শুরু না হলেও সারাদিনের কান্নাকাটিতে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত রাই আধো খোলা চোখে তাকায় ওর জয়ি আন্টির দিকে,”কেন আমি বাবাকে আগে বললাম না আন্টি? মা যতই বারণ করুক,আমি সেদিন জোর করে বলে দিলে মা সুস্থ হয়ে যেত।আমায় ছেড়ে চলে যেতনা।” দু ফোঁটা জল আবার চোখ উপচে গড়িয়ে পড়ে।
জয়িতা নিচু হয়ে রাইমার মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে।
“ঘুমো রাই, ঘুমো মা।আমি আছি তোর সাথে,ঘুমো একটু”,জয়ি ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে রাই কে।নিজের মনে প্রলাপ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে ও।

এতক্ষন পরে জয়িতা দুচোখ ঢাকে দুটো হাত দিয়ে।মনে মনে রেশমিকে ও নিজেও দোষারোপ করতে থাকে।কোনো আওয়াজ আসেনা হাতের আড়াল থেকে।শুধু পিঠটা মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে।

দরজার আড়ালে দাঁড়ানো মিনু লক্ষ্য করে প্রায় সব কিছু।ও মুখ চাপা দেয় শাড়ির আঁচল দিয়ে।তারপর ছুট্টে চলে যায় ওর একান্ত নিজের জায়গা এবাড়ির রান্নাঘরে।

রণ একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল দুপুরটায়।এমনিতে ওর রুটিন অনুযায়ী দুপুরে ঘন্টাখানেক রেস্ট নেয় ও,রাতে জাগে বলে।আজ অবচেতনে চিন্তা ছিল,আর ওই চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়েছিল বলে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হচ্ছিল।তারপর কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল….নাহ!আধ ঘন্টা বেশি রেস্ট হয়ে গেল আজ।

কিন্তু মম তো একবার এসময় ঘুরে যায় ওর ঘরে,আজ এলো না!তাহলে কি এখনো ফেরেনি?কোথায় গেল?
হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয় ও,চারটে পনেরো।কি মনে করে মায়ের নম্বরটা টিপে দেয়।যদি বাড়িতে থাকে কল না ধরে ডিরেক্ট ওর ঘরে চলে আসবে।কিন্তু ওকে অবাক করে ওর মা ফোনটা ধরে।

-“মম তুমি দুপুরে বাড়ি আসোনি?”
-“না রণ।তুমি লাঞ্চ করেছিলে?এখন কি করছো?”
-“আজ একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দুপুরে।অন্যদিন তুমি ডেকে দাও।লাঞ্চও করেছি,ফলও খেয়েছি।তুমি লাঞ্চ করেছ?”

রণর কথায় খেয়াল হয় ওর,সকাল থেকে কিছু খায়নি আজ।সকালে চেম্বার ক্যান্সেল করতে পারেনি,যাহোক বুড়ি ছোঁয়া করে জয়ন্তর এখানে চলে এসেছিল।
রণ জন্মানোর পর হসপিটাল ছেড়ে দিয়েছিল ও।প্রাক্টিসও বন্ধ রেখেছিলো বেশ কিছু বছর।তবে নিজেকে আপ টু ডেট রাখতো সব সময়।তাই রণ যখন স্কুল যেতে শুরু করলো প্রাইভেট প্র্যাক্টিস শুরু করেছিল আবার,তখন শুধু সকালের টাইমটা করতো।আর উইকেন্ডে শহরের নাম করা বেসরকারি হসপিটালে ডেলিভারি,যে সপ্তাহে দরকার পড়তো।এখন তো সব সিজারের চল এ শহরে,জয়ির নিজেরও টিম আছে একটা।
এখন সপ্তাহে দুদিন ওই হসপিটালের আউটডোরে বসে সন্ধ্যের দিকেও।তবে এবছর রণর ফাইনাল এক্সাম বলে চেষ্টা করছে কম পেশেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার।

-“কি হল মম লাঞ্চ করেছিলে?” রণ আবার রিপিট করে।ও জানে ওর মায়ের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।না খেলে কষ্ট হয়।
-“না রে রণ,ফিরে তোকে সব বলবো।” ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয় জয়ি।
সারাক্ষন হুল্লোড় করা,মাতিয়ে রাখা,মায়ের ওপর দরকারে চেঁচামেচি করে শাসন করা ছেলেটা বুঝতে পারে আজ কিছু অসুবিধে হয়েছে,কিছু একটা ঠিক নেই।আর কথা বাড়ায় না।
“টেক কেয়ার মম” বলে ফোনটা ছেড়ে দেয়।

উঠে পড়ে রণ এবার।আজ বিকেলে প্রাইভেট পড়া আছে।একটু ফ্রেস হয়ে নীচে নামে।রমা পিসি ওর পছন্দ মত চকোলেট ফ্লেভারের হেল্থ ড্রিংকস রেডি করে দিলে খেয়ে বেরিয়ে যায়।

আজ বড্ড অস্থির লাগছে ওর।সাইকেল নেয়না তাই।মম ফেরেনি,তাই গাড়িও নেই।অন্য গাড়িটা তো পাপা নিয়ে বেরিয়ে যায় সকালে,নিজেই ড্রাইভ করে।মমের গাড়ি মম খুব কম চালায়,ভাস্করদা কোনো কারণে না এলে।
আজ তো ভাস্করদাই মমকে নিয়ে গেছে সকালে।

বাড়ি থেকে বেরিয়েই অটো পেয়ে যায় ও।উঠে পরে।

স্যারের কোচিং ক্লাস রাস্তার উপরেই।অটো থেকে নামছে দেখতে পায় রুদ্রকে,সাইকেল রাখছে।ওকে দেখে এগিয়ে আসে।
-“কিরে সাইকেল বা গাড়ি কই?”
-“গাড়ি মম নিয়ে বেরিয়েছে।আর সাইকেল আনতে ইচ্ছা করলো না।”
-“কেন রে!তোর সাইকেলটা দেখলেই আমার লোভ হয়।ফায়ারফক্স ভাইপার, যা তা সাইকেল ওটা।বাপিকে পটিয়ে ফেলেছিলাম প্রায় তোরটা দেখার পর,মা বাগড়া দিয়ে দিল শেষ মুহূর্তে।” সরকারি চাকুরের ছেলে রুদ্র অনেক ক্ষেত্রেই পাল্লা দিতে পারেনা এসব উচ্চবিত্ত ছেলেদের সাথে।কিন্তু ওর কথায় সেটা বুঝতে দিতে চায়না কখনো।
রণ কোনোদিনও নিজের বন্ধুত্বে স্ট্যাটাস আনেনা, তাছাড়া আনার দরকারও পড়েনা।ও শহরের যে স্কুলে পড়ে সেখানে বিত্তশালী বাবা-মার সন্তান ছাড়া পেরে ওঠা মুশকিল।
রুদ্র আর দু তিনজন উচ্চ মধ্যবিত্ত,তাদের সাথেও ও মেশে বাকি বন্ধুদের মতোই,যদিও ওর ক্লাসের বাকি ছেলেরা ওর মত মনোভাব খুব কমই রাখে।তাই রুদ্র রণর সাথে ঘোরে বেশি।ওর হিরো রেজারব্যাক সাইকেল নিয়ে রণর ফায়ারফক্সের পাশে পাশে যেতে হীনমন্যতায় ভোগেনা।

রণ হাসে।সাইকেল ওর ও দুর্বলতা।ও ওর স্পোর্টস সাইকেল নিয়ে এই শহরেই দূরে দূরে চলে যায়।দেখতে এমনি ও লম্বা,হ্যান্ডসাম।তারপর সাইক্লিং করে করে শরীরটাও মেদহীন।
বাবা মা ডাক্তার,আর ওরও মেধা কম না।তাই ডাক্তারি ওরও লক্ষ্য।কিন্তু শরীর তৈরি ওর নেশা।আর হ্যান্ডসাম ডাক্তার তো সবাই পছন্দ করে।

রণ বন্ধুদের প্রচন্ড পছন্দের একটা ছেলে।ও সব দিক দিয়ে টপ,কিন্তু বন্ধুত্ব ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।ও ছেলে মেয়ে বিচার করেনা,ও মেধার বিচার করেনা,আবার স্ট্যাটাসও দেখেনা।তাই সবার খুব প্রিয় ও ওর ক্লাসে।
হৈচৈ করে সব জায়গায় মাতিয়ে রাখে,আবার এই ছেলেটাই পরীক্ষা হলে গুরুগম্ভীর।সবার সাথে খোলা মনে মিশলেও আজও ওর প্রিয়বন্ধু সেই মা।
দূর মা যে কোথায় কি করছে! সকালে সেই না খেয়ে বেরিয়েছে।মায়ের চিন্তা করতে করতে অংকের কোচিংয়ে ঢুকে যায় রণ,রুদ্র কে সঙ্গে নিয়ে।

“জয়ন্ত এবার আমরা আসি।মেয়েটার একটু খেয়াল রাখিস।একটা ট্রমাতে আছে ও।একটু সঙ্গ দিস।আমি যখনই সময় করতে পারবো চলে আসবো”, জয়ন্ত ফিরতে জয়ি বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নেয়।

ঋষি ওকে ফোন করে দিয়েছিল,জয়ন্তর বাড়ি আর আসেনি।ও বাড়ি চলে গেছে,ফ্রেস হয়ে এবেলা চেম্বার যেতে হবে।
জয়ন্ত ফিরতে ওকে চা-টা দিয়ে জয়ি ঘুমন্ত রাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে জয়ন্তর ঘরে যায়।
রেশমির রোগ ধরা পড়ার পর জয়ন্ত বাড়িতে স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছিল প্রায়।আজ একবছর পর বাড়িতে সিগারেট ধরিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছিল ও।জয়ির কথায় জানলা গলিয়ে সিগারেট ফেলে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
জয়িতা দেখে জয়ের চোখের কোনে জল।
এককালের প্রিয় বন্ধুকে ভেঙে থাকতে দেখে এগিয়ে যায় ও।
“জয় তুই ডাক্তার,সবচেয়ে বড় কথা তুই মাহারা একটা বাচ্ছা মেয়ের বাবা।এবার তো তোকে শক্ত হতে হবে বল।জানি তোর শূন্যতা পূর্ণ হওয়ার নয়।কিন্তু রাইয়ের মুখ চেয়ে তোকে স্বাভাবিক হতে হবে।নাহলে রেশমিও শান্তি পাবেনা।” জয়ি জয়কে টেনে এনে ওর ঘরে রাখা চেয়ারে বসিয়ে কথাগুলো বলে।
চুপ করে থাকে জয়ন্ত,কোনো উত্তর দেয়না।

“আজ আমি আসি রে।কাল পরশু পারলে আবার আসবো।তুই রাইয়ের খেয়াল রাখিস, আর নিজেরও”,জয়ি জয়ন্তর মাথায় হাত দিয়ে অনেক বছর আগে যেভাবে কথা বলতো সেভাবে বলে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
“আমি পারবো না।” পিছন থেকে আসা জয়ের কথা থামিয়ে দেয় ওকে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বলে,”মানে?কি পারবি না তুই?”
“রেশমির ফেলে যাওয়া কোনো দায়িত্ব আমি নিতে পারবোনা, ওর মেয়েরও না।ও যেমন স্বার্থপরের মত আমার কথা ভাবেনি,আমিও ওর কিছু নিয়ে ভাববো না।আমি নর্থবেঙ্গলের পাহাড় ঘেঁষা একটা গ্রামে,সদ্য খোলা হসপিটালে ট্রান্সফারের অ্যাপ্লাই করেছি।পেয়ে গেলে চলে যাবো।রাইকে এখানে কোনো হোস্টেলে দিয়ে দেব”।অনুভূতিহীন ভাবে কথা গুলো বলে ও।

জয়িতা কিছুক্ষন কোনো উত্তর দিতে পারেনা।তারপর বিস্ময়ভরা গলায় বলে,”তুই কি বলছিস তুই জানিস?তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?একজন ডাক্তার হয়ে তুই জানিস না জন্ম মৃত্যু কারোর হাতে থাকেনা।আমরা চেষ্টা করতে পারি।…হ্যাঁ জানি রেশমি আরো আগে তোকে বললে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু…”,জয়ি চমকে ওঠে ওর বন্ধুর চিৎকারে।স্বভাব শান্ত ছেলেটাকে কোনোদিনও গলা তুলতেও ও দেখেনি আজ অবধি।

“কিসের কিন্তু?ওরা দুজন পাকামো না করে আমায় সত্যিটা আরো আগে বললে এভাবে আমার পৃথিবীটা তছনছ হয়ে যেতনা।” চিৎকার করে ওঠে ও।সেই কলেজ থেকে জয়িতাকেই তো মনের খারাপ লাগাগুলো বলতে পারতো ও।

“দুজন!! কারা দুজন!!কি সত্যি?” জয়িতা যেন বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়।

“রেশমি আর ওর মেয়ে।কেন বলেনি আমায় কিছু?রেশমি রাইকে দেখিয়েছিল অনেক আগে,কেন ও চেপে গেছিল মায়ের কষ্টটা? ও নাকি ওর মাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতো।মায়ের শরীরে একটা স্পট এসেছে, মা খাওয়াদাওয়া করছেনা ঠিক করে ও কি বলতে পারতো না?” পাগলের মতো নিজের মনের রাগ গুলো বের করতে থাকে জয়।

জয়ি এবার জয়ের কাছাকাছি এসে ওর কাঁধে হাত রাখে।
“এই জয় কি পাগলের মতো বকছিস?রাইয়ের তখন কত বয়স!আরো ছোট ছিল তখন ও।ও কি বুঝবে এসবের।আর রেশমি ওকে বলতে দিতে দেয়নি।ও ভেবেছিল অ্যালারজি,ঠিক হয়ে যাবে।তোর কাছে এধরণের কথা আশা করিনা।তুই কোথায় রাইকে…”,আবার কেঁপে ওঠে জয়ি।
“তাই তো।আমি খালি মহানতা দেখাতে জন্মেছি।নিজের দরকার যে মেয়েটা বলতে পারে,সে এই কথাটা বলতে না পারার মত ছোট ছিলোনা।আসলে গুরুত্ব দেয়নি।” জয়ন্তর গলা ধরে আসে।
জয়ি বিহ্বল হলে যায়।কি বলবে ওর মাথা আর কাজ করেনা।সারাদিন পেটে খাবার নেই,এরকম পরিবেশ,তারওপর ওর সারাজীবনের বুঝদার বন্ধুর এরকম অগোছালো কথাবার্তা ওকে নির্বাক করে দেয়।জয়ন্তর কান্নাও ওকে আর ছোঁয়না।
সারাদিন রাইকে সামলে অদ্ভুত মায়া পড়ে গেছে জয়ির ওর ওপর,হয়তো নিজে হাতে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল বলে।জয়ন্তর এসব ভিত্তিহীন কথা ওর মাথায় ঢোকেনা।অসহায়ের মত শুধু বলে,”প্লিজ জয়ন্ত মেয়েটার এখন তোকে খুব দরকার।খুব ভেঙে পড়েছে ও,প্লিজ ওকে দূরে ঠেলিসনা।”

“আমি এই মুহূর্তে কারোর দায়িত্ব নেওয়ার অবস্থায় নেই জয়ি।ও আমার সামনে থাকলে আমি ভুলতে পারবোনা ওদের নেগলিজেন্সি টা।আরো রাগ বাড়বে।তার চেয়ে ও হোস্টেলে যাক,ভালো থাকবে।” ভেঙে পড়া, অথচ দৃঢ় স্বরে বলে ও কথাগুলো।জয়ি বুঝতে পারে ওর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।
প্রচন্ড রাগ হতে থাকে ওর জয়ন্তর ওপর।খালি রাইয়ের কান্না ভেজা অসহায় মুখটা ভাসতে থাকে,আর ভাসতে থাকে অনেক গুলো বছর আগের একটা দৃশ্য।
ওটিতে সদ্যজাত সন্তানকে বুকে নিয়ে রেশমির সেই আনন্দ্রাশ্রু।
“ঠিক আছে জয়।আজ তুই রেস্ট নে।কাল আমি আবার আসবো।আজ আসি”,আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসে জয়ি।

সারারাস্তা ওর মনে ঝড় চলতে থাকে।ওর সেই শান্তশিষ্ট সমঝদার বন্ধুকে ও খোঁজার জন্যে স্মৃতি হাতড়াতে থাকে।

ওই তো অবুঝ ঋষিকে বোঝাচ্ছে জয়ন্ত।ওই তো বাড়িতে মায়ের ওপর রাগারাগী করে কলেজে আসা জয়িতাকে দিয়ে বাড়িতে ফোন করাচ্ছে ও।
আরে হ্যাঁ, মেডিকেল কলেজে ঝামেলা হলেই মেটানোর দায়িত্ব তো ওই নিত।
আর ওর-ঋষির ঝামেলা কোনোদিনও জয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া মিটেছে বলে জয়ির মনেই পড়েনা।

কিকরে এতটা বদলে গেল সেই জয়।রেশমির মৃত্যু ওকে এতই অসহায় করে দিয়েছে বলেই এসব বলছে নাকি ও?কিন্তু ওই অদ্ভুত রাগটা.. জয়ন্তকে একগুঁয়ে করে দিয়েছে।এখন ও বুঝতে পারছে রেশমিকে নিয়ে বাড়ি ঢুকে কেন ও রাইয়ের দিকে ফিরেও চায়নি!!
রেশমির ওপর ছেলেমানুষি অভিমান ওকে এরকম করে দিয়েছে।রেশমিকে পাচ্ছেনা রাগ দেখাতে, তাই তার সবচেয়ে প্রিয় মেয়ের ওপর রাগ ফলাচ্ছে।
জয়ি ভাবে এটা সাময়িক।দুদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে।আবার আগের মত হবেনা কিছুই,কিন্তু বাপ-মেয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ঠিক কাটিয়ে উঠবে আজকের সময়।

পুরোটা একজনের সাথে আলোচনা করতে ও ব্যগ্র হয়ে ওঠে।সবটা ঋষিকে বলতে না পারলে ওর যেন এই চঞ্চলতা কাটবে না।

বাড়ি ঢুকে সোজা নিজের রুমে গিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমের গিজার অন করে ফোনটা হাতে নেয়।
একজন ডাক্তার হয়ে ও জানে চেম্বারের মাঝে ফোন বিরক্তির ব্যাপার।তাও টিপে দেয় ঋষির নম্বর।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় রাইয়ের।এমনিও ওর পেটে খাবার ছিলোনা বলে জয়িতা হালকা ডোজের ওষুধ দিয়েছিল।ও ভাবেনি তখন জয়ন্ত এধরণের ভাবনা মনে পোষণ করে রেখেছে।ও ভেবেছিল আপাতত ঘুমোক মেয়েটা,যখন ঘুম ভাঙবে জয় সামলে নেবে।
কিন্তু রাইয়ের যখন ঘুম ভাঙলো ওর চারিদিক তখন অন্ধকার।প্রথমে চোখ চেয়ে কিছু বুঝতে পারলো না ও।
মনেও পড়লো না,আজ ওর জীবন মাতৃশূন্য হয়েছে।কিছুক্ষন চোখ খুলে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকলো ও,শুধু অনুভব করলো ওর প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে।
কয়েক সেকেন্ড….খিদে পেলে যার কথা মনে আসে রাইয়ের ভাবনা সেখানে আসতেই ওর বুক হুহু করে উঠলো।

“মা-আ-আ-আ”,নিজের জায়গায় উঠে বসলো ও প্রায় আর্ত চিৎকার করে।
চোখ একটু সয়ে যেতে দেখতে পেলো মেঝেতে বিছানা পেতে মিনু অন্যরাতের মতোই ঘুমোচ্ছে।কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ও ভাবার চেষ্টা করলো সত্যি ওর মা ওর জীবনে নেই নাকি ও দুঃস্বপ্ন দেখছিল।কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে এলো ও প্রায় নিঃশব্দে।
আগের রাতে ঠিক করে ঘুম হয়নি,সারাদিন মানসিক ধকল গেছে,মিনু কিছু বুঝতেই পারলো না।
জয়ন্তর পোস্ট সিনিয়র লেভেলের বলে ও কোয়ার্টারটা এখানে বেশ ভালো পেয়েছিল,দোতলা ছোট একটা বাড়ি।
রাইয়ের ঘর দোতলায়।একতলায় নেমে খাবার জন্যে ডাইনিং স্পেসে যেতে গিয়ে দেখল জয়ন্তর স্টাডিরুমে আলো জ্বলছে।
রাই ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকে ওর পড়ার ঘরে ওর মা ওকে নিয়ে শুতো।বাবা অনেক সময় ওপরের ঘরে যেত রাতে শুতে,কখনো নিচেই নিজের এই কাজের ঘরেই রাত কাটিয়ে দিত।
বাবা মা দুজনে মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,ওর ঘরে বড় খাটও বানিয়ে দিয়েছিল বাবা শোয়ার সুবিধের জন্যে।
রাই ক্লাস এইটে উঠলো আর ওর মার অসুখও বাড়লো, মিনুদি এলো ওদের বাড়িতে,অসুস্থ মায়ের কাছে রাতে বাবা থাকতে শুরু করলো।
কেউ জানেনা শুধু মিনুদি ছাড়া বাবা সেভাবে ওর সাথে কথা বলেনা প্রায় একবছর,যেদিন থেকে বাবা জেনেছে রাই মায়ের লাল স্পটটা দেখেছিল বছর খানেক আগে,কিন্তু বাবা কে কিছু বলেনি।
মা কে প্রথমবার হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে আসার পর বাবা ওর ঘরে এসেছিল।সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো ও কবে থেকে জানে মায়ের লাল স্পটটার কথা।
রাইমা সহজ মনে বলেছিল প্রায় বছর খানেক।
ওর বাবা অবাক দৃষ্টিতে ওকে দেখে বলেছিল,”তাহলে আমায় বলিসনি কেন?”
“আমি তো বুঝতে পারিনি বাবা ওটা কোনো বড় রোগের লক্ষণ।মা একদিন দেখিয়ে বললো, ‘দেখ রাই এখানটা কিরকম লাল হয়ে খালি মিসমিস করছে কদিন’।আমি বলেছিলাম দাঁড়াও এলার্জির মলমটা লাগিয়ে দি।দুদিন পর জিজ্ঞেস করতে বলেছিল,’দূর ওটা এমন কিছু না।ঠিক হয়নি,কিন্তু দু তিনদিনে ঠিক হয়ে যাবে,তুই ওতো ভাবিস না’।আমিও আর কথা বাড়াইনি।”
রাইয়ের উত্তরে বাবা সন্তুষ্ট হয়নি ও বুঝতে পারছিল,কিন্তু কম কথা বলা মেয়েটা আর কথা না বাড়িয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে।তারপর কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় বললো,”মাস চার পাঁচেক আগে আমি টিউশন থেকে ফিরে দেখলাম,সন্ধ্যেবেলা মা গায়ে চাদর দিয়ে শুয়ে আছে।আমি কাছে যেতে বললো, ‘শরীরটা ভালো লাগছেনা,শীত শীত করছে তাই শুয়ে আছি’।আমি বলেছিলাম তুমি আসলে বলতে,আমার পরেরদিন এক্সাম ছিল আমি বিজি হয়ে গেছিলাম।কয়েকদিন পর জিজ্ঞেস করতে বললো তোমায় বলার দরকার নেই,এখন ঠিক আছে”।
ওর বাবা আর কিছু বলেনি,সেদিনের মত চলে গিয়েছিল ওর ঘর থেকে।
রাইমা সেদিন বুঝতে পারেনি ওর বাবার অস্থিরতার কারণ।ও ভাবতেও পারেনি এরকম একটা রোগ ওর মায়ের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।ও নিজের মায়ের রোগ বুঝেছিলো যেদিন অপেরাশনের পর মা হসপিটাল থেকে ফিরেছিল।সদ্য ক্লাস এইটে ওঠা মেয়েটা এটুকু বোঝার জ্ঞান রাখতো।ও নিজেও সেদিন নিজেকে দোষারোপ করেছিল কেন একবার বাবাকে বলেনি।কিন্তু ও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি ওর বাবা….
ও জানে ওর বাবা ওকে মনে মনে দোষী ভাবে।

পায়ে পায়ে বাবার ঘরে উঁকি মারে।দেখে বাবা নিজের ইজিচেয়ারে চুপ করে বসে আছে।শীতের রাতে দরজা খোলা থাকলেও জানলা সব বন্ধ থাকায় ঘরের মধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধ আটকে আছে।
প্রায় একবছর বাবা স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছিল বাড়িতে।ওর পায়ের আওয়াজ শীতের রাতের শান্ত পরিবেশে জয়ন্তর কানকে ফাঁকি দিতে পারেনা।
চমকে তাকায় ও দরজার দিকে।
চোখাচোখি হয় রাইয়ের সাথে।

-“কি হলো! ঘুম ভেঙে গেল কেন এত রাতে?”
-“হমম ভেঙে গেল বাবা।খিদে পেয়েছে। তুমি ঘুমোওনি?”
-“নাহ!আমার আর ঘুম আসবে না।যাও কিচেনে দেখো যদি কিছু পাও।মিনুকে ডাকনি কেন?একা নেমেছো?”
-“মিনুদি খুব ঘুমোচ্ছে দেখলাম।তাই…”।

আর কথা বলেনা জয়ন্ত।আবার মুখ ঘুরিয়ে চোখ বোজে।ওর চোখে ভাসতে থাকে পুরোনো স্মৃতি সিনেমার মত।

জয়ন্ত জানে রাইকে হোস্টেলে পাঠাতে ওর মধ্যে কি লড়াই চলছে।কিন্তু ও কিকরে পারবে সব দিক সামলে রাইকে চোখে চোখে রাখতে? ওর হসপিটাল,ওর চেম্বার এসবের পর সময় কতটুকু থাকে ওর কাছে।মেয়েটা বাঁচাবে কিকরে একা একা?
ও জানে রেশমি আর ওর অসম বিয়ের কারণে এই কোয়ার্টারের বেশিরভাগ মানুষ,রাইয়ের স্কুলের বন্ধুরা ওর সাথে বিশেষ কথা বলেনা।এদের বাড়ির লোক খালি বড় স্কুলে পড়িয়েই বিশ্ব জয় করে ফেলে,সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা কেউ দেয়না।
রেশমি বিয়ের আগে,এমনকি পরেও যতদিন না রাই হয়েছে এনজিওর কাজে কি ভয়ানক ব্যস্ত থাকতো।ছোটাছুটি করতো ওদের নিয়ে।কিন্তু রাই হতেই সমস্ত অ্যাটেন্সন ওকে দিয়ে দিল।কিছু বলতে গেলেই বলত,”আমি জানি মায়ের অভাব কি কষ্টের।আমার রাই কখনো আমার মত কষ্ট পাবেনা।ওর মা সবসময় ওর প্রকৃত বন্ধু,সহযোদ্ধা,শিক্ষিকা আর মা হয়ে ওর পাশে থাকবে।”
সব ছেড়ে দিয়েছিল,যুক্তি ছিল মেয়ে বড় হলে কাজ করার সময় অনেক পাবে।এখন মেয়ের দরকার তার মাকে।

ছায়ার মত লেগে থাকতো রাইয়ের সাথে।কতদিন ও বলেছে,’রাতে রাই ঘুমোলে চলে আসবে আমার কাছে।আমারও তো তোমার অভাব বোধ হয়’,রাখেনি জয়ন্তর কথা।মেয়েকে কখনো একা ছাড়তো না ও।
আজ সেই মেয়েকে নিজের কাছে রেখে সেই অভাব কখনো জয়ন্ত পূরণ করতে পারবে না।তাছাড়া রেশমির স্মৃতি জড়ানো এই কোয়ার্টারে থাকলে ও পাগলও হয়ে যাবে।মেয়েটা বড্ড নরম।তাই ওকে একা হোস্টেলে রেখে আসার আগে মানসিক ভাবে শক্ত করতে হবে,সেটা হবে মায়ের জন্য সমব্যথা না দেখিয়ে ওকে আঘাত করলে।বাবাকে ছেড়ে একা বাঁচতে শিখবে ও,শিখবে বাইরের প্রতিকূলতার সাথে লড়তে।
হঠাৎ কি মনে হতে চেয়ার ছেড়ে উঠে জয়ন্ত রান্নাঘরে উঁকি মারতে যায়।মেয়ে কি করছে লুকিয়ে দেখতে।
চমকে যায় জয়।
এবারে হসপিটাল যাওয়ার আগে কষ্ট করে মিনুর সাহায্যে রাই আর জয়ন্তর জন্যে প্রচুর চিনির নাড়ু,নিমকি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে গেছিল রেশমি।বানিয়েছিল রাইয়ের পছন্দের মোরব্বা।হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছিল ও।
মেয়ে তো ফ্রিজ খুলে খায়না বিশেষ,মা’ই জোর করে সময় সময় হাতে খাবার প্রায় ধরিয়ে দিত।
এখন ফ্রিজ ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই, মোরব্বা হাতে করে,পুরো মুখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
জয়ন্ত সহ্য করতে পারেনা দৃশ্যটা।ওর চোখ দুটোও জলে ঝাপসা হয়ে আসে।

“কেন রেশমি কেন?কেন এভাবে আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে গেলে তুমি?চলেই যদি যাবে আমাদের এরকম পরজীবী করে রেখেছিলে কেন?কিকরে মেয়েটা বাকি জীবন মায়ের ভালোবাসা ছাড়া কাটাবে?খুশি হতে পারছো তুমি!!আমাদের কষ্ট দেখে শান্তি পাচ্ছো আদৌ?কেন আগে,আরো আগে এলেনা তুমি?সে রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তোমার বুকে হাত দিয়ে যদি আমি ওই শক্ত জায়গাটা অনুভব না করতাম তুমি যেচে বলতেও না।নিঃশব্দে চলে যেতে।অবশ্য বুঝেই বা কি হলো?এত দেরি হয়ে গেছিল চেষ্টা করেও কিছু করতে তো পারলাম না।যে মেয়েকে একা ছেড়ে আমার কাছে আসলে রাতে উঠে ভয় পাবে ভাবতে তাকে আজ পুরো একা করে দিয়ে চলে গেলে।মা ছাড়া যে ও কিছু বুঝতো না।কিকরে বাঁচাবো ওকে?অনেক কঠিন দায়িত্ব দিয়ে গেলে তুমি,রাইকে সামাজিক করার,আত্মনির্ভর করার।আমি সেই দায়িত্ব একা পারবোনা পালন করতে,তাই হোস্টেলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছি।দেখো তুমি ওকে,প্লিজ দেখো”,জয়ন্তর বিড়বিড়ানি একসময় প্রলাপ হয়।কিন্তু ফিসফিস করে বলা ওর কথা গুলো আত্মমগ্ন রাইয়ের কানে পৌঁছয় না।মোরব্বা হাতে নিয়ে ও অনুভব করার চেষ্টা করে মায়ের স্পর্শ।
মায়ের বানানো খাবারের মধ্যে দিয়ে মা কে ছুঁতে চায় ও।ঘুম ভাঙার পর যে কষ্টটা অনেকটা সহনীয় লাগছিলো,সেটাই আবার ফিরে আসতে থাকে।ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে টেবিলে মুখ গুঁজে দেয় ও।এক হাতে মোরব্বা ধরে অন্য হাত মাথার চারদিক দিয়ে বের দিয়ে ফোঁপাতে থাকে ও।খিদের মুখেও খাবার হাতেই রয়ে যায়,মুখ অবধি পৌঁছয় না।

ক্রমশ….