মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৩

0
559

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#তৃতীয়_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল থাকলে তা কাকতালীয়।)

জয়ি রাতের খাওয়া শেষে রমার সাহায্যে সব কাজ মিটিয়ে যখন বেডরুমে এলো তখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর পাড় করে ফেলেছে। ঋষির ফিরতেই আজ রাত প্রায় দশটা হয়ে গিয়েছিল।ঋষি সারাসন্ধ্যে এত বিজি ছিল জয়ির ফোনও ধরতে পারেনি তখন।
জয়ি ভেবেছিল ও ঘরে যেতে যেতে ঋষি হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে।জয়ন্তর ফোন পেয়ে সেই রাত থাকতে উঠে বেড়িয়ে গিয়েছিল,তারওপর সারাদিনের ধকল,বিকেলে চেম্বার….ক্লান্তি ওকে আজ জয়ির জন্যে অপেক্ষা করতে দেবেনা।
এদিকে জয়ি একটু তাড়াতাড়ি করছিলো,চাইছিল মনের উচাটনটা ঋষির সাথে ভাগ করে নিতে।কিন্তু রাত এগারোটার পর আশাহত হয়ে সব কাজ মিটিয়ে ধীর পায়ে যখন ঘরে এলো ঋষি তখনও ওদের বেডরুমে লাগানো নিজের শখের সোনি স্মার্ট টিভিতে খবর দেখছে।প্রচন্ড অবাক হলো ও।

“কি গো ঘুমোওনি?রাত তো অনেক হলো।তারওপর সারাদিন যা গেল…”,জয়ি কথা মাঝপথে থামিয়ে প্রশ্নচোখে তাকায় ঋষির দিকে।

“না ঘুম আসছেনা আজ।মনটা কিছুতেই হালকা হচ্ছে না।” টিভি থেকে মুখ সরিয়ে জয়ির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় ঋষি।

জয়ি এসে ঋষির পাশে বসে।পিঠে বালিশ ঠেস দিয়ে কোমর অবধি কম্বল চাপা দিয়ে ঋষি আধশোয়া হয়ে খবরের চ্যানেল দেখছিল।আজ যে ওর টিভি দেখায় মন নেই জয়ি ভালো বুঝতে পারছিল।নাহলে অন্যদিন যে লোকটা একটা চ্যানেলে পাঁচমিনিটও স্থির থাকেনা,সে শুধু খবরের চ্যানেল চালিয়ে চুপচাপ বসে!!

“ঋষি বের করে দে মন থেকে কষ্ট গুলো।জানি আমরা ডাক্তার,কিন্তু আমাদেরও যে মন আছে সেটাই সমস্যা।আমি জানি রেশমা শেষ একবছরে তোরও খুব কাছেরজন হয়ে গিয়েছিল।তাছাড়া জয়ন্তর কষ্ট তোকে খুব নাড়া দিয়েছে।চেপে থাকিসনা,যা মন চাইছে বলতে পারিস আমায়।” জয়িদের সম্পর্কের ভিত্তি বন্ধুত্ব,যা আজও ওরা ধরে রেখেছে।গভীর আলোচনা,খুনসুটি বা ঝগড়ায় ওদের পুরোনো সম্বোধন তাই আজও স্বাভাবিক নিয়মে মুখ থেকে বের হয়।
ছেলে বা বাইরের লোকের সামনের ‘তুমি’ সম্বোধন,গভীর আলোচনার সময় অনায়াসে তাই ‘তুই’ হয়ে যায়।

“কি বলবো বল জয়ি!সত্যিটা তো জানতাম,কিন্তু ভাবিনি দিনটা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে।আর আমার স্পেশালাইজেশনে মৃত্যু তো তোদের তুলনায় অনেক বেশি দেখি।শুধু জয়ন্তর সাথে এরকম হওয়াটা হয়তো মানতে সময় লাগছে।রেশমিও এই কমাসে বড্ড কাছের হয়ে গিয়েছিল।খারাপ লাগছে ওই বাচ্ছা মেয়েটার জন্যেও।….”,ঋষির কথা শেষ হয়না,জয়ি কথা শুরু করে দেয়।
“জয়ন্ত ওকে হস্টেলে পাঠিয়ে দেবে।”

“মানে”,সোজা হয়ে বসে জয়ির চোখে চোখ রাখে ঋষি।

জয়ি উঠে জানলার ধারে চলে যায়।পর্দা সরিয়ে বন্ধ জানলার কাঁচ দিয়ে বাইরে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে জয়ন্তর কাছে শোনা ওর পরিকল্পনার কথা।বলতে বলতে গলা ধরে আসে ওর।

ঋষি বিছানা ছেড়ে উঠে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভেঙে পড়া জয়িকে নিজের বুকে টেনে নেয়।
“কষ্ট পাসনা সোনা।আমি জানি রেশমা তোর মনের খুব কাছাকাছি ছিল।ওর মেয়ের প্রতি তোর টান স্বাভাবিক,বিশেষ করে তোর হাতে যেখানে ওর জন্ম।কিন্তু জয়ন্ত ওর বাবা,ওর ডিসিশনে আমাদের কি বলার থাকে বল!”
“আমরা ওকে আমাদের কাছে তো আনতে পারি না ঋষি?রণর সাথে ও মানুষ হবে এখানে।…”,ঋষির বুক থেকে মাথা তুলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পাওয়ার আশায় কথাটা বলেই ফেলে জয়িতা,সারা সন্ধ্যে ভেবে যেটা ওর মাথায় এসেছে।
ঋষি কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনা।অবাক চোখে জয়িতার দিকে তাকায়।
জয়ন্ত ওদের খুব ক্লোজ ছিল,আর রেশমাকেও জয়ি নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসতো।কিন্তু তাই বলে পরের মেয়ের দায়িত্ব!!
“তুই একটু ভেবে দেখ জয়ি,একটা মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া চাট্টিখানি কথা না।আর তাছাড়া জয়ন্ত রাজি হবেই বা কেন?ও না চাইলে তুই জোর করতে পারবি না।আর রাইও যথেষ্ট বড় হয়েছে,ওর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে…রণ আছে বাড়িতে।হঠাৎ একটা মেয়ে বাড়িতে এসে থাকলে ওরও সমস্যা হতে পারে।তাছাড়া দুটো প্রায় সমবয়সী ছেলেমেয়ে একটা বাড়িতে…লোকে কি বলতে কি…”,ঋষি একটানা কথা বলতে বলতে থেমে যায় জয়ির উত্তরে।

“কি বলবে লোকে আবার?তাছাড়া আমাদের সম্বন্ধে বলতে গেলে দশবার ভাববে।আমি আমার ছেলেকে যে শিক্ষা দিয়েছি তার ওপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।আমি তো জোরের কথা বলিনি।ওরা দুজন,মানে জয় আর রাই রাজি থাকলে তবেই আমরা এগোবো।কিন্তু আমরা একবার বলে তো দেখতে পারি।মেয়েটা বড্ড নরম স্বভাবের,হস্টেলের ওই রুক্ষ পরিবেশে ও কোনোভাবে ভালো থাকবেনা।বিশেষ করে ওর মায়ের পরিচয় ওকে ভালো থাকতে দেবে না।ও যে ধরণের মেয়ে,হস্টেল জীবন ওর জন্যে না।তুই রাজি থাকলে আমি জয়ন্তকে কাল বলে দেখবো,অবশ্যই রাইয়ের মত নিয়ে।” জয়ি শেষের কথা গুলো ভাঙা গলায় বলে,ওর মনেহয় রণর কথা ভেবে ঋষি নিজেই রাজি হবে না।

ঋষি ধীরে ধীরে জয়ির মাথায় হাত বুলোতে থাকে।
“আজ অবধি তোর কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি যাইনি, কারণ আমি জানি তুই যা কাজ করিস ভেবে করিস।আমার থেকেও অনেক মাথা ঠান্ডা করে তুই ডিসিশন নিস।আজও তুই যেটা করতে চাইছিস নিশ্চই ভেবেছিস বলেই আমায় বললি।আমি সবসময় তোর সাথে আছি তুই তো জানিস।শুধু একটাই চিন্তা রণ কিভাবে নেবে ব্যাপারটা।ওর মত ছেলে কিছু সমস্যা করবে না আমি জানি।তাও ওকে একটা টাচ দিয়ে রাখিস জয়ন্তকে বলার আগে।”

জয়ি আরো জোরে জড়িয়ে ধরে ঋষিকে।এই ছেলেটা আজ অবধি কোনোদিনও ওর বিরুদ্ধে যায়নি।ওকে যদি কেউ সবরকম ভাবে বিশ্বাস করে সেটা একমাত্র ঋষি।আজও ওর বিশ্বাস,ভরসা ওর ভালোবাসার মতো সতেজ।তাই হয়তো ওদের সম্পর্কটা আজও কোনোভাবে পুরোনো হয়ে যায়নি এতগুলো বছরেও।

ঋষি এবার জয়ির মুখটা তুলে ধরে নিজের মুখের কাছে,”জানিস জয়ি আমি রাইয়ের কষ্টের থেকেও জয়ন্তর কষ্টটা বেশি অনুভব করতে পারছি।আমি তো জীবনটা ভাবতেই পারিনা তোকে ছাড়া।এখনো সেমিনারে কোথাও গেলে তোকে উত্যক্ত করি তোর সব কাজ বন্ধ রেখে আমার সঙ্গে যেতে।আজ সারাদিন মনে হয়েছে জয়ন্ত কিকরে বাঁচবে,কি করে কাটাবে বাকি জীবনটা।ওর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেও আমি শিউরে উঠেছি।পাগল হয়ে যাবো আমি তোকে ছাড়া।তুই আজও আমার বাঁচার অক্সিজেন।যতই যে থাক,তুই না থাকলে আমার পৃথিবী শূন্য।তাই হয়তো জয়ন্তকে দোষ দিতে পারছিনা।কোনো কোনো ছেলে সত্যি অসহায় তাদের স্ত্রীকে ছাড়া।” আরও বুকের কাছে জয়িকে আঁকড়ে ধরে ঋষি।

জয়ন্তর একাকীত্ব ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে।সত্যি তো জয়িকে ছাড়া আজ ও কিছুই বোঝেনা,ওকে সামলে রাখে জয়ি।নিজের ভয় কাটাতে অন্যবারের মতো এবারেও জয়িতে ডুবতে চায় ও।জয়ির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগোয়।জয়িকে বন্ধন মুক্ত করতে করতে নিজেকে ওর সাথে মিশিয়ে দিতে চায়।একমাত্র জয়িকে অনুভব করলে তবেই ওর এধরণের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে।যেকোনো কষ্ট,দুঃখ,ভয় সব কিছু ভুলতে সবসময় এভাবেই ওর অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরে ঋষি।

“রণ উঠে পড়,সাতটা বাজে প্রায়।আজ তোর কোচিং নেই?” জয়ি প্রতিদিনের মত সকালে রণর ঘরে গেল ওকে ডাকতে।
মায়ের গলা কানে যেতে রণর ঘুমের ঘোর কেটে যায়।
আগেরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরলেও মম বড্ড বেশি চুপচাপ ছিল সারাসন্ধ্যে। একদম ভালো লাগেনা ওর মমের এরকম মুড। ওর মা সবসময় হৈচৈ করে,ওকে বকে,ওর সাথে বাড়ি থাকলে আড্ডা মারে…সেটাতেই ও অভ্যস্ত।একমাত্র যেদিন ঠাম্মি মারা যায়,জ্ঞানত মা কে তারপর কিছুদিন চুপচাপ দেখেছিল ও।ঠাম্মি মমের ব্যাকবোন ছিল,আজও মম বলে ঠাম্মি না থাকলে রণকে রেখে আবার কেরিয়ার রিজিউম করা মমের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা,এমনকি দিনে একবার চেম্বার করাও।
আজ আবার পুরোনো গলা শুনে ভালো লাগায় ঘুম ভেঙে যায়।উঠে বসে ও বিছানায়।
“মর্নিং মম।ফিলিং বেটার?” হাসি মুখে রণ প্রশ্ন করে ওর মাকে,জানলার পর্দা সরিয়ে কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
জয়ি রণর কথায় ওর দিকে ফেরে।
“মর্নিং ডার্লিং।না রে মনটা ভালো নেই,আর তাই তোর সাথে কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা বলতে এলাম।”

-“আমার সাথে!!!বলো না মম।তোমায় চুপচাপ দেখতে আমার একদম ভালো লাগেনা।” রণ একহাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বালিশের পাশ থেকে মোটা কালো ফ্রেমের ট্রেন্ডি চশমা নিয়ে চোখে দেয়।বছর খানেক হলো চশমাটা দরকার পড়ছে,প্লাস না মাইনাস পয়েন্ট।
জয়ি মৃদু হেসে ছেলের সিঙ্গল খাটের দিকে এগিয়ে আসে।ওর পাশে বসে মায়ের স্নেহে ওর এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলে,”রণ আমার আর তোর বাবার কলেজের বন্ধু জয়ন্তকে তো তুই দেখেছিস,আর ও আমাদের কতটা কাছের বন্ধু সবটাই তুই জানিস।সেই জয়ন্তর ওয়াইফ রেশমা গতকাল মেটাস্টাটিক ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা গেছে।রেশমা আমার খুব কাছের ছিল,তোর বাবার আন্ডারেই শেষ একবছর ছিল কিন্তু সরকারি হসপিটালে।…”,জয়ি রণর কথায় থামে।

“সরকারি হসপিটালে?”

“হ্যাঁ, রেশমার জন্যে ঋষি স্পেশাল পারমিশন করিয়েছিল,তাও চেনা জানা ছিল বলে আনঅফিসিয়ালি পসিবল হয়েছিল।হ্যাঁ যেটা বলছিলাম,রেশমা ছিল অনাথ মুসলিম একটা মিষ্টি হেল্পফুল মেয়ে,যাকে বিয়ে করে জয়ন্ত পরিবারছাড়া হয়।বুঝতেই পারছিস আজও ওদের এই খারাপ সময়ে কেউ পাশে নেই।” একটু থামে জয়ি।কিন্তু বুঝতে পারে রণ বুঝতে পারছেনা জয়ি কি বলতে চাইছে।

রণর চোখের প্রশ্নের উত্তর দিতেই জয়ি আবার শুরু করে,”রেশমা জয়ন্তর একমাত্র মেয়ে রাই, যার দুনিয়া বলতে ছিল তার মা।রেশমার অতীতের কারণে আমাদের মহান সমাজে ওর বন্ধুও হাতে গোনা।মেয়েটা কোনোভাবেই সামলে উঠতে পারেনি এই আঘাতটা।কাল বিকেলে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছিলাম।আজকের আপডেট এখনো জানিনা,যাবো একটু পড়ে।রণ….তোকে একটা কথা বলার ছিল বাবা”,জয়ি বুঝতে পারেনা রণ কি ভাবে নেবে ওর সিদ্ধান্তটা।তবে নিজের সংস্কার,আর ছেলের বড় মনের ওপর ওর বিশ্বাস ওকে বিষয়টা সিরিয়াসলি নিতে ভরসা দিয়েছে।
রণজয় মুখে কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।এখনো অবধি নতুন কিছু ও শোনেনি মায়ের থেকে,এই ঘটনাটা তো ও নিজেই আন্দাজ করেছিল গতকাল।তাই মাকেই বলতে দেয় ও,”রণ জয়ন্ত রেশমাকে শুধু নিজের পছন্দে বিয়েই করেনি,রেশমা ছিল ওর দুনিয়া।তাই ওকে ছাড়া ওর পুরোনো কোয়ার্টার বা এই শহরে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না।ও তাই নর্থ বেঙ্গলে চাকরি নিয়ে চলে যাবে,আর ক্লাস এইটে পড়া মেয়েটাকে রেখে যাবে হস্টেলে।
বিশ্বাস কর রণ রাইয়ের এখন নিজের লোকের দরকার,ভালোবাসার দরকার,বন্ধুর দরকার।আমি তাই ভেবেছি…..”,জয়ি আবার থামে।

“কি ভেবেছো মম? রাইকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবে?” রণ জয়ির কথা থামতেই সেই কথার সূত্র ধরে বলে।

চমকে ওঠে জয়ি।
“রণ…তুই কিকরে…তোর কোনো আপত্তি?” কথা হারিয়ে যায় ওর।

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে রণ।পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় জানলার কাছে,যেখানে একটু আগে জয়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
“মম আমি জানি তুমি কতটা সফট মাইন্ডেড।তোমার কথার ধরণ,জয়ন্ত আঙ্কেলের মেয়ের কথা বলতে গিয়ে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাওয়া,সব মিলিয়ে মনে হলো এটাই তুমি ভাবছো।কিন্তু মম,তুমি কি ঠিক ভাবছো?”ও আর বলেনা গতকাল রাতে মা বাবার ঘরের সামনে দিয়ে নিচে যাচ্ছিল যখন জলের বোতল আনতে,শুনতে পেয়েছিল ওদের আলোচনা।না দাঁড়ায়নি ও ওদের ঘরের সামনে,কিন্তু মমের কথাটা অ্যাকসিডেন্টলি ওর কানে চলে এসেছিল।রাতে বিষয়টা নিয়ে ভেবেওছে ও।

“কেন একথা বলছিস রণ? তুই তো দেখিসনি রাইকে।বুঝতে পারছিস না কি অসহায় অবস্থা মেয়েটার।মা ছাড়া কিছু বুঝতো না।জয়ন্তর সাথেও সেই আত্মিক সম্পর্ক নেই মনে হলো।কাল সারাদিন আমায় আঁকড়ে ছিল,আমার মধ্যে ওর মা’কে খুঁজছিল বারবার।” জয়ি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।

“বুঝতে পারছি মম।কিন্তু একটা পরের মেয়ের রেস্পন্সিবিলিটি নেওয়া ,আজকের ডেটে, একটু বাড়াবাড়ি নয় কি? আর যদি মেয়েটা পরে,এখানে এসে থাকার পর ভুল কিছু করে ফিউচারে, সব রেস্পন্সিবিলিটি কিন্তু তোমার ওপর এসে পড়বে।তোমাদের বন্ধুর মেয়ে,ওর মা খুব ভালো ছিলেন,মেয়েটাও খুব ভালো,সব মানছি।কিন্তু ফিউচারের কথা কে বলতে পারে বলো! তার ওপর ওর বাবাও কাছে থাকবেনা।খুব বড় রেস্পন্সিবিলিটি কিন্তু।থিংক টোয়াইস।” রণ যে বাস্তববাদী সেটা জয়ির জানা ছিল,কিন্তু এত পরিণত চিন্তাভাবনা ও ভাবেনি কখনো।সারাক্ষন হইহল্লা,হাসি মস্করা আর নিজের জগৎ নিয়েই থাকে ও।কিন্তু ওর কথা গুলো সত্যি ভাবার মতোই।

চুপ করে থাকে জয়ি।কি উত্তর দেবে,ভুল তো কিছু বলেনি রণ। ঋষি এইজন্যই বলেছিল ওর সাথে কথা বলতে।আসলে জয়ি রণর বেস্ট ফ্রেন্ড,কিন্তু যা কিছু সিরিয়াস আলোচনা সবই ওর বাবার সাথে।তাই হয়তো বাবা ছেলেকে বোঝে বেশি।
রণজয় ঘুরে তাকায় মায়ের দিকে,আপসেট হয়ে বসে আছে মেঝের দিকে চেয়ে।দূর!তার সব বিষয়ে কনফিডেন্ট মমকে এভাবে দেখতে একটুও ভালো লাগেনা ওর।জানলা ছেড়ে মায়ের কাছে ফিরে যায় আবার।
“কি হলো মম! আপসেট হচ্ছো কেন?লিসেন,তুমি কদিন সময় নাও।পরপর কদিন যাও জয়ন্ত আঙ্কেলের কোয়ার্টারে।আরো কাছ থেকে দেখো ওঁর মেয়েকে।তারপর তুমি যা ভালো বুঝবে কোরো।আমি আর ড্যাড সবসময় তোমার সাথে আছি।আর আঙ্কেলের রাজি হওয়ার একটা ব্যাপারও তো আছে।সো টেক য়্যূর টাইম এন্ড মেক য়্যূর ডিসিশন।” রণ নিজের হাত দুটো রাখে মায়ের কোলে রাখা দুটো হাতের ওপর।সামান্য চাপ দেয়,চোখের ইশারায় দেয় ভরসা।

ছেলের শেষ কথা গুলোয় হাসি ফোটে জয়ির মুখে।
“থ্যাংক্স রণ।তুই সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছিস আমাদের সামলানোর জন্যে”,উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের চুলগুলো ঘেঁটে দেয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে,”নিচে আয়।আজ ব্রেকফাস্টে সারপ্রাইজ আছে”।

হেসে ফেলে রণ,ও যে ওপরে বসেই লুচি ভাজার গন্ধ পাচ্ছে মম বুঝতেও পারেনা।

কলকাতা শহরের নামকরা ক্যান্সার স্পেশালিস্ট হসপিটালে সকালের রাউন্ড সেরে আউটডোরে যখন এলো ঋষি ঘড়িতে তখন বেলা প্রায় দশটা।শীত প্রায় যাওয়ার মুখে।রেশমা চলে গেছে প্রায় মাস দুই হয়ে গেল।ঋষি সময় পায়না রেগুলার জয়ন্তদের খোঁজ নেওয়ার কিন্তু জয়িতা ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহে অন্তত দুদিন রাইমার কাছে যায়।ঋষি বুঝতে পারে মেয়েটার ওপর ওর অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছে।
সপ্তাহের আজকের দিনটা হসপিটালের চেম্বারেই বসে ঋষি।এখানে সকালে দুদিন,আর সন্ধ্যের সময় দুদিন ওর চেম্বার।বাকিদিন বাইরে দু তিন জায়গায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেম্বার করে।একমাত্র রবিবার সকালে ও শহরাঞ্চলের দিকে একটা এনজিওর হয়ে বিনা পয়সায় রুগী দেখে।ওখানকার রুগীদের দরকারে সরকারি হসপিটালে ভর্তি করার ব্যবস্থাও করে।খুব এমের্জেন্সি হলে হসপিটালের স্পেশাল পারমিশনে নিজেও যায় রেগুলার দেখতে।সারাসপ্তাহ এভাবেই ছোটাছুটিতে কেটে যায় ওর।শেষ একবছর এর মাঝেও রেশমার আলাদা করে ও কেয়ার নিয়েছে,বিশেষ পারমিশনে সময় মতো সরকারি হসপিটালে গিয়ে দেখেও এসেছে,দুমাস হলো ওই দায় থেকে মুক্ত হয়ে গেছে।
আজ চেম্বারে একজন ব্রেস্ট ক্যান্সারের রুগী এলো,বছর পঁয়ত্রিশ বয়স,স্টেজ টু ব্রেস্ট ক্যান্সার।ঋষি জানে সময় আছে।সার্জারি করে কেমো আর রেডিয়েশন থেরাপিতে সুস্থ হওয়ার চান্স অনেকটাই।শুধু দেখতে হবে ধরণটা কি,কতদূর ছড়িয়েছ।কোন ধরণের সার্জারি ঠিকঠাক,মাসটেকটমি(Mastectomy) নাকি ল্যাম্পেকটমি (lampectomy),অর্থাৎ পুরো ব্রেস্টটা বাদ যাবে নাকি টিউমার সহ ক্যান্সারাস সেল আর কিছু অংশ বাদ দিলেই হবে? পরীক্ষা গুলো করে আনুক আগে,তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
আসলে অনেকে রেডিয়েশন থেরাপি অ্যাভয়েড করতে চায়,তাদের ক্ষেত্রে পুরো ব্রেস্ট বাদ দিতে হয়।সবার আগে টেস্ট করতে হবে ক্যান্সারটা ব্রেস্টের বাইরে ছড়িয়েছে কিনা।টেস্ট রিপোর্ট দেখে আলোচনা করবে ঠিক করে ও।

“আসবো স্যার?” ঋষির চিন্তায় ছেদ পরে। চেম্বারের দরজা ফাঁক করে মুখ বাড়াচ্ছে একটা মেয়ে,কোলে বছর দু-তিনের এক বাচ্চা,মনে হচ্ছে ছেলে।ভদ্রমহিলার পিছন পিছন ভদ্রলোক এসেও ঢুকলেন।
ওঁর কাছে যারা আসে তাদের মুখে কোনোদিনই কোনো উছ্বাস থাকেনা।তবে এই মহিলার মুখ অত্যাধিক শুকনো লাগলো,রুগী কি তাহলে মেয়েটাই?বোঝার চেষ্টা করলো ডাক্তার মুখার্জী।

ইশারায় ডাক্তারের দেখানো চেয়ারে বসে যুগলে,মেয়েটি ঘুমন্ত শিশুটাকে কোলে শুইয়ে নেয়।
বাচ্ছাটার মুখের দিকে তাকিয়ে এক অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ডাক্তারের পোশাক পড়া, বাইরে থেকে কঠিন অভিব্যক্তি সম্পন্ন ঋষির।
রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকেই তাকায় ঋষি।
-“নাম বলুন।আর কার রেফারেন্সে এসেছেন তার নামও।তারপর কেস হিস্ট্রি শুনবো।”
-“রণজয়,রণজয় সাঁতরা, বয়স দুবছর তিন মাস।” শুকনো গলায়, নিষ্প্রাণ চোখে উত্তর দেয় ভদ্রলোক।

নামটা লিখতে গিয়ে হাতটা একটু কেঁপে যায় ঋষির।বয়স শুনে বুঝে যায় ওর অনুমানই সত্যি।মনটা খারাপ হয় আরও একবার।

বাচ্ছাটার বাবার নাম সুজয় সাঁতরা,সেই সংক্ষেপে বলে ঘটনা।বাচ্ছাটার মাস দুই আগে সন্ধ্যের পর জ্বর আসতো।প্রথমে ছোট থেকে লোকাল যে পেডিয়াট্রিসিয়ান দেখে তার কাছে নিয়ে যেতে নরমাল ঠান্ডা লাগার চিকিৎসা করেন। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়না।উল্টে কিছুদিনের মধ্যে গায়ে লাল লাল দাগ দেখতে পায় ওর মা।বাচ্ছাটার খাওয়া প্রায় একদম বন্ধ হয়ে যায়।খুব ক্লান্ত হয়ে থাকতো,আগের চঞ্চল ছটফটে বাচ্ছা নেতিয়ে যেতে থাকে।এর মধ্যে একদিন নাক দিয়ে রক্ত বের হয়,পায়েও যন্ত্রনা হত বলে পা ছুঁড়ে কাঁদতো।এরপর মাড়িতে রক্ত দেখে ওরা অন্য এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।সেই ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দেন,তারপর রিপোর্ট দেখেই বাচ্ছাটাকে এখানে নিয়ে আসার কথা বলেন।

ঋষি সুজয়ের বাড়িয়ে দেওয়া রিপোর্টে চোখ বোলায়।ডাব্লুবিসি(WBC-white blood cell)কাউন্ট অত্যাধিক বেড়ে গেছে।সমস্ত প্রাইমারি রিপোর্ট দেখে ঋষি বুঝতে পারে রোগটা, অ্যাকিউট লিম্ফোব্ল্যাস্টিক লিউকেমিয়া(acute lymphoblastic leukemia)।মুখে কিছু বলে না ও,আরো কয়েকটা টেস্ট লিখে দেয় শিওর হতে।
শুধু সুজয়দের দিকে তাকিয়ে বলে,”প্রেগনেন্ট অবস্থায় এক্সরে বা রেডিয়েশন হয়েছিল মায়ের?”

সুজয় চিন্তা করতে করতে ওর স্ত্রী বলে দেয়,”হ্যাঁ ডান হাতের কব্জিতে খুব জোরে আঘাত লাগে,তখন পাঁচমাসের প্রেগনেন্ট।এক্সরে করিয়ে নিয়েছিলাম একটা।”
অবাক সুজয় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কই আমার মনে পড়ছে না তো?”
“বাপের বাড়ি ছিলাম।তোমায় বলিনি চিন্তা করবে বলে।ওখানে যে গাইনিকোলজিস্ট আমায় দেখতেন,বকবকিও করেছিলেন।” নিচু স্বরে বলে মেয়েটা।

কথা বাড়ায় না ঋষি।হয়তো ওটাই কারণ নাও হতে পারে,আবার হয়তো ওটাই কারণ।

ও সবার আগে জানতে চায় ক্যান্সারটা কোন স্টেজে আছে।প্রাইমারি দু একটা ওষুধ আর টেস্ট লিখে দিন সাত পরে আবার রিপোর্ট দিতে বলে।

ডাক্তারদের,বিশেষ করে অঙ্কোলজিস্টদের মন নরম হলে এই প্রফেশনে টিকে থাকা সম্ভব নয়।আমাদের দেশে এখনও এই রোগে অন্তিম ফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেগেটিভ হয়।ঋষি সবই জানে।এমবিবিএস করার পর এমএস করার সময় জয়ি বারবার ওকে সতর্ক করেছিল,কিন্তু নিজের ঠাকুমাকে ওই রোগে হারিয়েছিল বলেই হয়তো ওর প্রথম থেকেই টার্গেট ছিল অঙ্কোলজিস্ট হওয়ার।
বসে বসে সবে ভাবছে আজকের শেষ আর একজন রোগী বাকি ,সেই সময় দরজায় নক করে ঘরে এসে ঢোকে অনেক বছরের পুরনো রোগী মিসেস দাশগুপ্ত।ওঁকে দেখেই ডাক্তার ঋষি মুখার্জীর মন ভালো হয়ে যায়।মুখ ভরে ওঠে হাসিতে।পুরোনো পরিচিতকে আমন্ত্রণ জানানোর ভাষায় বছর পঞ্চান্নর আরতি দাশগুপ্তকে দেখে বলে ওঠে,”আসুন আসুন মিসেস দাশগুপ্ত।বলুন কেমন আছেন?”

ভাস্কর আজ বেশ অনেক বছর হয়ে গেল জয়িতার গাড়ি চালাচ্ছে,তাই ড্রাইভার শুধু না নিজের ছোটভাইয়ের মতোই সম্পর্ক হয়ে গেছে ওর সাথে।ওর হাতে স্টিয়ারিং থাকলে জয়ি গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে অনায়াসে হারিয়ে যায় নিজের মনরাজ্যে।আজও সেরকমই চিন্তার জগতে ঘুরছিল ও,যার সিংহভাগ জুড়ে ছিল রাই।

রেশমা চলে যাওয়ার পর নিয়মিত রাইয়ের খোঁজ নিতে যেত জয়ি।মাঝে দিন পনেরো যাওয়া হয়নি রণর বোর্ড এক্সামের জন্যে।জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা,জয়ি চেয়েছিল ছেলের সাথে থাকতে।কাল ওর পরীক্ষা শেষ হয়েছে,তাই আজ সকালের চেম্বার শেষ করে বাড়ি ফিরেই ও জয়ন্তর কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।
রাইয়ের স্কুল ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড,ওদের পরীক্ষা এবার শুরু হবে।শেষবার জয়ি জেনে এসেছিল ওর থেকে।

মেয়েটার ওপর একটা মায়া পরে গেছে,যেতে না পারলেও দিনে একবার ফোন ও করেছে নিয়মিত।আজ রাইয়ের পছন্দের ইলিশ মাছ হয়েছিল লাঞ্চে, ওর আর জয়ন্তর জন্যে টিফিন বক্সে ভরে নিয়ে যাচ্ছে ও।মেয়েটার মুখে হাসি তো আজকাল আসেইনা,যদি একটু হলেও আনন্দ পায়।

“কিরে রাই কি করছিস?” মিনুকে টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে সোজা রাইয়ের ঘরে চলে আসে জয়ি।ওদের তিনজনের রাতের খাওয়ার জন্য ইলিশ মাছ এনেছে শুনে মিনুও খুশি হয়েছে খুব।মিনুর মুখের হাসিটা জয়ির মনেও ছড়িয়ে আছে।

বিছানায় বসে শেষ বিকেলের আলোতে মন দিয়ে কিছু লিখছিল রাইমা।জয়ির গলার আওয়াজে তাড়াতাড়ি লেখা বন্ধ করে তাকায়।জয়িকে দেখে মুখটা উজ্জ্বল হয় অল্প।
আজকাল আবেগ,আনন্দ ওর সেভাবে আসেনা,তবে জয়ি আন্টি আসলে মনটা খুব ভালো হয়ে যায়।মা কে মিস করাটা কিছুটা কমে আন্টিকে দেখে।
বিছানা থেকে নেমে ওর পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টানতে যায় ও আন্টির জন্যে, কিন্তু জয়ি বাধা দেয়।
“কি রে চেয়ার টানছিস কেন?তোর বিছানায় বসতে দিবিনা?আমি কিন্তু বাড়ি থেকে চান করে ফ্রেস হয়ে এসেছি”,হেসে বলে ও।
“দূর আন্টি কি যে বল।তোমার যেখানে খুশি বসো।” আবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে ও,জয়িও ওর পাশে গিয়ে বসে।

“চুল আঁচরাসনি কেন রাই?এত সুন্দর চুল তোর।যত্ন করিসনা।” রাইয়ের এলোমেলো চুলগুলো হাতে করে ঠিক করতে না পেরে জয়ি উঠে যায় ড্রেসিং টেবিলের কাছে,চিরুনি খোঁজার অভিপ্রায়।
একটা চিরুনি নিয়ে ফিরে এসে দেখে রাইয়ের চোখ ছলছল করছে।জয়িতার বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর কথাগুলো মেয়েটার মনে আবার কষ্ট তৈরি করেছে।
আসলে জয়ির একটা মেয়ের খুব শখ ছিল,কিন্তু কমপ্লিকেসির জন্যে সেকেন্ড ইস্যু নিতে পারেনি।ভেবেছিল রণ একটু বড় হলে একটা মেয়ে দত্তক নেবে,কিন্তু দিনগুলো কোথা দিয়ে যে কেটে গেল আজ আর হিসেব করতেই পারেনা।
জয়ি চিরুনি নামিয়ে রেখে রাই কে বুকে জড়িয়ে ধরে।
“এই পাগলী মেয়ে আবার মন খারাপ করে।আমি আছি তো।তোর বাবা আছে।…”

“আন্টি বাবা তোমায় বলেছে আমায় হস্টেলে যেতে হবে?বাবা নর্থ বেঙ্গলে কোনো প্রত্যন্ত জায়গার হাসপাতালে বদলি হয়ে যাচ্ছে।ওখানে আমার বোর্ডের স্কুল নেই,তাই শিলিগুড়ির দিকে কোনো আবাসিক স্কুলে আমার অ্যাডমিশনের চেষ্টা করছে।” জয়ির বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ধরা গলায় বলে রাইমা।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেনা জয়িতা।ও ভেবেছিল এই দুমাসে জয়ন্ত হয়তো সামলে নিয়েছে,মন ঠিক করে ও শেষ অবধি রাইকে নিজের থেকে দূর করতে পারবেনা।কিন্তু রাইয়ের কথায় ও বুঝতে পারে ওর ধারণা ভুল ছিল।

“তুই হস্টেলে যেতে চাসনা রাই?” জয়িতা ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে।

চুপ করে থাকে মেয়েটা বুকের মধ্যে।জয়ি আস্তে আস্তে ওর মুখটা তুলে ধরে,”কি রে বল না আমায়?”

বয়সের তুলনায় এখনো বাইরের জগৎ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ রাই বলে,”আমার ওখানে ভালো বন্ধু হবে আন্টি?এখানকার স্কুলে,কোয়ার্টারে হাতে গোনা দু চারজন আমার সাথে কথা বলে।মা ই ছিল আমার ফ্রেন্ড,ফিলোজাফর, গাইড।ওখানে সবাই অ্যাক্সেপ্ট করবে আমায়?” সবার ধীরে ধীরে জয়ির বুকে মাথা ঠেকায় রাই,যেভাবে রেশমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে আদর খেত।মা কে প্রতি মুহূর্তে মিস করতে থাকা রাই জয়ি আন্টির মধ্যে এক অদ্ভুত মা মা ভাব অনুভব করে।মা মা গন্ধটা যেন আন্টির গায়েও আছে মনেহয়।

এবার জয়ি চুপ করে থাকে।দুজনের মাঝের নীরবতা যেন বলে যায় অনেক না বলা কথা।এভাবে কয়েক মুহূর্ত কাটার পর জয়ি খুব ধীরে ধীরে বলে,”রাই আমার কাছে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি? যদি তুই চাস আমি তোর বাবার সাথে কথা বলবো।কিন্তু তোকে তার আগে একটা কথা দিতে হবে।”
চমকে উঠে রাই মাথা তুলে তাকায় জয়িতার মুখের দিকে।
“তুমি আমায় কেন রাখবে আন্টি?আমার বাবা’ই আমার দায়িত্ব নিতে পারবে না,তুমি কেন নেবে বলো?”

রাইয়ের মনের গভীরে অভিমান ওর একটা কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় জয়ির কাছে।
“রাই, তুই ভুল বুঝছিস তোর বাবা কে? ও আসলে খুব ভেঙে পড়েছে, তাই এখানে তোর মায়ের স্মৃতি থেকে দূরে যেতে চাইছে।”

“কিন্তু একবারও ভাবছেনা আমার কথা।মা চলে যাওয়ায় এমনি আমি অনেক একা হয়ে গেছি।এরপর বাবাও দূরে চলে গেলে আমার কতটা একা লাগবে বাবা ভাবেনি আন্টি।মা কে হারিয়ে বাবাকে আমার বড্ড দরকার ছিল,সেই বাবা’ই….”,আবার গলা বুজে আসে রাইমার।

“রাই সবাই সব পারেনা মা।তোর বাবা একটু নরম মনের,সে তোর মায়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না।ওর কিছুটা সময় দরকার।তুই ছাড়া ওর আর কেই বা রইলো বল”,জয়ির কথায় উত্তর করেনা রাইমা।

“আমি রেশমা চলে যাওয়ার পরের দিন থেকে ভেবেছি তোকে নিজের কাছে নিয়ে যাই।কিন্তু তোর মত,তোর বাবার মত এগুলো জানা আগে দরকার ছিল।বিশেষ করে তুই চাস কিনা যেতে সেটা আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট।আবার সমস্যা হলো…রাই আমি চাই তুই তোর মত করে বড় হ,কিন্তু রেশমার অমূল্য ধন তুই,হস্টেলে কেমন থাকবি সেটাও বুঝতে পারছিনা।আচ্ছা রাই আমি তোর দায়িত্ব নিলে কোনোদিন আমায় ছোট করে দিবি না তো মা? পরে কোনোদিনও তোর কোনো কাজের জন্যে তোর বাবার কাছে আমায় লজ্জা পেতে হবে না তো? জানিস তো একটা মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া খুব চাপের,কিন্তু আমি জানি রেশমার হাতে করে বড় হওয়া মেয়ে কোনোদিনও ভুল করবে না।আমি কি বলছি বুঝতে পারছিস তো রাই?” জয়ি মনের উদ্বেগটা ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারেনা।
রাইকে হস্টেলে পাঠাতে মন চায়না, আবার রণর সেদিনের কথা গুলোও ওড়াতে পারেনা।একদিকে মমত্ব,দায়িত্ব আর অন্যদিকে কঠোর বাস্তব যেটা হয়তো দুর্ভাবনায় রয়ে যাবে,ভবিষ্যতে বাস্তব নাও হতে পারে।জয়ি কি করবে বুঝতে পারেনা।তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় চাপিয়ে দেয় রাইমার ওপর।

ক্লাস এইটে পড়া মেয়েটার বাইরের অভিজ্ঞতা ভালো না।তাই অনিশ্চিত হস্টেলেজীবন ওকে ভয় পাওয়াচ্ছে।ও জানেনা কেন শেষ দুমাস জয়ি আন্টি ওর সবচেয়ে ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।জয়ির আদর,স্নেহ ওকে ওর মায়ের কথা মনে করায়, কিন্তু অদ্ভুত ভালোলাগা ওর মনে ছেয়ে থাকে।
ও চুপ করে আছে দেখে জয়ি ওর হাত দুটো ধরে আবার জিজ্ঞেস করে,”বল রাই মুখ ডোবাবি না আমার?আমি তো বাড়িতে সারাক্ষন থাকিনা।রণ কেও ছেড়ে ছেড়ে,কিন্তু বিশ্বাস রেখে মানুষ করেছি।ও কোনোদিনও বিশ্বাস ভাঙেনি।তুই আমায় শুধু কথা দে, তুইও কোনোদিন সেই বিশ্বাস ভাঙবি না?”

“আন্টি আমার মা’ই আমার দুনিয়া ছিল।কখনো কিছু লুকোইনি তার কাছে।তুমিও দেখছো দুমাস,আমি শুধু এটাই বলবো আমার মায়ের আদর্শে আমি মানুষ।এবার তুমি বুঝে নাও”,রাইমা বলতে পারেনা বিশ্বাস ভাঙতে আমি শিখিনি আন্টি।আর ভালোবাসার কাঙাল আমি, তাই ভাবতে পারিনা কারোর দেওয়া ভালোবাসা আমি অবজ্ঞা করবো।
হস্টেলে যেতে ওর সমস্যা নেই, কিন্তু ওর স্কুলে ও অনেক উপেক্ষা পেয়েছে,তখন সামলাতো মা।দিনের শেষে সব গল্প এসে করতো মায়ের সাথে।সুন্দর করে ভালোবেসে মা বুঝিয়ে দিত এমনভাবে সারাদিনের মন খারাপ মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে যেত।
ওর মনে একটা ভয় ঢুকেছে,একাকিত্বের ভয়।যে ভয় অনেকের মাঝে থেকেও উপেক্ষা থেকে আসে।তাই ওর ভাঙা মন নিয়ে ও যেতে ভয় পাচ্ছে কোনো প্রতিকূল পরিবেশে।
জটিলতা আজও রাইমা কে ছোঁয়েনি,তাই অনাত্মীয় জয়িতার বাড়ি গিয়ে থাকা ওর কাছে অনেক শান্তির লাগছে,এমনকি বাবার কাছে থাকার চেয়েও যেন বেশি শান্তি লাগছে ওর।জয়িতার স্পর্শে ওর মনে যে ভরসা জন্মেছে সেটাই ওকে অজানা এক আনন্দ দিচ্ছে সারাক্ষন আন্টির সংস্পর্শে থাকতে পারবে ভেবে।অন্যের বাড়ি গিয়ে থাকলে আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হবে সেটা ওর অনুভূতিতে নেই তার কারণ জয়িতা নিজে।ওর ভালোবাসা রাইমাকে ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করিয়েছে।রেশমার শূন্যস্থানটা ও পূরণ করতে হয়তো পারবে না।কিন্তু রাইয়ের মনের এখন সবচেয়ে কাছের জন হয়ে উঠেছে ও।ছোট মেয়েটা মা কে যে আশ্রয়টা করতো,সেটা খুঁজে পেয়েছে জয়িতা আন্টির মধ্যে।হস্টেলের অজানা পরিবেশের থেকে জয়িতার বাড়ি ওকে মনে একটা আরাম দিচ্ছে।

জয়ি উঠে পড়ে রাইয়ের বিছানা ছেড়ে।
“ঠিক বলছিস রাই।তুই রেশমার আদর্শ,সংস্কারে মানুষ।তুই বিশ্বাস ভাঙতে শিখিসনি।আমি তোর বাবার সাথে কথা বলবো,আজই।”
রাইয়ের উজ্জ্বল মুখ ওকে বুঝিয়ে দেয় হস্টেলের পরিবেশ ওকে কতটা অশান্তি আর কষ্টে রেখেছিলো।রাইমার মুখের হাসিতে ওর মনও অনেক শান্ত হয়।ভবিষ্যতে কি হবে তখন দেখা যাবে,রণ কে বুঝিয়ে বললে ও ঠিক বুঝবে।আর ঋষি আছে ওর সবচেয়ে বড় সাপোর্টার,ও ঠিক সবটা সামলে নেবে।চিন্তা শুধু জয়ন্তকে নিয়ে।আত্মসম্মানী বন্ধুটা কি এই সিদ্ধান্ত খুশিমনে মানবে?ও না চাইলে জয়িতা কিছুই করতে পারবে না।ওই একটা চিন্তা এই খুশির মুহূর্তে কাঁটা হয়ে ওর মনে বিঁধে থাকে।অপেক্ষা করতে থাকে ও জয়ন্ত ফেরার।

ক্রমশ….