মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৪

0
486

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#চতুর্থ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল থাকলে তা কাকতালীয়।)

আজ রাতের খাওয়ার টেবিলে জয়িতা একটু বেশি চুপচাপ ছিল,কেন কি চিন্তা করছিল এক মনে রণ খেয়াল করলেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি আগ বাড়িয়ে।ও জানে মা আজ জয়ন্ত আঙ্কেলের বাড়ি গেছিল,তাই ওখানকার ভাবনায় চুপ ছিল বলেই ও ধরে নিলো।

রণ আর ঋষি নিজেদের মধ্যে টুকটাক আলোচনা করতে করতে খাচ্ছিল,মূল বিষয় ছিল রণর ভবিষ্যৎ।মেধাবী রণর নিজের পছন্দ ছোট থেকেই স্থির ছিল,ও সর্বদা ভাবতো মা-বাবার মত ডাক্তার হবে।জয়ি বা ঋষি কখনোই ওর ওপর নিজেদের চিন্তা চাপিয়ে দেয়নি।তবে বাবার মত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বা মায়ের মতো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ না,ওর ইচ্ছা ছিল সম্পূর্ণ অন্য,সেটা নিয়ে ও কোনোদিনই ডিটেইলসে মা বাবার সাথে কিছু শেয়ার করেনি।আজও বাবার কথা শুনলেও নিজের লক্ষ্যটা চেপেই রাখলো।তবে ঋষি বা জয়ি এক্ষেত্রে পুরোটাই ছেড়ে রেখেছে ওর ওপর,ওরাও কোনোদিন কিছু জোর করবে না তা জানে রণ।

খাওয়া শেষে রণ উঠতে যাবে হঠাৎ ঋষি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,” ওই দেখ ঘটনাটা তোকে বলবো,আর বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম।বস রণ তোকে আজ একটা ভালো ঘটনা শোনাই,পজিটিভ ঘটনা।তোর তো ধারণা আমার এমন একটা সাবজেক্ট খালি মৃত্যু আর নেগেটিভ ঘটনা,পজিটিভও প্রচুর আছে।”

জয়িতা ঋষির কথা শেষ হলে বলে,”কোন ঘটনার কথা বলছো তুমি?”

“আরে মিসেস দাশগুপ্তর কথা।আমরা যখন চেন্নাইতে ছিলাম কলকাতা থেকে গেছিলেন,স্টমাক ক্যান্সার,মনে পড়ছে তোমার?” ঋষি মনে করানোর ভঙ্গিতে বলে।

কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে জয়িতা ভাবে,তারপর ভ্রু তুলে ও নিজেও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে,”ও হ্যাঁ হ্যাঁ চেতনা দাশগুপ্ত।”

“তোমরা চেন্নাইতে ছিলে মানে?” রণ অবাক হয়ে তাকায় দুজনের দিকে।

“আরে তোকে বলেছিলাম না বিয়ের পরেই তোর বাবা চেন্নাইয়ের হসপিটালে প্র্যাকটিসের চান্স পায়,বিয়ের আগেই পরীক্ষা দিয়েছিল।ওখানকার ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট কিছুটা উন্নত।মুম্বইয়ের টাটা মেডিকেল সেন্টার নাহলে চেন্নাই যেকোনো একজায়গায় তোর বাবা কাজ করার এক্সপেরিয়েন্স নিতে অ্যাপ্লাই করে।চেন্নায়ের অপরচুনিটি আগে আসে।আমিও গেছিলাম,একটা প্রাইভেট হসপিটালে প্র্যাকটিস করতাম।তারপর তোর আসার খবর আর কলকাতা থেকে দূরে থাকতে দিলো না।তোর ঠাম্মির উৎকণ্ঠা,দিম্মার বকাঝকা ফিরিয়ে আনলো এখানে”,জয়িতা ছেলেকে মনে করায়।

“ও হ্যাঁ একবার বলেছিলে”,রণ মনে পড়ার ভঙ্গিতে সায় দেয়।তারপর বাবার দিকে ফিরে বলে,”কি ঘটনা বলো?”

“আরে তখন সবে মাস্টার্স করে বিয়ে করে চেন্নাই গেছি।প্রথম প্রথম মিথ্যে বলবনা সারাদিন এই হাহাকার মনে খুব চাপ তৈরি করতো, তারওপর ছিল ভাষার সমস্যা।তবে আমি আর তোর মা একমাসের মধ্যে কাজ চালানো ভাষা শিখে নিয়েছিলাম।কলকাতা থেকে ভালোই রুগী ওখানে যেত। যে কটায় পজিটিভ রেজাল্ট আসতো মাক্সিমাম ব্রেস্ট ক্যান্সার, বাকি গুলো আর্লি স্টেজে এলে সারভাইভ করে যেত,কিন্তু আয়ু কতটা বাড়তো জানিনা।অনেকে খরচ টানতে না পেরে মাঝ রাস্তায় কলকাতায় ফিরে এসেছে এমনও কেস দেখেছি।এর মধ্যে একদিন একটা কেস এলো।এই চেতনা দাশগুপ্ত।বছর চল্লিশ তখন বয়স,সেকেন্ড স্টেজে স্টমাক ক্যান্সার ধরা পড়ে।কি ভাগ্য ধরা পড়েছিল।আর পাঁচটা বাঙালি মায়ের মতোই অ্যান্টাসিড খেত পেটে পেইন হলেই,ভাবতো গ্যাস থেকে হচ্ছে।কিন্তু যখন দেখলো অ্যান্টাসিডে কাজ হচ্ছেনা একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এর কাছে যায়।ডক্টর আল্ট্রাসাউন্ড আর এন্ডোস্কোপি করাতেই ধরা পড়ে রোগটা।ভদ্রমহিলার তখন দুটো ছেলের ছোটটা সবে ক্লাস সেভেনে পড়ে।দেরি করেননি ওঁর হাজব্যান্ড,চেন্নাই নিয়ে চলে যান।ভদ্রমহিলাকে না জানিয়েই ট্রিটমেন্ট শুরু হয়।আমি ছিলাম ডাক্তার টিমে।অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয় স্টমাকের বেশ খানিকটা।এরপর কেমো শুরুর আগে সত্যিটা জানানো হয় পেশেন্টকে।খুব শক্ত মনের ভদ্রমহিলা,প্রথমে একটু কান্নাকাটি করলেও খুব স্পোর্টিংলি নেন সবটা।কো-অপারেট করেন খুব।ছ’টা কেমো লাগে।তারপর প্রায় মাস চারেক পর বাড়ি ফিরে যান।বাঙালি বলে আমার সাথে একটা গুড রিলেশন তৈরি হয়েছিল।এখনো বছরে একবার চেকআপ করাতে হয়।প্রথম দুবার চেন্নাই গেলেও পরে আমার কাছেই চেকআপে আসা শুরু করেন।জীবনে কিছু রেস্ট্রিকশন আছে,কিন্তু আজ বছর ষোল সতেরো হয়ে গেল ঠিকই তো আছেন।
আসলে কি বলতো সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে চিকিৎসা হলে কিন্তু এই রোগটার সাথে লড়া সম্ভব।কিন্তু সমস্যা হলো মানুষের নিজের সব ব্যাপারে ডাক্তারি।জ্বর হলে কজন মানুষ ডাক্তারের কাছে প্রথমেই যায় বলতো?মানুষের নেগলিজেন্স মানুষকে পরে ভোগায়।বুঝলি?” ঋষির কথায় রণ সমর্থনের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে।

জয়ি অন্যমনস্ক হয়ে বলে,”হমম সবাই যদি সামান্য সচেতন হতো তাহলে রেশমির মত অল্প বয়সে সংসার ছেড়ে কাউকে যেতে হতোনা।মেয়েটারও এই অসহায় অবস্থা হতোনা”।

ঋষি,রণ দুজনেই জয়ির মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট দেখতে পায় ওর চোখে।

“তুমি আজ গেছিলে তো,কি বললো রাই?এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে?” ঋষি প্রশ্ন করলেও রণ মনে মনে উত্তরের আশায় কান খাড়া করে থাকে।মমকে ও বারণ করার পর মম জয়ন্ত আঙ্কেলের মেয়েকে এবাড়িতে আনার কথা আর বলেনি,এমনকি এবিষয়ে কোনো আলোচনাও সেদিনের পর থেকে করেনি রণর সাথে ।ও বুঝতে পেরেছিল তার কারণ জীবনে প্রথম রণর বোর্ড এক্সাম।তাও একটা অস্বস্তি,খারাপ লাগা ওর মনেও রয়ে গেছে।

জয়ি মুখ তুলে তাকায় ঋষির দিকে।তারপর মুখ নামিয়ে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে অবশিষ্ট খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,”জয়ন্ত বলেছে রাইকে হস্টেলের কথা।কিন্তু মেয়েটা একদম মানতে পারছে না।আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার কাছে থাকতে চায় কিনা।” বলে রণকে আড়চোখে দেখলো ও।
“কি বললো?” ঋষি কৌতূহলী হয়।

জয়ি ভাবে কি বলবে ও।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মুখটা।আমি ওকে খোলাখুলি সব বলেছি,বলেছি পরের মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার সমস্যা।কিন্তু ও ডিরেক্ট বলেছে কোনোদিনও বিশ্বাস ভাঙবে না আমার”।
আবার কিছুটা থেমে বলে,”একটা মেয়ে,শুধু মেয়ে কেন,একটা মানুষ অন্যেরবাড়ি আসতে তখনই সহজে রাজী হয় যখন তার অন্য উপায় থাকেনা।নাহলে ওই অপরিচিত বা অর্ধপরিচিতকে ভরসা করে।এক্ষেত্রে দুটোই হয়েছে।রাইয়ের আর কোনো অপশন নেই,আর ও আমাকে খুব আঁকড়াচ্ছে।তার কারণ অবশ্যই ওর জীবনে শূন্যতা।জয়ন্ত কোনোভাবেই রেশমির চলে যাওয়ার শূন্যতা ভরাতে পারছেনা,বা বলা বেটার চাইছেনা।আর একা হয়ে যাওয়া রাই আমাকে ভরসা করতে চাইছে।এখন প্রশ্ন হলো ওর জন্যে কোনটা বেটার হবে আমাদের বাড়ি না হস্টেল?” জয়ি থেমে ঋষি আর রণ দুজনের মুখের দিকেই তাকায়।
কিন্তু কারোর থেকেই কোনো উত্তর আসেনা।দুজনেই চিন্তান্বিত অবস্থায় বসে থাকে।
জয়িতার উদ্বেগ বাড়ে।ও সরাসরি উত্তর না পেলে ঠিক করতে পারেনা ও নিজে কি করবে।বিকেলে আবেগঘন হয়ে রাইকে বলে তো দিয়েছে,কিন্তু ফ্যামিলির বাকিদের মতটাও জরুরী।তাছাড়া আজ অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও জয়ন্তর সাথে দেখা হয়নি।সাতটার সময় যখন জয়িতা ওখান থেকে বেরোনোর সময় ফোন করেছিল জয়ন্ত ফোন ধরেনি।আর ফোনও করা হইনি।
জয়ির প্রশ্নের উত্তর মেলেনা ঋষি বা রণর থেকে।কিছুক্ষন পর উঠে বাপ-ছেলে যে যার ঘরে চলে যায়।একরাশ প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তার সাথে জয়িতাকে ছেড়ে।
জয়িও উঠে পড়ে,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় এগারোটা বাজে।কাল জয়ন্তকে ফোন করবে মনে মনে ভেবে রমাকে হাঁক দেয়,’এতক্ষনে নিশ্চই রমার খাওয়া হয়ে গেছে’।
দুজনে মিলে টেবিল গুছিয়ে পরের দিনের রান্নার আলোচনা করে জয়িতা যখন ওপরে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখে ওর হাতের মুঠোয় রাখা সেলফোনটা ডেকে ওঠে।মুঠো খুলে ও দেখে জয়ন্তর নম্বর,তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে ও।

প্রাইভেট হসপিটালের ঝাঁ চকচকে রুমে বসে রুগী দেখলে সেটা হসপিটাল আউটডোর ভুলেই যায় জয়িতা।চেম্বারের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয় বেশি।তবে অনেকসময় ডাইরেক্ট হসপিটাল এমার্জেন্সিতে পেশেন্ট এলে ওকে অ্যাটেন্ট করতে হয়,এই যা।
আগেরদিন রাতের জয়ন্তর ফোনটা জয়িতাকে মানসিক ভাবে খুব অস্থির রেখেছিলো সারারাত।ঘুম ভালো হয়নি।ফলে হসপিটাল আউটডোরে আসতে দেরি হয়েছিলো ওর।ও সাধারণত হাতে গোনা সেই কজন ডাক্তারের মধ্যে পড়ে যারা সময়ের সাথে চলতে বেশি পছন্দ করে।সেই কারণেই সময়ের থেকে পিছনে চলা আনপাঞ্চুয়াল ঋষির ছেলে রণকে জয়ি নিয়মানুবর্তী হতে শিখিয়েছে ছোট থেকে।
ঋষির এই সময়ের থেকে সবসময় দেরিতে আসা অভ্যাসের জন্যে সম্পর্কটা প্রায় ভাঙতেও বসেছিল,তাও ঋষি বদলায়নি।বলেছিল,”খামোখা গার্লফ্রেন্ডকে ইম্প্রেসেড করে ভবিষ্যতে নিজের গর্ত নিজে খুঁড়তে পারবোনা।আমি যেমন সেরকম আমায় অ্যাক্সেপ্ট করতে পারলে কর।বদলাবার চেষ্টা করবি না।”
দুদিন ফোন বন্ধ রেখেছিলো জয়িতা,শেষে ওর বাড়ি গিয়ে হামলা করে ঋষি ওকে মানায়।কিন্তু বদলানোর শর্ত মানেনি।

হঠাৎ জয়ির রুমের বাইরে যে মেয়েটি থাকে ঘরে নক করে ঢুকে এলো।একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখছিল ও।মহিলার সমস্যা একটু জটিল।মহিলা এতদিন চেপে রেখেছিলেন আজ নিজের মেয়ের পাল্লায় পড়ে ডাক্তারের কাছে এসেছেন,যখন সার্জারি ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা বিশেষ নেই।
সাদা বাংলায় বললে মহিলার নাড়ি বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে,ফলে ইউরিনেশনের সময় যথেষ্ট ব্যাথা হয়।এই বয়সে সার্জারি ছাড়া ঠিক করা সম্ভবনা।এসব চিন্তার মাঝে ওর রুমে ঢুকে আসা মেয়েটার দিকে চোখ তুলে চায় একবার জয়িতা।মেয়েটা শুধু বলে,”এমার্জেন্সি ম্যাম”।

বয়স্ক মহিলাকে দেখে ছেড়ে দিয়ে বাকি পেশেন্টদের অপেক্ষায় রেখে জয়ি এমার্জেন্সি কেস দেখতে ছোটে।মেয়েটি দুদিন আগে মা হয়েছে।দুর্ভাগ্য যে তার অর্থবান স্বামী কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল না,নিজের স্ত্রীকে ডেলিভারির জন্যে নিয়ে গেছিলেন নামী নার্সিং হোমে।সেখানকার মালিক সাধারণ এমবিবিএস হয়েও দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী চিকিৎসকের পরিচয় দিয়ে একাধিক ডেলিভারি করিয়েছেন।আগে কি হয়েছে জানা নেই কিন্তু এই মেয়েটার ক্ষেত্রে সিজার হওয়ার পর মেয়েটা কোমায় চলে যায়।বাচ্ছার অবস্থাও ভালো না।চমকে ওঠে জয়িতা।মানুষ নামতে নামতে কোথায় চলে যাচ্ছে,টাকার লোভে পাগল হয়ে যাচ্ছে।ধরা পড়লে কি হবে সেসব ভাবার ক্ষমতাও নেই,শুধুই টাকার নেশায় ছুটছে।

পরের কয়েক ঘন্টা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করেও ঘন্টার মেয়াদ বেঁধে দিতেই হয় জয়িকে,সবটা ডাক্তারের হাতে থাকেনা। উপরওয়ালার ইচ্ছেতেও হয় অনেক কিছু।এমার্জেন্সি ,সাথে আউটডোরের বাকি পেশেন্ট,সামলাতে জয়ির নাভিশ্বাস উঠে যায়।কয়েকঘন্টার জন্যে রাই-জয়ন্ত-রণ-ঋষি হারিয়ে যায় মন থেকে।
সবটা প্রায় সামলে গিয়ে বেলা একটা নাগাদ যখন গাড়ির ব্যাক সিটে গিয়ে বসে শরীর ছেড়ে দেয়।মাথার ওপর চেয়ে বসা প্রেসারে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে,কিন্তু তার মধ্যেও আবার ফিরে আসে রাইয়ের চিন্তা।

জয়ন্ত কি করছে,কি চাইছে কিছুই মাথায় ঢোকেনা আজকাল জয়ির।কাল রাতের ফোনটা ওর মাথা আরো ঘেঁটে দিয়েছে।ফোনটা করেছিল জয়ন্ত,কিন্তু বেহেড মাতাল হয়ে।ওর কথা গুলো মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিলোনা।
জয়ন্তকে এরকম জয়ি কোনোদিনও দেখেনি।মাঝে কয়েক বছর বিশেষ টাচে ছিলোনা ঠিকই,কিন্তু এতোটাও বদলায়নি ও।
রাই কোথায় ছিল জানেনা জয়িতা,শুধু জয়ন্তর কথা কান্নায় জড়িয়ে এলোমেলো কানে আসছিল।ফোনের এপাশ থেকে অসহায় জয়িতা একা কিছু বোঝাতে না পেরে ছুটে গেছিল ঋষির কাছে।দুজনে মিলে লাউডস্পিকারে অনেক্ষন কথা বললেও কারোর কথা কানেই নিচ্ছিল না ও।
জয়ি শুধু বুঝতে পারছিল কাঁদতে কাঁদতে জয়ন্ত নিজেকে দোষারোপ করছিল।অনেক কষ্টে ও আর ঋষি মিলে বুঝতে পেরেছিল কিছু কথা।
জয়ন্তর বাবা বছর তিনেক আগে মারা যান।মারা যাওয়ার আগেও তিনি ছেলেকে ক্ষমা করেননি।এমনকি মৃত্যুর পর মুখে আগুন দেওয়ার অধিকারটুকুও একমাত্র ছেলেকে দেননি।
তারপরও খবর পেয়ে ছুটে গেছিল জয়ন্ত বাবাকে শেষ দেখা দেখতে,কিন্তু ওর মা ওকে বাড়িতে ঢুকতে অবধি দেয়নি।মা ছিল বিয়ের আগে ওর সমস্ত জোরের উৎস।মা’ও ত্যাগ করায় ভেঙে পড়ে ও।সমস্ত ক্ষোভ ওর স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে উগরে দেয় রেশমির ওপর।শোকে দুঃখে সত্যিকে উপেক্ষা করে রেশমিকে দায়ী করে ও।
একটাও প্রতিবাদ করেনি রেশমি।কিন্তু পরের কয়েকমাস অপ্রতিরোধ্য দূরত্ব তৈরি করে নেয় জয়ন্তর সাথে।
তৃতীয় পক্ষের চোখে সব স্বাভাবিক থাকলেও জয় নিজে উপলব্ধি করতো সেই দূরত্ব।নিজে এগিয়ে গিয়ে সব মিটিয়ে নিতে ইচ্ছে হলেও স্বভাব চুপচাপ জয়ন্ত পারেনি সেই মুহূর্তে মুখ খুলতে।আর অভিমানী রেশমি তাই দূরত্বটা পাকাপাকি করার ব্যবস্থা করে ফেলে।চরম শাস্তি দেয় ও জয়ন্তকে।আর এই কষ্টটাই ওকে দিনরাত কুরে কুরে খাচ্ছে।কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেনা ও,ভুলতে পারছেনা নিজের দোষটা।
কিন্তু ওই ছোট মেয়েটার দোষ কোথায়, এটা জয় কেন রিয়ালাইজ করতে পারছে না।মা হারানোর শোক,তারওপর বাবার এরকম বদলে যাওয়া,কি রকম মানসিক চাপ আর একাকিত্বে যে ওর কাটছে জয়িতা ভালোই বুঝতে পারছে।সামনে আবার পরীক্ষা, জয়ি ভাবে আজ বিকেলে কোথাও চেম্বার নেই যখন একবার ঘুরে আসবে রাইমার কাছে।

বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে যায় ও।ঋষি সাধারণত দুপুরে ফেরেনা,হসপিটালেই থাকে।কিন্তু আজ বেডরুমে গিয়ে দেখে ঋষি বসে বসে এই অসময়ে টিভি দেখছে।তার মানে কোনো কারণে অস্থির আছে।
জয়ির দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও,তারপর বলে,”তুই যেদিন জয়ন্তর সাথে কথা বলতে যাবি আমিও যাবো।রাইকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে।আর আমরা ছাড়া ওর জন্যে ভাবার আর কেউ আছে বলে মনেহয়না।জয়ন্ত তো আমাদের দুজনের কাছেই নিকট আত্মীয়ের থেকেও আপন,তাহলে তার মেয়েকে কেন নিজেদের কাছে এনে রাখতে পারবোনা।জয়ন্তর সাথে কথা বলে তো দেখি।ও তো হস্টেলে দিতই, দেন হোয়াই নট আস?আমিও যাবো তোর সাথে কথা বলতে।”টিভির দিকে তাকিয়ে একটানা বলে যায় ঋষি।কথা শেষে সম্মতির অপেক্ষায় তাকায় নিজের বউয়ের দিকে।
জয়ি কোনো উত্তর না দিয়ে বলে,”ফ্রেস হয়ে আসছি।”
হসপিটাল থেকে ফিরে দুপুর হোক কি রাত গরম জলে সারাবছর চান করে ও।ফ্রেস নাহয়ে পাঁচ মিনিট বসেওনা কোথাও।হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা টেনে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ও।

চান করে পরিষ্কার হয়ে ঋষির পাশে এসে বসে।
“অনেক বেলা হলো,কিছু খাওনি তো?চলো খেতে খেতে কথা বলি”। তুমি বলেই শুরু করে অনেকদিন পর।

জয়ির কথায় ঘাড় নেড়ে রিমোট থেকে টিভি অফ করে উঠে পড়ে ঋষি।অন্যমনস্ক ভাবে বলে,”মনটাও আজ ভালো না।জানি ডাক্তারদের আবেগ থাকতে নেই,তাও…”।

“কি হলো আবার?” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করে জয়ি।

“কি আর নতুন হবে! আমি তো এমনিতে পজিটিভ মাইন্ডেড তুই জানিস।কিন্তু এই রেশমির ঘটনাটা মনে বড্ড চাপ দিয়ে দিয়েছে।আসলে যতই এই সমস্ত রুগী নিয়ে দিন কাটাই না কেন,নিজের কাছের কারোর যতদিন না রোগটা হয়েছে মন অতটাও নাড়া খায়নি হয়তো।দেখনা কাল ই তো একটা বছর দুয়েকের বাচ্ছা এলো,যদিও টেস্ট করতে দিয়েছি সবে,কিন্তু আমি শিওর বাচ্ছাটার অল(ALL-acute lymphoblastic leukemia) এর সিম্পটম”, ইচ্ছে করে বাচ্ছাটার নাম এড়িয়ে যায় ঋষি। কাকতালীয় হলেও মায়ের মন তো,একেই রাই কে নিয়ে সর্বদা চিন্তা করছে,আবার নিজের ছেলের নামে নাম শুনলে হয়তো ওর মতোই মন খারাপ করে ফেলবে।

“ইসস! সত্যি এই রোগটা যেন আজকাল আর বয়স মানেনা।ওই টুকু বাচ্ছা।কিন্তু দেখবে ও ঠিক সেরে যাবে।তুমি বলোতো এখন এই ক্যান্সার থেকে কিওর হওয়ার চান্স অনেক বেশি।” জয়ি যেন নিজেকেই বোঝায়।

“হমম সেতো বলি।দেখি রিপোর্ট কি আসে।আশা তো থাকেই।আর বাচ্ছাটার বাবা মা বিশেষ দেরি করেনি।তোর কথা সত্যি হোক।তবে তুই ঠিক বলেছিস।সেদিন হসপিটালে এক কাপল এসেছিলেন,প্রায় পঞ্চাশের ওপর বয়স দুজনেরই।ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে।ওঁরা চলে যেতে ওই হসপিটালের সবচেয়ে পুরোনো স্টাফ জ্যোতিষ্কদা বললেন,ওঁদের একমাত্র ছেলের ছোট বয়সে অ্যাকিউট লিম্ফোব্ল্যাস্টিক লিউকমিয়া হয়।সেই ছেলে ট্রিটমেন্টের পর সুস্থ অবস্থায় এতটা জীবন কাটিয়ে এখন বিয়ে করতে যাচ্ছে।” ঋষি যেন নিজের মনে অদ্ভুত এক আনন্দ পায়।
তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,”এবার ছাড় ওসব।সারাদিন এই নিয়েই আলাপ আলোচনা,নাড়া ঘাঁটার পর বাড়ি ফিরেও একই আলোচনা ভালোলাগে না।তুই তোর কথা বল।”

“আমার খবর আর কি বলবো বলো।চারপাশের ঘটনাই আজকাল অবাক করে,মনে হয় মানুষ দিনদিন অর্থলোভী হয়ে যাচ্ছে।ন্যায় নীতির কোনো মূল্য নেই।” তারপর ওর হসপিটালে যে মেয়েটা ভর্তি হয়েছে তার কথা বলতে থাকে।
কথা বলতে বলতে যখন খেয়ে ওঠে তখন প্রায় তিনটে বাজে।দুজনে ঠিক করে জয়ন্তর বাড়ি যাওয়ার।আধ ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়।

“কিরে রণ এরকম চুপচাপ আছিস তুই? পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই আবার পড়া শুরু হয়ে যাচ্ছে,ভালো লাগে নাকি?!এতক্ষন ধরে আমি একাই বকে যাচ্ছি তুই উত্তরও দিচ্ছিস না”,রুদ্র বলে।স্বভাবতই অভিমান ঝরে ওর গলায়।
এমনি অন্য বন্ধুরা ওর সাথেও এটাই করে,ও বকে যায় কেউ ওর কথায় উত্তরও করেনা।কিন্তু রণজয় তাদের দলে পরে না।তাই রুদ্র ওর বাড়ি এলেও অস্বস্তিতে ভোগে না।
আসলে রণ ওর মমের কথা ভাবছে।ওই রাই বলে মেয়েটার প্রতি মম একটু বেশি দুর্বল হয়ে গেছে।ওর বাবা রাজি থাকলে ওকে কদিন পর এই বাড়িতেই নিয়ে আসবে।
রণ কিছুতেই বোঝাতে পারছেনা ওর উদ্বেগটা।

ওর মনে আছে তখনও ক্লাস এইটে পড়ে।ওর ক্লাসমেট ময়ূখ ক্লাসে চুপচাপ বসেছিল।ও এমনিতে রণর মত সবার সাথে না মিশলেও রণকে একটু বেশিই ভালোবাসতো।ওকে সব বলতো নিজের কথা।
রণর জোরাজুরিতে ও বলেছিল,বছর খানেক আগে ওর একমাত্র মাসি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়।তার মেয়ের বয়স ছিল তখন প্রায় বছর কুড়ি।ওর বাবা অন্য স্টেটে জব করতো।ময়ূখের মা তার দিদির একমাত্র মেয়েকে এনে নিজের কাছে রাখে,কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো মেয়েটা।

ময়ূখ বলেছিল,”জানিস ওর বাবা ওর কোনো খোঁজ নিতনা শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া।কিন্তু মামনি দিদিকে মাসিমনির অভাব একফোঁটা বুঝতে দিতনা।কিন্তু দিদি কারোর কথা ভাবলো না”।
মেয়েটা চলে গিয়েছিল একটা বেকার ছেলের সাথে।যে মেসো মেয়েকে ছমাসে ক’বার ফোন করেছিল হাতে গুনে বলা যায়।সে ময়ূখের মা’কে খুব খারাপ ভাষায় অপমান করে।ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ওই ঘটনার পর।

ওর মা খুব শক্ত মনের হাসিখুশি মহিলা ছিল,রণ ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছে।সবচেয়ে বড় কথা আন্টির একটা বুটিক ছিল নিজেদের বাড়ির একতলায়।ময়ূখদের ব্যবসায়ী পরিবারে টাকার অভাব যেমন ছিল না,তেমন ছিল না লোকের অভাব।কেউ না কেউ বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা থাকতো।
সেখানে মম একটা পরের মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ভাবছে,মম নিজে বাড়ি থাকেনা।তাছাড়া ভালো করলে তার দাম পাবেনা,কোনো অঘটন ঘটে গেল ওর সফট মাইন্ডেড মা কি করবে সেটাই রণর দুশ্চিন্তার কারণ।
ও রুদ্রকে কিছুই বলতে পারেনা।এটা এমনই পারিবারিক কারণ কাউকে বুঝিয়ে বলা মুশকিল।
রণকে চুপ থাকতে দেখে আবার রুদ্র খোঁচায়।

“রণ তোর ভবিষ্যতে কি নিয়ে পড়ার শখ রে?তোর প্যারেন্টস ডাক্তার,তুইও নিশ্চই তাই হবি?”রুদ্র রণর রুমে বসে একটা মেডিকেল জার্নালের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলে।ওর বাবা মার জন্যে এগুলো বাড়িতে আসলেও রণর অসময়ে পাতা উল্টে দেখতে ভালো লাগে।
“হমম ডক্টর তো হতে চাই,তবে সাইকিয়াট্রিস্ট।মনের ডাক্তার”, মুখটা উজ্জ্বল হয় ওর কথাটা বলার সময়।

অবাক চোখে তাকায় রুদ্র ওর দিকে,”হঠাৎ?”

“হঠাৎ না।অনেকদিনের টার্গেট।মানুষের মন নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করতে একটা আলাদা উত্তেজনা।তুই জানিস আমরা এখনো শরীরের সামান্য রোগে ডাক্তারের কাছে ছুটি,কিন্তু লঙ টাইম ডিপ্রেশনে থাকলেও সেটা নিয়ে কারোর সাথে আলোচনা করিনা,সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া তো অনেক পরের চিন্তা। আমার এক জেঠুর কথা শুনেছিলাম বাবার কাছে।বাবাদের দেশের বাড়ি হুগলী ডিস্ট্রিক্টে। ওই জেঠু খুব ভালো বাইকার ছিল।কিন্তু একবার নিজের বোনকে নিয়ে কোথাও একটা যাওয়ার সময় বড় একসিডেন্ট হয়।ওই পিসির পা বাদ পড়ে যায়।সবাই অ্যাকসিডেন্টকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়।কিন্তু ওই জেঠু পারেনি।অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে চলে যায়।তাও তার কোনো আত্মীয় তাকে কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি।লাস্ট অফ অল সুইসাইড করে সেই জেঠু।বাবা তখন ডাক্তারি পড়ছে।এই ঘটনা আমায় বাবা বলেছিল বছরখানেক আগে।তারপর আমি সুযোগ পেলে টুকটাক পড়তাম বিষয়টা নিয়ে।এখন ভীষণ ইন্টারেস্টিং লাগে”,একটানা রণ যখন কথা গুলো বলে রুদ্র ওর চোখে আলাদা একটা ইন্টারেস্ট দেখতে পায়।
রণ আবার শুরু করে,”ক্যান্সার নিয়ে স্পেশালাইজেশন আমার দ্বারা হবেনা।আর মায়ের সাবজেক্টও অতটা ইন্টারেস্টেড নই।বাবা বলছিল অর্থোপেডিক বা কার্ডিও কিন্তু আমার ‘সাইকিয়াট্রি’ সাবজেক্টার প্রতি ইন্টারেস্ট বেশি।তোর কি টার্গেট ফিউচারের?” রণ এবার রুদ্রকে জিজ্ঞেস করে।
“আমার আর কি শখ ভাই! সবই বাবা মার শখ।প্রথম টার্গেট মেডিকেল,নাহলে ইঞ্জিনিয়ারিং,নাহলে….জানিনা”,হেসে ফেলে রুদ্র।
ওর বাবা চায় ও জেনারেল লাইনে পড়ে ওঁর মতোই সরকারি চাকরি করুক,তবে অফিসার লেভেলে।কিন্তু ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে বদ্ধপরিকর।তাই হয়তো রণর সাথে রুদ্রর ঘোরাফেরা ওর মায়ের এত পছন্দ।রুদ্র বোকা হলেও জানে ওকে ডাক্তারি পড়ানোর ক্ষমতা ওর বাবার থাকলেও ওর নিজের সেই ক্ষমতা নেই।কিন্তু এখন মা’কে কিছু বলে কষ্ট দেয়না।চুপচাপ শুনে যায়।
এখনও তাই রণর কথাটার ঠিক করে জবাব দিলোনা,বলতে পারলোনা ওর ইচ্ছের কথা।ইংলিশ সাহিত্য নিয়ে পড়ে কলেজে পড়াতে চায় ও।বাবা মার ইচ্ছের আড়ালে ওর নিজের স্বপ্নটা আজ চাপা পড়ে গেছে।বাবার চিন্তার সাথে তাও ওর স্বপ্নের রাস্তা এক,কিন্তু মায়ের আকাশছোঁয়া ইচ্ছেপূরণ হয়তো ওর দ্বারা হবেনা।তাই ওর ভবিষ্যৎ কি ও নিজেও ভাবেনা।

“জয়ন্ত তুই সত্যি চাসনা রাই আমাদের কাছে থাকুক।আমরা তোর আত্মীয় নই, কিন্তু তার থেকেও বেশি।তুই আমাদের কাছে কি সেটা তুই ভালো জানিস।তাহলে প্রবলেম কোথায়?” ঋষি জয়ন্তকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।
চুপ করে থাকে ঋষির কলেজ জীবনের অন্তরাত্মা।কি বলবে ও! ও তো জানে ঋষি-জয়ির কাছে রাই থাকলে ওকে আর মেয়ের জন্য চিন্তা করতে হবেনা,নিশ্চিন্তে ও নিজের জগতে ডুবে নিজেকে গোছাবার সময় পাবে।কিন্তু মেয়েটা কি ওখানে মানিয়ে থাকতে পারবে? সম্পূর্ণ অপরিচিত বাড়ি,অপরিচিত পরিবেশ,নতুন স্কুল,সেখানকার নতুন বন্ধুবান্ধব-টিচার,সবচেয়ে বড় ব্যাপার ঋষির ছেলে।
জয়ন্তর ঋষির ছেলেকে নিয়ে সমস্যা নেই,কিন্তু ঋষির আত্মীয় স্বজন কোথায় কি বলে দেবে,ওর আত্মভিমানি মেয়ের মনে লেগে যাবে!
ও জানে জয়ি প্রচন্ড খেয়াল রাখে রাইয়ের।কিন্তু রেশমির জায়গা কি কেউ কোনোদিনও নিতে পারবে?মা তো মা’ই হয়।আর রেশমি ছিল ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।ওর মেয়ে এমনিও চাপা,যদি ওখানে গিয়ে ভালো না থাকে!তখন সমস্যা আরো বাড়বে,উল্টে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ওদের বন্ধুত্বের।
“জয় প্লিজ কিছু বল। রাই নিজেও হস্টেলের থেকে জয়িতার কাছে থাকা বেশি প্রেফার করছে।হস্টেলে ও যদি মানাতে না পারে,কাকে বলবে ও?তুইও কাছে থাকবি না।তুই রাই কে…”,বাধা পায় ঋষি।
“ও এখন বাস্তবটা বোঝেনা ঋষি।কিন্তু তুই তো বুঝিস।কেন তোরা খামোখা জড়াতে যাচ্ছিস বল।আমাদের বন্ধুত্বটা আমার কাছে ভীষণ দামি,কোনো কারণে সেটা নষ্ট হোক আমি চাইনা।প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্টান্ড।” জয়ের গলায় আকুলতা ঋষির কানে লাগে।
এসময় জয়ি রাইকে সঙ্গে করে নিয়ে জয়ন্তর একতলার স্টাডিরুমে এসে ঢোকে।

“জয় আমি রাইকে দিন দশ পরে এসে নিয়ে যাবো।ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে।তুই তো ওকে নেক্সট মাসে বোর্ডিং স্কুলে এডমিশন করাবি বলছিলি।ও তার আগে কিছুদিন আমার কাছে থাকুক,গেস্টের মত না।আমি নিয়ে গেলে যেভাবে থাকতে হবে নিজের খেয়াল রেখে সেভাবে।যদি ওর থাকতে প্রবলেম না হয় তোকে তাহলে তোর ডিসিশন নিয়ে আবার ভাবতে হবে।ও হস্টেলে না আমার কাছে থাকবে।” জয়ির গলার জোরে ঋষিও চমকে যায়।

“না জয়ি।রাই এমনি তোদের বাড়ি বেড়াতে যেতে চায় যাক।কিন্তু পার্মানেন্ট থাকা পসিবল না।আমি নিজে গিয়ে ঘুরে দেখে এসেছি,ও ওই হস্টেলে ভালো থাকবে।আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন”। জয়ন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে,তাকিয়েও দেখেনা ওর এই সিদ্ধান্তে রাইয়ের মুখের আলো নিভে যায়।ভয়ে শুকিয়ে যায় মুখ।

ঋষি ভ্রু কোঁচকায়,যতই বন্ধু হোক ওর কথা বলার ধরণ অপমানে লাগে ওর।ও কিছু বলতে যাবে চোখ পড়ে জয়ির দিকে,দেখে ও ইশারায় চুপ থাকতে বলছে।সামলে নেয় ঋষি নিজেকে।

“বেশ,তুই ওর বাবা।তুই যা ডিসিশন নিবি আমাদের মানতে হবে।কিন্তু আমি ওকে দশদিন পর নিয়ে যাবো এটা ফাইনাল।আর তার দিন দশ পর তুই ওকে আনতে আমাদের বাড়ি যাবি।ওকে?” জয়ির কথা জয়ন্ত না মেনে পারেনা। কলেজ জীবনেও জয়ি এভাবেই জয়ন্তকে দিয়ে কথা আদায় করিয়ে নিত, আজও তাই প্রিয় বন্ধুটাকে ও না বলতে পারেনা।
“যা রাই তুই পড়তে যা।তোর ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ পরীক্ষা আছে কাল।আমি এ’কদিন আসবো না,আসলে তোর পড়ার অসুবিধা হয়।গল্প করতে শুরু করে দিস”,হাসতে হাসতে বলে জয়িতা।”আবার উইকেন্ডে আসবো।”
রাই স্মিত হেসে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

“জয় তুই সোজা জিনিস আগের মত সোজা ভাবে ভাব প্লিজ।তুই আমাকে আর ঋষিকে তো চিনিস।আর আমার বাড়িতে আছে রণ আর আমার সংসারের কেয়ার টেকার রমাদি।এদের কারোরই রাইকে নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।আমি প্র্যাকটিস করলেও সেটা খুব লিমিটেড,তুইও জানিস।তাই রাইকে দেওয়ার সময় আমি পাবো।রণ সারাদিন নিজের স্টাডি নিয়ে বিজি, আরো বিজি হয়ে যাবে।আর ওর মত বুঝদার ছেলেকে নিয়ে কারোর প্রবলেম হয়না,আমি মা হয়ে বলছি।তাও তোকে জোর আমি করবোনা।” জয়ি ঋষিকে ইশারা করে উঠে পড়তে,বেরোবে বলে।
জয়ন্ত চুপ করে শোনে,আজকাল ওর কথাগুলো বেশির ভাগ মনের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়।বাইরে বের হয়না।শুধু নেশা করলে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে ওর।কিন্তু বাড়িতে রাই আছে বলে নেশা করলে আজকাল বাড়িও ফেরেনা।হসপিটালের এক স্টাফের বাড়িতে রাত কাটিয়ে দেয়।
ও বুঝতে পারছে জীবনটা ও কিছুতেই সামলে উঠতে পারছেনা।মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয়,কিন্তু যেদিন ই রাইয়ের সাথে সময় কাটাবে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে রাতগুলো যেন ওকে গিলে খেতে আসে।ঘুম আসেনা।রেশমির ওপর রাগ ফিরে আসে,ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে সব কিছু।
জয়ির কথা ও মেনে নেবে না নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকবে একটা দোটানায় পরে যায় ও।
হঠাৎ দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে ফিরে দাঁড়ায় জয়ি।ঋষি ততক্ষনে বেরিয়ে গেছে।ফিরে আসে জয়িতা জয়ন্তর কাছে,”জয় আমার একটা মেয়ের শখ ছিল।ভেবেছিলাম দত্তক নেব রণ একটু বড় হলে।কিন্তু দিনগুলো যে কোথা দিয়ে কেটে গেল…রাইকে আমি যতদিন বেঁচে থাকবে মায়ের মতোই আগলাবো।রেশমির জায়গা কেউ নিতে পারবে না,আমি রণর মা হয়ে সেটা বুঝি।কিন্তু হস্টেলের একাকীত্ব ও আমার বাড়িতে পাবেনা।কি জানিস তোর মেয়ে বড্ড নরম,তাই ওকে হস্টেলে পাঠাতে আমি ভয় পাচ্ছি।তুই এক কাজ কর অন্তত দুবছর ওকে আমার কাছে রাখ।ততদিনে ও একটু পরিণত হয়ে যাবে।তুই তো বলছিস বছর পাঁচেকের আগে ফিরতে পারবিনা,ওকে বরং দুবছর পর তোর কাছাকাছি নিয়ে চলে যাস।ভেবে দেখিস আমার কথাটা”।জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে জয়ি ঘুরে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
জয়ন্ত হাত বাড়িয়ে জানলার ধারের টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা নেয়।একটা সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালায়।জানলা দিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে।পুরোনো দিনের জানলার শিকে লেগে ধোঁয়াটা দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়,অনেকটা ওর মনের মত।এখন ওর মনও জয়িতার কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে।ভাবতে থাকে ও।
ওপরের তলার নিজের ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে থাকে রাই।জয়ি আন্টিদের গাড়িটা দূরে চলে যাচ্ছে,আস্তে আস্তে দৃষ্টির বাইরে।

ক্রমশ….