মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৫

0
437

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#পঞ্চম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

অনেক্ষন ধরে বেলটা বাজছে।আজকাল আর ছুটে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতে পারেন না মমতা।হাঁটুগুলোর জোর কমে গেছে।সারাজীবন নিয়ম মেনে জীবন কাটিয়েছেন,রোজ সকাল সন্ধ্যে হাঁটতে বেরোনো কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই বন্ধ করেননি।তাও ষাট পেরোনোর পরপরই কেন যে হঠাৎ বুড়িয়ে গেলেন…
“যাচ্ছি,যাচ্ছি বাবা…”,এই দুপুরবেলা কে যে আবার এলো।সারাদিনের দেখাশোনার মেয়ে সুলেখা আজ সকালে একটু ওর বাড়ি গেছে।ওর নাতিটা খাট থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে,কান্নাকাটি করছিল খবর পেয়ে থেকে,তাই আজ মমতা নিজেই বললেন ঘুরে আসতে।সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আসবে।
দরজা খুলে একটু হকচকিয়ে গেলেন,’এই রে দারোগাকে আজকেই আসতে হলো!এবার সুলেখাকে ছুটি দেওয়ার বকুনিটা খেতে হবে’।সুলেখা অবশ্য বলেছিল,’দিদিকে খবর দাও।তোমায় একা রেখে যাবুনি। দিদি জানতে পারলি বকবে’,মমতা কথা কানে নেননি।
তার মেয়ের কি নিজের বিশ্রামের সময় আছে!
শুধু তো দিনেরবেলাটা, ও ঠিক বই পড়ে-টিভি দেখে কেটে যাবে।
কিন্তু এ মেয়ে ঠিক আজকেই এসে হাজির।ভগবানের এ যে কেমন বিচার,মনে মনে ঠাকুরকে স্মরণ করেন মমতা।

“সুলেখাদি কই?তুমি দরজা খুললে?” ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে বাঁ হাতের ঘরে জুতো ছাড়তে ছাড়তে প্রশ্ন করলো জয়িতা,তার ষাটোর্ধ্ব মা মমতাকে।
বছর পাঁচেক আগে সময়ের আগেই বাবা চলে যাওয়ার পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া মা’কে একা রাখবে না বলে নিজের কাছে নিয়ে গেছিল জয়ি।কিন্তু একমাসও রাখতে পারেনি নিজের কাছে,নিজের বাড়ির টানে ফিরে আসেন মমতা তার আটশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে দিন কুড়ির মধ্যেই।
জয়ি এসে ওইসময় কদিন ছিল,কিন্তু এটা পার্মানেন্ট সমাধান না বলেই সুলেখাকে নিয়ে আসে ও।
জয়ি যে প্রাইভেট হসপিটালে এখন আছে ওখানকার গার্ড সমরের কাকিমা এই সুলেখা।অল্প বয়সে সংসারের একমাত্র রোজগেরে ছেলে অ্যাকসিডেন্টে হঠাৎ মারা যায়।বৌমা আর এক বছরের নাতিকে নিজের কাছছাড়া করবে না বলে বছর বিয়াল্লিশের সুলেখা কাজ খুঁজছিল।জয়ি তাকে রাজি করিয়ে ফেলে মমতার কাছে দিনরাত থাকার জন্যে।সুলেখা যা টাকা পায় ওর সংসার শুধু দাঁড়িয়ে যায়নি,নাতিটাকেও একটা সরকারি ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে ও,পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবে বলে।

“সুলেখা!!” মমতা ঢোক গেলেন।কি বলবেন ভাবতে থাকেন।মেয়েটা বড্ড বকাঝকা করে আজকাল,ভয়েতেই তাই সব গুলিয়ে যায়।এককালে উনি নিজে কতটা রাশভারী ছিলেন মনে পড়েনা।
“হ্যাঁ সুলেখাদি। বাজারে গেছে নাকি?” জয়িতা ডাইনিং স্পেসে এসে টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে।লিফট কি কারণে বন্ধ আছে,সিঁড়ি ভেঙে এই পাঁচ তলায় উঠতে গলা শুকিয়ে গেছে।
“সুলেখা একটু বাড়ি গেছে…মানে…ওর নাতি,ওর নাতিটা রে,খাট থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে।বেচারা কান্নাকাটি করছিল,একা বৌমা কি করবে…আমি তাই…তবে সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসবে।” জয়ির বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে মমতার গলার স্বর শেষ দিকে কমে আসে।
কিছুক্ষন হাঁ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর জয়ি বলে,”আমাকে আগে থেকে জানানোর দরকার মনে করোনি?কেন আমি কি বারণ করতাম?”
“না মানে তুই কাজের মানুষ।তারওপর জয়ন্তকে আর মেয়েটাকে নিয়েও তোরা দুজনে আজকাল ব্যস্ত থাকিস।তাই আর কি…দিনের বেলা তো।তাই…”,মমতা মুখ কাঁচুমাচু করে বলে।

“দিনের বেলা কি মা? সুগার ফল কি প্রেসার বেড়ে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ঘটনা কি দিন রাত দেখে আসবে?আগের ক’বার কি প্রতিবার রাতে তোমার শরীর খারাপ করেছিল?তুমি জানো না সুগার ফল যখন তখন হতে পারে।
আর সুলেখাদির অন্তত আমায় একবার জানানো উচিত ছিল।” জয়িতা গজগজ করতে করতে মায়ের ঘরে গিয়ে ঢোকে।ব্যাগ থেকে এক গাদা ফল বের করে মায়ের খাটের পাশের টেবিলে রাখে।ভাস্কর বয়ে ওপরে দিয়ে যাবে বলছিল,কিন্তু ডাক্তার জয়িতা মুখার্জী এটুকু পারবে বলে ভাস্করকে বারণ করে।
এই সময় মমতার ঘরের এক ফালি ব্যালকনির দরজা দিয়ে সুন্দর মিষ্টি রোদ ঘরে এসে ঢোকে।দুপুরে কখনো ঘুমোননা জয়ির মা।চেয়ারে বসে ওই রোদে পিঠ দিয়ে বই পড়েন।
“সুলেখা বলতে চেয়েছিল কিন্তু একবেলার ব্যাপার বলে আমি বারণ করেছিলাম।আমি তো বুঝতে পারি শরীর খারাপ হলে।দেখলাম একদম ফিট আছি তাই….”,মমতা আমতা আমতা করে বলেন।
জয়িতা কিছু উত্তর না দিয়ে বিরক্ত হওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।
মমতা বুঝতে পারে মেয়ে আজ অতটাও মাথা গরম করেনি।নাহলে এতক্ষনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত।
জয়িকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আবার উনি বলেন,”কি খাবি?একটু চা কর না।দুজনে খাই।এই শীতের দিনে এই সময় চা খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে।সুলেখা ফ্লাক্সে করে রেখে যাবে বলেছিল।আমি বারণ করলাম।দুধ চিনি ছাড়া চা ফ্লাক্সে রাখলে তিতকুটে হয়ে যায়।খাওয়া যায়না।” একটানা বলে মেয়ের মুখের দিকে আড়চোখে দেখেন।জয়ির স্ট্রিক্ট অর্ডার,একদম আগুনের সামনে যাওয়া চলবে না।তাই মমতা ইচ্ছে করেই জয়িকে খুশি করতে চা করে আনার কথা বলেন।
কোনো উত্তর না দিয়ে জয়িতা উঠে কিচেনে চলে যায়।হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত ধোয় বাইরে থেকে এসেছে বলে।তারপর চায়ের জল চাপায়।মা’কে একবার দেখে বাড়ি চলে যাবে ভেবেছিল।রাইকে দুদিন হলো বাড়িতে এনেছে।সেই খবরটা দিতেই এসেছিল।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সন্ধ্যে অবধি থাকতে হবে।এসেই যখন পড়েছে মাকে একা রেখে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না,সে মা নিজে যতই যা বলুক।

চা আর সাথে মায়ের জন্য আলাদা করে লোকাল বেকারীতে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা সুগার ফ্রি আটা কুকি নিয়ে আসে।
“এই নাও চা”, মমতার দিকে চিনি ছাড়া লাল চায়ের পেয়ালাটা এগিয়ে দেয় ও।
“হ্যাঁ রে জয়ি তোর সেই বন্ধুর মেয়েকে তোরা নিজেদের কাছে এনে রাখবি ভাবছিস?” মমতা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে।
অবাক চোখে তাকায় জয়িতা মায়ের দিকে।মাকে তো ও এই ব্যাপারে কিছু বলেনি, মা তাহলে রাই এর ব্যাপারে কি করে জানলো?
মেয়ের অবাক দৃষ্টির উত্তর মমতাই দেন।
“পরশু দাদুভাই এসেছিল হঠাৎ করে।বললো বাড়িতে বসে ভালো লাগছিলো না।তাই এসেছে।ওই বললো কথাটা।কিন্তু একটা অপরিচিত মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া কি ঠিক হবে মা?তাছাড়া তোর বাড়িতে একটা ইয়ং ছেলে আছে।মেয়েটা ভালো কি খারাপ সেটা বলছিনা কিন্তু লোকে কথা বলবে।….”,মমতা কথা শেষ করতে পারেননা।
“দেখো মা আমাদের সোসাইটিতে এখন এসব ব্যাপার নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায়না।রণ বাচ্ছা ছেলে,জানিনা তোমায় কি বলেছে! কিন্তু পুরোটা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে তোমার মেয়ে কোনো ভুল করেনি।” জয়িতা আবেগকে বশ করতে পারেনা।
“না দাদুভাই সেরকম কিছু বলেনি।ও বলছিল আজকালকার দিনকাল ভালো না।ওর কোন বন্ধুর মাসির মেয়েকে একই ভাবে তার মা এনে রেখেছিলো।কিন্তু সেই মেয়েটা কয়েকবছর পর বাড়ি থেকে চলে যায় একটা ছেলের সাথে।তখন ওই বন্ধুর মা’কে মেয়েটার বাবা অনেক উঁচুনিচু কথা বলেছিল।তোর মনটা তো নরম তাই নিয়েই ওর চিন্তা।আর কিছু না।ও মেয়েটার কথা কিছু বলেনি,তোকে নিয়েই ভাবছিল বেশি।” মমতা খোলাখুলি সবটা বলেন,যাতে ছেলে-মায়ের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
চুপ করে থাকে জয়ি।ওর মনে পড়ে পরশু সন্ধ্যের কথা। যখন ও রাইকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলো রণ বাড়ি ছিলোনা।রণ ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজিয়ে দিয়েছিল।যদিও ও জানতো না রাইকে ওইদিনই নিয়ে আসবে জয়ি,কিন্তু রাই যে আসবে এটা শুনেছিল।আর শুনে থেকে একটু চুপচাপ হয়ে গেছিল।
সেদিন ঢুকেই ডাইনিং স্পেসে রাইকে দেখে একটু থমকেছিলো যেন।জয়ি খেয়াল করলেও কোনো প্রশ্ন করেনি।
রাতে খাওয়ার টেবিলেও ছিল চুপচাপ।জয়ি ফরমাল পরিচয় করিয়ে দিলেও গতকাল সারাদিন রণকে কথা বলতে দেখেনি ও রাইয়ের সাথে।এমনি মেয়েটা চুপচাপ,তারওপর অচেনা পরিবেশে এসে একটু সিঁটিয়েই আছে।
কে জানে আজ ও বাড়ি নেই,ফিরতে দেরি হবে,কি করবে সারাটা সময় ও একা একা।হয়তো ছাদে যাবে।
কি মনে করে জয়িতা নিজের সেলফোনটা বের করে,মমতার বিস্ময় ভরা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে টিপে দেয় বাড়ির নম্বরের পাশে ‘কল’ লেখাটা।

“মে এই কামিং ডক্টর”,এক সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠস্বরে ঋষি সোজা হয়ে বসে।
একটা বছর ত্রিশের মিষ্টি মুখের মেয়ে এসে ঢোকে দরজা ঠেলে।ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বলে সরাসরি তাকায় ঋষি মেয়েটার মুখের দিকে,হাত বাড়িয়ে টেনে নেয় প্রেসক্রিপসন প্যাডটা।
“নমস্কার ডাক্তারবাবু।আমি শ্রীজা,শ্রীজা বসু।আমার স্বামী আকাশ বসুর জন্যে এসেছি।” মেয়েটা মুম্বাইয়ের এক নামকরা ক্যান্সার স্পেশালিস্ট হসপিটালের রেফারে এসেছে বলে জানিয়ে দরকারি কাগজ দেখায়।
মনটা খারাপ হয়ে যায় ঋষির।একদম বাচ্চা মেয়ে।কিন্তু অসম্ভব মনের জোর সেটা ওর কথাবার্তাতেই স্পষ্ট।কলকাতা না,মফস্বলে বাড়ি ওদের।একটা তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে আছে।হাজব্যান্ডের ব্রেইন টিউমার,থার্ড স্টেজ ম্যালিগনেন্সি।মুম্বাইতে ওই ছোট মেয়েকে নিয়ে এই মেয়েটা স্বামীর চিকিৎসা করাতে গেছিল।কিন্তু আর পারছিল না।সব দিক দিয়ে চাপে পরে গিয়ে কলকাতায় ফিরিয়ে এনেছে।

ছেলেটা সমবয়সী,মানে ওই বছর ত্রিশই বয়স।বিয়ে হয়েছে বছর চারেক।ব্রেইন টিউমারের যা যা সিম্পটম তাই ছিল বিয়ের আগে থেকেই,কিন্তু ধরা পড়েনি।আসলে ওর মাথায় কষ্ট বিশেষ হয়নি।কষ্ট হতো কোমর থেকে পায়ে।
শ্রীজার কথায় বিয়ের আগে থেকে কোমর থেকে যন্ত্রনা হত।ডাক্তার এমআরআইও করিয়েছিল স্পাইনাল কর্ডের।কিন্তু কিছু ধরা পড়েনি।যা ওষুধ দিত,খেলে কিছুদিন ভালো থাকতো,আবার শুরু হত।
এমনকি ব্রেইন টিউমারে যে সকালে ঘুম থেকে উঠলে মাথায় যন্ত্রনা হয় সেটাও আকাশের ছিলোনা।
মাস ছয়েক আগে থেকে যেটা সমস্যা হচ্ছিল আকাশের সেটা হলো স্মৃতি,কিছু মনে রাখতে পারতো না।কোনো কথার সাথে কোনোটার মিল থাকতো না।
শ্রীজা বলছিল,”ওর বন্ধুদের কথার উত্তরে উল্টো কথা বলছিল।উইকেন্ডে বাড়ি থাকলে,বলছিল বাইরে গেছিলাম।কিন্তু ও ওরকম ছেলে না।যেখানে এরকম কথা বলার দরকার নেই,ও কখনো বলবে না।আমি পাশে বসে ফোনে এধরণের কথা বলতে শুনে অবাক হয়ে ফোন রাখতে জিজ্ঞেস করলে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো,’ওহ তাই বললাম বুঝি?’।নিজেই মনে রাখতে পারতো না।তাছাড়া ছমাসের আগে যে বাইরে গেলে সর্বদা মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরতো, আমার কোলে অবধি দিতনা।সে হঠাৎ করে মেয়েকে কোলে নিতে পারছিল না।এমনিতে স্বভাব শান্ত ছেলে ও,মাস চারেক আগে থেকে খালি একটুতেই রেগে যেত।”
শ্রীজার কথা ভালো করে মন দিয়ে শুনছিল ঋষি।পেশেন্টকে আনেনি শ্রীজা,নিজে পুরোটা গুছিয়ে বলবে বলে।ও আশা করে আছে ওর স্বামী সুস্থ হয়ে যাবে।কিন্তু ঋষি নিজেও জানেনা আদৌ সব ঠিক হবে কিনা।থার্ড স্টেজ ব্রেইন ক্যান্সার,একটু দেরি ই হয়ে গেছে।টিউমারটা আদৌ সার্জারির জায়গায় আছে কিনা।মুম্বাইতে খালি রেডিয়েশন থেরাপি হয়েছে।
এই রোগটা সত্যি মাঝে মাঝে অসহায় করে দেয়।
ব্রেইন টিউমার মানেই মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা না।আকাশেরও মাথায় কষ্ট একদম প্রথমে বিশেষ ছিলোনা,ইদানীং ঘুম থেকে ওঠার পর মাথায় অল্প পেইন হচ্ছে।
স্পাইনাল কর্ডে পেইন,ব্যালেন্স নষ্ট হওয়া, মনে রাখতে না পারা,পায়ে হঠাৎ হঠাৎ টান ধরা বা সেন্সলেস হয়ে যাওয়াও যে লক্ষণ সেটাই অনেকে জানেনা।এমনকি ডক্টরও সিম্পটম ধরে ট্রিটমেন্ট করতে করতে রোগে পৌঁছতে দেরি করে ফেলেন,যেমন আকাশের হয়েছে।

শ্রীজাকে ঋষি বলেছে আকাশকে নিয়ে কাল আসতে।ওর তো ট্রিটমেন্ট অলরেডি চলছিল,তাই অপেক্ষা না করে রিজিউম করে দেওয়াই ভালো।বাকিটা ভগবানের হাতে।

একেই রণজয় বলে বাচ্ছা ছেলেটা কে নিয়ে চিন্তায় আছে ও।পেডিয়াট্রিক সার্জেন ডাক্তার পরিমল ঘোষের সাথে আজ একবার মিটিং করতে হবে।তারপর ওর চিকিৎসাও শুরু করে দিতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।ডাক্তার ঘোষের সাথে আলোচনার পর ঠিক করতে পারবে মেডিকেল অঙ্কলজিস্ট রূপা সেনের সাথে মিটিংটা।
আকাশের টাও ফেলে রাখা যাবেনা।
সত্যি মাঝে মাঝে মাথা কাজ করেনা নিজেরই।
শ্রীজাকে রিপোর্ট গুলো রেখে যেতে বলেছিল ঋষি,আজ আর পেশেন্ট নেই বলে সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিল ঋষি।হঠাৎ বায়োপসি রিপোর্টে এসে থমকালো ও।ও মাই গড! আকাশের কেসটা আর সার্জারির পর্যায় নেই।কেমো নিতে পারবে কিনাও সন্দেহ।নাহ এই কেসটা নিয়ে তো ডক্টর সেনের সাথে আজই কথা বলা দরকার।হসপিটালের এক্সটেনশন নম্বর টেপে ঋষি,কেমোথেরাপি ডিপার্টমেন্টের সাথে কথা বলতে।এখন হয়তো রূপা সেন আছেন হসপিটালে।

“কিরে রাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস এখানে?মন খারাপ করছে?” জয়ি রাইকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলায় এসে দেখে সামনের দিকে বারান্দায় চুপ করে বসে দূরে তাকিয়ে আছে ও।
একটা মৃদু করুন হাসি হাসি রাইমা।
“না আন্টি, মন আর খারাপ হয়না।এমনি ভালো লাগছিলো না বলে বসেছিলাম”, চোদ্দ বছরের মেয়েটার গলায় ওর কথার সমর্থনে জোড়টা পাওয়া যায়না।
জয়িতা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ওর।
“চল খাবি চল,রাত হলো। তোকে আর রণকে খেতে দি।তোর আঙ্কেল আজ এখনো ফেরেনি”।
রণ’র কথায় হঠাৎ বিকেলের কথাটা মনে পড়ে যায় ওর।আন্টি রাইয়ের জন্যে ওদের বেডরুমের ঠিক পাশের রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছে।আন্টি নিজেও থাকতে চেয়েছিল ওর সাথেই, রাই বারণ করেছে,ওর একা থাকতে এখন অসুবিধা হয়না।
আজ বিকেলে ওই ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল,হঠাৎ দরজায় আওয়াজ শুনে ফিরে তাকায়।
দেখে রণজয় দাঁড়িয়ে,নিমেষে রাইমার মুখ লাল হয়ে যায়।আজ দুদিন এসেছে এবাড়িতে, রণ ওর সাথে একটাও কথা বলেনি।এখন আন্টির অনুপস্থিতিতে কিছু বলতে এসেছে।রাইয়ের মনে ধারণা হয়েছিল ওর এবাড়িতে আসায় রণ বিশেষ খুশি হয়নি।তাই ওকে হঠাৎ দেখে একটু ভয় পায়,যদি খারাপ কিছু বলে!
মুখে একটা আলগা হাসি নিয়ে রণ ওর ঘরে এসে ঢোকে।
“সরি কিছু মনে কোরোনা।আমার সাইকেলের চাবিটা পাচ্ছিনা।পরশু সকালে বাইরে থেকে এসে এঘরে ঢুকেছিলাম।তাই একবার চেক করার ছিল।” মুখে কথা বললেও ওর চোখ ঘুরতে থাকে পুরো ঘরে।হঠাৎ কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দে কয়েক মিনিটে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর।
এগিয়ে যায় খাট পেরিয়ে বেডসাইড টেবিলের দিকে।রাইয়ের নজরে আসে একটা লাল রিং,সঙ্গে ছোট একটা চাবি।রণ ওটা হাতে নিয়ে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে,রাইও প্রত্যুত্তরে একটুকরো হাসি ফিরিয়ে দেয়।

“আমি রণ,রণজয়।এবছর সিবিএসসি দিলাম।তুমি কোন ক্লাস?” স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে রণ।

রাইমা একটু থমকায়, ও ভেবেছিল চাবি পেয়ে গেছে তাই রণ আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাবে।কিন্তু ওর যেচে আলাপচারিতায় ও প্রথমে একটু গুটিয়ে গেলেও মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে,”আমি এইটের ফাইনাল দিলাম।ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড”।
রণ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলে,”ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড?সিবিএসসি বা আইসিএসসি না কেন?” আজকাল সবাই তো কনভেন্ট ব্যাকগ্রাউন্ড পছন্দ করে,বিশেষ করে ডাক্তারের মেয়ে।
হাসি চওড়া হয় এবার রাইয়ের।ছোট থেকে ও আর ওর মা এতবার কথাটা শুনেছে তাই এখন আর অবাক হয়না।শুধু বলে,”বাংলা পছন্দের বিষয়।আর ওটা নিয়েই পড়বো ভবিষ্যতে।আমার মা’ও সেটাই চাইতো।”শেষ বাক্যে রাইয়ের গলা একটু ধরে আসে, খেয়াল করে রণ।
এগিয়ে আসে ও রাইয়ের দিকে।এর জন্যে অনেকটা মনের জোর সংগ্রহ করে নেয় ও মনে মনে।মেয়েটার প্রথম দিনের ওই কুণ্ঠিত মুখটা ওকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল।প্রথম ওকে দেখে চমকেছিলো রণ,কোথায় যেন দেখেছে।
পায়ে পায়ে ওর কাছে এসে বলে,”তুই আমার বন্ধুর মত।তোকে তুমি না বলে তুই বললে কিছু মনে করবি?”
রাইয়ের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে।
“নাহ।ভালোই লাগবে”।
রাইয়ের হাসি ছড়িয়ে যায় রণর মুখেও,ভালোলাগার হাসি।
“পরে আড্ডা মারবো তোর সাথে।এখন একটু বেরোনোর আছে।আর প্লিজ মন খারাপ করবি না।আনন্দে থাকবি।তোর কি মনেহয় তোকে কষ্ট পেতে দেখলে আন্টির ভালো লাগতো?”
রাই উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে ফেলে।
“ঠিক আছে বাই।মা বাড়িতে নেই,বোর হোসনা।টিভি দেখিস।” রণ বেরিয়ে গেছিল ঘর ছেড়ে।
একরাশ মন খারাপের মধ্যে একটু মন ভালো করার কথা বলে ওকে একটু ভালো সময় দিয়ে গেছিল।

“কিরে কি ভাবছিস।চল।রণ বসে আছে খাওয়ার টেবিলে।” জয়ি তাড়া লাগায়।
রাই ওর মিষ্টি হাসিটা হেসে বলে,”চল”।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রাতের প্রসাধনটুকু করতে করতে জয়ি কিছু একটা চিন্তা করছিল।নজর এড়ায়না ঋষির।যতই স্মার্ট ফোনের অ্যাপে ইম্পরট্যান্ট খবরের হেডলাইন দেখুক না কেন,দিনের শেষে রাত গভীর হলেও একবার সময় করে খবরে কাগজে চোখ না বোলালে যেন দিনটা সম্পূর্ণ হয়না ওর।কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতেই নজরে আসে আয়নার মধ্যে দিয়ে জয়ির মুখটা।রিডিং গ্লাসটা খুলে বেডসাইড টেবিলে রেখে উঠে যায় ও নিজের স্ত্রীর কাছে।অন্যমনস্ক জয়িতাকে পিছন থেকে আলগা করে জড়িয়ে বলে,”কি এত ভাবছিস তুই তখন থেকে?রাত কত হলো খেয়াল আছে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়ি।
“রণ মনেহয় রাই কে মেনে নিয়েছে।আজ খাবার টেবিলে মনেহলো দুজনের হাবভাবে।এমনকি একবার রণ কে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতে শুনলাম রাইকে।আমি অবাক হয়ে তাকাতে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আমরা তো প্রায় সমবয়সী,বন্ধুর মতই।তাই আর কি…’।রণ স্কুলের বন্ধু ছাড়া ‘তুই’ বিশেষ কাউকে বলেনা।” জয়ির অন্যমনস্কতা রয়েই যায়।
“ওহ কাম অন জয়ি।তোর প্রবলেমের শেষ নেই।এই দুদিন আগে ছেলে রাই কে এড়িয়ে ছিল বলে সমস্যা হচ্ছিল।আজ আবার নরমাল বিহেভ করছে বলে ভাবছিস?তোর সমস্যাটা কি বলতো?’ ঋষি একটু অধৈর্য্য হয় সরে আসে জয়িতার থেকে।
বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় শহরের প্রখ্যাত অঙ্কলজিস্ট ডাক্তার ঋষি মুখার্জী।
জয়িতাও পেছন পেছন এসে দাঁড়ায়।গরমের তীব্রতা এখনো আসেনি,রাতের দিকে এই হাওয়াটা আরামই দেয়।
এককালে জয়িতাও মেডিকেল কলেজে থাকতে কাউন্টার খেত জয় ঋষির থেকে।বিয়ের পরও বেবি প্ল্যান করার আগে ওকেশনালী স্মোক করতো।ইদানিন আর একদমই ছোঁয়না।আজ কি মনে হতে হাত বাড়ালো ঋষির দিকে।
অবাক ঋষি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,”নিবি?”
“হমম এক-দু টান”,জয়ি হাত সরালো না।

ঋষি নিজেও আজকাল খুব একটা সিগারেট খায়না।ডিনারের পরে একটা পুরোও না,হাফ খেয়ে ফেলে দেয়।
একটা বিবেক দংশন হয় ওর,বিশেষ করে রেশমির ঘটনার পর থেকে।
সিগারেটে একটা টান দিয়ে জয়ি বললো,”আমি খুশি হয়েছি রণ রাইকে মেনে নেওয়ায়।কিন্তু বয়সটা ভালো না।তাই ভাবনা হয়।আমি একটা পরের মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছি,তার ভালো করতে গিয়ে খারাপ যেন না হয়।লোকে যেন বদনাম না দেয়।” নিজের মায়ের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করে ও।মমতা সব শুনে জয়িকে কিছুই বলেননি,না সাপোর্ট করেছেন না বিরোধিতা।কিন্তু একটা খুতখুঁতনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন ওর মনে।
জয়ি জানে ওর ছেলে কেমন,তাও চিন্তা তো একটা রয়েই যায় অবচেতনে।
“তুই অতো ভাবিস না।রণ যথেষ্ট ম্যাচিউর ছেলে।শুধু চিন্তা করা বন্ধ কর।হয় রাইয়ের দায়িত্ব নিসনা।আর নিলে এত কিছু ভাবিস না।সময় অনুযায়ী ডিসিশন নেওয়া যাবে।এখন এসব ছাড়”, দিনের শেষে আর এসব মনগড়া দুশ্চিন্তার বোঝা নিতে ইচ্ছে করেনা ঋষির।সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ব্যালকনিতে রাখা অ্যাস্ট্রেটে গুঁজে নিভিয়ে দেয় ও।
“হমম ঠিকই বলেছিস।আমি একটা কথা ভেবেছি,দেখি।” জয়ি বলে নিজের মনে।
“কি আবার ভাবলি?তোর ভাবনা চিন্তার কথা শুনলেই আমার টেনশন হয়।” মজা করে বলে ঋষি।
“সে সময়ে জানবি।এখন শুয়ে পড়বি চ।এদিকে পেসেন্টকে জ্ঞান দিস লাইফ স্টাইল ডিস অর্ডার ক্যান্সারের মত রোগের অন্যতম কারণ।আর নিজে ফর্টি প্লাস এজেও কিছু মানিসনা।” জয়ি ভ্রু কোঁচকায়।
“আর ফর্টি প্লাস! ফিফটি তে প্রায় ঢুকে পড়লাম আমরা।এবার সত্যি করে তাড়াতাড়ি শুয়ে সকালে উঠে মর্নিং ওয়াকে যেতে হবে আগের মত।প্রায় মাস ছয় হলো পুরো রুটিনটা ঘেঁটে গেছে আমাদের।নেক্সট উইক থেকে আবার শুরু করি চ।শরীরটা আনফিটও লাগছে কদিন।” ঋষি ব্যালকনির দরজা টানতে টানতে বলে।

“কেন কি হলো আবার?” জয়ি উদ্বিগ্ন মুখে ঘুরে দাঁড়ায়।
“এই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।বউ দেখে না তাকিয়ে।শরীরের আর দোষ কি?” কথা বলতে বলতে জয়িকে টেনে এনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে ডাক্তার ঋষি।
জয়ি কিছু বলার আগেই দুস্টুমি হাসি হেসে ওর নরম ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটা চেপে দেয়।
প্রেমের পাগলামি নাকি বয়সের সাথে কমে,একঘেয়েমি আসে বিবাহিত জীবনে।ঋষি নিজে কোনোদিন অনুভব করেনি, জয়িকেও বুঝতে দেয়নি।নিয়মিত ভাবে না হলেও মনের ইচ্ছেতে ওরা আজও হারিয়ে যায় একে অপরের মধ্যে।

নিজের বিছানায় শুয়ে হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল ল্যাম্পটা রণ জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে।মনের অস্থিরতা যেন পাঠিয়ে দিতে চাইছে তার বেয়ে।এই দুদিনে কি যেন একটা চাপা অস্থিরতা ওকে সারাক্ষন উত্তেজিত করে রাখছে।সুপার কুল ছেলেটা কোথাও নিজেকে স্থির ভাবে বসাতে পারছেনা কিছুতেই।

আজ রাজীবের জন্মদিনের ট্রিট দিতে ও ডেকেছিল একটা থ্রি স্টার রেস্টুরেন্টে। সবাই এসেছিল, ঈশানি,গৌরব,স্নেহা,দীপ,চন্দ্র এমনকি রুদ্র অবধি।কিন্তু বন্ধুদের আড্ডায় চুপচাপ বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া রণ দু ঘন্টাও টিকতে পারেনি।বারবার একটা হাসি ওর মনঃসংযোগ নষ্ট করছিল।রুদ্র খেয়াল করেছিল ওর অন্যমনস্কতা।কিন্তু রণ এড়িয়ে গেল ওকে।
শেষ অবধি মায়ের সাথে দরকার আছে দোহাই দিয়ে ও বেরিয়ে এসেছিল বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে।

কেন মেয়েটা বারবার ওকে অস্থির করছে!ওর দুর্ভাগ্য কি রণকে দুর্বল করে দিচ্ছে!তাহলে তো ঘটনা গুলো শুনেই ওর খারাপ লাগতো,ওকে দেখার পর কেন এরকম হচ্ছে।কেন মনেহচ্ছে যদি ও পারতো যে চোখটায় শুধু কষ্ট ভরা আছে তাতে সীমাহীন আনন্দ আর খুশি ভরে দিতে…।
ছোট থেকে কোয়েট স্কুলে পরে মেয়েদের প্রতি আলাদা কোনো অনুভূতি ফিল করেনি।যদিও ওদের স্কুলে ক্লাস নাইন থেকেই সব বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড খুঁজে নেয়,কিন্তু ওর কাছে সবাই ছিল বন্ধু।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে রণ।মেয়েটা খুব সরল,ওর চোখ,ওর হাসি সেটাই প্রমান দেয়।আর সেই কারণেই মম ওকে দূরে ঠেলতে পারেনি।ও তো চেনে নিজের মা কে,রাইমার প্রতি মায়ের দুর্বলতার কারণ রণ আজ বুঝতে পারছে।এই মেয়ের মুখ দেখে কারোর পক্ষেই একে উপেক্ষা করা সম্ভব না।
দুদিকে বেনি বেঁধে,লং স্কার্ট পরে যখন জানলার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে যে কোনো কারোর মনে মায়া জন্মাতে বাধ্য।রণ লক্ষ্য করেছে ওকে পাঁচটা কথা বললে,ও একটা কথার উত্তর দেয়।করুন হাসি এক চিলতে সবসময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে।বাইরের জগৎ,বন্ধুবান্ধব যেন কিছুই নেই ওর।

কিন্তু রণ এই অস্থিরতা ওর ছায়াকেও বলতে পারবে না।নাহলে হয়তো মম পারবে না এত বড় দায়িত্ব নিতে।ও জানে ওর মমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও নিজে।তাই ওর অস্থিরতার কারণ জানলে মা কোনো রিস্ক নেবে না।

না রাইয়ের একটা পরিবার খুব দরকার।এমন তো কতবার শুনেছে ও ওর বন্ধুদের কাছে,রাস্তায় বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কোনো মেয়েকে দেখে ওদের বুকে ঝড় উঠেছে।কিন্তু আবার তারা মিলিয়ে গেছে রাস্তাতেই।রেখে গেছে আবার কোনো এক সুন্দর মুহূর্তে হঠাৎ দেখা হওয়ার অপেক্ষা।
ওর বন্ধুদের দেখেছে কদিন খুব আলোচনা করে তারপর আবার ভুলে যেতে।
ওর ক্ষেত্রেও নাহয় তাই হবে।রাই আসলে ওর অবচেতনে রাখা ওর ভবিষ্যৎ সঙ্গীর যেন প্রতিচ্ছবি।কল্পনাবিলাশী রণজয় যার ছবি এঁকে রেখেছিলো প্রেম বোঝার বয়স থেকেই।ওর মা বাবার সম্পর্ক ওর কাছে আদর্শ,ওরা কোনোদিনও রণকে লুকোয়নি একে অপরের প্রতি টানটা।তাই জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রণ নিজের মনের ক্যানভাসে এঁকে রেখেছিলো যে মেয়ের ছবি কাকতালীয় ভাবে তা মিলে গেছে রাইমার সাথে।
কিন্তু রাই ওর ভালোলাগা হয়ে মনে থাকবে আপাতত।রণ হবে ওর খুব কাছের এক বন্ধু।তারপর ভবিষ্যৎ ঠিক করবে বাকিটা।
বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দেয় রণ।জোরে জোরে দুবার শ্বাস নেয়।বেরিয়ে আসে পুরোনো রণ হয়ে।চুপচাপ শান্ত মাথার মেধাবী ছেলে।যে জানে তার দায়িত্ব।রাইমার বন্ধুত্ব বেছে নেয়।হয়তো রাই ওর হঠাৎ ভালোলাগা।হয়তো এটা বয়সের ধর্ম।
আগে কোনোদিনও ওদের বাড়িতে কোনো ওর বয়সের কাছাকাছি কোনো মেয়ে থাকেনি।ওর মা মাঝে মাঝে মজা করে বলতো,”রণর বউ আমার মেয়ের জায়গা ভরাবে।”
তাই হয়তো ওর মনের অবচেতনেও এবাড়িতে মেয়ের উপস্থিতি মানে ওর বউ চিন্তাটা মনে গেঁথে ছিল।মনের কল্পনার দৃশ্যে রাইকে বসিয়ে ফেলছে হয়তো।

এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তার মাঝে ওর চোখ বুজে আসে।রাইকে মনের একদিকে সরিয়ে রেখে ও হারিয়ে যেতে চায় ঘুমের রাজ্যে।
একটা দুর্বলতা কে প্রশয় না দিয়ে তাকে এই বয়সেই মনের গভীরে পুঁতে দেয় ও।
একটা অসহায় মেয়ের প্রতি শুধুমাত্র ভালোলাগাকে বাঁচিয়ে রেখে ভালোবাসা নামক আবেগ কে মাথাচাড়া দিতে দেয়না ষোল বছর বয়সী ছেলেটা।
সময় এগোতে থাকে।

ক্রমশ….