মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৬

0
434

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#ষষ্ঠ_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

‘…কুঁক-কুঁক-কুঁক-কুঁক…কুঁক-কুঁক-কুঁক-কুঁক…’ হাত বাড়িয়ে বেড-সাইড টেবিলের ওপর রাখা এলার্ম ঘড়িটা বন্ধ করে জয়ি।অনেকেই এখন ফোনেই এলার্ম দেয়।কিন্তু ছোটবেলার এই তীক্ষ্ণ আওয়াজ এখনও কানে না ঢুকলে ওর ঘুম ঠিক করে ভাঙে না।
আরো কিছুক্ষন বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়ে ও বিছানা ছেড়ে।ঋষির দিকে তাকিয়ে দেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।কাল রাত থেকেই একটু আপসেট ও।অনেক জিজ্ঞেস করেও কিছু বলেনি কাল।জয়ি জানে ঋষির ধরণ এটাই,নিজে না চাইলে কিছুতেই মুখ খুলবে না।
গিজারের সুইচ অন করে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ও।
পুরো গরমকাল দিনে দুবার স্নান করা ওর অভ্যেস।সকালে উঠে ভালো করে স্নান করে,আর হসপিটাল থেকে ফিরে আরো একবার,সেটা দুপুর হোক কি রাত।
মিনিট দশ পর বালতি ভরার কল খুলতে যাবে,শুনতে পায় ঋষির ফোন বাজছে।আজ তো ওর দুপুরে ডিউটি।এত সকালে ফোন! নিশ্চই এমার্জেন্সি।
আত্মীয়রাও কখনো রাতে ছাড়া ফোন করেনা,ওরা জানে সকালে ঋষি দরকার ছাড়া ফোন ধরা পছন্দ করেনা।কৌতূহলী হয় জয়িতা।কিন্তু ফোন রিসিভ করার পর আর কোনো কথা বাথরুম থেকে কানে আসেনা।জলের ট্যাপ খুলে দেয় ও।

মিনিট পনেরো বাদে ওয়াশরুম থেকে বাথরোব গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এসে একটু থমকায়।বিছানায় নেই ঋষি,নজর যায় ব্যালকনিতে, আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কৌতূহল বাড়ে।ওয়ার্ডরোব খুলে বাড়িতে পড়ার ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে আগে চেঞ্জ করে নেয়।তারপর চুলে জড়ানোর ছোট তোয়ালেটা নিয়ে ভালো করে মাথায় জড়াতে জড়াতে ঋষির পিছনে এসে দাঁড়ায়,কিন্তু অন্যমনস্ক ঋষি তা বুঝতে পারেনা। জয়ি এবার পিছন থেকে ডানহাতটা ওর বাঁ কাঁধে রেখে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।ক্ষনিকের জন্য চমকে ওঠে ও,হারিয়ে গেছিল অনেক দূরে কোথাও, বুঝে যায় জয়ি।
ওর দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বাইরের দিকে নজরটা ফেরায় ঋষি।
কিছুক্ষন চুপ থাকে দুজনেই,জয়িতা সময় দিতে চায় ঋষিকে।জানে এবার মুখ খুলবে ওর প্রিয় বন্ধু ওর কাছে।

মিনিটের নিস্তব্ধতার পর মুখ খোলে ঋষি।ধীরে ধীরে বলে,”আমরা ডাক্তাররা সবচেয়ে বেশি অসহায়,তাই না রে?মেডিকেল সায়েন্সও কোথাও গিয়ে থেমেই যায়।বিশেষ করে আমাদের দেশে,একটা তরতাজা প্রাণ শেষ হয়ে যায় চোখের সামনে।মেডিকেল সায়েন্স সাপোর্ট না করলে আমরা ভগবান হতে পারি না।মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যি যদি ভগবান হতে পারতাম।” আবেগে গলা ধরে আসে ওর।জয়ি জানে ঋষি সহজে ভাঙে না।
“কি হয়েছে সোনা?প্লিজ আমায় বল।তুই তো আমায় সব বলে হালকা হোস।তোর মুখে শুনে শুনে তোর পেসেন্টদের আমিও চিনে যাই।সেই জন্যে ওদের ভালো খবরে যেমন আনন্দ পাই,খারাপ খবরে চোখ দিয়ে জলও বেরিয়ে আসে।প্লিজ বল কার জন্য তোর মন এত খারাপ?” জয়িতা স্নেহ মেশানো গলায় বলে।
মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে সেটা ছাড়তে ছাড়তে ঋষি বলে,”ছেলেটা কে কোনো ভাবেই আরো কিছুদিন রাখা গেল না রে।ওরাল কেমো শুরু হওয়ার তিনদিনের মধ্যে সেই যে কোমায় গেল আর ফিরলো না।ওই বাচ্ছা মেয়েটা,ওর ওয়াইফ ওদের লড়াইটা বড্ড কঠিন করে দিয়ে গেল”।

জয়ি হাঁ করে শুনছিলো কথাগুলো।ওর অবাক হয়ে যাওয়া মুখে ফুটে উঠছিলো প্রশ্নটা,সেটাই বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে,”কার কথা বলছিস তুই?”

“আকাশ।বলেছিলাম তোকে ওর কথা।মাসখানেক আগে ওর স্ত্রী শ্রীজা এসেছিল আমার কাছে।তোর মনে নেই হয়তো”,ঋষি উদাস গলায় বলে।

কিছুক্ষন ভাবে জয়ি,তারপর হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ বম্বে ফেরত।ব্রেইন টিউমার আর অপারেটের জায়গায় ছিলোনা।থার্ড স্টেজে ধরা পড়েছিল ব্রেইন ক্যান্সার।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি..!!!” শেষে জয়ির কথাও আস্তে হয়ে যায়।

ঋষি ধীরে ধীরে বলে,”মুম্বাই হসপিটালে প্রায় 40টা রে দিয়েছিল।আমরা এখানে এডমিট করার পর টেস্ট করে বুঝি কেমো টানতে পারবে কিনা গ্যারান্টি নেই।তাই ওরাল কেমো শুরু করি।কিন্তু তিনদিনের মধ্যে কোমায় চলে গেল।বেচারার মেয়েটা বড্ড ছোট,একদিন দেখেছিলাম।আর শ্রীজারই বা বয়স কত?মেয়েটা কে দেখলে কষ্ট হয়।জানিস জয়ি আকাশের বাবারও লান্স ক্যানসার ধরা পড়েছে।”

“তার মানে হেরিডিটারি?” জয়ি ঋষির মুখের দিকে তাকায়।

“তুই না ডাক্তার?তুইও এরকম কথা বলছিস!তোকে তো আগেই বলেছি সেভাবে এখনো সায়েন্টিফিক্যালি কোনো প্রুফ নেই এর সাপোর্টে।তুই বল ক্যান্সার কেন হয়,জিনের মিউটেশন থেকে।এখন যদি জেনেটিক মিউটেশন বাবা অথবা মায়ের থেকে সন্তানের কাছে যায়ও,সেটা ভবিষ্যতে ক্যান্সারের রিস্ক বাড়ায় অ্যাভারেজের তুলনায়।কিন্তু হবেই সেটা মোটেই না।আর অনেক ক্ষেত্রে এটা পাসও হয়না।আসলে কি বলতো এই মিউটেশনের কারণ আমাদের পরিবেশ আর পরিস্থিতি।তোকে সেই বাচ্চাটার কথা বলেছিলাম না, যার অ্যাকিউট লিম্ফোব্ল্যাস্টিক লিউকেমিয়া হয়েছে রে,তার কারণ সম্ভবত রেডিয়েশন।আবার কয়েকটা কেমিক্যালের থেকে হয়। অ্যাসবেস্টস খনিজ বা মিনারেল থেকে ক্যান্সার হওয়ার তো প্রমাণও পাওয়া গেছে,লান্স ক্যান্সার।আসলে ক্যান্সারের পিছনে হেরিডিটারি কারণের এখনো কোনো প্রমান নেই।ব্রেস্ট ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার এরকম কিছু ক্ষেত্রে রিস্ক থাকে,কিন্তু হেরিডিটি কারণ এখনও প্রমান সাপেক্ষ।জিনের মিউটেশন থেকে ক্যান্সার হয়,কিন্তু সেটা বংশপরম্পরায় পাস হয়না।” ঋষি যেন স্টুডেন্টকে বোঝাচ্ছে এভাবে জয়িকে বোঝায়।কারণ ও জানে জয়ির মনে রেশমির মেয়ে রাইমাকে নিয়ে একটা ভয় সবসময় কাজ করে।
কিছুক্ষন দুজনেই চুপ থাকে তারপর জয়ি বলে,”বেচারি!যে গেল সে তো চলেই গেল।কিন্তু যারা রইলো তাদের জন্যে যে কত বড় যুদ্ধ ছেড়ে গেল।আমাদের সমাজ আজও এগোয়নি বুঝতে পারবি যখন একটা মেয়ে অল্প বয়সে স্বামী হারায়।সমাজ ধরেই নেয় তার স্বাভাবিক জীবনের আর অধিকার নেই।অথচ একটা ছেলের ক্ষেত্রেই এটা উল্টো হয়ে যায়।ওই শ্রীজা বলে মেয়েটার জীবনে বরং আরও লড়াই বেড়ে গেলো।আর ও নিজেই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে বাচ্ছাটার যে কি হবে… “,জয়িতা থামে ঋষির কথায়।

“না আমি যতদূর জানি মেয়েটা খুব শক্ত মনের।যেভাবে ও সমানে স্বামীর পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে..ও অনেক আগেই বুঝেছিলো চান্স খুব কম।তাও ভাঙেনি,সমানে আকাশকে সাহস জুগিয়েছে।ওকে আমি প্রথম কাঁদতে দেখি যখন আকাশ কোমায় চলে যায়।জানিনা আজ ওর সাথে দেখা হবে কিনা তবে হয়তো পরে হলেও ওকে একবার হসপিটালে আসতে হবে কিছু কাগজ পত্রের জন্যে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”সত্যি বলছিস এতদিন একরকম লড়াই ছিল,এরপর একটা অন্যরকম লড়াই শুরু হবে।”

দুজনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে।কিছু নিস্তব্ধতা কথা বলতে থাকে।ডাক্তারদের জীবনে জন্ম বা মৃত্যু আলাদা করে হয়তো প্রভাব বিশেষ ফেলেনা।নিজে হাতে একটা শিশুকে পৃথিবীতে আলো দেখানোর আনন্দ জয়িকে আজও স্পর্শ করে হয়তো,কিন্তু ঋষির অভিজ্ঞতায় মৃত্যুর শোক ওকে আর ছুঁতে বিশেষ পারেনা।বরং কেউ যদি সুস্থ হয়ে ফিরে যায় সব দুঃখ ম্লান হয়ে একটা ক্ষনিকের ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় মনে।
কি অদ্ভুত ওদের জীবন।একজন নতুন প্রানের জন্ম দেখে বেশি,অন্যজন মৃত্যুকে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার সাথে।কিন্তু কখনো কখনো এই আকাশের মত তরতাজা প্রানের হেরে যাওয়া ওর নিজের অসহায়তাকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।বুঝিয়ে দিয়ে যায় ভগবানের ওপর কারোর হাত নেই,ভগবানরূপী মানুষ শুধু চেষ্টা করতে পারে মাত্র।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যতটা আয়ুরেখা দিয়ে পাঠায় তাকে বাড়ানোর ক্ষমতা কোনো মানুষেরই নেই।
তারপরও জীবন চালাতে হয়।যারা রয়ে যায় তাদের এগিয়ে যেতে হয় জীবনের সাথে সাথে।

রাইমা সিলিং পাখাটার ঘোরা দেখছিল একমনে।চোখটা ফ্যানের দিকে থাকলেও মন ছিল অতীতে।এলোমেলো চিন্তা গুলো আজকাল বড্ড ফিরে ফিরে আসে।
আজ কেন জানেনা সেই দিনটা বারবার মনে ফিরে ফিরে আসছে,মনের চোখে ভেসে উঠছে সেদিনের ঘটনাটা যেটা সহজ করে দিয়েছিল ওকে ওর জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।

বাপি নর্থবেঙ্গলের হসপিটালে চলে গেছে প্রায় একমাস হলো,আর ও নিজের সিদ্ধান্তে জয়িতা আন্টির বাড়ি চলে এসেছে তার একদিন আগে।

পরীক্ষা শেষে কয়েকদিনের জন্যে যখন এসেছিল এই বাড়িতে ও নিজেও দ্বিধায় ছিল জীবন নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবে!
হোস্টেল না আন্টির বাড়ি,কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না।জন্ম থেকে মায়ের আঁচল ধরা মেয়েটা হস্টেলের কথা ভাবলেই গুটিয়ে যাচ্ছিল মনে মনে।আবার অন্যের ওপর নির্ভর করে বাঁচার ইচ্ছাতেও সায় দিচ্ছিল না মন।খালি কান্না পেতো তখন।
আন্টির বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার দুদিন আগে এক বিকেলে ছাদে ঘুরছিল ও।খুব সুন্দর জয়ি আন্টির ছাদটা।হঠাৎ ছাদ থেকে নজর গেল আঙ্কেলের বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে।ভুলিয়ে রাখা মন হুহু করে উঠলো হঠাৎ করে।চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো সিনেমার মত কতগুলো দৃশ্য।
ওদের কোয়ার্টারের সেই বিরাট গাছটা,যার তলাটা বছরের এই সময় রঙিন হয়ে থাকে।
ও আর মা মিলে আগের বছরেও সেই ফুল কুড়িয়েছে।বেশি খুঁজতো কুঁড়ি,যার মধ্যে থেকে লম্বা পুংকেশর ছিঁড়ে ও আর মা একটা খেলা খেলতো,কে অন্যের লম্বা ডাঁটিটা নিজেরটা দিয়ে ছিঁড়ে দিতে পারবে!তারপর কুড়িয়ে পাওয়া ফুল মাথায় গুঁজতো।পরীক্ষা শেষে বিকেল গুলো মায়ের সাথেই হইহই করে দিনগুলো কাটতো ওর।হঠাৎ মনের গভীরে চেপে রাখা কষ্ট গুলো ওর চোখ ভিজিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।

‘কেন গেলে মা আমায় একা করে দিয়ে।কোথায় গেলে তোমায় দেখতে পাবো!…’,হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো রাই।জানতো আন্টি বাড়ি নেই,কেউ ওর খোঁজে ছাদে আসবে না।
কিন্তু হঠাৎ একটা হাত মাথায় এসে হাত বুলিয়ে দিল।চমকে উঠে জল ভরা চোখে ঘুরে তাকিয়ে অপ্রস্তুতে পরে গেল ও।
চোখ ভর্তি জল তখনও গাল বেয়ে গড়াচ্ছিলো।সামনের জন মুখে একটা আলগা হাসি টেনে মুছিয়ে দিলো জলটা।

কান্নাটা যেন আর বাধা মানলো না।ক্ষনিকের স্নেহের স্পর্শে আরো দ্বিগুন বেগে উপচে উঠলো আবেগ।হয়তো মা,আন্টি বা বাবা থাকলে কান্না চাপতে ঝাঁপিয়ে পড়তো তাদের বুকে,কিন্তু সামনের ছেলেটা যে রণ।ওর অর্ধপরিচিত ওর প্রায় সমবয়সী একটা ছেলে,যার সাথে ওর সম্পর্ক বন্ধু নামেই আটকে রেখেছে রণ।আন্টি কোনো কিছু বলতে গেলেও এড়িয়ে গেছে ও বারবার,রাইমা নজর করেছে।ও নিজেও বোঝেনি রণদা ওর এবাড়িতে থাকাটা আদৌ পছন্দ করছে কিনা! আন্টি যখনই রণর সামনে ওকে বলেছে,”থাক না রাই তুই আমার কাছে।আমার খুব মেয়ের শখ ছিল।তুই আর রণ দুটিতে মিলে আমার বুক জুড়ে থাকবি।আমারও মেয়ের সাধ পূরণ হবে”,রণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেছে।
এমনকি সেদিন রণজয়কে রাইমা কি বলে ডাকবে জয়িতার এই অদ্ভুত প্রশ্নের জবাব রণ নিজেই দিয়েছে।
“ও আমায় রণ বা রণদা বলে ডাকবে”,ওর দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুধু রাই না জয়িতাকেও যে অবাক করেছিল সেটা ফুটে উঠেছিল আন্টির চোখে মুখে।রাই বুঝতে পারে না,রণ একা ওর সাথে যতটা স্বাভাবিক থাকে,আন্টির সামনে থাকলে গুটিয়ে থাকে কেন?
রণর স্নেহের স্পর্শে বেরিয়ে আসা চোখের জল আটকাতে রাই আবার মুখ গোঁজে নিজের দুটো হাতের তালুতে।
উল্টো দিকের অনভিজ্ঞ রণজয় জোর করে না কান্না আটকাতে,বরং ওর মাথায় ওই মুহূর্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অপেক্ষা করতে থাকে রাই-এর নিজেকে সামলে নেওয়ার।
কিছুক্ষন পর রাই মুখ তুলে দেখে রণ সেই হাসি মুখে কিন্তু চোখে একরাশ কষ্ট নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।অবাক হয় রাই ওর চোখ দেখে।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে রণ মুখ খোলে,”কিরে কাঁদছিলি কেন?আন্টিকে মনে পড়ছিল?বলেছি না তোকে এভাবে দেখলে আন্টি আরো কষ্ট পাবে।চোখ মোছ এবার।” বলে নিজের পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে,”এই নে।তোর এটা খুব প্রিয় তো?” রাইয়ের প্রিয় ব্র্যান্ডের প্রিয় ফ্রুট এন্ড নাটের চকলেটটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে।

জলভরা চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকায় রাই।কিকরে জানলো রণদা ওর প্রিয় চকলেটের কথা!

রণ এবার ইশারায় বলে চোখের জলটা মুছে নিতে।তখন রাইয়ের চোখে জল দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে নিজে মুছিয়ে দিলেও এবার আর সেটা রিপিট করে না।উল্টে রাইয়ের অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলে,”অতো অবাক হওয়ার দরকার নেই।একটা ট্রাই নিয়েছিলাম।মেয়েদের শুনি সবসময় এই চকোলেট টাই ফেভারিট।তাই…”,কথা শেষ না করেই হোহো করে হাসতে থাকে।
রাই এর মুখেও এতক্ষন পর হাসি ফোটে।বুঝতে পারে ওর মন ভালো করতে রণদা মজা করছে।চকলেটটা কার জন্যে আনা শিওর হতে ধরা গলায় শুধু বলে,”এটা আমারই তো?নাকি…”,কথাটা শেষ না করে হাসি মুখে তাকায় রণর দিকে।

“নাকি?” রণ রিপিট করে কথাটা ভ্রু দুটো ওপরে তুলে।তারপর একগাল হেসে লজ্জা পাওয়ার মত মুখ করে বলে,”নাকি আমার।লল!আমার হট ফেভারিট এটা।তাই খাবো বলে কিনে এনেছিলাম।বাট ইটস ওকে,একটা ছিঁচকাদুনে মেয়েকে আমি চুপ করাতে চকলেটটা নাহয় স্যাক্রিফাইসই করলাম”,দুস্টুমি হাসি হেসে বলে,”আমায় না দিয়ে সে কি একা একা খাবে বল?”
রাই এবার হেসে ফেলে ভালো করে।নাক টানতে টানতে বলে,”থ্যাংক য়্যূ।কিন্তু যদি চকলেট না থাকতো কি করতে?”

রণর মুখের হাসিটা একটু ছোট হয়।মনে মনে বলে,’জানিনা কি করতাম।তুই যে এখনও বড় আবছা আমার কাছে।কিন্তু শুধু এটা জানি তোকে কাঁদতে দেখতে,মুখ শুকনো করে ঘুরতে দেখতে ভালো লাগেনা।আজকাল কংসেনট্রেশন বড্ড কমে গেছে।আগে সারাদিন নিজের ঘরে কাটিয়ে দিতাম।বাইরে থেকে এসে মম বাড়ি না থাকলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকতাম।এখন আগে তোকে খুঁজি।আজও তো খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে দেখলাম তুই নিজের মনে কাঁদছিস।কেন বুকে একটা কষ্ট শুরু হলো বলতো ওটা দেখে!!’
মুখে বললো,”হমম তখন ভেবে নিতাম কিছু একটা।তবে তুই শিওর থাক আমি আমার বন্ধুদের বেশিক্ষন মন খারাপ করে থাকতে দিইনা।ঠিক হাসিয়ে দি কোনো না কোনো ভাবে”, হাসিটা চওড়া হয় আবার।
রাই এর পাশে রেলিংয়ের ধারে গিয়ে দাঁড়ায় রণ।
গলার স্বর পাল্টে বলে,”রাই কাঁদিস না আর।আমাদের জীবন এটাই।সবার জীবনে কিছু না কিছু যুদ্ধ আছে।আমার এক বন্ধু ছোট বেলায় বাবা কে একসিডেন্ট হারিয়েছিল।তার মা, বাবার জব পেলেও একা হাতে পারছিলেন না ওর দেখাশোনা করতে।ওকে হোস্টেলে পাঠাতে বাধ্য হন।তখন আমরা ক্লাস টু তে পড়ি।এখন সেই ছেলেটা আর তার মা কে বুঝতে চায়না।বোর্ড এক্সাম দিয়ে বাড়ি ফিরেছে।সেদিন রাস্তায় দেখা হলো।ওর কথায় বারবার বুঝতে পারছিলাম নিজের মায়ের প্রতি একটা ডিসরেস্পেক্ট তৈরি হয়েছে।ওর ধারণা জন্মেছে ওর মা নিজের জীবন বাঁচতে ওকে হস্টেলে পাঠিয়েছিল।কিন্তু জানিস আন্টি তো এপাড়াতেই রয়ে গেছিলেন,আমরা জানি কতটা একাকিত্বের মধ্যে উনি দিন কাটাতেন।ওঁর ছেলের কথা ভেবেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।কিন্তু আজ সেই ছেলে মা কে বুঝতে চাইছে না”,এতটা একটানা বলে ও তাকালো রাইয়ের দিকে।বুঝতে চেষ্টা করলো ওর মনোভাব।

রাই, মনের কথা যার মনেতেই থাকে বেশিরভাগ সময়,উল্টো দিকের মানুষটা ওর থেকে কিছু জানতে চায় বুঝেও যার মুখ খোলেনা সে আজ সহসা অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বললো,”তোমার সেই বন্ধুটা কতটা একা হয়ে গেছিল জিজ্ঞেস করেছিলে রণ দা? কতটা অভিমান জমেছিল ওই ছোট বাচ্ছাটার মনে?হয়তো অনেকটা অসহায়ও অনুভব করেছিল ও নিজেকে।তারপর অনেক লড়ে যখন সব ভয়,একাকিত্ব,অসহায়তা কাটালো শুধু অভিমানটাই বেঁচে রইলো।আসলে ভালো ও ছিল না,হয়তো এখনো নেই।”

রণ আর কিছু বলতে পারলো না,চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো রাই এর দিকে।বুঝতে চেষ্টা করলো ওর অভিমানও কি ওর বন্ধুর মতোই গভীর?বুঝতে পারলো না।মনটাই যে বড্ড গভীর মেয়েটার,তল পাওয়া কঠিন।

“রাই তোর হস্টেল যেতে ইচ্ছা করছে না তাই তো?” কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে রণ।

উত্তর দেয় না রাই।কি উত্তর দেবে ও!মুখ ফুটে সত্যি বলতে যে বড় লজ্জা করছে।রণ আবার নিজেই বলে,”যাচ্ছিস কেন তাহলে?”
অন্যদিকে মুখ করে থাকা রাই চকিতে মুখ ঘোরায় রণজয়ের দিকে।কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে,হয়তো ভরসা,হয়তো বিশ্বাস,হয়তো বা সত্যিটা।কিন্তু রণর হাসিটা ওকে বন্ধুত্বের আশ্বাস দেয়।
হাসিমুখে রাই বলে,”তুমি হলে কি করতে রণ দা?”
-“মনের কথা শুনতাম।কখনো কখনো মাথা,লোকজন সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু মনের কথা শোনা উচিত।তাতে আক্ষেপ থাকেনা,থাকেনা ভবিষ্যতে লাভ ক্ষতির বিচারের কষ্ট।”

এবার অবাক হওয়ার পালা রাইয়ের।কিন্তু রণর কথা যে ওর ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিতে থাকে।ছোট রাই বুঝতে পারেনা কার কথা শুনবে?ওর মন যে স্বার্থপরের মত এই পরিবারটার সাথে থেকে যেতে চাইছে।কিন্তু মাথা বিদ্রোহ করছে।সবটা যখন গুলিয়ে যাচ্ছে তখন রণ ওর কাঁধে হাত রাখে।বন্ধুকে বোঝানোরভঙ্গিতে বলে,”কেন এত কিছু ভাবছিস রাই?তুই যেমন, তেমন ভাব।তোর মনে এখনো ছেলেমানুষি ইচ্ছা গুলো বেঁচে আছে।ইগো বা বড়দের কমপ্লিকেটেড চিন্তা তোকে ছোঁয়নি এখনো।তাহলে জোর করে সেগুলো মনে পুরিসনা।নিজে ভালো থাকতে চাওয়া,আনন্দে থাকতে চাওয়া সেলফিসনেস না।তোর মন যা চায় সেটা কর,অহেতুক সবার কথা শুনে অপছন্দের কাজ করিস না”।

রণর ওই কথাগুলো দুদিন রাই কে খুব ভাবিয়েছিলো।ও দুদিন পর বাড়িও ফিরে গেছিল।কিন্তু ওর মনে গেঁথে যাওয়া রণর কথা গুলো শেষ অবধি ওকে শক্তি দিয়েছিল বাবাকে পুরোটা বুঝিয়ে বলার।
সারাজীবন দুর্বল মেয়েটা সেদিনের পর থেকে কিছুটা সাহসী হয়েছে নিজেকে নিয়ে।নিজের ভালো থাকাটা বুঝতে শিখেছে।এবাড়ি এসে ও ভাবেনি একটা সত্যি বন্ধু পাবে।কিন্তু রণ যেন ওর মায়ের বন্ধুত্বের জায়গাটায় সবার অলক্ষ্যে দখল করে নিয়েছে।
রাই সেদিনের পর থেকে রণ কে খোঁজে কোনো সমস্যায় পড়লে।ওর থেকে বছর দুয়েকের বড় ছেলেটা কি সুন্দর ভাবে ওকে বুঝিয়ে ওর সমস্যার সমাধান করে দেয়।

রাই ওর ঘরে শুয়ে চুপচাপ এসবই ভাবছিল।রণ বাংলা পড়ায় একটু কাঁচা,কারণ ওর স্কুলে বাংলা বিশেষ পড়তে হয়নি।হিন্দি ছিল সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ।তাই ও রাইয়ের কাছে জোর করে এসে এসে বাংলা শেখে,আর ওকে সহজ করে বুঝিয়ে দেয় অঙ্কটা।অন্য বিষয় কিছু আটকালে সেটাও বুঝতে সাহায্য করে।
কিন্তু রণ ওকে সবসময় একটা কথা বলে ,”আমরা খুব ভালো বন্ধু”।কেন যে এটা বারবার বলে রাই বুঝতে পারেনা।তবে আন্টি থাকলে রণ বিশেষ ওর ঘরে আসেনা।এগুলো মাঝে মধ্যে রাইকে ভাবায়, তবে বেশিক্ষন ও মনে রাখেনা বিষয়গুলো।

হঠাৎ ফোনে টুং করে আওয়াজ হলো।বাবা যাওয়ার আগে এটা কিনে দিয়ে গেছে।নতুন স্কুলে দু একজন বন্ধু হলেও মোবাইলের কথা বিশেষ কাউকে বলেনি।আন্টি বাবার সাথে কথা বলে তিনজন হোম টিউটর রেখেছে।তাই স্কুল ছাড়া বাইরে বিশেষ যায়না বলে ফোনটা সারাদিন প্রায় অফ থাকে।স্কুল থেকে ফিরে অন করে,বাবা ফোন করে বলে।অন্যদিন শোয়ার আগে অফ করে দেয়।আজ ভুলে গেছে।
কৌতূহলী হয়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয় বেডসাইড টেবিল থেকে।
আরে একটা মিসড কলও আছে।কৌতূহলী মন আনলক করে ফোনটা।
মিসড কল রণদা।এত রাতে কি ব্যাপার!ভাবতে ভাবতে হোয়াটস অ্যাপ খোলে।
‘কিরে পেঁচি ফোন অন? ঘুমোসনি এখনো?’

আলতো হাসি ফোটে রাইয়ের ঠোঁটে।
‘না।ঘুমোবো এবার।আজ ফোন অফ করতে ভুলে গেছি।কিন্তু তুমি কল করেছিলে কেন?’

বেশ কিছুক্ষণ উত্তর আসেনা।ফোনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে যেই ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে যাবে,আবার আলো জ্বলে টুং করে আওয়াজ হয়।ফোনটা আবার হাতে তুলে নেয় রাই।
‘কল করিনি।মিসড কল দিয়ে দেখছিলাম অন আছে কিনা।অন্যদিন অফ থাকে…আজ অন আছে বলে রিং হয়ে গেছে’,সাথে একটা জিভ বের করা ইমোজি।

অবাক হয় রাই।কিন্তু কি লিখবে বুঝতে পারেনা।রণদা কে ও একদম বুঝতে পারেনা।পড়াশোনায় প্রচন্ড সিরিয়াস কিন্তু প্রাণখোলা একটা ছেলে।এটা ঠিক বন্ধুদের গুরুত্ব ওর জীবনে অনেকটা ওপরে,কিন্তু রাই নিজে কোনোদিন এরকম বন্ধু পায়নি বলে ওর কথায় কথায় অবাক লাগে।হয়তো এটাই রণজয়ের প্রকৃতি।খারাপ তো লাগেনা।বরং একটা ভালো লাগাই কাজ করে।একটা অনুভূতি কেউ একজন আছে,যাকে নিজের সবটা বলা যায়।মা চলে যাওয়ার পর এক জায়গাটাই বড্ড ফাঁকা হয়ে গেছিল ওর।আন্টিকে যতই ভালোবাসুক, অনেক না বলা কথা থেকেই যেত।
রণ র মতো বন্ধু সেই জায়গাটা অনেকটা পূর্ণ করে দিয়েছে।আজ মায়ের জন্য মন খারাপ করলেও প্রথম দিকের মত নিজেকে অতটা একা আর অসহায় লাগেনা।
রণর মজা,ওর খুনসুটি,ওর লেগ পুল করা কিংবা বন্ধু হয়ে বোঝানো রাইকে এখন অনেক স্বাভাবিক করেছে।একা ঘরে আর অত কান্না পায়না।চোখ বুজে মায়ের ভালো স্মৃতি মনে করতে করতে ঘুম পেয়ে যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে মিনুদির কথা।কাল একবার ফোন করবে মিনুদি কে।কেমন লাগছে আবার হসপিটালের কাজ!
কি মনে করে ফোনটা তুলে নেয় রাই।টাইপ করে লেখে,’গুড নাইট রণদা।ঘুমোলাম।কাল কথা হবে।’
মেসেজ সেন্ড করে উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা অফ করে দেয় ও।

অন্যঘরে ফোনটা হাতে নিয়ে জানলার ধারে ইজিচেয়ারে বসে থাকা রণ মেসেজ দেখেই সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই লিখে সেন্ড করে রাই কে,’গুডনাইট’।
নাহ! ডেলিভারি হয়না মেসেজটা।মেয়েটা ফোনটা অফ করে দিয়েছে শিওর।নিজের মনে হেসে ফোনটা সাইলেন্ট করে নিজের বালিশের পাশে রেখে দেয় ও।তারপর কি মনে হতে এসিটা বন্ধ করে ফ্যানটা জোর করে দেয়,খুলে দেয় জানলাটা অল্প করে।
রাইয়ের এসির অভ্যেস নেই,তাই চালায়না।রণ জানে।

“এই নে দাদুভাই।এই দুপুর রোদে কেউ বের হয় বাড়ি থেকে?” মমতা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে নাড়ুর প্লেট আর জলের গ্লাস বাড়িয়ে দেয় রণর দিকে।

“আরে তুমি আবার কেন উঠে এসব আনতে গেলে।আমি খেয়াল করিনি একদম।” নিজের ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বলে রণ।আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে দিদানের খাটে।তারপর নাড়ুর প্লেটে চোখ যেতে চকচকে চোখে বলে,”তুমি করেছ দিদান?”

“না রে ভাই।এই বুড়ির শরীরে কি আর সে জোর আছে।বেশিক্ষন দাঁড়াতেই পারিনা।তোর সুলেখা মাসি দুটো নারকেল এনেছিল ওর বাড়ি থেকে,নিজেই ছাড়িয়ে কুড়ে ওই বানালো।জানে তুই ভালোবাসিস।কালই বলছিল ‘দিয়ে আসবো রণদাদা কে?’ আমি বললাম ‘না সে আসবে ঠিক।দুদিন অন্তর সে ঠিক আসে বুড়ি দিদানের কাছে’।” মমতা বিছানায় বসতে বসতে বলে।
সুলেখা এই সময় পাশের ঘরে একটু ঘুমোয়।দুপুরের ঘুমটা না হলে ওর শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে।

মমতার কথায় হেসে ফেলে নাড়ুর প্লেট থেকে নাড়ু নিয়ে মুখে পুরে দেয় রণ।
“দাদুভাই সেই মেয়েটা তোদের বাড়ি এসে কিভাবে আছে রে?কথা শুনছে তোদের?” নাতি সপ্তাহে সপ্তাহে এলেও বসেনি বিশেষ শেষ ক’বার।আর সুলেখা থাকে বলে সব কথা ওর সামনে বলেনও না মমতা।আজ সুযোগ পেয়ে তাই কথাটা পারলেন।
চুপ করে ভাবে রণ কি বলবে দিদান কে?কতটা বলবে?
মায়ের কাছে এতদিন ওর লুকোচুরির কিছু ছিলোনা।কিন্তু যত বড় হচ্ছে বুঝতে পারছে না চাইলেও কিছু কথা মা কে বলতে গিয়ে আটকাচ্ছে।কিছু অনুভূতি,কিছু উপলব্ধি পুরোটা হয়তো মা কে বলা সম্ভব না।এতদিন ওর দুনিয়াটা সীমিত ছিল,সেখানকার কথা মা কে বলে দিত অনায়াসে।কিন্তু দিন কাটছে,বড় হচ্ছে ও।তাই তৈরি হচ্ছে নিজের দুনিয়া।সেটাই হয়তো স্বাভাবিক।
কিন্তু দিদান! দিদান ও ওর খুব ভালো বন্ধু,আর হয়তো অভিজ্ঞতায় মায়ের থেকে অনেক এগিয়ে।

“কি রে দাদুভাই,তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না কি মেয়েটার ও বাড়িতে থাকায়।আমায় বল।আর সেরকম হলে তুই আমার কাছে এসেও থাকতে পারিস,তোর স্কুল তো খুব একটা দূরে পড়বে না এখান থেকে।কি ভাবছিস এত?” মমতা অধৈর্য্য হয়।

“ওর নাম রাই দিদান।রাইমা।খুব ভালো মেয়ে।তোমার কাছে একদিন আনবো।দেখবে ভালো লাগবে।” শুধু এটুকুই বলতে পারে রণ।
কিন্তু অভিজ্ঞ মমতা এটুকু কথাতেই ভ্রু কুঁচকে তাকান নাতির দিকে।যেন পড়তে চান নিজের দৌহিত্র কে।
রণ বাইরের দিকে এতক্ষন চেয়ে ছিল দিদানের ব্যালকনির কাঁচের দরজা দিয়ে।এবার মুখ ঘোরায় দিদার দিকে।দেখে ওকেই দেখছে দিদান।
আবার হেসে ফেলে ও,আসলে এই হাসিটাই ওর সম্পদ।ওর হাসিতে একটা কিছু থাকে যা সবার মধ্যে থাকলেও ওকে আলাদা করে।ওর উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ সবাইকে আকর্ষণ করলেও ওর হাসি ওকে সবার কাছে এনে দেয়,বুঝিয়ে দেয় ওর মনটাও ওর মুখের মতোই সুন্দর।

“কি দেখছো ওরকম করে?!…জানো দিদান মা’ই ঠিক ছিল।আমি ভুল।আসলে মানুষ আলাদা হয়।রাই খুব দুর্বল একটা মেয়ে,যে নিজের মা কে জড়িয়ে বাঁচতো।তোমায় মা বলেছে কিনা জানিনা ওর বন্ধু বিশেষ ছিলোনা।এখনও নেই।হস্টেলে গেলে একাকিত্বে ওর মনে প্রচন্ড চাপ পড়তো।মা ঠিক বুঝেছিলো ওকে।আমার বুঝতে দেরি হলো।” রণ বদলাতে চাইলো দিদানের মনোভাব, যা তৈরি হয়েছিল মাস দুই আগে ওর কথায়।
মমতা চুপ করে থাকেন।রাইমাকে উনি দেখেননি।কিন্তু ওর অতীত শুনেছেন।গোঁড়ামি ওর কোনোদিন সেভাবে ছিল না,তাই রাইয়ের অতীত নিয়ে উনি ভাবেনও নি।ওঁর ভাবনা নিজের নয়নের মনিকে নিয়ে,তার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
অভিজ্ঞতা ভয় পায়,ভয় ওঁর সোনার টুকরো নাতির জন্যে।ওর মনটা ওর মায়ের মতোই নরম,কিন্তু এখনকার সময়টা আসলে ভালো না,বলা ভালো যুগ ভালো না।

উনি নিজে ছিলেন স্কুল শিক্ষকের মেয়ে।কত ছাত্র একসময় ওঁদের গ্রামের বাড়িতে থেকে খেয়ে পড়াশোনা করে গেছে।মাস্টারমশাই এর মেয়েকে তাঁরা সব সময় সম্মানের চোখে দেখেছে।কিন্তু আজকাল দিনকাল বদলেছে।কোনো কিছুই আর সরল ভাবে হয়না।
শুধু রাই বলে মেয়েটা ভালো হলেই তো সমাজ বদলে যাবেনা।রক্তের সম্পর্কহীন একটা সোমত্ত মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দিলে সবার আগে নজর পড়বে আত্মীয়দের।যারা জীবনে খোঁজ খবর নেয়না,বাতাসে ভেসে খবর তাদের কানে গেলে উৎসুক হবে তারাই বেশি।
রণ ছেলে,দুবছর পর পড়তে বাইরেও চলে যাবে।কিন্তু ওই অনাত্মীয় মেয়েটা কোনোভাবে কৌতূহলের শিকার হলে প্রভাব পড়বে ওর ভবিষ্যতেও।জয়ি এসব নিয়ে কোনোদিনও মাথা ঘামায় না।ও ওর বাবার প্রকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু মমতা জানেন এসব আলোচনা বহুদূর গড়ায়।তাই ভয় হয় ওঁর।
বিশেষ করে আজ রণর মনোভাব ওঁর চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিল।উনি বুঝতে পারলেন ওঁর নাতির মনেও নিজের মায়ের মত নরম জায়গা জন্মেছে মেয়েটার জন্যে।তাই কোনো বদনাম দিলে,রণর মনেও খারাপ লাগা ছুঁয়ে যাবে।

জয়ির সাথে কথা বলবেন ঠিক করলেন।রণকে বললেন,”ঠিক আছে একদিন তবে ওকে এনো দাদুভাই।আলাপ করার ইচ্ছে রইলো।তোমার মা সব কিছুই বলেছে ওর সম্বন্ধে।আজ তুমিও বলছো যখন তাহলে মেয়েটা ভালোই হবে।মা মরা মেয়ে একটু ভালোবাসার কাঙাল হয়।ভালোবেসে সবাই মিলে রাখলে ও নিশ্চই ভালোবাসা ফিরিয়েই দেবে…”,দিদানের বাকি কথা কানে ঢুকলো না রণর।কিন্তু হঠাৎ কানটা গরম লাগলো।’ভালোবেসে রাখলে…ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে?’
ও সবাইকে নিয়ে হইহই করে থাকে।পড়ার সময় কোনদিকে জ্ঞান থাকেনা ওর,এটা নাকি ওর জিনগত।ওর বাবাও এরকম ছিল ছোটবেলায়।কিন্তু আজকাল সেই পড়ার সময়ও মন অস্থির হচ্ছে।পড়াশোনা শুরু হয়েছে,কিন্তু রেজাল্ট বেরোনো অবধি সেই চাপ নেই।
ও জানে রেজাল্ট বেরোনোর পর কোনদিকে তাকানোর সময় পাবে না ও।তখন হয়তো পড়ার অভ্যেসটা ফিরে আসবে।কিন্তু রাই… না রাইএর ও বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েই থাকবে।
ওর ভালোলাগা চাপিয়ে দেবেনা ওর ওপর।রাই একেই ওদের বাড়িতে থাকছে বলে একটা অস্বস্তিতে ভোগে।আজ রণর কিশোর মনের ভালোলাগা জানলে হয়তো কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে স্বীকার করে নেবে।কিন্তু রণ তা চায়না।
ও আসলে বিশেষ কিছুই চায়না।ও শুধুই চায় রাইমা ভালো থাকুক।ও জানেনা এটা কি?হয়তো বয়সের ভালোলাগা।হয়তো অসহায় একটা মেয়ের প্রতি অনুকম্পা,হয়তো এত কাছাকাছি কোনো মেয়ের সাথে আগে থাকেনি তার প্রভাব।জানেনা রণ কিছুই জানেনা কারণটা কি!শুধু জানে রাই ওর মনের একটা ছোট দুর্বলতা হয়ে গেছে,যাকে খুশি রাখতে ও বদ্ধপরিকর।সেই খুশি রাখা শুধুই বর্তমান সময়ে,ভবিষৎ ও ভাবেনা। কে জানে ভবিষ্যতে ও বুঝতে পারবে এটা শুধুই ভালোলাগা ছিল,ভবিষ্যতে প্রকৃত ভালোবাসা হানা দেবে ওর জীবনে!
ও বর্তমানে বাঁচে,তাই রাইয়ের বর্তমান খুশি ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।আর ও সেই চেষ্টাই করে শুধু।

ও বুঝেছে মম ভুল করেনি,আর ও তাতেই খুশি।কিন্তু মম ভুল করবে না,এটাও ও শিওর না।তাই মমের সামনে দূরত্ব বজায় রাখে রাইমার সাথে।ও চায়না ওর মা জোর করে সব দিক বাঁচাতে গিয়ে কোনো ভুল করে দিক ওর ভবিষ্যতের সাথে।ও সময় দিতে চায়,আর তাই নিজেও সময় চায়।
এই কথা গুলোই আজকাল ওর নিজের হয়ে থাকে,বলতে পারেনা কাউকে।মম কে তো নয়ই।আর দিদান কেও না।
হয়তো একজন বুঝবে,বোঝেও।সেই ওর ভরসা,ওর বাবা।আসলে ও অনেকটাই ওর বাবার মত,তাই হয়তো ওকে অতটা বুঝতে পারে।

মমতা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নাতির দিকে।শেষ বিকেলের রোদ একফালি ঢুকছে ঘরের মধ্যে।সেটা মেঝেতে প্রতিফলিত হয়ে যেন রণর চোখে গিয়ে পড়ছে।বড় জ্বলজ্বল করছে ওর চোখদুটো,কিন্তু কয়েকদিন আগেও নিজেকে সবটা উজাড় করে দেওয়া দাদুভাই আজ অনেক লুকিয়ে রাখতে শিখেছে নিজেকে।অভিজ্ঞতা বলেছে কিছু বদলেছে ওর মধ্যে,কিন্তু ও চাইছে সেটা লুকোতে।
ভরসা আছে মমতার রণর ওপর।বিশ্বাস আছে ওর মায়ের শিক্ষাতে।থাক না কিছুটা অপেক্ষা।চোখ খুলে ভরসা করে অপেক্ষা থাক কিছু শোনার,কিছু জানার ভবিষ্যতে।
এখন কি বা বয়স ওর,কিন্তু পরিণত বোধ ওকে কোনো ভুল করতে দেবে না,মমতা জানেন।
হাত বাড়িয়ে নাতির মাথায় হাত রাখেন।মৃদু হেসে রণ মাথা রাখে দিদানের কোলে।বড় আদরের জায়গা এটা ওর,যার ভাগ আজ অবধি ও কাউকে দেয়নি।কিন্তু এবার দেবে।এবার ভাগ দেবে ওই মেয়েটা কে।ওই দুর্বল শান্ত মেয়েটা কে পরের দিন নিয়ে আসবে দিদানের কাছে,যাতে দিদানের মনের জোর কিছুটা ওকেও স্পর্শ করে।ও জানে দিদানও ওকে ভালো না বেসে পারবে না।
শান্তিতে চোখ বোজে রণ তার দিদানের কোলে।

ক্রমশ….