মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৭

0
406

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#সপ্তম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“কে রে ওই মেয়েটা?” রুদ্র কৌতূহলী হয়।এতদিন রণদের বাড়ি আসছে কই দেখেনি তো কোনো মেয়ে।আজ রণর সাথে ওর বাড়িতে এসে দেখলো ডাইনিং স্পেসে বসে আন্টির সাথে গল্প করছে।ওর দিকে আড়চোখে একবার দেখলো মনে হল।ওরা নিজেদের চারপাশে যেরকম মেয়েদের দেখে,স্মার্ট-মডার্ন, একে ঠিক সেই রকম লাগলো না।আবার গ্রামের মেয়েও ঠিক না।কিন্তু অনেকটা গ্রামের নরম প্রকৃতির এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মত।তাই হয়তো কৌতূহলটা বেশিই হল রুদ্রর।নাহলে কোনো মেয়ের দিকেই ওর নজর বিশেষ পড়েনা।

“কোন মেয়েটা?” রণ যদিও না বোঝার ভান করলো।ও চায়না রাই কে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হোক।যত রাইয়ের কথা সবাই জানবে তত ওর এখানে থাকতে অস্বস্তি হবে।একদিন খুব সাধারণ ভাবে ও মিশে যাবে ওদের সাথে এটাই রণজয়ের ইচ্ছে।আলাদা করে বিষয়টা নিয়ে চর্চা করতে ও চায়না,তাই কোনো বন্ধুই এখনো জানেনা ঘটনাটা।রুদ্র তাই এতটা কৌতূহলী।
“আরে আন্টির সাথে যে নীচে বসেছিল,দুদিকে চুল বাঁধা।আজকাল কোনো মেয়েকে ওভাবে চুল বাঁধতে বিশেষ দেখিনা।” রুদ্রর চোখে মুখে কৌতুক খেলা করে যায়।
কিন্তু রণ পাত্তাও দেয়না।অন্যকাজে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,”ওহ,ও?ও রাইমা।আমার বাবা-মার কমন ফ্রেন্ড জয়ন্ত আঙ্কেলের মেয়ে।”
“ও-ও-ও! আমি ভাবলাম তোর কোনো দূরসম্পর্কের বোন।তা,তোদের এখানে বেড়াতে এসেছে?” রুদ্রর গলার স্বরে কৌতূহল কমলেও ওর কথাগুলো রণর শরীর-মন চিড়বিড়িয়ে দেয়।
“হমম”, নিজেকে সামলে কিছু না ভেবেই আলোচনা বন্ধ করতে রণ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়।
ও জানে আজ নয় কাল সবাই জানবে, প্রশ্ন করবে।কিন্তু তাও যতদিন বিষয়টা এড়িয়ে থাকা যায়,রাইয়ের মনে কোনোরকম চাপ পড়ুক ও চায়না।
“আচ্ছা রণ তুই এত ফাটাফাটি রেজাল্ট করলি ট্রিট দিলি না তো ভাই? কত আশা করেছিলাম একদিন পিজ্জা পার্টি দিবি পিজ্জা হাট- এ।” হতাশা মেশানো গলায় বলে রুদ্র,ওর কথার উত্তেজনায় বোঝাই যাবেনা এই ছেলেটাই পাঁচ মিনিট আগে একটা মেয়ের সম্বন্ধে কৌতূহল দেখাচ্ছিল।

হেসে ফেলে রণ।এই ছেলেটার কথাবার্তাই এরকম,বেশিক্ষন রাগ করে তাই থাকাও যায়না।সুযোগ পেলেই খালি খাওয়ার চিন্তা।কিকরে রণর ঝেঁপে খাবে।আসলে ফাস্ট ফুড খেতে খুব ভালোবাসে রুদ্র,কিন্তু ওর বাবা মা ওকে অতটাও পকেটমানি দেয়না।এমনিও আঙ্কেল ওকে ভালো স্কুলে পড়াতে চাপে থাকেন,তারওপর এক্সট্রা এসব খরচ চালানো সম্ভব হয়না।
যদিও রণর বাবা মা বেশি ফাস্ট ফুড খাওয়ার বিপক্ষে তাও রুদ্রকে সুযোগ পেলেই রণ ট্রিট দেয়।
রণদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে দিন সাতেক হল।রণর রেজাল্ট আশানুরূপ ভাবেই ফাটাফাটি হয়েছে।ও জানে ওদের স্কুলে এরকম রেজাল্ট বছর বছর হয়। সেই কারণেই বাবা মা’রা কষ্ট করে হলেও চেষ্টা করে ছেলে মেয়েদের এই স্কুলে পড়াতে।
তাই ও স্কুল টপার হলেও সেই ভাবে মাতামাতি করার কথা কারোর মনেই হয়নি।কিন্তু ও জানে ওর বাবা মা খুব খুশি হয়েছে,আর অবাক হয়েছে রাই।

এক অদ্ভুত মেয়ে এই রাইমা।যেন আজ থেকে দশ বছর আগের সময়ের।রণর মনেহয় আরো এক যুগ আগে জন্মালে ও হয়তো ভালো থাকতো।
রাইও তো ডাক্তারের মেয়ে,ওর মা’ও শিক্ষিত কিন্তু ওর মধ্যে এখনো এক অদ্ভুত সারল্য।স্কার্ট আর সালোয়ার ছাড়া ও আর অন্য কোনো ড্রেস পড়ে বলে রণর জানা নেই।দুদিকে দুটো বেনি বেঁধে এখনো স্কুলে যায়।ওর মধ্যে এখনো সেই বাচ্চা মেয়েটা যেন বেঁচে আছে।
ও বোঝানো সত্ত্বেও রণ আজও বুঝে উঠতে পারেনি ও কেন কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েনি,হয়তো কনভেন্ট হতনা।কিন্তু মিডিয়াম তো ইংরাজি হত।বাংলা মিডিয়াম খারাপ না,কিন্তু আজকাল স্ট্যান্ডার্ড পরিবারের কেউ ইংরাজি মাধ্যম ছাড়া ভর্তি হয় বলে রণর জানা নেই।
রাই যদিও বলেছে ওর পড়ার ইচ্ছে বাংলা নিয়ে,সেটা যেন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি রণর।ওর মনেও আসেনা ওর জানার পরিধি এখনও সীমিত।এখনো হাজার হাজার ভালো ঘরের মেধাবী ছেলে মেয়ে বাংলা মিডিয়ামে পড়েও এগিয়ে যাচ্ছে।
রণ যেন নিজেকে ঝাঁকুনি দেয় হঠাৎ!ধুর আজকাল চিন্তা গুলো সব রাইতে এসে যায় কোনও না কোনো ভাবে।

“কিরে কিছু বললি না? ট্রিটটা দিবি না?” রুদ্র আবার খোঁচায়।
“দেব রে বাবা দেব।নেক্সট উইক পাক্কা।তারপর তুই বল,বলেছিলি স্কুল পাল্টাবি।তা কোথায় কোথায় ফর্ম তুললি?” দুই বন্ধু আবার নিজেদের পড়াশোনার জগতে ডুবে যায়।
কিন্তু রাই জায়গা ছাড়েনা মেধাবী ছেলেটার মনে।আজকালকার দিনে স্কুলে পড়তেই যেখানে বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবী তৈরি হয় সেখানে রণজয়ের মতো ছেলেরা ব্যতিক্রম থেকে যায়।তাদের কাছে সব বন্ধুই সমান হয়।কিন্তু ওই যে বয়স,ওটা শরীর মন সব জায়গায় তো থাবা বসাবেই।তাই ভালোলাগা কে চাইলেও এড়ানো যায়না।মনের গভীরে লুকিয়ে সে জাল বুনতে থাকে,সময় হিসেব দেয় সেই জাল মজবুত হবে না পলকা।সময় জানিয়ে দেয়,বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসার গভীরতা।

আজ অনেকদিন পর জয়ি বাড়ি ছিল,রাই ওই জন্যে প্রায় চিপকে ছিল জয়ির সাথে।দুপুর প্রায় যখন শেষের দিকে জয়ি একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে গেল।আর রাইও চলে এলো নিজের ঘরে।
ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে চোখ পড়াতে চমকে গেল ও।ওর খাটে কিসের প্যাকেট!
এলই বা কিকরে?কে রাখলো?
কেউ ঘরে এসে রেখে গেছে বুঝতে পারলো ও?কিন্তু সে কে?আন্টি!!কখন এলো?
পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে প্যাকেটটা খুলল ও।
খুলেই যে জিনিসটা বেরোলো সেটার দিকে অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবলো।চোখটা আবেগে ছলছল করলেও নিজেকে সামলে জিনিসটা হাতে নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, গিয়ে দাঁড়ালো রণর ঘরের দরজায় ।এখন প্রায় চারটে বাজে।রণ দার বন্ধু চলে গেছে কিছুক্ষন আগে।যদি রণদা বিশ্রাম নেয়।কিন্তু কিন্তু করে ফিরে আসবে কি না ভাবছে,হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল।

“কিরে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস?” একগাল হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো রণ।
থতমত খেয়ে কি উত্তর দেবে ভেবে পেলোনা রাই, শুধু বিস্মিত গলায় বললো,”না মানে তুমি বুঝলে কিকরে আমি এসে দাঁড়িয়ে আছি?”
হাসি চওড়া হলো রণর।”আমি জানতাম তুই আসবি।তাই কান খাড়া করে অপেক্ষা করছিলাম।”
রাইও এবার হেসে ফেললো ফিক করে।”থ্যাংক য়্যূ রণ দা”,হাতের উইন্ড চাইম টা তুলে ধরে।
“ভেতরে আয়”, গলাটা একটু নামিয়েই বললো রণ।
কিছুটা ইতস্তত করে রাই ঢুকলো রণর ঘরে।
“তুই সেদিন বললি,তোদের কোয়ার্টারে তোর ঘরের জানালায় ছিল এরকম একটা উইন্ড চাইম।গরমকালে খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিত।অনেকটা তোর মায়ের হাতের চুরির আওয়াজের মত।তাই আজ রুদ্রর দরকারে একটা দোকানে গিয়ে দেখতে পেয়ে নিয়ে নিলাম।খুশি হয়েছিস তো?” রুদ্রর দরকারে না,এই উইন্ড চাইম খুঁজতে রুদ্রকে নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরেছে রণ এই দুপুর রোদে সেটা আর বলল না।

হঠাৎ নিজের জগতে ঘুরতে থাকা রণ রাইয়ের প্রায় আর্তচিৎকারে চমকে ওঠে।
“বাপরে রণ দা!তুমি কি করে রেখেছ ঘরটা! নিজে এত ফিটফাট থাকো আর ঘরটা এত অগোছালো করে রেখেছো?” কম কথা বলা কিন্তু ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা রাই রণর ঘর দেখে চুপ থাকতে পারেনা।।ওর হাত নিশপিশ করতে থাকে।
লজ্জার হাসি হেসে রণ বলে,”সরি রে।আসলে ওই ভাবি গুছিয়ে রাখবো,কিন্তু ঠিক হয়ে ওঠেনা।সবচেয়ে বড় কথা গুছোলে কিছু জিনিস আর খুঁজে পাইনা।আগে মা গুছিয়ে দিত।কিন্তু ওই এক সমস্যা…আমার চেঁচামেচির চোটে মা আর হাত দেয়না”।
রণ কথা বলতে বলতে খেয়াল করে রাইয়ের চোখ দুটো পুরো ঘরে ঘুরছে,আর একটা অস্থিরতা কাজ করছে মুখে।বোঝাই যাচ্ছে ঘরটা এলোমেলো দেখে ওর মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে।রণ জানে রাই কতটা গুছিয়ে রাখে ওর এখানকার ঘরটাও।ও একটু ইতস্তত করে বলে,”আজ ঠিক গুছিয়ে নেব।কাল এসে দেখে যাস সব পারফেক্ট জায়গায় থাকবে”।
“আমি গুছিয়ে দেব?বেশিক্ষন লাগবে না”,বলেই ফেলে রাই শেষ অবধি।ও জানে রণ মোটেও গুছোবে না ঘরটা।যেরকম আছে তেমন থাকবে,আর এই অগোছালো ঘর দেখে গিয়ে থেকে রাইয়ের মন খুঁতখুঁত করবে।
রণ একটু থতমত খেয়েই যায়।রাই ওর ঘর গুছিয়ে দেবে ভাবতেই হঠাৎ একটা অচেনা অনুভূতি সারা শরীর যেন ছুঁয়ে যায়।
শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতিটুকু দিয়ে ও কাঠের পুতুলের মত নিজের টেবিল চেয়ারে চুপ করে বসে থাকে।এই বয়সের একটা ছেলের কাছে আশাতীত কিছু পাওয়া হয়তো তাকে এরকমই স্তব্ধ করে দেয়।জানলার পাশে চেয়ারে রাই এর দিকে পিছন করে বসে ও শুধু এলোমেলো ভাবতেই থাকে।হঠাৎ রাইয়ের একটা কথা কানে আসতেই ওর কান দুটো গরম হয়ে যায়,” আগামী সপ্তাহে রাখি।আন্টি বলছিল তোমায় ওইদিন বাড়ি থাকতে বলবে”।
রাই নিজেও জানেনা ও কেন হঠাৎ রণকে কথাগুলো বললো।আসলে রণ ওকে বলেছিল কদিন আগেই,”রাই বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কোনো সম্পর্ক হয়না জানবি।যে কোনো সম্পর্ক বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে শুরু হলে তার লংজিটিভিটি অনেক বেশি হয়।কিন্তু কোনো সম্পর্ক বন্ধুত্ব ছাড়া শুরু হলে কদিন টিকবে কেউ জানে না।অন্য সম্পর্ক টিকে থাকলেও মনের সম্পর্ক তৈরি হয়না।আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক,এর আর কোনো নামের দরকারও হয়না।”
আজ আন্টির কথা শুনে কেন কে জানে রাইয়ের সেদিনের কথা মনে পড়েছিল।একটাই কথা মাথায় বারবার ধাক্কা মারছিল,’আমরা খুব ভালো বন্ধু রাই।কোনোদিনও ভুলবি না তোর একটা ভালো বন্ধু আছে।যখনই কোনো সমস্যায় পড়বি জানবি আমি আছি”।
রাই এর কাছে কথাটা শুনেই রণ সমস্ত কল্পনা কেটে বাস্তবের জমিতে এসে পড়লো।ওর মাথায় শুধু ঘুরতে লাগলো কিকরে বেড়িয়ে পালাবে ও সেদিন এই বাড়ি থেকে।রাইএর সারাজীবন ও বন্ধু হয়ে থেকে যাবে,কিন্তু মিথ্যে সম্পর্কের আবরণ জড়িয়ে কিছুতেই সম্পর্কটা নোংরা করতে ও পারবে না।নিজের কাছে নিজে তাহলে ছোট হয়ে যাবে।কোনোদিনও চোখ তুলে তাকাতেও পারবে না রাইয়ের দিকে।
“রাই একদিন আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?” দিদুনের জন্যে ওর মন কেমন করতে থাকে।
রাইমা অবাক হয়ে তাকায়।আন্টিকে বলতে তো হবে,রণদা কি সেটা বলেই নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে?
ওর বিস্মিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সবচেয়ে আপনজন।মম কে আমি যা বলার বলবো।” ও জানে রাইমা কে দিদুনের কাছে নিয়ে যাবে বললে মম বারণ করবেনা।

রাই একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলে ,”ঠিক আছে”,রাখির প্রসঙ্গ ওখানেই চাপা পরে যায়,কিন্তু চাপা পড়েনা রণর মনে।
ও বুঝতে পারেনা মম কে কিভাবে বোঝাবে ওর সমস্যাটা।আর বলবেই বা কি?কিন্তু এই পরিকল্পনায় সায় দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না।ও কোনোভাবে পারবে না ওর আর রাইয়ের সম্পর্ককে ভুল নাম দিতে।ভাবতে থাকে রণ।

“আপনার সমস্যা তো অনেকদিনের।চেপে রেখেছিলেন কেন? যন্ত্রনা চেপে রাখলে কি তা কমে!” বয়স্ক মানুষটার কষ্ট ক্লিষ্ট মুখটা দেখে মায়াই হয় ঋষির।
ভদ্রলোকের বদলে মুখ খোলে ওঁর মেয়ে।ধরা গলায় বলে,”বাবা খুব প্রাণচঞ্চল মানুষ ডাক্তারবাবু।চুপ করে কখনো বসে শুয়ে থাকেনা।কিন্তু মাস দেড়েক আগে আমিই প্রথম খেয়াল করি খালি শুয়ে পড়ে থেকে থেকে।অনেক চাপাচাপি করতে বলে পায়ের পেইনের কথা।আমরা প্রথমে অর্থোপেডিক দেখাই।তিনি শুনে এক্সরে আর এমআরআই দেন।আর পরে আর একটা টেস্ট দেন”,মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঋষি বোঝে মেয়েটা সত্যিটা জানে।ওর শুকিয়ে যাওয়া মুখ সেটাই জানান দিচ্ছে।
ভদ্রলোক মিস্টার সত্যনারায়ন দে’র স্পাইনাল কর্ডের এলফোর-এলফাইভ(L4-L5) অঞ্চলে টিউমার আছে।আর এফএনএসি(FNAC-Fine Needle Aspiration Cytology) টেস্ট প্রমান দিচ্ছে ম্যালিগনেন্সির।
ভদ্রলোকের হয়েছে স্কিন ক্যান্সার, যেটা স্কোয়ামস সেল কার্সিনোমা (squamous cell carcinoma)টাইপ,কিন্তু টিউমার হয়েছে স্পাইনাল কর্ডের এল4-এল5 রিজিওনে।মানে রোগটা স্প্রেড করেছে বেশ কিছুটা।এটা একটু রেয়ার।
“পেইন বা অস্বস্তিটা বেশ কিছুদিনের।তাই তো মিস্টার দে?” এবার প্রশ্ন করে পেশেন্ট কে।
“হ্যাঁ।তা কষ্টটা বছরখানেক হলো।ভেবেছিলাম বয়সের কারণে।রেস্ট কম হচ্ছে।আর পৌলমির মা অসুস্থ, তাকে নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত থাকি নিজেরটা অতটা তখন খেয়ালও হয়নি”। কিছুটা ভাঙা গলায় বলেন ভদ্রলোক।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঋষি।রোগটা কোন স্টেজে আছে বোঝাও যাচ্ছেনা।কিন্তু টিউমারটা ওখানে হলো কেন?এধরনের টিউমার রেয়ার আর অ্যাগ্রেসিভ হয়।
“ঠিক আছে মিস দে।আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।আপনাদের সাথে আর একজন রিলেটিভ এসেছেন বললেন,মিস্টার দে কে তাঁর কাছে বসিয়ে আসুন।আমি কয়েকটা কথা জেনে তারপর কি করতে হবে বলছি।” ঋষি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।অনেক ক্ষেত্রেই এটা করতে হয়,পেশেন্টের সামনে সবটা আলোচনা করা যায়না।বিশেষ করে বয়স একটু বেশি হলে।এক্ষেত্রে মিস্টার দে ও রাজি হয়ে যান,মেয়ের ওপর ভরসা যে খুব বেশি ঋষির বুঝতে অসুবিধা হয়না।
হসপিটালের নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে ওয়ার্ড বয় কে হুইল চেয়ার আনতে বলে ঋষি।
ওয়ার্ড বয়ের সাথে গিয়ে পৌলমি ওর বাবাকে সেই রিলেটিভের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে।

চেয়ারে বসে মুখ খোলে পৌলমি,”আমরা রিপোর্ট পেয়ে বাবাকে মুম্বাই নিয়ে যাই।সেখানে স্পেশালিস্ট হসপিটালে খুব খারাপ ব্যবহার পাই ডাক্তার বাবু।কিন্তু অন্য আর একটি হসপিটালের খোঁজ পেয়েছিলাম পেপার থেকে।সেখানকার ডাক্তার বাবুরা খুব ভালো করে কেয়ার করেছিলেন বাবার।আপনি দেখুন রিপোর্ট গুলো আছে,হোল বডি স্ক্যান করেছিলেন।” তারপর কিছুটা থেমে গলা নামিয়ে বলে,”একটা কেমো দিয়ে ওরা ফেরত পাঠিয়ে দেয়”।

একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে ফেলে ঋষি।আরো টুকটাক যা জানার জেনে আর দেরি করেনা।ভদ্রলোকের বয়স প্রায় সত্তর।রিস্ক খুব বেশি,কিন্তু ডাক্তারের ধর্মই শেষ অবধি চেষ্টা করে যাওয়া।একটা কেমো হয়েছে।আরো ৪-৫টা কেমো লাগবে।
হসপিটালের অন্যতম মেডিকেল অঙ্কলজিস্ট রক্তিম সেনকে রেফার করে ও।কারণ কেমোর দায়িত্ব ওর,মেডিকেল অঙ্কলজিস্টের।কেমো শেষ হলে রেডিয়েশন চালু হবে।
মেয়েটার শুকিয়ে যাওয়া মুখ বলে দেয় বাবা ওর কতটা কাছের।কিন্তু এক্ষেত্রে ডক্টরেরও হাত বাঁধা,শুধু চেষ্টা করতে পারে মাত্র,বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে।
পৌলমি কে সবটা বুঝিয়ে কেমো ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেয় ও।
হঠাৎ মনেহয় রক্তিমের সাথে একবার কথা বলে নিলে ভালো হবে।ফোনটা নিয়ে সবে আনলক করে কল করতে যাবে তার আগেই ফোন বেজে ওঠে।চেম্বারে ফোন সাইলেন্ট থাকে তাও হাতের মধ্যে ফোনের কাঁপুনি ওকে কিছুটা চমকে দেয়।নিজেকে সামলে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই মুখে একটা আলগা হাসি খেলে যায়।রুনু দি( Runu Chowdhury ) ফোন করছেন।এই ভদ্রমহিলা কোথা থেকে যে এত এনার্জি পান।সত্যি অসম্ভব প্রাণ শক্তি।আর কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়।ঋষি ফোনটা ধরে মজার ছলে বলে,”বলুন ম্যাডাম কি আদেশ এবার?”

কেমন যেন একটা উত্তেজনা হচ্ছে রণর।রাই কে নিয়ে প্রথমবার বাইরে বেরিয়েছে,দিদুনের বাড়ি যাচ্ছে।মম একটু ভ্রু কুঁচকে ছিল,কিন্তু তার আগে দিদুনকে ফোন করে রণ বলে দিয়েছিল মমকে কি বলতে হবে।দিদুন ওদের দুজনকে দুপুরে খাবার নেমন্ত্রন করেছে।
আজ রবিবার ভাস্করদা আসেনা।মা’ও উবেরে কাজ চালায়,রণও সেই পথ অবলম্বন করেছে।
রাই আগে কখনো নিজের মা বাবা ছাড়া বাইরে বেরিয়েছে বলে মনে হয়না,এখানে দুদিন মমের সাথে বেরিয়েছিল তাও বাড়ির গাড়িতে।
এত গরমে শুনশান দুপুরে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে এমন মেয়ে,তাও কিছুটা জড়সড় হয়ে।

রাখির দিন রণ যাহোক করে বেঁচে বেরিয়ে গেছে।মা’রও ওইদিন এমার্জেন্সি একটা অপারেশন পরে যাওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল খুব ভোরে।আর যখন ফেরে রণ বাইরে ছিল।ওইদিন রণ ইচ্ছে করে দিদুনের বাড়ি চলে গিয়েছিল রাতে থাকবে বলে।তখন আজকের প্ল্যানটাও রেডি করে নেয়।একটা হিন্টস ওই দিনই দিয়ে এসেছিল ওর দিদুনডার্লিং কে।
রাইকেও রাখির দিনের কথা যেচে কিছু জিজ্ঞেস করেনি রণ।যেটা ওর পক্ষে সম্ভব না,সেটা কোনো না কোনো ভাবে ও ঠিক এড়িয়ে যাবেই।
দরকারে জোর গলায় বলবে,’রাই শুধুই ওর বন্ধু।অন্য কোনো সম্পর্কে এটাকে বাঁধতে চায়না ও’।

“রণ দা আমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে,এনেছি।দিদুনের কাছে প্রথমদিন যাচ্ছি।একটা গিফট কেনার খুব ইচ্ছে ছিল”,ধীর গলায় আস্তে আস্তে বলে রাই কথাগুলো।
চোখ বড় বড় করে তাকায় রণ রাইয়ের দিকে,”এই গরমের দুপুরে,রবিবার, কোনো দোকান খোলা পাবি নাকি?আগে বলতে হয় তো?”
মুখটা শুকিয়ে যায় রাইয়ের।সত্যি তো কি বোকা ও!কিছুই ভাবেনা আগে থেকে।মা’ও তাই বলতো,’এই মেয়ের সবকিছু শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে’।
কিছু উত্তর দেয়না মুখে,কিন্তু ওর মুখটা যে ছোট হয়ে গেল রণর তা নজর এড়ায়না।ওর নিজের মনটাও খারাপ হয়ে যায়।
হঠাৎ চোখে পড়ে এই গরমের দুপুরেও একজন অল্পবয়সী ছেলে ফুটপাতে গাছের তলায় ফুল বিক্রি করছে।
“প্লিজ গাড়িটা একটু থামাবেন”,সময় নষ্ট না করে ড্রাইভারের উদ্দেশে বলে ও।
ভদ্র সভ্য পাঞ্জাবি ড্রাইভার কথা না বাড়িয়ে উপযুক্ত জায়গায় ফুটপাত ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দেয়।

ফুলওয়ালা কে ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে ওরা।
“রাই আয় একবার”,রাইয়ের হাত ধরে টেনে বের করে আনে ও।ড্রাইভার অবাক চোখে তাকায়।
রণ বুঝতে পারে ওর উদ্বেগটা,অল্পবয়সী দুটো ছেলেমেয়ে ভাড়া না দিয়ে পালায় যদি।রণ গাড়ির বাইরে বেরিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলে,”আঙ্কেল আপনি পারলে গাড়িটা একটু পিছিয়ে ওই ফুলের দোকানের সামনে নিয়ে আসতে পারেন।আমার একটু ফুল কিনবো”,চেষ্টা করে রণ ওকে আশ্বস্ত করতে।
ড্রাইভারের সিটে বসা ভদ্রলোক শুধু ইশারায় বোঝান,’ঠিক আছে।কোনো ব্যাপার না’।

“দিদুনের ফুল খুব পছন্দ।প্রচন্ড খুশি হবে তোর গিফট দেখে।”রণ বোঝায় হতভম্ভ রাই কে।
এবার হাসি ফোটে ওর মুখে।রণদার কাজে ও তো চমকেই গেছিল।ওর কাঁধে ক্রস করে নেওয়া ছোট পাউচ ব্যাগ থেকে ও টাকা বের করে এগিয়ে দেয় রণর দিকে।
“আরে হাতে রাখ।আগে কিনি”,রণ রা কথা বলতে বলতে পৌঁছে যায় ফুলওয়ালার কাছে।
রাই রণকে যত চিনছে অবাক হয়ে যাচ্ছে। বইয়ের জগতে ডুবে থাকা ছেলেটা আসলে সবার খেয়াল রাখে।আন্টি খেতে অনিয়ম করলে বকাবকি করে।দিদুন কে নিয়মিত দেখতে যায়।আজকাল রাইকেও ছাড়েনা।ওর ভয়ে রাই কাঁদে না বেশি।জানে কাঁদলে আরো বকুনি খাবে।ওর মায়ের মত রণদা ওকে আগলে রাখে।
রণর একটা সুন্দর মন আছে,সেটা ও পেয়েছে আঙ্কেল আন্টি দুজনের থেকেই।ও মিশতে গেলে ক্লাস ভাবেনা।রমা পিসি হোক বা ভাস্করদা দুজনের সাথে ওর সম্পর্ক বাড়ির লোকের মত।রাই এবাড়ি আসার আগে বেশি চিন্তায় ছিল রণজয়কে নিয়ে।ভেবেছিল রাইকে হয়তো পাত্তাও দেবেনা এত বড় স্কুলে পড়া ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটা।কিন্তু আজ ওর সবচেয়ে ভরসার মানুষ রণদা।
মা মারা যেতে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল ওর জীবনে,ও তাই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল জয়িকে।জয়িও ওকে আগলে নিয়েছিল।
জয়ি আজও রাইকে আগলে রাখে,কিন্তু মায়ের মত তো সারাক্ষন কাছে থাকতে পারেনা।ওর নিজের জগতেই যা ব্যস্ততা।
কিন্তু রাই একাকীত্বে ভোগেনা রণর জন্যে।এবার রণর ক্লাস স্টার্ট হবে,প্রচন্ড ভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ও।রাইও পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে।তাও একটা একাকীত্ব হয়তো ওকে ছোঁবে।
ভাবেনা রাই এসব নিয়ে বেশি।রণ ওকে নিজের ডেস্কটপটা দিয়ে দিয়েছে।সেট করে দিয়ে গেছে ওর ঘরে।ও এমনি এখনকার মেয়ে কম্পিউটারের ব্যবহার তো জানতোই,আজকাল অনেকটা সময় কাটে ওর ডেস্কটপে।

“দিদিভাই আরেকটু মাছ নাওনা?” দিদুনের কথায় ঘাড় নেড়ে না বলে রাই।এমনি ও ভালো কাঁটা বাছতে পারেনা।সারাজীবন মা’ই কাঁটা বেছে দিয়েছে।আন্টির ওখানে রমা পিসিকে বলে একটা পেটির মাছ বা অন্য কাঁটা ছাড়া মাছ যাহোক করে খায়।
ইলিশমাছ ওর সবচেয়ে প্রিয়,কিন্তু আন্টির বাড়ি ‘খাইনা’ বলে এড়িয়ে গেছে দুদিন।খুব ইচ্ছে করেছে কিন্তু সাহস করেনি কাঁটা বেছে খাওয়ার।
এখানে দিদুন জোর করে দুটো মাছ দিয়েছে,এখন সেটা বাছতে নাকানিচোবানী খাচ্ছে ও।
হঠাৎ দিদুন পা টেনে টেনে এগিয়ে এসে ওর পাশের চেয়ারে বসলো।রাই হাসিমুখে তাকালো ওঁর দিকে।
দিদা,ঠাম্মি কি হয় ওতো কোনোদিন দেখেনি।দিদুনকে দেখে রণর সাথে ওঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুভব করে আজ প্রথম নিজের দিদা,ঠাকুমার অভাব বোধ করলো রাই।
হঠাৎ দিদুন ওর থালাটা একটু টেনে নিল নিজের দিকে।ওর এঁটো থালা,চমকে উঠে রাই দিদুনের চোখে চোখ রাখলো।
রণও মন দিয়ে খেতে খেতে মুখ তুলে তাকালো দিদুনের দিকে,ভ্রু টা একটু কোচকাল।
“বলিসনি কেন মাছের কাঁটা বাছতে পরিসনা?তখন থেকে টুকটুক করে খাচ্ছিস দেখেই বুঝেছি।জয়িও ছোটবেলায় এরকম করতো।বসে থাকতো কখন মা এসে কাঁটা বেছে দেবে”,হাসিমুখে বলে রণর দিদুন।
হঠাৎই রাইয়ের চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়।মা কৃত্রিম অভিমান দেখিয়ে বলতো,’এত বুড়ো ধারী মেয়ে এখনো কাঁটা বাছতে পারেনা।শ্বশুর বাড়িতে কি আমি কাঁটা বেছে দিতে যাব!’
মিটিমিটি হাসতো রাই।’আমি মোটেও যাবোনা শ্বশুর বাড়ি।বিয়েই করবো না’।রাই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতো।
আজও ইচ্ছে করছিল দিদুনকে ওভাবে জড়িয়ে ধরতে।তার বদলে মনে মনে বললো,”থ্যাংক য়্যূ দিদুন”।
রাইয়ের ভিজে চোখ রণর দৃষ্টি এড়ালো না,ওর দিকে চোখ পড়তে দেখলো,ও চোখ বড় করে কৃত্রিম বকার ভঙ্গিতে মুছে নিতে বলছে চোখটা।একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে।

আসলে ছোট থেকে নিজের সবটুকু নিজে করতে করতে অভ্যস্ত মায়ের হয়তো মনে হত যদি কেউ থাকতো,তাই রাইকে অনেক বেশি কেয়ারে রাখতো।যেটা নিজে পায়নি,রাইকে তার থেকেও আরো অনেক বেশি কিছু দিতে চাইতো।রোগটা ধরা পড়ার পর রাইয়ের জন্যে সুস্থ হয়ে ওঠার অদম্য জেদ কাজ করতো ওর মধ্যে।

সারাটা দুপুর বিকেল দিদুনের সাথে গল্প করে কেটে গেল রাইদের।যে ছেলে বাড়িতে দুপুরে ঘুমোয়না, সে কি অবলীলায় দিদুনের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো।
রাই আজ প্রথম এই সম্পর্কটার ছোঁয়া পেলো,দিদা ঠাম্মি কি হয় বুঝলো।
কি সুন্দর দিদুন কথা বলতে বলতে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।মায়ের কথায় ওর গলা ধরে এলে বুকেও টেনে নিল।দিদুনের ফ্ল্যাটটা ওর খুব আপন লাগলো।
জয়ি আন্টির বাড়িটা বিশাল,কিন্তু দিদুনের ফ্ল্যাট ওদের কোয়ার্টারের মতোই আয়তনে।সুলেখা মাসিও কত আপন।সব মিলিয়ে আজকাল ভালো থাকা রাইয়ের আজকের দিনটা স্পেশালী আরো অনেকটা বেশি অন্যরকম কাটলো।

জয়ি নিজের ঘরে ড্রেসিং টেবিলে বসে রাতের স্বল্প প্রসাধন টুকু সারছিলো।এই চুলটা আঁচড়ে, মুখে একটু নাইট ক্রিম আর হাতে পায়ে মশ্চারাইজার লাগানো,এসি তে নাহলে হাত পা বড্ড ড্রাই হয়ে যায়।আজ ঋষির নাইট শিফট।ও এখন সিনিয়র হয়ে গেছে,খুব একটা রাতে শিফট থাকেনা।নিশ্চই কোনো এমার্জেন্সি আছে,তাই নিজেই নিয়েছে রাতের ডিউটি।জয়ি ওকে চেনে,পেশেন্ট কবে ওর নিজের হয়ে যায়,তার অবস্থা ঠিক না থাকলে ও যেচে রাতে থাকার দায়িত্ব নেয়।
সেদিন ঋষি একটা কথা বললো,সেটা জয়ির মনে সারাক্ষন খচখচ করছে।
রাইয়ের এখন বয়স চোদ্দো, আর বছর পাঁচেক পর থেকে ওকে বছরে অন্তত একবার স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে।ডাক্তার হিসেবে জয়িও জানে এতে ক্ষতি তো কিছু নেই,বরং লাভ।ব্রেস্ট ক্যান্সারের হিস্ট্রি থাকলে আজকাল স্ক্রিনিং টেস্ট করতে বলে যাতে সময় থাকতে রোগ ডিটেক্ট করে চিকিৎসা করা যায়।কিন্তু রাইয়ের ক্ষেত্রে আজকাল জয়ি কেন কে জানে দুর্বল হয়ে পড়ে।
জয়ি জানে রণর সাথে রাইয়ের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।তাতে একদিকে জয়ি বাইরে থাকলে স্বস্তিতেই থাকে,কিন্তু ভয় পায়।ভয় পায় লোকের কথাকে।রমা অনেকদিন ওদের বাড়ি আছে,কিন্তু ওর মানসিকতায় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয় ভাই বোন,নাহলে বিশেষ কোনো সম্পর্ক।
সম্পর্কের নির্দিষ্ট নাম ছাড়া ওদের মেলামেশা বাড়লে সেটা নিয়ে রমার মত অনেকের নজরে দোষ ধরা পড়বে।ছোট ছোট মন গুলো অহেতুক কলুষিত হবে।একটা চাপ পড়বে মনে,বিশেষ করে রাইয়ের।

রাই পরের মেয়ে,যেচে জয়ি দায়িত্ব নিয়েছে।রণ আজ বাড়িতে থেকে এক মানসিকতার আছে,দুবছর পর ও পড়তে বাইরে চলে যাবে।ডাক্তারি পেলে চলে যাবে হোস্টেলে।ওর জগৎ বড় হবে,হয়তো অন্য কোনো সমমনস্ক মেয়ে আসবে ওর জীবনে।রাই এর স্মৃতি আবছা হবে।
কিন্তু রাই যে প্রকৃতির মেয়ে ওর মনে একবার কারোর ছায়া পড়লে তা সরবে না কোনদিন।আর সেটাই এই বয়সে জয়ি চায়না।মেয়েটা একেই এত বড় আঘাত পেয়েছে এই বয়সেই।আর কোনো কষ্ট,বিশেষ করে জয়িদের তরফ থেকে,জয়ি ওকে পেতে দেবে না।

রণ জয়ির নিজের হাতের তৈরি,ও জানে ওর ছেলে জেনে বুঝে কোনো ভুল করবে না।কিন্তু এই বয়সটাই এমন ঠিক ভুল বোঝার ক্ষমতা থাকেনা।কিন্তু এই বয়সের মনের প্রকৃতি,বিশেষ করে ছেলেদের পরবর্তীকালে বদলায়,জয়ির অভিজ্ঞতা তাই বলে।
জয়ি জোর করে কিছু চাপাতে কোনোদিনই পছন্দ করেনা।কিন্তু রাই ওর দায়িত্ব বলেই ওর চিন্তা।তাই ও ওদের সম্পর্কের নাম দিতে চাইছে,একটা সুস্থ সম্পর্কে বাঁধতে চাইছে ওদের।
ও নিজেও জানেনা সেটা ঠিক কিনা?কিন্তু ক্ষতিকারক না এটা ওর ধারণা।
জয়ি এটাও জানে,রণ যতই শান্ত স্বভাবের হোক,ওর মতের বিরুদ্ধে কিছুই করানো সম্ভব না।আর এই সম্পর্কের বাঁধনে ও কোনো কারণে রাজি না।কেন সেটা জয়ি নিজেও ভালো বুঝতে পারছে না।

টেক-স্যাভি রণর মনটা নরম,তাই রাইয়ের দুঃখে মনে প্রভাব পড়েছে।তাছাড়া ও খুব সহজে মিশতে পারে,আর ছোট থেকে কোয়েড স্কুলে পড়ায় ছেলে মেয়েতে বিশেষ পার্থক্য ও করেনা।তাই মিশে গেছে রাইয়ের সাথে।কিন্তু রাই… ও যদি ভুল ভেবে নেয়।

সব কেমন গুলিয়ে যায় জয়ির।কার জন্য ও এতটা সতর্ক হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারেনা।বুঝতে পারেনা ঠিকভুল।শুধু জানে ও অত্যধিক সতর্ক রাইয়ের ব্যাপারে।আর সেটাই কারণ ওদের প্রথমেই বেঁধে দেওয়ার।
যতই নিজের ছেলে হোক রণ,আজকালকার ছেলেদের মনের প্রকৃতি বড়ই বদলেছে।প্লেটোনিক লাভ কি তাই হয়তো ওদের জানা নেই।তাই পরের মেয়েটাকে নিজের কাছে আগলে রেখে মানুষ করতে গেলে ও যা ভেবেছে সেটাই করবে ও।দরকারে কথা বলবে ও রণর সাথে।

বেডরুমের আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালায় জয়ি।এসি টা কুড়িতে দিয়ে হালকা রাজস্থানী রাজাইটা কোমর অবধি টেনে শুয়ে পড়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
রাই ওর দায়িত্ব,রেশমির অসমাপ্ত স্বপ্ন।যেটা জয়ি সম্পূর্ণ করার দায় স্বেচ্ছায় নিয়েছে।
রণর মত ছেলে আজকের দিনে হিরে,কিন্তু ওর মনের গভীরতার তল জয়ি নিজেও পায়না।তাই ওর অনিশ্চয়তা এত বেশি।
হঠাৎ মনে পড়ে এসিতে রাই অভ্যস্ত না।তাই ফ্যান চালায়,কখনো দোতলার ঘরের জানালা এক পাল্লা খুলে শোয়।সেই ভীতু,একা শুতে অনভ্যস্ত মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে।আজ জয়ি বলেছিল ওর কাছে শুতে,কিন্তু ও ঠিক রাজি ছিলোনা বুঝতে পেরে জয়ি নিজেই বারণ করে দেয় শেষ পর্যন্ত।
রণ,ছোট থেকে এসি ছাড়া থাকতে না পারা ওর ছেলে,এবছর খুব কষ্ট নাহলে এসি চালাচ্ছে না।জয়ি দেখেছে।
আর চিন্তা না।মনটা যতটা সম্ভব চিন্তামুক্ত করে চোখ বোজে জয়ি।চেষ্টা করতে থাকে ঘুমানোর।

ক্রমশ….