মরীচিকা না ধ্রুবতারা পর্ব-০৮

0
392

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#মরীচিকা_না_ধ্রুবতারা
#অষ্টম_পর্ব
#সামাজিক_প্রেমধর্মী_অনুপ্রেরণারমূলক
#প্রাপ্তমনস্কদের_জন্যে
#তমালী
©Tamali Pal Burman

(কিছু বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে গল্পটা রচিত।চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও চরিত্র বাস্তব। প্রতিটা চরিত্রের অনুমতিক্রমে ঘটনা গল্পে স্থান পেয়েছে।মূল কাহিনী লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।)

“আসুন আসুন ম্যাডাম”,ঋষি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালো রুনু চৌধুরীকে।আজ উনি একা নন,সাথে আরো একজনও আছেন।
“নমস্কার ডাক্তার মুখার্জী।কেমন আছেন?” দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললেন রুনু।
“এই চলে যাচ্ছে।থোর বড়ি খাড়া,আর খাড়া বড়ি থোর।আপনি বলুন আজকের সেলিব্রেশনের আসল কারণ…।” ঋষি স্বরে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“আর কি!এই চলে এলাম নিজের জন্মদিন পালন করতে।কয়েক বছর আগে অবধি তো নিজের জন্মদিনে
সেলিব্রেশন বিশেষ ছিলোনা।মেয়েরা অনলাইন কেক পাঠিয়ে দিত, কাটতাম,কর্তা-গিন্নি খেতাম,ব্যাস।এখন এই মানুষগুলোর সাথে সময় কাটানোর বাহানা খুঁজি।তাই ক্ষুদে গুলোর সাথে সময় কাটাতে চলে এলাম আজকের জন্মদিনের কেক নিয়ে”,রুনুদি গলগল করে মনের কথা বলতে থাকেন।
“আরে বাপরে!আগে বলবেন তো।জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।এরকম এক্টিভ,এনার্জেটিক থাকুন বছরের পর বছর”,ঋষি উচ্ছ্বসিত হয়ে পরে।
“থ্যাংক য়্যূ থ্যাংক য়্যূ ডক্টর,থ্যাংক য়্যূ ভেরি মাচ।আজ আমার বন্ধুও আমার সঙ্গে আছে,ওই পুচকে গুলোর সাথে একটু সময় কাটাবে বলে।” রুনু চৌধুরী খুব আনন্দ পান ঋষির কথায়।

এটাই তো উনি চান,এই ভাবে অ্যাক্টিভলি কাজ করে যেতে।অনেক কাজ যে বাকি।’সাহস’ এর হাত ধরে সেসব যে পূরণ করতে হবে তাঁকে।
আজও মনে আছে ওই অভিশপ্ত সময়টা।নয় নয় করে ন’টা বছর কেটে গেল।
“ডক্টর আমার সেই দিনগুলো আজও মনে পড়লে কাজের এনার্জি বেড়ে যায়।কে জানতো বলুন,বিকেলের পর হালকা জ্বর জ্বর,ক্লান্তি আসলে এতবড় একটা রোগের ইঙ্গিত।তারপর লড়াইটা যতটা শরীরের সাথে,ঠিক ততটাই মনের সাথে।সেই অসহ্য যন্ত্রণার দিনগুলো কিন্তু আজও মনে পড়ে।চার ঘণ্টা অন্তর অন্তর পেইনকিলার ইঞ্জেকশন নেওয়ার পরও মনে হত আর পারছিনা।নার্সদের কত বিরক্ত করতাম,বলতাম মেরে ফেলো আমায়…”,এখনো যন্ত্রণাটা যেন অনুভব করতে পারছেন বলে মনে হয় ওঁর মুখ দেখে।
পাশ থেকে ওঁর বন্ধু কাঁধে হাত দিয়ে বলেন,”থাম রুনু।আর ওইদিন গুলো মনে করিসনা”।

“না রে,ওই দিন গুলোই আমার কাজের প্রেরণা।যখন মুম্বাই গেছিলাম,হসপিটালের জানলা দিয়ে আরব সাগর দেখা যেত।তুই তো জানিস সমুদ্র আমার কত প্রিয়।নেভিতে যারা প্রথম ট্রেনিং নিতে আসতো তাদের ওই সমুদ্রে প্রথম ট্রেনিং দেওয়া হত।ওরা জলে পড়তো,আবার উঠে চেষ্টা করতো।আমিও ওদের দেখে সাহস পেতাম,ভাবতাম আমিও তো পারি ওরকম চেষ্টা করতে।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ,শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।…রোজ রোজ সানরাইজের মত সানসেটও দুচোখ ভরে দেখতাম।আর মনে মনে রোজ সানসেট দেখার সময় প্রেই করতাম কাল সকালের সানরাইজটাও যেন দেখতে পাই।যন্ত্রনা কষ্ট যাই থাকুক ওই দিনগুলো জীবনটা নতুন করে দেখতে শিখিয়েছিল।হাতের কাজ ভালো লাগতো করতে,ছোটবেলা থেকে মা-মাসি-পিসি-জেঠি-কাকী দের দেখেছি,কিন্তু শরীর টানতো না।তাছাড়া ইনফেকশনের ভয় ও থাকতো।উল কাঁটাও চালাতে পারতাম না।ওই ক্রুস দিয়ে বসে বসে ছোট ছোট জিনিস বানাতাম।যেসব পেশেন্ট চলে যেত,তাদের একটা করে ওই ক্রুসে বোনা কয়েন ব্যাগ গিফট দিতাম।এভাবেই তো শুরু বল।”রুনু চৌধুরী একটু থামেন ভালো করে নিশ্বাস নিতে।এখন রোগমুক্ত হলেও কিছুটা ধীর,যদিও জীবন সবসময় ছুটছে ওঁর।
ক্যান্সার পেশেন্টদের সাহায্যার্থে গড়ে তোলা ওর সংস্থা “সাহস” ওঁর সমস্ত প্রাণ শক্তির উৎস।
“ম্যাডাম আপনার মত মনের জোর খুব কম পেশেন্টের দেখেছি,আর সমঝদারও।কটা পেশেন্ট বা তাদের বাড়ির লোক বোঝে বলুন তো আসল কেয়ার লাগে কেমো দেওয়ার পর।কেমো তো আসলে একটা বিষ,ওই মালিগন্যান্ট সেল গুলো ধ্বংস করার।কিন্তু সেটা তো অনেক ভালো সেলও ধ্বংস করে দেয়।শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার প্রায় জিরো হয়ে যায়।তাই প্রচন্ড সাবধানে থাকতে হয় এরপর।সেটাই সবাই বোঝে না,এরপর বিভিন্ন ইনফেকশন সহজে কাবু করে ফেলতে পারে।” ঋষি এই কথাগুলো পেশেন্টদের পরিবারকে বারবার বলে,শোনে হাতে গোনা কিছু মানুষ।আরে গাছে জল দেওয়ার আগে যেমন চারপাশ টা খুঁড়ে দিতে হয়,এটাও তো প্রায় সেরকম।সিমেন্ট করতে গেলেও তো ফাটা অংশ ছাড়াও ভালো অংশ নিয়েও করতে হয়।

“আমার স্বামীর সুযোগ ছিল,তাই আমার চিকিৎসার খরচ লাগতো না।কিন্তু এই রোগের চিকিৎসাও তো ব্যয়বহুল,তাই মনে হয়েছিল দুঃস্থ রোগীদের জন্য কিছু করবো।আমার পাশের বাড়ির এক ছেলে,খুব উৎসাহী এসব কাজে,ওকে ডেকে সবটা বলেছিলাম হাসপাতালের বেডে বসে।তারপর কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর শুরু করলাম কাজ।’সাহস’ নামটা অবশ্য আমার ছোট মেয়ের দেওয়া।আর পিছন ফিরে তাকায়নি।নিজে সুস্থ হওয়ার সাথে অনেককে সুস্থ করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।অবশ্যই একা না।(নিজের বন্ধুর দিকে দেখিয়ে)এঁর মত অনেক বন্ধু,আত্মীয়-অনাত্মীয় এগিয়ে এসেছে।হাতের কাজে সাহায্য করেছেন,আর্থিক সাহায্য কেউ কেউ করেছেন, সাহস এগিয়ে চলছে।আগে ব্যক্তি সাহায্য করতাম,কিন্তু দেখলাম সেটা ঠিক উদ্দেশ্যে সব সময় খরচ হচ্ছে না।তখন এই আপনাদের মত স্পেশালিস্ট হসপিটালে সাহায্য করা শুরু করলাম দুঃস্থ রোগীদের যাতে ঠিক করে চিকিৎসা হয়।আপনি তো জানেন সব,কতবার রোগীর নাম করে টাকা দিয়ে গেছি।আমি কাজ করতে চাই,কিন্তু চাই যাতে সঠিক উদ্দেশ্যে সেটা ব্যবহার হয়।আর কিছু না”।

ঋষি আর রুনু ম্যাডামের বন্ধু চুপ করে শুনছিল কথাগুলো।বরাবরই রুনু কথা বলতে খুব ভালোবাসেন।কিন্তু এখন ওর কথাগুলো যেন অন্যরকম একটা ওষুধের কাজ করে,এমন ওষুধ যা কখনো কখনো ডাক্তারদেরও প্রয়োজন পড়ে।
ঋষি যে রোগের সাথে যুক্ত সেখানে ডাক্তারদের সারাক্ষন নিজেকে যেন মোটিভেট করতে হয়,মোটিভেট করতে হয় পজিটিভ চিন্তা করার জন্যে।প্রতিটা নতুন কেস,তাতে নতুন করে নিজেদেরও উৎসাহ দিতে হয় মনে মনে।রুনু দির ঘটনার মত ঘটনা গুলো মনে শক্তি যোগায়,বিশ্বাস করায় মিরাকেলও ঘটে।নাহলে ফোর্থ স্টেজ ওভারিয়ান ক্যান্সার থেকে সুস্থ হওয়া…নাহ হয়তো,রুনু চৌধুরী তার প্রমান।শুধু কি তাই তার সাথে আরো ছিল…চিন্তায় ছেদ পরে ঋষির।চিলড্রেন ওয়ার্ডের ওয়ার্ড-বয় এসে দাঁড়িয়ে ওর কেবিনের দরজা নক করে মুখ বাড়ায়।
ঋষি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়,”চলুন ম্যাডাম।চিলড্রেন ইউনিটে যাওয়া যাক।এতক্ষনে নিশ্চই সব রেডি হয়ে গেছে।”
রুনু ও তাঁর বন্ধুও উঠে দাঁড়ান।অনুসরণ করেন ডাক্তার মুখার্জী কে।

ঋষি কিছুক্ষন পর ফিরে এসেছিল নিজের কেবিনে।আজ ওর পেশেন্ট দেখার দিন না।তাই চাপ কিছুটা কম থাকে।
কাজের জন্য কম্পিউটারটা অন করেও অনেকদিন পর ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো।
সত্যি আজ ওর মনে পড়ছিল পুরোনো কথাগুলো।চেন্নাই থেকে ফিরেছে তখন বছর আটেক হয়ে গেছে,রণ স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে।কলকাতায় ও নিজেও অঙ্কলজিস্ট হিসেবে ভালোই পরিচিত তখন।ঋষি মুখার্জী কে অনেক হসপিটালই অফার দিচ্ছে।এরকম একদিন এক বন্ধু এসে ওকে নিয়ে গেছিল কলকাতার সেনা হসপিটালে,ওই বন্ধুরই আরেক বন্ধুর মা’কে একবার দেখার জন্য।
ওখানে ঋষি আগে কোনোদিনও যায়নি,গিয়ে একটু অভিভূত হয়েছিল।অন্য অনেক নামকরা হসপিটালের থেকে অনেক উন্নত।ও রোগী দেখবে কি নিজেই শিখে এসেছিল অনেক কিছু।ভদ্রমহিলার রিপোর্টে দেখেছিল লাস্ট স্টেজে ওভারিয়ান ক্যান্সার পৌঁছে গেছে,তার সাথে আছে সেকেন্ড স্টেজে থাকা নন হজকিন লিউফোমা ক্যান্সার, যেটা প্রায় সারা শরীরে বিস্তার লাভ করেছে।ঋষি কি বলবে বুঝতে পারেনি।
ওভারিয়ান ক্যান্সারকে এমনিও সাইলেন্ট কিলার এইজন্যই বলে,প্রথম দিকে ওটা ধরা খুব মুশকিল বলে।ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই ওটা ধরা পড়ে থার্ড কি ফোর্থ স্টেজেই।এঁর থার্ড স্টেজে ধরা পড়লেও কিছুটা ভুল চিকিৎসা প্রথমে হয়ে গেছিল,বায়োপসি করার পর রোগটা ফোর্থ স্টেজে চলে যায়।
কিন্তু যে টা দেখার ছিল ভদ্রমহিলার মনের জোর।নিজের বাড়ির লোককে বলেছিলেন,”কেউ কাঁদবিনা আমার সামনে।আমি জানি ঠিক সুস্থ হবো”।অসহ্য যন্ত্রনাতে নিজে কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু বাড়ির লোকের সামনে ভাঙেননি।
নিজের বৃদ্ধা মা ছিলেন,ভাইদের বলেছিলেন মা কে না জানাতে।
ঋষির সেদিন মনে হয়েছিল আর্মির লোকজনদের শুধু না,ভগবান বুঝি তাঁদের পরিবারের মানুষদেরও অন্য ভাবে বানান।অসীম সাহস আর সহ্যশক্তি দেন ওঁদের।
রুনু দির হাজব্যান্ড আর্মিতে ছিলেন,দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আর্মি অফিসারের সাথে।এঁদের লড়াই করার ক্ষমতাকে কুর্নিশ জানিয়েই হয়তো মিরাকল ঘটে।
ঋষি কথা প্রসঙ্গে শুনেছিল মুম্বাই নিয়ে চলে যাওয়া হবে ওঁকে,ওঁর বড় মেয়েও ওখানে থাকতো তখন।তারপর বম্বে স্পেশালিস্ট হসপিটালে নিয়ে চলে যায় ওঁর বাড়ির লোক।

কিন্তু রুনুদির সাথে ওই দিনের সম্পর্ক আজও রয়েই গেছে ঋষির, ওঁর পরবর্তীকালের কাজের সূত্র ধরে।
রুনু চৌধুরীর নিজের জীবনের সেই হঠাৎ বিপর্যয় ওঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল দুঃস্থ, অসহায় কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করতে।রুনু চৌধুরীর নরম প্রাণ অনুভব করেছিল এটা বর্তমান যুগের রাজরোগ।নিম্নবিত্ত দূর,মধ্যবিত্ত মানুষদের ক্ষেত্রেও এর চিকিৎসা কষ্টকর।তাই নিজের অনুভব থেকে শুরু করতে চেয়েছিলেন সেই সব মানুষদের জন্য কিছু করতে।
ব্যক্তি সাহায্য করতে গিয়ে যখন এক দুবার ঠকলেন,খুব মন খারাপ করেছিলেন।কিন্তু ভেঙে পড়েননি।তারপর যোগাযোগ করেছিলেন ঋষির মত কিছু ডাক্তার,কিছু স্পেশালিস্ট হসপিটালের ম্যানেজমেন্টের সাথে।তাদের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন সাহায্য।এখন সাহায্যের মানুষ অনেক,কর্মযজ্ঞ বিস্তার লাভ করেছে দূরে দূরে।
শুধু রোগীদের সাহায্য না,দরকারি যন্ত্রপাতি বসাতেও রুনুদি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।এরকম কিছু মানুষ সঙ্গে থাকলে ,জোট বেঁধে এই রোগটা কে হারিয়ে দিতে পারবে মানুষ,এটা ঋষির বিশ্বাস।
অজান্তেই ঋষির মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে ওঠে,একটা হালকা হাসি মুখে নিয়ে তাকায় ও ল্যাপটপের দিকে।নাহ কয়েকটা কেস একটু স্টাডি করে নিতে হবে।আজই একবার কথা বলতে হবে মেডিকেল অঙ্কলজিস্টদের সাথে।নিজের কাজে ডুবে যায় ও রুনু চৌধুরীর অনুপ্রেরণা কে পাথেয় করে।

দিনের শুরুটা সত্যি খুব সুন্দর কাটলো,রুনু চৌধুরী আর ওঁর বন্ধু সেই আলোচনা করতে করতেই বেরিয়ে আসছিলেন হসপিটালের গেট দিয়ে।জন্মদিনের শুরু যদি সবার এভাবেই হয়,হয়তো মনের মধ্যে কোথাও একটা শান্তি থাকে সারাদিন।ঋষি কিছুক্ষন থেকে ফিরে গেছিল ওর কেবিনে,তাই আসার আগে আর এক বার দেখা করে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেছিল।হসপিটালের গেটের বাইরে দাঁড়ানো নিজেদের গাড়িতে সবে দরজা খুলে উঠতে যাবেন হঠাৎ পেছন থেকে একটা ডাক পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন দুজনেই।
“ম্যাডাম ম্যাডাম…”,দেখলেন একজন নার্স এগিয়ে আসছে।চিলড্রেন ইউনিটে একটু আগে একে দেখেছিলেন মনে হলো।
“হ্যাঁ বলো কি বলবে”,রুনুই প্রশ্ন করে।
“আপনাকে আমি আগে দেখেনি।আজ প্রথম দেখলাম।কি সুন্দর করে আপনি ওই বাচ্চাটাকে বুঝিয়ে দিলেন।” নার্স মেয়েটার চোখে মুখে একটা আলাদা ভালোলাগার ঝলক দেখা যায়।
“কোন বাচ্চাটা?” বন্ধু ভদ্রমহিলা এবার বলেন।
“ওই যে কাঁদছিলো হেঁটে কেকের টেবিলের কাছে আসতে পারছেনা বলে।আপনি আপনার হুইলচেয়ারে বসা ছবি দেখিয়ে বললেন,একদিন আপনিও ওরকম হাঁটতে পারতেন না।আজ পারেন।তাই ও পারবে।আপনাকে বিশ্বাস করে চোখ মুছে মায়ের কোলে চেপে কেক খেতে চলে এলো বাচ্ছাটা। …আপনাকে এত ভালো লাগলো ।আসলে আমি বাচ্চাদের ইউনিটে থাকি তো,ওদের কষ্ট একদম নিতে পারিনা।মাস ছয়েক আগে যখন নার্সের ট্রেনিং করে এসেছিলাম ভাবিনি এরকম হসপিটালে,তাও আবার বাচ্ছাদের ইউনিটে ডিউটি পাবো।এক একসময় ইচ্ছে হয় ছেড়ে চলে যাই অন্য কোনো হাসপাতালে,কিন্তু পারিনা ওই বাচ্চা গুলোকে ছেড়ে যেতে।আজ আপনার ওদের সাথে সময় কাটাতে দেখে কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।” মেয়েটা নিজের মনের খুশিটা আটকে রাখতে পারেনা।

মনটা ভরে যায় রুনুর।মনে পড়ে আগের বছর শিবরাত্রির দিনটা।ওইদিন ও এরকম একটা স্পেশালিস্ট হসপিটালে গেছিলেন।সঙ্গে ছিল অন্য এক বান্ধবী।কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন,একজন ভলান্টিয়ার এগিয়ে এসেছিলেন ওঁদের দিকে।একটা বাচ্চার কেমো শুরুর আগে রক্তের দরকার ছিল,দরকার ছিল হাজার খানেক টাকা। ওঁকে টাকাটা সেদিন ওই বান্ধবী দিতে দেননি,উনি দিয়েছিলেন।অদ্ভুত একটা পরিবেশ গত মিল পেলেন রুনু দুটো দিনের।
লোকে পুজো করতে মন্দিরে যায়,এখন এই হসপিটাল গুলোই ওঁর কাছে মন্দির।এখন যে কোনো আনন্দ উৎসবেই ওঁকে এখানকার মানুষ গুলো টানে।
নার্স মেয়েটাকে আস্তে করে “থ্যাংক য়্যূ” বলে একটা তৃপ্তির হাসি হেসে অল্প বয়সী মেয়েটার পিঠটা একটু চাপড়ে দিলেন রুনু চৌধুরী।”ভালো থেকো।কাজ করে যেও”,বলে মুখে হাসিটা নিয়েই গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়লেন গাড়িতে।
কাঁচের আড়াল থেকে হাত নেড়ে এগিয়ে চললেন আবার জীবনের গতিতে।আবার হয়তো কদিন পর এখানে আসবেন,বা ছুটে যাবেন অন্য কোনো আর এক হসপিটালে।কিন্তু ‘সাহস’ এগোবে ,অনুপ্রেরণা আর সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাবে,পৌঁছে যাবে দুরারোগ্য এই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে নিজের গন্তব্যে।

“রেশম রেশম আমার জামাটা কোথায়?আজ বলেছিলাম হোয়াইট শার্টটা প্রেস করে রাখতে।কি গো শুনতে পাচ্ছোনা?” জয়ন্তর চিৎকার ওর নিজের স্টাডি রুম থেকে পৌঁছে যায় কিচেনে।
সবে মাত্র মাছটা কড়াইতে দিয়েছে রেশমা।কিন্তু ও জানে ও না যাওয়া অবধি জয়ন্তর চেঁচানো থামবেনা।এমনিতে স্বভাব শান্ত কিন্তু কোনো কিছুই নিজে খুঁজে পায়না ও।রুমাল থেকে মোজা সব হাতের কাছে দিয়ে আসতে হয়।আজ শরীরটা ঠিক নেই বলে উঠতে দেরি হয়ে গেছে,তাই সব গন্ডগোল হয়ে গেছে ।
“কি হলো চিৎকার করছো কেন?” রেশমা গ্যাসটা সিম করে এসে জিজ্ঞেস করে।
-“আমার সাদা শার্ট…?”
-“ভুলে গেছি।শরীরটা ভালো ছিলোনা।”
-“কি আবার হলো তোমার?”
কাছে এগিয়ে আসে জয়ন্ত রেশমার।
-“তেমন কিছু না।একটু জ্বর জ্বর…ঠান্ডা লেগেছে মনেহয়।দাঁড়াও শার্টটা আয়রন করে দিচ্ছি।” জয়ন্তর হাত থেকে শার্টটা নিতে যায় ও।
জয়ন্ত রেশমার কপালে হাত রাখে। তাপ খুব একটা অনুভূত হয়না।
-“আরে তেমন কিছু না।কাল বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো।তাই…দাও।” শার্টটার জন্যে হাত বাড়ায়।
-“রেশম তুমি আমার সাথে আজ হসপিটালে চলো তো।কদিন ধরেই দেখছি খালি বলছো ক্লান্ত লাগে।রাই ও সেদিন বললো জ্বর আসে মাঝে মাঝে।আর সেদিন রাতেও….”,চুপ করে যায় জয়।অন্তরঙ্গ মুহূর্তে রেশমের বুকে হাত দিতেই শক্ত মত যেটা ঠেকলো…।না না লক্ষণ ভালো লাগছেনা।

কিন্তু রেশমা…..সাদা শার্টটা হাতের মধ্যে নিয়ে জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে জয়।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে খেয়ালই থাকে না ওর।
এই সাদা শার্টটা আজ ছমাস হলো গায়ে দেয়নি ও।যতবার দিতে গেছে চোখ ছাপিয়ে জল নেমেছে।ভুলে গেছে ছোটবেলার শেখানো কথা,’ছেলেদের কাঁদতে নেই’।প্রতিবার মনে ভেসে এসেছে পুরোনো যত স্মৃতি। সবচেয়ে মনে পড়ে ওর গায়ের রং একটু চাপা বলে ও সাদা পড়তে বিশেষ পছন্দ করতো না।কিন্তু রেশম এটা ওকে একটা জন্মদিনে গিফট করেছিল।জয় মুখে কিছু না বললেও মন খারাপ করেছিল,ও সাদা পড়েনা জেনেও রেশম সাদা আনলো।কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেনি।আশ্চর্য্যের বিষয় যখন একটা সেমিনারে কালো ফর্মাল ট্রাউসারের সাথে ওই শার্টটা পড়লো নিজেকেই বেশ অন্যরকম লাগলো আয়নায়।তারপর হসপিটালে বিশেষ দিনে বা যে কোনো সেমিনারে জয়ন্ত ব্যানার্জী কে দেখা যেত ওই বিশেষ পোশাকে।

রেশম পরে বুঝিয়ে বলেছিল,জয়ন্ত কেন কাউকেই নিজের অস্বাচ্ছন্দের জায়গাটা এড়িয়ে যাওয়া উচিত না।মাথা উঁচু করে মুখোমুখি হওয়ার দরকার সব কিছুতে।আর সেই জন্যেই জয়ন্তর অস্বস্তি ভাঙাতে ও কিনে এনেছিল সাদা শার্টটা।ভাগ্গিস কিনে এনেছিল তাই জয় জানতে পারলো ওকে কতটা স্মার্ট লাগে এই পোশাকে।

হঠাৎ মনটা কেমন করে ওর।মনটা প্রানপনে ফিরে যেতে চায় ওই পুরোনো দিন গুলোতে।সবাই বলছে রেশম নেই সত্যিটা মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে।কিকরে মানবে জয়?কিকরে এত সহজে ভুলে যাবে কুড়ি বছরের স্মৃতি, এত সহজ সব ভুলে যাওয়া!এত সহজ সবটা মেনে নেওয়া!এত সহজ ‘মুভ অন’ করা! সবাই যে সবটা এত সহজে পারেনা।

জয়ের একটাই বিবেক দংশন হয়,সে হলো রাই।কিন্তু ওর মনটা ভেঙে এতটাই টুকরো হয়ে গেছে যে রাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতাটুকু ওর আর নেই।
আজ ওর কাছে জীবনটা বোঝা হয়ে গেছে,শুধু দিনগুলো যেন ও কাটিয়ে যাচ্ছে।রাই এর জন্যে বেঁচে থাকতে হবে বলে বেঁচে আছে।শেষ কুড়ি বছর রেশম ওর সমস্ত দায়িত্ব গুলো নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলো।শুধু সংসারে দরকারি টাকাটা ও মাসের শুরুতে বা মাঝে তুলে দিত ওর রেশমের হাতে।ব্যাস আর কোনো দিকে ওকে তাকাতে হতোনা।মাঝে মাঝে মজা করতো রেশম,”মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে জানো তুমি?”
তাও রাই এর তো কোনো দোষ নেই।সব বোঝে জয়,কিন্তু তাও নিজের মনকে মানাতে পারেনা।যেকোনো বন্ধনই আজকাল ওর অসহ্য লাগে।দায়িত্বের নামে ও ভয় পায়।
কি মনে করে মোবাইল ফোনটা তুলে নেয় হাতে ।
আজ ওর নাইট ডিউটি,তাই দিনটা পুরো ফাঁকা।যদিও সপ্তাহের মাঝের দিন,বুধবার, তাও রাইয়ের নম্বরটা টিপেই ফেলে দোনামনা করে।
আশ্চর্য্য হয়ে গেল,দুবার রিং হতেই ফোনটা ধরলো রাই।

“বলো বাবা।এই অসময়ে ফোন করলে ?” রাই ফোন ধরে অবাক স্বরে বলে।
“তুই স্কুলে যাসনি রাই?ভেবেছিলাম তোর ফোন অফ থাকবে।” বলে উঠতে পারেনা ‘মনটা খুব খারাপ রাই।তোর গলাটা শুনতে খুব ইচ্ছে করলো’।
“না বাবা আজ যায়নি স্কুল।”কিছুটা ভেবে বলে,”আজ শরীরটা ভালো নেই।পেটে ব্যাথা করছিল,তাই জয়া আন্টি বললো রেস্ট নিতে।তুমি হসপিটালে যাওনি?”বাবার হঠাৎ অসময়ে ফোন ওকে সাময়িক একটা আনন্দ দেয়।

কিন্তু উদ্বিগ্ন হওয়া গলায় জয়ন্ত বলে ,”বলিসনি কেন আমায়? কি হয়েছে তোর?”
যদিও আজকাল বাবা মেয়ের সম্পর্ক বন্ধুর মত হয়,কিন্তু রাই বাবার সাথে ততোটাও স্বাচ্ছন্দ্য কোনোদিন ছিলোনা ,তাই কিছুটা অস্বস্তি হলেও শেষ অবধি বলেই ফেলে কথাটা।
“কিছু না বাবা।ওই পিরিয়ডের পেইন।আজ সেকেন্ড দিন,তাই একটু কষ্ট হচ্ছে।”
কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে যায় জয়।’পিরিয়ডের পেইন!!!’ কবে এতটা বড় হলো তার মেয়ে!!!ওতো জানতেই পারলোনা কবে যে মেয়েটা শৈশবের গন্ডি পেরিয়ে কৈশোর-যৌবনে পৌঁছে গেল??”
রাই নিজেও কি জানে সময়টা! কবে ও প্রকৃত পরিণত হলো?
ওর মা যখন হসপিটালে ভর্তি একদিন খেয়াল করেছিল বাথরুমে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে।ওর বন্ধু ছিলোনা বিশেষ একটা,তাই জানতেও পারেনি মেয়েদের এরকম কিছু বিশেষ দিন থাকে মাসে ,যা আর পাঁচটা স্বাভাবিক দিনের মতোই ।
না কোনো নিকট আত্মীয়,মা-মাসি-পিসি বা জেঠি-কাকিমা নয় ওকে পরিণত হয়ে ওঠার প্রাথমিক জ্ঞান দিয়েছিল মিনু।রেশমার আলমারি রাইকে দিয়ে খুঁজিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের যে প্যাকেটটা পেয়েছিল সেটা দিয়ে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সবটা।প্রথম পিরিয়ডের ভয়,উদ্বেগ,শারীরিক কষ্ট সবটাই রাইয়ের কেটেছিল মিনুকে জড়িয়ে।তাও প্রায় বছর খানেক হলো।এখানে ওর সবটা সামলে রাখে জয়ি।এমনকি নিজের ডেটটা ও ভুলে গেলেও জয়ি ভোলেনা।কখনো এই নিয়ে কোনো অস্বস্তিতে অন্তত রাই এবাড়ি তে এসে থেকে পড়েনি।
“আচ্ছা।তাহলে তুই রেস্ট নে।আমি পরে ফোন করবো।এমনি করেছিলাম রে।” নিজের কৌতূহল নিজের মনেই চেপে মেয়েকে উত্তর দেয় জয়ন্ত।
“বাবা তোমার মন খারাপ?” মেয়ের কথায় চমকে ওঠে জয়।কি করে বুঝলো রাই! ওর গলা শুনে ওর মনের কথা একমাত্র তো রেশম বুঝতো!!!কিন্তু রাইয়ের গলায় একই সুর শুনলো জয়ন্ত।এও কি সম্ভব! রেশম চলে গেলেও রাইয়ের মধ্যেই হয়তো বেঁচে আছে।
নিজেকে সামলে জয় বললো,”না রে মা।তেমন কিছু না।আসলে আজ নাইটে ডিউটি,দুপুরে একা আছি কোয়ার্টারে,মনে পড়ছে অনেক কথা।পুজোর ছুটিতে তোকে কদিন নিয়ে আসবো।আসবি তো বুড়ো বাবার কাছে?এখানে পাহাড়ি অঞ্চল,একটু রিমোট টাইপের,কিন্তু খারাপ লাগবে না কদিন থাকতে দেখিস।”

চোখটা জ্বালা করে ওঠে রাইমার।’আমি তো চাই বাবা তোমার কাছে থাকতে।’,মুখে বলে,”না কোনো কষ্ট হবেনা,বরং ভালো থাকবো।সত্যি নিয়ে যাবে আমায়?” বুক হুহু করে ওঠে জয়ন্তর মেয়ের কথা শুনে।বুঝতে পারে যতই জয়ি ঋষি থাক মায়ের অভাব মেয়ে পূরণ করতে চায় বাবা কে দিয়ে।মনে মনে বলে,’বড় অপদার্থ তোর বাবা রে রাই।এত ছোট বয়সে তোর মা,পরিবার সব কেড়ে নিল।কিছু আগলে রাখতে পারলোনা ,এখন তোকেও কাছে এনে রাখতে ভয় পায়।যদি তোর যত্ন করতে না পারে!যদি অবহেলা হয়ে যায় রেশমের একমাত্র সম্পদের।
মুখে বলে,”সত্যি রে মা।তুই এমনি ভালো আছিস তো?” জানে জয়ির কাছে অনেক ভালো থাকবে ওর মেয়েটা।নিজের মা কে মিস করলেও জয়ি ওর খেয়ালটুকু রাখবে ঠিক।
“ভালো আছি বাবা।সত্যি ভালো আছি।এখানে সবাই খুব খেয়াল রাখে আমার।কিন্তু বড্ড মন কেমন করে তোমাদের জন্যে।মা তো ফিরবে না।তাই….”,পারেনা রাই শেষ অবধি নিজেকে সামলে রাখতে,গলা ধরেই যায় ওর।
জয়ন্তর বড় অপরাধী লাগে নিজেকে।ও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা।ধরা গলায় বলে,”আমায় ক্ষমা করিস রাই।বড় স্বার্থপর তোর বাবা।আমি যাবো খুব তাড়াতাড়ি তোকে দেখতে।মন খারাপ করিসনা।তুই ছাড়া আর কে আছে বল আমার!”
এতমাস পর বাবার মুখে এরকম কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা রাই, যে কান্নাটা এতক্ষন গলা বুজিয়ে দিচ্ছিল সেটা চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে এবার,সজোরে ফুঁপিয়ে ওঠে ও।
কিছুটা সময় লাগে বাবা মেয়ের দুজনেরই নিজেদের সামলাতে।তারপর আরো কিছুক্ষন কথা বলে যখন ফোন কাটে জয়ন্তর বুকটা অনেকটা হালকা লাগে।রাইমারও মনটা ভালো হয়ে যায়।এতদিন যে বিশাল শূন্যতা বুকে ছিল,আজ যেন অনেকটা ভরাট লাগে সেখানটা।অসহায়তা অনেকটা কম লাগে।

“ওই রণ কত নতুন ছেলে মেয়ে এসেছে রে আমাদের স্কুলে!আগের অনেকে ছেড়ে চলেও গেছে ।আমি তোর টানেই বলতে পারিস স্কুলটা চেঞ্জ করতে পারলাম না।হ্যাঁ রে তোর সেই বাবার বন্ধুর মেয়ে চলে গেছে?” রুদ্র স্কুলের প্রথম দিন এসে থেকে বকেই যাচ্ছে।এবার রণর বিরক্তি চরমে পৌঁছল।এমনিতে ও চট করে বিরক্ত হয়না,কিন্তু রাইয়ের প্রসঙ্গ কিছুতেই ও আলোচনা করতে চায়না কারোর সাথে।
সবে ও ঘুরিয়ে উত্তর দিতে যাবে ওর কথা থেমে যায়।

-“এক্সকিউজ মি,আর য়্যূ ওল্ড স্টুডেন্টস অফ দিস স্কুল?”
-“ইয়া।অ্যা’ম রণজয় এন্ড হি’জ রুদ্র”।
-“অ্যা’ম শীর্ষা, শীর্ষা ভট্টাচারিয়া”,বলে মেয়েটা নিজের পুরোনো স্কুলের নাম বলে।শহরের নামকরা গার্লস স্কুল।
-“শীর্ষা!!!!” রুদ্র ঢোঁক গেলে।
-“কেন শীর্ষা নাম হয়না?” ভ্রু তোলে রণদের স্কুলে নতুন মেয়েটা।
-“আরে না না।ভেরি নাইস নেম, আর আনকমন ও।এন্ড নাইস টু মিট য়্যূ”।রুদ্রর কথা সামাল দিতে রণ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় শীর্ষার দিকে।
শীর্ষাও মুখে একটা কোমল হাসি এনে রণর সাথে হাত মিলিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দেয় রুদ্রর দিকে।
-“ডোন্ট মাইন্ড।আসলে আমি আগে এই নামটা শুনিনি তাই একটু অবাক হয়েছিলাম।কিন্তু তোমার নাম সত্যি খুব মিষ্টি,একদম তোমার মত”,একগাল হেসে শীর্ষার হাতে হাত মিলিয়ে বলে রুদ্র আর শীর্ষার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
সত্যি নিখুঁত সুন্দরী বলতে যা বোঝায় শীর্ষা তাই।লম্বায় প্রায় ওদের সমান মেয়েটার নাক,মুখ চোখ সবটাই যেন ভগবান সময় নিয়ে এঁকেছেন।শুধু রংটা টকটকে ফর্সা না,উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা বলা যেতে পারে। আর সেটাই ওর রূপটাকে বাড়িয়ে তুলেছে।অনেকের মধ্যেও ওকে আলাদা করা যায় শুধু ওর সৌন্দর্য্য দিয়ে।ওর উজ্জ্বল হালকা বাদামি চোখদুটোতে যে সরলতা আছে,সেটাও কোয়েড স্কুলের ছেলেদের মাথা খারাপ করার জন্যে যথেষ্ট।
-“আমি সায়েন্স।তোমরা?”
-“আমরাও তাই”।
-“আচ্ছা আমরা তাহলে তো ব্যাচমেট।সো এই ‘তুমি’ টা ঠিক ভালো লাগবে না,’তুই’ বলি একে অপরকে”।
-“একদম।শীর্ষা তুই কি কিছু জানতে এসেছিলি না জাস্ট আলাপ করতে?” রণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।
-“ও হ্যাঁ।আরে আই কান্ট ফাইন্ড দ্য সায়েন্স রুম।আমার স্কুল ও অনেক বড় ছিল,কিন্তু এখানে ক্যাম্পাস টা সত্যি বিশাল।প্লিজ হেল্প।”
-“চ আমরাও রুমে যাবো।ব্যাগ আগেই রেখে এসেছি।জাস্ট এমনি চক্কর দিচ্ছিলাম স্কুলটা”,রণ শীর্ষা কে ইশারা করে ওদের অনুসরণ করতে।
-“বাই দ্য ওয়ে,তুই কি সেই রণজয় মুখার্জী যার অল ওভার ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক ফিফটিনথ?” শীর্ষা আবার ভ্রু তোলে।
হেসে ফেলে রণ,ওর গজ দাঁতের হাসিটা আলাদা করে সবার চোখে পরেই।
“হ্যাঁ, আমি রণজয় মুখার্জী।কিন্তু ফ্রেন্ডস এন্ড ক্লোজ সার্কেলে শুধুই রণ”।
এই প্রথম সুন্দর মেয়েটা পুরোপুরি হাসে,যে হাসিতে কোনো অহংকার নেই,আছে শুধুই বন্ধুত্বের সারল্য।
ভালো লাগে রণর।ও বন্ধুত্ব বেছে করে না।কিন্তু ‘আমিত্ব’ ওর খুব অপছন্দের।স্ট্যাটাস দেখে যারা বন্ধুত্ব করে ও তাদের একটু এড়িয়েই থাকে।ও খোঁজে ভালো মানুষ। তাই রুদ্র কে সবাই এড়িয়ে চললেও ওর বন্ধুত্বে কোনো ঘাটতি থাকে না রুদ্রর সাথে।
ও বুঝতে পারে শীর্ষাও মিশে যাবে হয়তো ওদের সাথে।তবে চেনা জানা শুরু নাহলে বোঝা সম্ভব না।
এতদিন সব মেয়ে ছিল ওর ব্যাচমেট,আজ প্রথম কাউকে বন্ধু মনে হয়।তিনজন একে অপরকে চিনতে চিনতে পা বাড়ায় নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে।

ক্রমশ….