মায়ার বাঁধন পর্ব-০৫

0
213

মায়ার বাঁধন-৫ম পর্ব
©শাহরিয়ার

খাবার টেবিলে আড্ডা বেশ জমে উঠলো, দুলা ভাইয়েরা তাদের পুরনো দিনের গল্প বলতে শুরু করলো। বাবা মা খুব দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে পরলেন।

বড় দুলাভাই: আর বলো না জয়, এই যে তোমার বড় আপুকে দেখছো, একেতো বিয়ের পর আমার একদম পছন্দ হতো না। মনে হতো একটা আপদ এসে হাজির হয়েছে জীবনে। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগলো এই মেয়ের গুনের কাছে আমি হার মানতে বাধ্য হলাম। আর একটা সময় বুঝতে পারলাম ও আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনে শুধু উন্নতি আর উন্নতিই হচ্ছে। তাইতো আমার এই ভাইয়ের জন্যও আমি এ বাড়ি থেকেই মেয়ে নিয়ে গিয়েছি। তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে আমার আর একটা ছোট ভাই নেই। থাকলে হয়তো উপমাকে তুমি আর বিয়ে করতে পারতে না। তাকে দিয়েই বিয়ে করিয়ে নিয়ে যেতাম।

দুলা ভাইদের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো, জয়ও কৃত্রিম হাসি দিয়ে তাদের সাথে যুক্ত হলো। খাওয়া শেষ করে হাসি মুখেই জয় আমার সাথে নিজের রুমে চলে আসলো।

রুমের দরজা বন্ধ করতেই জয় বলতে শুরু করলো।

জয়: আচ্ছা তোমাদের তো দেখছি অনেক গুন। তোমার দুলাভাইয়েরা কি করে তোমার বোনদের নিয়ে সংসার করছে আমিতো এটাই বুঝতে পারছি না। এতো বছর ধরে এদের নিয়ে সংসার করা যায়?

উপমা: আপনি হয়তো সারা জীবন মানুষের বাহিরের সুন্দর্য্য খুঁজে চলেছেন। তাই আমাদের শরীরের রঙ আপনার ভালো লাগে না। আপনি হয়তো সবাইকে নিজের সাথে মিলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু আসলে কি জানেন হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান না ঠিক তেমনি পৃথিবীর সব মানুষ শুধু বাহিরের সুন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়না।

জয়: শোন মুখে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু বাস্তবতায় কেহ এসব বিশ্বাস করে না। যদি এমনটাই হতো তাহলে অনেক আগেই তোমার বিয়ে হয়ে যেতো। আমাকে তোমার বিয়া করতে হতো না।

উপমা: ব্যাপারটা আসলে ঠিক তা না, আপনার সাথে সৃষ্টিকর্তা আমার বিবাহ লেখে রেখেছে বলেই বিয়েটা হয়েছে।

জয়: ও তাই বুঝি, ওকে ঠিক আছে তোমাকেতো তিন মাস সময় দিয়েছি দেখি তুমি সারা জীবন আমার সাথে সংসার টিকিয়ে রেখে প্রমাণ করো সৃষ্টিকর্তা সত্যিই তোমার সাথে আমার সম্পর্ক লেখে রেখেছে বলেই আমাদের বিয়েটা হয়েছে।

উপমা: আপনার যদি এমনটা মনে হয় আমাদের সংসারটা টিকবে না। যদি আল্লাহ এমনটা চান তবুও আমি বলবো “আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন” সুরা তালাক:আয়াত-৭, তিনি আরও বলেছেন সে তার বান্দাকে ততটা কষ্ট দেন না যতটা সে সহ্য করতে পারবে না। তিনি বলেছেন ” আমি কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না” সুরা আন’আম-১৫২।

জয়: আমি ঘুমাবো তোমার সাথে তর্ক করার কোন ইচ্ছে নেই আমার। সময় বলে দিবে কি হয়।

উপমা: আচ্ছা তাহলে আপনি ঘুমান আমি বাহিরে যাচ্ছি সকলের সাথে গল্প করে আসি।

জয়: হুম যাও।

রুমের দরজা লাগিয়ে বের হয়ে আসলাম। বের হয়ে সোজা বাবা মায়ের রুমে চলে আসলাম।

বাবা: কিরে মা তোর কি মন খারাপ?

উপমা: নাতো বাবা।

বাবা: আয় আমার পাশে বস।

আমি যেয়ে বাবার পাশে বসলাম।

বাবা: মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, জয় ছেলে হিসেবে খুব ভালো। আমি সব খবর নিয়েই তোকে বিয়ে দিয়েছে। তোর বিয়ের আগেই আমি সব রকম খোঁজ খবর নিয়ে তারপর তাদেরকে পাঁকা কথা দিয়েছিলাম।

আমি জানি বাবা তুমি সব সময় আমাদের জন্য ভালোটাই করবার চেষ্টা করেছো। আর আমি জানি অবশ্যই আল্লাহর রহমতে সব কিছু ভালোই হবে। আমি এসব নিয়ে কোন রকম টেনশন করি না। আমি জানি আমার বাবা মা আমাদের চার ভাই বোনকে কতটা আদর যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছো। আর আমি ভালো আছি আমার শ্বশুড় শাশুড়িও খুবি ভালো মানুষ বাবা। তারা আমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসে। আর জয় ও খুব ভালো মানুষ শুধু রাগটা একটু বেশী। আসা করি খুব তাড়াতাড়িই ও রাগ নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।

বাবা: হ্যাঁ আমি জানি আমার মেয়েদের জন্য অসাধ্য কিছু নেই। আমি আমার মেয়েদের কে সেই ভাবেই লালন পালন করেছি যাতে কোথাও থেকে কেউ কোন অপবাদ দিতে না পারে।

হ্যাঁ বাবা আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেন তোমাদের মান সম্মান রাখতে পারি।

মা: আয় তোর চুলে তেল দিয়ে দেই।

আমি মায়ের কাছে যেয়ে বসতেই মা তেলের বাটি নিয়ে এসে মাথায় তেল দিতে শুরু করলো। এমন সময় শাকিল ঘরে আসলো। মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে কিরে ভাই তুই কোথায় থাকিস? এমনিতেই আমি তোর উপর রেগে আছি গত রাতের ব্যাপারে তুই কি ভেবেছিস তুই ছাড় পেয়ে যাবি?

শাকিল: শাস্তিতো পাচ্ছিই, কাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। তুমি শ্বশুড় বাড়িতে থাকবে আর আমরা শান্তিতে কি ঘুমাতে পারবো ভাবছো? আমার কতটা খারাপ লেগেছে তা বলে বুঝাতে পারবো না তোমাদের। তাইতো তোমার বিদায়ের সময় তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারিনি।

মন খারাপ করিস না ভাই, দেখবি আসতে আসতে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এটাই বাস্তবতা এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আর আমরা কেউ এই নিয়মের উর্ধে নই। তাছাড়া আর কিছু দিন পর তোকেও বিয়ে করতে হবে। মা বাবার বয়স হয়েছে। তোর জন্যও পছন্দ করে একটা মিষ্টি বউ নিয়ে আসবো এই বাড়িতে।

শাকিল: লজ্জা পেয়ে তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। বলেই রুম থেকে বের হয়ে পরলো।

আমি মা বাবার সাথে আরও কিছুটা সময় গল্প করতে করতে আসরের আযান দিয়ে দিলো মসজিদে। মা বাবাকে বলে নিজের রুমে চলে আসলাম। খুব আস্তে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে জয়। আমি আস্তে করে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। ওযু করে বের হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম।

নামায শেষ করে আস্তে করে আবার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। সকলের জন্য নাস্তা বানানোর জন্য রান্না ঘরে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখতে পেলাম বড় আপু আর মেজ আপু আগে থেকেই এসে রান্না ঘরে বসে আছে। আমাকে দেখেই বড় আপু বলে উঠলো।

বড় আপু: কিরে তুই কেন আসলি নতুন বর রেখে?

ও ঘুমাচ্ছে, তাই ভাবলাম নাস্তা বানাই সকলের জন্য, এসে দেখি তোমরা আমার আগে থেকেই এসে পরেছো।

মেজ আপু: ভালোই হয়েছে, আয় তিন বোন মিলে নাস্তা বানাই, সমস্যা নাই অনেক দিন তিন বোন এক সাথে রান্না ঘরে কাজ করি না। তাছাড়া তোর হাতের চায়ের স্বাদই আলাদা।

কি যে বলো না তুমি, তোমার হাতের লুচি কতদিন খাইনা। মনে হয় এখনো জিবে তোমার হাতের লুচির স্বাদ লেগে আছে।

বড় আপু: হয়েছে হয়েছে তোরা দু’জন মিলে নাস্তা বানাবি আজ আর আমি বসে বসে দেখি।

তা হবে না।

বড় আপু: কেন?

কেন আবার তোমার হাতের সবজি ছাড়া লুচি খাবো কি দিয়ে?

তিন বোন গল্প করছি আর হাসছি এমন সময় মা এসে কিরে তোরা কি গল্প করেই বেলা শেষ করবি নাকি নাস্তাও বানাবি?

বড় আপু: কি যে বলো না, এইতো আমাদের হয়ে এসেছে। বাবা কি করছে মা?

মা: তোর বাবা আর কি করবে বাহিরে গেছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাহিরে গেছে। এখন কি আর তোর বাবার কোন চিন্তা রয়েছে? তোদের তিন বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারতো এখন সুখের দিন।

মেজ আপু: কি যে বলো না মা, তোমাদের দ্বায়িত্ব কি শেষ নাকি? এখনো শাকিলের বিয়ে বাকি, তাছাড়া আমাদের ছেলে মেয়ে হলে তাদের সন্তানাদির বিয়ে দিবে। তারপর তোমাদের ছুটি।

মা: শাকিলের বিয়ের দ্বায়িত্ব তোদের আর ওর তিন দুলা ভাইয়ের। আমদের বয়স হয়েছে, আমরা আর ঝামেলা পোহাতে পারবো না।

গল্প করতে করতে নাস্তা হয়ে গেলো, তিন বোন মিলে ডাইনিং এ নাস্তা সাজিয়ে রেখে যে যার রুমে চলে আসলাম। জয় ঘুমাচ্ছে পাশে এসে দাঁড়িয়ে তিন চার বার ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালো।

জয়: কি হয়েছে ডাকছো কেন?

সবাই নাস্তার টেবিলে চলে এসেছে, ফ্রেশ হয়ে চলুন নাস্তার টেবিলে যাবেন।

জয়: আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যেয়ে খেয়ে নাও।

তা হচ্ছে না, মা আপনাকে ডাকছে খাওয়ার জন্য।

জয়: হয়েছে বুঝছি।

বলেই বিছানা থেকে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণের ভিতর দু’জন মিলে ডাইনিং এ চলে আসলাম। সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলাম। জয় খুব তৃপ্তি নিয়েই খাবার খেলো।

বড় আপু: কি কেমন হয়েছে ভাইয়া নাস্তা?

জয়: হুম আপু ভালো হয়েছে,

আপু এরপর সবাইকে চা দিলো।

জয়: চায়ে চুমুক দিয়ে হুম আপু আপনিতো বেশ ভালো চা বানান আপু।

মেজ আপু: আরে আরে বড় আপু চা বানাবে কেন? চা বানিয়েছে উপমা, মানে তোমার স্ত্রী।

জয় আর কিছু বললো না, মুহুর্তেই ওর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো। হয়তো সে আমার সামনে অন্যদের প্রশংসা করে আমাকে ছোট করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা আর করতে পারলো না।

নাস্তা শেষে দু’জন ছাদে উঠে আসলাম। দুষ্টমির ছলে জয়কে বললাম শুনেন স্ত্রীর খাবারের প্রশংসা করতে হয় বুঝলেন? এতে করে স্ত্রী খুশি হয়।

জয়: কিছুটা রেগে চুপ একদম চুপ স্ত্রী? হ্যাঁ মাত্র তিন মাসের জন্য।

আমি হেসে বললাম তবুওতো স্ত্রী তাইনা? আর এই জন্যইতো মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সূরাতুন নিসার ১৯ নং আয়াতে বলেন, “সাবধান! স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর”। আর তাই আপনার উচিৎ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করা।

জয়: তোমার এই সব ন্যাকামো মার্কা কথা বন্ধ করো, বিরক্ত লাগছে তোমাকে কেন জানি আমার সহ্য হচ্ছে না।

চলবে…