মায়ার বাঁধন পর্ব-০৬

0
197

মায়ার বাঁধন- ৬ষ্ঠ পর্ব
©শাহরিয়ার

দেখুন আপনি আমার স্বামী, আর আমি আপনার স্ত্রী। তাই আমি যেভাবে আপনাকে সম্মান করছি, ভদ্রতা দেখাচ্ছি ঠিক ততটাই নম্রভাবে আমার সাথে ব্যবহার করা উচিৎ আপনারও। আপনি হয়তো জানেন না একজন নারী, ঠিক যতটা ভালোবাসতে পারে ঠিক তার চেয় অনেক বেশী ঘৃণাও করতে পারে।

জয়: কি বললেন ভালোবাসা, কে বলছে আপনাকে ভালোবাসতে? আমি বলছি?

দেখুন আপনি উত্তেজিত হবেন না, কেই দেখলে শুনলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া আগামি তিন মাস আমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করবো এটাই কথা। আর তা না করে আপনি যদি এমন চিল্লাচিল্লা করেন তাহালে নিশ্চই ঝামেলার সৃষ্টি হবে।

জয়: ঐসব কিছু আমি বুঝি না কি হবে না হবে , কিন্তু তোমার মত মেয়ের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্তই কতটা বিরক্তি কর। কতটা কষ্টকর সে আমি বুঝি, আমি জানি না কেন তোমাকে আমার সহ্য হয় না।

দেখুন, বিয়ের আগে আপনার বাবা মা যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো, তখন তারা বলেছিলো আপনি নামাজি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি বিয়ের পর আমি আপনাকে নামাজ পড়তে দেখিনি। ঐ যে বিশাল আকাশ দেখছেন কালো কালো মেঘ দিয়ে চাঁদকে ডেকে রেখেছে। একটা সময় সে মেঘ কেটে যাবে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হবে পুরো পৃথিবী। ঠিক তেমনি মানুষের অনন্তরও অহংকারে ডাকা পরে রয়েছে, আমরা বাহিরের চাকচিক্য আর সুন্দর্য্যের পেছনে ছুটে চলছি। অথচ মানুষের আসল সুন্দর্য হচ্ছে তার মন, আমরা সে মনকে নিজের ইচ্ছেতে কিংবা নিজের অজান্তেই ভেঙে চূরমার করে দিচ্ছি। আপনি জেনে বুঝেও না বুঝার মত করে আছেন। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও আজও সাদা কালো চামড়া নিয়ে পরে রয়েছেন। অথচ আমরা সকলেই জানি এই আকৃতি মহান আল্লাহ আমাদের দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

জয় কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হয়তো এই মুহুর্তে আমার কথা গুলোর বিপরীতে কি বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না।

আমি ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে বললাম শোনেন,
আমার রব যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন। ” তুমি তোমার রবের কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে”-সূরা আর রাহমান। আলহামদুলিল্লাহ তিনি আরও বলেন, “নিশ্চয় তোমার রব তোমাকে এত বেশি দিবেন যে তুমি অচিরেই খুশি হয়ে যাবে” – আল কোরআন। এখন আপনি বলেন আমি কালো কিংবা আপনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না তার জন্য কি আমি ভেঙে পরবো হতাশ হবো? কখনোই না। বরং আমি আমার রবের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করবো, পূর্বের ন্যায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো। কুরআন তেলোয়াত করবো। নিজের মনকে প্রশান্ত রাখবো। তবেই আমার আল্লাহ আমার উপর খুশি হবেন। আপনিও আপনার মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুণ কেননা আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া কোন কিছুই হয়নি বা আগামিতেও হবে না।

জয়: আমাকে কিছু সময় একা থাকতে দিবে প্লীজ?

এই প্রথম জয় নমনীয় ভাবে কথা বলছে, আমি হাসি মুখে হ্যাঁ অবশ্যই আপনি থাকুন আমি নিচে যাচ্ছি। বলেই হাঁটা শুরু করলাম। সিঁড়িতে আসতেই এশার আজানের সুর কানে ভেসে আসলো। আমি নিচে সোজা নিজের রুমে এসে ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কুরআন নিয়ে বসলাম। আজ সকালে কুরআন তেলোয়াত করা হয়নি, তাই মনটা কেমন জানি করছিলো। দেরী না করে কুরআন তেলোয়াত করতে শুরু করে দিলাম।

ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে জয়, এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে মনে ভাবছে উপমার বুদ্ধি, যুক্তির কাছে সে বার বার পরাজিত হচ্ছে। কি করবে সে? উপমার প্রতিটা কথাই যুক্তি সম্মত। এমন মেয়েকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা যায় কিংবা ভালোবাসা উচিৎ। পরক্ষণেই বন্ধু মহল আর এ সমাজের কথা মনে পরতেই না না এসব আমি কি ভাবছি এই মেয়েকে নিয়ে সংসার অসম্ভব। মাত্রইতো তিনটা মাসের ব্যাপার। দেখতে দেখতে চলে যাবে। নানান রকম চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ছাঁদের উপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই আস্তে আস্তে হেঁটে নিচে নেমে আসলো। রুমে ঢুকতেই সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলোয়াত কানে আসতে লাগলো।
জায়নামাজে বসে তেলোয়াত করছে উপমা। খাটের উপর শুয়ে মুগ্ধ হয়ে তেলোয়াত শুনতে শুনতে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে জয়ের।

উপমা: দীর্ঘ সময় তেলোয়াত শেষ করে উঠে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পাই, জয় বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে, যদিও দরজা খোলার শব্দ কানে এসেছিলো। কিন্তু তেলোয়াতের সময় তাই ঘুরে দেখা হয়নি কে এসেছে তবে অনুমানে বুঝা হয়েছিলো জয় এসেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় একদম নিষ্পাপ শিশুর মত দেখাচ্ছে জয় কে। খুব ইচ্ছে করছে কাছে যেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে। দু’হাতে তার গাল দু’টো কে স্পর্শ করে দিতে। অথচ সব ইচ্ছেকে দূরে সরিয়ে, তাকে শুধু দূর থেকে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। হয়তো আমি তাকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে অনেক বেশী ঘৃণা সে আমাকে করে। হয়তো সত্যি সত্যিই তিনটা মাসের মেহমান আমি তার জীবনে।

একদৃষ্টিতে জয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রয়েছি। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দ্যান ভাঙতেই দেখি জয় চোখ মেলে তাকাচ্ছে, তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পাই শাকিল দাঁড়িয়।

শাকিল: ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তোমাদের কি খেতে হবে না? কয়টা বেজেছে ঘড়িতে এক বার ও কি দেখেছো? আর এই যে দুলাভাই শ্বশুড় বাড়িতে এসে কি মানুষ এভাবে ঘরের ভিতর বসে বসে সময় কাটায়? বাড়িতে আরও দু’জন দুলাভাই আছে তাদের সাথে গল্প করে আসেপাশে ঘুরেওতো দেখতে পারেন।

জয় হয়তো এমন কথাবার্তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করছিলো তাই শাকিলকে বললাম তোর দুলাভাইয়ের শরীরটা বেশী ভালো না। তুই যা আমরা আসছি।

শাকিল: সে কি দুলাভাইয়ের কি হয়েছে? ডাক্তার নিয়ে আসতে হবে নাকি?

আরে না না এমনি, তেমন কিছু হয়নি। তুই যা আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি।

শাকিল: আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসো সবাই তোমাদের জন্য বসে রয়েছে, বলতে বলতে শাকিল রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

জয়: তুমি ওকে মিথ্যা কথা বললা কেন?

তাহলে কি আমি ওকে সত্যি কথা বলবো? যে তোর দুলাভাইয়ের আমাকে পছন্দ না। শুধু আমাকে যে পছন্দ না তাও না, আমাদের পুরো পরিবারের কাউকেই তার পছন্দ না।

জয়: দেখো অতিরিক্ত করছো কিন্তু, আমি কখনোই এমনটা বলিনি।

কি আশ্চর্য এখানে অতিরিক্তের কি হলো? আপনি সরাসরি বলেন নাই কিন্তু ইশারায় ঠিকই বুঝিয়েছেন। যাইহোক আমরা এখন তর্ক না করি, যান ফ্রেশ হয়ে আসুন, ডিনার করতে যাবো। না হয় আবার কে ডাকতে চলে আসে তখন আবার আপনাকে বাঁচানোর জন্য আমাকে মিথ্যা বলতে হবে।

জয় চোখ বড় বড় করে খাট থেকে নেমে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। জয়ের দিকে তাকিয়ে আমার প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো বলতে আপনার চোখ রাঙ্গানোতে আমার ভয় লাগে না। অল্প সময়ের ভিতর দু’জন ডাইনিং এ চলে আসলাম।

বড় দুলাভাই: জয়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কি ভাই নতুন বউ রেখে কি ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে হয় না নাকি?

জয়: কি যে বলেন ভাই, আমারতো ঘরে থাকতেই ইচ্ছে করে না। তবুও থাকতে হয়, উপায় নেই। নচিকেতার গানটা শুনেন নাই পুরুষ মানুষ দু’প্রকার জীবিত বিবাহিত। তো আমার হয়েছে সে অবস্থা।

গল্পে গল্পে ডিনারের পর্ব শেষ করে রুমে চলে আসলাম। বিছানা ঠিক করছি আর জয় ব্যালকনিতে যেয়ে সিগারেট জ্বালিয়েছে। বিছানা ঠিক করা হলে আমি এক কর্ণারে যেয়ে শুয়ে পরলাম। টেবিল ল্যামটা জ্বালিয়ে, মাঝে একটা কোল বালিশ দিয়ে। বেশ কিছু সময় পর জয় এসে বিছানায় শুয়ে পরলো। জয় অন্যদিকে চেয়ে শুয়ে রয়েছে আমি জয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছি, তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মসজিদ থেকে আজানের সুর কানে ভেসে আসছে। তাকিয়ে দেখি জয় যেমন করে শুয়ে ছিলো ঠিক তেমন করেই শুয়ে রয়েছে। আমি ওঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

দেখতে দেখতে দু’দিন কেটে গেলো। বিদায় লগ্ন এসে পরেছে। আমার বাবা মা, ভাই বোনদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে ঠিক অপর দিকে এটাও বুঝতে পারছি জয়ের বেশ ভালোই লাগছে, মনে হচ্ছে হাফ ছেড়ে বেঁচে গেছে সে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পেরে। দুপুরে খাবার শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে পরলাম শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে।

গাড়ির লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখছি মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছে, বাবা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের গাড়ির দিকে মুহুর্তেই সবাইকে পেছনে ফেলে গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলছে। দু’ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পরতেই দ্রুত তা মুছে, মানুষটার দিকে চেয়ে দেখি সে ভাবলেশহীন গাড়ি চালাচ্ছে সামনের দিকে তাকিয়ে।

কিছুটা সময় তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম। কতশত লোকজন চলছে নিজের মত করে। কেউ হেঁটে চলছে কেউ রিকশায় আবার কেউ আমাদের মত গাড়িতে। জীবন কত অদ্ভুত স্বামীর পাশের ছিটে বসেও তার সাথে দু’টো ভালোবাসার কথা বলতে পারছি না, অথচ মাত্রই যে রিকশাটাকে পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে লুকিং গ্লাসে চোখ পরতেই দেখতে পেলাম মেয়েটা ছেলেটার বুকে কত শান্তিতে মাথা দিয়ে রেখেছে।

চলবে…