মায়ার বাঁধন পর্ব-০৭

0
194

মায়ার বাঁধন-৭ম পর্ব
©শাহরিয়ার

জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় বাড়িতে চলে আসলো গাড়ি। দু’জন বাড়িতে প্রবেশ করলাম মা বাবাকে সালাম জানালাম। আমাদের দেখে তারা বেশ খুশি হলো।
ফ্রেশ হবার জন্য দু’জন রুমে চলে আসলাম। আমি আগে ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর জয় ফ্রেশ হয়ে বর হয়ে আসলো।

জয়: আমার দিকে তাকিয়ে আমি বাহিরে যাচ্ছি ফিরতে দেরী হবে।

কোথায় যাবেন আপনি এই অসময়ে? মাত্রইতো বাহির থেকে আসলেন।

জয়: আমি কোথায় যাবো সেই কৈফিয়ত নিশ্চই তোমাকে দিবো না।

কি আশ্চর্য আপনি সব কথায় এমন রিয়াক্ট কেন করেন? আমি শুধু জানতে চাইলাম কোথায় যাবেন? বাবা, মা আমার কাছে জানতে চাইলে আমি তাদের কি জবাব দিবো?

জয়: বলে দিবে বাহির গিয়েছে। আর কিছু বলার দরকার নেই।

জয় আর কোন রকম কথা না বলে বের হয়ে গেলো। মন তখন একা একাই বলতো শুরু করলো। “প্রিয়সীর হৃদয়ের তীব্র যন্ত্রনা বুঝে না যে জন। কেমনে বলো তুমি তাকে প্রেমিক? আমিতো বলি সে একজন খুনি।”

মাগরীবের নামাজ শেষ করে ছাঁদে একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছি আর ভাবছি জীবনটা কোথায় থেকে কোথায় এসে দাঁড়ালো, কাকে দোষ দিবো বাবা কে? কিন্তু বাবার কি দোষ? সে কি জয়ের মনের ভিতর ঢুকেছে। কেউ আসলে দোষ কারোর না দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়। সময়ের সাথে সাথে কত কিছুরইতো পরিবর্তন হয়। ভাগ্যে থাকলে জয়ের মনের ও পরিবর্তন হতে পারে।

অনেকটা সময় একা একা হাঁটাহাঁটি করে, সিঁড়ি ধরে দু’তলায় আসতেই মা নিচ থেকে ডাক দিলেন। আমি হেঁটে নিচে ডাইনিং এর সামনে এসে দাঁড়ালাম।

মা: কি ব্যাপার জয় কোথায়? তুমি একা একা ঘুরছো কেন?

উনি কোথায় জানি গিয়েছেন, বললো আসতে একটু দেরী হবে, দরকারি কাজ রয়েছে।

মা: বাবার দিকে তাকিয়ে তোমার ছেলের কি এমন দরকারি কাজ থাকতে পারে বাহিরে? যে নতুন বউ রেখে তাকে সেই কাজ করতে যেতে হবে?

বাবা: আহা আমি কি করে বলবো, হয়তো আছে কোন কাজ, আর আমাকেতো আর বলে যায়নি।

মা: কোন কাজ নেই নিশ্চই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়েছে। আজ আসুক নতুন বউ রেখে বাহিরে আড্ডা দেয়া বের করবো।

মা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে, মা আপনি রাগ করবেন না। যাক না একটু ঘুরে আসুক বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে যদি ভালো লাগে তাহলে তাই করুক। আসলে কাউকে জোর করে ঘরে বন্দি করে রাখাটাও কিন্তু ঠিক নয়। তাছাড়া উনিতো ছোট মানুষ না। যে সব সময় চোখে চোখে রাখবেন। উনি পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষ তাই উনার নিজের মত করে চলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। আপনারা বসুন আমি চা করে নিয়ে আসছি। উনি নেই তাতে কি আমার বাবা মাতো আছে। আমার সময় আরও অনেক বেশী সুন্দর কেটে যাবে। বলেই কিচেন রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

আকাশ বেশ কালো হয়ে এসেছে, জয় বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে, রাত প্রায় দশটা বাজে তাতে তার কিছুই আসে যায় না। বন্ধুদের মাঝে কেউ একজন বলে উঠলো কিরে জয় বাড়ি যাবি না?

জয়: মন চাচ্ছে না আরও কিছুক্ষণ পরে যাবো।

রাজীব: কেন রে ভাবী কি আদর যত্ন করে না, নাকি ভাবীর অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে যে তোকে তারে স্পর্শ করতে দেয় না। দোস্ত এমন হলে কিন্তু তোর জোর করে তাকে আদর করা উচিত কেননা তাতে সেই মজা পাবি।

অমিত: কি যে বলিস না তুই, শুনেছি ওর বউ নাকি খুব কালো, তাকে জোর করার কি আছে? কোথায় আমাদের জয় আর কোথায় ঐ মেয়ে।

রাজীব: বিয়ারের ক্যানে আরেকটা চুমুক দিয়ে? ঢুলঢুল অবস্থয় আচ্ছা বন্ধু তুই কি শারিরিক সম্পর্ক করেছিস? না মানে সে কি ভার্জিন ছিলো নাকি আগেই অন্যকারো সাথে সম্পর্ক করে তোর ঘরে এসেছে?

কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো সবাই। রাগে জয়ের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, জয় রাজীবের কলার ধরে শালা বড্ড বেশী নেশা করে ফেলেছিস, মুখে যা আসবে তাই বলবি নাকি? অন্যর বউকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার আগে নিজের ঘরের বউকে নিয়ে ভাব। তোর বউতো তোকে রেখে প্রতিদিন নানান পার্টিতে এটেন্ড করে। না জানি কত জনার সাথে বিছানায় যায়। সে খবর আগে খুঁজে নে, তারপর না হয় আমার বউ এর কথা বলতে আছিস।

কথাটা বলেই একটা ধাক্কা মেরে রাজীবকে দূরে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো জয়।

সবাই কিছুটা ভয় পেয়ে একদম চুপ হয়ে রইলো। জয় কিছুটা দূরে হেঁটে আসতেই রাজীব বলে উঠলো, ঘরের বউয়ের সাথে পারিস না, এসেছিস আমাদের সাথে লাগতে, আরে বন্ধু দেখে কিছু বললাম না, নয়তো লাশ বানিয়ে ফেলতাম। শালা আমার বউ যেখানেই যাক না কেন? রাতে ঠিকই জায়গা মত এসে আমাকে ঠাণ্ডা করে যায়। আর তোর বউ তোকে ঠাণ্ডা হবার জন্য এই বারে পাঠায় নাকি?

বন্ধুদের এমন ব্যবহার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না জয়। কতটা নিচু মন মানুষিকতার পরিচয় দিচ্ছে ওরা। এতোদিনের বন্ধুত্ব। এতো ভালো বন্ধু ছিলো সবাই আর মুহুর্তেই কেমন জানি সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ভাবতে ভাবতে ঢুলঢুল হয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বুকের ভিতর কেমন অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষ হয়ে ওদের মুখের ভাষা এমন ভাবতেই ঘৃণা লাগছে নিজের কাছে।

ডাইনিং টেবিলে বাবা মাকে খাবার দিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মা: তুমিও খেয়ে নাও।

আপনারা খেয়ে নেন মা, আপনার ছেলে আসলে তাকে নিয়ে আমি খাবো।

মা: ও কখন আসবে তার ঠিক আছে, ততক্ষণ তুমি না খেয়ে থাকবে?

কিছু হবে না মা, আপনারা খেয়ে নিন উনি হয়তো চলে আসবে কিছু ক্ষণেরভিতর। বাবা মা খেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। ডাইনিং এ বসে মাথাটা টেবিলের সাথে লাগিয়ে শুয়ে আছি। নানান রকম চিন্তা করতে করতে অল্প সময়ের ভিতর চোখ লেগে আসলো।

জয়: মাথাটা কেমন বুম বুম করে ঘুরছে, ইচ্ছে করছে সব কিছু তছনছ করে দিতে, গাড়ির স্পীড বাড়িয়েই চলছে। নেশা নেশা চোখ বার বার লেগে আসতে চাচ্ছে। রাগটা যেন মাথায় উঠে গিয়েছে।

হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চোখ মেলে দ্রুত ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে যেয়ে দরজা খুলতেই বাজে একটা গন্ধ এসে নাকে প্রবেশ করে।

জয় কোন কথা না বলে দরজা ঠেঁলে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরে।

উপমা: আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।

জয়: ঢলতে ঢলতে আমার ক্ষুধা নেই, বলেই হাঁটা শুরু করলো।

বুঝতে বাকি রইলো না জয় কিছু একটা নেশা জাতীয় কিছু খেয়ে এসেছে।

ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পরলো জয়।

উপমা: কি হয়েছে আপনার ফ্রেশ হয়ে আসুন, তারপর না হয় ঘুমাবেন যদি শরীর খারাপ লাগে।

জয়: চোখ মেলে তাকায় রক্তের মত লাল টকটকে হয়ে আছে চোখ দু’টো। কিছুটা চিৎকার করে আমার রুম আমি যেমনে খুশি তেমনি করে থাকবো তাতে তোমার কি?

কিছুটা ভয় পেয়ে দেখুন, চিৎকার করবেন না প্লীজ মা বাবা ঘুমাচ্ছে জেগে উঠবে। আর আপনি কি খেয়েছেন? খুব বাজে গন্ধ বের হচ্ছে আপনার মুখ দিয়ে।

জয়: আমি খেয়ে এসেছি তার কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে? আর যা খেয়েছি বেশ করেছি, তোমার জন্যই খেয়েছি। তোমার জন্যতো কোথাও মুখ দেখাকে পারছি না। আজ বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে কাল অফিসে গেলে সেখানেও মানুষজন হাসাহাসি করবে। কোথাও আর মুখ দেখাতে পারবো বলে মনে হয়না। কি পাপ যে করেছিলাম জীবনে আল্লাহ জানে যার জন্য আমাকে সব খানে ছোট হতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে বহুদূর চলে যেতে।

দেখুন, আপনি আপনার বাবা মায়ের সাথে যদি বিয়ের আগেই কথা বলতেন তাহলে হয়তো আপনাকে কোথাও ছোট হতে হতো না।

জয় আর কোন কথা বলছে না, ঘুমিয়ে পরেছে।

উপমা নিচে নেমে ডাইনিং এ থাকা খাবার গুলো সব গুছিয়ে রেখে আবার উপরে উঠে গেলো। ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে। জয়ের পায়ে থাকা সু খুলে দিলো, জামা কাপড় আস্তে আস্তে সব খুলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে সমস্ত শরীর মুছে দিয়ে ঘরের লাইট অফ করে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে নিরবে দু’চোখের পানি ছেড়ে দিলো।

সকালে ফজরের নামাজ শেষ করে মুনাজাতে আল্লাহ কাছে জয়ের হৃদয় নরম করে দেবার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা চাইলো। এরপর ঘর ছেড়ে কিচেনে যেয়ে সবার জন্য নাস্তার তৈরি করতে শুরু করলো। নাস্তা তৈরি হতেই মা কিচেনে আসলো।

মা: কিরে মা তুই এতো তাড়াতাড়ি উঠেছিস। আর তোকে নাস্তা বানাতে হবে কেন? আমিইতো নাস্তা বানাতাম।

কেন মা আমি বানালে কি কোন সমস্যা, আমি যতদিন এ বাড়িতে আছি, এখন থেকে আমিই নাস্তা বানাবো। আপনারা এখন থেকে আরাম করবেন। আপনাদের এখন আরাম করার বয়স।

মা: শোন পাগলী মেয়ের কথা যতদিন আছি মানে কি? দোয়া করি আল্লাহ তোকে দীর্ঘায়ু করুক। আর সারা জীবন আমার ছেলের সাথে সুখে শান্তিতে সংসার কর।

মায়ের কথায় চোখের কোনে জল জমে এলো। তাকে যে বলতে পারছি না, তার ছেলে আমাকে দেখতে পারে না। আমি অল্প কিছু দিনের মেহমান এ বাড়িতে।

চলবে…