মায়ার বাঁধন পর্ব-০৮

0
202

মায়ার বাঁধন-৮ম পর্ব
©শাহরিয়ার

মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিয়ে, মাকে বললাম আপনি ডাইনিং এ বসুন আমি সব রেডি করে দিচ্ছি।

মা: না এখন বসবো না, আগে যেয়ে তোমার বাবাকে উঠতে বলি, তারপর সবাই এক সাথেই নাস্তা করতে বলবো। তুমিও সব গুছিয়ে জয়কে উঠতে বলো।

আচ্ছা মা ঠিক আছে, মা চলে গেলো। ডাইনিং এ সব নাস্তা সুন্দর করে সাজিয়ে উপরে রুমে চলে আসলাম। জয় ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি তার খুব কাছে যেয়ে ডাক দিলাম শুনছেন? বেশ কয়েকবার ডাক দেবার পর জয় চোখ মেলে তাকালো, উঠেন সকাল হয়েছে, মা বাবা রেডি হয়ে ডাইনিং এ যেতে বললো।

জয়: বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে একি আমার গায়ের শার্ট কোথায়?

রাতে আপনি জামা কাপড় জুতা সব পরেই শুয়ে পরেছিলেন তাই আমি খুলে দিয়েছি।

জয়: কি! তোমাকে না বলেছিলাম আমাকে স্পর্শ করবে না? তারপরেও কেন তুমি আমার শরীরে হাত দিয়েছো?

দেখুন আমার কোন ইচ্ছেই ছিলো না যে আপনার শরীরে হাত দিবো। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছে আপনার শরীরে হাত দিতে। একটা মানুষ নেশা করে এসে পায়ে জুতা, শরীরে দূর্গন্ধ যুক্ত জামা পরে পাশে শুয়ে থাকলে নিশ্চই তার পাশে ঘুমানো সম্ভব না। তাই ইচ্ছে না থাকলেও খুলে দিতে বাধ্য হয়েছি। আমি ঐসব বিষয়ে এখন কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন নাস্তার টেবিলে যেতে হবে।

জয় আর কোন কথা বললো না, তবে মনে হচ্ছে গতরাতের ব্যাপারে সে কিছুটা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করেই ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ওয়াশ রুম থেকে রেডি হয়ে বের হতেই দু’জন নাস্তার জন্য নিচে নেমে আসলাম। বাবা মা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলো। সবাই মিলে এক সাথে নাস্তার টেবিলে বসলাম।

বাবা: নাস্তা করতে করতে তোরা কোথাই থেকে ঘুরে আয় এক সাথে ভালো লাগবে। এ ভাবে বাড়িতে থাকতেও তো খারাপ লাগে।

জয়: বাবা হাতে সময় কম এই অল্প সময়ে কোথায় যাবো? দুই তিন দিন পর থেকে আবার অফিসে যেতে হবে।

মা: তোর বড় খালা ফোন দিয়েছিলো, বললো তোকে আর উপমাকে যেয়ে ঘুরে আসার জন্য।

জয়: মা গ্রামের বাড়ি আমার ভালো লাগে না।

বাবা: আরে গ্রামের বাড়ির মত সুন্দর জায়গা আর আছে নাকি? চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ বিশুদ্ধ বাতাসে মুহুর্তেই মন ভালো হয়ে যায়।

জয়: কিন্তু আমারতো ভালো লাগে না।

মা: আগে ভালো লাগতো না একা ছিলি, কিন্তু এখন তো বউ আছে। আর তাছাড়া আমি তোর বড় খালাকে বলে দিয়েছি তোরা আজই গ্রামে যাবি।

জয়: কিন্তু মা এটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি আমার সাথে কথা না বলে খালাকে তোমার কথা দেয়া।

মা: ও তাহলে আমাদের কথার কোন মূল্য নেই? এখন তোর কাছ থেকে জেনে তারপর সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে?

জয়: আহা মা তুমি এমন করে কেন বলছো? আমি কি তা বলছি? আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি। এখনতো আগে শান্তিমত নাস্তাটা খেতে দিবা।

মা: আচ্ছা খা, আমার দিকে তাকিয়ে তুমি যেয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নাও। ইস আমিও যদি যেতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। কতদিন গ্রামের বাড়িতে যাই না।

চলুন না মা আপনিও যাবেন আমাদের সাথে।

মা: আরে না না বাড়ি ফাকা রেখে যাওয়া যাবে না। এবার তোমরা যেয়ে ঘুরে আসো। তোমরা আসলে পরে আমরা যাবো। ঐখানে যাবার পর দেখবা তোমার আর আসতেই ইচ্ছে করবে না। কত সুন্দর চারিদিক, সবুজ ধান ক্ষেত, পুকুর ছাঁয়া শ্যামল সোনার বাংলা মানেই হলো গ্রাম। আর আমাদের বাড়ি হলো জমিদার বাড়ি। যদিও জমিদারি নাই সে কবেই জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছো। তাতে কি সে বাড়িতো আছে। তুমি গেলেই দেখবে বাড়ির সুন্দর্য দেখলেই তোমার চোখ জুড়িয়ে আসবে। বিশাল বড় শান বাঁধানো পুকুরঘাট। বড় বড় নারকেল গাছ। সারিবন্ধ সুপারি গাছ। দু’তলার জানালা খুলে দিলে কি এক প্রশান্তির হাওয়া এসে শরীর মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

বাবা: আহা সব যদি তুমি এখানেই বলে দাও তাহলে মেয়েটা যেয়ে কি উপভোগ করবে?

মা: হ্যাঁ তাইতো আমি ও কি বোকার মত সব বলতে শুরু করেছি। আসলে শৈশবের স্মৃতি মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। যাই হোক তোমরা সেখানে গেলেই সব দেখতে পারবে বুঝতে পারবে।

কথা বলতে বলতে নাস্তার পর্ব শেষ করে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে পরলাম। ঘরে এসে ব্যাগে জামা কাপড় গুছাতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরেই জয় চলে আসলো। আপনার জন্য কোন কোন জামা নিবো?

জয়: আমি দিচ্ছি, বলে জয় নিজের কাপড় নিজেই এগিয়ে দিলো। আমি তা ব্যাগে ভরে নিলাম। ঘন্টা খানেকের ভিতর দু’জন রেডি হয়ে গেলাম।

আমার কখনো গ্রামে যাওয়া হয়নি। গ্রাম আমাকে অন্য রকম ভাবে আকর্শন করছে। আমি খুবি আনন্দিত। কিন্তু মনে মনে ভয় ও পাচ্ছি, কেননা মানুষটা আমাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। যদি গ্রামে যেয়ে মানুষের সামনে খারাপ ব্যবহার অথবা চিৎকার চেচামেচি করে তখন কি একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে?

ভাবনার দুনিয়া থেকে ফেরৎ আসলাম জয়ের কথায়।

জয়: শোন তোমাকে একটা কথা বলি, ঐখানে যেয়ে কোন রকম উল্টা পাল্টা কথা বলবে না। যাতে করে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।

মনে মনে ভাবলাম যাক ভালোই হলো আমিতো উল্টা পাল্টা বলি না, সে নিজেই বলে করে আর উল্টা আমাকে বলতে এসেছে। তবুও মাথা নাড়িয়ে বললাম ঠিক আছে।

এরপর জয় নিজেই ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো চলো। আমি জয়কে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলাম। নিচে নেমে এসে বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মা কিছু একটা সূরা পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলাম। জয় গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমি কোন রকম কথা না বলে চুপ করে তার পাশে বসে রইলাম। সে এক মনে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি আস্তে করে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিলাম। মুহুর্তে ফুরফুরে সতেজ বাতাস এসে মুখে লাগলো। বাতাসে খোলা চুল গুলো উড়তে শুরু করলো। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম।

অনেক লম্বা জার্নি এভাবে কি করে একটা মানুষ চুপ করে বসে থাকতে পারে আমি এটাই ভেবে পাচ্ছি না। সে কথা না বললে আমিও কিছু বলতে পারছি না। কেননা আমার কোন কথায় কখন সে রেগে যায় বলা যায় না। যে কয়টা দিন আছি না হয় তার মনের মতই থাকার চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ আমার ভাগ্যে বিচ্ছেদই লেখে রাখেন। তবে নিশ্চই তাতে আমার জন্য ভালো কিছুই রেখেছেন তিনি। তিনিতো তার সকল বান্দার মনের সকল কথাই জানেন।

দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙে জয় প্রশ্ন করলো,

জয়: আচ্ছা তোমার সম্পর্কে কিছু বলো? না আসলে এভাবে চুপ করে বসে থাকলে গাড়ি এগিয়ে চলছে কিনা বুঝতে পারবো না। তাছাড়া একজন আরেক জনের সম্পর্কে না হয় কিছু জানা শোনা হয়ে যাবে এটাও মন্দ কিসের?

আমার সম্পর্কে আসলে বলার মত কিছুই নেই।

জয়: তোমার ছোট বেলা, তোমার বন্ধু মহল, প্রেম ভালোবাসা, তোমার পছন্দ অপছন্দ এসব বিষয়ে বলো। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে এভাবে দু’জন যদি চুপ করে থাকি তাহলে কারোরই ভালো লাগবে না। মনে করো আমি তোমার একজন নতুন বন্ধু, আর আমাকে তোমার জীবনের গল্প বলবে।

ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার ছোট বেলা ছিলো এই রকম। আমি খুব কালো ছিলাম, যার কারণে তেমন কোন বান্ধবি হয়নি। আমি একা একা বেঞ্চে বসতাম। যদি কখনো কেউ বসার জায়গা না পেতো তবেই আমার পাশে বসতো। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো তারপর বুঝতে পারলাম আসলে আমার গায়ের রঙটাই মানুষের কাছে আসল। তাই যারা সুন্দর তারা আমাকে পছন্দ করতে চায় না। যখন স্কুল শেষে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসতাম, তখন বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো হতাশ হতে নেই, নিজের চেহারা নিয়ে মন খারাপ করতে নেই, কেননা আল্লাহ তার সকল বান্দাকে নিজ নিজ গুনে আর রূপে বানিয়েছেন। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের কালো রূপেই এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বাবার কথায় কেমন জানি যাদু ছিলো। সত্যি নাকি মিথ্যা না বুঝলেও এটা বুঝতাম বাবার কথায় কেমন জানি মুহুর্তে মন ভালো হয়ে যেতো।

প্রতিদিন ফজরে উঠতাম, শুধু যে আমি উঠতাম তাও না, পরিবারের সকলেই উঠতাম। বাবা মা আমাদের সব ভাই বোনদের এক সাথে নিয়ে নামাজ পড়তেন। তারপর মা বাবা দু’জন মিলে আমাদের কুরআন তেলোয়াত শিখাতেন সেই সাথে তার অর্থ পড়ে পড়ে বুঝাতেন। একটা সময় যখন কুরআন আর অর্থ বুঝতে শিখলাম তখন থেকে আর নিজের চেহারা নিয়ে তেমন একটা মন খারাপ হতো না। বরং নিজেকে সত্যি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী মনে হতো। কেননা, প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “পৃথিবী মুমিনের জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত।” (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১১৩)। এছাড়াও, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “যারা ইমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাকারা : ৮২)।

চলবে…