মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-১২

0
47

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – বারো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের বুক ছিঁড়ে লাল টুকটুকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে পূব আকাশে। ধীরেধীরে অন্ধকার ছাড়িয়ে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। সুন্দর, ঝকঝকে এক পরিচ্ছন্ন সকালকে উপভোগ করতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে ফারশাদ। বুকভরে শ্বাস নিচ্ছে। আজ প্রতিটা নিঃশ্বাসও সুখের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেন, কে জানে! গতকাল রাতের কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ভর করল। উসাইদ বিয়ের ব্যাপারে পজেটিভ বা নেগেটিভ কোনো সিদ্ধান্ত না জানালেও মোরশেদ জামান তাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলেন,

-‘তোমার সাহস, সততা ও সরল স্বীকারোক্তি শোনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। মনে সাহস রেখো আর জবানকে ঠিক রেখো, নিশ্চয়ই সমাধান একটা হয়ে যাবে।’

বাবা সমতুল্য এই মানুষটার কথাতে কীযে শান্তি পেয়েছিল ফারশাদ, তা যদি কাউকে বলে বোঝাতে পারত, তাহলে কেউ সহজেই বুঝে যেত, ভেতর জুড়ে আনন্দেরা মিছিল জমিয়েছিল তখন। হাজারও সুখপাখিদের ভীড় জমেছিল মনের অন্দরে। সে নিজেও ভদ্রলোককে ভরসা দিয়ে বলেছিল,

-‘শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার এই সিদ্ধান্তে আমি স্থির থাকব, ইনশা’আল্লাহ্।’

এতে করে উসাইদের চোখে যে বিস্ময় নেমে এসেছিল, সেটা দেখার মতো ছিল। এরপর সে সবাইকে বলেছে, উজমাকে যা বলার, সেটা সে নিজেই বলবে। আগ বাড়িয়ে কেউ যেন, কিচ্ছুটি না জানায়। তাতে সবাই সায় দিয়েছে। উসাইদও বলেছে,

-‘তুই দেখে নিস, উজমা কোনোদিন সম্মতি দিবে না।’

ফারশাদ একটু চিন্তিতমন নিয়ে বলেছিল,
-‘তোর বোনের মন জয় করার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। যদিও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে ম্যানেজ করে নেব। তবে তার আগে, তোর বোনকে দিয়ে সম্মতিটা ঠিকই আদায় করে নিব।’

উজমা কতটা শক্ত মনের মানুষ ও কতটা আত্মসম্মানী সেটা উসাইদ জানে। আর তাই বন্ধুর এই কথা শোনে বলল,
-‘জেদ দেখিয়ে আদায় করবি বুঝি?’

-‘না…। ভালোবাসায় জেদ চলে না। এক্ষেত্রে জেদ নয়, ভালোবাসাই হচ্ছে মোক্ষম ট্রিটমেন্ট। আমি ভালোবেসেই তোর বোনের মন ছোঁবো। প্রমিস…।’

আবেগটা যত সহজে ফারশাদ প্রকাশ করেছিল, আদতে তা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। কীভাবে যে এই কঠিন মেয়ের মনের ভেতর নিজের নামের একটুকরো সিল মারতে পারবে, সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে সে। এই ক’দিনে উজমাকে যেমন দেখেছে, তাতে এটাই মনে হয়েছে, এই মেয়েটার মন একদম পাথরের তৈরী। সাধারণ কোনো বিষয় নিয়ে মেয়েরা যেভাবে ছিঁচকাঁদুনে রূপে নিজেদের আবৃত করে নেয়, সেখানে উজমা একদমই অন্যরকম। ভেতর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও মুখফুটে বলে না তার কষ্ট হচ্ছে। এমন আকাশ-পাতাল ভাবনায় ছেদ পড়ল বাইরের গেইটের আওয়াজে। উপর থেকেই নিজে দৃষ্টি দিয়ে দেখল, বাড়ির ভেতরে পা রেখেছে তার মনপাখি। পরনে নীল রঙের চুরিদার, জামার ওপর হুডি আবার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ও অ্যাপ্রোন। পায়ে স্নিকার্স স্যু। সাদামাটা সাজপোশাকের এই উজমাকে দেখে প্রথমদিনের মতোই সাতরঙা রংধনুর মতো রঙিন হয়ে উঠল তার চারপাশ। সেই গোধূলির রঙে রাঙা শেষবিকেলের একটা মায়াবী মুখ, কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের আঁধারে একজোড়া জল টলমল চোখ, হিমশীতল সকাল ও সোনালী রোদ্দুরের ফাঁকে মায়াভরা হাসি, প্রতিবাদী মেজাজ, রাগ-দম্ভ, জ্বলন্ত চোখ ও নিজেকে ভালোবাসতে জানা নানান রূপের মিশেলে থাকা এক রূপবতী, গুণবতী, মায়াবতী, সাহসী ও সুন্দর মনের একটা নারী। যার সবকিছু এত সুন্দর, তাকে ঠিক কীসের সাথে তুলনা করলে তার সৌন্দর্যকে যথেষ্ট প্রশংসা করা হবে, ফারশাদ তা নিজেও জানে না। উজমার সৌন্দর্যের তুলনা কোনোকিছুর সাথেই হয় না। এই মেয়েটা নিজ গুণে গুণান্বিত বলেই হয়তো, চট করে তা চোখের লাগার সাথে সাথে মনেও জায়গা করে নেয়। এই অনিন্দ্য সুন্দর মেয়েটাকে ভালোবাসতে পেরে নিজেকেই তার ভাগ্যবানদের একজন মনে হচ্ছে। যার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ে, মন বেসামাল হয়ে যায়, একফালি রোদ্দুর এসে মনের আঙিনায় রংবেরঙের সুগন্ধি ফুল ফুটিয়ে মাতাল হাওয়ার মতোন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায়, ‘তুমি ডুবেছ, হেরেছ, মরেছ, মন হারিয়েছ। কোথায় গেলে এই হারিয়ে যাওয়া, হেরে যাওয়া, ডুবে যাওয়া মনকে ফিরে পাবে আবার?’

কিছু অস্থির ভাবনায় ডুবে গিয়ে, মায়াবী মেয়েটার মায়ায় একটু একটু করে অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল ফারশাদ। মনে মনে হিসাব কষছিল, কীভাবে এই মেয়েটার মনে নিজের নামের বীজ বপন করে, ভালোবাসি বলে সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী করবে, সেইসব গড়মিল হিসাবের মাঝে আচমকাই বুকের ভেতরটায় কেমন করে মোচড় দিল তার। মনের কোথাও চিনচিনে ব্যথাদের জন্ম হলো। এই নিষ্পাপ মুখ দেখে কে বলবে, মেয়েটার সাথে অবুঝ বয়সে কী হয়েছে। অতীত দৃশ্য তা তো নিজে দেখেনি ফারশাদ, কিন্তু উপলব্ধি করতে গিয়েই আনমনে বিড়বিড়িয়ে উঠল,

-‘যে পবিত্র মন ও শরীরে আমার মা অপমানের চিহ্ন এঁকেছে, সেইসব অপমান একদিন আমি ঠিকই মুছে দেব, বাটারফ্লাই।’

***

ঘরে এসে ব্যাগপত্র রেখে, ফ্রেশ হয়ে, রান্নাঘরে গেল উজমা। ঊষা চুলোয় চা বসিয়েছে সবে। বোনকে দেখে হাসি হাসি মুখ নিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,

-‘তুমি বোসো। আমি নাশতা তৈরী করছি।’

মাঝেমধ্যে বোনের প্রতি খুব বেশি ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে ঊষা এমন আদুরে কাজকর্ম করে। উজমা সেটা আন্দাজ করে নিল মুহূর্তেই। বলল,

-‘খুশির কারণটা কী শুনি?’

মুখভরা হাসি নিয়ে বোনকে আলতোহাতে জড়িয়ে ধরল ঊষা। বলল,
-‘কত কারণই তো থাকতে পারে। তাছাড়া, কারণ না থাকলে বুঝি চা-নাশতা তৈরী করতে নেই?’

-‘তুমি তো আর এমনি-এমনি এখানে আসোনি, সোনা। তোমাকে আমি হাড়েমজ্জায় চিনি।’

একটু আদর-আহ্লাদ দেখি উজমা ফের বলল,
-‘দেখি সর। ভাইয়ার ঘুম ভেঙেছে কি-না দেখে আয়।’

ঊষা সরে যাওয়ার নামই নিল না। আঠার মতো চিপকে থেকে বলল,
-‘ভাইয়া ঘুমোচ্ছে।’

-‘তোকে যেতে বলেছি।’

-‘যাব না। আমি তোমার পাশেই থাকব।’

-‘কেন? আজ এত ভাব-ভালোবাসা কেন?’

ঊষার ঠোঁটের হাসি মুছে গেল নিমিষেই। এই বোনটাকে সে কোনোদিন তারমতো করে বোঝার চেষ্টা করেনি। এইযে, এত কথাবার্তা ও লোকজনের অপমান, এসব শোনেও কীভাবে পারে টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যেতে! ঊষার বড্ড ভয় হয়, বোন তার সুখের মুখ দেখবে তো কোনোদিন? সে ভয়ভীতি মনে পুষে রেখেই বলল,

-‘শামীম ভাইয়া কী বুঝে তোমাকে অপমানজনক কথাবার্তা বলল, আপু?’

ঊষার কথা খুব একটা আমলে নিল না উজমা। বলল,
-‘জানি না, কেন?’

-‘এমনি। তোমার আর আমার বয়সের ব্যবধান কতটুকু?’

-‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন, ঊষা? এটা কি তুই জানিস না?’

-‘না, মানে…। আমরা যখন ভাড়াবাসায় থাকতাম, তখন তো আমি অনেক ছোটো, তাই না?’

-‘হুম…। হঠাৎ এই কথা?’

-‘ওই বাসাতে তোমার অনেক স্মৃতি ছিল, সেসব কি মনে পড়ে?’

একদৃষ্টিতে বোনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল উজমা। জবাব দিল না। ঊষা বলল,
-‘শামীম ভাইয়া বলছিল না, ওখানে তোমার সাথে খুব খারাপ কিছু হয়েছে? কী হয়েছিল, আপু? আমার তো কিছু মনে নেই। আমি তো কিছুই জানি না।’

হঠাৎ করে ঊষা কেন এসব জানতে চাইছে, বুঝতে পারল না উজমা। সে ব্যস্ত হাতে নাশতা তৈরী করায় মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঊষা বলল,

-‘আমার না ওই বাসার সব স্মৃতি মনে নেই। শুধু মনে আছে, তাক্বদীম ভাইয়ার মায়ের সাথে তোমার একটা চমৎকার সম্পর্ক ছিল। আন্টিও তোমাকে খুব পছন্দ করতেন। আহ্, সেইসব দিনের কথা মনে হলেই আমার তো আবারও ওখানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আন্টির আদর নিতে ইচ্ছে করে।’

মেকী হাসির আড়ালে উজমা নিজের দুঃখ আগলে নিয়ে বলল,
-‘যা তাহলে। কেউ তো বারণ করেনি। আন্টি তোর জন্য রোজ পথচেয়ে থাকেন…।’

ইচ্ছে করেই উজমা একটু লাগিয়ে-বাজিয়ে বলল। ঊষা মুখ বাঁকাল সেই কথা শোনে। বলল,
-‘এ্যাহ, মিথ্যে কথা।’

-‘না, একদম সত্যি। আন্টিকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে, যা। খামোখা কাজে বিরক্ত করিস না। এমনিতেই মেজাজের অবস্থা ভালো না।’

ঊষা এতক্ষণ পর খেয়াল করল, আসলেই উজমার মেজাজ ভালো না। কেমন একটা রাগ-ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে চেহারায়। সে অবাক হয়ে বলল,

-‘কেন? তোমার আবার কী হলো?’

মেজাজ খারাপ হওয়ার মতোই ঘটনা ঘটেছে উজমার সাথে। হসপিটালের ডিউটি শেষে বাড়ির ফেরার পথে সিএনজিতে আরোহন করেছিল সে। পাশে একজন পুরুষও ছিল। যেহেতু শীতের সকাল, মানুষজনের যাতায়াত কম, গাড়ি-ঘোড়া যুতসই পাওয়া যায় না। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে চট করে সেই সিএনজিতেই উঠেছিল। হসপিটাল থেকে চলতে শুরু করার পরপরই পাশে বসা পঞ্চাশোর্ধ এক লোক, ইচ্ছে করেই উজমার গা ঘেঁষে বসতে চেষ্টা করছিল। প্রথমবার ব্যাপারটা ভুল হিসেবেই দেখেছে উজমা। দ্বিতীয়বার ধাক্কা লাগাতে বলেছিল,

-‘একটু সরে বসবেন, প্লিজ।’

লোকটা সামান্যই সরেছিল। এরপর আবারও গা ঘেঁষে একেবারে পায়ে হাত দিল। প্রথমস্পর্শে উজমা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল,

-‘হাতটা সরান।’

লোকটা হাত সরায়নি উলটে চলন্তগাড়ির মধ্যে জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। হাতের নড়াচড়া তখন এলোমেলো লোকটার। রাগে, অপমানে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে দু’হাতে ধাক্কা মেরে লোকটাকে সরিয়ে ড্রাইভারকে বলে সামনে যে গ্যাসপাম্প ছিল, তার কাছাকাছি গাড়ি থামিয়ে কলার ধরে অসভ্য, অভদ্র লোকটাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে পায়ের জুতো খুলে বেশ কয়েকটা কেলানি দেয়ার পর মুখের ওপর থুতু ছুঁড়ে বলেছিল,

-‘আপনি আমার বাবার বয়েসী। আপনাকে আমার সম্মান করার কথা। কিন্তু বাধ্য হলাম, আজ এইভাবে জনসম্মুখে বাবার মতো এক জানোয়ারের গায়ে হাত তুলতে। আপনার মতো পুরুষ ও নারী, উভয়ই এই সমাজটাকে ধ্বংসের জন্য দায়ী।’

আশেপাশের অসংখ্য মানুষ, যারা সকালে কাজে বের হয়, হাঁটতে বের হয়, তারা ছুটে এলো। ড্রাইভার বেচারা এতক্ষণ হতভম্ব ছিল। সে বুঝতেই পারেনি কী হয়েছে। মানুষজন একত্রিত হওয়ার পর উজমা বিচ্ছিরি ঘটনাটা শেয়ার করলে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে অন্য আরেকটা সিএনজি থামিয়ে উজমাকে সেটায় তুলে দিয়ে বলেছিলেন,

-‘তুমি যাও, মা। সাবধানে যেও।’

মহিলাটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিয়েছিল উজমা। সিএনজি চলতে শুরু করলে সে মুখ বের করে গ্যাসপাম্পের দিকে তাকিয়ে দেখল, ততক্ষণে ওখানে থাকা কিছু সাহসী বাবা ও ভাই, অসভ্য লোকটার দফারফা ঘটিয়ে দিচ্ছে।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা বোনের সামনে পূণরায় শেয়ার করার পর ঊষা বলল,
-‘তুমি এই চাকরিটা ছেড়ে দাও। দরকার নেই এভাবে দিনেরাতে ছোটাছুটি করার।’

যারপরনাই বিরক্ত হয়ে উজমা বলল,
-‘আমি চাকরিটা শখের বশে করছি না। প্রথমে প্রয়োজন ছিল বলে করেছি, এখন মায়ায় পড়েছি। চাইলেও এই দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারব না।’

-‘তাইবলে নিজের দিকে তাকাবে না একবার?’

-‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’

-‘চাকরির তো দরকার নেই এখন। তবুও কেন করবে?’

-‘দরকার আছে কি নেই, সেটা আমি দেখব। তুই যা তো। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। এমনিতেই ঠাণ্ডা ঠেলে এসেছি।’

চট করে ‘ওহ’ উচ্চারণ করে চায়ের দিকে নজর দিল ঊষা। উজমা একটা ঝাড়ু হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ ঘরদোর পরিষ্কার করা শুরু করল। ঘর ঝাড়ু দেয়া শেষে উঠোনে গেল। ঝরেপড়া শুকনো পাতা ও ডালপালা সবকিছু সরিয়ে উঠোন পরিষ্কার করে, বাড়ির সীমানায় থাকা বড়ো গর্তের মধ্যে আবর্জনা রেখে ঝুড়ি হাতে ফিরে আসার পথেই ছাদে চোখ গেল। কয়েক সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময়ে উজমা অস্বস্তিতে পড়লেও ফারশাদ হাসিমুখে বলল,

-‘গুড মর্নিং।’

বিনিময়ে শুধু একটু হাসলোই উজমা। এরপর আর দাঁড়াল না। এই ছেলের দৃষ্টিটা ঠিক ভালো লাগছে না। আবার সন্দেহজনকও না। পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি খুব সহজেই চেনা যায়, কিন্তু এই দৃষ্টি অন্যরকম। একদম ভাবিয়ে তুলে। ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। সবকিছুর ভরাডুবি খুব করে বুঝতে পারে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সর্বনাশ হবে নিশ্চিত ভেবে ঘরে চলে এলো।

***

সকাল দশটায় কিছু খরচপাতি কেনার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল উসাইদ। মিশকাতের অসুস্থতা বলে অফিস থেকে আগেভাগে ছুটি নিয়েছে। খরচপাতি ঘরে যা ছিল, তা ফুরিয়ে এসেছে। কী কী লাগবে, একটা লিস্ট করে তারপরই বেরিয়েছে সে। শামীমের বাবা খবর দেয়াতে সেখানে চলে গেছেন মোরশেদ জামান। ফারশাদ কোথাও যায়নি। কোনোকিছুই তার ভালো লাগছে না। দুপুরের পর যদি পারে, তাহলে তাহমীদকে খুঁজতে যাবে। আজ সকাল থেকে যতবার উজমাকে দেখছে, ততবারই বিষণ্ণতা, মন খারাপ এসে ভর করছে অস্তিত্বে। ভালোবাসা এত কষ্ট সেটা যদি আগে বুঝত! এসব ভাবতে গিয়ে ফারিশার কথা মনে হলেই আরও অস্থির লাগে তার। সবমিলিয়ে পুরো সকালটাই তার কাছে তেতো হয়ে গেল। কোনোমতে নাশতাপানি গিলে, উসমান ওয়াজেদের সাথে টুকটাক গল্পে সময় কাটানোর চেষ্টা করল।

নাশতার পরবর্তী সময় থেকেই মিশকাতের দিকে নজর দিচ্ছে উজমা। মেয়েটা ঠোঁটে ঠোঁট চাপছে আর কোমরে চাপ দিচ্ছে। মিনারা খাতুনের পাশে বসে গল্প করলেও তার কোনো মনোযোগই নেই। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। সন্দিহান মন নিয়েই মিশকাতের কাছে ছুটে এলো উজমা। হাত ধরে বলল,

-‘কী হয়েছে, ভাবী? এমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?’

মিশকাতের শরীর ঘেমে যাচ্ছে। উজমা তার অস্থিরতা বুঝতে পেরে পরনের সোয়েটার খুলে রাখল। মিশকাত কোনোমতে উচ্চারণ করল,

-‘সকাল থেকে কোমর ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। কিছুক্ষণ পরপরই ব্যথাটা আসছে।’

-‘তুমি এটা এখন বলছ? ঊষা, ভাইয়াকে ফোন কর। তাড়াতাড়ি।’

উজমার মনে হলো আর দেরী করা চলে না। সে রান্নাবান্নার কাজ ফেলে রেখে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে কল করে অ্যাম্বুলেন্স আনার ব্যবস্থা করল। এরপর উসাইদকে কল করতে গিয়ে দেখল, তার ফোন বন্ধ। দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল উজমা। দেরী করলে যে কী সর্বনাশ হবে, সেটা আন্দাজ করেই মিনারা খাতুনকে বলল,

-‘মামীমা, তুমি তৈরী হও। ভাবীকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। এখানে রেখে কোনো সুবিধা হবে না। উলটে, বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।’

মিনারা খাতুন তা-ই করলেন। মিশকাতের চোখমুখ দেখেই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, শরীরের অবস্থা কী। লজ্জায় মিশকাত তাকে কিছু বলেনি। এড়িয়ে গেছে। এই সময়ে এসেও মেয়েটা লজ্জাকে প্রশ্রয় দিল দেখে, তাঁর খারাপ লাগল। নিজের মা নয় বলেই হয়তো, লজ্জা পাচ্ছিল মেয়েটা। মুখফুটে বলতে পারছিল না, তার শরীর খারাপ লাগছে। উজমার কথায় সবকিছু গুছানো শুরু করলেন তিনি। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল। ঊষা গেইট খুলে দিলে, সরাসরি সেটা উঠোনে এসে দাঁড়াল। উজমা একাধারে ভাইকে কল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠল, কিন্তু কোনোভাবেই উসাইদকে ফোনে পাওয়া গেল না। এরপর মামাকে জানালে, তিনি খুব তাড়াতাড়ি আসছেন বলার পরও দুঃশ্চিন্তায় দিক হারাতে শুরু করল উজমা। সঙ্গে পুরুষ মানুষ কেউ না থাকলে, কীভাবে! সে ঝটপট অনিক, তাক্বদীম ও কাইফকে জানাতে গিয়ে শুনল, অনিক অলরেডি শায়েস্তাগঞ্জ ও কাইফ ঢাকায়। যাদের রক্তের সাথে মিশকাতের রক্তের গ্রুপ মিলে, তাদের কেউ-ই শহরে নেই। উজমার মনে হলো, এক্ষুণি সে কেঁদে দেখে ফেলবে। কিন্তু না। নিজেকে খুব করে শক্ত রেখে তাক্বদীমকে বলল,

-‘যত তাড়াতাড়ি পারিস, ডোনার জোগাড় করে হসপিটালে আয়, প্লিজ।’

প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে, সবকিছু ব্যাগে গুছিয়ে নিয়েছেন মিনারা খাতুন। সেসব অ্যাম্বুলেন্সে তোলা শেষ। ঊষা শেষ আরও দু’বার উসাইদের নম্বরে কল দিল, তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। ফোন যে বন্ধ হয়েছে, খোলারই নাম নিচ্ছে না। ভয়-ডর সব পিছনে ফেলে ঊষাকে বাবার কাছে রেখে মিনারা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে মিশকাতকে গাড়িতে তুলল উজমা। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে খেয়াল করল, ফারশাদও সামনের সিটে বসেছে। উজমার অবাক করা দৃষ্টি দেখে ফারশাদ নিজেই বলল,

-‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। উসাইদ এলে আমি বাড়ি চলে আসব। ও কখন আসবে কে জানে। এরকম সিচুয়েশনে বসে থাকা উচিত না। তাছাড়া পুরুষ মানুষ কেউ না থাকলে…।’

উজমা এতকিছু শুনল না, ভাবলও না। শুধু বলল,
-‘থ্যাংক ইউ।’

ডোর আটকানোর আগে ঊষাকে বলল,
-‘বাবাকে দেখে রাখিস।’

ঊষা মনে সাহস রাখল। ভাইকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। এত কঠিন সময়ে এসে কারও ফোন বন্ধ দেখলে যে কেমন ভয় লাগে, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝে না। সে মাথা নেড়ে লাগাতার কল দিয়ে গেল, উসাইদের নম্বরে। ওপাশ থেকে একটাই বাক্য ভেসে,

-‘দ্য নম্বর ইউ আর ট্রায়িং টু কল ইজ নট রিচেবেল।’

দুঃশ্চিন্তা, বেদনা সবকিছুকে সঙ্গে নিয়ে বোন ও ভাবীকে বিদায় দিল ঊষা। মিশকাত ছটফট করছে আর বকছে,
-‘তোর ভাইকে কল কর, উজমা। তাড়াতাড়ি আসতে বল। উফফ, আল্লাহ। এত কষ্ট…।’

ব্যথা যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, দু’হাতে জাপটে ধরে উজমাকে। উজমা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে, মিশকাতকে সামলানোর। ফাঁকে ফাঁকে উসাইদকে কল করার পাশাপাশি মিশকাতের বাবার বাড়িতেও জানিয়ে দিল। উজমার বেশি খারাপ লাগল এইভেবে যে, রক্তের প্রয়োজন পড়লে রক্ত কোথায় পাবে? বুদ্ধিশুদ্ধি সব লুপ পাচ্ছে তার। এত অসহায়, এত একা লাগছে, বিড়বিড়িয়ে শুধু আল্লাহকে ডাকছে আর ভাইয়ের সুস্থতা কামনা করছে। কোথায় যে গেল ভাইটা!

***

চলবে…