মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-১৩+১৪

0
52

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – তেরো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

হসপিটালে আসার পরপর একজন নারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মিশকাতকে চেক করেন, ব্যথা কতটুকু বা কেমন। বাচ্চার পজিশন কী। এগুলো চেক করতে গিয়েই বুঝতে পারেন, ওয়াটার ব্রেক আগেই হয়েছে কিন্তু মিশকাত সেটা বুঝতে পারেনি বলেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ব্যথা আছে ঠিকই কিন্তু জরায়ুমুখ খুলছে না। তিনি উজমাকে বিষয়টা জানিয়ে পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন যে, সিজার করবে না-কি অপেক্ষা করবে! উজমা জানে, এই অবস্থায় অপেক্ষা করা মানে, বাচ্চার ক্ষতি। সে তড়িঘড়ি মিশকাত ও মামীমার সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিজারিয়ান সেকশনে যাওয়ার জন্য। এরমধ্যে তাক্বদীম এসে পৌঁছাল হসপিটালে। উজমা একটু সাহস পেল এবার। বলল,

-‘ডোনার পেয়েছিস?’

-‘হ্যাঁ, গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম। একজন আসবে বলেছে। সে মৌলভীবাজারে নেই, সিলেট থেকে আসছে। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’

উজমা মনের অসহায় অবস্থা সামলাতে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে মিশকাতকেও একাধারে সাহস দিয়ে গেল। ও বেচারি ব্যথায় শুধু চিৎকার করছে, আর কিছু বলতেই পারছে না। আবার এই ব্যথায় জোর দিয়েও কাজ হচ্ছে না। এরকম একটা বিপদের মুহূর্তে ভাই পাশে নেই, এটা উজমাকে আরও দুর্বল করে দিল। সে রক্তের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল। যেহেতু এখুনি ও.টিতে যাবে। রক্ত আগে থেকেই ম্যানেজ করে রাখতে হবে। চিন্তায় চিন্তায় আবারও ভাইকে কল করল, কিন্তু না। উসাইদকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফারশাদ নিজেও নিজের ফেসবুক পেইজে রক্তের গ্রুপ চেয়ে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে থেকেই বলল,

-‘ভাবীর ব্লাড গ্রুপ কী? আমি একটা স্ট্যাটাস দিই, হয়তো ম্যানেজ হতে পারে।’

উজমা ভেবে দেখল, হাতের কাছে দুই ব্যাগ রক্ত রাখা ভীষণ জরুরী। একজন তো এক ব্যাগ দিবে, আরেক ব্যাগ কোথায় পাবে? আগে যদি জানত, নরমালি হবে না, তাহলে আগে থেকেই ডোনার খুঁজে রাখত। সে অস্থির মন নিয়েই বলল,

-‘ও পজেটিভ। অনিক আর কাইফ থাকলেই হোতো, ওরা তো কেউ নেই এইমুহূর্তে।’

-‘ওকে। টেনশনের কিছু নেই। আমি ব্লাড দিব। আমার ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ। যদিও এক ব্যাগের বেশি নিবে কি-না সন্দেহ।’

ফারশাদ ফোন রেখে তাক্বদীমকে বলল,
-‘তোমার ডোনারকে কল করে দেখো, কতদূর এগিয়েছে।’

তাক্বদীম দেরী করল না, ফোন হাতে নিয়ে ডোনারকে কল করতে করতে হসপিটালের নিচে এসে ইমার্জেন্সি রুম ক্রস করতে গিয়েই খেয়াল করল, ওখানে উসাইদ। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতের কনুইয়ের কাছাকাছি অংশে এইমুহূর্তে সেলাই দিচ্ছে ডাক্তার। সে তড়িঘড়ি পাশে গিয়ে বলল,

-‘ভাইয়া, কী হয়েছে তোমার? তুমি এখানে কীভাবে? তা-ও রক্তাক্ত অবস্থায়! তোমার ফোন বন্ধ কেন?’

উসাইদ নিজেও অবাক হলো তাক্বদীমকে দেখে। ডাক্তার হাতের সেলাই শেষ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। সে নিজের অবস্থা জানাতে বলল,

-‘হারিয়ে গেছে।’

বাজারে যাওয়ার সময় যে গাড়িতে উঠেছিল উসাইদ, ফোন হয়তো তখনই হারিয়েছে, সে খেয়াল করেনি। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে কল করতে গিয়েই বুঝল, ফোন হারিয়ে ফেলেছে। কোথায় যে পড়ল মনেই করতে পারল না। নিজের নম্বরে কল করার পর বুঝল, ওটা অলরেডি চোরের পকেটে। এরপর তড়িঘড়ি বাজার শেষ করে থানায় গিয়ে জিডি করে রিকশা নিল, স্ট্যান্ডে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছুপথ এগিয়েই রিকশাটা একটা চলন্ত সিএনজির সাথে ধাক্কা খেল। ফলাফল এই অবস্থা। সে রিকশাওয়ালার চিকিৎসা করিয়ে অলরেডি তাকে একটা গাড়িতে তুলে দিয়েছে। সেই ফাঁকে নিজের কাটাছেঁড়া জায়গায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়ার জন্য এখানে এসেছে। মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে বলেই এখানকার ডাক্তার ও নার্স প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টের জন্য বসিয়ে রাখল। নিজের কথা শেষ করে উসাইদ জানতে চাইল,

-‘তুমি এখানে কেন?’

-‘আমরা তো ভাবীকে নিয়ে এসেছি। উজমাও আছে। এক্ষুণি ও.টিতে নিতে হবে। ডোনার এসেছে। তাকেই নিতে এসেছিলাম।’

-‘কী বোলো? আমি তো ওকে সুস্থ রেখেই বের হলাম।’

হাতের সেলাই শেষ হয়েছিল মাত্র, ডক্টর প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, উসাইদ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। ঝড়েরবেগে বের হলো সেখান থেকে। সোজা তিন তলায় গেল। যেখানে অপারেশন থিয়েটার আছে। বারান্দায় পা ফেলতেই ফারশাদের সাথে দেখা হলো। বন্ধুকে এই অবস্থায় দেখে রীতিমতো বিস্মিত ফারশাদ। আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করল,

-‘ইন্না-লিল্লাহ, তোর এই অবস্থা হলো কী করে?’

উসাইদ ক্রমশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-‘মিশকা কোথায়?’

আঙুল দিয়ে কেবিনের ভেতরটা দেখাল ফারশাদ। ওখানে শুধু মহিলারা আছেন। মিনারা খাতুন ও মিশকাতের মা। পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ আপাতত। নার্স মিশকাতকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে স্ট্রেচারে করে বাইরে আসছিল সবে। ব্যথায় আর্তনাদ করছে মিশকাত। ছটফট করছে। উজমা তাকে সাহস দিলেও ননদিনীর কথা মেয়েটা কানেই তুলছে না। তার একটাই কথা, ‘তোর ভাই কোথায়? আমি মরে গেলে আসবে?’ স্ত্রীর মুখে এই সময়েও অভিমানী কথা শোনে নার্সকে থামিয়ে উসাইদ বলল,

-‘একটু বাইরে যাবেন, প্লিজ।’

ভাইয়ের গলার আওয়াজ শোনে সঙ্গে থাকা নার্সকে ইঙ্গিত দিতেই, সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। উজমাও বাইরে এলো। ভাইয়ের সামনে এসে তাকে ওভাবে অসুস্থ অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

-‘একী অবস্থা তোমার? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, জানো? কোথায় ছিলে তুমি?’

-‘পরে বলছি।’

একটু একটু করে উসাইদের কণ্ঠস্বর কানে আসতেই চিৎকার থামিয়ে সামনে তাকাল মিশকাত। মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ দেখে দুর্বল, ব্যথাতুর শরীর নিয়ে ছটফটিয়ে উঠল। স্ট্রেচার থেকে নামতে চাইলে উসাইদ তাকে আটকে বলল,

-‘মাথা খারাপ? নিচে নামছ কেন?’

মিশকাতের অবস্থা বেসামাল হয়ে গেল। সে একহাতে একাধারে কিল-ঘুষি মেরে গেল। উসাইদ তাকে আটকাতে চেয়েও পারল না। আগলে নিয়ে দাঁড়াল। কপালে চুমু দিল। মিশকাতের অভিমান এবার উপচে উপচে পড়ল। সে কেঁদে কেঁদে অসংখ্য অভিযোগ, অভিমান ঢেলে দিল। উসাইদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-‘তুমি না অনেক সাহসী একটা মেয়ে? এভাবে কেঁদে কেঁদে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করছ কেন?’

ব্যথা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে স্বামীর রক্তাক্ত টি-শার্ট খামচে ধরল মিশকাত। ভয়মিশ্রিত গলায় বলল,
-‘আমি পারছি না আর। জান বেরিয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছি।’

সন্তান জন্ম দেয়া যে কত কষ্টের, সেটা স্ব-চক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে গিয়ে উসাইদ নিজেও এখন যথেষ্ট ভয় পাচ্ছে। স্ত্রীর এই কঠিন মুহূর্তে নিজের ভয়কে মোটেও প্রশ্রয় দিল না। নার্স তখন তাড়া দিচ্ছে। উজমাও ভেতরে এসে বলল,

-‘ভাইয়া, নিয়ে যাই?’

উসাইদ মাথা নেড়ে মিশকাতের কপালে আরও একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে তার মনে সাহস দিতে বলল,

-‘একটি সফল যুদ্ধ ও যুদ্ধের সুন্দর সমাপ্তির জন্য অসংখ্য শুভকামনা আমার, প্রিয়তমা। মা হওয়ার এই কঠিন যুদ্ধে আল্লাহ যেন তোমাকে পর্যাপ্ত ধৈর্য্যশক্তি দেন এবং একজন সাহসী ও বিজয়ী যোদ্ধা হিসেবে কবুল করে নেন, সেই প্রার্থনা। ভয় পেও না, মনে সাহস রেখো। এটুকুও জেনে রেখো, আমার ভালোবাসা ও দোয়া সবসময়ই তোমার সাথে আছে। প্লিজ, ডোন্ট ক্রাই। কাম ব্যাক টু মি কুইকলি, উইথ মাই লিটল প্রিন্সেস।’

সব ব্যথা-যন্ত্রণা মুহূর্তেই ভুলে গেল মিশকাত। এতটুকুই তো সে চেয়েছিল, একটু সাহস, একটু মনের জোর, একটু ভরসা। এখন ব্যথা যত গভীর হোক, তাতেও তার কষ্ট নেই। মনের সবটুকু ভয়কে দূরে সরিয়ে মুচকি হেসে স্বামীকে আশ্বস্ত করে বলল,

-‘ঠিক আছে। ফিরে এসে ঝগড়া করব।’

সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশের আগে উজমা তার সহকর্মী ফারিণকে বলল, ব্লাড সংগ্রহ কর‍তে। ওই মুহূর্তে ডিউটি ফারিণের ছিল। তা-ই ব্লাড নেয়ার দায়িত্ব সে-ই পালন করল। ডাক্তারের অনুমতি পাওয়ায় মিশকাতের মনের জোর হওয়ার জন্য উজমা নিজেও ও.টিতে প্রবেশ করল।

দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা শেষে ছোট্ট নবজাতককে নিয়ে বাইরে এলো উজমা। সে সুস্থই আছে। মিশকাতকে কেবিনে শিফট করা হলেও তার জ্ঞান ফিরেনি। ইতিমধ্যে তাকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। উজমা বাইরে এসে আদুরে বাচ্চাটাকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিল। উসাইদ কী করবে ভেবে পেল না, কাঁপা কাঁপা বাচ্চাটাকে কোনোমতে কোলে নিয়ে আলগোছে বুকের কাছে আগলে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,

-‘আমার মা…। তুমি আমার ঘরে আল্লাহর নেয়ামত হয়ে এসেছ মা। দীর্ঘায়ু হও। একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠো। বাবা ও মায়ের সম্মান হয়ে বাঁচো।’

***

মিশকাত তখনও চোখ মেলেনি। হাতে ক্যানোলা। রক্ত চলছে। মোরশেদ জামান যখন হসপিটালে পৌঁছান, ততক্ষণে সমস্ত ঝুটঝামেলা ও বিপদ-আপদের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে একনজর দেখেই বিদায় নিলেন। বেশিক্ষণ হসপিটালে থাকতে পারবেন না। তাঁকে আবার আজকের মধ্যেই রাজশাহী রওনা দিতে হবে। ফারশাদ ও আরও একজন ডোনার বেডরেস্টে আছে। যদিও রক্ত দেয়ার পর তেমন কোনো শারিরীক অসুস্থতা দেখা যায়নি, তবে একটু মাথা ঘুরছে, দুর্বল লাগছে। এজন্য ঘণ্টা খানেকের বিশ্রাম প্রয়োজন। উসাইদ নিজেও অসুস্থ হলেও ওই শরীর নিয়েই মামাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিল। শামীমের বাবা সাজ্জাদ ওয়াজেদ কেন খবর পাঠিয়েছেন, এইটুকু জানতে চাইলে তিনি বললেন, বাসায় পৌঁছে ধীরেসুস্থে জানাবেন। উসাইদ আর জোর করেনি। রাত হয়ে গেলে আবার সমস্যা হতে পারে, এইভেবে বিকেলের মধ্যেই মামাকে বিদায় জানাতে হলো। মিনারা খাতুন ক’টাদিন এখানে থাকবেন। একদিকে উজমার বিপদ, অন্যদিকে উসাইদের স্ত্রীর অসুস্থতা, তাদের পারিবারিক সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে ভেবেই, তিনি থেকে গেলেন।

সন্ধ্যের পরপর হসপিটালে এলো ঊষা। ভাইঝিকে দেখবে আর তার খেয়াল রাখবে। সে এসেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে রইল। আর তাকে নড়ানোও গেল না। কারও কোলেই দিচ্ছে না। কাঁদলেও সে সামলে নিচ্ছে। হাঁটছে, গল্প করছে। উজমা বোনের এই পাগলামি দেখছে পাশে বসে। তাক্বদীম এসে জানাল, ডোনার বিদায় নিতে চাইছে। যেহেতু আর প্রয়োজন নেই, উজমা তাকে বিদায় দিতেই এগোলো। নিচে এসে বলল,

-‘থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। আপনি অনেক উপকার করলেন।’

ছেলেটা অমায়িক হেসে বলল,
-‘থ্যাংকস এর প্রয়োজন নেই। আপনার ভাবী এখন কেমন আছেন?’

-‘ভাবীর তো এখনও জ্ঞান ফিরেনি।’

-‘ওহ, বাচ্চাটা?’

-‘ভালো আছে।’

-‘আমি তাহলে আসি?’

ছেলেটা চলে যেতে চাইলে তাক্বদীম তার হাতে অনেকগুলো ফলমূল ও অল্পকিছু টাকা দিয়ে বলল,
-‘এগুলো নিয়ে যান।’

-‘ইট’স ওকে, ভাইয়া। এগুলো লাগবে না। আমি তো আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এরজন্য টিপস নিতে হবে কেন?’

-‘কষ্ট করে এসেছেন। কিছু না দিলে কেমন দেখায়! আচ্ছা, টাকা নিতে হবে না। ফলগুলো নিয়ে যান। ওগুলোর প্রয়োজন আছে।’

-‘আমি কিন্তু এসব ব্যাপারে খুবই রাগ করি। তবুও আপনি আমার সিনিয়র দেখে ফলগুলো নিয়ে যেতে পারি। আর নেক্সট টাইম, যদি ব্লাডের প্রয়োজন হয়, অবশ্যই আমাকে ডাকবেন।’

-‘ঠিক আছে।’

তাক্বদীম তাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তা পর্যন্ত এসে গাড়িতে তুলে দিল। এরপর দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে হসপিটালের ভেতর এসে ফারশাদের কাছে গেল। যদিও তাকে বলা হয়েছে, বিশ্রাম নাও। সে বিশ্রাম নিবে কী! ফোন হাতে নিয়ে অযথাই স্ক্রল করছে। ওদের দু’জনকে দেখে ফারশাদ বলল,

-‘আমার বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।’

হসপিটালে রাতে কে কে থাকবে, এটা এখনও নিশ্চিত নয়। আবার বেশি মানুষজন থাকাও ঝামেলার। এজন্যই সে চলে যাওয়ার কথা তুলল। এই নিয়ে কেউ কিছু বলল না দেখে আবারও বলল,

-‘তাক্বদীম, তুমি যাবে না?’

-‘অবশ্যই যাব। তুমি বোসো, আমি ভাইয়ার থেকে বিদায় নিয়ে আসি।’

উজমা চুপচাপ তাক্বদীমের পিছন পিছন কেবিনে এলো। ঊষা বাড়ি থেকে আসার সময় খাবার-দাবার নিয়ে এসেছে। আর কেউ যাবে কি-না এটা জিজ্ঞেস করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সে যাওয়ার কথা তুলতেই ঊষা বলল,

-‘আমি যাব না। আমি আজ এখানেই থাকব। প্লিজ, আপু।’

উজমা অবাক হয়ে বলল,
-‘আশ্চর্য, বাড়ি না গেলে বাবাকে কে দেখবে?’

-‘কেন, তুমি। তুমি দেখবে।’

-‘আমি তো ভাবীর কাছে থাকতে চাইছিলাম।’

-‘তুমি যাও। ভাইয়া তো থাকছেই। ভাবীর জ্ঞান ফেরার পর নাহয় যাবে। বাবাকে তো ঔষধ খাওয়াতে হবে, তাই না? ওটা তুমি ছাড়া কেউ সামলাতে পারে?’

এটা অবশ্য ঠিক বলেছে ঊষা। উসমান ওয়াজেদ ঔষধ খেতে গেলে যা ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপেন, তখন ওই সিচুয়েশনে উজমাকেই শক্ত হয়ে বাবাকে সামলাতে হয়। রাতের মধ্যেই মিশকাতের জ্ঞান ফিরে আসবে। বাচ্চাটাও সুস্থ আছে। অযথা ভীড় জমিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারলে, সারাদিনের ক্লান্তি যাবে। অলরেডি সাতটা হয়ে গেছে। আর বেশি দেরী করা ঠিক হবে না। সে ঊষাকে ঔষধপত্র বুঝিয়ে দিল। ভাইকে সবকিছু বুঝিয়ে ঔষধ খাওয়ার কথা বলে বিদায় নিল। ফারশাদ নিজেও এসেছিল বন্ধুর থেকে বিদায় নিতে। সে বাচ্চাটাকে একনজর দেখল। উসাইদ বলল,

-‘বাড়ি যা। গিয়ে বিশ্রাম নে। এখানে খুব একটা সুবিধা হবে না। তোকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ তুই যা করলি…।’

ফারশাদ মুচকি হেসে বলল,
-‘আমাকে তো কিছুই করতে হয়নি।’

-‘এইরকম সিচুয়েশনে কিছু করা আসলে ব্যাপার নয়, পাশে থাকাটাই আসল। তোকে কী বলে ধন্যবাদ দিব, আমি জানি না।’

-‘তোর ধন্যবাদ আমি নিলে তো। যা চাইলাম, সেটা তো দিবি না বলে জেদ ধরে বসে আছিস।’

উসাইদ হাসলো। বোনের দিকে একনজর তাকাল। উজমা অবশ্য এসবের কিছুই বুঝল না। ঠিকমতো শুনলোই না সে। ঊষা আবার মুখ টিপে হাসছে। সে বন্ধুর অভিমান ভাঙাতে বলল,

-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ভাগ্য যদি তোর সহায় হয় আর আল্লাহ যদি চান, আমি কোনোকিছুতেই বাঁধা হব না। তবে অবশ্যই, যা নিবি আমার কাছ থেকে তার যথাযথ সম্মান দিবি। নয়তো আমি খুব খারাপ হয়ে যাব।’

‘আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া’ বোধহয় একেই বলে। ঠোঁট মুড়ে হাসি লুকিয়ে আলগোছে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে বলল,

-‘এই তোর বাচ্চাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম। আমার ভাগ্যে যদি ওই প্রাপ্তিটা লেখা থাকে, যদি আমি তা পেয়ে যাই, এই জীবনে কোনোদিন আমি সেই প্রাপ্তির অসম্মান, অযত্ন কিংবা অবহেলা করব না। এখন আসি। দরকার পড়লে অবশ্যই কল করবি। আর নিজেও একটু বিশ্রাম নে।’

***

তিনজনে একসাথে হসপিটাল থেকে বের হয়ে তাক্বদীমের গাড়িতে করেই বাড়ির দিকে রওনা হলো। ফারশাদ সামনেই বসলো আর উজমা পিছনে। রাত হওয়াতে ঠাণ্ডা পড়েছে বেশি। চারপাশটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গিয়েছে। যান চলাচলের কারণে আশপাশ স্পষ্ট দেখা গেলেও খুব বেশিদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। দুই পুরুষ একাধারে ক্রিকেট নিয়ে বকবক শুরু করলেও উজমা কোনো কথাই বলল না। সে চুপচাপ সিটে মাথা রেখে নীরবে ওদের কথাই শুনছিল। এক পর্যায়ে তাক্বদীম বলল,

-‘উজমা, আমরা একটা ট্যুর দিতে চাইছিলাম। তুই কবে সময় দিতে পারবি?’

মন একেবারে বিধস্ত উজমার। পারিবারিক ও নিজস্ব জীবনের কিছু জটিলতা নিয়ে। আনন্দ আর ভেতর থেকে বাহির হতে চায় না। এই একটা জীবন নিয়ে যত আশা ছিল, সব একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে। যত স্বপ্ন ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেছে। একজীবনে মানুষ আসলে ঠিক কী নিয়ে শান্তিতে বাঁচে এই একটা প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন খুঁজে পেল না উজমা। যখনই ভাবে, একটু সুখের দেখা পাওয়া যাবে, তখনই কোথা থেকে যেন সব এলোমেলো হয়ে যায়। কাউকে জীবনে জড়াতেও এখন ভয় হয়। আবার নিজেকে সুখী ভাবতে গিয়েও মনে হয়, আদতে সে কোনোদিন সুখী ছিল কি-না। যেখানে মনটাতেই শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, সেখানে ট্যুর কতটা আনন্দের প্রভাব ফেলবে, সে বুঝল না। বন্ধুরা তার মনের অবস্থা জানে না বলেই, কষ্টের ভাগ কোনোদিন নিতে পারেনি। এটা অবশ্য বন্ধুদের দোষ না। দোষটা তারই। সে নিজেই তো শেয়ার করেনি কিছু। এ জাতীয় কিছু অদ্ভুত চিন্তাকে মনে ঠাঁই দিয়ে বলল,

-‘এখন তো সেটা সম্ভব নয়। তোরা কি ডেট ফাইনাল করেছিস?’

-‘না, সেটা এখনও করিনি। আমি শুধু ওদের দু’জনকে জানিয়েছি। ওরা বলেছে, তোরা মেয়েরা যখন ফ্রি হবি, তখন ট্যুর হলেই হবে।’

-‘ওহ, রাইদাহ কি ফ্রি আছে? ওর তো আবার যখন-তখন প্রোগ্রাম থাকে।’

-‘সেটা কাইফ ম্যানেজ করে নেবে। আসলে, তোর পরিবারের এরকম সিচুয়েশনে ফ্রি হওয়াটা বিরাট কষ্টের হয়ে যাবে। আবার তোকে ছাড়া ট্যুর, ভাবতেই পারব না।’

-‘অসুবিধা নেই, এবার নাহয় তোরাই যা। আমি একা মানুষ আর কত তোদের নিজস্ব প্রাইভেসিতে বাঁধা হব। নিজেরই খারাপ লাগে।’

লাস্ট ট্যুরে তো সবাই-ই কাপল ছিল, শুধু উজমা একা মোমকে নিয়েই সময় কাটিয়েছিল। ওদের একেকজোড়া দম্পতিকে ঘুরতে পাঠিয়ে, সে মোমকে নিয়ে সারাদিন বিচে ঘুরে বেরিয়েছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওদের নিজস্ব কিছু মুহূর্তে সে আর কখনও বাঁধা হবে না। ব্যাপারটা খুবই খারাপ দেখায়। হোক বন্ধু, প্রাইভেসি সবারই আছে। উজমার কথায় হো হো করে হেসে উঠল তাক্বদীম। বলল,

-‘তুই এখনও আগের চ্যাপ্টারেই পড়ে আছিস? আসলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর শোনে। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর এবার আমরা সবাই মিলে একটা কাপল ট্রিপ দিব। কিন্তু যা হলো…।’

-‘ওসব কথা বাদ দে, ভাই। ভালো লাগছে না।’

আজ রাতটাই গায়ে হলুদের রাত হওয়ার কথা ছিল। আগামীকাল বিয়ে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে, আজ গায়ে হলুদ হচ্ছে ঠিকই, তবে সেটা উজমার নয় শাম্মার। এই কঠিন সত্যটা খুব সহজে মেনে নিলেও নিজের ভাগ্যের হিসেব মিলাতে পারছে না উজমা। বুঝতেই পারছে না, কেন তার সাথে এমন হচ্ছে। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে আছে। বিয়ে ভেঙেছে, এইভেবে নয়। বরং, শাম্মার কথা ভেবে। সাকিব যে কী পরিমাণ সন্দিহান মনের মানুষ সেটা শাম্মা বুঝতে পারেনি। আল্লাহই ভালো জানেন, মেয়েটার কপালে কী আছে। এতটুকু বিড়বিড় করে মূল রাস্তার সামনে আসতেই উজমা বলল,

-‘এখানেই রাখ, তাক্বদীম।’

-‘কেন? বাড়িতে যাই? এইটুকু রাস্তা হেঁটে যাবি কেন?’

-‘অসুবিধা নেই। আমি একটু হাঁটতে চাইছি। ভাবী বোধহয় অপেক্ষা করছে। তুই আর দেরী করিস না। সারাদিন অনেক ছোটাছুটি করেছিস।’

-‘ওকে…।’

পার্কিং এড়িয়া ঘেঁষে একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়ি থামালে দু’জনেই নেমে পড়ল। ওদের নামিয়ে ঝটপট বিদায় নিল তাক্বদীম। উজমা আস্তেধীরে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। ফারশাদ নিজেও পাশাপাশি হাঁটছে। কেউ-ই কোনো কথা বলছে না। কে জানে হয়তো ওরা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আবার কী বলা উচিত, সেটাই বুঝতে পারছে না। আচমকাই ফারশাদ বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘আজও আমরা পাশাপাশি, কাছাকাছি হাঁটছি। দু’জনের গন্তব্যও এক। তবুও এক আকাশসম দূরত্ব। এই যাত্রা কি দীর্ঘস্থায়ী হতে পার‍ত না? এই দূরত্ব কি শেষ হতে পার‍ত না?’

আড়চোখে ফারশাদের দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের মতো হাঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উজমা। বিড়বিড় শুনেছে, কিন্তু কী বলেছে ছেলেটা, সেটা স্পষ্ট বুঝেনি। ওই সামান্য চাহনিতেই ফারশাদ বুঝল, মেয়েটার মন ভালো নেই। সে একটু জোরেই বলল,

-‘বেবির নাম কী রাখবেন?’

-‘এখনও ভাবিনী।’

-‘আমি একটা নাম দেই?’

-‘দিতে পারেন।’

কথা বলতে গিয়ে বেখেয়ালিতে পায়ে মোচড় খেল উজমা। ফট করে ছিঁড়ে গেল জুতা। এতক্ষণে খেয়াল হলো, তার পায়ে আসলে স্লিপার। মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই।।এই জুতো ছেঁড়ায় মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। সামান্য ঝুঁকে জুতো খুলে উড়িয়ে দিল মাঠের দিকে। খালি পায়েই হাঁটতে শুরু করল। ফারশাদ অবাক হয়ে বলল,

-‘কী করলেন এটা? পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে তো।’

-‘অসুবিধা নেই।’

নীরবতার চাদর গায়ে মেখেই আরও কিছুপথ এগোলো ওরা। স্কুল, মন্দির ও হিন্দুপাড়া ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে আবারও পায়ে মোচড় খেল উজমা। তার মনে হলো এই পা’টাকে যদি কেটে ফেলা যেত। মোচড় খেয়ে এবার একটু গুঙিয়ে উঠল উজমা। ফোনের টর্চ অন করে দেখল, বেয়াদব পা’টাই ভয় পেয়ে আগেভাগে কেটে বসে আছে। আজ কি দুর্ঘটনা ঘটার দিন? একটার পর একটা বিপদ যাচ্ছে। যদিও তার কপালটাই এমন। সবসময় একটা না একটা বিপদ লেগে থাকতে চায়। সে না চাইলেও বিপদগুলো কোত্থেকে যেন উড়ে এসে চেপে বসে ঘাড়ে। মাঝেমধ্যে নিজের ওপরই প্রচণ্ড বিরক্ত হয় উজমা। এখনও হলো। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে পা’টা কেটে যেতে পারল? দূর, বলে নিজেকেই বকলো সে। ফারশাদ দেখল, নীরবে চেয়ে চেয়ে। কেটে যাওয়া পা নিয়ে তবুও মেয়েটা একটু একটু করে হাঁটছে। পা থেকে রক্ত ঝরছে, অথচ কিছু বাঁধছে না। তার কী হলো কে জানে! শক্ত মেজাজে বলল,

-‘একটু দাঁড়ান।’

উজমা দাঁড়াল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল, ফারশাদ তার গায়ের ওড়নার একটা প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। উজমা রেগেমেগে বলল,

-‘কী করলেন এটা? ওড়না ছিঁড়লেন কেন?’

-‘হাতের কাছে আপাতত কিছু নেই, ওড়নাই সমাধান।’

এরপর টুপ করে নিচু হয়ে উজমার ডানপা তুলে নিল নিজের হাঁটুর ওপর। ওড়নার ছেঁড়া অংশ পায়ে বেঁধে বলল,
-‘এবার হাঁটুন। ব্যথা কম হবে।’

ফারশাদ উঠে দাঁড়ালে আবারও ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করল উজমা। এবার ব্যথা একটু কম লাগছে। ধন্যবাদ দিতে গিয়েও থেমে গেল। কথা বলতে ভালো লাগছে না। ফারশাদ নিজেও খানিকটা ইতস্ততভাব নিয়েই হাঁটছিল। এটা বোধহয় খেয়াল করল উজমা। একসময় নীরবতা ভেঙে বলল,

-‘বেবির নাম পেয়েছেন?’

ফারশাদ হাসিমুখে বলল,
-‘আমি নাম দিলে কি পছন্দ হবে?’

-‘কেন হবে না? দিয়েই দেখুন।’

কিছুক্ষণ ভাবল ফারশাদ। উসাইদ ও মিশকাতের নাম এক করেও সুন্দর কোনো নাম পেল না। একটা সময় ভাবনা থামিয়ে বলল,

-‘আপনি চাইলে মাশিয়াত বা উপমা রাখতে পারেন। যদি চয়েস হয় আরকি।’

-‘দুটো নামই সুন্দর।’

নাম নিয়ে কথা শুরু হলেও কয়েক মিনিটের রাস্তা টুকটাক কথা বলেই এগোলো দু’জনে। ফারশাদ মনে মনে চাইল, এই রাত দীর্ঘ হোক, এইমুহূর্ত চিরস্মরণীয় হোক, কিন্তু কীভাবে? মনের কথা বলার সুযোগটা কি আজই? না-কি আরও সময় নিবে? উঁহু, ঠিক কখন বললে এই রমণী রি’অ্যাক্ট করবে না, রেগেমেগে গর্জে উঠবে না। এমন একটা সময়ে বলতে হবে, যখন উজমার মেজাজটা গরম থাকবে। টগবগ টগবগ করে ফুটতে থাকা উত্তপ্ত মেজাজে যেন তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তিটা এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে। যদিও এমন মুহূর্ত আসবে কি-না নিশ্চিত নয় সে। তবুও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে দোষ কী?

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – তেরো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

হসপিটালে আসার পরপর একজন নারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মিশকাতকে চেক করেন, ব্যথা কতটুকু বা কেমন। বাচ্চার পজিশন কী। এগুলো চেক করতে গিয়েই বুঝতে পারেন, ওয়াটার ব্রেক আগেই হয়েছে কিন্তু মিশকাত সেটা বুঝতে পারেনি বলেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ব্যথা আছে ঠিকই কিন্তু জরায়ুমুখ খুলছে না। তিনি উজমাকে বিষয়টা জানিয়ে পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন যে, সিজার করবে না-কি অপেক্ষা করবে! উজমা জানে, এই অবস্থায় অপেক্ষা করা মানে, বাচ্চার ক্ষতি। সে তড়িঘড়ি মিশকাত ও মামীমার সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিজারিয়ান সেকশনে যাওয়ার জন্য। এরমধ্যে তাক্বদীম এসে পৌঁছাল হসপিটালে। উজমা একটু সাহস পেল এবার। বলল,

-‘ডোনার পেয়েছিস?’

-‘হ্যাঁ, গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম। একজন আসবে বলেছে। সে মৌলভীবাজারে নেই, সিলেট থেকে আসছে। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’

উজমা মনের অসহায় অবস্থা সামলাতে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে মিশকাতকেও একাধারে সাহস দিয়ে গেল। ও বেচারি ব্যথায় শুধু চিৎকার করছে, আর কিছু বলতেই পারছে না। আবার এই ব্যথায় জোর দিয়েও কাজ হচ্ছে না। এরকম একটা বিপদের মুহূর্তে ভাই পাশে নেই, এটা উজমাকে আরও দুর্বল করে দিল। সে রক্তের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল। যেহেতু এখুনি ও.টিতে যাবে। রক্ত আগে থেকেই ম্যানেজ করে রাখতে হবে। চিন্তায় চিন্তায় আবারও ভাইকে কল করল, কিন্তু না। উসাইদকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফারশাদ নিজেও নিজের ফেসবুক পেইজে রক্তের গ্রুপ চেয়ে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে থেকেই বলল,

-‘ভাবীর ব্লাড গ্রুপ কী? আমি একটা স্ট্যাটাস দিই, হয়তো ম্যানেজ হতে পারে।’

উজমা ভেবে দেখল, হাতের কাছে দুই ব্যাগ রক্ত রাখা ভীষণ জরুরী। একজন তো এক ব্যাগ দিবে, আরেক ব্যাগ কোথায় পাবে? আগে যদি জানত, নরমালি হবে না, তাহলে আগে থেকেই ডোনার খুঁজে রাখত। সে অস্থির মন নিয়েই বলল,

-‘ও পজেটিভ। অনিক আর কাইফ থাকলেই হোতো, ওরা তো কেউ নেই এইমুহূর্তে।’

-‘ওকে। টেনশনের কিছু নেই। আমি ব্লাড দিব। আমার ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ। যদিও এক ব্যাগের বেশি নিবে কি-না সন্দেহ।’

ফারশাদ ফোন রেখে তাক্বদীমকে বলল,
-‘তোমার ডোনারকে কল করে দেখো, কতদূর এগিয়েছে।’

তাক্বদীম দেরী করল না, ফোন হাতে নিয়ে ডোনারকে কল করতে করতে হসপিটালের নিচে এসে ইমার্জেন্সি রুম ক্রস করতে গিয়েই খেয়াল করল, ওখানে উসাইদ। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতের কনুইয়ের কাছাকাছি অংশে এইমুহূর্তে সেলাই দিচ্ছে ডাক্তার। সে তড়িঘড়ি পাশে গিয়ে বলল,

-‘ভাইয়া, কী হয়েছে তোমার? তুমি এখানে কীভাবে? তা-ও রক্তাক্ত অবস্থায়! তোমার ফোন বন্ধ কেন?’

উসাইদ নিজেও অবাক হলো তাক্বদীমকে দেখে। ডাক্তার হাতের সেলাই শেষ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। সে নিজের অবস্থা জানাতে বলল,

-‘হারিয়ে গেছে।’

বাজারে যাওয়ার সময় যে গাড়িতে উঠেছিল উসাইদ, ফোন হয়তো তখনই হারিয়েছে, সে খেয়াল করেনি। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে কল করতে গিয়েই বুঝল, ফোন হারিয়ে ফেলেছে। কোথায় যে পড়ল মনেই করতে পারল না। নিজের নম্বরে কল করার পর বুঝল, ওটা অলরেডি চোরের পকেটে। এরপর তড়িঘড়ি বাজার শেষ করে থানায় গিয়ে জিডি করে রিকশা নিল, স্ট্যান্ডে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছুপথ এগিয়েই রিকশাটা একটা চলন্ত সিএনজির সাথে ধাক্কা খেল। ফলাফল এই অবস্থা। সে রিকশাওয়ালার চিকিৎসা করিয়ে অলরেডি তাকে একটা গাড়িতে তুলে দিয়েছে। সেই ফাঁকে নিজের কাটাছেঁড়া জায়গায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়ার জন্য এখানে এসেছে। মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে বলেই এখানকার ডাক্তার ও নার্স প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টের জন্য বসিয়ে রাখল। নিজের কথা শেষ করে উসাইদ জানতে চাইল,

-‘তুমি এখানে কেন?’

-‘আমরা তো ভাবীকে নিয়ে এসেছি। উজমাও আছে। এক্ষুণি ও.টিতে নিতে হবে। ডোনার এসেছে। তাকেই নিতে এসেছিলাম।’

-‘কী বোলো? আমি তো ওকে সুস্থ রেখেই বের হলাম।’

হাতের সেলাই শেষ হয়েছিল মাত্র, ডক্টর প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, উসাইদ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। ঝড়েরবেগে বের হলো সেখান থেকে। সোজা তিন তলায় গেল। যেখানে অপারেশন থিয়েটার আছে। বারান্দায় পা ফেলতেই ফারশাদের সাথে দেখা হলো। বন্ধুকে এই অবস্থায় দেখে রীতিমতো বিস্মিত ফারশাদ। আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করল,

-‘ইন্না-লিল্লাহ, তোর এই অবস্থা হলো কী করে?’

উসাইদ ক্রমশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-‘মিশকা কোথায়?’

আঙুল দিয়ে কেবিনের ভেতরটা দেখাল ফারশাদ। ওখানে শুধু মহিলারা আছেন। মিনারা খাতুন ও মিশকাতের মা। পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ আপাতত। নার্স মিশকাতকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে স্ট্রেচারে করে বাইরে আসছিল সবে। ব্যথায় আর্তনাদ করছে মিশকাত। ছটফট করছে। উজমা তাকে সাহস দিলেও ননদিনীর কথা মেয়েটা কানেই তুলছে না। তার একটাই কথা, ‘তোর ভাই কোথায়? আমি মরে গেলে আসবে?’ স্ত্রীর মুখে এই সময়েও অভিমানী কথা শোনে নার্সকে থামিয়ে উসাইদ বলল,

-‘একটু বাইরে যাবেন, প্লিজ।’

ভাইয়ের গলার আওয়াজ শোনে সঙ্গে থাকা নার্সকে ইঙ্গিত দিতেই, সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। উজমাও বাইরে এলো। ভাইয়ের সামনে এসে তাকে ওভাবে অসুস্থ অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

-‘একী অবস্থা তোমার? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, জানো? কোথায় ছিলে তুমি?’

-‘পরে বলছি।’

একটু একটু করে উসাইদের কণ্ঠস্বর কানে আসতেই চিৎকার থামিয়ে সামনে তাকাল মিশকাত। মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ দেখে দুর্বল, ব্যথাতুর শরীর নিয়ে ছটফটিয়ে উঠল। স্ট্রেচার থেকে নামতে চাইলে উসাইদ তাকে আটকে বলল,

-‘মাথা খারাপ? নিচে নামছ কেন?’

মিশকাতের অবস্থা বেসামাল হয়ে গেল। সে একহাতে একাধারে কিল-ঘুষি মেরে গেল। উসাইদ তাকে আটকাতে চেয়েও পারল না। আগলে নিয়ে দাঁড়াল। কপালে চুমু দিল। মিশকাতের অভিমান এবার উপচে উপচে পড়ল। সে কেঁদে কেঁদে অসংখ্য অভিযোগ, অভিমান ঢেলে দিল। উসাইদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-‘তুমি না অনেক সাহসী একটা মেয়ে? এভাবে কেঁদে কেঁদে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করছ কেন?’

ব্যথা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে স্বামীর রক্তাক্ত টি-শার্ট খামচে ধরল মিশকাত। ভয়মিশ্রিত গলায় বলল,
-‘আমি পারছি না আর। জান বেরিয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছি।’

সন্তান জন্ম দেয়া যে কত কষ্টের, সেটা স্ব-চক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে গিয়ে উসাইদ নিজেও এখন যথেষ্ট ভয় পাচ্ছে। স্ত্রীর এই কঠিন মুহূর্তে নিজের ভয়কে মোটেও প্রশ্রয় দিল না। নার্স তখন তাড়া দিচ্ছে। উজমাও ভেতরে এসে বলল,

-‘ভাইয়া, নিয়ে যাই?’

উসাইদ মাথা নেড়ে মিশকাতের কপালে আরও একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে তার মনে সাহস দিতে বলল,

-‘একটি সফল যুদ্ধ ও যুদ্ধের সুন্দর সমাপ্তির জন্য অসংখ্য শুভকামনা আমার, প্রিয়তমা। মা হওয়ার এই কঠিন যুদ্ধে আল্লাহ যেন তোমাকে পর্যাপ্ত ধৈর্য্যশক্তি দেন এবং একজন সাহসী ও বিজয়ী যোদ্ধা হিসেবে কবুল করে নেন, সেই প্রার্থনা। ভয় পেও না, মনে সাহস রেখো। এটুকুও জেনে রেখো, আমার ভালোবাসা ও দোয়া সবসময়ই তোমার সাথে আছে। প্লিজ, ডোন্ট ক্রাই। কাম ব্যাক টু মি কুইকলি, উইথ মাই লিটল প্রিন্সেস।’

সব ব্যথা-যন্ত্রণা মুহূর্তেই ভুলে গেল মিশকাত। এতটুকুই তো সে চেয়েছিল, একটু সাহস, একটু মনের জোর, একটু ভরসা। এখন ব্যথা যত গভীর হোক, তাতেও তার কষ্ট নেই। মনের সবটুকু ভয়কে দূরে সরিয়ে মুচকি হেসে স্বামীকে আশ্বস্ত করে বলল,

-‘ঠিক আছে। ফিরে এসে ঝগড়া করব।’

সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশের আগে উজমা তার সহকর্মী ফারিণকে বলল, ব্লাড সংগ্রহ কর‍তে। ওই মুহূর্তে ডিউটি ফারিণের ছিল। তা-ই ব্লাড নেয়ার দায়িত্ব সে-ই পালন করল। ডাক্তারের অনুমতি পাওয়ায় মিশকাতের মনের জোর হওয়ার জন্য উজমা নিজেও ও.টিতে প্রবেশ করল।

দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা শেষে ছোট্ট নবজাতককে নিয়ে বাইরে এলো উজমা। সে সুস্থই আছে। মিশকাতকে কেবিনে শিফট করা হলেও তার জ্ঞান ফিরেনি। ইতিমধ্যে তাকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। উজমা বাইরে এসে আদুরে বাচ্চাটাকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিল। উসাইদ কী করবে ভেবে পেল না, কাঁপা কাঁপা বাচ্চাটাকে কোনোমতে কোলে নিয়ে আলগোছে বুকের কাছে আগলে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,

-‘আমার মা…। তুমি আমার ঘরে আল্লাহর নেয়ামত হয়ে এসেছ মা। দীর্ঘায়ু হও। একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠো। বাবা ও মায়ের সম্মান হয়ে বাঁচো।’

***

মিশকাত তখনও চোখ মেলেনি। হাতে ক্যানোলা। রক্ত চলছে। মোরশেদ জামান যখন হসপিটালে পৌঁছান, ততক্ষণে সমস্ত ঝুটঝামেলা ও বিপদ-আপদের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে একনজর দেখেই বিদায় নিলেন। বেশিক্ষণ হসপিটালে থাকতে পারবেন না। তাঁকে আবার আজকের মধ্যেই রাজশাহী রওনা দিতে হবে। ফারশাদ ও আরও একজন ডোনার বেডরেস্টে আছে। যদিও রক্ত দেয়ার পর তেমন কোনো শারিরীক অসুস্থতা দেখা যায়নি, তবে একটু মাথা ঘুরছে, দুর্বল লাগছে। এজন্য ঘণ্টা খানেকের বিশ্রাম প্রয়োজন। উসাইদ নিজেও অসুস্থ হলেও ওই শরীর নিয়েই মামাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিল। শামীমের বাবা সাজ্জাদ ওয়াজেদ কেন খবর পাঠিয়েছেন, এইটুকু জানতে চাইলে তিনি বললেন, বাসায় পৌঁছে ধীরেসুস্থে জানাবেন। উসাইদ আর জোর করেনি। রাত হয়ে গেলে আবার সমস্যা হতে পারে, এইভেবে বিকেলের মধ্যেই মামাকে বিদায় জানাতে হলো। মিনারা খাতুন ক’টাদিন এখানে থাকবেন। একদিকে উজমার বিপদ, অন্যদিকে উসাইদের স্ত্রীর অসুস্থতা, তাদের পারিবারিক সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে ভেবেই, তিনি থেকে গেলেন।

সন্ধ্যের পরপর হসপিটালে এলো ঊষা। ভাইঝিকে দেখবে আর তার খেয়াল রাখবে। সে এসেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে রইল। আর তাকে নড়ানোও গেল না। কারও কোলেই দিচ্ছে না। কাঁদলেও সে সামলে নিচ্ছে। হাঁটছে, গল্প করছে। উজমা বোনের এই পাগলামি দেখছে পাশে বসে। তাক্বদীম এসে জানাল, ডোনার বিদায় নিতে চাইছে। যেহেতু আর প্রয়োজন নেই, উজমা তাকে বিদায় দিতেই এগোলো। নিচে এসে বলল,

-‘থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। আপনি অনেক উপকার করলেন।’

ছেলেটা অমায়িক হেসে বলল,
-‘থ্যাংকস এর প্রয়োজন নেই। আপনার ভাবী এখন কেমন আছেন?’

-‘ভাবীর তো এখনও জ্ঞান ফিরেনি।’

-‘ওহ, বাচ্চাটা?’

-‘ভালো আছে।’

-‘আমি তাহলে আসি?’

ছেলেটা চলে যেতে চাইলে তাক্বদীম তার হাতে অনেকগুলো ফলমূল ও অল্পকিছু টাকা দিয়ে বলল,
-‘এগুলো নিয়ে যান।’

-‘ইট’স ওকে, ভাইয়া। এগুলো লাগবে না। আমি তো আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এরজন্য টিপস নিতে হবে কেন?’

-‘কষ্ট করে এসেছেন। কিছু না দিলে কেমন দেখায়! আচ্ছা, টাকা নিতে হবে না। ফলগুলো নিয়ে যান। ওগুলোর প্রয়োজন আছে।’

-‘আমি কিন্তু এসব ব্যাপারে খুবই রাগ করি। তবুও আপনি আমার সিনিয়র দেখে ফলগুলো নিয়ে যেতে পারি। আর নেক্সট টাইম, যদি ব্লাডের প্রয়োজন হয়, অবশ্যই আমাকে ডাকবেন।’

-‘ঠিক আছে।’

তাক্বদীম তাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তা পর্যন্ত এসে গাড়িতে তুলে দিল। এরপর দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে হসপিটালের ভেতর এসে ফারশাদের কাছে গেল। যদিও তাকে বলা হয়েছে, বিশ্রাম নাও। সে বিশ্রাম নিবে কী! ফোন হাতে নিয়ে অযথাই স্ক্রল করছে। ওদের দু’জনকে দেখে ফারশাদ বলল,

-‘আমার বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।’

হসপিটালে রাতে কে কে থাকবে, এটা এখনও নিশ্চিত নয়। আবার বেশি মানুষজন থাকাও ঝামেলার। এজন্যই সে চলে যাওয়ার কথা তুলল। এই নিয়ে কেউ কিছু বলল না দেখে আবারও বলল,

-‘তাক্বদীম, তুমি যাবে না?’

-‘অবশ্যই যাব। তুমি বোসো, আমি ভাইয়ার থেকে বিদায় নিয়ে আসি।’

উজমা চুপচাপ তাক্বদীমের পিছন পিছন কেবিনে এলো। ঊষা বাড়ি থেকে আসার সময় খাবার-দাবার নিয়ে এসেছে। আর কেউ যাবে কি-না এটা জিজ্ঞেস করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সে যাওয়ার কথা তুলতেই ঊষা বলল,

-‘আমি যাব না। আমি আজ এখানেই থাকব। প্লিজ, আপু।’

উজমা অবাক হয়ে বলল,
-‘আশ্চর্য, বাড়ি না গেলে বাবাকে কে দেখবে?’

-‘কেন, তুমি। তুমি দেখবে।’

-‘আমি তো ভাবীর কাছে থাকতে চাইছিলাম।’

-‘তুমি যাও। ভাইয়া তো থাকছেই। ভাবীর জ্ঞান ফেরার পর নাহয় যাবে। বাবাকে তো ঔষধ খাওয়াতে হবে, তাই না? ওটা তুমি ছাড়া কেউ সামলাতে পারে?’

এটা অবশ্য ঠিক বলেছে ঊষা। উসমান ওয়াজেদ ঔষধ খেতে গেলে যা ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপেন, তখন ওই সিচুয়েশনে উজমাকেই শক্ত হয়ে বাবাকে সামলাতে হয়। রাতের মধ্যেই মিশকাতের জ্ঞান ফিরে আসবে। বাচ্চাটাও সুস্থ আছে। অযথা ভীড় জমিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারলে, সারাদিনের ক্লান্তি যাবে। অলরেডি সাতটা হয়ে গেছে। আর বেশি দেরী করা ঠিক হবে না। সে ঊষাকে ঔষধপত্র বুঝিয়ে দিল। ভাইকে সবকিছু বুঝিয়ে ঔষধ খাওয়ার কথা বলে বিদায় নিল। ফারশাদ নিজেও এসেছিল বন্ধুর থেকে বিদায় নিতে। সে বাচ্চাটাকে একনজর দেখল। উসাইদ বলল,

-‘বাড়ি যা। গিয়ে বিশ্রাম নে। এখানে খুব একটা সুবিধা হবে না। তোকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ তুই যা করলি…।’

ফারশাদ মুচকি হেসে বলল,
-‘আমাকে তো কিছুই করতে হয়নি।’

-‘এইরকম সিচুয়েশনে কিছু করা আসলে ব্যাপার নয়, পাশে থাকাটাই আসল। তোকে কী বলে ধন্যবাদ দিব, আমি জানি না।’

-‘তোর ধন্যবাদ আমি নিলে তো। যা চাইলাম, সেটা তো দিবি না বলে জেদ ধরে বসে আছিস।’

উসাইদ হাসলো। বোনের দিকে একনজর তাকাল। উজমা অবশ্য এসবের কিছুই বুঝল না। ঠিকমতো শুনলোই না সে। ঊষা আবার মুখ টিপে হাসছে। সে বন্ধুর অভিমান ভাঙাতে বলল,

-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ভাগ্য যদি তোর সহায় হয় আর আল্লাহ যদি চান, আমি কোনোকিছুতেই বাঁধা হব না। তবে অবশ্যই, যা নিবি আমার কাছ থেকে তার যথাযথ সম্মান দিবি। নয়তো আমি খুব খারাপ হয়ে যাব।’

‘আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া’ বোধহয় একেই বলে। ঠোঁট মুড়ে হাসি লুকিয়ে আলগোছে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে বলল,

-‘এই তোর বাচ্চাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম। আমার ভাগ্যে যদি ওই প্রাপ্তিটা লেখা থাকে, যদি আমি তা পেয়ে যাই, এই জীবনে কোনোদিন আমি সেই প্রাপ্তির অসম্মান, অযত্ন কিংবা অবহেলা করব না। এখন আসি। দরকার পড়লে অবশ্যই কল করবি। আর নিজেও একটু বিশ্রাম নে।’

***

তিনজনে একসাথে হসপিটাল থেকে বের হয়ে তাক্বদীমের গাড়িতে করেই বাড়ির দিকে রওনা হলো। ফারশাদ সামনেই বসলো আর উজমা পিছনে। রাত হওয়াতে ঠাণ্ডা পড়েছে বেশি। চারপাশটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গিয়েছে। যান চলাচলের কারণে আশপাশ স্পষ্ট দেখা গেলেও খুব বেশিদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। দুই পুরুষ একাধারে ক্রিকেট নিয়ে বকবক শুরু করলেও উজমা কোনো কথাই বলল না। সে চুপচাপ সিটে মাথা রেখে নীরবে ওদের কথাই শুনছিল। এক পর্যায়ে তাক্বদীম বলল,

-‘উজমা, আমরা একটা ট্যুর দিতে চাইছিলাম। তুই কবে সময় দিতে পারবি?’

মন একেবারে বিধস্ত উজমার। পারিবারিক ও নিজস্ব জীবনের কিছু জটিলতা নিয়ে। আনন্দ আর ভেতর থেকে বাহির হতে চায় না। এই একটা জীবন নিয়ে যত আশা ছিল, সব একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে। যত স্বপ্ন ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেছে। একজীবনে মানুষ আসলে ঠিক কী নিয়ে শান্তিতে বাঁচে এই একটা প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন খুঁজে পেল না উজমা। যখনই ভাবে, একটু সুখের দেখা পাওয়া যাবে, তখনই কোথা থেকে যেন সব এলোমেলো হয়ে যায়। কাউকে জীবনে জড়াতেও এখন ভয় হয়। আবার নিজেকে সুখী ভাবতে গিয়েও মনে হয়, আদতে সে কোনোদিন সুখী ছিল কি-না। যেখানে মনটাতেই শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, সেখানে ট্যুর কতটা আনন্দের প্রভাব ফেলবে, সে বুঝল না। বন্ধুরা তার মনের অবস্থা জানে না বলেই, কষ্টের ভাগ কোনোদিন নিতে পারেনি। এটা অবশ্য বন্ধুদের দোষ না। দোষটা তারই। সে নিজেই তো শেয়ার করেনি কিছু। এ জাতীয় কিছু অদ্ভুত চিন্তাকে মনে ঠাঁই দিয়ে বলল,

-‘এখন তো সেটা সম্ভব নয়। তোরা কি ডেট ফাইনাল করেছিস?’

-‘না, সেটা এখনও করিনি। আমি শুধু ওদের দু’জনকে জানিয়েছি। ওরা বলেছে, তোরা মেয়েরা যখন ফ্রি হবি, তখন ট্যুর হলেই হবে।’

-‘ওহ, রাইদাহ কি ফ্রি আছে? ওর তো আবার যখন-তখন প্রোগ্রাম থাকে।’

-‘সেটা কাইফ ম্যানেজ করে নেবে। আসলে, তোর পরিবারের এরকম সিচুয়েশনে ফ্রি হওয়াটা বিরাট কষ্টের হয়ে যাবে। আবার তোকে ছাড়া ট্যুর, ভাবতেই পারব না।’

-‘অসুবিধা নেই, এবার নাহয় তোরাই যা। আমি একা মানুষ আর কত তোদের নিজস্ব প্রাইভেসিতে বাঁধা হব। নিজেরই খারাপ লাগে।’

লাস্ট ট্যুরে তো সবাই-ই কাপল ছিল, শুধু উজমা একা মোমকে নিয়েই সময় কাটিয়েছিল। ওদের একেকজোড়া দম্পতিকে ঘুরতে পাঠিয়ে, সে মোমকে নিয়ে সারাদিন বিচে ঘুরে বেরিয়েছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওদের নিজস্ব কিছু মুহূর্তে সে আর কখনও বাঁধা হবে না। ব্যাপারটা খুবই খারাপ দেখায়। হোক বন্ধু, প্রাইভেসি সবারই আছে। উজমার কথায় হো হো করে হেসে উঠল তাক্বদীম। বলল,

-‘তুই এখনও আগের চ্যাপ্টারেই পড়ে আছিস? আসলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর শোনে। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর এবার আমরা সবাই মিলে একটা কাপল ট্রিপ দিব। কিন্তু যা হলো…।’

-‘ওসব কথা বাদ দে, ভাই। ভালো লাগছে না।’

আজ রাতটাই গায়ে হলুদের রাত হওয়ার কথা ছিল। আগামীকাল বিয়ে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে, আজ গায়ে হলুদ হচ্ছে ঠিকই, তবে সেটা উজমার নয় শাম্মার। এই কঠিন সত্যটা খুব সহজে মেনে নিলেও নিজের ভাগ্যের হিসেব মিলাতে পারছে না উজমা। বুঝতেই পারছে না, কেন তার সাথে এমন হচ্ছে। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে আছে। বিয়ে ভেঙেছে, এইভেবে নয়। বরং, শাম্মার কথা ভেবে। সাকিব যে কী পরিমাণ সন্দিহান মনের মানুষ সেটা শাম্মা বুঝতে পারেনি। আল্লাহই ভালো জানেন, মেয়েটার কপালে কী আছে। এতটুকু বিড়বিড় করে মূল রাস্তার সামনে আসতেই উজমা বলল,

-‘এখানেই রাখ, তাক্বদীম।’

-‘কেন? বাড়িতে যাই? এইটুকু রাস্তা হেঁটে যাবি কেন?’

-‘অসুবিধা নেই। আমি একটু হাঁটতে চাইছি। ভাবী বোধহয় অপেক্ষা করছে। তুই আর দেরী করিস না। সারাদিন অনেক ছোটাছুটি করেছিস।’

-‘ওকে…।’

পার্কিং এড়িয়া ঘেঁষে একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়ি থামালে দু’জনেই নেমে পড়ল। ওদের নামিয়ে ঝটপট বিদায় নিল তাক্বদীম। উজমা আস্তেধীরে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। ফারশাদ নিজেও পাশাপাশি হাঁটছে। কেউ-ই কোনো কথা বলছে না। কে জানে হয়তো ওরা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আবার কী বলা উচিত, সেটাই বুঝতে পারছে না। আচমকাই ফারশাদ বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘আজও আমরা পাশাপাশি, কাছাকাছি হাঁটছি। দু’জনের গন্তব্যও এক। তবুও এক আকাশসম দূরত্ব। এই যাত্রা কি দীর্ঘস্থায়ী হতে পার‍ত না? এই দূরত্ব কি শেষ হতে পার‍ত না?’

আড়চোখে ফারশাদের দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের মতো হাঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উজমা। বিড়বিড় শুনেছে, কিন্তু কী বলেছে ছেলেটা, সেটা স্পষ্ট বুঝেনি। ওই সামান্য চাহনিতেই ফারশাদ বুঝল, মেয়েটার মন ভালো নেই। সে একটু জোরেই বলল,

-‘বেবির নাম কী রাখবেন?’

-‘এখনও ভাবিনী।’

-‘আমি একটা নাম দেই?’

-‘দিতে পারেন।’

কথা বলতে গিয়ে বেখেয়ালিতে পায়ে মোচড় খেল উজমা। ফট করে ছিঁড়ে গেল জুতা। এতক্ষণে খেয়াল হলো, তার পায়ে আসলে স্লিপার। মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই।।এই জুতো ছেঁড়ায় মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। সামান্য ঝুঁকে জুতো খুলে উড়িয়ে দিল মাঠের দিকে। খালি পায়েই হাঁটতে শুরু করল। ফারশাদ অবাক হয়ে বলল,

-‘কী করলেন এটা? পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে তো।’

-‘অসুবিধা নেই।’

নীরবতার চাদর গায়ে মেখেই আরও কিছুপথ এগোলো ওরা। স্কুল, মন্দির ও হিন্দুপাড়া ক্রস করে হাঁটতে হাঁটতে আবারও পায়ে মোচড় খেল উজমা। তার মনে হলো এই পা’টাকে যদি কেটে ফেলা যেত। মোচড় খেয়ে এবার একটু গুঙিয়ে উঠল উজমা। ফোনের টর্চ অন করে দেখল, বেয়াদব পা’টাই ভয় পেয়ে আগেভাগে কেটে বসে আছে। আজ কি দুর্ঘটনা ঘটার দিন? একটার পর একটা বিপদ যাচ্ছে। যদিও তার কপালটাই এমন। সবসময় একটা না একটা বিপদ লেগে থাকতে চায়। সে না চাইলেও বিপদগুলো কোত্থেকে যেন উড়ে এসে চেপে বসে ঘাড়ে। মাঝেমধ্যে নিজের ওপরই প্রচণ্ড বিরক্ত হয় উজমা। এখনও হলো। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে পা’টা কেটে যেতে পারল? দূর, বলে নিজেকেই বকলো সে। ফারশাদ দেখল, নীরবে চেয়ে চেয়ে। কেটে যাওয়া পা নিয়ে তবুও মেয়েটা একটু একটু করে হাঁটছে। পা থেকে রক্ত ঝরছে, অথচ কিছু বাঁধছে না। তার কী হলো কে জানে! শক্ত মেজাজে বলল,

-‘একটু দাঁড়ান।’

উজমা দাঁড়াল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল, ফারশাদ তার গায়ের ওড়নার একটা প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। উজমা রেগেমেগে বলল,

-‘কী করলেন এটা? ওড়না ছিঁড়লেন কেন?’

-‘হাতের কাছে আপাতত কিছু নেই, ওড়নাই সমাধান।’

এরপর টুপ করে নিচু হয়ে উজমার ডানপা তুলে নিল নিজের হাঁটুর ওপর। ওড়নার ছেঁড়া অংশ পায়ে বেঁধে বলল,
-‘এবার হাঁটুন। ব্যথা কম হবে।’

ফারশাদ উঠে দাঁড়ালে আবারও ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করল উজমা। এবার ব্যথা একটু কম লাগছে। ধন্যবাদ দিতে গিয়েও থেমে গেল। কথা বলতে ভালো লাগছে না। ফারশাদ নিজেও খানিকটা ইতস্ততভাব নিয়েই হাঁটছিল। এটা বোধহয় খেয়াল করল উজমা। একসময় নীরবতা ভেঙে বলল,

-‘বেবির নাম পেয়েছেন?’

ফারশাদ হাসিমুখে বলল,
-‘আমি নাম দিলে কি পছন্দ হবে?’

-‘কেন হবে না? দিয়েই দেখুন।’

কিছুক্ষণ ভাবল ফারশাদ। উসাইদ ও মিশকাতের নাম এক করেও সুন্দর কোনো নাম পেল না। একটা সময় ভাবনা থামিয়ে বলল,

-‘আপনি চাইলে মাশিয়াত বা উপমা রাখতে পারেন। যদি চয়েস হয় আরকি।’

-‘দুটো নামই সুন্দর।’

নাম নিয়ে কথা শুরু হলেও কয়েক মিনিটের রাস্তা টুকটাক কথা বলেই এগোলো দু’জনে। ফারশাদ মনে মনে চাইল, এই রাত দীর্ঘ হোক, এইমুহূর্ত চিরস্মরণীয় হোক, কিন্তু কীভাবে? মনের কথা বলার সুযোগটা কি আজই? না-কি আরও সময় নিবে? উঁহু, ঠিক কখন বললে এই রমণী রি’অ্যাক্ট করবে না, রেগেমেগে গর্জে উঠবে না। এমন একটা সময়ে বলতে হবে, যখন উজমার মেজাজটা গরম থাকবে। টগবগ টগবগ করে ফুটতে থাকা উত্তপ্ত মেজাজে যেন তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তিটা এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে। যদিও এমন মুহূর্ত আসবে কি-না নিশ্চিত নয় সে। তবুও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে দোষ কী?

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – চৌদ্দ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

জীবন বড্ড ছোট্ট। ছোট্ট এই জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করলে প্রাপ্তির সংখ্যা খুবই কম হলেও এসব নিয়ে শূণ্যতা, হাহাকার, কিংবা কোনোপ্রকার হা-হুতাশ নেই উজমার। সে জানে, এই জীবনে প্রত্যেকটা মানুষের প্রতিটাদিন অতিবাহিত করার পিছনেই কোনো না কোনো কান্না-হাসির নানান মিশেলের গল্প ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকে। তার নিজের জীবনেও এরূপ গল্প আছে বিধায় সে চায়, তার হাসির গল্প সবাই জানুক, কিন্তু কান্নার গল্প আড়ালেই থেকে যাক, সবসময়। এজন্য নিজেকে খুব করে শক্ত রাখে সে। কিন্তু ইদানীং, বেশ কিছু ধাক্কা একাধিক বার সামলাতে গিয়ে মনের ওপর চাপ পড়ছে বেশি। এর কারণে একেকটা দিন বড়ো যন্ত্রণায় কাটে। তবুও হাসিমুখে সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করে কষ্ট লুকাতে বাধ্য হয়। জীবনটাকে যে হাজারও প্রাপ্তি দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে এ-ও নয়। তবুও কিছু বিষাদ, কিছু দুঃখ সারাক্ষণ তার মনটাকে নানারকম চিন্তাভাবনার ভীড়ে ঠেলে নিয়ে যায়। সে না চাইলেও সেইসব ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে সারাক্ষণ। মাঝেমধ্যে ভাবে, জীবনটা আসলে কেন! জন্ম না নিলেই কী হতো এই পৃথিবীতে? কেন-ই বা জন্ম, কেন-ই বা মৃত্যু? এতকিছু ভাবতে গিয়ে আবারও শুরু থেকে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে, ফলাফল তীব্র মাথাব্যথা, মেজাজ খারাপ ও মনের কঠিন ব্যামো।

ফারশাদের সাথে টুকটাক গল্প করতে করতেই এগোচ্ছিল উজমা। হঠাৎই ফারশাদ জানতে চাইছিল, তার জীবনের লক্ষ্য কী? ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই অন্তহীন ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল উজমা। উত্তর তো খুঁজে পেলই না, উলটে মেজাজের বারোটা বেজে গেল। কোনোমতে বলল,

-‘তেমন কোনো লক্ষ্য নেই। ভাই-বোন ও বাবার জন্য ভাবা, হসপিটালে রোগীদের সেবাযত্ন করা, মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করা। যতটুকু ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে কোনো অনাথ কিংবা পথশিশুর পাশে দাঁড়ানো, বন্ধুবান্ধবদের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া, এরপর দিনশেষে পরিবারের সবার সাথে একই টেবিলে খাবার খাওয়া আর একটা শান্তির ঘুম দেয়া। এসব ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই।’

ফারশাদ প্রাণবন্ত হেসে বলল,
-‘তা-ও ভালো, আপনি আপনার এই সময়টাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপভোগ করতে পারছেন। আমি তো সেটাও পারি না।’

-‘কেন?’

-‘সময় হয় না আসলে। খেলা, প্রাকটিস, এগুলোর জন্য আমি বছরের বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই থাকি। খুব প্রয়োজন হলে বাড়ি যাই। যেমন এবার গিয়েছিলাম, মায়ের চাপাচাপিতে। তা-ও অনিচ্ছায়। আমি তো বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই শান্তি খুঁজে পাই। দিনশেষে ভাবার জন্য কেউ নেই, শুধু ফাবিহা ছাড়া। কখনও কখনও ওর জন্যই বাড়িতে যেতে হয় আমাকে। নয়তো…।’

ততক্ষণে ওরা বাড়ির সীমানায় এসে পড়েছে। উজমা কথা এড়িয়ে যেতে গেট পেরিয়ে এসে ঘরের ভেতর পা রাখল দ্রুত। ফারশাদ এগোতে এগোতে বলল,

-‘একটা ওয়াটার হিটার হবে?’

-‘কেন?’

-‘শাওয়ার নিতাম। হসপিটাল থেকে এসেছি তো। শাওয়ার না নিয়ে ঘুমোতে পারব না।’

মাথা নেড়ে নিজের রুমে প্রবেশ করল উজমা। শোকেস খুলে পানি গরমের ছোট্ট হিটার বাড়িয়ে দিল ফারশাদের দিকে। হিটার হাতে নিয়েই নিজের রুমে গেল ফারশাদ। উজমা এলো রান্নাঘরে। রান্নাবান্না সব সামলানো শুধু গরম করতে হবে। সে খুব দ্রুত ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল সেরে, পায়ে সামান্য ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে চুলোয় তরকারি বসিয়ে একটা একটা করে সবক’টা তরকারি গরম করতে বসাল। পাশাপাশি এক কাপ কফি করে নিল নিজের জন্য। বাবা ও ফারশাদকে একসাথে খেতে বসিয়ে পরে সে খেয়ে নেবে, এরকমটাই ছিল উদ্দেশ্য। সবকিছু গুছিয়ে, পরিপাটি করে উসমান ওয়াজেদকে খাবার বেড়ে দিয়ে মাত্রই কফিতে চুমুক বসিয়েছিল, এরমধ্যেই ফট করে একটা শব্দ হওয়ার পাশাপাশি কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ কানে এলো, আর সঙ্গে সঙ্গে গেস্টরুমের বাতি নিভে গেল। শব্দ পেয়েই গেস্টরুমে উঁকি দিল উজমা। ওয়াশরুমে তখনও পানির শব্দই শোনা যাচ্ছে। সে টর্চ হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে লাইট চেক করতে দিয়ে দেখল, ওটা ব্লাস্ট হওয়ার কারণে শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। রুম অন্ধকার থাকবে ভেবে বারান্দায় এসে দুটো বাতি থেকে একটা বাতি খুলে নিল। ভাবল, ফারশাদ ওয়াশরুমে থাকতে থাকতে বাতিটা বদলে রুম পরিষ্কার করে ফেলবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। ব্যথাতুর পা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এসব কাজ করতে গিয়ে স্টাডি টেবিলের ওপর উঠে বাতি বদলে অন্য বাতি লাগিয়ে সেটা আর সুইচ দিতে পারল না। স্টাডি টেবিল থেকেই পা ফসকে গেল তার। পায়ের নড়বড় অবস্থা টের পেয়ে ভয়ে চিৎকার দিল উজমা। সাথে সাথে আঁচড়ে পড়ল কোথাও। ব্যালেন্স রাখতে দু’হাতে শক্ত করে ধরল, হাতের কাছে যা পেল তা। ভয়ের কারণে ক্রমাগত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হাত টেনে আনতে গিয়েই বুঝল, সে কারও কণ্ঠনালীতে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। ফারশাদের ভেজা ও উন্মুক্ত ঘাড়ের কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে ধড়ফড়িয়ে উঠে নামতে চাইলে এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে ফারশাদই তাকে বাঁচিয়ে নিল। কোল থেকে নামিয়ে বলল,

-‘কিছু একটার শব্দ শুনেছিলাম।’

-‘বাতি ফিউজ হয়ে গিয়েছিল। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেতে আসুন।’

এইটুকু বলে আর কোনোদিকেই তাকাল না উজমা। মুখ নামিয়ে বাতি জ্বালিয়ে রুম পরিষ্কার করে একছুটে বেরিয়ে এলো। ফারশাদ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে হাসলো। আলগোছে হাত রাখল ঘাড়ে। ওখানে এখনও উজমার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ভারি খাচ্ছে। সে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করল,

-‘কাঙ্ক্ষিত নারী যখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ছুঁয়ে যায়, তখন তো প্রেমিকমন আরও বেসামাল হয়ে পড়ে, বাটারফ্লাই। ছুঁয়ে দিয়ে নেশা তো বাড়িয়ে দিলেন আপনি। এখন এই নেশা আমি দূর করব কীভাবে?’

***

উসমান ওয়াজেদ খাচ্ছেন ঠিকই তবে খেতে দিয়ে অর্ধেক ভাত তরকারি-ই তিনি নষ্ট করে ফেলছেন। মাছও ঠিকঠাক বেছে খেতে পারেন না। উজমা দ্রুতই এসে দাঁড়াল বাবার পাশে। আলাদা একটা বাটি এনে ভদ্রলোকের হাত ধুইয়ে নিজেই বাবাকে খাইয়ে দিতে লাগল। তিনি একটু একটু করে খাচ্ছেন আর চারপাশে তাকাচ্ছেন। সম্পূর্ণ ঘর ফাঁকা দেখে বললেন,

-‘বউমা কোথায়, বড়ো মা? এখনও ফিরেনি? উসাইদকেও সারাদিন ধরে দেখছি না।’

-‘ভাবী তো হসপিটালে। তিনদিন পর ফিরবে। ভাইয়াও আছে। সকালে ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। হাতে অনেক ব্যথা পেয়েছে।’

-‘আর আমার নাতনী?’

মানুষটা সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও নিজের আপনজনদের কখনও ভুলতে পারেন না। পিছনের স্মৃতির খণ্ড খণ্ড অংশ মনে যেমনই থাকুক, সংসারে কতজন মানুষ, কে কী করে, এসব ঠিকই মনে রাখতে পারেন। সকালে তিনি দেখেছিলেন, মিশকাতকে নিয়ে সবাই কীভাবে দৌড়েছে। সারাদিন ঘরে অপেক্ষা করছেন, সন্তানেরা ঘরে ফিরবে কখন, এসব ভেবে। দিনশেষে যখন একজনকে দেখলেন, মনে প্রশ্ন জাগলো তাঁর। তা-ই মেয়ের কাছে জানতে চাওয়া। বাবার কথা শোনে হাসিমুখে নিজের ফোন কাছে টেনে নিল উজমা। লক খুলে গ্যালারি ওপেন করে ছোট্ট নবজাতকের ছবি তুলে ধরল বাবার সামনে। বলল,

-‘দেখো, এটাই তোমার নাতনী।’

তিনি আপনমনেই বিড়াবিড়ালেন,
-‘মাশা’আল্লাহ।’

বাবার সাথে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজবের বাহানায় সবটুকু ভাত খাইয়ে, ঔষধ নিয়ে এলো। উসমান ওয়াজেদ ঔষধ দেখেই ঘাড় বাঁকিয়ে বসলেন। বললেন,

-‘এগুলো খাব না, বড়ো মা। নিয়ে যা।’

-‘খেয়ে নাও, বাবা। তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে তো।’

-‘আমি কি অসুস্থ? আমি তো সুস্থই।’

-‘হ্যাঁ, তুমি সুস্থ। জ্বর, সর্দি-কাশি এসব কিচ্ছু নেই। তবুও এই ঔষধ খেতে হবে। খাও…।’

বাবার মুখের সামনে ঔষধ ধরে রাখলে, তিনি উজমার হাত ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। গটগট পা ফেলে নিজের রুমে চলে যেতে চাইলেন। উজমা দ্রুতপায়ে ভদ্রলোককে থামাল। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলল,

-‘খেয়ে নাও না, বাবা। জেদ কোরো না।’

-‘একবার বলেছি খাব না। আর জোর করবি না। দূরে সর।’

মেয়েকে সরিয়ে তিনি আবারও হাঁটা ধরলেন। প্রতিদিন এই কাহিনী সামলাতে সামলাতে ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে ফেলছে উজমা। নিত্যই ঔষধ নিয়ে এই জেদ, এই ছোঁড়াছুড়ি, ভাঙাভাঙি, এগুলো এখন আর ভালো লাগে না। একটা মানুষকে আর কত সাপোর্ট দিলে, মানুষটা সুস্থ হয়ে উঠবে সেটাই বুঝে উঠতে পারে না উজমা। প্রতিবার ধৈর্যেরা হেরে যায় ক্লান্তি, বিষণ্ণতা ও হতাশার কাছে। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ। এই তিনটে ভাই-বোন একাধারে বাবাকে চিকিৎসা দিচ্ছে, যত্ন নিচ্ছে, সাহস ও ভরসা দিচ্ছে, সব ধরনের পারিবারিক ঝুটঝামেলা থেকে দূরে রাখছে, যেন মানুষটা দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। অথচ তাদের সব চেষ্টা দিনশেষে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাবার এই জেদ দেখে উজমা বলল,

-‘আমি কিন্তু মায়ের কাছে চলে যাব। তুমি যদি আমাকে সারাদিন ধরে খুঁজো, তা-ও পাবে না। দেখো, আমি সত্যিই মায়ের কাছে চলে যাব এবার।’

উসমান ওয়াজেদ থেমে গেলেন। ‘মায়ের কাছে চলে যাওয়া’ বলতে মেয়েটা কী বুঝিয়েছে, সেটা বুঝেই পায়ের জোর হারিয়ে ফেললেন তিনি। বাচ্চাদের মতো হাত বাড়িয়ে বললেন,

-‘দে ঔষধ।’

ঔষধ বাড়িয়ে দিতেই তিনি আর দ্বিরুক্তি করলেন না। টুপ করে খেয়ে ফেললেন। উজমা আদুরে হাতে বাবাকে ধরে ধরে রুম পর্যন্ত এসে মশারী টানিয়ে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে বলল,

-‘ঘুমোও। কিছু লাগলে আমাকে ডেকো।’

***

ফারশাদ খেতে আসছে না, এদিকে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। একটা শান্তির ঘুমের বড্ড প্রয়োজন। গতকাল রাতেও ঘুমোয়নি। হসপিটালে রাতের শিফটে ঘুম হয় না। রোগীদের নিয়েই রাত কেটে যায়। ফাঁকে একটু ঘুমোনোর সুযোগ এলে, বাকিদের আড্ডা ও মাস্তির কারণে ঘুম উড়ে যায়। সে-ও যোগ দেয় আড্ডায়। খাবার ঢেকে রেখে গেস্টরুমের দরজায় এসে নক করল উজমা। ‘এইযে কোথায় আপনি? খেতে আসুন’ এভাবে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। কেমন জানি শোনাচ্ছে। নিজের গলার আওয়াজই নিজের বিরক্ত লাগছে, আবার মনে হচ্ছে, এভাবে কেউ কাউকে ডাকে, ‘এইযে’ দূর। তখনকার পরিস্থিতির কথা মনে হতেই আরও ঘাম ছুটলো তার। মিনমিন স্বরে ডাকল,

-‘এ্যাক্সকিউজ মি, ভাইয়া। শুনছেন?’

এক আকাশসম অনুভূতির মাঝখানে কেউ যেন আচমকাই বজ্রপাত টেনে আনলো। ঠাস ঠাস আওয়াজে মন বেচারা ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেল। কতক্ষণ ধরে আবেগে, আবেশে, ভালোবাসা নামক সুপ্ত অনুভূতিকে ঘিরে কিছু মোহময় ভাবনায় বিভোর ছিল, ফারশাদ। তার সবটুকু আবেগের মধ্যে তিতকুটে নুন ঢেলে দিল উজমা, তা-ও ভাইয়া ডেকে। বিরক্তিতে ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো সে। তুফানের মতো ছুটে এলো উজমার সামনে। পর্দা সরিয়ে কটমট মেজাজে চেয়ে থেকে বলল,

-‘কে ভাইয়া?’

ফারশাদের দাঁড়ানোতে উজমা একটু ভয় পেয়েছিল। হঠাৎ করেই এসে দাঁড়িয়েছিল সে। সে-ই ভয়টা আরও বেড়ে গেল, গমগমে গলার ‘কে ভাইয়া’ শোনে। থতমত খেয়ে বলল,

-‘কেন আপনি!’

-‘আমি আপনার কোন কালের, ভাইয়া? খালাতো, মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো, কাজিন লাগি আমরা? আমি আপনার ভাই হলাম কবে?’

আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে যেন চড়ে বসলো উজমা। ভাইয়া ডাকে কী খারাপ আছে, সে বুঝলোই না। সম্মান দিয়ে ডাকল। যেহেতু বয়সে বড়ো, আবার ভাইয়ের বন্ধু। নাম ধরে ডাকা যায় না। আবার এইযে, এইযেও করা যায় না। এতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো? না-কি পাপ হলো? পলকহীন চোখে চেয়ে উজমা বলল,

-‘আপনি তো ভাইয়ার বন্ধু।’

-‘তো?’

-‘ভাইয়ার বন্ধু মানে আমারও ভাই।’

-‘কোথায় লেখা আছে, ভাইয়ার বন্ধু মানে আপনারও ভাই?’

-‘ভাই নাহলে কী? ভাই-ই তো।’

ফারশাদ বেজায় বিরক্ত হলো। ত্যক্তবিরক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘ফাজলামি রাখুন প্লিজ। আমি কিন্তু সিরিয়াস। আপনি আমাকে আর ভাই ডাকবেন না। শুনতে ভালো লাগে না।’

-‘আমিও সিরিয়াস। আপনি ভাইয়ার বন্ধু। আমার সিনিয়র। সেই হিসাবে ভাইয়ার বন্ধু তো আমারও ভাই-ই হবে। আমি আপনাকে ভাই-ই ডাকব।’

দাঁতে দাঁত চেপে ফারশাদ বলল,
-‘অন্য সবার ক্ষেত্রে ভাই হলেও আমার বেলায় হিসেবটা সামান্য উলটো হবে।’

-‘যেমন?’

-‘ভাইয়ার বন্ধু ভাই হলেও, বন্ধুর ছোটোবোন মোটেও আমার বোন নয়। তাকে আমি বোন হিসেবে মানতে পারব না।’

-‘কেন পারবেন না? কীসের অসুবিধা?’

-‘যে আমার মনের জমিন দখল করে বসে আছে সে তো আমার বউ হবে। জীবনসঙ্গিনী হবে। তাকে বোন হিসেবে মেনে নেয়া অসম্ভবই।’

যেভাবে আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে চড়েছিল, ঠিক সেভাবেই ধপাস করে জমিনে পড়ে গেল উজমা। চোখদুটো কুটোরে ঢুকে গেল তার। সেইসাথে সবটুকু রাগ ছিঁড়বিড়িয়ে মাথায় উঠে গেল। শক্ত মেজাজে বলল,

-‘আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন। বুঝে কথা বলুন।’

-‘বোঝেই বলছি, উজমা। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আমি আপনাকেই চাই। আমার দিক থেকে আমি কোনো বোন বোন ফিল পাচ্ছি না। স্যরি, আপনাকে আমি বোন মানতে পারব না।’

-‘আশ্চর্য! এটা কোন ধরনের কথা?’

-‘এটাই কথা, উজমা। মানা না মানা আপনার ব্যাপার।’

নিজের জায়গা স্পষ্ট করতে উজমা বলল,
-‘আমি কখনও আপনাকে ওই চোখে দেখিনি, দেখতে পারবও না।’

-‘কিন্তু আমি তো দেখছি। মনের চোখ দিয়ে। মনের মানুষ হিসেবে।’

-‘বাড়াবাড়ি করছেন।’

-‘আপনাকে নিয়ে একশোবার বাড়াবাড়ি করতে পারি, উজমা। মন থেকে সেই সায় আমি পেয়েছি। তাই মনের কথাই শুনব।’

-‘আমি আপনাকে নিয়ে কোনোদিন এসব ভাবতে পারব না। বোঝার চেষ্টা করুন।’

-‘সেটা আপনার ব্যাপার, উজমা। মন আপনার, তাকে পোষ মানানোর দায়িত্বও আপনার। আর আমার মনের দায়িত্বটাও সম্পূর্ণ আমার। তাই আমি কাকে ভালোবাসব, কাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বাছাই করব, সেটাও আমার মনেরই দাবী। মন যা চাইবে, আমি তা-ই করব। এতে আপনি রাগ করুন কি যা-ই করুন, আই ডোন্ট কেয়ার। অনেক বছর পর মন আমার কারও মায়ায় পড়েছে, কাউকে ভালোবেসেছে, আপন করতে চাইছে। এজন্য, কোনোভাবেই আমি আমার মনের সাথে বেইমানী করব না। ভালো আমি আপনাকেই বাসব, সেটা আপনি চান বা না চান।’

সাহস নিয়ে এই কথাগুলো রুমে প্রবেশ করল ফারশাদ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এলো। উজমা তখন নিজের জায়গায় পাথর, অনড়, বেকুব। তাকে এইভাবে স্তম্ভিত, হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মজা পেল ফারশাদ। মুচকি হেসে চট করে নিচে বসে গেল। আগের মতোই উজমার কেটে যাওয়া পা’টা তুলে নিল হাঁটুর ওপর। ছোট্ট বাক্স থেকে বের করল একটা রূপোর আংটি। চোখের পলকের ব্যবধানে সেই আংটি পরিয়ে দিল উজমার পায়ের দ্বিতীয় আঙুলে। সাহস নিয়ে বলল,

-‘সবাই তো হাতে আংটি পরিয়ে ভালোবাসি বলে। আমি নাহয় পায়ে আংটি পরিয়ে আমার ভালোবাসাকে আপন করে নেয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। যখন মন সায় দিবে, আমার ভালোবাসাকে সাদরে গ্রহণ করে নিবেন। আর যদি মন থেকে সায় না আসে, তাহলে এই আংটি ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। আমি বুঝে নেব, আপনার মনের না বলা কথা। বুঝে নেব, আমার মনপাখি আমাকে নয়, অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।’

‘ভালোবাসা’ শব্দটার গভীরতা কতবেশি, সেটা যদি সবাই বুঝত, এত সহজে ও কম সময়ে কাউকে ভালোবাসতে পারত না। ফারশাদের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথা শোনে, তার মনে হলো, একটা ছোট্ট বাচ্চা পছন্দের চকলেটের জন্য বায়না ধরেছে। এখন এই চকলেটটা তার চাই-ই চাই। না পাওয়া পর্যন্ত চকলেটের বায়না চলতেই থাকবে। সে এই ক’দিনের পরিচয়ে চেনা একটা মানুষের ‘ভালোবাসি’ বলে সহজেই ভালোবাসাকে সত্যিকার অর্থে ‘ভালোবাসা’ হিসেবে মেনে নিতে পারল না। হুঁশে ফিরে চট করে পা সরিয়ে নিল। আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখল, দুটো ছোটো ছোটো ফুলের ডিজাইনের চমৎকার একটা আংটি। এই অদ্ভুত কাজে তীব্র রাগে মেজাজের দফারফা ঘটে গেলেও নিজেকে খুব শান্তই রাখল উজমা। পা তুলে আংটিটা খুলে ফেলতে চাইলে ফারশাদ বাঁধা দিয়ে বলল,

-‘প্লিজ, এখুনি না।’

অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল উজমা। ফারশাদের না শোনেও সে কথা আমলে না নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই আংটি খুলে সেটা ফারশাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ভালোবাসার মতো জঘন্য অনুভূতি আমার জীবনে আসুক, তা-ও আপনার মাধ্যমে, এটা কোনোদিনও চাইব না। প্রয়োজনে মনকে আমি লোহার শিকলে বেঁধে রাখব, তবুও আপনাকে ভালোবাসার মতো ভুল করব না।’

আহত চোখে তাকিয়ে রইল ফারশাদ। ‘ভালোবাসি’ বলার মতো উপযুক্ত সময় এটা নয়, সেটা বুঝেও উজমার এই ‘ভাইয়া’ ডাক শোনে, মেজাজ হারিয়ে বোকার মতো একটা কাজ করে বসে, নিজের ওপরই তার রাগ হচ্ছে এখন। তবুও বলল,

-‘আমার অপরাধ কী, জানতে পারি?’

উজমা নিরুত্তর। অযথা অতীত টানার দরকার নেই। তার নীরবতাতেই কতকিছু যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল ফারশাদের কাছে। সে মন খারাপের সুরে বলল,

-‘আমি মুনমুন হক্বের সন্তান, এটাই কি আমার অপরাধ উজমা?’

এবারও চুপ করে রইল উজমা। কোনোকিছুই বলতে পারল না। ফারশাদ বলল,
-‘প্রতিটা মানুষ ও তাদের অনুভূতি, বিচার-বিবেচনা, বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান ও দক্ষতা যে সম্পূর্ণ আলাদা হয়, এটা কি আপনি জানেন না?’

এটা খুব ভালো করেই জানে উজমা। প্রতিটা মানুষ যেমন আলাদা, তাদের চলাফেরা, শিক্ষাদীক্ষা, বুদ্ধি-বিবেচনা সবটাই আলাদা। কোনো একজনই অন্যজনের সমকক্ষ নয়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে অনুভূতি জন্ম নেয়ার আগেও দশবার ভাবা উচিত যে, দুটো মানুষের জীবনযাপন কোনোভাবেই একই সূত্রে গাঁথা নয়। কোথায় আসমান আর কোথায় জমিন। ফারশাদ কেন ভুলে যাচ্ছে এটা। সে ফারশাদের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে বলল,

-‘দেখুন, আমি জানি প্রতিটা মানুষ আলাদা। আপনি ও আপনার মা-ও আলাদা। কিন্তু তবুও, আপনার এই অনুভূতিকে সম্মান জানানোর মতো সাহস, ইচ্ছে-আগ্রহ কিংবা মনের জোর কোনোকিছুই আমার নেই। একজন মানুষ হিসেবে আমি আপনাকে সম্মান করি, আপনার অনুভূতিকেও শ্রদ্ধা জানাই। মানুষ মাত্রই ভুল ও শুদ্ধের সমষ্টি। একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে ভালোবাসতেই পারে, তাকে নিজের অনুভূতির কথা জানাতেও পারে, এতে আমি ভুলের কিছু দেখছি না।’

-‘তাহলে? কেন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন আপনি?’

-‘প্রতিনিয়ত আমরা সমাজ নিয়ে চলি, সমাজের মানুষজনকে নিয়ে চলি। হুট করে এই সমাজের মানুষ যখন জানবে, নামকরা ক্রিকেটারের সঙ্গে একটা সাধারণ ঘরের মেয়ের মনের লেনদেন গড়ে উঠছে, তখন সবাই প্রথম চান্সেই, আঙুল তুলবে আমার দিকে। সবারই বদ্ধমূল ধারণা হবে, টাকার লোভে বড়োলোকের ছেলেকে পটিয়ে তার গলায় ঝুলে পড়েছি আমি। এটা সাধারণ যুক্তি। যে কারো মনেই এই ধারণা জন্ম নিবে। এমনিতেই সমাজের চোখে আমি কলঙ্কিনী, চরিত্রহীনা, দুঃশ্চরিত্রা। আর আপনি একজন নামীদামী মানুষ। আপনার সাথে আমার নামটা জড়ানোর সাথে সাথে, নানারকম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। আমাকে নিয়ে লোকে নিন্দে বলে বলুক, আমি এসব কথা কানে জায়গা দেই না। কিন্তু আমার কারণে আপনার ও ভাইয়ার সম্মান নষ্ট হয়ে যাক, সাধারণ মানুষের কাছে আপনারা ছোটো হোন, আমি সেটা চাই না। চাইতে পারব না।’

ফারশাদ অনুরোধের সুরে বলল,
-‘এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। সব আমার ওপর ছেড়ে দিন।’

-‘কেউ না চাইলেও জোর করে তার মনে জায়গা করে নিতে পারবেন?’

-‘ভালোবাসায় জোরাজুরি চলে না, এটা আমি জানি। আপনি এতকিছু যেহেতু ভাবছেন, তার মানে আমার অনুভূতিটা আপনার কাছে তুচ্ছ নয়, এজন্যই ভাবছেন।’

-‘আমি আগেই বলেছি, আমি আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি। তার মানে এই না যে, আমিও আপনাকে ভালোবাসি। অনুভূতিকে সম্মান করা ও ভালোবাসার পিঠে ভালোবাসি বলা, দুটোই আলাদা।’

এত তর্কবিতর্ক আর ভালো লাগছে না ফারশাদের। সে সব কথার একটা উপযুক্ত জবাব নিতে বলল,
-‘আমাকে ভালো না বাসার একটা স্পষ্ট ও যৌক্তিক কারণ দেখান, যা আপনার মতের বিরুদ্ধে।’

বেকায়দায় পড়ল উজমা। আর কী যৌক্তিক কারণ দেখাবে ভেবে পেল না। এই ছেলেটা না চাইতেও অতীতের জঘন্য স্মৃতিতে ধাক্কা দিয়েছে। যেখানে মুনমুন হক্বের মতো মানুষের আনাগোনা জড়িয়ে আছে, সেখানে উজমা ওয়াজেদাহ বড্ড ঠুনকো। এরূপ ভালোবাসা সাময়িক মোহ ছাড়া আর কিছুই না। সে বড়োলোকের সন্তান। ক’দিন দেখেছে, মায়ায় পড়েছে, পরিস্থিতি দেখে করুণা করে ‘ভালোবাসি’ বলে নিজেকে মহাপুরুষ সাজাতে চাইছে। যতই সে ভালোবাসার বুলি আওড়ে যাক, আগাগোড়া সে মুনমুনের হক্বেরই সন্তান। স্ট্যাটাস, যোগ্যতা কিছুই এক না। সব আলাদা। এখান থেকে চলে গেলেই এই মোহ কেটে যেতে পারে। এবং সে এটাও বুঝে যাবে যে, মোহে পড়ে নর্দমায় মন ডুবিয়েছিল। ভেবেচিন্তে এবার একটা শক্তপোক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়ে উজমা বলল,

-‘অল্প ক’দিনের পরিচয়ে কাউকে সম্পূর্ণ না জেনে, সামান্য চোখের দেখা থেকে যে ভালোবাসা আপনার মনে সৃষ্টি হয়েছে, তার স্থায়ীত্ব খুবই সীমিত এবং এটা সাময়িক মোহ। চোখের আড়াল হওয়া মানেই মনের আড়াল হওয়া। মনের আড়াল হওয়া মাত্রই সব মোহ কেটে যাবে আপনার।’

নিজের কথা, অনুভূতি ও ভালোবাসাকে সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরতে গিয়ে ফারশাদ খুব সাহসের সাথেই বলল,

-‘এটা যে মোহ নয়, সেটা আপনিও বুঝে গেছেন এতক্ষণে। আর ভেঙেচুরে বলতে হবে না। ভালোবাসার জন্য আমি আপনাকে জানতে নয় উজমা, বুঝতে চাই। আপনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে চাই। আমার কাছে আপনাকে জানার চাইতে বোঝা ও উপলব্ধি করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি আপনাকে বুঝতে চাই, আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আপনার কষ্ট দূর করতে চাই। আপনি কি এই অনুমতি দিতেও কার্পণ্য করবেন, বাটারফ্লাই?’

***

চলবে…