মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-১১

0
54

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – এগারো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

বন্ধুত্ব খুব চমৎকার ও বিশ্বস্ত একটা সম্পর্ক। এই সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ একে-অন্যের মনের খবর জানে, দুঃখ-কষ্ট, চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান, রাগ-ঘৃণা সবকিছুই জানে। এই সম্পর্কে বিশ্বাস আছে বলেই এখানে থাকা একেকজন মানুষ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। যেকোনো বিপদ-আপদ এলে একে-অন্যকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট ও সহানুভূতি দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে। যে সম্পর্ক এত বিশ্বস্ত, সেখানে কোনোপ্রকার ভয়ভীতি ও মনের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত না। তবুও উসাইদ এইমুহূর্তে ভয়ে ডুবে আছে। শৈশব ও কৈশোরে যে ফারশাদকে সে চিনেছে, বুঝেছে, সে-ই ফারশাদ আজও একই আছে কি নেই, এটা বিরাট একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তার মনে। এই কারণে সম্পর্ক বিশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও ফারশাদের প্রস্তাব এত জলদি গ্রহণ করে নেয়ার সাহস সে পেল না।

বন্ধুত্ব যেমনই হোক, যোগাযোগ ছিল না বহুবছর। এত বছরে একটা মানুষের মধ্যে শারিরীক, মানসিক অনেক পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। ফারশাদেরও নিশ্চয়ই এসেছে। একটা সময় যে ফারশাদ ছিল, বাবা-মায়ের অবাধ্য, নিজের মতামত ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া ব্যক্তি, সে-ই ফারশাদ আজও একই আছে না-কি পালটেছে, এইটুকুই ক্ষণে ক্ষণে উসাইদের মনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফারশাদ যেমনই হোক, তার পরিচয় এখন সে এই দেশের নামকরা ক্রিকেটার। তার সাথে এক সাধারণ ঘরের, সাধারণ মেয়েকে একেবারেই মানায় না। বেমানান ও বেখাপ্পাই লাগবে। রাজপুত্রের জন্য রাজকন্যাই মানানসই। কোনো কুঁড়েঘরে বেড়ে ওঠা সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত উজমা এই রাজপুত্রের জীবনে বড্ড বেমানান, এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

ফারশাদের এই প্রস্তাব কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে উসাইদকে। মুহূর্তেই মন খুঁজে বেরিয়েছে ফেলে আসা স্মৃতি। যদিও সেই স্মৃতিতে ফারশাদ আপাদমস্তক একজন ভালো বন্ধু, শুধু কোনো একটা জায়গায় এই বন্ধুত্বের সুতোটাও বড্ড নড়বড়ে। এজন্য বাল্যবন্ধুর এই প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারল না উসাইদ। বলল,

-‘তেল আর জল তো কোনোদিন মিলে না রে, ভাই।’

মোরশেদ জামান ভাগনের এই কথা শোনে অবাক হলেন বটে। চুপও রইলেন। ঊষা ছটফটিয়ে উঠল। ফারশাদের প্রস্তাব শোনে সে ভীষণ খুশিতে টুপ করে মিশকাতের হাত চেপে ‘ইয়াহু’ বলে নিজের খুশিটা মাত্রই প্রকাশ করেছিল, এরমধ্যেই উসাইদের এই কথায় কানে প্রবেশ করতেই শুকনোমুখে ভাবীর দিকে চেয়ে থেকে ঠোঁট উল্টিয়ে পরবর্তী কথা শোনায় মনোযোগ দিল। বন্ধুর এই কথায় ফারশাদ সামান্য হেসে বলল,

-‘তাই না-কি? কেন এই কথা মনে হলো? ওহ, তোর কী ধারণা হয়েছে জীবনে নাম-পরিচয় কামিয়েছি বলে মন-মানসিকতা পালটে গিয়েছে?’

উসাইদ আমতা-আমতা করে বলল,
-‘আসলে, তুই আর উজমা ঠিক ম্যাচ করবে না। এটা হয় না, শাদ। প্লিজ, তুই তোর কথা ফিরিয়ে নে।’

-‘কেন হয় না? আমি তোর বোনের অযোগ্য? মানুষ হিসেবে খারাপ? না-কি আমার চরিত্রে দোষ আছে? ঠিক কীসের জন্য কথা ফিরিয়ে নেব, বলবি?’

-‘সম্পর্কটা সমানে সমানে হওয়া উচিত, শাদ। এতে দুই পক্ষের মাঝেই সমঝোতা, বোঝাপড়া ও…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারশাদ বলল,
-‘তুই কি বলতে চাস? এরজন্য তোর বোনকে আমি কোনোদিন ছোটো হতে দেব? কিংবা এই সমাজের চোখে তাকে ছোটো করব? এরকম কিছু?’

বলতে গিয়েও বার বার ফিরে আসছে উসাইদ। তার মনের ভয় দূর হচ্ছে না। বোন যে ওখানে ভালো থাকবে না, সেটা তো সে-ই ভালো বুঝতে পারছে। অনেকক্ষণ পর এবার মোরশেদ জামান বললেন,

-‘উসাইদ আমি একটা কথা বলি। ও যেহেতু প্রস্তাব রেখেছে, ওর প্রস্তাবটা ভেবে দেখ। এমনিতেই লোকের মুখের নানান কথায় উজমার মনের ওপর চাপ পড়ছে। এই কানাঘুঁষা যত বাড়বে, ও ততই নিজের মনের জোর হারিয়ে ফেলবে। শ্যাষম্যাশ, উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তও নিতে পারে। ওর প্রস্তাবটা ফেলে দেয়ার মতো নয়। তুই তোর বোন বিয়ে দিবি ওর কাছে, ও কেমন সেটা বিচার করে। এখানে সমাজের কী লেনদেন? সমাজের মানুষ কিন্তু তোর উপকার করতে আসবে না, বরং সুযোগ পেলে তোকে প্রতি পদে পদে অপদস্ত করবে।’

উসাইদ বলল,
-‘মামা, আমি অন্য একটা কারণে চাইছি না, শাদ আমার বোনের দায়িত্ব নিক।’

‘এগুলো ছাড়াও অন্য কারণ আছে? আহ, কী দুর্ভাগ্য আমার’ আনমনেই এইটুকু আওড়ে গিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘সেই অন্য কারণটা কী?’

মাথাভরা দুঃশ্চিন্তাকে দূরে সরিয়ে উসাইদ বলল,
-‘তোর বাবা-মা কী রাজি হবে? তাছাড়া তোর মা…।’

ফারশাদের প্রচণ্ড হাসি পেল এই কথায়। এতক্ষণে উসাইদের না বলা কথা সে বুঝতে পারল। বন্ধু যে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা বুঝেই মনের ভেতর একরাশ না পাওয়ারা ভীড় জমাল। সে মনের অপ্রাপ্তিগুলোকে এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে বলল,

-‘তুই কি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারছিস না?’

-‘কথাটা ভরসার নয়, শাদ। সম্মানের।’

-‘বেশ…। আমি তোর বোনকে সম্মানের সাথেই এখান থেকে নিয়ে যাব। বাবা-মায়ের সম্মতিসহ।’

-‘আগে সম্মতি নিয়ে নে, তারপর আমাকে কনফার্ম করিস। ঠিক আছে?’

-‘তোর কী ধারণা, বাবা-মা রাজি হবেন না?’

-‘কোনোদিনও না।’

-‘কেন?’

-‘যেখানে বন্ধুত্বটাই আত্ম-অহমিকার কাছে অনেক বছর আগে হেরে গেছে, সেখানে আমার বোনের সম্মান বেঁচে থাকা তো আমার জন্য বিলাসিতা রে।’

ভয়ানক এক ধাক্কা খেল ফারশাদ। চোখ ছোটো ছোটো করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চট করে পাশে বসে দুটো হাত ধরে বলল,
-‘এ্যাই, আমাকে বল। কে, কী বলেছে তোকে? আমার বন্ধুত্বের মাঝে কোনো ত্রুটি ছিল? আমি কোনোদিন তোকে অপমান করেছি? অসম্মান করেছি? উঁচুনিচুর পার্থক্যের জন্য বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে ছোটো করে দেখেছি? কিংবা আমাদের আশেপাশে যারা ছিল, তাদের কাউকে অসম্মানজনক কথা বলেছি কখনও?’

-‘সেরকম কিছু নয়, শাদ। ব্যাপারটা তোকে বোঝাতে পারব না আমি। মাফ কর।’

-‘অবশ্যই না। তোকে আমি জীবনেও মাফ করব না। আগে তোর বোনকে আমায় দে, তারপর ভেবে দেখব, মাফ করা যায় কি-না।’

-‘বাচ্চাদের মতো জেদ ধরিস না, প্লিজ।’

-‘নিজের বেলায় আমি কতটা জেদ ধরতে জানি, সেটা তুই ভালো মতোই জানিস। আশা করি, আমার জেদ সম্পর্কে তোকে আর নতুন করে কিছু বলতে হবে না।’

ফারশাদের জেদ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তার। এই ছেলে যা চায়, তা-ই করে। কোনোকিছু পেতে চাইলে, নিজের করতে চাইলে, সেটা সে করেই ছাড়ে। যতক্ষণ না জিনিসটা সে নিজের করে পাচ্ছে না, ততক্ষণ হাল ছাড়ে না। এই জেদের কারণেই তাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন একই সরলরেখায় এগিয়ে চলেছিল। শুধু এই ছেলে চেয়েছিল বলেই, বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আজও অস্বীকার করতে পারে না উসাইদ। এই ছেলে জেদ ধরেছিল বলেই, তার বাবা-মা না চাইতেও দু’জনার বন্ধুত্বকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন। পুরনো স্মৃতি মনে হতেই হাঁসফাঁস শুরু হলো উসাইদের। সে এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো চেপে রেখেছিল, যে কথা ও স্মৃতি তাকে বাধ্য করেছিল, বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিতে, আজ সেইসব কথাই চোখের সামনে স্বচ্ছ আয়নার মতো ভেসে উঠতে লাগল। একসময় ঠাণ্ডা মাথায় মামা-মামী, বোন ও স্ত্রীকে সামনে রেখে বলতে লাগল,

-‘আচ্ছা, তোকে একটা গল্প বলি। গল্পটা শোনে তোর রি’অ্যাক্ট কী হবে আমি জানি না। তবে এরপর তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি, সেটা অবশ্যই ভেবে-বুঝে নিবি।’

-‘কীসের গল্প?’

-‘গল্পটা আমাদেরই। তুই, আমি, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও আশেপাশের কিছু মানুষকে ঘিরেই। যেখানে এইমুহূর্তে মুখ্য চরিত্রে থাকবে উজমা নিজে আর অপজিটে আমাদের বন্ধুত্ব।’

ফারশাদ বেশ অবাক হলো এই কথা শোনে। আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইল বন্ধুর দিকে। উসাইদ গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করল,

-‘তোরা রংপুর যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা এটা। সেদিন বিকেলে, আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম। উজমা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। ও তখন অনেক ছোটো। ফাইভে পড়ত মাত্র। সেটা তো তুই জানিস। কিন্তু ওইদিন ক্লাস ও কোচিং শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে ওর সাথে যা হয়েছে…। সেটা মনে হলেই আমার শরীর শিউরে ওঠে। আমি আজও ভুলতে পারি না। ওর প্রত্যেকটা চিৎকার আমার কানে বাজে। তোর মনে আছে, আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে উজমাকে আমরা পাগলের মতো খুঁজেছিলাম?’

মূল ঘটনা শুরু হয়েছিল, এর দু’দিন আগে। ফারশাদরা যে ফ্লাটে থাকত, সেদিন সেই ফ্লাট ছিল খালি। ফারিশা, ফাবিহা, ফারশাদ ও ফয়জান মুনতাসীর কেউ-ই বাসায় ছিলেন না। পাশাপাশি আরও একটা ফ্লাট ছিল, যে ফ্লাটে উজমার ক্লাসমেট দিশা থাকত। প্রতিদিন বিকেলে ওর সাথে খেলতে যেত উজমা। ওদের খেলাধুলা বাসার ভেতরেই হতো। মাঝেমধ্যে বাইরে বের হতো। তবে বেশিরভাগ সময়ই ভেতরে খেলত। লুকোচুরি, কানামাছি, পুতুলখেলা। এইসব। একদিন লুকোচুরি খেলতে খেলতে দিশা ফ্লাটের বাইরে চলে এসেছিল। তাকে খুঁজতে উজমাও বেরিয়েছিল। কোথাও না পেয়ে ফারশাদদের ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে দিশাকে খুঁজছিল সে। দিশাকে খুঁজে না পেয়ে সে সামনের ফ্লাটের কলিংবেলে চাপ দেয়। অবুঝ মনের ধারণা হয়, দিশা হয়তো ওখানেই লুকিয়ে থাকতে পারে। সে কয়েকবার কলিংবেল চাপ দেয়ার পর এক বিধস্ত মহিলা এসে দরজা খুলে ঠাস করে উজমাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে বলেছিলেন,

-‘বেয়াদব মেয়ে। কী চাই এখানে? সামান্য ভদ্রতা জানিস না? বাবা-মা তোকে ম্যানার্স শেখায়নি? তুই জানিস না, এই ফ্লাটে তোদের মতো ছোটোলোকদের আসা নিষেধ?’

উজমা পুরোটাই হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। চড় খেয়ে নয়, মুনমুন হক্বের এলোমেলো পোশাক-আশাক ও শরীরের কামুকতা দেখে। আবার তার পিছনে যে লোকটি অর্ধনগ্ন হয়ে আছে সে এই অ্যাপার্টমেন্টেরই একজন ব্যাংকার। গালে হাত না দিয়ে মুখে হাত দিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল উজমা। কথা বলার শক্তি সে প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। এখানে কী হয়েছে সেটা সে বুঝেনি। কিন্তু বাংলা সিনেমাতে এসব দৃশ্য হরদমই দেখা যায়। টেলিভিশন দেখতে বসলে এই ধরনের কোনো দৃশ্য এলে ওয়াহিদা জামান টেলিভিশন বন্ধ করে ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দিতেন। বলতেন,

-‘এসব আজেবাজে জিনিস দেখতে হয় না। ভালো কিছু দেখবে। কে বলেছে তোমাদেরকে এসব ফালতু সিনেমা দেখতে?’

মুনমুন হক্বের মেজাজ, দাম্ভিকতা ও অহংকারের জন্য এই অ্যাপার্টমেন্টের সাধারণ পরিবারের লোকেরা কেউ-ই তার সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে চাইত না। তিনি শুধু বড়োলোকী আচরণ ও কথাবার্তা বলে সাধারণ পরিবারের লোকজনকে অপমান করেন দেখে, সবার সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পান না। কারও আশেপাশে যান না, কেউ আসেও না। যারা আসে, তারা শুধু শরীরভিত্তিক চাহিদার জন্য আসে। তা-ও সেসব শ্রেণীর পুরুষ যাদের মানসিকতা একদম নোংরা। যেহেতু এখানকার সবার সাথে মুনমুন হক্ব ও এই পরিবারের কারও ওঠাবসা নেই, সেজন্য মুনমুন হক্বের এই নোংরা রূপ কেউ জানত না। সবাই জানত তিনি খুব অহংকারী ও মেজাজী মহিলা। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তিনি ও ফয়জান মুনতাসীর অহংকারী স্বভাবের মানুষ হলেও তাদের তিনটে ছেলেমেয়ে হয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা। একেবারে তাদের স্বভাবের বিপরীত স্বভাব ছেলেমেয়েদের। এজন্য মুনমুন হক্ব যতই সন্তানদের বলতেন, এই শ্রেণীর মানুষদের থেকে দূরে থাকো, সন্তানেরা ততই এদের সাথে মিশত। ফাবিহা তখন ছোটো হলেও ফারিশা ও ফারশাদ যথেষ্ট উপযুক্ত। তারা মায়ের এই জঘন্য রূপ তখনও জানত না। জেনেছিল আরও অনেক বছর পর। কিন্তু এই ঘটনার বিস্তৃতি কিচ্ছুই তারা জানে না আর জানতেও পারেনি কোনোদিন।

হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে উজমা বলেছিল,
-‘আন্টি, আমি দিশাকে খুঁজতে এসেছিলাম।’

-‘বেয়াদব মেয়ে, আবার কথা বলে। যা এখান থেকে। ফের যদি নক করেছিস, তোর হাত আমি ভেঙে ফেলব।’

কোনোকিছু বুঝতে না পেরে দিশাদের ফ্লাটে ফিরে আসে উজমা। তখনই দেখতে পায় সোফার পিছন থেকে দিশা বের হচ্ছে। তাকে দেখে উজমা বলল,

-‘ওই আন্টিটা খুব খারাপ। আমাকে চড় মেরেছে।’

দিশা জানে, মুনমুন হক্বের আচরণ। তাই সে খুব একটা অবাক হলো না। বলল,
-‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?’

-‘হুম…। আচ্ছা, ওখানে একটা আংকেলকে দেখলাম। ওই যে, দুই নম্বর ফ্লোরে থাকেন, রাশেদ আংকেল। উনি। জানিস ওনার পরনে কী ছিল…।’

ঠোঁটকাটা অবুঝ উজমা গড়গড় করে সব বলে গেল। শোনে দিশার মাথায় হাত। সে-ও বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল বান্ধবীর দিকে। উজমা এ-ও বলল,
-‘জানিস, আমি সেদিন একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলাম, সেখানেও এরকম দেখেছি। আম্মু বলছিল, এগুলো না-কি ভালো না…।’

দু’জনেই অবুঝ, দু’জনেরই বয়স কম। এসব নোংরা অভিজ্ঞতা ও পরকীয়া সম্পর্কে তারা কিছু জানে না, বুঝেও না। চোখের সামনে যা দেখে, তা-ই অন্যকে শোনায়। উজমা এই বিষয়টা সেদিন ভুলে যেতে চাইলেও দিশা গণ্ডগোল পাকালো। সঙ্গী সাথী যত বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ছিল, সবার কানে এই কথা চলে গেল। এরপর বড়োদের কানে গেল। ব্যস…। পুরো অ্যাপার্টমেন্টের মানুষ মিলে মুনমুন হক্বের নামে শালিস ডাকল। মুনমুন হক্ব সেই শালিসে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে পুরো দোষটাই উজমার ওপর ঠেলে দিলেন। শালিসে অন্য বাচ্চাকাচ্চারা কেউ ছিল না। শুধু মুরব্বিরা ছিলেন আর প্রত্যক্ষদর্শী উজমা ছিল। তিনি তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘ও ছোটো মানুষ, কী দেখতে কী দেখেছে। ওর দেখাতে কেন সবাই আমাকে খারাপ ভাবছেন?’

যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই, সবটাই উজমার দেখার ভুল বলে চালিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু তার দু’দিন পর সেই সামান্য ভুলের মাশুল দিতে হলো ছোট্ট উজমাকে। বেণী করা চুল দুলিয়ে নাচতে নাচতে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল সে। দিশা যায়নি আজ। তার জ্বর ছিল। এজন্য উজমা একাই স্কুলে গিয়েছিল, আর ফিরেছেও। অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি এসে লিফটের কাছে গিয়ে দেখল, লিফট উপরে। অপেক্ষা করতে হবে দেখে সে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি টপকাতে গিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই কেউ একজন তার ধরে টান দিয়ে চট করে সম্পূর্ণ চোখমুখ বেঁধে দিল। হাত-পা ছুঁড়তে গেলে নিমিষেই হাতে-পায়ে বাঁধন শুরু হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল উজমার। অস্ফুটস্বরে শুধু গুঙিয়ে গেল।

বিকেলে খেলা শেষ করে বাসায় ফিরে উসাইদ জানল, উজমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ডায়েরি করা হলো। মাইকিং হলো। আশেপাশের এলাকা ও স্কুল, খেলার মাঠ, নদীনালা সবকিছু খোঁজা হলো। কিন্তু কোত্থাও উজমাকে পাওয়া গেল না। দারোয়ানও কিছু বলতে পারল না। এই ফ্লাটে সিসিটিভিও ছিল না যে, সেটা চেক করে দেখবে উজমা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছে কি-না। এত খোঁজাখুঁজি, হয়রানি ও লোক জানাজানি হওয়ার পরও উজমার চিহ্নই পাওয়া গেল না। ঠিক দু’দিন পর উজমার রক্তাক্ত দেহটা তাদের ফ্লাটেরই দরজার কাছে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল। ওয়াহিদা জামান মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডেকে আনেন। মুহূর্তেই দু’হাতে আদরের বাচ্চাটাকে কোলে তুলে হসপিটালে ছুটে যান। উজমার সম্পূর্ণ শরীর তখন পুরোটাই রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। কত আঘাত যে সহ্য করেছে বাচ্চাটা।

জ্ঞান ফেরার পর উজমা কারও সাথে কোনো কথা বলেনি। ফ্যালফ্যালিয়ে সবার দিকে তাকিয়েছিল শুধু। কোথায় ছিল, কেমন ছিল, কিচ্ছু বলেনি। তার সম্পূর্ণ শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানান, তাকে দাঁত দিয়ে শুধু কামড়ানো হয়েছে। ব্লেড দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। তবে ধর্ষণের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি শরীরে। ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়ার পর পুলিশের ধারণা হয়, তাকে মেন্টালি টর্চার করার জন্যই এইভাবে আটকে রাখা হয়েছে। কে করেছে, কেন করেছে, কিছুই জানা যায়নি। সেদিনের পর উজমা একেবারে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। হাসে না, খেলে না, কারও সাথে কথা বলে না, শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে আর দেয়ালে মাথা ঠুকে। অ্যাপার্টমেন্টের সবাই তার নামে বদনাম রটাতে থাকে। তাকে অসতী, কলঙ্কিনী, দুশ্চরিত্রাসহ নানান গালিগালাজে অতিষ্ঠ করে তুলে। উজমা কাউকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে না। বলতেও পারে না যে, তার কোনো দোষ নেই। অসতীর সংজ্ঞা কী, কীভাবে হয়, সেটাই তো রপ্ত করেনি সে। বুঝবে কী করে, কোনটা কলঙ্কের দাগ আর কোনটা সম্মানের! তবে সেদিনের পর যে মানসিক আঘাত উজমা পেয়েছিল, সেই আঘাত তাকে দীর্ঘদিন ভুগিয়েছে। প্রতিরাতেই চিৎকার করে উঠত। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদত। বার বার বলত, কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায়। সে-ই কেউটা কে, সেটা কোনোদিন কাউকে বলেনি। একটু চিৎকার-চেঁচামেচি হলেই সে নিজেকে আড়াল করে নিত। এভাবে চলতে চলতে, অসংখ্য ডাক্তার দেখিয়ে, পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট ও পারিবারিক সাপোর্ট দিয়ে উজমাকে পূণরায় স্বাভাবিক করতে হয়েছিল। বড়ো হওয়ার পর, মা ও ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার পর, আস্তে-ধীরে সব কথা বলেছিল। এ-ও বলেছিল, ওই দু’দিন মুনমুন হক্ব তাকে কত রকমের শারিরীক ও মানসিক আঘাত করেছেন।

এর কয়েকদিন পর মুনমুন হক্বের পরিবারের সবাই ওই ফ্লাট ছেড়ে বিদায় নেয়। ফ্লাটের সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাথে উজমাও। সবাই যখন তাদের বিদায় দিচ্ছিল, দূর থেকে সে দেখেছিল, মুনমুন হক্বের সাথে ফারিশা, ফারশাদ ও ছোট্ট ফাবিহা।

ফারশাদ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে উসাইদের কাছে ছুটে যেত, উসাইদও মেলামেশা করত, ফারিশার সাথে কথাবার্তা বলত, সাহায্য-সহযোগিতা চাইত, তবে কখনও উজমার সাথে তার সেভাবে কথা হয়নি বা খাতির হয়নি। উজমা বরাবরই বাচ্চাকাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা করত। ফারশাদ কখন তার ভাইয়ের কাছে যেত, কখন আড্ডা দিত, এসব সে খেয়াল করত না। মাঝেমধ্যে বাসায় দেখা হলে, ‘কেমন আছো’, ‘ভালো’, ‘পড়াশোনা কেমন চলছে’ এই জাতীয় দু’একটা কথা হতো। তবে সেদিনের পর সে জেনেছিল, এই মুনমুন হক্বের সন্তানই সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীর। বিদায়ের দিন সকলের অগোচরে উসাইদের কানে মুনমুন হক্ব বলেছিলেন,

-‘তোকে বলেছিলাম আমার ছেলের থেকে দূরে থাকতে। বলেছিলাম এই বন্ধুত্বটা ভেঙে ফেলতে। তুই তা করিসনি। উলটে, আমার ছেলের জেদকে সফল করতে বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রেখেছিস। তোর পিচ্চি বোনটা অনেক আদরের তাই না? ওকে বলিস, সবসময় চোখের সামনে যা দেখে, সেসব মানুষের কাছে প্রকাশ না করে হজম করে নেয়া শিখতে। একবার করেছে বলেই, দু’দিন অনেক মেরেছি। এত মেরেছি যে, মার খেতে খেতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তোকে ও তোর বোনকে একটা সুযোগ দিয়ে যাই। যদি বোনের সম্মান বাঁচাতে চাস, তবে আর কোনোদিন শাদের সাথে যোগাযোগ করবি না। ভুল করেও যদি করিস, তোর বোনের জীবন আমি নরক বানিয়ে দেব। কথাটা মাথায় রাখিস।’

সেইযে কলঙ্কিনী, দুশ্চরিত্রা তকমাটা উজমার কপালে লেগে গেল, আজও দূর হলো না। ওই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে এখানে আসার পর জীবনে একটু শান্তি ফিরে এসেছে। বন্ধুবান্ধবদের পেয়ে পিছনের স্মৃতিটা সে ভুলে যেতে চেয়েছে। ওইদিন রাতে ফারশাদের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর, বিদঘুটে দৃশ্যটা আচমকাই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল উজমার। এই কারণেই সে চিৎকার দিয়েছিল, ‘ভাইয়া আমাকে বাঁচাও। কেউ আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে’ এই কথা বলে।

সব কথা শোনে ফারশাদ বোবা হয়ে গেল। সে জানে তার মায়ের জঘন্য রূপ ও চরিত্রের অধঃপতন। কিন্তু সেটার গভীরতা যে এতবেশি, এটা কোনোদিন বুঝতে পারেনি। সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র যে মানুষ পশুতে রূপান্তরিত হয়, তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করা যায় কি-না এটাই এখন ভাববার। উসাইদ কথা শেষ করে, সোফায় মাথা হেলিয়ে দিল। বড্ড ক্লান্ত ও অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। মিশকাত আজ জানল এক ভাইয়ের জীবনে বোনের গুরুত্ব ও ভালোবাসা কতখানি। ঊষাও সব শোনে যেন আকাশ থেকে পড়ল। আজ সে বুঝতে পারছে, বোন কেন এত কাঁদে! তার খুব রাগ হলো মুনমুন হক্বের ওপর। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে ভাইয়ের কাছে ছুটে গিয়ে ভাইকে জাপটে ধরল। উসাইদ বেসামাল হলেও ছোটো বোনের আবেগমাখা ব্যবহারে স্মিত হেসে বলল,

-‘কী হয়েছে?’

-‘কিছু না, ভাইয়া।’

মোরশেদ জামান ও মিনারা খাতুন এতকিছু জানতেন না। তাঁরাও বেশ অবাক হলেন। সবার মুখের এই থমথমে ভাব কাটানোর জন্য ফারশাদ সহাস্যে কঠিন স্বীকারোক্তির সুরে বলল,

-‘তোকে ভাবতে হবে না আর। উজমার সম্মানের দায়িত্ব আমি-ই নিব। ভাবিস না, এটা আমি তোর বোনকে করুণা করে বলছি। উসাইদ, আমি তোর বোনকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোর মনে হতে পারে, আমি সাময়িক ভাবাবেগে ভেসে গিয়ে এই কথা বলছি। ট্রাস্ট মি, দোস্ত। এটাই সত্য। এটা কোনো মোহ নয়। আই রিয়্যালি লাভ হার, এন্ড ট্যু ডে আই প্রমিসড, আই উইল লাভ হার লাইক দিস টিল মাই লাস্ট ব্রেথ।’

***

চলবে…