মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-১৫+১৬

0
53

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – পনেরো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

কিশোরীমন হলে ‘ভালোবাসি’ কথা শোনার পর হয়তো উজমা আবেগাপ্লুত হয়ে যেত, মনের আকাশে বিচরণ করত একঝাঁক ডানাছাড়া পাখি, দুঃখ ভুলে সুখসাগরে ভাসতে শুরু করত, আয়নায় মুখ দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যেত, হয়তো মনে মনে সে-ও আওড়ে যেত, ‘ভালোবাসি।’ এমন সাহস ও তেজী স্বর নিয়ে ‘ভালোবাসি’ বলে ভালোবাসার স্বচ্ছতা দেখাতে গিয়ে কেউ যদি যুক্তির দ্বারা কাউকে পরাজিত করে দেয়, তাহলে কিশোরীমন অকূলে কূল হারাতে বাধ্য। বয়সটা তার আবেগের নয় বলেই, প্রেমিক পুরুষের দৃঢ়স্বরের বলা ‘ভালোবাসি’ কথার গভীরতা তার মনের কোথাও সমুদ্রের গর্জন তুলল না। যেমন শান্ত, নরম কণ্ঠে ভালোবাসাটাকে মোহ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল, তেমনি শান্তভাবে তোলপাড় করা অনুভূতির প্রকাশ দেখেও নিজেকে শক্ত খোলসের আবরণে ঢেকে রাখল উজমা। ভালোবাসার মতো সর্বনাশা অনুভূতি যে জীবনে আর একটাও নেই, সেটা বন্ধুবান্ধবদের দেখে উপলব্ধি করেছে। কেউ যদি সত্যিকার অর্থে কাউকে ভালোবেসে থাকে, তবে সেই ভালোবাসার মানুষটার কথাকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দেয়, ছোটোখাটো যেকোনো কথাই ওই প্রেমিক পুরুষটার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে ধরা দেয়। এটুকু সে অনিক, কাইফ ও তাক্বদীমের ভালোবাসা দেখেই বুঝেছে। এজন্যই সে চেয়েছিল, জীবনে যদি কেউ আসে, সে যেন তাকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারার ক্ষমতা নিয়ে আসে। যদিও সবাই এটা পারে না, সবাই এমন হয় না। এগুলো শুধু নাটক-সিনেমাতেই সম্ভব। তবুও একান্তই কিছু ব্যক্তিগত চাওয়া সব মনই লালন করে আসে। এর থেকে উজমাও চায়, কেউ একজন আসুক, তার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে। যে তাকে বুঝবে, একদম তার মতোন করে। যার সাথে মতের ও মনের বোঝাপড়া হয় তার সাথেই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। এতদ্রুত ফারশাদ তাকে এইভাবে খেয়াল করেছে দেখে নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হয়ে পড়ল উজমা। তার দুর্বলতা কেউ জানে না, তার মনের ক্ষত কেউ দেখেনি। অমন অদ্ভুত চাহনির মাঝে যে এত গভীর উপলব্ধি লুকিয়েছিল, সেটা টের পেয়েই কপাল চাপড়াল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু কোনো যথোপযুক্ত জবাব খুঁজে পেল না। রুমের ভেতর থেকে রিংটোনের আওয়াজ ভেসে এলো তখন। ফারশাদ সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে ছুটে গেল রুমে। উজমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুযোগ পেয়ে সরে পড়ল।

ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকাল ফারশাদ। বলল,
-‘কেমন আছিস?’

ওপাশ থেকে ফাবিহা শুধু কেঁদে গেল। একনাগাড়ে বোনের কান্না ও ভয়মিশ্রিত কণ্ঠস্বর শোনে বলল,
-‘কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কোনো সমস্যা?’

-‘তুমি বাড়ি কবে ফিরবে? আমি এখানে থাকব না আর। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, ভাইয়া। আমাকে বাঁচাও, প্লিজ।’

তাদের বাড়িটা যে একটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছে, এটা দুই ভাইবোন খুব ভালোমতোই জানে। তার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। সে চিন্তিত মন নিয়েই বলল,

-‘কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি?’

এরপর ফাবিহা যা বলল, তাতে তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। নিজের জীবনের চাওয়া-পাওয়া আগে না-কি দায়িত্ব-কর্তব্য আগে সেটার হিসেব কষেই মনে হলো, ছোট্ট ফাবিহার প্রতি অবহেলা করা উচিত হবে না। সে বড়ো ভাই, একজন বোনের ভরসার আশ্রয়। বেঁচে থাকতে বোনের কাছ থেকে ভরসার আশ্রয়কে দূরে সরানো কাপুরুষদের কাজ। অনেক ভেবেচিন্তে বলল,

-‘চিন্তা করিস না, আমি কালকেই ফিরব।’

-‘ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি এসো।’

ফাবিহা লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলেও ফারশাদ পড়ে গেল চিন্তায়। বাড়িতে এতবড়ো তুলকালাম যাচ্ছে অথচ বাবা নির্বিকার! এদিকে তাহমীদেরও খোঁজ পাচ্ছে না। টেনশন পাগল পাগল অবস্থা। একদিকে নিজের জীবন, অন্যদিকে বোন। এইমুহূর্তে সে ঠিক কী করবে, এটাই ভেবে পেল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, উজমার সাথে শক্তপোক্ত একটা আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। মেয়েটা তার অনুভূতিকে মূল্যই দিচ্ছে না। সে মুনমুন হক্বের সন্তান, এতে তার দোষ কী? সে তো নিজের জায়গায় সৎ, অপকট।

উজমা শান্তভঙ্গিতে ঘরের কাজকর্ম করছে। মানে একটু আগে যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ তাকে প্রপোজ করল, এটা নিয়ে মেয়েটার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। মেয়ে মানুষ যে এত কাঠখোট্টা, আবেগ-অনুভূতিহীন এটা তো উজমাকে এত কাছে থেকে না দেখলে বুঝতেই পারত না। আশ্চর্য! এই মেয়েটা এত কঠিন কেন? উজমার এই ভাবলেশহীন কাজকারবার দেখে ফারশাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। সে ভরাট গলায় বলল,

-‘কিছু কি বলার নেই আপনার?’

-‘অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।’

-‘গ্রেট…। তাইতো মনে হবে। আমি মানুষ উজমা, রোবট নই। আমারও যে কিছু ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ আছে, নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর দরকার আছে, এটা কি আপনাকে এখন আমি হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেব?’

উজমা ত্যাড়াব্যাকা কণ্ঠেই বলল,
-‘আপনি একজন দামী মানুষ। আপনার আশেপাশেই তো অনেক মেয়ে ঘুরঘুর করে রোজ। নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য তাদের মধ্যে কেউ একজনকে…।’

কথা শেষ করার আগেই হাতের কনুইতে টান অনুভব করল উজমা। হুটহাট এই টান খেয়ে বেসামাল হয়ে গিয়ে একদম ফারশাদের বুকের কাছে আঁচড়ে পড়ল। সুযোগ পেয়ে দু’হাতই চেপে ধরল ফারশাদ। বলল,

-‘কী মিন করলেন এটা দিয়ে? হুম…। কী?’

-‘আমি বাড়াবাড়ি কিছু মিন করিনি। আপনি অযথাই রেগে যাচ্ছেন।’

-‘আমার অনুভূতিটা কি এতই সস্তা যে, যে কারও কাছেই নিজেকে বিলিয়ে দেব আমি? এ্যাই মেয়ে, আর কীভাবে বোঝালে বুঝবেন, আমার শুধু আপনাকেই চাই?’

-‘দেখুন, আমি ভালোভাবে বলছি, বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার এবং আমার মাঝখানে অনেক বাঁধা। স্ট্যাটাস, যোগ্যতা, ক্ষমতা, এতকিছু ডিঙানোর সাহস আমার নেই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা… আপনার মা। আমি বুঝাতে পারব না আপনাকে। প্লিজ… জোর করবেন না।’

-‘রাইট…। আমার মা। আমার মা আপনাকে টর্চার করেছে, আপনার সম্পূর্ণ শরীর রক্তাক্ত করেছে, আপনার নামে মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে, আপনাকে সমাজের চোখে কলঙ্কিত সাজিয়েছে, আমি সবকিছু জেনেই বলছি, উজমা। সব ক্ষত আমি সারিয়ে দেব। একবার ভরসা করে দেখুন। আমি তো আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারছি না। কেন বোঝাতে পারছি না আমি আপনাকে?’

একটু একটু করে মনের জোর হারিয়ে ফেলছে উজমা। ধৈর্য্যও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফারশাদ সব জানে মানে। কীভাবে জানে! কে বলল? এসব তো ভাইয়া ও মা বাদে আর কেউ জানে না। তবে কি ভাইয়াই জানাল? ভাবতে গিয়ে দিশা হারিয়ে ফেলল উজমা। তবুও কোনোমতে বলল,

-‘আপনি ভুল করছেন। সবকিছু একটা আবেগ ভেবে ভুলে যান। ভুলে যান যে, কোনোদিন এই শহরে এসেছিলেন আর আমার মতো সাধারণ একজন মেয়ের সাথে আপনার পরিচয় হয়েছিল।’

-‘আপনি তো সাধারণ কেউ নোন। যে আমার এত বছরের আগলে রাখা, যত্নে রাখা ঘুমন্ত মনটাকে জাগিয়ে দিতে পারে, সে সাধারণ কেউ হতেই পারে না। আমার চোখে তো না-ই। আপনি তো অসাধারণ। সাধারণের পরিবেশেও আপনার মাঝে যে গুণ, ধৈর্য্যশক্তি ও মনের জোর দেখেছি তাতে আপনাকে সাধারণ কেউ ভাবতে পারছি না। এই সাধারণ গুণাবলী নিয়েই তো আপনি অসাধারণ, উজমা।’

-‘তবুও বলছি। আপনি আমাকে ভুলে যান। সবটাই একটা ভুল ও মোহ ভেবে ভুলে যান। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো ভাবুন, যা প্রয়োজনের সময় কাছে পেয়েছেন আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলেই, দূরে ছুঁড়ে ফেলেছেন। এরপর পুরনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকিছুকে গ্রহণ করে নিন।’

ফারশাদ এবার ভয়ংকর পর্যায়ের ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপল। কপালের শিরা ফুলে ফুলে উঠল। দাঁতে দাঁত চাপল। অবিশ্বাস্য চোখে উজমাকে পরখ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের রাগটাকে সে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে শক্ত মেজাজে বলল,

-‘আপনি নিজেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাথে তুলনা করছেন?’

-‘আপনাদের স্ট্যাটাস বুঝতে গেলে, অর্থটা এরকমটাই দাঁড়ায়।’

-‘আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবর্তন করা যায়, একবার শেষ হলে নতুন করে কিনে আনা যায়, হারিয়ে গেলে নতুনের মাধ্যমে নিজেকে সান্ত্বনা যায়। অথচ ভালোবাসার বেলায় এই হিসেবটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়, উজমা। কেননা, এক মনে একজনকে ঠাঁই দেয়ার পর তাকে স্বেচ্ছায় অন্যত্র দান করা যায় না। আবার সেই মনে নতুনভাবে আরেকজনকেও বসানো যায় না। ভাগ্যদোষে যদি ভালোবাসা হারিয়ে যায়, তবুও তার শূণ্যতা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে শিখে যায়। এই অনুভূতিটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মতো অর্থ দিয়ে কিনতে হয় না ঠিকই তবে হৃদয়ের মতো সবচেয়ে দামী ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়।’

-‘আপনাদের মতো বড়োলোকদের কাছে তো সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা তুচ্ছই। যেখানে সাধারণ পরিবার ও তার আশেপাশের মানুষ তুচ্ছ, সেখানে ভালোবাসার মতো অনুভূতি এত চড়াদামে কে কিনবে বলুন?’

-‘আপনি আমার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নোন, যাকে আমি সস্তাদরে কিনে নিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে দেব। আপনি আমার হৃদয়ঘরের সবচেয়ে দামী সম্পদ, যাকে আমি আমার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসার বিনিময়ে অর্জন করতে চাইছি, শুধু নিজের জন্য। যে আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে দামী, তাকে আমি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে বিক্রি করতে পারি না, কিংবা কোনোকিছুর সাথে তার অ্যাক্সচেঞ্জ করতে পারি না। পৃথিবীর সবকিছুকে হয়তো টাকা কিংবা দামের সাথে তুলনা করা যায়, কিন্তু ভালোবাসাকে কোনোকিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ ভালোবাসা এমনই একটা সম্পদ, যার দাম হৃদয়ের মতো দুর্লভ ও দামী বস্তু দিয়ে কেনা হয়ে থাকে। হৃদয়ের দামে যে হৃদয় আমি কিনতে চাইছি, সেটাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে তুলনা করতে পারব না, বাটারফ্লাই। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’

তর্ক করার মতো আর ধৈর্য্যশক্তি পাচ্ছে না উজমা। হাল ছেড়ে দিয়ে আলতোভাবে ফারশাদকে ধাক্কা মেরে বলল,
-‘হাতে লাগছে আমার।’

তর্কবিতর্কের কারণে ফারশাদ নিজেও ভুলে গিয়েছিল, সে উজমার হাত চেপে ধরে আছে। তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিল হাত। তাকিয়ে দেখল, ফর্সা হাতের কনুই ইতিমধ্যে রক্তিম হয়ে উঠেছে। এত ব্যথা দিয়ে ফেলল? শীত এখনও ঝেঁকে বসেনি। মেয়েটা সোয়েটার বা চাদর কিছুই গায়ে জড়ায়নি আজ। এজন্যই হয়তো হাতের ছাপ গভীরভাবে লেগেছে। অনুশোচনায় বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বলল,

-‘স্যরি, আমি আসলে ইচ্ছে করে আঘাত দিইনি। রেগে গিয়েছিলাম।’

উত্তরে এই নিয়ে কোনো কথা বলল না উজমা। ব্যথাতুর অংশে হাত ঘষতে ঘষতে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। গলায় জোর এনে বলল,

-‘খেয়ে নিন। সারাদিন ধরে না খেয়ে আছেন।’

ফারশাদ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
-‘যদি না খাই, আপনি কি খুব রাগ করবেন?’

-‘উপকারী জিনিসটাকে যারা হেলায়, ফেলায়, অবহেলায় হারায় তাদেরকে আমি বুদ্ধিমান মানতে পারি না। শরীরটা যেহেতু আপনার, ওটার সুস্থতার জন্য সময়মতো খাওয়ার দায়িত্বও আপনার। ফালতু অভিমান দেখালে ভাববেন না যে, আমি আপনাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেব, কিংবা আপনার হাত ধরে লটকে থেকে বলব, ‘আসেন, আসেন, খেয়ে নেন। আপনি না খেলে, আমিও খাব না।’ এরকম সস্তা ডায়লগ দিতে আমার ভালো লাগে না আর আমি এসব পারবও না। এত আলগা পিরিতিরও কোনো দরকার দেখছি না।’

কথা শেষ করে প্লেটে খাবার নিয়ে ঝটপট খেতে বসলো উজমা। এতসব তুফান যে হলো, এটা এই শক্ত রমণীকে সামান্য পরিমাণও টলাতে পারল না। বোকা বনে গেল ফারশাদ। মানে, এইভাবে কেউ নিজেকে এত কট্টর বোঝাতে পারে? খাবারের জন্য একবারের বেশি সাধবে না, ঠিক আছে। তাইবলে মেহমান রেখে সে খেতে বসে যাবে? অযথা অভিমানের বহর না দেখিয়ে ফারশাদ নিজেও খেতে বসলো। শরীর দুর্বল লাগছে। ঘুমটা প্রয়োজন মনে হচ্ছে। কিন্তু ঘুম কি আসবে? সে খেতে খেতেই বলল,

-‘একটা সিরিয়াস কথা বলতে চাইছি।’

খাবার চিবোতে চিবোতে উজমা বলল,
-‘ওই টপিক ছাড়া অন্যকিছু থাকলে বলুন।’

ফারশাদ হেসে ফেলল। শব্দহীন সেই হাসি। মুখভরা হাসি নিয়েই বলল,
-‘রাগ করলেও কিছু করার নেই। আমাকে বলতে হবে। আপনি হয়তো আমার এসব কথাকে আবেগ ভেবে বসে আছেন। এটা যদি সত্যিই আবেগ হতো, আমি নিজেকে প্রকাশ করতাম না। কারণ আমার বয়সটা আবেগের নয়। আমি সরাসরি ও স্পষ্ট কথা বলা মানুষ, এজন্যই মনে যা আছে তা প্রকাশ করে ফেলেছি। এত লুকোচুরি, এত নাটকাভিনয় আমার পছন্দ নয়, আমি পারি না এগুলো করতে।’

একটু থামলো ফারশাদ। কণ্ঠে জোর এনে বলল,
-‘আমার এত বছরের জীবনে আপনি-ই প্রথম নারী যাকে দেখার পর আমি একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। কেন জানি না, আপনাকে দেখার পর আমার মনের ভেতর মুহূর্তের মধ্যেই অদ্ভুত অনুভূতি খেলে গেল আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বেলাশেষের একটা কৌতূহলী মুখ, একটা মায়াভরা হাসি ও ছোটো ছোটো করে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকা এক ভয়ানক দৃষ্টি। ওইদিনই, আমি থমকে গিয়েছিলাম আপনার চোখের দৃষ্টি দেখে। ভাগ্যে কী আছে আমি জানি না। তবে অনুভূতিটা প্রকাশ করা উচিত বলেই আমি আপনাকে জানিয়েছি। হয়তো আমি পারতাম, কিছু না বলেই এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার যে একটা সুযোগ সেটা হাতছাড়া করে ফেলতাম। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি, এর মানে এই না যে, আমাকেও আপনার ভালোবাসতে হবে। যে অনুভূতি কেবল মনের উপলব্ধি থেকে আসে, সেটা জোর করে পাওয়ার মতো এত ক্ষমতাশালী ভয়ানক পুরুষ আমি নই। ভালোবাসা না পেলে নিজেকে একেবারে সর্বহারা ভেবে ভুল স্টেপ নেব, এতটাও কাপুরুষ কিংবা মহান পুরুষ আমি হতে পারব না। আপনাকে ভালোবেসে যে স্বস্তি, শান্তি ও সুখ আমি পেয়েছি, আরও অনেক বছর এই স্বস্তি, শান্তি ও সুখ নিয়েই আমি বাঁচতে পারব শুধু আপনাকে একতরফা ভালোবাসার জোরে।’

উজমা চুপ রইল। নীরবে খাবারের প্লেটে আঁকিবুঁকি করে গেল। সেটা দেখে ফারশাদ বলল,
-‘বাড়িতে একটা ঝামেলা হয়েছে। ফাবিহা ফোন করেছিল। কাল বিকেলের মধ্যেই চলে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর ওকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব। ব্যস্ত হয়ে পড়ব নিজের জীবন নিয়ে। আপনার সাথে আর দেখা কিংবা কথা, কোনোকিছুই হয়তো হবে না। যদি আপনি এই প্রপোজালে সাড়া দিতেন, তাহলে আপনাকে পাওয়ার জন্য একটা সুযোগ আমি নিতাম। মন থেকে সায় নেই বলে, আপনি তো কোনোদিন আমার ডাকে সাড়া দিবেন না। জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না বলেই, আমি আপনার মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ শুনতে চাইছিলাম। নয়তো আমি চাইলেই পারতাম, সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে। আমি শুধু চাইছিলাম, আমার অনুভূতি ও আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে। ভাগ্য হয়তো আমার সহায় হবে না, তাই আপনাকে আমি পাব সে-ই আশাও আজ ছেড়ে দিলাম।’

কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে আবারও ফারশাদ বলল,
-‘কোনোদিন যদি কাউকে ভালোবাসতে পারেন, তাকে হারাতে দিবেন না। নিজের করে নেয়ার চেষ্টা করবেন। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অনেক। এই যন্ত্রণাটা সহ্য করা যায় না। আর যারা একপাক্ষিকভাবে ভালোবেসে, তারা না যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করতে পারে আর না ওই মানুষটাকে ভুলে যেতে পারে।’

জল টলমল চোখ নিয়ে মুখ নামিয়ে রইল উজমা। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায়ও দেখল না। ফারশাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-‘আপনি অনেক চমৎকার একটা মেয়ে। আপনার চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম, রাগ-অভিমান এমনকি কান্না-হাসি সবকিছুই এত মনকাড়া যে, যেকোনো শক্ত মনের পুরুষকেও হোঁচট খাওয়াতে সক্ষম। আমার দুর্ভাগ্য, আমি আপনাকে নিজের করে চাওয়ার পরও আপনার মনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ডিঙিয়ে সেখানে নিজের দখলদারি অর্জন করতে পারিনি।’

এত কথা শোনে উজমা এবার ভীষণ বিরক্ত হলো। শক্ত কণ্ঠে ধমকে উঠে বলল,
-‘আপনি কি একটু থামবেন? আপনার এত কথা অসহ্য লাগছে আমার।’

-‘কষ্ট করে আরও কয়েকঘণ্টা সহ্য করে নিন। এরপর এই জীবনে আর কোনোদিন আপনাকে বিরক্ত করতে আসব না।’

বকবকানি সত্যিই সহ্যের বাইরে চলে গেল। রাগে, অভিমানে, দুঃখে একেবারে গর্জে উঠল উজমা। বলল,
-‘আপনারা কী, হ্যাঁ? আপনাদের ডিকশনারিতে কি ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই?’

ফারশাদ হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল,
-‘ভালোবাসা শব্দটা আমার ডিকশনারিতে এতদিন ছিল না তো। নতুন যোগ হয়েছে। অনুভূতিটা দারুণ, উজমা। খুব উপভোগ করছি। কখনও কাউকে ভালোবাসলে আপনিও বুঝবেন, এই অনুভূতিটা কী ভয়ানক প্রভাব ফেলে মনে।’

বিরক্তিতে কপালে হাত চেপে বসে রইল উজমা। খাবারটাও গলা দিয়ে নামছে না এখন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফারশাদ এবার থেমে গেল। আর কথা বলার জোর নেই। বলেই বা কী লাভ? যে বোঝে না, তাকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিলেও বুঝবে না। জানানোর প্রয়োজন ছিল, জানিয়েছে। গ্রহণ করা, না করা ব্যক্তি স্বাধীনতা। সে কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় না। চায় না কেউ ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তার অনুভূতিকে সম্মান দিক। নিশ্চুপে খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে চলে যাওয়ার আগে ডাইনিং টেবিলের সম্মুখে থাকা জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আজ রাতটাই এই শহরে আমার শেষরাত, উজমা। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে এই শহরে যে অমূল্য রত্ন আমি পেয়েছিলাম, তাকে এইভাবে ফেলে যেতে হচ্ছে দেখে খারাপ লাগছে। একদিন ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে আপনাকে চাওয়ার সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করেছিলাম। আর আজ এই নিস্তব্ধ ও অন্ধকার রাত্রিকে সাক্ষী রেখে বলছি, জীবনে যতদিন বাঁচব কোনোদিন এই শহরের নামও মুখে আনব না। যে সুন্দর ও স্বচ্ছ অনুভূতির জন্ম এই শহরে এসে হয়েছিল, তাকে যদি এখানেই কবর দিয়ে যেতে পারতাম, হয়তো একটু শান্তি পেতাম মনে। কিন্তু আমি তা পারছি না। ভালোবাসাকে কবর দেয়া তো অসম্ভব। কী করে পারব, বলবেন?’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ষোল

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

ভালোবাসা নামক অনুভূতিকে যদি কবর দেয়া যেত, অসংখ্য প্রেমিক ও প্রেমিকা আত্মহত্যা নামক পাপ থেকে বেঁচে যেত। অসংখ্য অবুঝ মন, পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধার আগেই ভালোবাসাকে কবর দিয়ে ফেলত। এই অনুভূতির গভীরতা এত মারাত্মক ও ভয়াবহ যে, একটা মানুষকে বেঁচে থাকা অবস্থাতেও মেরে ফেলতে সক্ষম হয়। উজমা খুব করে চাইল, এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবে। কিন্তু সেটাও হলো না। মনের কোথাও ফারশাদের জন্য অনুভূতি না থাকা সত্ত্বেও আফসোসের সাথে বিড়বিড় করল,

-‘মানুষ কেন ভালোবাসে?’

কখনও কখনও পরিস্থিতি এত জটিল ও কঠিন হয় যে, শত চাইলেও সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া যায় না। অনেকক্ষণ ধরেই উজমা চাইছিল, ফারশাদের এই অনুভূতিকে অবহেলা, অবজ্ঞা করে চুপ থেকে সে বুঝিয়ে দিবে, ভালোবাসা নামক অনুভূতি তাকে খুব একটা দুর্বল করে না। এই কারণেই শক্ত মেজাজে বসে থেকে একাধারে নিজের যুক্তি পেশ করে নিজেকে এই প্রেম-ভালোবাসা নামক অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। ফারশাদ নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নিশ্চুপে সেখান থেকে চলে গেলে উজমাও ধীরস্থিরভাবে সমস্ত কাজ সামলে, সব দরজা-জানালা চেক করে নিজের রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার বেশ কয়েকটা বদভ্যাসের মধ্যে আরও একটা বদভ্যাস হচ্ছে, কনকনে শীতেও সোয়েটার ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকা। আবার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করা। তবে বাইরে আসা-যাওয়া করতে হয় বলেই, ভাইয়ের হুকুমে তখন ভারী নয়তো হালকা-পাতলা সোয়েটার ও চাদর গায়ে দেয়। শীতকালে সে শরীরে চাদর জড়িয়েই রাখতে পছন্দ করে বেশি। আজ গোসল সেরে চাদর জড়ায়নি। ঋতুতে পৌষ মাস চললেও ঠাণ্ডা এখনও যথেষ্ট কম। আর আগুনের আঁচের কাছে থাকলে ভারী পোশাকে কাজ করতে অসুবিধা হয় বলেই, সোয়েটার না পরে চাদর ব্যবহার করে। আজ ঠাণ্ডা সামান্য কম ছিল বিধায় ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে রান্নাঘরে গিয়েছিল। ফলাফল ফারশাদের এই আচানক টানে হাতে লেগে যাওয়া। যদিও দাগ পড়েনি। যা একটু লাল হয়েছিল সেটা মিলিয়ে এসেছে। হাত-মুখ ধুয়ে শরীরে লোশন মাখতে গিয়েই হাতের দাগগুলোর দিকে নজর গেল। অসংখ্য ছোটো ছোটো দাগ, প্রত্যেকটা আবার এক ইঞ্চি পরিমাণ। যেন কোনোকিছু আঁচড় দিয়েছে। বামহাতের শিরায় পাঁচটে সেলাইয়ের দাগ। এত বছর আগের ক্ষত, তবুও দাগ রয়ে গেছে শরীরে। এই সামান্য দাগই উজমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। ফর্সা শরীর বলে এই দাগগুলো কারও নজরে পড়ে না, আবার খুব করে তাকালে একটু-আধটু চোখে পড়ে।

বন্ধুবান্ধবদের সাথে চলাফেরা বেশি থাকায়, ওদের চোখে এই দাগগুলো পড়াতে উজমা বলেছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্টে এরকম হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্টটা কেমন ও কী কারণে হয়েছে, সেটা আজও প্রকাশ করেনি। এরকম আরও ছোটো ছোটো দাগ, পেটে, পিঠে, পায়েও আছে। এরকম মুহূর্ত থেকে বেঁচে ফেরা যে কত কষ্ট, সেটা অল্প বয়সেই অনুধাবন করতে পেরেছিল সে। এজন্য জীবনের মূল্য খুব ভালো করেই বুঝতে পারে, বুঝতে পারে প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য লড়াই করে যেতে হয় প্রত্যেকটা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও অপ্রকাশ্যে। কখনও বাইরের মানুষের সাথে আবার কখনও নিজের সাথেই এই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।

এইযে এত কথা ভাবতে গিয়ে বুক কাঁপিয়ে কান্না আসছে, এটা কি বাইরের মানুষকে বোঝাতে পেরেছে কোনোদিন? হাসি দিয়ে কষ্ট গিলে ফেলতে জানে বলেই, মা ও ভাই ব্যতীত কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি তার ভেতরের কষ্ট। বুঝতে পারেনি মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা হাহাকার, শুনতে পায়নি তার নীরব আর্তনাদ। একটা মা, একজন নারী যদি এমন ভয়াবহ হতে পারে, তাহলে মানুষ নিরাপদ থাকে কোথায়? নিজের বেইজ্জতি লুকাতে যে মা পশুর মতো আচরণ করতে পারে, সে-ই মা তো পরবর্তীতে আরও ভয়ানক হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যখনই জানবে, ফারশাদ মন ডুবিয়েছে পঁচা ডোবায়, উড়ে এসে চেপে ধরবে গলা। জেনে-বুঝে নিজেকে কীভাবে সে ফারশাদের সাথে জড়াবে? যদি অনুভূতি জন্মাত, তবে হয়তো কিছু একটা ভাবত। কিন্তু যেখানে অনুভূতিই জন্মায়নি, মনের টানই তৈরী হয়নি, সেখানে কীভাবে কাউকে বলতে পারে, সে কারও জীবনসঙ্গিনী হতে প্রস্তুত? এমন না যে, ফারশাদ খারাপ বা তার ব্যক্তিত্বে দোষ। এই ক’দিনে এটা অন্তত স্পষ্ট যে, ফারশাদের মধ্যে তার বাবা-মায়ের মতো নোংরা মানসিকতা নেই। সে যথেষ্ট সৎ, সাহসী ও মনে-মস্তিষ্কে আপাদমস্তক পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। নানাবিধ ভাবনায় ভাবতে গিয়ে উজমা উপলব্ধি করল, মনের অজান্তেই সে ফারশাদকে নিয়ে এতকিছু ভাবছে। আশ্চর্য! এত ভাবার তো কিছু না। ‘ভুলে যা উজমা, ভুলে যা।’ এরকম সাবধানবাণী শুনিয়ে নিজেকে নির্ভার করে ফোন হাতে নিয়ে বন্ধুদের সাথে কলে জয়েন হলো। হুটহাট পরিস্থিতি তাকে বিব্রত করেছিল বলেই, ভেতরে একটা জড়তা তৈরী হয়েছিল। নিজের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর, কয়েকফোঁটা চোখের পানি ঝরানোর পর এখন শান্তি লাগছে, হালকা লাগছে। ঠাণ্ডায় হোক কি কান্নায়, গলা বসে গেছে তার। ওপাশের দুই রমণী সেটা আঁচ করতে পারল মুহূর্তেই। মাইসারা বলল,

-‘তোর বদভ্যাসগুলো ছাড়, উজমা। এসবের কারণে একদিন নিউমোনিয়া হবে।’

বান্ধবীর কথা শোনে হাসি এলো উজমার। বলল,
-‘হোক, অসুবিধা নেই। তোরা এসে সেবাযত্ন করবি।’

-‘এ্যা, ঠ্যাকা পড়েছে তো। আমরা আসব। আমরা কেন তোর সেবাযত্ন করব? সেবাযত্ন করার জন্য একটা ব্যক্তিগত মানুষ লাগে। জুটিয়ে ফেল একটা। তাহলেই তো হয়।’

-‘এত সোজা বুঝি?’

-‘কঠিন কে বলছে? আমরা জুটাইনি?’

-‘খুব পেরেছিস বুঝি? ভুলে যাস না, তোর ওই ঢিলে মাথায় অনিককে ঢুকাতে গিয়ে আমাদের অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল।’

হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল মাইসারা। রাইদাহ বলল,
-‘যা বলেছিস। এ্যাই মেয়েটা এত গাধী ছিল। বিয়ের পর মনে হয় একটু বুদ্ধিশুদ্ধি বেড়েছে।’

-‘আরেহ্, বাড়বে না? অনিক আছে তো। ঠেলেঠুলে ঠিকই ঘাড়ে বুদ্ধি ঢেলে দিবে।’

-‘ওহ, শোন। কাল হসপিটালে আসছি। ভাবীকে দেখব আর দুপুরের খাবার নিয়ে যাব। তোকে কিছু করতে হবে না। আন্টি রান্না করবেন বলেছেন।’

মায়ের মৃত্যুর পরও কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎ উজমা পেয়েছিল, যাদের কাছে সে সন্তান সমতূল্য। তারমধ্যে অনিক, তাক্বদীম ও মাইসারার মা অতুলনীয়। এই তিন মা তাকে সবসময়ই এত আদর করেন, মনে হলেই নিজের ভাগ্যকে বড্ড সুপ্রসন্ন মনে হয় উজমার। সে হাসিমুখেই বলল,

-‘আচ্ছা। আসিস।’

-‘আরেকটা কথা, বেবির নাম কী রেখেছিস? মোমের নাম তো সারা দিয়েছিল।’

নামের কথা ভাবতে গিয়ে আবারও ফারশাদের কথা মনে পড়ে গেল উজমার। ছেলেটা ঘুমিয়েছে কি-না কে জানে! ঘুমোলে ঘুমোক, না ঘুমোলে নাই। তার কী? নিজেকেই একগাদা বকাঝকা দিয়ে বলল,

-‘মাশিয়াত নামটা কেমন?’

-‘ভীষণ কিউট। কে দিয়েছে?’

-‘কে আবার? ভাইয়ার বন্ধু।’

-‘ওই ক্রিকেটার? কী যেন নাম, ফারশাদ মুনতাসীর না-কি কী একটা। দূর, খেলাটেলাও দেখি না, এদেরকেও চিনি না।’

-‘হ্যাঁ, উনিই। তুই সেলিব্রেটি হয়ে আরেক সেলিব্রেটিকে চিনিস না?’

উজমা একটু খোঁচা দিল বান্ধবীকে। রাইদাহ ফুলে উঠে বলল,
-‘সারাদিন অনেক কাজ থাকে আমার। সেলিব্রেটিদের নিয়ে পড়ে থাকলে তো হবে না। কে কোথায় গেল, কী করল, এসব আমার জানার দরকার কী?’

-‘হম, সেটা ঠিক। আচ্ছা, কাইফ কবে ফিরছে?’

-‘হয়তো সপ্তাহ খানেক লাগবে। ওখানে একটা কাজের ব্যাপারেই আলোচনা করতে গিয়েছে।’

তিন বান্ধবী আরও অনেক কথা বলল। ঘণ্টাখানেকের দুষ্টুমিষ্টি আড্ডা শেষ করে ভাইয়ের নম্বরে কল দিল উজমা। বাচ্চাটার খবর ও মিশকাতের সুস্থতার খবর নিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকাল। চোখ বন্ধ করতে গিয়েই ফারশাদের প্রত্যেকটা কথা কানে এসে ধাক্কা মারতে শুরু করল। বিরক্ত উজমা কানের ওপর বালিশ চাপল। তবুও হলো না। চোখ তো বন্ধ করা গেলই না, কানের ভেতর থেকেও কথাগুলো বের করা গেল না। না ঘুমিয়েই বসে রইল বিছানায়। বিড়বিড়িয়ে বকে গেল,

-‘দূর, অসভ্য লোক একটা। কোথা থেকে উড়ে এসে অযথা বকবক করে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। কানের কাছে এরকম একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে ঘুমোনো যায় না-কি!’

***

সকাল আটটার দিকে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরল ঊষা। সারারাত বাচ্চার জন্য জেগেই ছিল একরকম। ছোট্ট বাচ্চা। কখনও ঘুমায়, কখনও কাঁদে। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে বসে থাকাও যায় না। হাঁটাহাঁটি করে সামলাতে হয়। উসাইদ এখন হসপিটালে। রাতে হসপিটালে পুরুষ মানুষ থাকা নিষেধ হওয়ায়, সে তার এক বন্ধুর বাসাতেই ছিল। যেটা হসপিটালের পাশের ফ্লাটেই। মিশকাতকে ওভাবে রেখে বাড়ি আসতে ইচ্ছে করছিল না তার, আবার বাড়ি এলে যদি রাতে কোনো সমস্যা হয়, এজন্য দূরে এসে শান্তি পাবে না বলেই ওখানে থাকা। সকাল হতেই সে হসপিটালে পা রেখে বোনকে বাড়ি পাঠিয়েছে, যেন একটু বিশ্রাম নিতে পারে। দু’দিন এভাবে কষ্ট করা ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। ঊষা বাড়ি এসে দেখল, উজমা রান্নাঘরে, উসমান ওয়াজেদ ও ফারশাদ ড্রয়িংরুমে। সে একটা পেপার হাতে করে নিয়ে এসেছিল। সেটা খেয়াল করেই ফারশাদ বলল,

-‘নিউজপেপারে কী ছাপল আজ?’

ঊষা এগিয়ে এসে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘দূর আমি নিউজপেপার পড়ি না। ভাইয়া নিয়েছিল। লাগবে?’

ফারশাদ হাত বাড়াতেই খবরের কাগজ তার হাতে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল ঊষা। একটা একটা করে নিউজ না দেখে, সোজা খেলার খবরে চলে গেল ফারশাদ। ক’দিন ধরেই তাকে নিয়ে বেশ হুলস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। ফেসবুক স্ক্রল করলে নানানরকম সমালোচনা ও তিক্ত কথা সামনে আসছে রোজ। তাকে ও সোহানাকে নিয়ে বেশকিছু কথা লেখা হয়েছে আজ দৈনিক পত্রিকার পাতায়। এসব আবার মুনমুন হক্বের মাধ্যমে ছড়িয়েছে, এটাও স্পষ্ট। সকাল সকালই মন-মেজাজের বারোটা বেজে যাওয়াতে উঠে দাঁড়াল সে। আবার দেখা হলো ঊষার সাথে। বলল,

-‘একটা কাগজ-কলম হবে?’

-‘হ্যাঁ, দিচ্ছি।’

মুহূর্তেই নিজের রুমে প্রবেশ করে একটা ডায়েরি ও কলম বাড়িয়ে দিল ফারশাদের দিকে। বলল,
-‘ভাইয়া বলল, আজ আপনি চলে যাচ্ছেন।’

-‘হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। এটা তো আর আমার শ্বশুরবাড়ি নয় যে, দিনের পর দিন বসে থেকে জামাই আদর উপভোগ করব।’

ফারশাদ একটু শক্ত কণ্ঠেই কথাগুলো বলছিল। সব কথা উজমার কানে গেল। সে কোনো প্রতুত্তর না দিয়েই নিজের মতো করে কাজ চালিয়ে গেল। যেন সে কিছুই শোনেনি। ঊষা দু’জনকেই ভালোমতো লক্ষ্য করল। বোনের থমথমে মুখটাই তাকে অনেক কথা বুঝিয়ে দিল। সে তো আর ছোটো বাচ্চা নয়। অনেক কথাই বুঝে। সে-ও একটু ঠাট্টার ছলে বলল,

-‘আপনি চাইলে জামাই আদর হতে পারে, ভাইয়া।’

-‘শুধু আমি চাইলেই তো হবে না, ঊষা। অন্যজনকেও চাইতে হবে। এক হাত দিয়ে তালি বাজাব কী করে বোলো?’

-‘উম, বুঝলাম।’

মাথা নেড়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘ওই রমণী না, একটু বেশি-ই শক্ত। ওই মনে জায়গা পাওয়া এত সহজ হবে না।’

-‘কতটা শক্ত? পাথরের চেয়েও বেশি?’

-‘পাথর কি-না জানি না, তবে আপুকে টলানো এত সোজা না। শামীম ভাইয়ার মতো মানুষ পারল না আর আপনি। আমি তো কোনো পথই দেখি না।’

-‘শোনো, পিচ্চি। তোমার শামীম ভাইয়া ও আমার মধ্যে অনেক পার্থক্য বুঝলে। আমি যখন কাউকে ভালোবেসেছি, তখন তার সম্মান-অসম্মানের দিকটাও মাথায় রেখেছি। না বুঝে নিশ্চয়ই নিজেকে প্রকাশ করিনি।’

ঊষা ফের মাথা নেড়ে বলল,
-‘সিদ্ধান্ত না নিয়েই চলে যাচ্ছেন তাহলে।’

-‘একবার যখন বলেছি, তখন আমি আমার কথাতে অনড় থাকব। দেখা যাক ভাগ্য আমার সহায় হয় কি-না। যদি না হয়, তোমার ওই শক্ত মনের বোনকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিও। এতে যদি তিনি তার স্বামীকে একটু ভালোবাসতে পারেন আরকি।’

একদম উজমার দিকে চেয়ে চেয়ে কথাগুলো শেষ করল ফারশাদ। না শোনার ভান ধরে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে আবারও। রান্নাবান্না গুছিয়ে তাকে হসপিটালে যেতে হবে। সে কারও প্রেমের ডায়লগ শোনে নিজের মনকে মোটেও দুর্বল করবে না। জোর দিয়েই কাজকর্ম করে টেবিলে নাশতা সাজাল। বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ঊষা, খেতে খায়। আমার অনেক কাজ।’

ডায়েরি ও কলম নিয়ে ফারশাদ সোজা রুমে চলে গেলে ঊষা বোনের কাছে এসে বলল,
-‘শাম্মাপু ফোন করেছিল ভাইয়ার কাছে। বিয়েতে থাকতে বলেছে।’

‘উফফ যন্ত্রণা’ শব্দদুটো আওড়ে উজমা বলল,
-‘আমাকে কি নির্লজ্জ পেয়েছে যে ওর বিয়ে খেতে যাব?’

-‘আমিও বলেছি, যাব না। তবুও জোর করছে।’

-‘করুক, পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। আবার ফোন করলে বলিস, সাকিবকে যেন আঁচলের সাথে গিট্টু দিয়ে বেঁধে রাখে। বলা যায় না, রাস্তায় আবার কোনো মেয়ে মানুষ দেখল আর গিলে খাওয়ার জন্য পিছনে ছুটল।’

বোনের কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ঊষা। নাশতা খেতে বসে ফারশাদকেও ডাকল,
-‘ভাইয়া, আসুন। আজ একসাথে ব্রেকফাস্ট করি।’

ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। ঊষা কোনোকিছু না জানার ভান ধরে বলল,
-‘কিছু কি হয়েছে আপু?’

-‘না তো। কী হবে? কারও খেতে ইচ্ছে হলে খাবে, না হলে না। এত সাধতে হবে কেন? তুই খা তো। আমি তৈরী হয়ে আসি।’

উজমা সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে এলো। তখনও ফারশাদের খবর নেই। এই ছেলেটা এত জ্বালাচ্ছে। সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। বাবাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও বসতে চাইল, কিন্তু বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে গেস্টরুমের দরজায় এসে নক দিয়ে বলল,

-‘আপনি কি নাশতাটা শেষ করবেন? আমার দেরী হচ্ছে। আমি হসপিটালে যাব।’

সকাল থেকে উজমার সাথে একটা শব্দও কথা হয়নি। ইচ্ছে করেই কথা বলেনি ফারশাদ। শেষবেলা নিজেকে আর দুর্বল করতে চায় না সে। এজন্যই ইগনোর করা। এখন এই ডাক শোনে ভেতর থেকেই বলল,

-‘আপনি খেয়ে নিন। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’

আর কী বলবে ভেবে পেল না উজমা। কোনোরকমে বলল,
-‘আপনাকে ছাড়া আমি খেতে পারছি না।’

-‘কেন?’

-‘মেহমান রেখে খাওয়া যায় না-কি!’

-‘কাল তো ঠিকই খেতে পারলেন।’

-‘কাল ও আজকের মধ্যে অনেক পার্থক্য।’

-‘আমি তো কোনো পার্থক্য দেখছি না।’

‘দূর, এর সাথে কথা বলাই বেকার’ বিড়বিড় করে খেতে বসলো উজমা। আশ্চর্যজনকভাবে আবিষ্কার করল, সে খেতে পারছে না। সারাক্ষণ একটা অদৃশ্য কাঁটা গলার ভেতরে আটকে থেকে ভীষণরকম জ্বালাযন্ত্রণা দিচ্ছে। না খেয়েই উঠে দাঁড়াল। বেসিনে হাত ধুয়ে বোনকে বলল,

-‘আসছি, বাবার খেয়াল রাখিস।’

ঊষা খুব অবাক হলো। বোন তো এমন করে না। আজ কী হলো হঠাৎ? সে চিন্তিত মন নিয়েই বলল,
-‘তুমি কখন আসবে?’

-‘বিকেলে নাহয় রাতে। ঘণ্টাখানেক পর ভাইয়া আর মামীমাকে পাঠাব।’

ঘাড় দুলিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল ঊষা। বাবার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে নিজের খাওয়াও শেষ করল। প্রায় আধঘণ্টা পর রুম থেকে একেবারে তৈরী হয়েই বের হলো ফারশাদ। ঊষা অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল,

-‘এখুনি চলে যাবেন?’

-‘হ্যাঁ, দেরী করলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। আসছি। তোমার ডায়েরিটা রুমে আছে। ওটা তোমার বোনের হাতে দিও।’

-‘কিছু তো মুখে দিয়ে যান।’

ঊষার কথা রাখতে সামান্য পানি খেয়ে উসমান ওয়াজেদকে কদমবুসি করে বিদায় নিল ফারশাদ। মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাস্তায় এলো। একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে প্রথমেই পৌঁছাল বাসস্ট্যান্ডে। টিকিট কেটে ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষা দেখে, তড়িঘড়ি এলো একটা জুয়েলারির দোকানে। কয়েক মিনিটে চয়েস করল একটা স্বর্ণের চেইন। এরপর ছুটে এলো হসপিটালে, মিশকাত, উসাইদ, মামীমা ও বাচ্চাকে বিদায় জানাতে। এসেই দেখল, এখানে রীতিমতো মেলা জমেছে। অনিক, মাইসারা, রাইদাহ কাউকেই সে চিনলো না। মিনারা খাতুন ও মিশকাতের থেকে বিদায় নিয়ে বাচ্চার গলায় পরিয়ে দিল সদ্য কিনে আনা স্বর্ণের চেইন। কপালে আদর দিয়ে বলল,

-‘ভালো থেকো, মা।’

মিশকাত তার এত তাড়াহুড়ো দেখে বলল,
-‘আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন, ভাই? ওর নামকরণের অনুষ্ঠানে তো আপনাকে প্রয়োজন। আপনি ছাড়া কী করে হবে?’

-‘ভাববেন না, ভাবী। আমার দোয়া সবসময় ওর সাথে থাকবে। ইমিডিয়েট বাড়িতে যেতেই হবে। কিছু করার নেই।’

উসাইদ পাশ থেকে বলল,
-‘আবার কবে আসবি?’

-‘জানি না, দোস্ত। এখানে যদি রিযিক লেখা থাকে, হয়তো কোনোদিন আসব, নয়তো না।’

খুব করে খেয়াল করে উসাইদ দেখল, সাদামাটা যেসব কথা উজমা বলে, আজ সেসবও বলছে না। একধ্যানে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে। সরাসরি কিছু বলতেও পারল না। অনিক, মাইসারা ও রাইদাহ নিজেরাই পরিচয় দিতে এগোলে অনিক বলল,

-‘আপনি হয়তো আমাদের চিনতে পারেননি। আমরা উজমার বন্ধু। তাক্বদীমের কাছে আপনার অনেক কথা শুনেছি।’

উজমা শক্ত মেজাজে তাকাল অনিকের দিকে। বলতে পারল না, আগ বাড়িয়ে কথা বলিস না। ভাব বেড়ে যাবে। কটমট চোখে চেয়েই রইল। ফারশাদ সবকিছু খেয়াল করে বলল,

-‘আমার ভীষণ সৌভাগ্য যে, শেষবেলা আপনাদের সাথে পরিচয় হলো। বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি। ভালো থাকবেন আপনারা।’

বিদায়ের বেলা একবারের জন্যও উজমার দিকে তাকাল না ফারশাদ। হাসিমুখেই প্রস্থান করল। উসাইদও বেরিয়ে এলো বন্ধুর সাথে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে ফারশাদ বন্ধুকে বলল,

-‘একটা কথা দিবি আমাকে?’

অনুরোধের সুরে বলা এমন কথায় উসাইদ বন্ধুর দিকে তাকালে ফারশাদ তার হাত ধরে বলল,
-‘আমার ব্যাপার নিয়ে তুই ওকে কোনোপ্রকার জোরাজুরি করবি না। এই প্রস্তাবটাও আর ওর সামনে তুলবি না। আমি মেনে নিয়েছি, ও আমার ভাগ্যে নেই।’

-‘কেন?’

-‘আমি চাই না, কেউ নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করুক। তোর বোন অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। সহজে তাকে টলানো যায় না। তার শক্ত মনের দরজায় আমার ভালোবাসা সামান্য একটা নুড়িপাথর মাত্র। সেখানে টিকে থাকার সাধ্য ওই পাথরের নেই।’

-‘তাহলে কী করব? তুই-ই তো বলেছিস, তুই ওকে ভালোবাসিস। সবটাই কি আবেগের বশে বলা কথা ছিল?’

-‘এটা আবেগের বয়স নারে, বন্ধু। আমি ওকে ভালোবেসেছি নিজের সবটা দিয়ে। এজন্যই আপন করতে চেয়েছি। কিন্তু, জোর করে বা ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে নিজের জন্য চাইব, এটা বোধহয় অসম্ভব।’

-‘তুই কি চাস ওর অন্যত্র বিয়ে হোক?’

-‘তোর বোন যা চায়, তুই সেটাই করিস। আমার কিছু বলার নেই আর। ও যদি অন্য কারও কাছে গিয়ে নিজেকে সুখী ও নিরাপদ ভাবতে পারে, ভাবুক। আমি কোনোদিন ওর সুখে বাঁধা হব না। এসব নিয়ে তুই ভয় পাস না। আমি ওকে ভালোবেসেছি, সারাজীবন ভালোবাসার জন্য। ওর সুখের পথের বাঁধা হওয়ার জন্য নয়।’

রংপুরগামী বাস এসে থামলে ফারশাদ নিজের ট্রলিব্যাগ গাড়িতে তুলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে নিজের সিট চেপে বসলো। অচেনা শহরের মায়া কাটাতে চোখ বন্ধ করে মায়াবী মেয়েটার মায়ায় একা একাই ভাসতে শুরু করল। এই শহরটা ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। যেতে হবে। চলতে চলতে বাস হসপিটালের কাছে এসে থামলো। ছোট্ট মোমকে নিয়ে নিচের দোকানে এসেছিল উজমা ও মাইসারা। হঠাৎ করেই বাসের জানালায় চোখ পড়ল। চেয়ে দেখল, একজোড়া অভিমানী ও তৃষিত চোখ। বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে যে এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে, যেভাবে একদিন অনিকও এই শহর ছেড়েছিল। আপনা হতেই চোখদুটো জ্বলে উঠল উজমার। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল ফারশাদ। আর তাকানো যাবে না। এই ভয়ংকর রমণী কাছে থাকার মর্ম বুঝেনি। এবার দূরে গিয়েই নাহয় বোঝাবে। নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ে গেল,

-‘চলে যাচ্ছি মানে দূরে যাচ্ছি না। আপনাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য কিছু স্মৃতি জমা করে নিয়ে যাচ্ছি। ভালোবাসা ছাড়া এতগুলো বছর কাটিয়েছি। আরও অনেকগুলো বছর আপনাকে ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে পারব, বাটারফ্লাই। আপনি হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবেন না, কেউ একজন আপনাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় দিবানিশি জ্বলছে, পুড়ছে, নিঃশেষ হচ্ছে।’

***

চলবে…