মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-১৭+১৮

0
47

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – সতেরো

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

দীর্ঘ সময়ের লম্বা ভ্রমণ শেষ করে ফারশাদ যখন রংপুর পৌরসভা সংলগ্ন বাসভবনে এসে উপস্থিত হয়, তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। তার বাবা ফয়জান মুনতাসীর একজন উপজেলা চেয়ারম্যান। একটা সময় তিনি সরকারি ব্যাংকে জব করে প্রমোশন পেয়ে এখন উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েই দাপুটের সাথে চলাফেরা করছেন। মা-ও সেরকমই। বড়োলোক বাবার মেয়ে হওয়াতে মুনমুন হক্বও নিজেকে সবসময়ই সেভাবে উপস্থাপন করে আসছেন। যদিও বাবা ও মায়ের পরিচয়ে সে পরিচিত নয়, সে পরিচিত তার নিজস্ব পরিচয়ে। পুরো দেশের মানুষের কাছে ফারশাদ মুনতাসীর একটা আবেগের নাম। অসংখ্য ভক্তদের ভালোবাসা ও নিজের খেলার দক্ষতায় সে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত খেলোয়াড়। তাকে নিয়ে সমালোচনা খুব একটা হয়নি, খেলা নিয়ে যা একটু হয়, দু’দিন পর সেটা আবার চাপা পড়ে যায়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তুমুল সমালোচনার স্বীকার হচ্ছে সে, তা-ও মায়ের কারণে। সারাদিনের ক্লান্তি ও বিষণ্ণতায় ভরা মন নিয়ে ঘরে পা রেখে দেখল বিশাল বড়ো ড্রয়িংরুমের সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ফাবিহা। শরীরে ভারী হুডি থাকলেও সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে তার। একটা সুস্থ মেয়েকে এরকম অবস্থায় দেখে বিচলিত ফারশাদ সবকিছু ফেলে রেখে বোনের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকল,

-‘ফাবিহা, ভাইয়া এসেছি। এখনও ঘুমোসনি কেন? এখানে কী করছিস?’

কান্নারত মুখশ্রী নিয়ে মুখ তুলে ভাইকে দেখে দুর্বল শরীরে জোর দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তিতে ফারশাদকে জড়িয়ে ধরল সে। সমস্ত শরীর ছাপিয়ে কান্নারা বেরিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-‘মা আমার ওপর অনেক টর্চার করেছে। বলেছে, ওই ছেলেটার সাথে যেন ডেটিংয়ে যাই। এখনও পার্টিতে যাওয়ার আগে আমার গায়ে হাত তুলেছে।’

ফাবিহা এখন ডেটিং উচ্চারণ করলেও মুনমুন হক্ব মেয়েকে বলেছিলেন অন্য কথা। নিজের ভাইপোর সাথে মেয়েকে তিনি রুমডেটে পাঠাতে চেয়েছিলেন। ফাবিহা না বলাতে চড়-থাপ্পড় তো খেলই, ওই অসভ্য ছেলেটা এসেও তাকে অনেক গালিগালাজ করে গেল। নিজের মায়ের মুখ থেকে এরকম কথা শোনে ফাবিহার মনে হচ্ছিল, সে ওখানে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। এটা মা না-কি ডাইনী! মেয়ের সাথে কেউ এরকম করে? এত খোলামেলা আচরণ, তা-ও বিশ্রী ভাষায়। বোনের কান্নামাখা মুখ থেকে সব কথা স্পষ্ট বুঝে নেয়ার পর ফারশাদ বলল,

-‘সব বাদ। এখন আমরা ডিনার করব। আর কাল সকালেই ঢাকা যাব। ঠিক আছে?’

-‘আমি আর এখানে আসব না। উনি মা নোন, ভয়ংকর মহিলা একটা। কেউ নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে পারে বোলো?’

-‘বুবু এসব বুঝতে পেরেছিল বলেই বাড়ি ছেড়েছে। জানিস, আমি ওখানে তাহমীদ ভাইয়াকে দেখেছি। একপলকের জন্য। ভাইয়ার কোলে একটা বাচ্চা ছিল। ভীষণ আদুরে।’

-‘বুবু কি ভাইয়ার কাছে আছে?’

-‘জানি না তো।’

-‘ঠিকানা জানো না?’

-‘না…। খোঁজ নিয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। লোকাল থানার পুলিশকে জানিয়েছি। তাহমীদ ভাইয়ার গ্রাম, ভার্সিটি ও হোস্টেলের ঠিকানা দিয়েছি। ওনারা বলেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেন।’

-‘এরকম তো আরও চেষ্টা করেছিলে। লাভ তো কিছুই হয়নি।’

-‘হাল তো ছাড়ছি না।’

-‘আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হও। আমি টেবিলে খাবার দিতে বলি।’

-‘এইতো, গুডগার্ল। আর মন খারাপ নয়। কয়েকটা ঘণ্টাই তো। দুই ভাইবোন জমিয়ে আড্ডা দেয়া শুরু করব। সময় খুব দ্রুতই দৌড়াবে।’

উচ্চস্বরে হেসে উঠল ফাবিহা। ফারশাদ নির্ভার হলো। যাক, মেঘ কেটেছে তাহলে। ঝটপট নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ততক্ষণে কাজের খালা খাবার-দাবার সাজিয়ে রেখেছেন। দুই ভাই-বোন খেতে বসলো একসাথে। ফাবিহা বলল,

-‘সোহানা আপু এসেছিল।’

-‘কী চাইতে?’

-‘আর বোলো না। মায়ের কানে কীসব উল্টাপাল্টা কথার প্ল্যানিং সাজিয়ে সিম্প্যাথি আদায় করতে সাংবাদিকদের সামনে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিল। ব্যস, সবকিছু সুযোগ বুঝে ভাইরাল হয়ে গেল।’

-‘আমি সব দেখেছি। মা কীভাবে এসবে সায় দিল, বুঝলাম না। ওনার উচিত ছিল, এইদিকটা খুব সাবধানে হ্যান্ডেল করা, অথচ উনি সেটা করেননি। উলটে কী করলেন, তারই গুণধর পুত্র না-কি সোহানাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে এখন অ্যানগেজমেন্টের দিন হাওয়া হয়ে গেছে, এরকম ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে দিলেন। ভাবা যায়? কী পরিমাণ মিথ্যা কথা।’

খেতে খেতে দুই ভাইবোন এসব টুকরো টুকরো কথা নিয়ে আলোচনা করছিল। আচমকাই ঘরের সদর দরজা দিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে প্রবেশ করলেন মুনমুন হক্ব। ছেলেমেয়েদের কথা সামান্যই শোনেছেন তিনি। এর ভিত্তিতে চড়া গলায় বলে উঠলেন,

-‘তুমি কি ভেবেছ? পালিয়ে গিয়ে এই বাড়ির মান-সম্মান ডোবাবে? তুমি যেন এটা করতে না পারো, এজন্য তোমার ক্যারিয়ারের পথে ছোট্ট একটা বাঁধা তৈরী করলাম। দেখেছ তো, ক’দিন ধরে নিউজপেপারে কী তুলকালাম হচ্ছে?’

খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ফারশাদ। মাকে একনজর দেখল। জমকালো একটা গাউনের সাথে হাতে-পায়ে শোভা পাচ্ছে দামী দামী সব জুয়েলারি। বায়ান্ন বছর পেরিয়ে এসেও এই নারীর সাজসজ্জা ও ফিটনেস একেবারে ষোড়শী কন্যার মতো। দামী দামী সব মেকাপের ভারে নিজের বয়স হয়তো তিনি লুকাতে পারেন, কিন্তু লুকাতে পারেন না ইজ্জতকে। মুনমুন হক্বকে দেখলে কে বলবে, তিনি তিন তিনটে সন্তানের মা? সে খুব শান্ত মেজাজে হাত ধুয়ে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

-‘মান-সম্মান ঠিক কী, সেই সংজ্ঞাটা আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও তো মা। আমি তো ওসব বুঝি না। আমার তো ইজ্জতই নেই। যে নাটক তুমি শুরু করে, দেশের মানুষের সামনে আমাকে খারাপ বানিয়ে সামান্য সিম্প্যাথি অর্জন করতে চাইছ, সেটাকে কীভাবে মান-সম্মান বলে আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না। না মানে, এটা করে তোমার লাভ হলো কী? আমাকে খারাপ সাজিয়ে তুমি আসলে নিজেকে কী বোঝাতে চাইলে?’

মুনমুন হক্ব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,
-‘আমার কথামতো না চললে কী হয়, এটা তার ছোট্ট একটা ট্রেলার।’

-‘বেশ…। তাহলে আমিও মিডিয়াকে জানাই, ফয়জান মুনতাসীরের স্ত্রী মুনমুন হক্ব নারী জাতির কলঙ্ক। যে নারীর স্বামী-সন্তান, পরিবার, অর্থ-সম্পত্তি, সামাজিক মর্যাদা থাকার পরও পরপুরুষের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়, সে নারীর মান-সম্মান এত বেশি যে, আধুনিকতার নামে তিনি নোংরা খেলায় প্রতিনিয়ত নিজে ডুবে থেকে সন্তানদের দেন মানসিক অশান্তি, তাকে আপনারা সম্মানিত পদকে ভূষিত করে জাতিকে দেখিয়ে দিন, এরকম মায়েরাই ‘সেরা স্ত্রী ও সেরা মা’ হওয়ার অ্যাওয়ার্ড ডিজার্ভ করেন। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিতা হওয়ার কারণে, সংসার, সন্তান, পরিবার এসবকে তুচ্ছ করে আধুনিকতার সাগরে ডুবে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন রোজ। তিনি এমনই এক মা, যার চোখে সন্তানেরা বিক্রিত পণ্যের মতো। না আছে তাদের নিজস্ব ইচ্ছা, না আছে পারিবারিক সাপোর্ট, না আছে নিজেকে মেলে ধরার মতো সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি। তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। বলব, এসব কথা? খুব সম্মানের কথা হবে না এগুলো?’

মুনমুন হক্ব খানিকটা দমে গেলেন। চোপসানো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ছেলের সামনে। ফারশাদ তেজীয়ান কণ্ঠে বলল,

-‘তুমি নিজে নর্দমায় ডুবেছ ঠিক আছে। আমাদের কেন ডুবাতে চাইছ? তোমার জীবন যদি তোমার ইচ্ছে-স্বাধীনতার সিদ্ধান্তে চলে, তাহলে আমাদের জীবনও আমাদের ইচ্ছে-স্বাধীনতার ওপর চলবে। এখানে তুমি নাক গলাতেও পারবে না, নিজের সিদ্ধান্তকেও জোর করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। যতবার তুমি সেই চেষ্টা করবে, ততবারই আমি পালাব। আর নেক্সট টাইম, এই বাড়িতে আসাও ছেড়ে দেব।’

মুনমুন হক্ব চমৎকার করে হেসে বললেন,
-‘তাতে লাভ কী? সোহানাকে তো তোমার বিয়ে করতেই হবে। নয়তো মিডিয়ার সামনে আরও একটা নিউজ আমি তুলে ধরব, যা ভাইরাল হওয়ার পরপরই লোকজন তোমাকে জুতোপেটা শুরু করবে।’

-‘তুমি কি মা? মায়েদের মন তো এরকম হয় না। মায়েরা তো সন্তানদের জন্য সব সুখ-সাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে জানে। তুমি কেন পারো না কিছু ত্যাগ করতে? তুমি কেন প্রতিবারই আমাদেরকে তোমার কথামতো নাচাতে চাও? কেন একটা সুন্দর পরিবার গঠনের ইচ্ছা-আগ্রহ তোমার মধ্যে নেই? কেন মনে হয় না, যে সন্তানদেরকে তুমি গর্ভে ধারণ করেছ, তারা তোমার কাছে পজেটিভ কথাবার্তা আশা করে? সাপোর্ট আশা করে। একটা বার কি ভেবে দেখছ মা, তুমি যা করছ, এটা তোমাকে সাময়িক সুখ-শান্তি ছাড়া আর কিচ্ছু দিচ্ছে না। ইহকালীন সুখের জন্য তুমি তোমার পরকালকে নষ্ট করে দিচ্ছ মা। ফিরে এসো, প্লিজ। এখনও সময় আছে। তুমি খেয়াল করে দেখেছ, তোমাদের দু’জনের মধ্যে কত বছর ধরে একটা দূরত্ব চলছে? তোমরা একই বাড়িতে থাকো, অথচ আলাদা আলাদা। কেন? এসব যদি বাইরের মানুষ জানে, যে মান-সম্মানের কথা তুমি তুলেছ, সেটা কি আর আস্তো থাকবে? আমার গায়ে যে দাগ লাগিয়েছ, সেটার কথা বাদ দিলাম। তুমি মেয়ে হয়ে তোমার মেয়ের সাথে কী করছ? ভেবে দেখেছ একবার, এসবের কারণে আমরা সন্তানেরা তোমার কাছে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছি না? অথচ, মায়েরা হয় সন্তানদের ভরসার আশ্রয়। তুমি বেঁচে থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন সেই আশ্রয় থেকে বঞ্চিত, মা? কেন আমরা তোমার কাছে নিরাপদ নই?’

মুনমুন হক্ব এত কথার উত্তরে কোনো কথাই তুললেন না। বিরক্তিকর মেজাজের স্বরে বললেন,
-‘মাথা গরম কোরো না আমার, বাইরে থেকে এসেছি। নিজেকে আর নিচে নামাতে না চাইলে সোহানার সাথে বিয়েতে রাজি হও। এত তেড়িমেড়ি আমি সহ্য করব না। মনে রেখো।’

-‘তুমিও শোনে রেখো, সোহানার মতো নোংরা মন ও শরীরের মেয়েকে এই ফারশাদ মুনতাসীর তার জীবনে ভুল করেও জড়াবে না। আমি তাকেই বিয়ে করব, যাকে আমার মন চাইবে। যে আমার মনে আছে। আমার নিঃশ্বাস ও অস্তিত্বে মিশে আছে যে রমণী, ভালো আমি তাকেই বাসব, মৃত্যু না আসা পর্যন্ত। এটা আমার মনের এক এবং একমাত্র দাবী ও ওয়াদা।’

মুনমুন হক্ব প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা খেলেন। ফারশাদ কাউকে ভালোবাসতে পারে, তা-ও এই বয়সে এসে, তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না। অবাক চোখে চেয়ে থেকে বললেন,

-‘কে সেই মেয়ে? কাকে ভালোবাসো তুমি?’

ফারশাদ হাসিমুখ নিয়ে স্পষ্টবাক্যে বলল,
-‘ওইযে বললাম, আমার জীবন, আমার সিদ্ধান্ত। আমার জীবনের এই দামী সম্পদটাকে তোমার মতো মায়ের পায়ের কাছে এনে ফেলব না কোনোদিন। না তাকে নোংরা হতে দেব, আর না তাকে তোমার ওই নোংরা দৃষ্টির শিকার হতে দেব। তাকে আমি এতটাই নিরাপদে রাখব যে, তুমি তার ত্রিসীমানায়ও পা রাখতে পারবে না। কোনোদিন জানতেও পারবে না তার ঠিকানা কী, তার নাম কী।’

জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ছেলেকে ভস্ম করে দিয়ে মুনমুন হক্ব বললেন,
-‘আমি মুনমুন হক্ব, তোমার মা বলছি। ওই মেয়েটাকে তুমি কোথায়, কোন বাক্সের ভেতর গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে রাখো, সেটা আমি খুব শীঘ্রই দেখে ছাড়ব। যদি একবার তার খোঁজ পাই… আমি যে কত ভয়াবহ হব, সেটা তুমি টেরও পাচ্ছ না, শাদ।’

ফারশাদ এত তর্কেবিতর্কে গেল না আর। নিজেকে শান্ত রেখেই সরে পড়ল। মুনমুন হক্ব কড়া শাসনের চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বকতে গেলেই ফাবিহা জান বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমেই দরজা আটকে দিল। কাল সকালের আগে আর বেরই হবে না। এই মায়ের সামনেও দাঁড়াবে না। এতে যা হয়, হোক।

***

উজমা বাড়ি ফিরল রাতে। মিনারা খাতুনকে সাথে নিয়ে। ঊষা হসপিটালে গিয়ে আজও বায়না ধরল সেখানেই থাকবে। অগত্যা বাবার দেখাশোনা করার জন্য মামীমাকে নিয়ে মধ্যরাতেই বাড়ি ফিরতে হলো তাকে। হাতের ব্যাগপত্র রেখে প্রথমে ফ্রেশ হলো, এরপর মামীমা ও তার জন্য খাবার সাজাল। বাবাকে রাতের খাবার খাইয়ে গিয়েছে ঊষা। রুম চেক করে দেখল, তিনি ঘুমাচ্ছেন। বিরক্ত করল না আর। মিনারা খাতুন খেয়েই ঘুমাতে চলে গেলেন। উজমা সব গুছিয়ে রুমে এসে কয়েল জ্বালিয়ে রেখে ক্লান্তি সরাতে বিছানায় পিঠ ঠেকানো মাত্রই হ্যাঙ্গারের দিকে চোখ পড়তেই দেখল, ফারশাদের জ্যাকেটটা সেভাবেই আছে, যেভাবে ওইদিন রাতে রেখেছিল। বড্ড অযত্ন ও অবহেলায় এটাকে পড়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগলেও, সেই খারাপ লাগাকে বেশিক্ষণ মনে ঠাঁই দিল না। হসপিটালে পৌঁছে ঊষা বলেছিল, গেস্টরুমে ফারশাদ ডায়েরি রেখে গেছে। কেন, কীজন্য, এসব কিছুই বলেনি ঊষা। শুধু বলেছে, চেক করে দেখো। কে জানে আজ রাতটা কেমন কাটবে, এইভেবে রুম ত্যাগ করে সোজা গেস্টরুমে এলো। রুমের সবকিছু পরিপাটি। সবকিছু ফাঁকা। স্টাডি টেবিলের ওপর ডায়েরি ও ছোট্ট বাক্সটা রাখা। কৌতূহল থেকেই ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে-পাল্টে দেখল, চমৎকার হ্যান্ড রাইটিংয়ের সাহায্যে কয়েক পৃষ্ঠা কিছু লেখা। এত ছোটো ছোটো অক্ষর ও সমান আকারের লেখা দেখে চোখেমুখে একটু মুগ্ধতা নেমে এলো। লেখাটার প্রতি আগ্রহ জন্ম নিল। পড়া শুরু করতে গিয়ে দেখল, একটা গানের লিরিক। বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,

❝যদি আরেক জনম আমি পাই গো…
সে জনমে তোমাকেই চাই গো…❞

লিরিক শেষ করে আনমনেই হাসলো উজমা। বিড়বিড় করল,
-‘এত বিষাদের সুর নিয়ে কেউ কাউকে চিঠি লিখে?’

বাক্যটা আওড়ে খেয়াল করল, ডায়েরির লেখা ও কাগজ সামান্য কুঁচকানো। পানি পড়ার পর শুকিয়ে গেলে যেরকম দাগ হয়, তেমনি বেশ কিছু ছোটো ছোটো দাগ। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিশ্চিত হলো, ওটা পানিরই দাগ। অকারণেই মনে প্রশ্ন জাগল,

-‘খাবার পানি না-কি চোখের পানি!’

মনের প্রশ্ন চেপে রেখে আগ্রহী মন নিয়েই চিঠিতে মনোযোগ দিল। লিরিকের নিচের লেখাগুলো পড়তে লাগল,

ডিয়ার বাটারফ্লাই,

গানের সম্বোধনে ‘তুমি’ ব্যবহার হলেও আপনার ও আমার মাঝে যে দূরত্ব, সেসব হিসেব করতে গিয়ে ‘তুমি’ সম্বোধন করে অনুভূতিকে সুগভীর করার মতো পর্যাপ্ত সাহস আমি পেলাম না বলে, দুঃখিত। দূরের মানুষ যারা তাদেরকে আবার ‘তুমি’ সম্বোধন করা যায় না। খুব বেশি কাছের হলেই ‘তুমি’ ডাকটা বেরিয়ে আসে। আপনি আমার কাছের হলেও আমি আপনার কাছের কেউ নই, তাই আপনাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বিরক্ত করলাম না। দূরের মানুষ, দূরেই রইলাম।

মূল লেখায় ফিরে আসি। এটাই প্রথম কোনো চিঠি, যার প্রতিটা শব্দ আমি আপনার জন্যই লিখছি। আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লিখছি। এই যুগে এসে আমি ফারশাদ মনের সবটুকু আবেগ ও অনুভূতি ঢেলে দিয়ে কারও জন্য চিঠি লিখব, কখনও ভাবনাতেই আনিনি। যাই হোক, বেশিকিছু লিখে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করব না।

মানুষের জন্ম তো একবারই হয় তাই না? মৃত্যুও একবার। এই জনমের ইতি যেদিন ঘটবে, সেদিনই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের নাম ও অস্তিত্ব। যদি আরেক জনম বলে কিছু থাকত, সেই জনমে নিঃসন্দেহে আমি আপনাকেই চাইতাম, স্রেফ আমার করে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। ফারশাদ আরেক জনমের আশা করে না, তবে এই জনমের চাওয়া-পাওয়াকে এত সহজে মূল্যহীন হতে দিবে না বলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে নিজের কাছে। যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ আমি আপনাকে ও আপনার ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য লড়াই করে যাব। অন্য কারও নামে ‘কবুল’ বলার আগে পর্যন্ত যতদিন আপনি একা থাকবেন, ততদিন আমি আপনাকেই ভালোবেসে যাব। আপনাকে পাওয়ার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখব না, ইনশা’আল্লাহ। আমি জানি, অনুভূতি হচ্ছে মনের ব্যাপার। এটা জোরপূর্বক আসে না। কিন্তু যে অনুভূতি একবার জন্ম নেয়, সেই অনুভূতি কীভাবে জোরপূর্বক মনে চাপিয়ে রেখে দিন অতিবাহিত করতে হয় আমি জানি না। এজন্য পারিনি, আপনাকে ঘিরে আমার মনে যেসব অনুভূতির জন্ম হয়েছে, সেগুলোকে মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যেতে।

জীবনের এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে আমি, এই অসময়ে এসে কারও মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলব, ভুল করেও বুঝতে পারিনি। যদি আগে থেকে বুঝতে পারতাম, আমার মনটাকে আমি আটকেই রাখতাম। কখনও তাকে আপনার মায়ায় জড়াতে দিতাম না। আর এখন জড়িয়ে, আমি টের পাচ্ছি, ভালোবাসা কেন এত সুন্দর! ভালোবাসায় কেন এত শান্তি! খুব অল্প সময়েই আমি আপনার মায়ায় জড়িয়েছি বলেই, এটাকে আপনি আবেগের দিক থেকে বিচার করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে সবার কাছে এটা আবেগই। কিন্তু আমি জানি, আমার এত বছরের যত্নে গড়া মনে আমি কোনো আবেগকে ঠাঁই দেইনি। জেনে-বুঝেই মন হারিয়েছি, ভালোবেসেছি।

ভালোবাসা যে এত প্রশান্তিময়, তা আপনাকে ভালোবাসার পরই উপলব্ধি করলাম। আচ্ছা, আপনি বলেন তো, ‘ভালোবাসা আপনার কাছে ঠিক কী?’ ভালো তো কাউকেই বাসেন না, এর উত্তরও জানবেন না। আমি-ই বলছি, ভালোবাসা আমার কাছে একখণ্ড মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমার চাঁদের মতো। যে চাঁদ খুব বেশিক্ষণ মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না, বরং নিজ গুণ ও শক্তির দাপটে সে আবারও আগের মতো জ্বলজ্বল করে আলোকিত করে গোটা পৃথিবীতে। সে বুঝিয়ে দেয়, তার মতো চমৎকার করে এত মায়াবী রাত কেউ তৈরী করতে পারবে না। সে যদি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিষাদের সুর নেমে আসবে। আর সে যদি নিজ ক্ষমতায় জ্বলে উঠে, তাহলে পুরো আঁধার রজনী আলোর বন্যায় ভেসে যাবে। এত আলোর মিছিল দেখে রাতের আকাশের তারাগুলোও বাঁধনহারা জলের মতো হৈচৈ করতে বাধ্য হবে। যে আলো ওই গোটা রাতকে অন্যসব রাতের চেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলে, সে আলো সবার কাছেই প্রিয় থেকেও অধিক প্রিয় হয়। আমার মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা আপনি নামক অনুভূতিটাও ঠিক এরকমই। সবটুকু বিষাদ, যন্ত্রণা ও কষ্ট আমি ভুলে যাই, যখনই আমার মনের ভেতর আপনার আনাগোনা টের পাই। আমি বুঝতে পারি, আপনার এক সেকেন্ডের উপস্থিতির এতই প্রভাব যে, আমার মনের সব যন্ত্রণা ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে যায়। নিজেকে এতবেশি সুখী ও আনন্দিত হতে আমি আগে কখনও দেখিনি। আপনাকে ভাবতে গিয়ে আমি হাসি, শান্তি পাই, আবেগে ভাসি, সুখের নিঃশ্বাস ফেলি। মনের ভেতর আপনার আনাগোনা টের পেলেই, মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতোই ঝলমল করে হেসে উঠে আমার হৃদয়ঘর। মনের আঙিনায় সুখ নেমে আসে, সেই সুখে সব দুঃখেরা বিলীন হয়ে যায়। এখন হয়তো ভাবছেন, ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরের জীবনে আবার যন্ত্রণা কী! কষ্ট কী!

এই পৃষ্ঠার সমাপ্তি এখানেই। পরবর্তী পৃষ্ঠা উলটে দেখল, সেখানে লেখা, ‘মানুষ কখন এবং কেন ভালোবাসে?’ এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, একজন মানুষ কখন অপর একজন মানুষকে ভালোবাসে, সেটা মানুষ প্রথমেই কিন্তু বুঝতে পারে না। যে কেউ এই অনুভূতিতে যখন-তখন জড়াতে পারে। এই অনুভূতির নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই, নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। কেউ কৈশোরে ভালোবাসে, কেউ তারুণ্যে আবার কেউ কেউ যৌবনের একটা পর্যায়ে এসেও ভালোবাসতে শিখে যায়। কাউকে ভালোবাসার পরই কিন্তু সে বুঝতে পারে, সে ভালোবেসেছে এবং খুব গভীরভাবে।

ধরুন, আপনি প্রচণ্ড একা। এতটাই একা যে, নিজেকে সামলাতে গিয়ে আপনি বুঝতে পারছেন, আর সম্ভব নয়। জীবন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এই কঠিন জীবন থেকে মুক্তিটা ভীষণ দরকার। আপনি এমন একটা জায়গায় আছেন, যেখানে প্রতিবার নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে আপনার মনে হচ্ছে, জীবনের মানে কী এই! এমন জীবন মানুষ চায় কেন? কিছু কঠিন বাস্তবতা, কিছু নোংরা অভিজ্ঞতা, কিছু দমবন্ধ করা মুহূর্ত যখন আসে, তখন নিশ্চিত আপনার মনে হবে, ইনাফ। সব সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারছেন না, আবার অস্বীকারও করতে পারছেন না। এখন সেটা ভালো হোক কি মন্দ, আপনজন বলেই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন। একটা সময় সবকিছু যখন আপনার অসহ্য টিকবে, আপনি মুক্তি খুঁজতে পালাবেন। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটেছে, যার কারণে নিজেকে মুক্তি দিতেই আমি পালিয়েছি।

আমার মা সম্পর্কে অল্প বয়সেই যে কঠিন সত্য আপনি জেনেছেন, সেটা আজও একইভাবে শক্ত খুঁটির ন্যায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার সাথে। তিনি ছাড়তে নারাজ এবং সেই একই পথে নিজের সন্তানদের টেনে নিতে মরিয়া। এজন্য তিনি আমাদের তিন ভাইবোনের জীবনকে নরক বানানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। বুবু পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে। ফেঁসে গেছি আমরা। মায়ের পছন্দের মেয়ে সোহানা। সম্পর্কে আমার কাজিন। ওর স্বভাবও মায়ের মতোই। ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় মডেল ও গুণী অভিনেত্রীও বলতে পারেন। মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দিক বিচার করেই একজন মানুষকে সৎ, সুন্দর ও চমৎকারের মতো নানান উপমাতে আখ্যায়িত করা যায়। সোহানাকে যদি কোনোকিছুর সাথে তুলনা করতে হয়, এক কথায়, নর্দমা। সে ভেতর ও বাহির থেকে আপাদমস্তক নোংরা মন-মানসিকতার একটা মানুষ। এরকম একটা মানুষকে জেনে-বুঝে নিজের সাথে জড়ানো যায়? ভালোবাসা যায়? জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা যায়?

‘আপনি কাকে ভালোবাসবেন এবং কেন বাসবেন?’ এটা যদি আপনি বিচার করতে যান, তাহলে দেখবেন সবকিছুর হিসেব শেষে একটা কথাই আপনি আবিষ্কার করবেন, ‘ভালোবাসা হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষের জন্য নিরাপদ একটা আশ্র‍য়। প্রচন্ড কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও যে আশ্রয়টা দুটো দৃঢ় সংকল্পিত খুঁটির কারণে দীর্ঘবছর বেঁচে থাকতে পারে। যেখানে মানুষ খুব যত্ন ও বিশ্বাসের সাথে নিজের সমস্ত সত্তাকে বিলিয়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকে যে, এই অনুভূতিটার অবজ্ঞা, অযত্ন হবে না। এই নিরাপদ আশ্রয়টা একে-অন্যকে দিতে পারাটাই হচ্ছে ভালোবাসা। এই নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেকে একদম নির্ভার রাখতে পারাটাই হচ্ছে ভালোবাসা।’ এখন আপনি যার কাছে মূল্যবান নোন, যার কাছে নিরাপদ নোন, যার কাছে আপনার বিশ্বাস ঠুনকো, যে আপনার বিশ্বাস ও ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারবে না, এতকিছু জেনেও তাকে আপনি কীভাবে ভালোবাসবেন? কীভাবেই বা একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর কাটাবেন?

এই পৃষ্ঠার সমাপ্তি শেষে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টালো উজমা। সেখানে শুরুতেই লেখা,
-‘এখন আমি উত্তর দিই, কেন এবং কী কারণে আপনাকে ভালোবেসেছি এবং সারাজীবন আপনাকে ভালোবাসব বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – আঠারো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

বাটারফ্লাই, দিনের সূর্য ও রাতের চন্দ্রের পার্থক্যের মতো বাহ্যিক চাকচিক্য ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলীর মধ্যেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে, এটা তো জানেন নিশ্চয়ই। একটা মানুষের সৌন্দর্য যেমন নজর কেড়ে নেয়, ব্যক্তিত্বও তেমন মন কেড়ে নিতে পারে নিমিষেই। শুধু সৌন্দর্য দিয়ে একজন মানুষকে সম্পূর্ণ বিচার করা যায় না, মানুষকে বিচার করতে হয় তার অভ্যন্তরীণ গুণাবলী ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে। চন্দ্র-সূর্য ছাড়া যেমন রাত-দিনকে কল্পনাও করা যায় না তেমনি ব্যক্তিত্ব ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলী ছাড়া একটা মানুষকে পরিপূর্ণ সুন্দর বলা যায় না। হ্যাঁ, রূপ অবশ্যই সৌন্দর্য বোঝাতে সক্ষম, তবে কখনওই তা ব্যক্তিত্ব বোঝায় না। আপনাকে যদি এসব দিক থেকে আমি বিচার করি, তাহলে আমার কাছে অন্তত এটা পরিষ্কার যে, আপনার ব্যক্তিত্ব চমৎকার। আপনাকে সম্পূর্ণ না জেনে মন হারিয়েছি, আর ধীরেধীরে যত জেনেছি, ততই আরও গভীরভাবে ভালোবেসেছি। আর এখন, আমি আমার প্রতিটা নীরব মুহূর্তে, শয়নে-স্বপনে শুধু আপনাকে উপলব্ধি করি।

সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই যে, আমার জীবনের কঠিন একটা সময়ে এসে আমি আপনাকে পেয়েছি, আবার ভালোও বেসেছি। যে ব্যক্তিত্ব একবার মন কেড়ে নেয়, তাকে ভুলে যাওয়া তো সম্ভব হবে না কোনোদিন। আমি ভুলতেও চাই না। যার উপস্থিতি আমার মনকে পুলকিত করে, আমার চারপাশ রঙিন করে দেয়, যে সামনে থাকলে চোখে ও মনে তৃপ্তি নেমে আসে তাকে ভুলে অন্য কাউকে গ্রহণ করে নেয়া অসম্ভবই বটে। যদি এই অনুভূতির সীমা-পরিসীমা জানতে চান, তাহলে বলব – আকাশের বিশালতায় দৃষ্টি দিন, খুঁজে নিন সীমানা। যদি তা না পান, বুঝে নিবেন আমার মনেও আপনার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা লুকানো। দৈর্ঘ, প্রস্থ কিংবা উচ্চতা দিয়ে এই অনুভূতির গভীরতা আপনি হিসেব করতে পারবেন না, সীমানাও খুঁজে পাবেন না কোনোদিন। কারণ এই অনুভূতি মেপে সীমা-পরিসীমা খুঁজে বের করার মতো কোনো যন্ত্র আজও আবিষ্কার করতে পারেনি কোনো বিজ্ঞানী। এটা পরিমাপ করে বুঝানোর মতো কোনো অনুভূতি নয় বলেই হয়তো, ভালোবাসা নিরাকার, অপরিসীম ও অতলস্পর্শী।

‘আমার কাছে ভালোবাসা, সম্পর্ক ও বন্ধনের মানে কী জানেন?’ উদাহরণ হিসেবে বলি, একটা ঝিনুক দেখেছেন তো নিশ্চয়ই। শক্ত খোলসের আবরণে একটা ঝিনুক, দিনের পর দিন সমুদ্রের অথৈজলেও ভীষণ যত্ন ও নিরাপদে আগলে রাখে তার মুক্তোকে। ওই খোলসটা যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি ভাঙতে না পারছেন, ততক্ষণ মুক্তোটা কিন্তু নিরাপদই। ঝিনুক তার মুক্তোর মূল্য বুঝে বলেই প্রত্যেকটা উত্থাল-পাতাল ঢেউ সে সয়ে নেয়, অথচ মুক্তোর গায়ে সামান্যতম আঁচও পড়তে দেয় না। সম্পর্ক, ভালোবাসা ও বন্ধনটা এমনই। দুটো মানুষ বিশ্বস্ত হাতে ঝিনুকের শক্ত খোলস হয়ে সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখে বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসার সাথে। যত ঝড়তুফান আসুক, যত কঠিন পরিস্থিতি তৈরী হোক, দুটো বিশ্বস্ত হাতের কারণে মুক্তোর মতোই সম্পর্কটা বেঁচে থাকে যত্নে, ভীষণ নিরাপদে।

মনে আছে আপনার, সেই বৃষ্টিভেজা রাতে হাতে-হাত রেখে পাশাপাশি, কাছাকাছি হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছার কথা? ওইমুহূর্তে আমি কী চাইছিলাম জানেন? যে হাতটা আমি একবার ধরেছি, সে হাত যেন সারাজীবন ধরে রাখতে পারি। পায়ে পা মিলিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে, একটা বরফ শীতল হাতের মুঠোয় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই মুহূর্তটা আমার কাছে ভীষণ সুন্দর ও সেরা প্রাপ্তির একটা ছিল। একজীবন ওই স্মৃতি আমাকে ভীষণ সুখ দিবে। আপনাকে বলেছিলাম না, ‘সেদিনের কিছু মুহূর্ত একটু বেশি-ই সুন্দর?’ ওখানে বৃষ্টি যেমন সুন্দর ছিল, তেমনি সুন্দর ছিল আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিকন্যাও। তার ভয়ভয় মুখ, হতবাক দৃষ্টি, বৃষ্টিভেজা চোখের পাপড়ি ও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের স্বর, সবকিছু এত মাতাল করা ছিল যে, আমি নিঃশব্দে হোঁচট খেয়েছি কতবার। পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে আপনি যখন আমাকে কাছে টেনে আনলেন, তখন এত খুশি লাগছিল কেন জানেন? এটা ভেবে যে, আমি কারও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। এই সামান্য পরিচয়ে আমাকে আপনি এত বিশ্বাস করলেন যে, নিজেকে আমার কাছে নিরাপদ মনে করলেন। এইটুকু অনেক স্বস্তি ও সুখ দিয়েছিল আমায়। কারও বিশ্বাস অর্জন করা কত কষ্টের সেটা তো আপনি জানেন, বুঝেন। বিশেষ করে কোনো বিপজ্জনক মুহূর্তে, কিংবা এমন মুহূর্তে যেখানে ভয়, লোকলজ্জা কতকিছু জড়িয়ে থাকতে পারে। তবুও অচেনা এই আমাকে বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন। কেন? উত্তর জানা আছে আপনার?

এতটুকু পড়ে ডায়েরি বন্ধ করল উজমা। এত দীর্ঘ চিঠি কেউ লিখে? তা-ও মন কেমন করা সুরে! আজ আর পড়ার ধৈর্য নেই, জোর নেই। সামান্য কয়েক লাইনের চিঠি মনে কোনোপ্রকার অনুভূতি জাগাতে না পারলেও ভীষণরকম বিষণ্ণ করে দিয়েছে মনকে। চোখের পাতা ভার হয়ে এসেছে। ঘুমোনো দরকার। কত রাত যে ঠিকমতো ঘুম হয় না। ডায়েরি হাতে নিয়েই ফিরে আসতে গিয়ে ছোট্ট বাক্সটার দিকে নজর গেল। মুখ খুলে দেখল, পায়ের সেই আংটিটা। মন খারাপের সুরেই বিড়বিড়,

-‘আপনার ভালোবাসায় হয়তো কোনো ভুল নেই। কিন্তু আপনি ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবেসে নিজের মনকে কষ্ট দিয়ে ফেললেন। সারাজীবন এই কষ্টের ভার একাকী বয়ে বেড়াবেন অথচ আমি… না পারব সমাজ ডিঙাতে, আর না পারব সব ভুলে গিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে।’

***

সকাল দশটায় নাশতা শেষ করে দুই ভাইবোন প্রস্তুতি নিল, ঢাকার পথে রওনা দেয়ার। ফাবিহা সবকিছু গুছিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে নিচে এলো। ফারশাদও এলো। হুড়মুড় করে তখন দু’জনের কাছে এসে দাঁড়াল সোহানা। সোজা ফারশাদের সামনে। মুখোমুখি হয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,

-‘তুমি এটা করতে পারলে আমার সাথে? আমি এতদূর থেকে ছুটে এসেছি, তোমার জন্য। আর তুমি কি-না আমাকে এভাবে অপমানের সাগরে ডুবিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে! কী করে পারলে এটা করতে?’

ফারশাদ মুচকি হেসে বলল,
-‘আমি তোকে কোথায় ডোবালাম? ডুবলি তো তুই নিজে।’

-‘ছিঃ। কীভাবে পারো কাউকে ঠকাতে?’

-‘হাসালি। আমি তোকে ঠকাব কেন? আমি বলেছি দেশে ফিরে আয়? আমি বলেছি, আমি তোকে বিয়ে করতে চাই? আমি বলেছি, ওইদিন অ্যানগেজমেন্ট হবে? এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কেউ একবার আমাকে জানিয়েছ, বিয়েতে আমার মত আছে কি নেই? আমি তোকে বিয়ে করতে চাই কি-না? তোকে পছন্দ করি কি-না? কেউ-ই তো জানতে চায়নি। আমি তো জানতামই না, সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন হয়েছে। আমাকে কীভাবে ফাঁসানো হয়েছে জানিস কিছু? খোঁজ রেখেছিস?’

প্রাকটিস না থাকলেও কিছুদিনের অবসর ছিল ফারশাদের। বাড়ি থেকে ফোন করে তার বাবা বলেছিলেন, একটা বিশেষ দরকার, যদি তার সময় হয়, যেন বাড়ি আসে। বাড়ির সাথে সম্পর্ক তার শেষ হয়েছে অনেক আগে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আসে না। মাঝেমধ্যে ফাবিহা কান্নাকাটি করলেই একদিনের জন্য আসে আবার চলে যায়। যেহেতু বাবা বলেছেন, জরুরী দরকার, তার মানে জরুরী-ই। কেউ তাকে বিয়ের ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি, ফাবিহাকেও কিছু জানানো হয়নি। ফারশাদ বাড়ি এলে, রাতে মুনমুন হক্ব বলেন একটা পার্টির আয়োজন করেছেন। কেন, বা কীসের জন্য এটা বলেননি। ছোটোবেলা থেকেই এরকম দু’একটা পার্টিতে অ্যাটেন্ড করার অভ্যাস আছে ফারশাদের। পার্টির সুযোগে আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে দেখা হয়, আড্ডা হয়। সময়টা ভালো কাটে। গণ্ডগোল তো বাঁধল, পরদিন সকালে। মায়ের মুখ থেকেই শুনল, সোহানার সাথে তার অ্যানগেজমেন্ট। ব্যস, রেগেমেগে তখুনি তছনছ করে দিল সবকিছু। হাত জোর করে বুঝালো পর্যন্ত। মুনমুন হক্ব ছেলের কথায় কান দিলেন না। সবাই যেহেতু জেনে গেছে, পার্টি হতেই হবে। অ্যানগেজমেন্টও হবে। হাত-পা ধরে বুঝিয়েও যখন লাভ হলো না, তখনই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলো। মিডিয়ার সামনে না বলতে গেলে, অনেক ঝামেলা হতো। এটা তো আর বলা সম্ভব নয় যে, সোহানার চরিত্রে দোষ আছে!

সোহানা এত কথায় কান দিল না। বলল,
-‘কেন আমাকে পছন্দ কোরো না? আমি তো তোমাকে পছন্দ করি। ভালোও বাসি। তোমার জন্যই দেশে এসেছি।’

-‘তা-ই? তুই আমার জন্য এসেছিস? ওমা, ওখানকার ছেলেদের আর ভালো লাগে না? রুচি উঠে গেল এত তাড়াতাড়ি?’

-‘কী বলতে চাইছ তুমি?’

-‘তোর সাথে কথা বলার রুচি নেই। প্লিজ, সর।’

সোহানা সরে যাওয়ার নামই নিল না। গায়ের জোর দেখিয়ে ফারশাদের শার্টের কলার ধরলে ফারশাদ তার দুটো হাত টেনে সরিয়ে কয়েক হাত দূরে ফেলে দিল। সোহানা ফের উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ফারশাদকে দুর্বল করে দেয়ার বাহানায় বলল,

-‘তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যিই।’

আবারও ছুটে এসে ধরতে চাইলে হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দুটো চড় মেরে বসলো ফারশাদ। সোহানা হতভম্ব হয়ে কেঁদে ফেলল। চিৎকার করে ডাকল,

-‘খালামণি, তোমার অসভ্য ছেলে আমার গায়ে হাত তুলেছে। ওই হাতে আমি হাতকড়া পরাব।’

এক চিৎকারেই কাজ হলো। মুনমুন হক্ব ছুটে এলেন। পরনে এখনও নাইট স্যুট। ছেলের দিকে রেগেমেগে তাকিয়ে বললেন,
-‘ওকে মারছ কেন?’

-‘এখন তো চড় মেরেছি। আবার যদি আমার গলায় ঝুলতে আসে তো, একদম ছুরি বসিয়ে দেব। ও তোমার বোনের মেয়ে সেটা ভুলে যাব আমি।’

-‘শাদ…। বাড়াবাড়ি করছ।’

-‘বাড়াবাড়ি তো তোমরা করছ। আমার সাথে। বেঈমানী করেছ। জরুরী প্রয়োজনে ডেকে এনে অ্যানগেজমেন্টের পার্টি ডেকেছ। মেয়ে মানুষকে সম্মান করি বলেই, ওই সন্ধ্যায় মিডিয়ার সামনে যেন তোমাদের কোনো অপমান না হয়, সেজন্য আমি সরে পড়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো দমে যাবে না। যে খেলাটা তুমি শুরু করেছ, সেটার শেষ করব আমি। মিডিয়ার সামনে আমাকে অপদস্ত করতে চাইছিলে না? এবার আমিও নামব মাঠে। দেখব, লোকের থুতু হজম কোরো কী করে।’

-‘তাইবলে তুমি এত বড়ো একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলবে? তোমার বিবেক বলতে কিচ্ছু নেই?’

-‘বিবেক? কাকে বলে জানো তুমি? ওটা তোমার মধ্যে আছে তো? মনে আছে, তাহমীদ ভাইয়ার সাথে তুমি কী করেছ? মনে আছে, নিজের মেয়েকে ঘরে আটকে রেখে কী পরিমাণ মানসিক নির্যাতন তুমি করেছ? তোমার কি এটা মনে আছে যে, তোমার এই রূপ জানার পর সেদিন রাশেদ সাহেবের সাথে আমি কী করেছিলাম? সবকিছু যদি মনে থাকে, তাহলে একটা কথা কান খুলে শোনে নাও, আমার জীবনে যে-ই নাক গলাতে আসবে, স্রেফ রক্তাক্ত করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।’

মুনমুন হক্ব ছেলের এই আচরণ মেনে নিতে পারছেন না। বোলতার বাসায় ঢিঁল ছুঁড়ে তিনি ভুল করেছেন। ফারশাদ রেগে গেলে কী ভয়ানক হয়, সেটা তো তিনি জানেন। উফফ, যন্ত্রণা। কী করবেন এখন? পরিস্থিতি সামলানোর কোনো উপায় তার জানা নেই। পড়াশোনা ও ক্রিকেটের মায়ায় পড়ে ফারশাদ যখন ক্রিকেটকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখত, তখন থেকেই ঢাকায় একাকী জীবনযাপন শুরু হয় তার। প্রয়োজন না হলে বাড়িতে আসত না। আত্মীয়স্বজন কারো বিয়ে-শাদীতেও তাকে দেখা যেত না। নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দিয়ে এক পর্যায়ে যখন জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নেমে জীবনে প্রথম উপার্জন করে, সেদিন খুশিমনে বাড়ি ফিরেছিল সে। ইচ্ছে ছিল, সব টাকা মায়ের হাতে তুলে দিবে। তখনও মায়ের ভয়ংকর রূপ ফারশাদের সামনে আসেনি। সে মনের সবটুকু আনন্দ নিয়ে বাড়ি এসে দেখল, ঘর নিস্তব্ধ। ফাবিহা স্কুলে, কাজের বুয়া কাজ সামলাচ্ছে আর মায়ের রুমের দরজা বন্ধ। কী বিচ্ছিরি সব আওয়াজ আসছিল ওখান থেকে। ফারশাদ অবাক চোখে কাজের বুয়ার দিকে তাকালে, সে চুপ করে থাকে। ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে মায়ের রুমের দরজায় নক দেয়ার পরপরই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেন মুনমুন হক্ব। অসময়ে ছেলেকে বাসায় দেখে তিনি নিজেও কপাল চাপড়ে দাঁড়ালেন। রাগ, মেজাজ, ও চোখের দৃষ্টি কোনোকিছুকেই কন্ট্রোল করতে পারল না। লজ্জা ভুলে মাকে ধাক্কা দিয়ে রাশেদ সাহেবের কলার চেপে ধরে ইচ্ছামতো লাতি দিতে শুরু করল। শক্তপোক্ত হাতের এত মার, এত লাতি খেয়ে রাশেদ সাহেব গুঙিয়ে উঠছিলেন। মুনমুন হক্ব ফেরাতে গেলে তাকেও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল ফারশাদ। ভদ্রলোককে শাসিয়ে মায়ের বেশভূষার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

-‘ছিঃ…। তুমি এত নির্লজ্জ!’

মুনমুন হক্ব লজ্জা-সংকোচ সরিয়ে বলেছিলেন,
-‘কী করব বোলো? তোমার বাবা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। আমাকে সময় দেয়ার মতো সময় তার নেই।’

-‘তাইবলে এভাবে? তোমার তিনটে সন্তান আছে, মা। তুমি কী করে ভুলে গেলে? এসব কথা যদি মানুষজন জানে, মান-সম্মান থাকবে?’

-‘শোনো ছেলের কথা। শরীর যেমন আছে তার ক্ষিধেও আছে। একজন যদি পুষিয়ে দিতে না পারে, অন্যজন তো লাগবেই, তাই না?’

ফারশাদের ইচ্ছা করছিল তখন মায়ের গলাটা টিপে ধরুক সে। কিন্তু পারছিল না। মাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পর পরদিনই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় সে। যাওয়ার আগে বলে যায়,

-‘যতদিন না পাপের পথ থেকে তুমি ফিরছ, ততদিন আমি বাড়ির নামও মুখে নেব না।’

এরপর আর কারও সাথে যোগাযোগ করল না। ঢাকাতেই থাকতে শুরু করল। একদিন ফাবিহা জানাল, মুনমুন হক্ব ফারিশাকে ঘরে আটকে রেখেছেন। দিনরাত টর্চার করছেন। তার ভুল একটাই। সে সামান্য একটা স্কুল মাস্টারের ছেলেকে ভালোবেসেছিল। এরপর তাহমীদের সাথে যা হলো আর ফারিশা যেভাবে ঘর ছাড়ল, সেসব মনে হলেই ফারশাদের দমবন্ধ হয়ে আসে। ফারশাদ ভেবেছিল, মায়ের এসব কথা বাবাকে জানালে, তিনি হয়তো মাকে সামলাতে পারবেন। কিন্তু যখন দেখল, তার বাবাই মাকে পাপের পথে যেতে দেখেও চুপ থাকেন, তখন থেকে সম্পূর্ণরূপে বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আলাদা করে নিল।

এত চিৎকার-চেঁচামেচি শোনে ফয়জান মুনতাসীরও ড্রয়িংরুমে আসলেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘সকাল সকাল এত চেঁচামেচি করছ কেন তোমরা? মানুষের ঘুমের প্রয়োজন আছে, এটা বোঝো না?’

ফারশাদ শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘সন্তানদেরও যে পরিবারের সবার সাপোর্ট প্রয়োজন হয়, এটা বোঝো তো তোমরা?’

-‘কী বলতে চাও, তুমি?’

-‘বলতে চাই তো অনেক কথা, কিন্তু বলতে পারি না। আমি যতই শালীন শব্দ ব্যবহার করি না কেন, তোমরা তোমাদের জিহ্বাকে কন্ট্রোল করতে পারবে না। আমি যদি বলি, পাপের পথে পা বাড়িয়েছ কেন? তোমরা বোলো, শরীরে ক্ষিধে আছে তা-ই! এ জাতীয় উত্তর শোনার পর তোমাদের সাথে কথা বলার রুচি হয় না। একসাথে তো থাকো না, একই ছাদের নিচে আছো কেন? ডিভোর্স দিতে পারো না ওই মহিলাকে? লজ্জা হয় না তোমার যে, একটা চরিত্রহীন নারীকে নিয়ে এত বছর ধরে একসাথে থাকছ? ছিঃ। তোমাদের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়। কেমন স্বামী তুমি নিজের স্ত্রীকে আটতে রাখতে পারো না? কেমন বাবা তুমি, নিজের সন্তানদের ভালো-মন্দের খোঁজ নিতে পারো না? স্ট্যাটাস, ক্ষমতা, অর্থ এসব দিয়ে কী হবে, যদি মন-মানসিকতা নোংরা থেকে যায়?’

-‘মুখ সামলে কথা বোলো, শাদ।’

-‘মুখ তো সামলেই রেখেছি এতদিন। এরকম একটা জঘন্য মহিলাকে মা ডাকতে লজ্জা হয় আমাদের, তবুও ডাকতে বাধ্য হই, কারণ অস্বীকার করতে পারছি না। ওই মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছি, ওই মায়ের গর্ভে নিজেকে নিরাপদে রেখেছি। মায়ের ঋণ না-কি শোধ করা যায় না। যে মা পাপী, অপরাধী সে-ই মায়ের ঋণ শোধ করা যায় কি? যদি সেরকম কোনো উপায় থাকত, দুধের ঋণ শোধ করে সেদিনই মুনমুন হক্বকে আমি ত্যাজ্য করতাম, যেদিন তার পাপ প্রথম আমার সামনে এসেছিল।’

ফয়জান মুনতাসীর চুপ করে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার একটা ভুল যে, তাকে সন্তানদের সামনে এত অপদস্ত করবে, এত লজ্জার মুখোমুখি ফেলবে, সেটা যদি তিনি বুঝতেন, ভুল করেও ওই ভুলটা তিনি করতেন না। যতই তিনি ভুল বলে চালিয়ে দিতে চান, আসলে ওটা তো ভুল না, পাপ। নিজেও পাপ করলেন, স্ত্রীকেও সেদিকে ঠেলে দিলেন। এখন এত কথা মনে করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তা-ই ছেলের কথাকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন,

-‘ডিভোর্স দিলে তো তোমাদের নামের সাথে ব্রোকেন ফ্যামিলি শব্দটা জড়িয়ে যেত। এতে সমাজের লোকের কাছে তোমরা তিন ভাই-বোনেরা হাসির পাত্র সাজতে।’

-‘হাসলে হাসলো। খুব তো ক্ষতি ছিল না। হতাম ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। এতে এত পাপকে মুখবুঁজে সহ্য করতে হতো না। উনি মা বলেই, ওনাকে দশজনের সামনে হাসির পাত্রী সাজাতে পারি না। ওনাকে সম্মান দেই, মাথায় তুলে রাখতে চাই। কেউ ওনাকে দুঃশ্চরিত্রা বলবে, থুতু ছুঁড়ে মারবে, এটা আমরা সন্তানেরা দেখব কী করে? চক্ষুলজ্জা বলে তো কিছু আছে। কতবার বলেছি, এই পথ থেকে ফিরে এসো। কাকুতিমিনতি করেছি, কিন্তু উনি ফিরবেন না। তুমি ওনাকে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিও যে, উপযুক্ত সন্তানদের জীবন নিয়ে উনি যেন খুব বেশি বাড়াবাড়ি না করেন। সেই অধিকার ওনাকে আমরা দিইনি। যখন ছোটো ছিলাম, কিছু বুঝিনি। কিন্তু এখন, সময় পালটেছে। আমরাও বড়ো হয়েছি, বুঝতে শিখেছি। ভালো-মন্দের পার্থক্য জেনেছি। ঠিক-ভুল বাছাই করতে শিখেছি। আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে দাও। ভুল করেও গার্ডিয়ানগিরি ফলাতে আসবে না। যদি আর কোনোদিন এরকম কিছু করতে দেখেছি তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমাদের জীবন, আমাদের সিদ্ধান্ত। কারও কথায় লাফ দিয়ে নিজেদের জীবন আমরা নষ্ট করব না। আর ওই মহিলা যদি তবুও নিজেকে দাবিয়ে রাখতে না পারে, তাহলে আমি নিজেই সারা দেশের মানুষের সামনে সব সত্য প্রকাশ করব। এতে আমার ক্যারিয়ার যায়, যাক। আফসোস নেই। তবুও এমন জঘন্য মহিলার নোংরামির ফাঁদে কখনওই নিজের জীবনটাকে ধ্বংস হতে দেব না।’

কথা শেষ করে বোনের হাত ধরে বাড়ি ছাড়তে গেলে সোহানা আবারও তাকে আটকাতে চাইল। ফারশাদ শক্ত গলায় বলল,
-‘আজই লাইভে এসে বলবি, আমার সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই, কোনোকালে ছিলও না। যদি না বলিস, আগামীকাল সকালের সূর্য তুই দেখবি না। তার আগেই তোকে আমি হাজতে ঢুকিয়ে ছাড়ব। রিমেম্বার ইট…।’

***

চলবে…