মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-১৯+২০

0
67

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – উনিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

সকালের সোনালী রোদ্দুর গায়ে মাখতে বাড়ির পথ ধরে একাকী হাঁটছে উজমা। ঘুম ভেঙেছে বেশ ভোরে। এরপর হাতমুখ ধুয়ে, অযু করে ফজরের নামাজ শেষ করে, শীতের সকালটাকে উপভোগ করতে বেরিয়েছে। আকাশের বুক ছিঁড়ে উঁকি দেয়া লাল টুকটুকে সূর্যের দিকে চোখ রেখে গভীর করে শ্বাস নিচ্ছে আবার ফেলছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় বসে থেকে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলে কিছুদূর এগোতেই গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মহিলার সামনে পড়ল সে। প্রতিদিন সকালেই দলবেঁধে হাঁটতে আসেন সবাই। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। উজমাকে একাকী দেখে একজন মহিলা বললেন,

-‘ওমা, উজমা! সাতসকালে একা একা বাড়ির বাইরে কেন? দিনকাল ভালো না। কত খারাপ মানুষের নজর পড়তে পারে। যদিও তোর ওপর নজর পড়ার মতো কী-ইবা আছে? রূপ দিয়ে কি আর পুরুষ মানুষ ঘাস খাবে? তাদের তো দরকার অন্যকিছু। গ্রামের মানুষজন কত কথা বলে বেড়াচ্ছে। দামড়া মেয়ের বিয়ে ভেঙেছে, এদিকে মেয়েটা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল-লজ্জার মাথা খেয়েছিস না-কি?’

এই ত্যাড়াব্যাকা কথার জবাব উজমা হাসিমুখেই দিল,
-‘আমার তো লজ্জা-শরম একেবারেই নেই, চাচী। এজন্যই গায়ে হাওয়া লাগাতে এখানে এসেছি। যদি লজ্জাবতী হতাম, তিনবার বিয়ে ভাঙার পর তোমাদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেতাম না। অনেক আগেই গলায় দঁড়ি দিতাম। লজ্জা-শরম কম বলেই, মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারছি।’

-‘তুই যা-ই বলিস। গ্রামের লোক তো মিথ্যে বলে না। দোষ আসলে মানুষের না, তোরই। মান-ইজ্জত ডুবিয়ে ঘরের বাইরে কী করে বের হোস, বুঝি না। দেখি, সর। কলঙ্কিনী।’

-‘আমি যে কলঙ্কিনী, সেটা কি তুমি দেখেছ, চাচী? তোমার কাছে প্রমাণ আছে?’

-‘ওমা, প্রমাণ লাগে না-কি! গ্রামের বুড়ো থেকে বাচ্চা সবাই জানে, সারাদিন জোয়ান জোয়ান ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি করিস। আমরা কি চোখে পট্টি বেঁধে ঘুরি? কিছু দেখি না মনে করিস?’

-‘তো? এতে কি আমার জাত গেল? বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘোরাঘুরি করলেই কি মান-ইজ্জত ডুবে যায়? তাদের সাথে চলাফেরা করা মানে কি এই যে, ওই মেয়েটা কলঙ্কিনী?’

মহিলাটি ঘাড়ত্যাড়া মেজাজেই বলল,
-‘তোর ভাই-ই তো এইসব বলে বেড়ায়। তাছাড়া আমরা কি বুঝি না? বয়স কি এমনি-এমনি হয়েছে? চুল কি বাতাসে পেকেছে? তোর মতো দিন কি আমাদের ছিল না? তাই বলে কী আমরা এত নির্লজ্জ হয়ে জোয়ান জোয়ান ছেলেদের সাথে বেহায়াপনা করে বেরিয়েছি? শোন, মেয়ে মানুষের যৌবন হচ্ছে, সমুদ্রের জোয়ারের মতো। আজ আছে, কাল নেই। এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা ঠিক হচ্ছে না তোর।’

-‘না, চাচী। তোমার বয়স এমনি-এমনি বাড়েনি। কোটনামি করতে করতেই বেড়েছে। এখন যে বয়সে আমি আছি, সেটা তুমিও একদিন পার করে এসেছ। আমার চেয়ে তোমার অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। কিন্তু তুমি এটা বুঝো না যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুমি যৌবন হারিয়েছ আর বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। একটা কথা কী জানো, মানুষ হয়ে জন্মালেই কিন্তু মানুষ হওয়া যায় না। প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে গেলে পর্যাপ্ত মনুষ্যত্বের প্রয়োজন পড়ে। তুমি শুধু বয়সেই বড়ো হয়েছ, চুল পাকিয়েছ, মনে ও মস্তিষ্কে তুমি এখনও পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারোনি। যদি পারতে, লোকের কথা শোনে একটা মানুষকে বিচার করতে না। তোমার বিবেকবুদ্ধি ও পর্যাপ্ত মনুষ্যত্ববোধই তোমাকে বুঝিয়ে দিত, কখন, কোথায়, কাকে, কী বলতে হয়। বয়সে আমি তোমার মেয়ের মতো। একটু কল্পনা কোরো, আমার মতো একটা সিচুয়েশনে তোমার মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে তুমি তখন? তাকে কলঙ্কিনী বলে গালিগালাজ করবে না-কি সান্ত্বনা দিয়ে বলবে যে, মন খারাপ করিস না মা, ভাগ্যের লিখন তো আর খণ্ডানো যায় না?’

উজমার এত কথা শোনে মহিলাটি মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
-‘মান-সম্মান চলে যাচ্ছে তা-ও মেয়ের তেজ যায় না। কী দিনকাল এলো বাপু। আমরা তো জীবনে এসব করিনি। আমাদের কি বিয়ে হয়নি, সংসার হয়নি, বাচ্চাকাচ্চা হয়নি? সবই তো হয়েছে।’

-‘শোনো, চাচী। কাউকে যদি সহানুভূতি দেখাতে না পারো, ভুল করেও খোঁচা দিয়ে কথা বোলো না। এসব করে তুমি কিন্তু নিজেকেই ছোটো করছ। বিয়ে যদি আমার ভাগ্যে থাকে, কোনো না কোনোদিন ঠিকই হবে। তারজন্য আমি তোমার দরজায় হাত-পা ছুঁড়ে বলব না যে, আমার কেন বিয়ে হলো না চাচী, তুমি আমাকে বিয়ে দাও, বিয়ে দাও। বিয়ে না হলে আমার যৌবন খসে পড়বে গো।’

দাঁত কিড়মিড় করে এইটুকু বলে, আবারও বলল,
-‘আমি আমার রবের ওপর বিশ্বাস রাখি। যদি কোনোদিন বিয়ে না-ও হয়, তবুও আমি নিশ্চিত যে, আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট।’

কথাবার্তার ইতি টেনে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো উজমা। কিছুদূর এগোতেই দৌড়াতে দৌড়াতে তার দিকে এগিয়ে এলো অন্নপূর্ণা। হাতে তার পুজোর থালা। মাত্রই পুজো সেরেছে সে। বৌদির জন্য প্রার্থনা করেছে। বাড়ি ফেরার পথে উজমাকে দেখেই ছুটে এসে একসাথে হাঁটতে শুরু করল। বলল,

-‘ওরা কিছু বলছিল, তোমাকে?’

-‘কতকিছুই তো বলে, আমি ওসব কানে নিই না।’

-‘আমার কি ইচ্ছে করে জানো? এইসব কোটনী বুড়িদের ইচ্ছামতো দিই। কিন্তু আমি ছোটো বলে পারি না। পরে এসে বলবে, এই মেয়ে বেয়াদব, বড়োদের সাথে বেয়াদবি করে।’

-‘উচিত কথা বললে সবাই বেয়াদবই বলে। আমায়ই তো কতজন কত কথা বলে।’

হেসে বলল উজমা। অন্নপূর্ণা বলল,
-‘দাদা তোমাকে একটা থ্যাংকস পাঠিয়েছে আর বলেছে যে, যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাকে জানাতে। সে তোমাকে সাধ্যমতো চেষ্টা করবে সাহায্য করার।’

উজমা সেসব শোনে বলল,
-‘তা-ই? দাদা এই কথা বলেছে?’

-‘হুম…।’

-‘তুই তোর দাদাকে বলিস, আমার কোনো সাহায্য লাগবে না। সে যেন আমার জন্য একটু প্রার্থনা করে।’

-‘তোমার বিয়ে ভাঙার কথা দাদাকে বলেছিলাম, দাদা ভীষণ আফসোস করেছে, জানো। এতবার যে বিয়ে ভাঙল, এতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না, দিদি?’

-‘নারে পূর্ণা। আমার কষ্ট হয় না। আমি জানি, সবটাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে। এ-ও বিশ্বাস করি, একদিন সব অন্ধকার সরে আমার ভুবনও আলোকিত হবে, ঠিক যেভাবে রাতের পর সকাল আসে, তেমনিভাবে।’

-‘বৌদি তো সবসময়ই বলে, তুমি একটা সাহসী মেয়ে। আমিও বড়ো হলে তোমার মতো হব, সাহসী আর প্রতিবাদী। তুমি দেখে নিও, একদিন আমি অনেক সাহসী হব।’

-‘ভেরি গুড। বৌদির শরীর এখন কেমন আছে?’

-‘খুব ভালো।’

-‘আচ্ছা, বৌদিকে বলিস, সাবধানে চলাফেরা করতে।’

-‘বলব। মা বলছিল, যদি সময় পাও, একবার এসে ঘুরে যেতে।’

-‘দেখি, আমি তো খুব ব্যস্ত। এজন্য যেতে পারছি না। ফ্রি হলে যাব একদিন।’

-‘ঠিক আছে। আসি এখন। পরে দেখা হবে।’

বাড়ির পথ আসাতে অন্নপূর্ণা চলে গেল। কিছু মানুষের এই উদারতা, মানসিকতা এত সুন্দর যে, কখনও কখনও মনে হয়, পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য এমন সুন্দর মনের মানুষের বড্ড প্রয়োজন। ইশ, যদি সবার মানসিকতা এমন সুন্দর হতো? যদি কোনো শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, অযথা উঁচুনিচু ভেদাভেদ ও ধর্মীয় কোন্দল কোথাও না থাকত, সবাই যদি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতো, কেমন হতো তবে? নিশ্চয়ই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতো।

***

দুটোদিন ধরে টানা কয়েকঘণ্টার ক্লান্তিতে ফারশাদের চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। ঠিকমতো ঘুমও হয়নি এই ক’দিন, আবার মনের ওপর দিয়েও অদৃশ্য এক তুফান বয়ে যায় প্রতিনিয়ত। রুমে প্রবেশ করে ধপাস করে বিছানায় পড়ল সে। ক্লান্ত চোখজোড়া বন্ধ করতেই, চোখের পাতায় মায়াবী কন্যার মুক্তোঝরা হাসি নেমে এলো। ঠোঁটের কোণ ভরে উঠল হাসিতে। ফোন বের করে গ্যালারি ওপেন করা মাত্রই ক্যামেরা ফোল্ডারে দেখা মিলল, সদ্যজাত শিশুকে কোলে নিয়ে ও.টি থেকে বেরিয়ে আসা এক শান্ত, শীতল, মুখ। কী সুন্দর লাগছে দেখছে। ছবিটি তুলেছিল ফারিণ, এরপর তার কাছ থেকেই ছবিটা নিজের ফোনে আনিয়েছে সে। দু’জনকেই একমনে অনেকক্ষণ দেখে চোখের ও মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে রইল। মনে পড়ল, ঊষার ডায়েরিতে কত কথা লিখে এসেছিল সে। পাথর মানবী কি সেই কথাগুলো পড়বে, জানবে, কিংবা বুঝবে? মনের কথাগুলো তুলে ধরতে গিয়ে কারও চোখের কোণে ভর করেছিল, ভারী ভারী সব মেঘের দলা। একটা সময় সেই ভারী ভারী মেঘ বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ছিল চোখের সীমানা থেকে। ভিজিয়ে দিয়েছিল ডায়েরির একেকটা পৃষ্ঠা! ভাবতে গিয়ে নিজের উপরেই রাগ হলো ফারশাদের। কত বোকা সে। একটা মেয়েকে ভালোবেসে তাকে না পাওয়ার দুঃখে চোখের পানি ফেলল! মেয়েটা কি কোনোদিন বুঝবে না, এই ভালোবাসার মূল্য? খুঁজবে না সীমানা? জানবে না, মনের কত গভীরে লুকিয়ে আছে কারও নাম? অন্তহীন ভাবনায় ডুবে গিয়ে ফারশাদ ভুলে গিয়েছিল, খাবার-দাবারের কথা। সে ঝটপট উঠে ফ্রেশ হলো। মুহূর্তের মধ্যেই নিচের রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে দিল। রান্নাঘরে এসে দেখল ফাবিহা আনাড়ি হাতে কিছু রাঁধার চেষ্টা করছে। বোনকে কাজ করতে দেখে বলল,

-‘এখন কিছু করতে হবে না। আমি খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। সকালে খালা আসবে, রান্নাবান্না করবে। তুই খামোখা এসব করিস না। কিছু করতে পারবি না, উলটে হাত-পা পুড়িয়ে ফেলবি।’

ফাবিহা বলল,
-‘আমি তো চা বসাতে চাইছিলাম।’

ফারশাদ ঝটপট ইলেকট্রনিক কেটলি ধরিয়ে দিল বোনের হাতে। বলল,
-‘এটাতে কর। গ্যাস জ্বালানোর দরকার নেই।’

ফাবিহা তা-ই করল। কেটলিতে প্রয়োজনমতো পানি নিয়ে সুইচ টিপে দিল। ফারশাদ ঘরে থাকা কিছু বিস্কুট বের করে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখল। ফাবিহা চারপাশে ভালোমতো তাকিয়ে বলল,

-‘একটা ভাবী হলে কত ভালো হতো, তাই না?’

কাঁধ নাচালেও মুখে কোনো উত্তর দিল না ফারশাদ। ফাবিহা চা তৈরী করল। দুই ভাইবোন একসাথে চা পান করতে করতে বকবক শুরু করল। ফাবিহাই আগ্রহ নিয়ে বলল,

-‘তুমি বিয়ে করতে চাইছ না কেন?’

-‘চাইছি না, সেটা নয়। মনের মতো মেয়ে খুঁজে পাচ্ছি না।’

-‘কী যে বোলো না। মেয়ে না-কি পাওয়া যায় না।’

ফাবিহা বিশ্বাস করল না। খিলখিলিয়ে হেসে চা পানে মনোযোগ দিল। ফারশাদ নিজের মোবাইল বের করে বোনের সামনে রেখে গ্যালারির ছবিটা বের করে বলল,

-‘এই ছবিটা দেখ।’

ফোন হাতে এনে খুব মনোযোগ দিয়ে উজমা ও বাচ্চার ছবি দেখল ফাবিহা। বিড়বিড় করল, ‘খুব সুন্দর।’ এরপর জানতে চাইল,
-‘ইনি কে?’

-‘উসাইদের বোন। উজমা…। উসমান আংকেলের মেয়ে। মৌলভীবাজারে আমরা একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম।’

-‘ওহ, আমার তো কিছুই মনে নেই।’

কিছুক্ষণের নীরবতায় সম্পূর্ণ ঘর নীরব হয়ে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি আরও অনেকক্ষণ ধরেই দেখল ফাবিহা। বলল,
-‘ছবিটা দেখালে কেন?’

-‘ওই একজনকেই পেয়েছিলাম, যে আমার মনের মতো। যার সাথে আমার বোঝাপড়াটা চমৎকার হতো বলে ধারণা করেছিলাম। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, তা-ও মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে।’

আশ্চর্যান্বিত মনোভাব নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল ফাবিহা। পরপরই চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল,
-‘সত্যিই?’

-‘হুম…।’

-‘বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছ?’

-‘ভালোবাসার প্রস্তাবে যে সাড়া দেয়নি, সে বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দিবে? আমি বোধহয় সারাজীবন সিঙ্গেলই থেকে যাব।’

-‘আশ্চর্য! তোমার মতো ছেলের প্রস্তাব কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারে? যেখানে সোহানা আপু তোমাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া সেখানে ইনি…।’

-‘সোহানার ব্যাপারটা আলাদা। ও আসলে সুযোগ নিতে এসেছে। মায়ের ডুপ্লিকেট না? মায়ের মতোই তো হবে। তবে এই রমণী প্রত্যাখ্যান করার মতোই কঠিন মনের মানুষ। রেগে গেলে তাকে যেমন জ্বলন্ত আগুন মনে হয়, শান্ত চেহারায় তাকে তেমনই নিষ্পাপ লাগে। তার রাগ, মেজাজ, কথাবার্তা, সবকিছুই এত চমৎকার যে, এক নিমিষেই মনে হবে, সৃষ্টিকর্তা তাকে সব গুণাবলী দিয়েই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এত নিখুঁত ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।’

অল্প পরিসরে কয়েক দিনের স্মৃতিমাখা দৃশ্য মনে করে তাদের পারিবারিক গল্প ও উজমার বিয়ে ভাঙার কথা জানাল ফারশাদ। এটা বলল না, মুনমুন হক্বের মাধ্যমে মেয়েটা অতীতে ভয়ানকভাবে নির্যাতিত হয়েছে। লুকিয়েই গেল। যতটা বলেছে, যথেষ্ট। সব শোনে ফাবিহা বলল,

-‘আমি দোয়া করি, শীঘ্রই সে যেন এই বাড়ির একজন হয়ে আসে। আমার একটা বিশ্বস্ত বন্ধুর খুব দরকার। যার সাথে আমি হাসব, খেলব, সারাদিন ছোটাছুটি করব, রাগারাগি করব আবার মান-অভিমানও দেখাব, যেমনটা বুবুর সাথে করতাম।’

-‘কে জানে, আদৌ তোর এই দোয়া কোনোদিন কবুল হবে কি-না।’

কথার মাঝখানেই কলিংবেল বাজল। ফারশাদ উঠে গিয়ে ডোর খুলে পার্সেল নিয়ে ডাইনিংয়ে ফিরে এলো। ফাবিহা ফেসবুক স্ক্রল করছিল। আচমকাই বলল,

-‘ভাইয়া দেখো, সোহানা আপু লাইভে এসেছে।’

***

আজ রাতে হসপিটালে উজমাই থাকবে। ঊষা থাকবে বাড়িতে মামীমা ও উসমান ওয়াজেদকে নিয়ে। তা-ই সন্ধ্যের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। রাতের খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ঢুকিয়ে রাখায় ব্যস্ত ছিল, এরমধ্যে ফোন হাতে নিয়ে ছুটে এলো ঊষা। ফেসবুকের লাইভ দেখিয়ে বলল,

-‘এই দেখো, সোহানা মেয়েটা। ফারশাদ ভাইয়ার সাথে যার অ্যানগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল।’

বোনের কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল উজমা। বুঝে উঠতে না পেরে বলল,
-‘আমি কী করব?’

ঊষা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। যতখানি উৎফুল্ল ও ফুরফুরে মেজাজে সে ছিল, সেটা আর রইল না। গাল ফুলিয়ে বলল,
-‘কিছু তো করতে বলিনি, রেগে যাচ্ছ কেন?’

হুঁশে ফিরে চোখ বন্ধ করে রিল্যাক্স হলো উজমা। ডায়েরি পড়ে মন-মেজাজের ওঠানামা হচ্ছে যখন-তখন। বোনের ওপর চোটপাট করে ফেলছে। সারাদিন ধরে যতবার এটা-সেটার জন্য ডেকেছে, হুট করে রেগে গিয়ে আবারও নিজের মেজাজকে সামলাচ্ছে। এখনও ঠিক একইরকম পরিস্থিতি হলে, বোনের অভিমানী মুখ দেখে বলল,

-‘রাগ করিস না। কী জানি কী হলো, হুটহাট মেজাজ হারিয়ে ফেলছি!’

-‘তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত?’

উজমা দু’দিকে মাথা নাড়লে ঊষা বলল,
-‘ক’দিন ধরে ফারশাদ ভাইয়াকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন ভিডিও ও পোস্টে তাকে নিয়ে মানুষজন যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে।’

প্রতুত্তরে উজমা কিছুই বলল না দেখে ভিডিওর সাউন্ড বাড়িয়ে দিল ঊষা। শোনা গেল একজন যুবতীর গলা। তার কণ্ঠস্বর যতখানি সুন্দর, চেহারাটাও ততটাই মায়াবী। না চাইতেও চোখ পড়ল বার বার। ফারশাদ কেন এই মেয়েটাকে গ্রহণ করল না, সেটা ভাবতে গিয়েই নিজেকে তার খুব ছোটো ও তুচ্ছ মনে হলো। কী দেখে তাকে ছেলেটা এত ভালোবাসলো? সে কাজ সামলানোর ব্যস্ততা দেখালেও কান পেতে রাখল লাইভে। মিষ্টিমিষ্টি আওয়াজে ভেসে এলো,

-‘হাই, আমি সোহানা চৌধুরী। হুট করেই লাইভে এসেছি, আপনাদেরকে কিছু কথা ক্লিয়ার করতে। অ্যাকচুয়ালি, ওইদিন মুনমুন হক্ব যে পার্টির অ্যারেঞ্জ করেছিলেন, সেটাতে আমার ও আপনাদের প্রিয় খেলোয়াড় সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের অ্যানগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এখানে কিঞ্চিৎ ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মুনমুন আন্টি, আই মিন আমার খালামণি আমাকে অনেক স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। সেই হিসাবে আমারও ওনার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। ফারশাদ মুনতাসীর ও আমি ছোটোবেলা থেকে একসাথে খেলাধুলা করেছি, একসাথে বড়ো হয়েছি। ওর প্রতি আমি একটু উইক ছিলাম আরকি। তো, খালামণি বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর আমি আর না বলিনি। যেহেতু ওকে ভালোবাসি আর জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই, সেহেতু বিয়েতে না বলার কোনো কারণই ছিল না। সেই কারণেই দেশে ফিরে এসেছিলাম আসলে। আমি ভেবেছিলাম ও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু এই ঘটনার পর বুঝতে পারলাম, আসলে ও কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি। সবকিছুই আমার একপাক্ষিক ছিল। যাই হোক, মুনমুন আন্টি যা বলেছেন, সেটা আসলে তিনি না বুঝেই বলেছেন। ছেলের প্রতি মায়ের ভালোবাসা ও দায়িত্ব থেকেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ফারশাদ সেটা চাইছে না। আমি তার মনে জায়গা করতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। আপনারা তাকে প্লিজ, ভুল বুঝবেন না। সবটাই একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে।’

এরপর আরও কিছু কথা বলে পুরো লাইভেই এটা বুঝানোর চেষ্টা করল যে, ফারশাদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এখনও নেই। যা আছে, সেটা একতরফা ভালোবাসা। এমন কথা শোনে কেউ কেউ হা হা রি’অ্যাক্ট, কেউ কেউ গালিগালাজ করল, কেউ কেউ ইচ্ছামতো শেয়ার দিয়ে লাইভটা আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দেয়া শুরু করল। লাইভ শেষ হলে ঊষা বলল,

-‘কিছু বুঝলে?’

উজমা ঘাড়ত্যাড়া মেজাজে বলল,
-‘এখানে বোঝার মতো কিছু নেই। সে তার যা ইচ্ছে করুক, আমার কী?’

-‘এই মেয়েটা আসলে খুব বোকা। এখন ফ্রিতে পাবলিকের গালিবকা খাবে। কী দরকার ছিল নিজেকে এত নিচে নামানোর? সাদা চামড়ার মানুষেরা অনেক বোকা হয়, এই মেয়েটা তারই একটা ছোট্ট উদাহরণ। সবেমাত্র ফেমাস হওয়া শুরু করেছিল, এরমধ্যেই সমালোচনার শিকার হয়ে গেল।’

উজমা রীতিমতো বিরক্ত হলো এখন। বলল,
-‘তুই এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছিস কেন? যা এখান থেকে।’

ফারশাদের সাথে যা কিছু জড়িয়ে আছে, সবকিছুকেই দূরে সরিয়ে দিতে চায় উজমা। না কোনো স্মৃতি রাখতে চায়, না কোনো কথা শুনতে চায়। তার জীবন নামক ডায়েরির পাতায় ফারশাদ মুনতাসীর নামের কোনো অধ্যায় নেই। যদিও জোরপূর্বক আসে, ইরেজার দিয়ে ঘষেমেজে ফাঁকা করে দিবে তবু স্থায়ী হতে দিবে না। ওই চিঠির পাতাও পুড়িয়ে ফেলবে। এক পাতাও আস্তো রাখবে না। জ্যাকেটটাও পুড়াতে হবে। আংটিটাও ছুঁড়ে ফেলতে হবে দূরে, একেবারে দৃষ্টিসীমার বাইরে। যে মনে নেই, সে কোত্থাও থাকবে না। একেবারে বিলীন করে দিবে ফারশাদ মুনতাসীরের নাম ও নিশানাকে।

বোনের মেজাজ আঁচ করতে না পারলেও ঊষা একটু শান্ত গলায় অনুরোধের সুরে বলল,
-‘একটা কথা বলি?’

-‘এসব ছাড়া অন্যকিছু…।’

-‘ফারশাদ ভাইয়া বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলছিল, তোমাকে আগে মনের কথা জানাবে এরপর আংকেল-আন্টিকে ম্যানেজ করে পরিস্থিতি বুঝে বিয়ের জন্য এগোবে।’

হাত থেকে কাজ পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো উজমার। কী শুনলো এটা? এতটাই এগিয়েছিল কেউ? কেন? সবকিছু জেনে-বুঝে কেন এই ছেলেটা পাগলামি করছে তাকে নিয়ে? মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। ঝড়ের মতো একটা নাম, একটা অবয়ব বার বার তার চোখের সামনে ঘোরাঘুরি শুরু করলে প্রচন্ড শক্তিতে মনের জোর নিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার ও ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে তুফানের মতো বেরিয়ে গেল উজমা। ওইটুকু রাস্তা একা হাঁটতে গিয়ে মনে হলো, একা হাঁটার জোর আর নেই। পায়ে তো ব্যথা আছেই, সেই ব্যথা পা ছাড়িয়ে এখন মনেও ভর করেছে। কুয়াশার কারণে রাস্তাটা আবছা হলেও আকাশের কোণে জেগে ওঠা চাঁদের ঝলমল আলোয় পথ চলতে গিয়ে ভয় ও শূণ্যতা সবকিছুই তাকে আরও বিষণ্ণ করে দিল। সমস্ত অস্তিত্বে কাঁপন ধরলো। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাঁটা শুরু করে মনে সাহস ও জোর আনলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বিড়বিড় করল,

-‘আমি একা পথ চলতে জানি। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। পাশাপাশিও না, কাছাকাছিও না। কেউ না আসুক জীবনে। কোনোকিছুরই প্রয়োজন নেই আমার।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – বিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

ভোরের স্নিগ্ধ আলো ও সোনাঝরা রোদ্দুরকে গায়ে মেখে একটি সুন্দর সকালের সূচনা হলো আজ। ঘুমঘুম চোখ খুলে মিশকাত দেখল, তার বুকের মধ্যে উষ্ণতা নিচ্ছে আদরের বাচ্চাটা। ফজরের সময় খুব কাঁদছিল সে। ঠাণ্ডা ও ক্ষিধে দুটোই পেয়ে বসেছিল তাকে। উজমা যখন তাকে মায়ের বুকের মধ্যে রেখে বড়ো সাইজের লেপ দিয়ে মুড়ে দিল, তখনই একটু একটু করে তার কান্না থেমে এলো। আদুরে হাতে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দেখে পুরো কেবিনে চোখ বুলালো। উজমা সবকিছু গোছাচ্ছে। আজ রিলিজের দিন। তিনদিন পর বাড়ি যাবে। কিছু সুখ, কিছু আনন্দে খানিকক্ষণ নিজেকে ডুবিয়ে রেখে ননদিনীকে বলল,

-‘তোর ভাই এসেছে?’

-‘হ্যাঁ, ভাইয়া উবার ডাকতে নিচে গেছে।’

-‘আমি একটু ওয়াশরুমে যেতাম। তুই যদি ওকে একটু সামলাতি।’

হাতের কাজ রেখে বাচ্চাটাকে আগে নিজের কোলে তুলে নিল উজমা। এরপর একহাতে মিশকাতকেও বেড থেকে নামতে সাহায্য করল। তাকে ওয়াশরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিল। উবার নিচে রেখে উসাইদ এলো কেবিনে। বোনকে বলল,

-‘সব গোছানো শেষ?’

-‘হ্যাঁ, হয়ে এসেছে। বিল পেমেন্ট করেছ? আমি কি আসব?’

-‘আর বলিস না। শাদ যে কেন এত পাগলামি করল!’

উজমা পুরো কথা বুঝলো না। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘কীসের পাগলামি?’

-‘ও না-কি ফারিণকে বলে গেছে, ডিসচার্জের সময় ওকে যেন ফোন দেয়। ফারিণও এই কাজ করল। ওখান থেকে এক ফোনে সব বিল পেমেন্ট করে দিল। আমি কত করে মানা করলাম, কথা কানেই নিল না।’

যারপরনাই হতবাক উজমার সব রাগ গিয়ে পড়ল ফারিণের ওপর। যখনই ফারশাদকে ভুলতে চায় বা মন থেকে দূরে ঠেলে সরাতে চায়, তখনই কোনো না কোনোভাবে এই ব্যাটা চোখের সামনে তো নাচানাচি করেই মনের ভেতরও তার তাণ্ডব চালিয়ে যায়। আশ্চর্য! নিজের ওপর চরম বিরক্ত উজমা ভাইকে বলল,

-‘উনি কেন দিবেন?’

-‘ও না-কি বন্ধুর পাশে থাকতে চায়, সবসময়।’

-‘এত বছর খেয়াল ছিল না। এখন হুট করে এসে বন্ধুত্বের বহর দেখাচ্ছে।’

-‘ছাড় ওর কথা। গাড়ি নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মালপত্র নিয়ে যাচ্ছি, তোরা আস্তেধীরে এগো।’

কেবিনে নিজেদের আনা ব্যবহৃত যা কিছু ছিল, সবটাই একটা দুটো করে গাড়িতে তুলে রাখল উসাইদ। ফিরে এসে খুব সাবধানে মিশকাতকে পাঁজাকোলে তুলে নিল। যেহেতু অসুস্থ রোগী, এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা তারজন্য কষ্ট ও ঝাঁকুনির তা-ই কোনোপ্রকার রিস্কের দিকে না গিয়েই উসাইদের এই ব্যবস্থা। ভাই-ভাবী এগোনোর পর উজমাও বাচ্চাটাকে নিয়ে এগোলো। তাকে বিদায় দিতে ফারিণ এসেছিল। ফারিণকে দেখে অদৃশ্য আক্রোশে ফুঁসে উঠল উজমা। বলল,

-‘এ্যাই গাধী, বিল পেমেন্টের সময় তুই আমাকে জানাবি না একবার?’

-‘আমি আবার কী করলাম? আমি তো তোকে ডাকতেই এলাম। এসে দেখি তুই ঘুমোচ্ছিস। তা-ই ভাবলাম বিরক্ত না করি। এজন্য ভাইয়াকে ডেকে নিলাম। কেন, এখন আবার বিল নিয়ে কী সমস্যা হলো?’

-‘সমস্যা কিছু না। কিন্তু ব্যাপারটা ভালো দেখাচ্ছে না।’

-‘বাদ দে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় পাশে এসে দাঁড়াতে চায়, তাকে জোরপূর্বক দূরে ঠেলে দেয়াটা অনুচিত। তাছাড়া, উনি তো ভাইয়ার বন্ধু আর ভীষণ পরোপকারী মনোভাবাপন্ন। এমন মানুষকে উপকার করতে দেখলেও শান্তি লাগে।’

-‘হ্যাঁ, ভীষণ শান্তি লাগে।’

দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিয়ে নিচে নেমে এলো দু’জনে। উজমা এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। দু’জন অসুস্থ মানুষের খেয়াল রাখা, বাচ্চা সামলানো, ঘর সামলানো, এগুলো দৌড়ের ওপর থাকলে হবে না, এজন্যই। এই ক’টাদিন বাড়িতে থেকে পরিবারের সবাইকে সময় দিবে। কাজে ডুবে থাকলে মন খারাপও হবে না আর বিষণ্ণতাও ভর করবে না মনে।

***

বাড়ি ফিরে বাচ্চা ও বাচ্চার মাকে বিশ্রামে রেখে উসাইদ তার মামীমাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলো। সে এখন যথেষ্ট সুস্থ। হাতে ও মাথায় সামান্য ব্যথা ছাড়া আর কোনো শারিরীক দুর্বলতা নেই। কিছুদিন পর বাচ্চার নামকরণ করবে আর আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিবে। সে কাছেপিঠে যারা আছেন, তাদের নিয়ে ছোট্ট একটা লিস্ট তৈরী করল। চাচা, মামা, খালা-খালু ও প্রতিবেশী যারা সবারও নাম টুকে নিয়ে একজন একজন করে সবাইকে দাওয়াত দিল। বাদ গেল না শামীম, শাম্মাও। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোকে চাইলেও অবহেলা করা যায় না। মানবিকতা, বিবেক, এসবের কারণে কিছু সম্পর্ক ত্যাগ করা যায় না সহজেই। বড়ো মামাকে ফোনে দাওয়াত দিতে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের ফোনালাপ হয়ে গেল। সেই ফাঁকে তিনি জানালেন, সেদিন সাজ্জাদ ওয়াজেদ কেন তাকে ডেকেছিলেন। ফোন রেখে সে বোনকে ডাক দিলে তড়িঘড়ি ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিল উজমা। পাশে এসে দাঁড়াতেই হাতের ইশারায় সোফা দেখিয়ে বলল,

-‘বোস, দরকারী কথা আছে।’

উসাইদের কণ্ঠস্বরই বলে দিল, কিছু একটা গণ্ডগোল। মামীমাকে ইশারা করলে তিনি ঠোঁটে উল্টালেন। উসাইদ একটু স্থির হয়ে বলল,

-‘শামীম যেকোনো সময় ঝামেলা করবে এটা নিশ্চিত। ও এত সহজে তোর পিছু ছাড়বে না।’

-‘কেন? কী হয়েছে?’

মোরশেদ জামান ওখানে যাওয়ার পর সাজ্জাদ ওয়াজেদ ঠাণ্ডা মাথায় আবারও বিয়ের প্রস্তাব দিলে এক কথাতেই অসম্মতি প্রকাশ করে উঠে আসার প্রস্তুতি নেন তিনি। শামীম নির্লজ্জের মতো তাঁর পা ধরে লটকে থেকে অনেক কাকুতিমিনতি করতে শুরু করে। এরপর তিনি বোঝান যে, এখানে তিনি উজমার বিয়ে কোনোভাবেই দিবেন না। কিন্তু শামীম মানতে নারাজ। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলে কাজ হয়নি দেখে সে ক্ষ্যাপেটেপে অস্থির হয়ে বলে, সে উজমাকে না পেলে তার ক্ষতি করবেই, যেকোনো দিন, যেকোনো সময়। সব শোনে উজমার মনে হলো, এই পৃথিবীটা তার জন্য নরক হয়ে গেছে। বেঁচে থাকা এখানে এত কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণার সেটা যদি আগে বুঝত, নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে দিত। এরকম মুহূর্তে তার কী করা উচিত, কী বলা উচিত, ভেবেই পাচ্ছিল না। বোনকে চুপ থাকতে দেখে উসাইদ বলল,

-‘আমি চাইছি, ভালো পাত্র পেলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই তোর বিয়ে দেব।’

উজমা ঝটপট দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
-‘না, ভাইয়া। বিয়ের প্রয়োজন নেই। আমি এখানেই থাকব, সারাজীবন।’

-‘কিন্তু শামীম তো পিছন ছাড়ছে না। যদি রাস্তাঘাটে তোর পথ আটকে কোনো ক্ষতি করে?’

-‘আমরা কি একটা মামলা করতে পারি না?’

-‘মামলা করলেই ওকে থামানো যাবে?’

-‘অন্যত্র বিয়ে হলেই ও থেমে যাবে?’

-‘চোখের আড়াল হয়ে গেলে থেমে যেতে পারে।’

আর কী বলবে, ভেবে পেল না উজমা। শামীমের বউ হওয়া আর জীবন্ত লাশ হয়ে যাওয়া সমান। সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করল সে। ভাবতে ভাবতে বলল,

-‘আমাকে ক’টাদিন সময় দিবে? ভেবে জানাই?’

-‘ভাবার কী আছে আর? এমন তো না যে, তুই কাউকে ভালোবাসিস!’

উসাইদ খুব স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললেও, একমুহূর্তের জন্য উজমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ফারশাদের চেহারা। বড্ড অসহায় দেখাল তাকে। ভাইকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলল,

-‘বাসি না এটা ঠিক। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, পাত্র কোথায় পাবে তুমি? অনেক খুঁজে তো সাকিবকে বের করেছিলে। ফল কী দাঁড়াল! আমি আসলে বিয়ে নিয়ে আর ভাবতে চাইছি না, ভাইয়া।’

বোনের মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারলেও শামীমের হাত থেকে বোনকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় খুঁজে পেল না উসাইদ। বলল,
-‘এত ভাবিস না, একটা না একটা উপায় নিশ্চয়ই মিলবে। আমি অনিক, কাইফ, তাক্বদীমের সাথে কথা বলি। ভালো পাত্র ওরাই খুঁজে এনে দিতে পারবে। কত জানাশোনা ওদের।’

উজমা ম্লানমুখে বলল,
-‘ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝো, সেটাই কোরো।’

***

পৌঁষের তৃতীয় সপ্তাহের এক বিকেলের শেষ মুহূর্তে প্রাকটিস শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরল ফারশাদ। ফেরার পথেই কয়েকজন সাংবাদিকদের সম্মুখে পড়েছিল সে। তাদের করা প্রশ্নের কিছু মাথাগরম করা উত্তর দিয়ে তারপরই ফিরেছে। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বোনকে নিয়ে গল্প করতে বসলেই উসাইদের নম্বর থেকে কল এলো। ঝটপট হাতে রিসিভ করে বলল,

-‘কী অবস্থা তোর? বউ-বাচ্চা ভালো আছে তো? বাড়ি ফিরেছিস?’

উসাইদ বলল,
-‘হ্যাঁ, ভালো আছে দু’জনেই। আগামী সপ্তাহে আসতে পারবি, একদিনের জন্য বা কয়েকঘণ্টার জন্য? আসলে মিশকা খুব করে চাইছে, বেবির নামকরণে যেন তুই থাকিস।’

বন্ধুর কথা শোনে ফারশাদের প্রচণ্ড ইচ্ছে ও আগ্রহ হলো, ওই সময়টায় সে থাকুক, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। ওই রমণীর সামনে দাঁড়ানো এখন অসম্ভবই। তাছাড়া যদি দেশে থাকত, হয়তো ভেবে দেখত। সে নিজের অপারগতা প্রকাশ করে বলল,

-‘স্যরি, দোস্ত। সম্ভব হবে না। নেক্সট উইকে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সাথে নিউজিল্যান্ড সফরে যাচ্ছি। ওয়ানডে ম্যাচ আছে ওখানে।’

-‘ওহহো। তাহলে তো আর জোর করতে পারব বলে মনে হয় না।’

-‘রাগ করিস না, প্লিজ। যদি কখনও সময় পাই, চেষ্টা করে দেখব।’

-‘আচ্ছা, অসুবিধা নেই।’

-‘আংকেল, ঊষা সবাই কেমন আছে?’

-‘হুম… ভালো। রাখি তাহলে? বিরক্ত না করি আর।’

-‘ওকে… বাই। ভালো থাকিস।’

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিষণ্ণ মনে কফিতে চুমুক বসালো ফারশাদ। মনের কোথাও কুহু কুহু সুরে ভালোবাসার সুরসঙ্গীত বেজে উঠল। না ভুলা গেল, না গেল এড়ানো। দীর্ঘক্ষণ নীরবে, আনমনে, গোপনে সেই সুরসঙ্গীতকে লালন করে নিজস্ব ভাবনায় ডুবে রইল সে। ফাবিহা চিন্তিত মন নিয়ে বলল,

-‘তুমি যদি নিউজিল্যান্ডে চলে যাও, আমি একা এখানে কীভাবে থাকব?’

বোনের কথা শোনে ছোট্ট সমাধান খুঁজে ফারশাদ বলল,
-‘পাসপোর্ট সাথে এনেছিস?’

-‘হ্যাঁ, আমি তো সবকিছুই নিয়ে এসেছি। প্রয়োজনীয় কোনোকিছুই ফেলে আসিনি।’

-‘তাহলে আর কী? তুইও সাথে যাবি।’

-‘রিয়্যালি? আমাকে সাথে নিবে তুমি? তোমার সমস্যা হবে না?’

-‘না, কোনো সমস্যা হবে না। তোর বোর না লাগলেই হলো।’

ফাবিহা খুশিমনে আরও অনেকক্ষণ বকবক করে গেল। ফারশাদ শুনলো, হাসলো, বোনের চঞ্চলা কথার সুরে সে নিজস্ব ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে হাসিখুশি একটা মুহূর্ত কাটালো।

***

-‘আজ সন্ধ্যার দিকে প্রাককিস শেষ করে ফেরার পথে সাধারণ জনগণ ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে এ সময়ের জনপ্রিয় ক্রিকেটার ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সহঅধিনায়ক ফারশাদ মুনতাসীরকে। কিছু বিদ্রুপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি একদম মোক্ষম জবাব দিয়ে মাঠ ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন চ্যানেল ফোরটিনের রিপোর্টার শাহীদ সারোয়ার।’

টেলিভিশনের পর্দায় তখন ভেসে উঠল সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণের বেশকিছু প্রশ্ন। তাদের প্রশ্নগুলো এমন ছিল, ‘সোহানাকে সে কেন বিয়ে করতে আগ্রহী নয়? কেন সে একটা মেয়ের মন নিয়ে খেলল? কেন বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নিল না? কেন সোহানার মতো একটা মেয়ের সাথে অন্যায় হলো? তার কোথাও অ্যাফেয়ার আছে কি-না? কারও প্রতি অনুভূতি থাকলে, সে কে? বাবা-মা তো সন্তানদের ভালো চান, তাহলে তাদের পছন্দ মেনে নিতে আপত্তি কীসের?’ এগুলো ছাড়াও আরও বিব্রতকর অনেক প্রশ্নই ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছিল তার দিকে। সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার বদলে ফারশাদ প্রথম বলল,

-‘একটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন না তুললেই কি নয়? আপনারা ফারশাদ মুনতাসীরকে বিচার করবেন, তার খেলা দিয়ে। প্রতিটা ম্যাচের ভালো-মন্দ দুই দিক নিয়ে। কেন তাকে খেলা সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন না করে, এইসব অযৌক্তিক প্রশ্ন করছেন? ব্যক্তি ফারশাদকে আপনাদের জানার দরকার নেই তো। আমার ব্যক্তিগত জীবনের কোনোকিছুই সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করিনি কখনও, আজও করছি না, আগামীতেও করব না, ইনশা’আল্লাহ।’

এরপর আরও কিছু প্রশ্নের মধ্যে একটা ছিল,
-‘তাহলে মুনমুন হক্ব কেন বললেন, ফারশাদ মুনতাসীর তার বোনঝিকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তাকে ধোঁকা দিয়েছে? আপনি তো এখন পর্যন্ত আপনাদের পারিবারিক ছবি শেয়ার করেননি, তবে কি মিডিয়ার সামনে নিজেকে প্রকাশ করার একটা সস্তা টেকনিক ছিল এটা?’

উত্তরে ফারশাদ বলল,
-‘এরূপ সস্তা টেকনিকের মাধ্যমে ফারশাদ মুনতাসীর নিজেকে জনপ্রিয় প্রমাণ করতে চায় না। আগেও যেহেতু এরকম কাজ আমি করিনি, আগামীতেও করব না। আর এসব ব্যাপার যেহেতু আমার অফিসিয়াল পেইজ থেকে কোনো স্ট্যাটাস প্রচার করা হয়নি, আপনাদের তো বুঝে নেয়া উচিত যে, ফারশাদ মুনতাসীরের এসবে হাত নেই। বিয়ে বা প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে মন্তব্য করার আগে অবশ্যই আমার দেয়া আপডেট দেখে নিশ্চিত হয়ে নিবেন যে, ঘটনাটা আদৌ সত্য না-কি মিথ্যা। যাচাই না করে, গুজবে কান দেয়া বন্ধ করলে নেগেটিভিটি কম ছড়াবে।’

-‘তাহলে এই মুনমুন হক্ব কে? উইকিপিডিয়া তো বলছে, আপনার মায়ের নামও মুনমুন হক্ব। কেন তিনি আপনাকে নিয়ে মিথ্যা নিউজ প্রচার করবেন? মায়ের সাথে সন্তানের শত্রুতা কী? সোহানাই বা কেন সবকিছুকে একতরফা অনুভূতি বলে প্রচার করল?’

-‘দেখুন, ব্যক্তি ফারশাদ সবসময়ই সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে থাকতে পছন্দ করে। হ্যাঁ, মুনমুন হক্ব আমার মা। সোহানাকে নিয়ে যা কিছু প্রকাশ হয়েছে, সবটাই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের কারণে হয়েছে। আশা করি এই ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে। এরপর আর এসব নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি হলে একটা মানুষ ক্রমশই আক্রমনাত্মক মন্তব্যের শিকার হবে।’

-‘ফারশাদ মুনতাসীর কবে বিয়ে করছেন?’

-‘যখন বিয়েটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে, তখন।’

-‘সোশ্যাল মিডিয়ার সামনে যা এসেছে, সবটাই কি গুজব, মিথ্যে?’

যতটা বলার প্রয়োজন ছিল, ততটা বলেই হাতের ইশারায় সবাইকে সরিয়ে বিদায় নিয়েছিল ফারশাদ। সম্পূর্ণ নিউজ শেষ হলে ঊষা বলল,

-‘মানুষের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। একটা নিরপরাধ মানুষকে শুধু শুধু হেনস্তা করা। দূর…।’

উজমা কিছুই বলল না। মাথাব্যথার বাহানায় রুমে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। ডায়েরির কথা মনে হতেই হাত বাড়িয়ে সেন্টার টেবিল থেকে ডায়েরিটা নিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল,

-‘মানুষ ঘর কেন বাঁধে? বিয়ে কেন করে? সংসার কেন সাজাতে চায়?’

একটা সময় আমার মনে এসব প্রশ্ন জাগত। আমি উত্তর খুঁজে বেড়াতাম। চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি, আত্মীয়স্বজন অনেকের পারিবারিক অবস্থা, সবকিছু দেখার পর আমি আবিষ্কার করলাম, ‘ঘর’, ‘বিয়ে’, ‘সংসার’ এগুলো আসলে দুটো মানুষের মধ্যকার দূরত্ব দূর করার মাধ্যম হওয়ার পাশাপাশি দুটো মানুষের বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবার গঠন করার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পন্থা। একটা পরিবারে নানান বিষয়াদি থাকতে পারে, নানান সমস্যা থাকতে পারে, একে-অন্যের সাথে মতের অমিল হতে পারে, ঝগড়াঝাটি, রাগ-অভিমান, কথা কাটাকাটি অনেক কিছুই হতে পারে, এতকিছুর পরেও দুটো মানুষের ধৈর্য্য, মনের জোর ও পরিবারের প্রতি কিছু একনিষ্ঠ দায়িত্ব-কর্তব্য সামলাতে গিয়ে কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করে নিয়ে, পরিবারটাকে একান্তই আপন মনে করে বেঁচে থাকার লড়াইটাই হচ্ছে, একটা ‘ঘর’, একটা ‘বিয়ে’, কিংবা একটা ‘সংসার’এর মূল উদ্দেশ্য। এসবের জন্য অবশ্যই যে দুটো মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত বোঝাপড়াটা থাকতে হবে। দু’জনকেই হতে হবে ‘সাপোর্টিভ পার্টনার’। পরিবারের নানান বিশৃঙ্খলা, নানান ঝামেলার পর ব্যক্তিগত একটা মানুষ থাকবে, যার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে একটা মানুষ নির্ভার থাকবে। হাজারও অপ্রাপ্তি, হাজারও দুঃখ, মনোঃকষ্ট সবকিছু মুছে যাবে ওই একটা মানুষের সান্নিধ্যে এলে। সবকিছুর চিন্তায় যখন একটা মানুষ দিশেহারা, নিরুপায়, একদম অসহায়, তখন তার পাশে ভরসার একটা হাত থাকাটাই হচ্ছে, ‘বিয়ে’ নামক সম্পর্কের সুন্দরতম একটা অধিকার। একটা অপ্রকাশিত টান, অনুভব ও ভালোবাসা। দিনশেষে যদি আপনি একটা ভরসার মানুষই পাশে না পান, একটা বিশ্বস্ত হাত যদি আপনার না থাকে, তাহলে আপনার ‘ঘর’ হবে কখনও? কখনও ‘বিয়ে’ ও ‘সংসার’ এগুলোর প্রয়োজনবোধ করবেন আপনি? আমি তো দেখছি না। যেখানে আমি বিশ্বস্ত হাতই পাব না, শান্তিতে মাথা গুঁজে দেয়ার জন্য নিরাপদ একটা জায়গা পাব না, দিনশেষে একটা ভরসার আশ্রয় পাব না, যেখানে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে নির্ভার ভাবতে পারব না, এসব যদি জীবনে না-ই পাব, তাহলে ‘বিয়ে’ কেন করব? কেন ‘ঘর’ বাঁধার স্বপ্ন দেখব? ‘সংসার’ই বা হবে কী করে আমার?

এই পৃষ্ঠা শেষ করে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টালো উজমা। সেখানে শুরুতেই লেখা,
আপনাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, আমার একটা ‘ঘর’ প্রয়োজন। আমার একজন ব্যক্তিগত মানুষ প্রয়োজন। আপনি কী যেন বলেছিলেন, আমার আশেপাশে অনেকেই আছে, তাদের মধ্যে একজনকে বিয়ে করে আমি যেন আমার নিঃসঙ্গতা দূর করি। আচ্ছা, সঙ্গী/সঙ্গিনীর প্রয়োজন কেন হয় জীবনে? কেন কাউকে প্রয়োজন মনে করে ‘বিয়ে’ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়? সঙ্গী/সঙ্গিনী কি শুধু নিঃসঙ্গতা দূর করে, মানসিক শান্তি দেয় না? আমি তো সম্পর্কটাকে একটা দিক দিয়েই বিচার করি না। আমার কাছে তো সম্পর্ক মানে বিশ্বস্ততা, পারস্পরিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভালোবাসা। এগুলোকে বাদ দিলে সঙ্গী/সঙ্গিনীর কি প্রয়োজন জীবনে, যে শুধু নিঃসঙ্গতা দূর করবে আর কিছু না? এরকম হলে তো, একটা পুরুষের জন্য পতিতালয় সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। যেখানে গেলে নিঃসঙ্গতা দূর হয়ে যাবে নিমিষেই। এটা আমি বলতে চাইনি, কিন্তু আপনার কথার অর্থ ঠিক এরকমই ছিল। আমি তো এরকম জীবন চাই না। আমি তো চাই, আমার পাশে কেউ একজন থাকুক, প্রচণ্ড দুর্বল মুহূর্তে যে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলবে, ‘ভয় নেই, আমি আছি।’ প্রচণ্ড একা ও অসহায় মুহূর্তে যে পাশে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘কে বলে তুমি একা? তোমার তো আমি আছি।’ যখন আমার মনের আকাশে মেঘ জমবে, যখন সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে, তখন যেন কেউ এসে সেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে, ‘চোখের জলের মতো অমূল্য রত্ন আর কিচ্ছু নেই। এগুলো যখন-তখন ঝরাতে হয় না।’ খুব বেশি অসুস্থতায় যে মাথার ওপর ভরসার হাত রেখে, একটু ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলবে, ‘আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুমি ঘুমোও।’ এমন একটা মানুষের ছায়া আমি আপনার মাঝে দেখতে পেয়েছিলাম বলেই সাহস করে আপনাকে চেয়েও আমার দুর্ভাগ্যের কারণে হারিয়ে ফেললাম। আপনি কেন আমার হলেন না, বাটারফ্লাই? কেন আমার জীবনে ‘ক্ষণিকের রংধনু’ হয়ে এসেছিলেন আপনি? কেন এই ‘রংধনুর রং’ আমার মনের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে, রঙের মায়ায় আমাকে ডুবিয়ে-ভাসিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে সবটুকু রং মুঠোবন্দী করার আগেই সুদূরে মিলিয়ে গেলেন? কেন আপনাকে ভুলতে আমার এত কষ্ট হচ্ছে? কেন আপনার জন্য চোখের কোণে অশ্রুরা ভীড় করছে? কেন আপনার জন্য আমার চোখ থেকে আজ পানি ঝরছে? বলতে পারবেন আপনি? এই এত ‘কেন’এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর আছে আপনার কাছে? আর কিছু লেখার জোর আমার নেই। জীবনে এতটা দুর্বল, একা ও অসহায় আমি আগে কখনও হইনি, যতটা আজ হলাম। এতসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না আপনাকে। এই চিঠির জবাবও কোনোদিন চাইব না। এই কালো কলম, কলমের কালি, সাদা কাগজ ও চোখের পানির মূল্য যদি আপনার কাছে থাকে, তাহলে এটা আপনার কাছেই রেখে দিন। আর যদি না-ই থাকে, তাহলে চিঠি শেষ হওয়া মাত্রই দূরে ছুঁড়ে ফেলুন, নয়তো পুড়িয়ে ফেলুন। আমি চাই না, আমার এই অনুভূতির গভীরতা আপনি ছাড়া আর কেউ টের পাক। ভালো থাকবেন, আমার বাটারফ্লাই। ভালো রাখবেন সবাইকে। সব অনুভূতির ইতি টানলাম, এখানেই। আল্লাহ হাফেজ।

এরপর সমাপ্তির শেষে লেখা, ‘সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীর।’ চিঠি শেষ হওয়ার পর উজমা টের পেল, নিজের অজান্তেই চোখের কোণ ঘেঁষে অজস্র অশ্রুকণা বালিশ ভিজিয়েছে। চোখেমুখে হাত দিয়ে চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলে মনটাকে হালকা করতে চাইল। এমন বিষাদমাখা সুখের চিঠি তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এইভাবে কেউ চিঠি লিখে? এত কাঁদিয়ে? ইশ, নিজেরই খারাপ লাগছে। তড়িঘড়ি কী যেন ভাবল উজমা। এরপর কাঁচি দিয়ে ওই কয়েকটা পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটল। সিদ্ধান্ত নিল, এগুলো পুড়িয়েই ফেলবে। নয়তো যতবার হাতের সামনে থাকবে, ততবারই পড়তে ইচ্ছে করবে। এমন বিষাক্ত অনুভূতির অতলে তলিয়ে যাওয়া মানে, যেচেপড়ে নিজেকে জমের দুয়ারে পৌঁছে দেয়া। কাউকে ভালোবাসার প্রয়োজন নেই তার, কারও ভালোবাসারও প্রয়োজন নেই। ফারশাদ মুনতাসীরের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা নামক এই দামী অনুভূতি তারজন্য নয়। সে তো নিতান্তই একটা সাধারণ মেয়ে। তার কীভাবে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছাশক্তি ও অধিকার থাকতে পারে?

রান্নাঘরে এসে দিয়াশলাই দিয়ে কাগজের কোণায় আগুন ধরালো উজমা। চোখের সামনে একটা মানুষের সমস্ত অনুভূতি ও সুন্দর প্রকাশকে গলাটিপে হত্যা করতে কষ্ট হচ্ছিল, তবুও মনের জোর দিয়ে জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘তেতুল বনে জোছনা’র চমৎকার একটা উক্তি স্মরণ করে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বিড়বিড় করল,

-‘একটা সাধারণ মেয়েকে ভালোবেসে যদি আপনি কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারেন, তাহলে এই সাধারণ মেয়েটাও আপনাকে প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে সারাজীবন চোখের পানি ফেলে যাবে। আফসোস, আপনি কোনোদিন সেটা জানতেও পারবেন না।’

***

চলবে…