মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-২১+২২

0
76

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – একুশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

মানুষের মন বড়ো কঠিন, জটিল ও নিষ্ঠুর। তাকে ঠিকমতো বোঝা যায় না, সহজেই কোনোকিছুর বশে আনা যায় না। কোনোকিছুর ওপর মনের একবার তীব্র রাগ জন্ম নিলে মুহূর্তেই তাকে সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত করে দেয়ার সাথে সাথে মনের ভেতর হালকা একটা অনুভূতি হতে শুরু করে। মনের ওপর থেকে ভারী পাথরের বোঝা নেমে যায়। কিন্তু মন যখন তীব্র রাগ থেকে কোনোকিছু তছনছ করে দিতে গিয়ে আবারও তার মায়ার পড়ে গিয়ে চরম আফসোসের স্বীকার হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া সামান্য অংশটাকেও আগলে রাখার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার মতো অদ্ভুত ও বিষেভরা যন্ত্রণা সেই মনের কাছে আর একটাও হয় না। অনুভূতি যেমনই হোক, এই সামান্য চিঠি পোড়াতে গিয়ে উজমার হৃদয়পুরী যখন ভয়ানক পর্যায়ের কাঁপুনি ও হারানোর অত্যাধিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল, তখনই জ্বলন্ত কাগজের ওপর জোরেশোরে থাপ্পড় দিয়ে আগুন নিভিয়ে পূণরায় সামান্য পুড়ে যাওয়া একেকটা পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে আঙুলের আলতোস্পর্শে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল প্রতিটা অক্ষর। এখনও অক্ষত আছে দেখে শান্তি পেল কিছুটা। থাকুক কিছু অনুভূতি জীবিত, মনে নাহোক কাগজে। কেন পুড়িয়ে ফেলে এই অনুভূতির অবমূল্যায়ন করতে হবে? মন থেকে স্বীকৃতি আসেনি, তাইবলে কি একটা মানুষের অনুভূতিকে জোরপূর্বক মিথ্যে সাজানো যায়? তার মন অনেক কঠিন ও শক্ত ধাতুতে গড়া হলেও এই কাজটা শেষ পর্যন্ত করতে পারল না উজমা। বেঁচে থাকা প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা একত্রিত করে দিয়াশলাই রেখে আবারও রুমে ফিরে এলো। সবকিছু স্টাডি টেবিলের ওপর নিজের বইপত্রের ভাঁজে লুকিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিল। কিন্তু ঘুম আর হলো না। আদুরে বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ পেয়ে ছুটে গেল ভাইয়ের রুমে। মিশকাত বাচ্চাটাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। উসাইদও চেষ্টা করছে সামলাতে। তবুও কেউ-ই পারছে না। উজমা পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট কম্বল দিয়ে বাচ্চাটাকে ভালোমতো পেঁচিয়ে মিশকাতের বুকের সাথে আগলে দিয়ে বলল,

-‘ওর ঠাণ্ডা লাগছে। তোমার বুকের ওপর রাখো। মায়ের শরীরের উষ্ণতা পেলে বাচ্চারা শান্ত হয়ে যায়। খবরদার, এইটুকু বাচ্চাকে উপরনিচ ঝাঁকুনি দিবে না।’

মিশকাত হাসিমুখে বলল,
-‘দেখব, তোর বাচ্চাকাচ্চা হলে কীভাবে সামাল দেস? তখন যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, ইচ্ছামতো পিটাব।’

কথাটা কানে এলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না উজমা। বিয়ে নিয়েই তো আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না, বাচ্চা অবধি ভাবনা কি তার সাজে? চুপ করে মিশকাতকে বাচ্চা সামলানোর আরও কিছু টেকনিক শিখিয়ে দিয়ে বসার ঘরে এসে দেখল, ঊষা তখনও টেলিভিশনের সামনে বসা। মেয়েটা সিরিয়াল বা নিউজ কোনোকিছুতেই আসক্ত নয় অথচ আজ সন্ধ্যা থেকে টেলিভিশনের সামনে থেকেই সরছে না। শীতের রাত অনেক দীর্ঘ। খাওয়া-দাওয়ার পাঠ শেষ হলেও ঘুম নেই কারও চোখে। শুধু মুরব্বি দু’জন মানুষ বাদে সবাই-ই জেগে আছে। বোনকে সঙ্গ দিতে তার পাশে বসলো উজমা। বলল,

-‘কী রে, আজ তো টেলিভিশনের সামনে থেকে সরছিস না। কী আছে ওতে?’

লেট নাইট নিউজ দেখছিল ঊষা। সেটাই বোনকে দেখাল হাতের ইশারায়। উজমা চোখ ফেলতেই টেলিভিশনের বড়ো পর্দায় তখন একজনের বক্তব্য শোন যাচ্ছে। ইদানীং মন-মেজাজ ভালো থাকে না একদম। যাকে ভুলতে চায় সে-ই ঘুরেফিরে সামনে এসে পড়ছে। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তির হয়ে দাঁড়াল। ঝটপট বোনের কাছ থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে বলল,

-‘সারাদিন ধরে কীসব ফালতু নিউজ নিয়ে পড়ে আছিস? এগুলোর চেয়ে সিরিয়াল বা গানই ব্যাটার।’

চ্যানেল পালটিয়ে গানের চ্যানেল এনে রেখে দিল উজমা। ঊষা মিটমিটিয়ে হেসে বলল,
-‘তোমার কাছে ফালতু মনে হলেও আমার কাছে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। ওহ হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।’

-‘কী?’

-‘ডায়েরিতে কী লেখা আছে?’

বোনের এই বাচ্চামো কথাবার্তায় আরও বিরক্ত হলো উজমা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘একটা রূপকথার গল্প।’

-‘সত্যিই?’

-‘হ্যাঁ, সত্যিই। আমার জীবনে এত সুন্দর গল্প আমি আগে পড়িনি।’

-‘দেখাও না আমাকে। আমিও পড়ি।’

ছটফটে মন নিয়ে আবদার করল ঊষা। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীর এসে রূপকথার গল্প লিখেছে, তা-ও তার ডায়েরির পাতায়। এটা কি সত্যি না-কি বোন দুই নম্বরি করছে? সে চঞ্চল হাত-পা নিয়ে ছুটে গিয়ে ডায়েরি আনতে চাইলে উজমা ক্ষ্যাপেটেপে বলল,

-‘ইউটিউবে অনেক ভালো ভালো রূপকথার গল্প পাবি, ওগুলো দেখ। এটা পড়তে হবে না তোর।’

-‘মানে কী? রূপকথার গল্পই তো। পড়লে কী ক্ষতি?’

-‘পড়বি?’

খুশিমনে উপরনিচ মাথা নাচালো ঊষা। উজমা বলল,
-‘দাঁড়া দিচ্ছি।’

নিজের রুমে গিয়ে চট করে ডায়েরি এনে বোনের হাতে দিয়ে বলল,
-‘পড়। পড়া শেষ হলে তোর রুমে রেখে দিস। ডায়েরিটা তো তোরই, তাই না? তোর কাছেই তো থাকবে।’

ঊষার খুশিটা দেখার মতোই ছিল। ডায়েরি হাতে নিয়ে সে নাচতে নাচতে নিজের রুমে চলে গেল। উজমার হাসি আর ধরে না। আচ্ছা বেকুব বানানো গেল বোনকে। ঊষা চলে যাওয়ার পর দরজা আটকে টেলিভিশন বন্ধ করে নিজের রুমে ফিরল উজমা। একদলা মন খারাপের মেঘ এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। বিষণ্ণ ও আনমনা করে দিল। ভুলে যেতে গিয়েও আবার কাউকে মনে করে দুঃখ পেয়ে কেঁদে গাল ভাসানোর মতো অসহ্যকর অনুভূতি আর একটাও হয় না। কী এক জ্বালা হলো এটা?

***

আজকের সকালটা মুনমুন হক্বের মনমতো ছিল না একেবারে। এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ওনার নেই। কিন্তু ফয়জান মুনতাসীরের জরুরী দরকার শোনেই বিছানা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তিনি। একপ্রকার ত্যক্তবিরক্ত মন নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে হাই তুলতে তুলতে বললেন,

-‘এত সকালে কী দরকার আমার সাথে?’

হাত থেকে নিউজপেপার সরিয়ে, টেবিলের ওপর রাখা গরম চায়ের কাপ দেখিয়ে স্ত্রীকে বললেন,
-‘বোসো। অনেকদিন একসাথে চা খাই না।’

স্বামীর এই আচরণ আদিখ্যেতা মনে হলো মুনমুন হক্বের কাছে। তিনি নাকমুখ কুঁচকে নিয়ে বললেন,
-‘এত সকালে আমি চা খাই না। ভুলে গেছো তুমি?’

-‘আমরা বোধহয় অনেককিছুই ভুলে গেছি।’

হঠাৎ করে হাওয়া ঠিক কোনদিকে বইছে মুনমুন হক্ব সেটা বুঝতে পারলেন না। বললেন,
-‘যেমন?’

-‘কতদিন হলো, একসাথে নাশতা করি না, লাঞ্চ, ডিনার কিচ্ছু হয় না। একসাথে মুভি দেখা হয় না। কিংবা রাত জেগে জেগে তারা গোনাও হয় না। সবকিছু কেমন রূপকথার মিছে গল্পের মতো মিথ্যে, ছলনা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন।’

স্বামীর এই কথায় মুনমুন হক্ব ফিরে গেলেন জীবনের কিছু স্বর্ণালি দিনে। যে দিনগুলোতে জীবনে পর্যাপ্ত সুখ ছিল, সাচ্ছন্দ্য ছিল, ছিল ভালোবাসাও। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদেরকে স্মার্ট ও সেরা বোঝাতে গিয়ে আজকের এই স্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন দু’জনে। সম্পর্কে যে দূরত্ব সেটা দু’জনের ইচ্ছেতেই হয়েছে, আবার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিজেদের উপলব্ধি করা, নতুন করে সুখ খুঁজে নেয়া এটাও নিজেদের ইচ্ছেতেই হয়েছে। সবকিছু মনে করে চেয়ারে বসে হাসিমুখে বললেন,

-‘তুমি-ই বলেছিলে, স্মার্ট হও। নিজেকে মেলে ধরতে শিখো। সারাদিন শুধু ঘর-সংসার না সামলিয়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটো। নিজেকে পরিপূর্ণ সুখী ভেবে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন কোরো। আমি তো সেটাই করলাম। তোমার ইচ্ছের মূল্য দিলাম। জীবন থেকে এতগুলো বছর হারিয়ে আজ কেন এসব কথা বলছ, আমি বুঝতে পারছি না।’

-‘এই পথটা কি ছেড়ে দেয়া যায় না?’

উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন মুনমুন হক্ব। স্বামীর কথাকে অগ্রাহ্য করে পিছনের সময়টা তুলে ধরে বললেন,
-‘তখন আমিও একদিন বলেছিলাম, পরকীয়া নামক পাপ তুমি কোরো না। তোমার একটা সংসার আছে, বাচ্চা আছে, আমি আছি। তা-ও তুমি কেন অন্য নারীতে আসক্ত হবে? কিন্তু তুমি কি বলেছিলে মনে আছে? তুমি এক নারীতে ডুবে থাকার মতো পুরুষ নও। তোমার তো নিত্যনতুন নারী চাই। চাকরি থেকে অফিসের প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে গিয়ে কলিগ নিয়ে ট্যুর করে বেড়ালে আর বেড শেয়ার করলে। আজ আমি যা হয়েছি, সবটাই তোমার জন্য। এখন তো ফিরে আসা সম্ভব নয় আর। শাদ শুধু জানে আমি দোষী, আমি খারাপ, আমি নোংরা। অথচ শাদ এটা জানে না যে, তার জন্মদাতা পিতার স্বভাব কেমন! তোমাকে শাদের কাছে ছোটো করতে চাই না, তার কারণ একটাই, তুমি আমার স্বামী আর আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ওপর রাগ, জেদ, ঘৃণা ও অভিযোগ থেকেই আজকের এই মুনমুন হক্ব। এই সমাজে মুনমুন হক্বেরা এমনি-এমনি জন্ম নেয় না। প্রত্যেকটা মুনমুন হক্বের জন্মের জন্য একটি করে ফয়জান মুনতাসীর দায়ী থাকে। তেমনই আমার জীবন নষ্টের জন্য দায়ী, তুমি।’

রাগ-ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে মুনমুন হক্ব আবারও নিজের রুমে চলে গেলেন। ফয়জান মুনতাসীর কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সোনার সংসারটা নষ্টের জন্য দায়ী তিনিই। এটা তো ভুল নয়, পাপ। কেন তাঁর করা কিছু জঘন্য পাপের জন্য আজ সন্তানদের জীবন নষ্ট হচ্ছে? তাদের মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছে? তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হচ্ছে? জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করে নিজেকে আজ তিনি বড্ড একা ও শূণ্য আবিষ্কার করলেন। এতকিছু কীসের জন্য? এত আত্ম-অহমিকা, ধন-সম্পদ, সম্মান এগুলো দিয়ে কী হচ্ছে এখন? সংসার যে আর সংসার নেই। অনেক আগেই এই সংসারকে মরুভূমি বানিয়েছেন তিনি নিজেই। এই মরুভূমিতে কি আগের মতো সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে? না-কি চিরকালই এমন থাকবে?’

***

ছোট্ট বাচ্চার প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে বেবিশপে এসেছে উজমা। সাথে আছে মাইসারা। ছেলেরা কেউ নেই আজ। তাদের ব্যস্ততা। রাইদাহ এখন কনসার্টে সময় দিচ্ছে বেশি। এই কারণে চেয়েও তিন বান্ধবী এক হতে পারছে না। তবে রাইদাহ কথা দিয়েছে, বাচ্চার নামকরণে সে থাকবেই। মিস হবে না এটা। শপিং শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে গাড়িতে তুলে, রওনা দেয়ার আগেই উজমার চোখ পড়ল একটা ফুটফুটে বাচ্চার দিকে। মেয়েটা সড়কের ওপাশে যাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। আশেপাশে গার্ডিয়ান কাউকেই দেখা গেল না। চঞ্চল পা দু’খানা নিয়ে বাচ্চাটা সবে মাত্র সড়কে পা দিতে যাচ্ছিল, তখনই উজমা চোখ রাঙিয়ে বলল,

-‘রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও। অ্যাক্সিডেন্ট হবে।’

বাচ্চাটি সাহসিকতার সাথে বলল,
-‘কিচ্ছু হবে না।’

-‘কার সাথে এসেছ তুমি? তোমার বাবা-মা কোথায়?’

-‘আমি তো চাচ্চুর সাথে এসেছি। ওইযে চাচ্চু…।’

আঙুল দিয়ে দূরে কাউকে ইশারা করে দেখাল বাচ্চাটা। উজমা চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। এরমধ্যে বাচ্চাটা তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যে-ই রাস্তায় গেল, শা শা শব্দে একটা চলন্ত মোটরসাইকেল এসে কিঞ্চিৎ ধাক্কা মারলো তাকে। চলন্ত সাইকেলের ধাক্কা ও উজমার হাতের টানে ছোট্ট বাচ্চাটা ভয় পেয়েই অজ্ঞান হয়ে গেল। মুহূর্তেই ভীড় জমে গেল রাস্তায়। মাইসারাও ছুটে এলো। উজমা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটার শরীর চেক করে দেখল মাথা ও হাতে যথেষ্ট আঘাত লেগেছে। বাচ্চাটার কোনো গার্ডিয়ানকেও দেখা গেল না কোথাও। দেরী করলে যদি বাচ্চার ক্ষতি হয়, এজন্য সঙ্গে থাকা গাড়িতে তুলে ড্রেসিংয়ের জন্য সরকারি হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে চলে এলো উজমা। পর্যাপ্ত চিকিৎসা করিয়ে বাচ্চাটার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় রইল। বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে মাইসারা অসহায় কণ্ঠে বলল,

-‘কোথা থেকে বিপদ উড়ে এলো, দেখ! আল্লাহ সহায় যে, একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে। ইশ, কী হতো আজ!’

-‘সত্যিই। আল্লাহ সহায় ছিলেন।’

সহজ-সরল, শান্ত ও নিষ্পাপ মুখখানি দেখে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল উজমা। খেয়াল হলো, বাচ্চাটার গলায় একটা আইডেন্টিটি ঝুলছে। একপলকের জন্য সেখানে চোখ বুলিয়েই চোখদুটো স্থির হয়ে গেল তার। যেন দুর্লভ কোনোকিছুর সন্ধান পেয়েছে সে। তখুনি হুড়মুড় করে একটা সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক প্রবেশ করল কেবিনে। চারিদিকে তাকিয়ে একটা বেডে ছোট্ট বাচ্চাটাকে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কাছে ভীড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকল,

-‘তাম্মি…। চাচ্চু, কী হয়েছে তোমার? আমি খুব স্যরি সোনা, আমার ভুলের জন্য আজ তুমি এখানে।’

দুর্ঘটনার সময় খবর ছিল না, এখন এসে ঢং দেখাচ্ছে। উজমার চোখদুটো জ্বলে উঠল এই যুবকের অতি আহ্লাদ দেখে। সে রেগেমেগে বলল,

-‘এখন বলছেন, ভুল হয়েছে? যখন রাস্তায় একা ছেড়েছিলেন তখন ভুল হয়নি? আমার চোখে না পড়লে কী হতো ভাবতে পারছেন?’

যুবকটা দুঃশ্চিন্তায় বেখেয়ালি ছিল। খেয়ালে ফিরেই একটা রাগী মুখ ও জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। লোকজনের মুখে শুনেছিল, একটা মেয়ে ছোটো বাচ্চাকে গাড়িতে তুলে হসপিটালের দিকে এগিয়েছে। এই মেয়েটাই কি সেই মেয়ে? কথায় তো সেরকমই মনে হচ্ছে। চেনা নেই, জানা নেই, অথচ কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও বিবেকবোধের অধিকারিণী। এই যুগে এসেও কেউ কাউকে এইভাবে সাহায্য করতে পারে? একদম নিঃস্বার্থভাবে! নিজের অপারগতা ও ভুল স্বীকার করে বলল,

-‘আসলে ও কীসব অদ্ভুত বায়না করছিল। হাওয়াই মিঠাই, পপকর্ণ আবার টেডিবিয়ার! আমি ওকে গাড়িতে রেখে তারপর ওসব আনতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসতে আসতে ডোর খুলে একা একাই বেরিয়ে পড়েছে।’

-‘এইটুকু বাচ্চাকে একা রাখে কেউ? যদি খারাপ কিছু হতো?’

-‘আমারই ভুল।’

উজমা আর তর্কে গেল না। যুবকটা নিজে থেকেই বলল,
-‘আজ কি নিয়ে যেতে পারব?’

-‘হ্যাঁ, অবশ্যই। ও আসলে আঘাতের চেয়ে ভয় পেয়েছে বেশি। এজন্যই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এখন অবশ্য ঘুমোচ্ছে। কিছু ঔষধ আছে, ওগুলো এক সপ্তাহ কন্টিনিউ করবেন। ঠিক হয়ে যাবে।’

যুবকটা ডাক্তারের সাথে আরও কিছু আলাপ করছিল। সেই মুহূর্তে হসপিটালে এসে উপস্থিত হলো, একজন নারী। চশমা পরা মেয়েটা কেবিনে প্রবেশ করেই চারপাশে তাকিয়ে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

-‘কোথায় আমার বাচ্চা? কী হয়েছে ওর?’

খানিক দূরে যুবকটাকে দেখে মেয়েটি আবারও বলল,
-‘তানজীম, তুমি সাথে ছিলে না? কী করে হলো এটা?’

যুবকটা এগিয়ে এলো মেয়েটির কাছে। অপরাধবোধে বুঁজে এলো কণ্ঠস্বর। বলল,
-‘দুঃখিত, ভাবী। মাফ কোরো। কী থেকে কী হলো, কিছুই বুঝতে পারলাম না, আমি।’

মেয়েটি ছুটে গেল বাচ্চাটার কাছে। আদুরে হাতে ছুঁয়ে দিল তাকে। পরপর অজস্র চুমু খেয়ে বুকে আগলে নিয়ে বসে রইল। দেবরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব?’

-‘এইতো, এক্ষুণি চলে যাব। তুমি এগোও, আমি প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে আসছি।’

তানজীম ব্যস্ত হাতে প্রেসক্রিপশন নেয়ায় মনোযোগ দিলে মেয়েটি দু’হাতে অসুস্থ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আস্তেধীরে ইমার্জেন্সি রুম ত্যাগ করে মাত্রই করিডোরে এলো। পিছন থেকে উজমা বলল,

-‘পাঁচ মিনিট সময় হবে, ফারিশাবু?’

***

ম্যাচ শুরু হতে আরও তিনদিন বাকি। ওখানে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে বলেই আগেভাগে দেশ ছাড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের খেলোয়াড়দেরকে। দলবেঁধে এ্যায়ারপোর্টে এসে পৌঁছাতেই সেখানে কিছু সাংবাদিকদের সামনে পড়ল সবাই। এখানে কোনো প্রশ্ন না করলেও বেশ কয়েকজন ফারশাদের হাতের সাথে ফাবিহাকে দেখে ছবি তোলা ও লাইভ শেয়ার করা শুরু করল। এদিকে ছবি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হলো। যার যা মনে আসছে, সে সেটাই বলছে, শেয়ার করছে। সামান্য কিছু রি’অ্যাক্ট, কমেন্ট ও শেয়ারের আশায় কয়েকজন তো না জেনে, না বুঝে নানা রকমের নেগেটিভ কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে। বোনকে বিশ্রাম নিতে বলে মাত্রই পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছিল ফারশাদ। পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

-‘ছিঃ ছিঃ ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরের চরিত্র এত খারাপ? আজকাল মেয়ে নিয়েও ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছেন! বড়ো লোকের ব্যাটা ছেলেরা এমনই হয়। আড়ালে নোংরামি করে, মিডিয়ার সামনে এসে সাধুবাবা সাজে।’

এই জঘন্য কথা শোনার আগে যদি মৃত্যু হতো, সেটাও বোধহয় ভালো ছিল ফারশাদের জন্য। কমবয়সী ছেলেটা না বুঝে কী ভুল করল, সেটা বোধহয় সে বুঝল না। হাতের বোতলটা রেখে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে দু’হাতে সেই ছেলেটার কলার ধরল ফারশাদ। বসা থেকে টেনে তুলে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

-‘কী বলছিলেন আপনি? ফারশাদ মুনতাসীর মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে? আড়ালে নোংরামি করে আর মিডিয়ার সামনে সাধুবাবা সাজে, তাই তো? আপনি জানেন কাকে নিয়ে আপনি এই মন্তব্য করলেন? ওই মেয়েটা কে, জানেন? আরে স্টুপিড ও আমার বোন। মায়ের পেটের বোন হয় আমার। আমার বোনকে নিয়ে কি আমি রাস্তায় বের হতে পারব না? আমাকে কি বোরখা পরে বের হতে হবে? তাকে নিয়ে দেশের বাইরে কোথাও যেতে পারব না? এটা কি নিষেধ আমার জন্য? বোনের হাত ধরলেই কি একজন ভাইয়ের চরিত্র নোংরা হয়ে যায়? ভাই-বোনদের সম্পর্ককে আপনাদের কী মনে হয়? কোনোকিছু মন্তব্য করার আগে একটু মাথা খাটাবেন না? যা মুখে এলো, তা-ই বলে দিলাম। রাস্তায় একটা নারী-পুরুষ বের হওয়া মানেই কি, ওরা স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা? ওদের মধ্যে কি বন্ধুত্ব থাকতে পারে না? ওরা কি ভাই-বোন হতে পারে না? ওরা কি চাচা-মামা, ফুপি-খালা হতে পারে না? কাউকে নিয়ে সস্তা মন্তব্য করার আগে এটা আগে ভাববেন যে, কোথায় কোন শব্দটা ব্যবহার করছেন! আপনাদের মতো নোংরা মানসিকতার মানুষ এই সমাজে আছে বলেই, সমবয়সীদের সম্পর্ককে সবসময়ই আপনারা নোংরা চোখে দেখেন। এটা ভাবতে পারেন না যে, এই দেখার আড়ালেও সুন্দর কিছু থাকতে পারে। হতে পারে, ওদের সম্পর্কটা মা-ছেলে, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব, কিংবা অন্যকিছু।’

সাংবাদিকেরা যে কয়জন ছিল, সবাই এসে উপস্থিত হলো। দলের আর যারা ছিল, তারাও এসে ফারশাদের পাশে দাঁড়াল। ফাবিহা তাজ্জব বনে বসে আছে। এখানে যা কিছু হলো, সবকিছু ভাবতে গিয়েই গায়ে কাঁটা ফুটে উঠল। ইশ, মানুষ এত নোংরা! তাদের ভাবনা এত অপরিচ্ছন্ন! কোথায়, কী বলতে হয়, সামান্য জ্ঞানটুকুও নেই। এরকম একটা সিচুয়েশন জীবনে আসবে সে ভাবেনি। ফারশাদ ওই ছেলেটাকে আরও বেশকিছু শক্ত কথা শুনিয়ে, মিডিয়ার সবাইকে দূরে সরিয়ে, ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে তাকে হস্তান্তর করে ফাবিহার কাছে আসতেই মেয়েটি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। ফারশাদ বলল,

-‘কাঁদিস না তো। জার্নিটাই মাটি হয়ে যাবে।’

-‘আমি খুব দুঃখিত, ভাইয়া। ওরা আমার জন্য তোমাকে…।’

-‘মারব চড়। তুই কেন দুঃখিত হবি! নিজের পরিচয়ের জন্য এখন কি রাস্তায় বেরিয়ে সবাইকে শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে হবে, তুই ফারশাদ মুনতাসীরের বোন? তাদের মাইন্ড খারাপ, তাই খারাপ ভাবতে পারছে। তাইবলে আমরা কি খারাপ? এটা নিয়ে আমাদেরকেই কেন এত মাইকিং করতে হবে? কেন হাত ধরে ধরে সবাইকে বোঝাতে হবে, আমরা ভাই-বোন? তাদের কি বিবেকবুদ্ধি নেই? কথাবার্তা বলার আগে সামান্য ভদ্রতাটুকু তো বজায় রাখা উচিত ছিল। এটুকু না পারুক, আমাকে প্রশ্ন করলেই উত্তর দিয়ে দিতাম। নোংরা কথাগুলোই কেন ছড়াতে হবে তাদের? এরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মন খারাপ করিস না আর। আমি আছি তো না-কি!’

দলের অন্যান্য ক্রিকেটার মাফিন, নিহাদ, পরশ, অনীল বাদেও আরও যারা ছিল, সবাই ফাবিহাকে নিয়ে ওইটুকু সময় খুব হাসি-আনন্দে মেতে থাকার চেষ্টা করল। এই পরিস্থিতির উপযুক্ত জবাবটা সঠিক সময়ে দেয়াতে এখানে যারা যারা উপস্থিত ছিল, তারা তো অবাক হলোই, সাংবাদিকেরা মুহূর্তেই সম্পূর্ণ নিউজটা প্রচার করে দিল নিজ নিজ চ্যানেলে। লাইভ, পিকচার যা কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল, সেসবও ডিলেট হওয়া শুরু হলো। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট ছাড়লে দূর আকাশের নীলিমায় হারিয়ে গিয়ে, সাদা সাদা অসংখ্য মেঘ খণ্ডকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল সবাই।

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – বাইশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

বুবু নামের সাথে ফারিশার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পিছনে ফিরে তাকালেই এই নামের অস্তিত্ব খুব করে অনুভব করে সে। ছোটোবেলা থেকে সবাই তাকে বুবু বা ফারিশাবু বলেই ডাকত। সবার কাছে সে আদরের বুবু ছিল। জীবন থেকে বেশকিছু স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইলেও কখনও পিছনের সম্পর্ক ও আপন মানুষদের প্রতি ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে পারে না সে। এত বছর পর আবারও এই বুবু ডাক তার কানে আসবে, কেউ তাকে বুবু বলে ডাকবে, এটা তো একটা কল্পনাতীত ভাবনাই ছিল তার কাছে। এজন্য সময়ের সাথে সাথে বুবু শব্দটা জীবন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। বহু বছর আবারও যখন ‘ফারিশাবু’ ডাকটা কানে এলো, স্তম্ভিত, অনড় শরীর নিয়ে করিডোরেই থেমে গেল ফারিশা। চলার শক্তি হারিয়ে গেল তার। পিছু ফিরেই দেখল, একটা মায়াভরা মুখ, চোখেমুখে একরাঁশ হাসিখুশি ও চঞ্চলতা। তার দিকে কী মিষ্টি ও স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে অবাক হয়ে বলল,

-‘কে আপনি? আমার নাম জানলেন কী করে? আবার শেষে বুবু বলেও ডাকছেন!’

-‘আমি উজমা ওয়াজেদাহ্। মুসলিম কোয়াটারের ওদিকে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম আমরা। মনে আছে আপনার, উসমান ওয়াজেদ ও ওয়াহিদা জামানকে?’

স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে কতকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠল ফারিশার। একটু একটু করে সবকিছু মনে পড়ল। উসাইদ, উজমা ও ছোট্ট ঊষাও বাদ গেল না। বিস্ময়, সুখ ও আনন্দ নিয়ে বলল,

-‘তুমি! চেনা যাচ্ছে না একদম। অনেক পালটে গিয়েছ! বড়ো হয়ে গিয়েছ।’

-‘সময় কত এগিয়েছে!’

-‘হুম…। জরুরী কিছু বলবে?’

-‘হ্যাঁ…। শুধু পাঁচ মিনিট সময় নিব।’

-‘ঠিক আছে। কোথাও বসি?’

সাথে সাথে উপরনিচ মাথা নাড়লো উজমা। এইভাবে, এই সময়ে ফারিশাকে এখানে পাবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। সবকিছু কেমন কল্পনাসৃষ্ট গল্প মনে হচ্ছে। উৎফুল্ল মেজাজে ফারিশার সাথে ক্যানটিনের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে মাইসারাকেও ডেকে নিল সাথে। হসপিটালে কাছেই ছোট্ট ক্যানটিনে বসে সবার জন্য চা অর্ডার দিল উজমা। ফারিশা জানতে চাইল,

-‘আংকেল-আন্টি কেমন আছেন?’

-‘বাবা আগের মতোই। আর মা… কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন।’

-‘ইন্না-লিল্লাহ!’

ওয়াহিদা জামান বেঁচে নেই, এটা ফারিশার জন্য অত্যন্ত দুঃখের একটা সংবাদ। কত অমায়িক, কত সুন্দর মনের একটা মানুষ ছিলেন উনি। ভাবতে গিয়েই কান্না পেল তার। দীর্ঘশ্বাস গিলে নিয়ে বলল,

-‘উসাইদ কী করছে এখন?’

-‘একটা ফুড ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজার হিসেবে আছে। ঘর-সংসার সামলাচ্ছে আর আমাদের দেখাশোনা করছে। এইতো…।’

-‘বিয়ে করেছে?’

-‘হুম…। কয়েকদিন আগেই কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা এখানে থাকো কোথায়? গ্রামে ফিরে গেছো?’

-‘দাদাবাড়িতে যাইনি। ভাইয়া আলাদা বাড়ি বানিয়েছে।’

টুকটাক কথার ফাঁকে ওয়েটার চা দিয়ে গেলে তিনজনে চা খাওয়া শুরু করল। উজমা বলল,
-‘আপনি এই শহরে কবে এসেছেন?’

জীবনের কিছু বাজে অভিজ্ঞতা চোখের পলকেই উঁকিঝুঁকি মারলো মস্তিষ্কে। একটার পর একটা দুঃসহ স্মৃতি তার চোখমুখের মধ্যে মুহূর্তের মধ্যেই অসহায়ত্বের ছাপ এঁকে দিল। আদুরে বাচ্চাটাকে বুকের কাছে আগলে নিয়ে বলল,

-‘এই বছরই। জানুয়ারীতে।’

-‘ওহ, ভাইয়া কী করছেন?’

-‘ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে জব করছে।’

আরও কিছুক্ষণ চুপ রইল সবাই। উজমা কথা বলতে গিয়েও ঘুলিয়ে ফেলছে। কী বলবে, না বলবে ভেবে উঠতে পারছে না। তাকে চুপ থাকতে দেখে ফারিশা বলল,

-‘তুমি কিছু জরুরী কথা বলতে চাইছিলে!’

নিঃশব্দে উপরনিচ মাথা নাড়লো উজমা। মনে সাহস এনে বলল,
-‘লাস্ট উইকে আপনার ভাই, ফারশাদ মুনতাসীর আমাদের ওখানে এসেছিলেন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। মেইবি, কোনো শপিংমলে উনি তাহমীদ ভাইয়াকে দেখেছেন। এরপর থানাতেও যোগাযোগ করেছেন। উনি এখনও আপনাকে খুঁজছেন, পাগলের মতো। আপনার বোধহয় ওনার সাথে একবার কথা বলা উচিত। আজকের এই দুর্ঘটনাকে আমি দুর্ভাগ্য বলব না-কি সৌভাগ্য বলব, বুঝতে পারছি না বুবু। এখনও আমার কাছে সবটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।’

ফারিশাকে খুঁজে খুঁজে তানজীমও এলো ক্যানটিনে। তিনজন মেয়েকে একসাথে দেখে সে দাঁড়িয়েই রইল। বসলো না। ছোট্ট তাম্মিকে কোলে নিয়ে বলল,

-‘ভাবী, চলো ফিরে যাই। ভাইয়া ইতিমধ্যে চার-পাঁচবার কল করেছে।’

ফারিশা তখনও নিশ্চুপ। তার জল টলমল চোখ। পিছনের নানান স্মৃতি, হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, সবকিছু একসাথে ঘিরে ধরল তাকে। নিঃশব্দে কেঁদে গাল ভাসাল। তানজীম অবাক হলো। উজমা একহাতে ফারিশাকে আগলে নিতেই ফারিশা বলল,

-‘আমি পিছনে ফিরতে চাই না, উজমা।’

-‘রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার তো করতে পারবেন না। উনি ভাই হোন আপনার।’

-‘ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে?’

-‘না…। ভাইয়ার কাছে আছে।’

ভাইয়ের খবর পেয়ে একটু হালকা হলো ফারিশা। এই সম্পর্ক, এই বন্ধন ও আত্মিক টান কোনোকালেই মুছে ফেলার শক্তি তার ছিল না। ভ্যানিটি থেকে নোটপ্যাড বের করে নিজের ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল,

-‘এটা তোমার কাছে রাখো। ও যদি আর ফোন করে বা আমার কথা জানতে চায়, তাহলে এটা দিও।’

-‘আচ্ছা। এখন কি উঠবেন?’

-‘হুম…।’

উজমা ও মাইসারাকে রেখে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়াল ফারিশা। তানজীম বলল,
-‘শুধু বিদায়ই নিলে? ওনাকে একটা থ্যাংকস দাও। তাম্মিকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন আজ।’

কৃতজ্ঞতাবোধে মাথা নুইয়ে এলো ফারিশার। হাত বাড়িয়ে উজমাকে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য ধন্যবাদ দিল। বিনিময়ে শুধু লাজুক হাসি ফেরত দিল উজমা। তানজীম বলল,

-‘ধন্যবাদস্বরূপ আপনি কিন্তু আমার কাছে একটা ট্রিট পাবেন। আজ যেহেতু চলে যাচ্ছি, ট্রিটটা তোলা রইল। যদি কোনোদিন চলতে পথে আবারও আমাদের দেখা হয়, অবশ্যই অবশ্যই তা কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে দেব।’

তানজীম কথাটা যেভাবেই বলুক, তার স্বাভাবিক আচরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ধরনটা ভালো লেগেছে উজমার। সে হেসে জবাব দিল,

-‘আপনাকে ধন্যবাদ। ট্রিটের প্রয়োজন নেই। আমি তো শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।’

-‘যেটাই হোক, বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজকাল বিপদ দেখলে মানুষ পালিয়ে যায়। যেখানে অসংখ্য পুরুষ ছিল, পথচারী ছিল, সেখানে কেউ পাশে না দাঁড়ালেও আপনি একজন মেয়ে হয়ে যেভাবে তাম্মির পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেটা দেখে আমার মনে হয়েছে, কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদেরকে দায়িত্ব-কর্তব্য এগুলো শিখিয়ে দিতে হয় না, এরা নিজেদের মধ্যে থাকা পর্যাপ্ত বিবেকবোধ দিয়েই দায়িত্ব-কর্তব্য স্বেচ্ছায় কাঁধে নিতে জানে।’

উজমা খুব বেশি লজ্জা পেল। মুখ নামিয়ে বলল,
-‘আপনি একটু বাড়িয়েই বলছেন।’

লাজরাঙা মুখের মিটিমিটি হাসি ও ঠোঁট কামড়ানো দেখে মুচকি হেসে তানজীম বলল,
-‘আপনি জানেন না, তাম্মি আমাদের পরিবারের কী! ওর জন্য জানটাও দিয়ে দিতে পারি সবাই। আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত, আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। অনেক বড়ো অপরাধবোধের হাত থেকে আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব! প্লিজ, একটাদিন ট্রিট নিন, একজন বন্ধু মনে করে।’

কিছু প্রস্তাব যতই সহজ ও স্বাভাবিক হোক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে লুফে নেয়া যায় না। একেই তো ব্যক্তিটি তার অচেনা, তারমধ্যে ফারিশার দেবর। চেনা পরিচয় নেই, তার সাথে ভদ্রতার খাতিরে এতক্ষণ কথা বলেছে, এইতো ঢের। এরবেশি বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। যেহেতু প্রস্তাবটা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা মানে ব্যক্তিকে অপমান করা, তা-ই সরাসরি না বলে একটু ইনিয়েবিনিয়ে উজমা বলল,

-‘চলতে পথে যদি কোনোদিন দেখা হয়, ভেবে দেখব।’

-‘ওকে, বাই। ভালো থাকবেন।’

উজমা শুধু হাসলো কিছু উত্তর দিল না। শেষবেলা বাচ্চাটাকে একটু আদর দিয়ে ফারিশা ও তানজীমকে ক্যানটিন থেকে বিদায় দিয়ে দুই বান্ধবী ফের চেয়ারে বসলো। মাইসারা বলল,

-‘তুই বুঝলি কী করে এটা ফারশাদ মুনতাসীরের বোন?’

-‘বাচ্চাটার গলার আইডেন্টিটি খেয়াল করেছিস? ওখানে লেখা ছিল, বাবা ও মায়ের নাম। মায়ের জায়গায় সৈয়দা ফারিশা মুনতাসীর হলেও বাবার জায়গায় মেসবাহুল আলম লেখা। যতদূর জানি, ফারিশাবুর বয়ফ্রেন্ডের নাম তাহমীদ। এই মেসবাহুল আলমটা আবার কে!’

-‘তুই জিজ্ঞেস করলেই পারতি?’

-‘প্রথমদেখায় এতকিছু জিজ্ঞেস করা যায়, তা-ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে? বাড়াবাড়ি হয়ে যেত। এজন্যই চেপে গেছি।’

-‘তা ঠিক। উঠবি? দেরী হচ্ছে।’

চায়ের বিল মিটিয়ে দুই বান্ধবী গাড়িতে উঠে বসলো। শহরের শেষ মাথায় এসে কাইফের অ্যাপার্টমেন্টে মাইসারাকে নামিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল উজমা। তার ঠোঁটে ভীষণ তৃপ্তির হাসি। হঠাৎ করে একটুকরো সুখ যখন অন্তরকে ছুঁয়ে গিয়ে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলে চারপাশ, তার বেলায়ও তেমন হলো। মুখভরা হাসি ও বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে বিড়বিড়াল,

-‘তোমার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া, মাবুদ।’

***

ফারশাদ যেহেতু দেশের বাইরে, তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম আপাতত বন্ধই মনে হলো উজমার। যেহেতু দেশীয় ফোন নম্বর ইউজ করা যাবে না, তার মানে এই ক’টাদিন সে ফোনালাপের বাইরেই থাকবে। তবুও বাড়ি ফিরে খুশিমনে ভাইয়ের হাতে একটা ঠিকানা ও ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘এই ঠিকানা চিনো?’

উসাইদ লেখায় চোখ বুলিয়ে বলল,
-‘হুম…। এটা তো কোর্টরোড। কিন্তু ঠিকানাটা কার?’

-‘আছে একজনের। আমি চাইছি, তুমি এক্ষুণি ওই নম্বরে ফোন কোরো আর ওই নারীটিকে বোলো যে, আগামীকালকের নামকরণের অনুষ্ঠানে তিনি যেন স্ব-শরীরে এখানে এসে উপস্থিত হোন।’

থমকানো মনোভাব নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল উসাইদ। উজমা বলল,
-‘শুধু একজন না, ওনার সাথে আরও যদি কেউ থাকে স্বামী, সন্তান, কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি, সবাইকেই দাওয়াত দিও।’

-‘ঠিকানাটা কার সেটা তো বলবি?’

ঠোঁট চেপে হাসি আটকে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে পিছনে দাঁড়াল উজমা। চুপিচুপি বলল,
-‘তোমার ফারিশাবুর। বুবু এই শহরেই, এই ঠিকানায় থাকেন।’

উসাইদ ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাইকে তব্দা খাওয়ানো শেষ হলে, এক এক করে আজকের দিনের সম্পূর্ণ ঘটনা তুলে ধরল উজমা। সব শোনে উসাইদ বলল,

-‘দাঁড়া, আমি শাদকে জানাই।’

-‘উনি তো দেশের বাইরে, যোগাযোগ করবে কী করে?’

-‘হোয়াটসঅ্যাপে।’

‘ওহ’ বলে চুপ করে গেল উজমা। এটা তো সে ভুলেই গিয়েছিল। যোগাযোগের অন্য অপশন তাহলে আছে। উসাইদ ততক্ষণে ফারশাদের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলে উজমা বলল,

-‘ভাইয়া, শোনো।’

-‘বল।’

ফোনে টাইপ করতে করতে জবাব দিল উসাইদ। উজমা বলল,
-‘এক্ষুণি কিছু বোলো না। উনি তো মাত্রই দেশের বাইরে গেলেন, খেলার উদ্দেশ্যে। এখুনি যদি বোলো, হয়তো উড়ে আসতে চাইবেন। সেটা তো সম্ভব নয়, তাই না?’

উসাইদ ভেবে দেখল, কথাটা যুক্তির। সে থেমে গেল। বলল,
-‘ঠিক আছে। তুই ফ্রেশ হ, আমি বুবুকে দাওয়াত দিই।’

অবচেতন মন এখনও চায় না, ফারশাদ দ্বিতীয়বার এখানে আসুক আর তার সাথে আবারও দেখা হোক কিংবা কথা হোক। চোখের সামনে দাঁড়ালেই তো মনে হবে, ওই দামী চোখ, ওই সুন্দর মন ও মানুষকে সে কীভাবে অবহেলায়, অযত্নে মন থেকে দূরে সরাচ্ছে। আবারও যদি সামনে এসে দাঁড়ায়, কীভাবে পালাবে? লুকোচুরিই বা করবে কত? লুকিয়ে হয়তো মানুষকে ফাঁকি দেয়া যায়, কিন্তু মনকে তো দেয়া যায় না। মন তো বার বার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করবে? দূরে সরিয়ে দিলেও কি দূরে সরানো যাচ্ছে? দিনের একটা সময়, কিংবা রাতের একটা মুহূর্তে, কোনো না কোনো স্মৃতিতে ফারশাদ ঠিকই তার মনে উঁকিঝুঁকি মারছে। হয় সকালের শিশিরভেজা প্রথম সূর্যের কিরণে, নয় সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলির ক্ষণে, অথবা গভীর রাতে খুব নির্জন কোনো মুহূর্তে, একবার অন্তত উঁকি দিবেই, একটা নাম, একটা অবয়ব। কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে থাকা যে তাকে বার বার স্মরণ করা এটা যদি মন বুঝত, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা না করেই ভুলে যেত। এইযে, এখনও ভুলতে গিয়ে আবারও তাকে মনে করে, স্মৃতিকে পূণরায় জাগিয়ে তুলে কষ্ট পাওয়া, এটা কি তার সাজে? তবুও কেন এত কষ্ট হয়? কেন মন কাঁদে? কেন ভুলে থাকা যায় না? হেরে যাওয়া মন ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ফিরতেই হ্যাঙ্গারের দিকে চোখ গেল উজমার। গুটিকয়েক পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ফারশাদের ফেলে যাওয়া জ্যাকেটের গায়ে হাত বুলিয়ে আনমনেই আওড়ে গেল,

-‘কী বিচ্ছিরি অনুভূতি এটা? কেন আপনাকে ভুলতে গিয়েও বার বার মনে করছি? আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না। তা-ও কেন আপনার স্মৃতি আমার পিছু ছাড়ছে না? এই কঠিন অনুভূতির সামনে কেন আমাকে দাঁড় করিয়েছেন আপনি? যত ভুলতে চাই, ততই মনে করে কষ্ট পাই। আপনি মানুষটা একটা যন্ত্রণাদায়ক কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। উপড়ে ফেলতেও পারছি না, সহ্য করতেও পারছি না। এই বিষাক্ত অনুভূতি থেকে মুক্তি চাই আমি, মুক্তি চাই। একটু মুক্তি দিন না, আমায়!’

***

সকালে একদফা প্রাকটিস শেষ করে বোনকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে ঘুরতে বেরিয়েছে ফারশাদ। ফাবিহার চোখেমুখে মুগ্ধতা ও সুখ। তারাভরা খোলা আকশের সৌন্দর্য ও চারিদিকের রংবেরঙের উজ্জ্বল আলোয় শহরটা এত সুন্দর দেখাচ্ছে, মুগ্ধতা শুধু থেকে থেকে বাড়ছেই। দুই ভাই-বোন যখন ব্যস্ত ছিল, গল্প, আড্ডা ও হাসি-ঠাট্টায়, তখুনি ফারশাদের হোয়াটসঅ্যাপের রিংটোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে বাবার নম্বর দেখেও রিসিভ করার আগ্রহ পেল না। সাইলেন্ট করে রেখে দিল পাশে। আবারও সেটা জ্বলে উঠলে চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করল ফারশাদ। বলল,

-‘কী বলবে, তাড়াতাড়ি বোলো।’

-‘তুমি কি ব্যস্ত?’

ফয়জান মুনতাসীরের গলার আওয়াজটা খুব বিষণ্ণ শোনালো। কপালে ভাঁজ পড়ল ফারশাদের। বলল,
-‘তেমন কিছু না। ফাবিহাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি।’

-‘তোমার কাছে ক্ষমা চাইতেই ফোন করলাম।’

-‘কেন?’

-‘মনে কোরো, কোনো কারণে তোমার বাবা সন্তানদের কাছে অপরাধী। তাই অপরাধ বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইতে ফোন করেছে। তুমি কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে?’

ফয়জান মুনতাসীরের এই আচরণ, ঠিকঠাক বুঝে এলো না ফারশাদের। কতক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-‘আজ হঠাৎ করে এসব কথা কেন বলছ?’

-‘এমনিই, মনে হলো। তুমি, ফাবিহা, ফারিশা সবার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। জীবন তো চিরস্থায়ী নয়, তাই না? কখন কী হয়!’

এই থমথমে গলার আওয়াজ, ধীরস্থিরভাবে বলা প্রতিটা শব্দ, কেমন করে যেন ফারশাদের বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিল। সে অভিমানী মন নিয়ে বলল,

-‘তুমি যদি স্পষ্ট করে তোমার অপরাধের কথা শোনাও, তাহলেই ভেবে দেখব, ক্ষমা করা যায় কি-না।’

ফয়জান মুনতাসীর চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না। মনের জোর ও সাহস কিছুই নেই। আছে শুধু লজ্জা, অপরাধবোধ, পাপ। বাবার নীরবতা টের পেয়ে ফারশাদ বলল,

-‘আচ্ছা, বাবা। একটা কথা বলি?’

-‘বোলো।’

অস্ফুটস্বরে আওয়াজ করলেন তিনি। সামান্য গোঙালেনও। খানিকপর বাবার কান্নার আওয়াজ পেল ফারশাদ। বিচলিত কণ্ঠে জানতে চাইল,

-‘কী হলো, বাবা? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাবে? একটু অপেক্ষা কোরো আমি কেয়ারটেকারকে ফোন দিই।’

-‘আমি ঠিক আছি, শাদ।’

ভাঙাগলায় উত্তর দিলেন তিনি। ফারশাদ বলল,
-‘তাহলে কাঁদছ কেন?’

-‘একটা বাবা কখন কাঁদে শাদ? যখন সে খুব অসহায়, একা ও নিঃস্ব হয়, তখনই তো, তাই না?’

-‘মাকে ফেরাতে পারোনি কেন, বাবা? যদি পারতে…।’

-‘কী করে পারতাম? ওই একই অপরাধে তো আমিও। নিজেকে শাস্তি না দিয়ে আমি অন্যকে কী শাস্তি দিতাম?’

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আঁৎকে উঠল ফারশাদ। মনে এত ব্যথা অনুভব হলো যে, এই ব্যথা উপশমের উপায় সে খুঁজে পেল না। মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণায় শরীর-মন ভেঙে আসতে চাইল। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

-‘কী বলছ, বাবা?’

-‘এটাই সত্যি। এজন্যই তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে ফোন করলাম। পাপের বোঝা বোধহয় বেশি হয়ে গেছে, এজন্য বিবেক আমাকে আজ পিছনের সময়টাকে স্মরণ করিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সময়ের ভুল সময়ে না শোধরালে জীবনে সুখ-শান্তি কিচ্ছু হয় না। আমার জীবনে সবই আছে, তোমরা আছো, অথচ আমি সুখী নই। নিজে তো সুখী হতে পারলাম না, কাউকে সুখী করতেও পারলাম না। যদি কখনও পারো, বাবাকে ক্ষমা করে দিও।’

আর শোনার মতো পর্যাপ্ত মনের জোর ফারশাদ পেল না। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন সুইচড অফ করে রেখে দিল। ফাবিহা ভাইয়ের মুখের ভাবভঙ্গি খেয়াল করে বলল,

-‘বাবা কী বললেন?’

-‘তেমন কিছু না, এমনিই ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।’

-‘তুমি যা বলেছ, সব শুনেছি কিন্তু সব বুঝতে পারছি না।’

বোনকে দুঃখ দেয়ার প্রয়োজনবোধ করল না ফারশাদ। মনমরা ভাব দূরে সরিয়ে, মিথ্যে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
-‘এসব কথা বাদ দেই। তোর কথা বল। দেশটা সুন্দর না?’

ভাইকে জোর করল না ফাবিহা। যে কথা ভাই আড়ালে রাখতে চায়, সেটা আড়ালেই থাকুক। কী দরকার জানতে গিয়ে কাউকে কষ্ট দেয়ার! দরকার নেই তো। এমনিতেই তার জীবনে কষ্টের শেষ নেই। নতুন করে আর কষ্ট দেয়ার দরকার কী? সে প্রসঙ্গ ভুলে যেতে গিয়ে উত্তর দিল,

-‘ভীষণ সুন্দর।’

ফোন বের করে কিছু সুন্দর দৃশ্য ক্যাপচার করল ফাবিহা। ফারশাদ দেখল, হাসলো। একসাথে ডিনার শেষ করে ফেরার পথ ধরলে ফাবিহা বলল,

-‘যদি কোনোদিন বিয়ে কোরো, ভাবীকে এই দেশে নিয়ে এসো।’

হাজারও দুঃখ ভারাক্রান্ত মন ও যন্ত্রণাদায়ক কিছু মুহূর্তের মধ্যে একটুকরো সুখস্মৃতি হয়ে উজমার মায়াভরা হাসি তার হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠল। সমস্ত মন খারাপ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে হৃদয়জুড়ে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে জেগে উঠল স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল হাসি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল,

-‘যতদিন আমার নিঃশ্বাস চলবে, ততদিন আমি রবের নিকট আপনাকেই চাইব, বাটারফ্লাই। দেখব, আমার এত চাওয়ার বিনিময়ে রব আমাকে কী দিয়ে পুরস্কৃত করেন!’

***

চলবে…