মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-২৩+২৪

0
67

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – তেইশ

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

ভালোবাসার মতো সর্বনাশা অনুভূতি জীবনে আসুক, কারও জন্য মন ছটফট করুক, মন উতলা হোক, কাঁদুক, অন্তরজ্বালায় দিবানিশি জ্বলেপুড়ে ছাঁই হোক, এসব কিছুই উজমা চায়নি বলেই সবসময় এই অনুভূতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কখনও কাউকে দেখে মন দিক হারায়নি, বেসালাম হয়নি, ব্যকুল হয়নি। নিজেকে শক্ত পাথরের মতো অটল রেখে দিন কাটিয়েছে। মোহমায়া থেকে দূরে সরে থেকেছে। নিজেকে ও নিজের মনকে এমনতর ভাবনা থেকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। কখনও মনেও হয়নি, ‘ইশ একবার যদি কারও প্রেমে পড়তাম! তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।’ তবে সে জানে, ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা ভীষণরকম সুন্দর। এজন্যই সবসময়ের প্রার্থনা ছিল তার, যদি কেউ জীবনে আসে, পরিপূর্ণ বন্ধুরূপে আসুক। বিশ্বস্ত ও ভরসার মানুষ হয়ে আসুক। তবেই সে কাউকে নিজের সাথে জড়াবে, ভালোবাসবে। এরকম মানুষ হয়তো জীবনে চাওয়া, কাল্পনিক গল্পের মতোই। তবুও সে চাইত, কেউ এলে, এমন করেই আসুক। প্রকৃত বন্ধুর বেশে। যার মাঝে শান্তি, নিরাপত্তা, সুখ, ভরসা সবকিছুই পাবে। জীবন নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না, আকাশছোঁয়া কোনো স্বপ্নও ছিল না। ছিল, দিনশেষে সুখ-সাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাবার মতো নিজস্ব কিছু সুপ্ত সুন্দর ও গোপন চাওয়া। এই চাওয়াগুলো পূরণ হবে না জেনেও দু’হাত তুলে রবের নিকট চাওয়াগুলো পেশ করত রোজ। যদি কোনোদিন পূরণ হয়, যদি কোনোদিন কেউ আসে, এমনিভাবে তাকে সম্পূর্ণ তার মতো করে বুঝে ভালোবেসে ঘর সাজায়, তাহলে হয়তো তার চাওয়াগুলো স্বার্থকতার মুখ দেখত। নিজেকে সুখী মানুষের একজন মনে হতো। কিন্তু না, এই নীরব চাওয়া, এভাবেই নীরব থেকে যাবে। কোনোদিন স্বার্থকতার মুখ দেখবে না। এসব সে জানে, বুঝে বলেই ভালোবাসা নামক সুন্দর ও সুখময় অনুভূতিটাকে মনে ঠাঁই দিতে চায় না। এই অনুভূতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেও চায় না। অথচ ক’দিন ধরে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, কাজ, আড্ডা, সবকিছুই যেন রঙহীন, প্রাণহীন। কোনোকিছুতেই আগের মতো ভালো লাগা নেই, টান নেই, সুখ নেই। যখনই স্থির হয়ে কোনোকিছু ভাবতে চায়, তার সব ভাবনারা থমকে যায় ফারশাদ মুনতাসীর নামটা স্মরণ হলেই। যখনই কোনো কাজে ডুব দেয়, সেখানেও মনের অলিগলিতে ঘুরপাক খায় একটাই নাম, একটাই অবয়ব। কখনও কখনও স্থির দৃশ্যের মতো চিঠির প্রত্যেকটা শব্দ ভেসে উঠে চোখের সামনে। শব্দেরা ভীড় জমায় কর্ণকুহরে। প্রতিটা শব্দের ঝনঝনানি তাৎক্ষণিকভাবে সোজা মনে-মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। না চাইতেও সময়ে-অসময়ে কোনো না কোনোভাবে, ফারশাদ নামটা স্মরণে আসবেই। এই মানুষটাকে ভুলে থাকা, প্রতিমুহূর্তে মানুষটার জন্য কেঁদেও তাকে ঘৃণা করে বাঁচার চেষ্টার মতো গভীর যন্ত্রণা আর কীসে হয়, উজমা সেটা জানে না। এত চেষ্টায়ও একটা মানুষকে সে ভুলতে পারছে না, যত ভুলতে চায়, ততই মনে করে কেঁদে গাল ভাসায়, মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা ও হৃদয়ছোঁয়া চিঠির কিছু শব্দ, বাক্য ও প্রকাশভঙ্গি মনে করে প্রতিনিয়ত বিবেকের কারাগারে দংশিত হয়। একটা মানুষ তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে, খুব করে নিজের জন্য চায়, এসব জেনেও নিজেকে শক্ত খোলসের আবরণে বন্দী করে রাখতে গিয়ে দিনরাত যে মনোঃকষ্টে সে ছটফট করছে তার থেকে মুক্তির উপায় ঠিক কোথায় গেলে মিলবে এ-ও জানা নেই উজমার। তার সব মনোঃকষ্ট, তার সব কান্না, মনের অশান্তি ও কাজের বিঘ্নতা, এই সবকিছুই যে হচ্ছে ওই একটা নামে, ওই একটা মানুষের এতবেশি ভালোবাসার কারণে, সেটা বুঝতে গিয়েই নিজেকে তার আরও বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। নিজের ওপর বিরক্ত ও রাগ হচ্ছে। কোনোভাবেই কেন মুছে ফেলা যাচ্ছে না, সেটাও ভেবে পাচ্ছে না উজমা। মন তার সাথে বেঈমানী করছে, এটাও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

বাড়িতে এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠান, চারিদিকে এত মেহমানদের ভীড়, এত আনন্দ, এসব কিছুই তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না আজ। সারাক্ষণ একটা মন খারাপ ভাব থেকে যাচ্ছে মনে। চেহারার মাঝেও সেই ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বন্ধুবান্ধব সবাই এসেছে। কারও সাথেই ঠিকমতো কথা বলছে না উজমা, হাসছে না। যতক্ষণ সামনে থাকছে, একটু-আধটু কথা বললেও সেটুকুও যেন অনিচ্ছায়, জোরপূর্বক করছে বলে নিজের মনেই চাপা অভিমান জন্ম নিচ্ছে। মেহমানদের অযত্ন ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সুক্ষ্ম অবহেলা আঁচ করতে পেরে চোখ ভিজে এলো উজমার। সবাইকে আপ্যায়নের ব্যস্ততা করে দিয়ে চুপটি করে নিজের রুমে এসে বসে রইল। নীরব কান্নায় কতক্ষণ নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল সবে, এরমধ্যেই দরজার কাছ থেকে মাইসারা আওয়াজ তুলল,

-‘তোর কী হয়েছে?’

উজমা শব্দ করল না। মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে আবারও নীরব হয়ে রইল। রাইদাহ ও মাইসারা দু’জনে ভেতরে প্রবেশ করে পর্দা টেনে দিল। কাছে এসে রাইদাহ বলল,

-‘মন খারাপ কেন?’

সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিলেও এই দুই মানবীর কাছ থেকে নিজেকে লুকানো বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কোনোমতে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

-‘মন খারাপ হতে যাবে কেন? আমি তো এমনিই বিশ্রাম নিতে এসেছি।’

-‘আমরা সবাই এসেছি আর তুই বিশ্রাম নিচ্ছিস, এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? আমাদের কি চোখ নেই? আমরা বুঝি না? না-কি আমাদের বোকা ভাবিস, তুই?’

-‘তুই খামোখা রাগ করছিস, রাইদাহ। এসব কিছুই না। একটু মাথাব্যথা হচ্ছে আর কিছু না।’

-‘এরকম হাজারও মাথাব্যথা নিয়ে আমরা অনেক ট্যুর দিয়েছি, অনেক কনসার্ট, দায়িত্ব-কর্তব্য উপভোগ করেছি। কিন্তু কখনও নিজেকে একা করে, মুখ লুকিয়ে কাঁদিনি। এটা বোধহয় এবারই প্রথম হচ্ছে, তাই না সারা? কেউ নিজেকে লুকোতেই এখানে এসে ঘাপটি মেরেছে!’

মুখ টিপে হেসে মাথা নাড়ল মাইসারা। আলগোছে উজমার পাশে বসলো। প্রাণের সখীর মন খারাপ কেন, কেন তার চোখে পানি এটা জানতেই বলল,

-‘তুই হচ্ছিস একটা পাথর মানবী। হাজারও ঝড়তুফানেও যে শক্ত থাকতে জানে, তাকে অকারণ কাঁদতে দেখে কেমন জানি একটা সন্দেহ হচ্ছেরে উজমা। বাই এ্যানি চান্স, তুই কি কোনোকিছু লুকোচ্ছিস আমাদের কাছে? কোনো সিক্রেট কথা, কষ্ট কিংবা কোনো মন খারাপের গল্প?’

ম্লানমুখে বিছানা ছাড়ল উজমা। বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ফারশাদের চিঠিটা বান্ধবীদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি, ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছি, নিজের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনোভাবে সফল হচ্ছি না। যখনই এটা দূরে সরাতে চাইছি, মনে হচ্ছে কিছু একটার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে আমার।’

দুই হতবাক রমণী চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করল। একটু একটু করে তাদের চেহারার ভাবভঙ্গি পালটে গেল। বিস্ময় দৃষ্টির সাথে পুরো চিঠি শেষ করল দু’জনে। পুরো চিঠির পিছনের গল্প জানতে চাইলে উজমা সব কথা পরিষ্কার করে বলল। সব শোনে মাইসারা বলল,

-‘তোর সিদ্ধান্ত ঠিক কী? কী চাস তুই?’

-‘জানি না।’

-‘এরকম চিঠি, অনুভূতি তুলে ধরার ধরণ, প্রকাশভঙ্গি, এগুলো অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও সফল হওয়া যায় না। আমরা প্রত্যেকেই মানুষ আর আমাদের একেকজনের বোঝা ও প্রকাশ করার ধরণটা আলাদা। তবে এটা সত্যি যে, একটা মানুষ কাউকে মন থেকে চাইলে, তাকে পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে, সব উপায় হারিয়ে ফেললে, তার ভেতর ফেটে কান্না আসে। চোখের পানিটা না, জোর করে আসে না। ওটা ভেতর ফাটা আর্তনাদ থেকেই আসে।’

কথা খুঁজে পেল না উজমা। নীরবে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিল। রাইদাহ বলল,
-‘তুই কি তাকে ভালোবাসিস?’

-‘না…।’

-‘সত্যি তো?’

-‘হুম…।’

-‘তাহলে এই চিঠিটা কেন রেখেছিস? ছুঁড়ে ফেললেই পারতি।’

-‘বললাম তো, পারছি না।’

-‘কেন পারছিস না?’

-‘কষ্ট হয়।’

-‘কেন? যাকে তুই ভালোবাসিস না, তার চিঠি ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে কষ্ট কেন হবে?’

-‘ছিঁড়ে ফেললে বা পুড়িয়ে ফেললে এটার অমর্যাদা হতে পারে।’

-‘চিঠি পুড়িয়ে ফেললে অমর্যাদা হবে এটা বুঝলি আর কারও অনুভূতি প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ফিরিয়ে দেয়ার মতো দুঃসাহস দেখানোটা কি তার অনুভূতির প্রতি অমর্যাদা নয়?’

-‘এত কথা আমি জানি না, রাইদাহ। আমি শুধু এই অসহ্যকর মুহূর্ত থেকে মুক্তি চাইছি। প্লিজ, একটা উপায় থাকলে বল। আমার কোনো কাজে মন বসে না। কোনোকিছু স্থির হয়ে ভাবতে পারি না। নিজেকে নিয়ে আমি আসলে চরম হতাশ।’

-‘এসব থেকে মুক্তির প্রথম ও প্রধান উপায় হচ্ছে, সব স্মৃতি মুছে ফেলা। চিঠি, জ্যাকেট, আংটি, এগুলো দূরে ছুঁড়ে ফেললেই তুই মুক্তি পাবি, নিশ্চিত।’

নিরুত্তর উজমা কোনো কথা বলল না। মাইসারা ছুটে গিয়ে দিয়াশলাই নিয়ে ফিরে এলো। রাইদাহ সবকিছু একত্রে করল। বলল,

-‘এবার এগুলো পুড়িয়ে ফেলি, দেখবি রিল্যাক্স লাগছে।’

বলতে দেরী অথচ জিনিসগুলো ছু মেরে নিজের দিকে টেনে নিতে দেরী করল না উজমা। একটানে সবকিছু তুলে বিছানার ওপর রেখে বান্ধবীদের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘খবরদার, এসবে হাত দিবি না।’

-‘আশ্চর্য! তুই না মুক্তি চাইলি? তোকে তো মুক্তি দিচ্ছিলাম। এগুলো পুড়িয়ে ফেললেই মুক্তি পাবি। বিশ্বাস কর।’

-‘দরকার নেই, এগুলো পুড়ানোর। যা তোরা।’

দুই রমণী শান্ত হয়ে উজমাকে নিয়ে বিছানায় বসলো। হাতে হাত ধরে ধীরস্বরে রাইদাহ জিজ্ঞেস করল,
-‘কেন অস্বীকার করছিস?’

উজমা ফের বোবা হয়ে গেল। মাইসারা বলল,
-‘এগুলো পোড়াতে গিয়ে যদি এত কষ্ট হয়, তাহলে ভাব ওই মানুষটা সম্পূর্ণরূপে যখন তোর জীবন থেকে দূরে সরে যাবে, তখন কেমন কষ্ট হবে! এখনও সময় আছে, নিজেকে নিয়ে একটু ভাব।’

-‘আমার কষ্ট হবে না। আমি হয়তো এই জিনিসগুলোর মায়ায় পড়ে গিয়েছি।’

-‘হয়তো নয়, সত্যিই তুই মায়ায় পড়েছিস। সেটা শুধু এই জিনিসগুলোরই নয়, ওই মানুষটারও। তুই কখনও কাউকে ভালোবাসতে পারিস না, কাউকে ভালোবাসবি না, কারও প্রতি দুর্বল হবি না, এসব বলে নিজেকে তুই যতই বুঝানোর চেষ্টা করিস না কেন, আসলে তুই ব্যর্থ। তুই অলরেডি এই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। আর তা খুব তীব্রভাবে। যেটা এখন চাইলেও অস্বীকার করতে পারবি না। তাকে ফিরিয়ে দিয়ে তুই কষ্ট পাচ্ছিস না, তুই কষ্ট পাচ্ছিস তাকে হারিয়ে ফেলেছিস বলে। কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু যদি জীবনে আসে, তাকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে ফেলার মতো বোকামি আর দ্বিতীয়টা হয় নারে বোকা। অথচ তুই এটাই করেছিস। এটা করে তুই শুধু তাকে কষ্ট দিসনি, নিজেকেও ফাঁকি দিয়েছিস। অথচ তুই জানিস, এরকম একটা মানুষ, একটা বিশ্বস্ত সঙ্গী, তুই-আমি, আমরা সবাই-ই চাই। জেনে-বুঝে এই কাজটা কেন করলি তুই? কেন নিজের মনকে কষ্ট দিলি?’

দু’হাতে সমস্ত স্মৃতি বুকে আগলে নিয়ে শব্দহীন কান্নায় বিভোর হয়ে রইল উজমা। আলতো হাতে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাইসারা বলল,

-‘তুই তো আমার মতো এত বোকা নোস। সবই তো জানিস, বুঝিস। একটা সময় আমি যখন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম, হারিয়ে ফেলে কী পরিমাণ কষ্টে একেকটা মুহূর্ত কাটিয়েছি, কত অপেক্ষা, কত নির্ঘুম রাতের কান্নার পর যখন উপলব্ধি করলাম, আমার মন কী চায়। আমি কী চাই। তখন তোরাই তো বলতি, অনিকের চেয়ে কেউ আমাকে ভালো বুঝে না। যে মানুষটা স্বেচ্ছায়, নিজ দায়িত্বে তোকে বুঝে নিতে চাইল, তাকে তুই ফিরিয়ে দিলি, তা-ও এইভাবে! কেন উজমা? কেন এই বোকামিটা করলি তুই? জেনে-বুঝে একটা মানুষকে কষ্ট দিয়েছিস, এখন নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, এতে লাভ কী হচ্ছে? এভাবে কি জীবন চলে? বাঁচার জন্য একটা অপশন তো দরকার না-কি? সবকিছু যদি এভাবে হেলায়-ফেলায় হারিয়ে ফেলিস, তাহলে বাঁচবিটা কী নিয়ে? কেমন করে?’

চোখমুখ মুছে সহজ হলো উজমা। একটু রিল্যাক্স হতে এক গ্লাস পানি খেল। এরপর হাত-পা, পেট, পিঠ, গলা, এভাবে শরীরে প্রত্যেকটা অংশে যে ছোটো ছোটো দাগগুলো ছিল, সেগুলো দেখিয়ে বলল,

-‘তোরা জানতে চাইতি না, এই দাগগুলো কীসের? কীভাবে হলো?’

-‘হ্যাঁ, চাইতাম। তুই-ই তো বলেছিস, এগুলো একটা অ্যাক্সিডেন্টের দাগ।’

-‘হ্যাঁ, এগুলো অ্যাক্সিডেন্টের দাগ। কিন্তু ওই অ্যাক্সিডেন্টটা কোনো যানবাহনের সাথে ধাক্কা লেগে হয়নি, কিংবা রাস্তাঘাটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে হয়নি।’

-‘তাহলে?’

-‘এগুলো একজন নারীর সমস্ত রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা আর অত্যাচারের চিহ্ন। যে আমার শৈশবটা ধ্বংস করে দিয়েছে। দু’দুটো দিন আমাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে ধারালো ব্লেড দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। শক্ত দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত করেছে আমার সারা শরীর। হাতের শিরাটা পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল। মরতে মরতে বেঁচে থাকা কাকে বলে, সেটা খুব ছোটোবেলাতেই আয়ত্তে আনতে শিখে গিয়েছিলাম। যে নারীর সাথে আমার এই জঘন্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তার সন্তানের সাথে নিজেকে কী করে জড়াব আমি?’

দুই রমণী ভীষণ চমকে তাকাল। একটা মানুষের মনের ভেতর যে এত দুঃখ-কষ্ট লুকানো, সেটা নিজেরা এত বিশ্বস্ত হয়েও জানতে পারল না দেখে আফসোস হলো, কষ্ট হলো, অনুশোচনা হলো, বন্ধুটাকে ভালোমতো বোঝার চেষ্টাই করেনি কেউ। সবসময়ই যাকে পাশে পেয়েছে, তার ভেতরের কষ্ট জেনে নিজেদেরকে খুব দুর্ভাগা মনে হচ্ছে তাদের। সব শোনে, বুঝে রাইদাহ বলল,

-‘কে, কখন, কাকে ভালোবাসবে এসব কি আগে থেকেই বোঝা যায়? মানুষ অনুভূতিশীল প্রাণী। যেকোনো সময়, যে কাউকে ভালো লাগতেই পারে। এতে তো দোষের কিছু নেই। একজনের জন্য আরেকজনের ওপর অন্যায় করবি কেন তুই?’

-‘আমি জানি, ফারশাদ নির্দোষ। কিন্তু তবুও…। এটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমি পারব না তাকে নিজের সাথে জড়াতে। আর এসব ভাবতে গেলেই আমার নিজের ওপর রাগ হয় আরও। ভালোবাসার জন্য সে আর মানুষ পেল না? আমাকেই কেন? আমার চেয়ে কত সুন্দরী তার আশেপাশে ঘুরে! তাদের দিকে ফিরে তাকাতে পারল না? অসভ্য, খারাপ, বেয়াদব ছেলে একটা। দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তার মন কেন আমার মাঝেই ডুবতে গেল?’

-‘আচ্ছা বোকা তো তুই? ভালোবাসা কি শুধু চেহারা, নাম ও বংশের ব্যাপার না-কি? এই অনুভূতিটা সম্পূর্ণ মনের দাবী, মন থেকে আসে। কে, কার, কী, এসব হিসেব করে ভালোবাসা হয় না। তুই একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়ে এরকম বোকামি করলি। তোকে তো এখন আমার পিটাতে ইচ্ছে করছে।’

নিরুপায় কণ্ঠে উজমা বলল,
-‘প্লিজ, একটা উপায় বল। এসব আর নেয়া যাচ্ছে না। আমার সত্যিই অসহ্য লাগছে।’

দুই বান্ধবী একসাথে বলল,
-‘উপায় একটাই, তার ভালোবাসাকে গ্রহণ করে নেয়া।’

-‘অসম্ভব।’

উজমার ঘাড়ত্যাড়ামি শোনে মাইসারা বলল,
-‘অস্বীকার করতে পারবি, তুই তাকে ভালোবাসিস না?’

ড্রয়িংরুম থেকে উসাইদের গলা ভেসে এলে উজমা ছুটে যেতে চাইল। দু’জনেই তাকে আটকে ফেলল। সবকিছু রেখে দু’জনের হাত ছাড়িয়ে উজমা শক্ত কণ্ঠে বলল,

-‘আমি তাকে ভালোবাসি না।’

স্বীকারোক্তি দিয়ে একছুটে ড্রয়িংরুমে এসে ফারিশা, তানজীম, ছোট্ট তাম্মি ও আরও একজন অচেনা পুরুষকে দেখে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাম্মিকে নিজের কোলে এনে গালে আদর দিয়ে বলল,

-‘কেমন আছো, তুমি?’

-‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’

-‘খুব ভালো। তোমাকে পেয়ে আরও ভালো লাগছে।’

ঘরভর্তি মেহমান। সবাইকে বসার জায়গা দিয়ে সামান্য দই-মিষ্টি এগিয়ে দিল উজমা। উসাইদ তো ফারিশাকে এখানে পেয়ে খুশিতে আটখানা। তার ফারিশাবু, আজ তার বাড়িতে। চোখেমুখে এত আনন্দ দেখা যাচ্ছে। কী দিয়ে খাতিরযত্ন করবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে ছুটছে, ওদিকে ছুটছে। তার এই ছোটাছুটি দেখে ফারিশার স্বামী বলল,

-‘আপনি এত ব্যস্ত হবেন না, ভাই। একটু বসুন। কথাটথা বলি। রিশা সবসময় ওয়াহিদা আন্টির কথা, আপনার কথা বলত। শোনে শোনে এত অভ্যস্ত আমি আপনাকে দেখার ভীষণ আগ্রহ বোধ করতাম। কিন্তু আমার সময় হয় না। গতকাল তাম্মির ওই দুর্ঘটনার পর জানাল, সে না-কি চেনা-পরিচিত কার কার খোঁজ পেয়েছে। ওকে এত খুশি দেখাচ্ছিল!’

উসাইদ ব্যস্ততা থামিয়ে আলাপ-আলোচনায় মনোযোগ দিল। প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষে বলল,
-‘শাদ তো জানিয়েছিল, তাহমীদ নামের কেউ একজন…।’

কথা শেষ করার আগেই হো হো শব্দে হেসে ফেলল মেসবাহ। বলল,
-‘তাহমীদ আমারই ডাকলাম। ক্যাম্পাসে সবাই আমাকে এই নামেই ডাকত। তবে আইডেন্টিটির নামটা আলাদা।’

-‘ও তো থানায় গিয়ে আপনার খোঁজ করছিল।’

-‘আইডেন্টিটি ছাড়া ওই নামে আমাকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ ছিল না বলেই হয়তো পায়নি।’

-‘আপনারা যোগাযোগ কেন রাখেননি?’

-‘সেটা অন্যসময় আপনার ফারিশাবুর কাছেই শোনে নিবেন। আজ এতকিছু বলার মতো পরিস্থিতি…।’

উসাইদ চারপাশ খেয়াল করে লজ্জিত হেসে বলল,
-‘ওহ, ইয়েস! স্যরি। আমারই ভুল। কিছু মনে করবেন না, ভাইয়া।’

-‘ইট’স ওকে ব্রো। আমি কিছু মনে করিনি।’

-‘আজকের এই দৃশ্যটা শাদকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ও তো এখন অনেক ব্যস্ত।’

-‘ফ্রি হোক, দেখা হবে। কথাও হবে।’

আড্ডা ও খুঁনসুটির ফাঁকে উজমা এবার চা নিয়ে এলো। একে একে সবার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলে তানজীম চারপাশে তাকিয়ে বলল,

-‘ট্রিট তো আমি দিতে চেয়েছিলাম। আপনি দিচ্ছেন যে।’

-‘আমি ট্রিট দিচ্ছি না। অতিথি আপ্যায়ন করছি।’

তানজীম শুধু হাসলো। বলল,
-‘বেবির নাম কি রেখেছেন?’

-‘মাশিয়াত ইবনাত।’

-‘মাশা’আল্লাহ। সুন্দর নাম।’

আরও যারা এসেছিল, তাদেরকেও ঠিকঠাকমতো আগে চা-নাশতা দিল উজমা। খাবার-দাবারের আয়োজন আরও পরে হবে। এজন্য সবারই অবস্থান ড্রয়িংরুমে। গল্প, আড্ডা ও হাসিখুশির ফাঁকে সময় কেটে যাচ্ছিল। সবার নাশতাপানি খাওয়া শেষ হলে ঊষা এসে টি-টেবিল ফাঁকা করে সবকিছু ট্রে-তে নিয়ে যেতে চাইছিল। উজমা তখন রান্নাঘরে রান্না সামলাতে ব্যস্ত। ঊষা হয়তো খেয়াল করেনি, সে ট্রে নিয়ে আসতে গিয়ে কারও পায়ের সাথে হোঁচট খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে সম্পূর্ণ ট্রে হাত থেকে ছেড়ে দিল। একটা বিরক্তি ও বিব্রতকর আওয়াজ শোনে দেখল, তার হাত থেকে ফস্কে যাওয়া ট্রেতে থাকা যা কিছু অবশিষ্ট খাবার ছিল, সবকিছু পড়ে গেল ফারিশার দেবর তানজীমের ওপর। সে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে রাগী চোখে ঊষার দিকে তাকালেই একটা ভয়মিশ্রিত পানসে মুখ দেখে কিছু বলতেও ভুলে গেল। ঊষা কোনোমতে ভেঙে যাওয়া কাঁচের টুকরো তুলে নীচুস্বরে বলল,

-‘অ্যাম রিয়্যালি স্যরি।’

অর্ধভেজা পোশাক নিয়ে বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচতে ওয়াশরুমের খুঁজে দরজার কাছাকাছি এসে এদিক-ওদিক হেঁটে নিজের রাগ ও মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করছিল তানজীম। দাওয়াতে এসে এরকম অবস্থায় পড়ে তার মেজাজের দফারফা ঘটে গেছে। এই সিচুয়েশন হবে জানলে এখানে আসত না। সে খুঁজতে খুঁজতেও ওয়াশরুম কোনোদিকে সেটা বুঝতে না পেরেই পায়চারী বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঠিক তখুনি ঊষাকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখে বলল,

-‘ওয়াশরুমটা কোনদিকে?’

মেহমানদের জন্য ওয়াশরুম আলাদা। এটা দুই রুমের মাঝখানে যে ছোট্ট প্যাসেজ আছে, তার মধ্যবর্তী স্থানেই। মূলত ড্রয়িংরুম ত্যাগ না করলে এটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তানজীমের কথা শোনে ওয়াশরুমটা হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল ঊষা। তানজীম সেদিকেই গেল। যাওয়ার আগে চোখ কটমট করে তাকাতে ভুলল না।

সবাই নামকরণের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিল। অন্য কোনোদিকে কারও খেয়াল ছিল না। আনন্দঘন এইমুহূর্ত থেকে দূরে ছিল শুধু ফারশাদ। প্রাকটিস শেষ করে সবেই ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে সামান্য কোল্ড ড্রিংক হাতে নিয়ে সোফায় বসে টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি দিয়ে রেখেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ব্রেকিং নিউজের দিকে চোখ পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত কল দিল মায়ের নম্বরে। বলল,

-‘মা, নিউজে এটা কী দেখাচ্ছে?’

ওপাশ থেকে থমথমে গলায় মুনমুন হক্ব বললেন,
-‘ঠিকই দেখেছ। আধঘণ্টা আগেই তোমার বাবা মারা গেছেন। যদিও মিডিয়াকে শুধু মৃত্যুর খবর জানিয়েছি, সুইসাইডের কথা চেপে গেছি। এই বয়সে এসে তোমার বাবা আমাকে এমন অপদস্ত করবেন জানলে, অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে যেতাম।’

ফারশাদ যেন আরও অবাক হলো। একেই তো মৃত্যুর সংবাদ তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তারমধ্যে সুইসাইড। সে অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
-‘কী বলছ, মা? বাবা কেন সুইসাইড করবে?’

-‘পারলে এসো, এসে দেখে যাও। শোনে যাও সবকিছু।’

-‘আগামীকাল ম্যাচ শুরু হবে মা। এইমুহূর্তে, আচ্ছা তুমি জানাযার টাইমটা এখুনি জানিও না। আমি নেক্সট ফ্লাইটে আসছি।’

বাবা শব্দের সাথে যত আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়েছিল, একটু একটু করে সব আবেগ, ভালোবাসা ধূসর বর্ণ ধারণ করল। এইভাবে বাবা তাকে ফাঁকি দিতে পারলেন? কিছু বলার সুযোগ কেন দিলেন না? কেন এত অভিমানী হয়ে এই বয়সে এসে আত্মহত্যা করলেন? বুক ছিঁড়ে যাওয়া এক অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ক্রিকেট টিমের কোচকে নিজের বাবার মৃত্যুর সংবাদ জানাল ফারশাদ। এরপর ছুটে গেল ফাবিহার কাছে। সময় নষ্ট করলে চলবে না। যেভাবেই হোক, নেক্সট ফ্লাইটেই তাকে বাংলাদেশ ব্যাক করতে হবে।

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – চব্বিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

নামকরণের অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্য থেকে সবাই-ই চলে গিয়েছেন প্রায়। আছে কেবল বন্ধুবান্ধবরা, শামীম, মামা-মামী। শামীমের আজকের উপস্থিতি কেউ আশা করেনি, তবুও এই আয়োজনে তাকে দেখে অবাক হয়েছে উজমা। অন্য সবাইকে আপ্যায়ন করাতে ব্যস্ত ছিল বলে, শামীমকে সে পাত্তাই দেয়নি। একপ্রকার এড়িয়েই গিয়েছে। এত এড়িয়ে চলার পরও শামীমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও অসহ্যকর হাসি থেকে মুক্তি পায়নি। যখনই সামনে দেখে, দাঁত কেলিয়ে হাসে। এই হাসির অর্থটাই উজমা বুঝতে পারে না। মানুষ এত নির্লজ্জ হয় কী করে? সবাইকে বিদায় দিলেও বন্ধুবান্ধবরা যেহেতু রয়েই গেছে, ওদেরকে নিয়ে সন্ধ্যায় একটা জম্পেশ আড্ডার আয়োজন করেছে উজমা। সবাই মিলে একটা ফাঁকা জায়গায় গোল হয়ে বসে বালিশ বদল খেলছিল। হৈচৈ, আনন্দ ও খেলাধুলায় ব্যস্ত সবাই শামীমকে সেই স্থানে উপস্থিত দেখে একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। অনিক বলল,

-‘কিছু বলবেন, ভাইয়া?’

শামীম আমতা-আমতা স্বরে বলল,
-‘আমি একটু উজমার সাথে কথা বলতাম।’

-‘স্যরি, আমরা তো ওকে ছাড়তে পারব না। এ্যাই, তুই যাবি?’

আলগোছে চোখ মেরে উজমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল অনিক। রাইদাহ ও মাইসারা মুখ লুকিয়ে হাসলো। নিশাত টুপ করে উজমার হাত চেপে ধরে কিছু একটা ফিসফিসিয়ে বলে ফেলল। উজমা কোনোদিকে না তাকিয়ে খেলায় মনোযোগ রেখে বলল,

-‘দেখছোই তো খেলছি। এখন আবার কথা কীসের? তোমাকে তো একদিন নিষেধ করেছি, আমার সামনে আর এসো না। তবুও এসেছ? কেন? এত অপমানিত করেও শান্তি পাওনি? আর কী ক্ষতি চাও তুমি আমার?’

-‘দেখ, যা কিছু হয়েছে তার জন্য স্যরি। আমি এতবার করে ক্ষমা চাইছি, তাতেও তোর হচ্ছে না? আর কীভাবে বললে তুই আমার প্রস্তাবে রাজি হবি?’

-‘দুঃখিত, তুমি যদি রাজা-মহারাজাও হয়ে যাও, তবুও এই আমাকে রাজি করাতে পারবে না। জানোই তো আমার রাগ। এভাবে যদি বিরক্ত কোরো, আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব। তুমি আমার কাজিন। একই বংশের রক্ত আমাদের শরীরে। এই কারণে তোমাকে যথেষ্ট সহজ-সাবলীলভাবে বোঝাচ্ছি। এতেও যদি তুমি নীরব না হও, আমি আরও কঠিন হয়ে যাব।’

-‘তুই আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা করবি না?’

-‘সেই সুযোগ তুমি নিজেই হারিয়েছ। এখন হাত-পা ধরলেও কাজ হবে না।’

-‘আমি যদি রেগে যাই, ফলটা কিন্তু ভালো হবে না।’

-‘রেগে গিয়ে কী করবে তুমি? গায়ে হাত তুলবে? রক্তাক্ত করবে? মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে? এইতো! এরচেয়ে বেশি আর কী করবে? আর কিছু করার সাহস তোমার নেই। তুমি একটা কাপুরষ। যে শুধু নিজের শক্তি দেখাতে গিয়ে সাধারণ মানুষগুলোর ওপর অবিচার করতে জানে। চুপ থাকি তারমানে এই ভেবো না, আমি দুর্বল।’

শামীম হার মেনে নিল। বোঝানোর আর কোনো পথই পেল না। ভালোবাসার মানুষকে এত সহজে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে, এটাও ঠিক মেনে নিতে পারছে না। তার একটা ভুল, সব তছনছ করে দিল। কী হতো, ওই ভুলটা না করলে? উজমা তার হয়ে যেত নিশ্চয়ই! আফসোস হলো তার। শেষবারের মতো বলল,

-‘তুই কি চাস আমি তোকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করি?’

-‘আশ্চর্য! মেয়ের কি অভাব না-কি! বিয়ে তুমি করতেই পারো। তাতে আমার কী? আমি তো তোমার প্রতি দুর্বল নই। তাহলে? এখানে আমার চাওয়া না চাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?’

-‘পরে আফসোস করবি না তো?’

-‘আমাকে এতটাও কাঙাল ভেবো না। তুমি যে-ই হও, তোমার যা কিছু থাকুক, তবুও তোমার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কারণ একটাই, দু’মুখো মানুষ আমার দু’চোখের বিষ। ক্ষণে ক্ষণে প্রতিমুহূর্তে যারা নিজেদের একেকটা রূপ প্রকাশ করে, আশেপাশের সবাইকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়, তাদেরকে জীবনে স্বাগত না জানিয়ে বিতাড়িত করে দেওয়াই উত্তম। তোমার মতো একটা গিরগিটিকে যদি আমি আমার জীবনে প্রবেশ করাই, তবে আমার অস্তিত্ব যতটুকু আছে, সেটুকুও বিলীন হয়ে যাবে। জেনে-বুঝে আমি কোনো গিরগিটিকে আমার জীবনে প্রবেশ করার অধিকার দেব না। নিজেকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তুমি যেতে পারো। একটা কেন, ধর্মীয় নিয়ম মেনে চারটে বিয়েও করতে পারো, তাতে আমার কোনো লাভ-ক্ষতি নেই।’

-‘ওকে, তাহলে তা-ই হোক।’

শামীম বিদায় নেয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল উজমা। বন্ধুরা সবাই ওকে বাহ্বা দিল। তাক্বদীম বলল,
-‘তোরা কেন ওকে ঘরে ঢুকতে দিস, বুঝি না। আমি হলে ওর মতো মানুষকে আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও ঢুকতে দিতাম না।’

উজমা জবাব দিল,
-‘এগুলো বলা সহজ, করা কঠিন। শত হলেও চাচাতো ভাই। খারাপ ব্যবহার চাইলেও করা যায় না। তাছাড়া আমি ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। এত দাঙ্গাহাঙ্গামা আমার ভালো লাগে না। এজন্য যত্রতত্র মেজাজও দেখাতে পারি না।’

-‘হয়েছে, আর মেজাজ দেখাতে হবে না। এবার আমাদের বিদায় দে। রাত বাড়ছে।’

তাক্বদীমের কথায় সকলেই ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিল। আসলেই তাই। রাত এখন আটটারও বেশি। আর দেরী করলে সবারই বাড়ি পৌঁছাতে গভীর রাত হয়ে যাবে। যদিও দূরত্ব বেশি নয়, তবুও তাড়াতাড়ি বিদায় নেয়া ভালো। সবাই যে যার মতো উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিল। ছোট্ট মাশিয়াতকে কোলে নিয়ে শেষবেলা একটু আদর দিল নিশাত। আদুরে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দিতে গিয়ে চোখের কোণ ভরে উঠল। এই ছোটো ছোটো হাত, ছোটো ছোটো পা, এমন আস্তো একটা ছোট্ট জীবন্ত পুতুল তো তারও অভ্যন্তরে লুকিয়েছিল একদিন। যে কি-না খুব অভিমানে তাকে ফাঁকি দিয়েছে। কোলে আসার আগেই, পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই মৃত্যুকে আপন করে নিয়েছিল। বুকের ভেতর কষ্টেরা মিছিল শুরু করলে নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়ল। খুব করে বাচ্চাটাকে বুকে আগলে ধরে আদর দিল। তাক্বদীম সবটাই খেয়াল করল। তার চেহারাও মলিন হয়ে গেল নিমিষেই। সে শুধু অস্ফুটস্বরে ডাকল,

-‘নাওয়ার, দেরী হচ্ছে।’

ঝটপট পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিল নিশাত। মাথা নেড়ে ‘আসছি’ ইশারা করল। সাবধানে তাকে নিজের কোল থেকে মিশকাতের কোলে দিয়ে নিজের গলায় ঝুলে থাকা দামী একটা স্বর্ণের চেইন মাশিয়াতের গলায় আটকে দিল। মনে মনে প্রার্থনা করল,

-‘দীর্ঘজিবী হও, মা। আমার মতো আর কোনো মায়ের কোল খালি না হোক, মাবুদ। তুমি সহায় হও।’

সবাই একসাথে এক গাড়িতে উঠলেও চারজনকে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দিল তাক্বদীম। মন খারাপের এই ক্ষণে বাইরের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে রাখল নিশাত। এখনও ভেতরটা হালকা হচ্ছে না। কী ভুল করল জীবনে! একটা ভুল তার গোটা মাতৃত্বকে নষ্ট করে দিল। আস্তেধীরে ড্রাইভ সামলে তাক্বদীম বলল,

-‘সারাক্ষণ যদি এভাবে মন খারাপ করে থাকো, তাহলে তোমাকে সামলানো অসম্ভব হয়ে যাবে। এখানে এসেছিলাম তোমার মুখে খুশি দেখার জন্য, অথচ বিপরীত কিছু ঘটে গেল।’

মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে গেল নিশাত। দৃষ্টি ফেরালো স্বামীর দিকে। হাত বাড়িয়ে এক হাতের বাহু চেপে কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-‘মেয়ে হলে বুঝতেন, একটা মেয়ের জন্য এই মুহূর্তটা কতটা যন্ত্রণার।’

-‘আমি তোমাকে বুঝি না, বলছ?’

তাক্বদীমের চোখ নাচিয়ে বলার ধরণে হেসে ফেলল নিশাত। হাতে একটা চিমটি কেটে বলল,
-‘আমরা কিন্তু চাইলেই বেবি নিতে পারি।’

-‘হুম, পারি। কিন্তু তোমার ঝুঁকি আছে।’

-‘ভালো একজন গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ মেনে চললে ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে।’

-‘আমি আসলে রিস্ক নিতে চাইছি না। তুমি সুস্থ থাকো, এটাই আমার জন্য বিরাট পাওয়া।’

-‘তাইবলে বেবি নিব না?’

-‘আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি। আগে সব জটিলতা কাটিয়ে উঠো, তারপর বেবি।’

-‘দূর, মুডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।’

-‘তাহলে চলো, লং ড্রাইভে যাই। মুড ঠিক হয়ে যাবে।’

চোখ বন্ধ করে কিছু সুখকর ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখল নিশাত। ভাগ্যিস দেশে ফিরেছিল, তাক্বদীম জড়িয়েছিল জীবনে, নয়তো কী হতো! একটা মরিচীকার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবনটাই শেষ হয়ে যেত। আত্মহত্যাই হতো সবশেষ সমাধান। এই মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার। কীভাবে বুদ্ধি করে বাঁচিয়ে নিল তাকে। শুধু যে বাঁচালো তা-ই নয়, নতুন করে জীবন দিল। মৃত প্রায় মনটাকে আবারও ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিয়ে বিশ্বস্ত এক নীড় উপহার দিল। স্মৃতি হাতড়ে পিছনে ফিরতে গিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল তার। ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘থ্যাংক ইউ।’

-‘কেন?’

-‘আমাকে ভালোবাসার জন্য।’

তাক্বদীম মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বউকে আগলে নিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
-‘সব ঠিক হয়ে যাবে, নাওয়ার। আমার সবটুকু চেষ্টা ও ভালোবাসা দিয়ে তোমার কোল ভরিয়ে তুলব, আমি। ব্যস, একটু ভরসা কোরো।’

***

অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হলো ফারিশা। তাম্মিকে পড়তে বসিয়ে নিজে গেল রান্নাঘরে। রাতের খাবারের আয়োজন করতে। রান্নার ফাঁকেই সে মেসবাহ’র গলার আওয়াজ পেল। সবকিছু ফেলে রেখে সামনে এসে বলল,

-‘একটু আগেই তো চা দিয়ে গেলাম, এখন আবার ডাকছ কেন?’

মেসবাহ শুধু টেলিভিশনের পর্দার দিকে ইশারা করল। তাতেই জমে গেল ফারিশা। কয়েক মুহূর্ত অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ধপ করে সোফায় বসলো। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল তার। কষ্টে জর্জরিত মন নিয়ে অস্ফুটস্বরে আওড়ে গেল,

-‘বাবা…।’

তানজীম নিজেও নিউজ দেখছিল। সে ভাই-ভাবীর থমথমে মুখ দেখে বলল,
-‘তোমরা কি দেখতে যাবে?’

মেসবাহ কিছু বলার আগেই ফারিশা বলল,
-‘না…। উনি অনেক আগেই আমাকে ত্যাজ্য করেছেন।’

-‘সবটাই বোধহয় আমার জন্য হলো। আমি যদি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম, তাহলে আজ তোমাদের পরিবারে এই ভাঙন সৃষ্টি হতো না।’

মেসবাহ’র এমন কথা শোনে চোখ কটমট করে তাকাল ফারিশা। শক্ত মেজাজে বলল,
-‘বার বার দোষ নিজের দিকে টানবে না। যা হয়েছে সব আমার জন্য। আর আমি যা করেছি, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে করেছি। এমন বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নিয়ে প্রতিপদে লাঞ্ছিত হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ত্যাজ্য হয়ে বেঁচে থাকাও সুখের, তাহমীদ।’

ভাই-ভাবীর কথার মাঝখানে থাকার প্রয়োজনবোধ করল না তানজীম। সে দু’জনকে পর্যাপ্ত স্পেস দিতে নিঃশব্দে প্রস্থান করল। ফারিশা মুখভার করে বসে রইল। মেসবাহ বলল,

-‘সামান্য কথাতে তুমি ভীষণ চটে যাও, রিশা। এই বেড হ্যাবিটটা চেঞ্জ কোরো।’

-‘আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব।’

-‘অবশ্যই। তোমাকে পালটাতে দিচ্ছে কে? তোমার মতো দজ্জাল একটা বউ পেয়ে জীবন ধন্য হয়ে গেল আমার। সেদিন যেভাবে হুমকি দিয়েছিলে, বাপরে। আধমরা আমি ওখানেই মরে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস সাহস দেখিয়ে আমার হাত ধরেছ, নয়তো আমি জীবন্ত লাশ হয়ে যেতাম।’

মন খারাপের মাঝেও ফিক করে হেসে ফেলল ফারিশা। চোখের সামনে স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল। বাবা-মা যেদিন জানতে পারলেন, এক স্বল্প বেতনের স্কুল মাস্টারের ছেলেকে মন দিয়ে বসেছে ফারিশা, সেদিন কত অত্যাচারই না করেছিলেন। শুধু যে তাকে একা অত্যাচার করেছেন, তা নয়। মেহসাহ’র কলেজ, ক্যাম্পাসে গিয়ে, তাকে হোস্টেল থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে, মুখোশধারী কিছু ছাত্রনেতা দিয়ে উরাধুরা মার খাইয়েছিলেন। পেটে-পিঠে, শরীরের প্রত্যেকটা অংশে ছুরি-চাকু ঢুকিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলেন। এরপর অর্ধমৃত মানুষটাকে ফেলে দিয়েছিলেন, ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে। সঙ্গীরা যারা তাকে মার খেতে দেখেছিল, কেউ সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। শুধু শেষবেলা তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় কয়েকজন যুবক সাহস করে মেসবাহকে হসপিটাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে বাঁচাতে বন্ধুরা সবাই সেদিন ক্যাম্পাসে রটিয়েছিল, মেসবাহ মারা গেছে। খুব গোপনে কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু তাকে বাঁচিয়ে নেয়ার চেষ্টায় অসংখ্য দৌড়ঝাঁপ করে ট্রিটমেন্ট করিয়েছিল। ফারিশা তখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে যেদিন সে খবর পেল, মেসবাহ’র জীবন সংকটে সেদিনই বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, পালাতে গিয়ে মায়ের সামনে পড়ে যায় সে। আবারও অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু হলো, পাশাপাশি শারিরীক-মানসিক অত্যাচার শুরু হলো। মায়ের কাছ থেকে এরকম জঘন্য যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। কাজের খালার হাত-পা ধরে বলেছিল,

-‘আমাকে পালাতে সাহায্য কোরো, প্লিজ। এখানে থাকলে আমি মরেই যাব।’

কেউ তার কথা শোনেনি। সাহায্য করেনি। উলটে দিনরাত একাধারে চড়-থাপ্পড় খেতে খেতে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে। শেষবেলা কোনো উপায় না পেয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে বলেছিল,

-‘আমাকে একবার ওর কাছে যেতে দাও। মরে যাবে তো। এইভাবে কোনো মানুষ মানুষকে মারে? ওর বাবার যদি টাকা থাকত, যদি সমাজের অন্য সবার মতো ক্ষমতার বড়াই থাকত, তোমাদের মতো জঘন্য মানুষদের বুঝিয়ে দিত, টাকার বাহাদুরি কাকে বলে! তোমরা দুটো নিরপরাধ মানুষের সাথে যা করেছ, তাতে তো তোমাদের বাবা-মা বলে ডাকতে গেলেও দশবার ভাবতে হবে।’

ফারিশার কথা শোনে ফয়জান মুনতাসীর বলেছিলেন,
-‘ডেকো না, বাবা-মা। তুমি একজন আমাদের বাবা-মা না ডাকলে, খুব একটা ক্ষতি আমাদের হবে না।’

-‘তোমরা কী চাও? আমি এখানেই পঁচে মরি। আমি যদি সুইসাইড করি, তোমাদের দু’জনকে ফাঁসিয়ে যাব। যে পাপ তোমরা করছ, তা নিয়ে তো মাথাব্যথা নেই তোমাদের। তোমাদের কাজটা যদি ভুল না হয়, তবে আমার ভালোবাসা ভুল কেন হবে? কেন আমাকে আটকে রেখেছ? যেতে দাও বলছি।’

মেয়ের মেজাজ দেখে মুনমুন হক্ব বললেন,
-‘ওই দুই টাকার প্রেমিককে ভুলে গিয়ে আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে কোরো। সারাজীবন টাকার বিছানায় ঘুমোবে।’

-‘স্যরি, মা। টাকার বিছানায় ঘুমোনোর লোভ তোমার থাকতে পারে, আমার নেই। আমি ওর কাছে যাবই। পারলে আটকে দেখাও।’

শরীর ও মনে অসংখ্য পীড়া, যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ছাড়তে চাইলে ফয়জান মুনতাসীর গলা উঁচিয়ে বললেন,
-‘একবার যদি এই বাড়ির সীমানা তুমি ত্যাগ কোরো, আর জীবনেও এই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না।’

-‘ঠিক আছে, আমি স্বেচ্ছায় এই বাড়ি, এই রাজত্ব ত্যাগ করছি।’

ফারিশা চলে যেতে চাইলে আচমকাই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল ফারশাদ। ফারিশার শরীর, হাত-পা ও রক্তাক্ত মুখ দেখে আঁৎকে উঠেছিল সে। ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে বলেছিল,

-‘বুবু, কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ, তুমি?’

-‘এই জাহান্নাম থেকে নিজেকে মুক্তি দিচ্ছি। এরা মানুষ না। অমানুষ। বন্য হিংস্র পশুর চেয়েও জঘন্য মানসিকতা এদের। দূরে থাক তুই। জীবনেও এখানে আসবি না।’

-‘এভাবে কথা বলছ কেন তুমি? কী হয়েছে সেটা তো বলবে? বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি?’

-‘যেখানেই যাই, এখানে এসে মাথা ঠুকব না আর। ওনারা আমাদের জন্ম দিয়েছেন বলেই, সামান্য ছাড় দিচ্ছি। নয়তো এক কোপে দু’জনকেই শেষ করে দিতাম।’

ফারশাদ তখন পুরোটাই হতভম্ব। চিৎকার-চেঁচামেচি শোনে ছোট্ট ফাবিহাও এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বুঝে উঠতে পারছে না পরিস্থিতি। ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে দূরেই দাঁড়িয়েছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফারিশা যখন বাড়ি ছাড়তে যাবে পিছন থেকে ফয়জান মুনতাসীর বলেছিলেন,

-‘আজ থেকে তুমি আমাদের কাছে মৃত। এটা মাথায় গেঁথে নিয়ে যদি বাড়ি ত্যাগ করতে চাও, তাহলে যাও। ওই ভিখারীর বাচ্চাকেই কবুল করে আমাদেরকে ত্যাজ্য করে যাও। ফারিশা নামে আমাদের যে মেয়ে ছিল, তাকে আমরা দাফন করলাম।’

বাবার মুখ থেকে এই কথা শোনে দুঃখে চোখে পানি চলে এলো ফারিশার। হার মানলো না তবুও। মনে সাহস ও জোর নিয়ে বাবার মুখের ওপর বলেছিল,

-‘তাহলে তোমরাও শোনে রাখো, আজ থেকে আমি তোমাদের সন্তান নই, তোমরাও আমার বাবা-মা নও। যে অন্যায় তোমরা আমার সাথে করেছ, একটা নিরপরাধ মানুষকে লাশ বানিয়েছ, এতকিছুর পরেও তোমাদের বাবা-মা বলে ডাকার মতো অতি আদিখ্যেতা আমাকে দিয়ে পোষাবে না। তুমি কেন আমাকে ত্যাজ্য করবে? আমি-ই তোমাদের দু’জনকে ত্যাজ্য করলাম।’

কথা শেষ করে একপ্রকার তুফানের মতো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ফারিশা। পিছন পিছন ফারশাদও এগিয়েছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে বলেছিল,

-‘বুবু, দাঁড়াও। আমার কথা শোনো। এভাবে যেও না। কী হয়েছে পুরোটা বোলো আমাকে। বুঝতে তো দাও পরিস্থিতি! বুবু, ফিরে এসো প্লিজ।’

ফারশাদ তার কাছাকাছি এগোবার আগেই একটা ট্যাক্সিক্যাব থামিয়ে চোখের পলকেই হারিয়ে গেল ফারিশা। খালি হাতে বাড়ি ফিরে এলো ফারশাদ। বুবু কোথায় গেল জানতেও পারল না সে। ফারিশা প্রথমেই গিয়েছিল হোস্টেলে। সেখান থেকে জানল, মেসবাহ এখনও হসপিটালে। তার অপারেশন হয়েছে। বেঁচে আছে তবে এটাকে বেঁচে থাকা বলে কি-না কেউ জানে না। সময় নষ্ট না করে হসপিটালে এসে কেবিন নম্বর খুঁজে মেসবাহ’র পাশাপাশি, কাছাকাছি এসে বসেছিল। সারা শরীরে তার ব্যান্ডেজ। চোখ থেকে টপটপ, টপটপ করে পানি ঝরছে। এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখার শক্তি তার ছিল না। ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। নার্স সামনে ছিল বলে, সে সামলে নিয়েছিল। ফারিশাকে পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট দিলে কিছুটা মনের জোর পায় সে। একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেসবাহ’র বুকে। রেগেমেগে অস্থির হয়ে বলেছিল,

-‘ভীতুর ডিম একটা। পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিলে কেন? তুমি মারতে পারলে না? এত ভীতু যদি হও, ভালো কেন বেসেছ?’

ব্যথাতুর শরীর নিয়েও হেসেছিল মেসবাহ। বলেছিল,
-‘তুমি কি আমাকে সিনেমার নায়ক ভেবেছ না-কি? তোমার জন্য একগাদা পালোয়ানের সাথে ফাইট করব? আমি খুব দুঃখিত, ডার্লিং। তোমার জীবনের হিরো হতে পারলাম না। একজন ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে হসপিটালে বেডে গড়াগড়ি খেতে বসেছি।’

-‘ফাজলামি রেখে বোলো, বিয়ে কবে হচ্ছে? তোমার কাছে আসার জন্য নিজের পরিবারকে ত্যাগ করতে হয়েছে। আজই, এক্ষুণি তুমি আমাকে বিয়ে করবে। নয়তো আমি, ব্রিজের ওপর থেকে লাফ দিয়ে সোজা উপরে চলে যাব।’

-‘বাপরে বাপ। এত হুমকিদামকি দেয়া শিখেছ কোথা থেকে?’

-‘হুমকি দিচ্ছি না। নিজের অধিকারটা আদায় করে নিচ্ছি। তোমার বন্ধুদের কল করে কাজী নিয়ে আসতে বোলো।’

-‘এভাবে হয় না, রিশা। আমি একটা সহায়-সম্বলহীন মানুষ। চাকরি-বাকরি কিছু তো করি না, তোমার দায়িত্ব নিব কী করে?’

ফারিশা অভিমানী মন নিয়ে বলল,
-‘ফিরে যেতে বলছ?’

-‘অসম্ভব। তুমি যদি আমার জন্য ঘর ছাড়তে পারো, আমিও তোমার জন্য হাজারও দুর্বল মুহূর্তকে পাশ কাটিয়ে একটুখানি সাহসী হতে পারি। আফটার অল, তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।’

পরবর্তী মুহূর্তগুলো খুবই সুখের ও আনন্দের ছিল দু’জনের জন্য। বন্ধুবান্ধবদেরকে সাক্ষী রেখে বিয়ে হওয়ার এক সপ্তাহ পর ওই শহর ছেড়ে দিয়েছিল দু’জনে। অসুস্থ হলেও কিছু সৎ ও সাহসী বন্ধুর জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তারা। দূরে গিয়ে ঘর-সংসার শুরু করেছিল। অসুস্থ মেসবাহকে সুস্থ করার মাঠে নেমেছিল ফারিশা। যতটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল, তা দিয়ে সামান্য বেতনের চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল। এরপর একটু একটু করে তাদের টোনাটুনির সংসারে সুখ আসতে শুরু করে। স্বামী-সংসারে অভাব-অনটনের শিকার হলেও ভালোবাসার অভাব টের পায়নি ফারিশা। যথেষ্ট যত্নে ও আদরে মেসবাহ তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আজও স্মৃতিগুলো স্মরণ হলে বুক কেঁপে উঠে ফারিশার। দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সব ব্যথাবেদনা ভুলে গিয়ে হাসিমুখে ঘর-সংসার সামলায় সে। স্বামী, সন্তান, দেবর, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাইকে নিয়ে এখন সে সুখেই আছে। পিছনের স্মৃতি মনে করে কুড়িয়ে পাওয়া সেইসব সুখকে বেদনায় রূপান্তরিত করার কোনো মানেই হয় না আর। টেলিভিশন বন্ধ করে নির্ভার হেসে স্বামীকে বলল,

-‘শোনো, আমি চাইছি শীঘ্রই তানজীমের হাত-পা বেঁধে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। তুমি কী বোলো?’

-‘বাবা-মা যদি বলেন, তাহলে ব্যবস্থা করাই যায়।’

-‘বাবা-মা বলবেন কী? বয়স বাড়ছে না। তুমি যদি ছাব্বিশে বিয়ে করতে পারো, ও কেন আটাশে বিয়ে করবে না?’

-‘আহা, মেয়ে কি গাছের পাতা না-কি! টুপ করে ছিঁড়ে এনে গলায় ঝুলিয়ে দিবে? মেয়ে খোঁজাও তো একটা ঝামেলার কাজ। তাছাড়া তোমার যে দেবর। জীবনে তো একটা প্রেমও করল না। আমার ভাই হয়ে ও এমন বাউণ্ডুলে হলো কী করে? হিসেবটাই তো আমি মিলাতে পারলাম না আজও।’

-‘মেয়ে খুঁজতে হবে না। মেয়ে আমি পেয়ে গেছি অলরেডি। তুমি শুধু জীমকে রাজি করাও, তাতেই হবে। বাকিটা আমি সামলে নেব।’

-‘ওকে, যাও, চেষ্টা করব। আরেক কাপ চা নিয়ে এসো।’

-‘তুমি এত চা খাও কেন? এত বলেকয়েও তোমার এই স্বভাবটা পাল্টানো গেল না। দূর…।’

ফের মেজাজ দেখাতে দেখাতে রান্নাঘরে চলে গেল ফারিশা। বউয়ের রাগ-অভিমান দেখে মুচকি হেসে আবারও টেলিভিশন ছেড়ে বসলো মেসবাহ। এবারে নিউজ না দেখে খেলা দেখায় মনোযোগ দিল। মুড ঠিক হবে এতে।

***

প্রায় আঠারো ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ফারশাদ বাড়ি ফিরল, পরদিন রাতে। বাড়ির সীমানায় একটা অ্যাম্বুলেন্সে ফয়জান মুনতাসীরের মৃতদেহ ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছে শুধু সন্তানেরা শেষবার বাবাকে দেখতে চেয়েছিল বলে। ফারশাদ ও ফাবিহা ফেরা মাত্রই জানাযার নামাজের তোড়জোড় শুরু হলো। মুনমুন হক্ব এই মৃত্যুটাকে হার্ট অ্যাটাক বলেই চালিয়ে দিয়েছেন। এজন্য সাংবাদিকদের ভীড় জমলেও বাড়তি কোনো কথা উঠেনি। শেষবার বাবার মুখখানি দেখে কবরস্থানের দিকে এগিয়ে গেল সবাই। খাটিয়া কাঁধে নিতেই অশ্রুরা ভীড় জমাল চোখে। বাবাকে এইভাবে বিদায় জানাতে হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ফারশাদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য। এটাই হয়েছে। দাফনের কাজ শেষে, মোনাজাত শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে রুমে এসে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ফারশাদ। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। মনও যথেষ্ট আঘাত পেয়েছে। কোনোভাবেই শরীরে জোর আসছে না আর। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মুনমুন হক্ব যখন ছেলের দেখা পেলেন না, তখনই রুমের দরজায় নক করে ‘শাদ’ বলে ডাকলেন। ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে সোজা হয়ে বসলো ফারশাদ। বলল,

-‘কী বলতে চাইছিলে?’

-‘তোমার বাবা একটা চিঠি রেখে গেছেন। আমার মনে হয় এটা তোমার পড়া উচিত।’

-‘আমার জন্য?’

-‘হুম, তোমাদের দু’জনের জন্য।’

চিঠি হাতে নিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘আর কিছু বলবে?’

-‘আমি এখুনি চলে যেতে চাইছি।’

-‘কোথায়?’

-‘যেখানে আগেই যাওয়া উচিত ছিল।’

-‘বুঝলাম না।’

-‘এমনিতেও তোমার বাবাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা ছিল। উনি আত্মহত্যা না করলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ডিভোর্সের কাজটা কমপ্লিট হয়ে যেত।’

-‘ওহ, ঠিক আছে। যাও। স্বামী মারা গেলে না-কি স্ত্রীদের ইদ্দত পালন করতে হয়। সেটা করবে না?’

-‘ধর্মীয় কোনো রীতিনীতি আমি কখনওই পালন করিনি, শাদ। এখনও করব না। আমি যাচ্ছি। বাড়িটা রইল। পারলে সামলে রেখো, না পারলে বিক্রি করে দিও।’

মায়ের এই স্বার্থপরের মতো কাজ ফারশাদের পছন্দ হলো না। কিছু বলার মতো ইচ্ছে-আগ্রহও পেল না। যে মহিলা স্বামী, সন্তান, সংসারের মূল্য বুঝে না, তাকে আর শতবার বললেও বোঝানো যাবে না। উলটে অযথাই কথা কাটাকাটি, রাগারাগি হবে। মুনমুন হক্ব চলে যাওয়ার পরও দরজায় কারও ছায়া দেখতে পেয়ে চিঠি রেখে রুমের বাইরে এলো ফারশাদ। সেখানে সোহানাকে দেখে বলল,

-‘তুই এখানে? এখনও ইংল্যান্ড যাসনি?’

-‘আমার মনে হচ্ছে তোমার পাশে থাকা উচিত।’

-‘মার খেতে না চাইলে চোখের সামনে থেকে সর।’

-‘তুমি আমার সাথে এমন কোরো, কেন?’

-‘এ্যাই খালামণির চামচা, তোর খালামণির পায়ের তলায় গিয়ে বসে থাক। অযথাই আমার সামনে এসে আলগা পিরিতি দেখাবি না। এগুলো আমার অসহ্য লাগে।’

মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিল ফারশাদ। সোহানা গেল না-কি থাকল, তাতে তার মাথাব্যথা নেই। সে এখন বাবার চিঠি পড়বে। বিছানায় বসে চিঠির ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল। গোটা গোটা অক্ষরে কয়েক লাইনের ছোট্ট একটা চিঠি। এটাকে চিঠি না বলে চিরকুট বললেই ভালো শোনাবে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পুরো লেখায় চোখ বুলালো,

বাবা শাদ,
আমার কথা শোনে তুমি অনেক চমকেছ, কষ্ট পেয়েছ। হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে, এজন্য। আমি সারাজীবন টাকার পিছনে ছুটেছি। দু’হাত ভরা সুখ খুঁজতে গিয়ে লোভে পড়ে নিজেও পাপের পথে গিয়েছি, তোমার মাকেও সে পথে টেনে নিয়েছি। বরাবরই আমার কাছে ভুল পথটাই সুখের ছিল। এজন্য ভুল থেকে ফেরার চেষ্টা না করেই একের পর এক পাপ করে গিয়েছি। আমি জানি, এই কথাগুলো তোমার কাছে ঘৃণিত ও জঘন্য মনে হচ্ছে। তবুও বলি, যদি কোনোদিন পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। লজ্জার ব্যাপার হলেও ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে একফোঁটাও লজ্জা হচ্ছে না আমার। বরংচ খারাপ লাগছে এইভেবে যে, তোমাদের তিন জনের জীবন আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। একটা সুন্দর পরিবার দিতে পারিনি, সৎ ও আদর্শবান বাবা-মা উপহার দিতে পারিনি, বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতে পারিনি। সবসময়ই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি আর তোমাদেরকে অযত্ন, অবহেলা করেছি। শেষ বয়সে এসে আমি উপলব্ধি করছি, এত ব্যর্থতা নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টের। মাথাভরা পাপের বোঝা, লাঞ্ছনা, অপমান, সন্তানদের ঘৃণা নিয়েই পাপের জীবনের ইতি ঘটাতে যাচ্ছি। বেঁচে থাকা এখন অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে আমার কাছে। তাই মৃত্যুকেই গ্রহণ করে নিচ্ছি। তোমাদের মুক্তি দিচ্ছি। যেভাবে পারো, নিজেদের জীবন তোমরা উপভোগ কোরো। ভালো থেকো তোমরা। আমার মৃত্যুর পর যদি মনে হয়, কবর জেয়ারত করা উচিত, তাহলে কোরো। তোমাদের ওপর কোনো দাবী নেই। কোনো চাওয়া নেই, অভিযোগ নেই। তোমরা স্বাধীন, মুক্ত। জীবনে সফল হও, অনেকদূর এগিয়ে যাও, দোয়া রইল।

ছোট্ট চিঠির সমাপ্তি এখানেই। নিচে লেখা বাবার নাম। চিঠি শেষ করে ক্লান্ত শরীর বিছানায় হেলিয়ে দিল ফারশাদ। আবারও দরজায় নক হলো। ভেতরে প্রবেশ করল ফাবিহা। হাতে দু’কাপ কফি। ভাইয়ের পাশে বসে বলল,

-‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, ভাইয়া।’

ফারশাদ হাসলো। চুলে ব্যাকব্রাশ করে হাত বাড়িয়ে কফি নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বলল,
-‘মা চলে গেছেন?’

-‘হ্যাঁ, সোহানাপুও সাথে গেল।’

-‘কাল যাবি আবার না-কি বাড়িতেই থাকবি?’

-‘মা যেহেতু নেই, ভয়ের কিছু নেই। আমি থাকতে পারব। তুমি ম্যাচ শেষ করে ফিরে এসো। এরপর আবার ঢাকায় চলে যাব।’

-‘ঠিক আছে।’

-‘আর কিছু খাবে? টেবিলে ভাত দিই? সারাদিন ধরে অভুক্ত আছো।’

-‘ক্ষিধে নেইরে। গলা দিয়ে কিছু নামবে না এখন।’

ফাবিহা জোর করার সাহস পেল না। একটু শান্ত হোক আগে। এরপর খাওয়ানো যাবে। এইমুহূর্তে তাকে বিরক্ত না করে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। সে দরজা আটকে চলে গেলে ফারশাদ চুপটি করে বসে রইল। মনের ওপর দিয়ে একের পর এক তুফান যেভাবে যাচ্ছে, সেগুলো সামলে ওঠা ভীষণ কষ্টের ও ধৈর্যের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে কতদিন চলবে কে জানে! সে একদৃষ্টিতে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে অন্তহীন ভাবনায় বিভোর হয়ে রইল। তার সব ভাবনা, সব যন্ত্রণা এসে থামল, একটা আফসোসের ওপর। কষ্টে জর্জরিত মন নিয়ে আওড়ে গেল,

-‘কী পাপ করেছিলাম, মাবুদ! কেন এই যন্ত্রণাময় জীবন উপহার দিলে তুমি? এরচেয়ে মৃত্যুও যে ঢের সুখের হতো!’

***

চলবে…