মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-০৭

0
46

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – সাত

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

শামীম যাওয়ার পর থেকে একাধারে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছেন উসমান ওয়াজেদ। অনবরত বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করছেন। শেষ বয়সে এসেও আগের অভ্যাস বা মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হলেও এগুলো এই বাড়ির নিত্যদিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহে তিনদিনই তিনি এইভাবে গোষ্ঠিশোদ্ধ লোকজনকে পিছনের সময়টা ধরে বকাঝকা করতে থাকেন। ভদ্রলোকের এই চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজনেরা অভ্যস্ত হয়ে গেলেও বাইরের মানুষের সামনে হুটহাট এমন পরিস্থিতি খুবই বিব্রতকর, লজ্জার। মেয়ের মাথার এই ব্যথা দেখে অসুস্থ মন নিয়েও উসমান ওয়াজেদের পিতৃমন ভাই-ভাবী ও ভাইপোদের ওপর মারাত্মকভাবে ক্ষ্যাপে উঠল। মিশকাত এসব পরিস্থিতি খুবই ভয় পায়। এজন্য এরকম পরিস্থিতি এলে সে চট করে সরে পড়ে। নিজেকে একঘরে বন্দী করে ফেলে। ভদ্রলোকের এই চেঁচামেচি কোনোমতেই থামছিল না দেখে উজমা আলগোছে ভাইকে ইশারায় কিছু একটা বোঝাল। উসাইদ দেরী করল না। একছুটে প্রথমে নিজের ঘরে গেল, এরপর প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দৌড় দিল ফার্মেসিতে। উসাইদ চলে যাওয়ার পর উজমা ধীরেসুস্থে উসমান ওয়াজেদের হাত ধরে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝাতে শুরু করল,

-‘আচ্ছা, বাবা। আমায় একটা কথা বোলো তো।’

গালিগালাজের মাঝখানে মেয়ের কথা শোনে শান্তচোখে উজমার দিকে তাকালেন উসমান ওয়াজেদ। বললেন,

-‘কী?’

উজমা ভদ্রলোকের হাত ধরে তাঁর রুমে নিয়ে গেল। বিছানায় বসিয়ে নিজেও একপাশে বসে বলল,

-‘আমাদের জীবনে সুখ-শান্তি নেই, এসব নিয়ে কোনোদিন তোমাকে কিছু বলেছি আমরা?’

উসমান ওয়াজেদ চুপ করে গেলেন। মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয় একেবারে। পিছনের সময়টা এখনও মনে আছে তাঁর। স্পষ্ট না থাকলেও আবছা আবছা। সেই আবছা দৃশ্য যখন মস্তিষ্কে ধাক্কা মারে তিনি পাগলের মতো বকাবকি শুরু করেন। যাকে সামনে পান, তাকেই গালি দেন। বাবার চুপথাকা দেখে উজমা বলল,

-‘তুমি কি জানো, আমাদের জন্য চিন্তা করতে গিয়ে তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলে গেছো?’

-‘কই, না তো।’

-‘উঁহু, মোটেও তা নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ছ।’

-‘আমি অসুস্থ নই, বড়ো মা। সুস্থ আছি। আমার কিচ্ছু হয়নি।’

কোনোভাবেই ভদ্রলোককে মানাতে পারছে না, উজমা। কীভাবে ম্যানেজ করে ঔষধ খাওয়াবে এটাই চিন্তার হয়ে দাঁড়াল। হাজারও চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও সময়ে সময়ে ঔষধ খেতে চান না তিনি। সারাটারাত জেগে কাটিয়ে দেন। নিজের রুমে বসে একা একা বকবক করেন। এই রুমে, ওই রুমে গিয়ে দরজায় ধাক্কা-ধাক্কি করেন। নিজেও ঘুমান না, কাউকে ঘুমাতেও দেন না। এজন্য ঔষধ খাওয়াতে গিয়ে উজমা একটা চালাকি করে প্রতিবার। এবারও করল। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘আমি জানি তুমি অসুস্থ। দাঁড়াও, এক্ষুণি দেখাচ্ছি।’

ঝটপট নিজের রুমে গেল উজমা। স্টেথোস্কোপ হাতে ফিরে এলো আবারও। ব্যাপারটা বসার ঘরে থেকে খেয়াল করল ফারশাদ। সে-ও এগিয়ে এলো। জানতে চাইল,

-‘আংকেল কি খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?’

এতক্ষণ ভদ্রলোকের এইসব বকাবকি মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল ফারশাদের। কিছুক্ষণ আগে ঊষা সম্পূর্ণ বিষয় বুঝিয়ে বলেছে। এ-ও বলেছে, তিনি যে সময়মতো ঔষধ খেতে চান না। তা-ই নিজেও এগোলো। যদি কোনোভাবে ম্যানেজ করে মুরব্বি মানুষটাকে ঔষধ খাইয়ে ঠাণ্ডা করা যায়। তার প্রশ্ন শোনে তিনি বেঁকে বসলেন। বললেন,

-‘দেখো তো বাবা। আমার মেয়েটাকে একটু বোঝাও। খামোখা বলছে, আমি না-কি অসুস্থ। আমাকে দেখতে কি রোগা লাগছে, দুর্বল লাগছে?’

-‘ঠিক রোগা বা দুর্বল লাগছে না, আংকেল। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

-‘কেন?’

-‘দুপুরে খেতে পারেননি ঠিকমতো, মনে আছে? আমি কত করে খাবার মুখে তুলে দিলাম, তা-ও আপনি খেলেন না। সবটুকু খাবার নষ্ট করে দিলেন।’

-‘কী করব? আমি তো বেশি খেতে পারি না।’

-‘অসুস্থ বলেই আপনি বেশি করে খেতে পারছেন না। পেটে ক্ষিধে থেকে যাচ্ছে অথচ মুখ দিয়ে খাবার যাচ্ছে না। যদি অসুস্থ না-ই হোন, এমনটা কেন হবে?’

গল্পের ছলে ভদ্রলোককে এটা-সেটা বোঝাতে শুরু করল ফারশাদ। উজমা প্রেশার চেক করে বলল,
-‘এই দেখো, একদম লো হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরই মাথাঘুরে পড়ে যাবে। ডাক্তার কী বলত মনে নেই তোমার? তোমার শরীরে ভিটামিনের প্রচুর অভাব। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করার পাশাপাশি ঔষধও খেতে হবে। নয়তো শরীরে জোর পাবে না।’

ভদ্রলোক মেয়ের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। নিজেকে সুস্থ দাবী করতে উঠেপড়ে লাগলেন। এরমধ্যেই দৌড়ের ওপর ঔষধপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল উসাইদ। উজমা বাবাকে বুলিয়ে-টুলিয়ে ইনজেকশন প্রস্তুত করে বলল,

-‘এটা দেই। দেখবে, কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রেশার ঠিক হয়ে যাচ্ছে।’

চট করে মেয়ের হাত ধরে ফেললেন তিনি। বললেন,
-‘এটা কীসের ইনজেকশন?’

-‘দুর্বলতার।’

-‘ওহ, দে তাহলে।’

সুযোগ পেয়ে ইনজেকশন পুশ করে নিল উজমা। কৌটা বের করে বেশ কয়েকটা ঔষধ হাতে নিল। একগ্লাস পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘হা কোরো।’

-‘আবার কী দিচ্ছিস, বড়ো মা?’

-‘এগুলো সব ভিটামিন। খেতে হবে।’

-‘এসব খাব না, আমি। এগুলো খেলে আমার খালি ঘুম পায়।’

-‘দুর্বল শরীরে হুট করে ভিটামিন পড়লে ঘুম পাবেই। একটু ঘুমোলে দেখবে, ঠিক হয়ে গেছো। নাও, মুখ খুলো এবার।’

ভদ্রলোক দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন। হাত দিয়ে উজমার হাতে এমনভাবে ধাক্কা দিলেন, ব্যথায় একটু ‘উহ’ শব্দ উচ্চারণ করল উজমা। পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে। কোনোভাবেই এসব ঔষধ তিনি গিলবেন না, এটাই ওনার মর্জি। এসব দৃশ্য এখন আর উজমার খারাপ লাগে না। কষ্টও হয় না। সয়ে গেছে সবকিছু। আর কতদিন এভাবে চলবে কে জানে! তবুও মানিয়ে নিতে হবে। সে পূণরায় বাবার দিকে এগোলো। উসাইদ বাবার হাত ধরে আটকে রাখল। উজমা জোরপূর্বক ঠোঁট ফাঁক করে সবকটা ঔষধ মুখের ভেতর ঢুকিয়ে পানির গ্লাস ধরে রইল। তিনি ঔষধ ফেলে দিতে চাইলে রেগে গেল উসাইদ। মুখে হাত চেপে ধরে গিলাতে বাধ্য করল। ঔষধ, পানি খাওয়ানো শেষ হলে, আলগোছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল উজমা। বুক ছিঁড়ে কষ্টেরা বেরিয়ে আসতে চাইছে। অশ্রুগুলো বাঁধা মানছে না আর। উসাইদ বোনকে তখন বলল,

-‘তুই একটা পেইনকিলার খেয়ে নে, উজমা। কপালে অনেকখানি জখম হয়েছে। আমি ঔষধ এনেছি।’

-‘একটুপর খাব। তুমি একটু ভাবীর কাছে যাও। এসবকিছু হয়তো ভাবীর মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। দেখে আসো একটু।’

বন্ধুকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল উসাইদ। উজমা বাবার বিছানার বালিশ ঠিকঠাক করে মশারী টানিয়ে দিল। ধরেবেঁধে বালিশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-‘কিছু খাবে বাবা?’

উসমান ওয়াজেদ মেয়ের নিষ্পাপ মুখপানে তাকিয়ে, গজ বাঁধা কপালের অংশ দেখে বললেন,
-‘তুই চিন্তা করিস না, বড়ো মা। দেখবি, শামীমকে আমি ঠিক শাস্তি দিব।’

উজমা নীরবে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে গেল, মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ করল না। তবে মনে মনে আওড়ে গেল,
-‘আমিও তো তাই চাই, বাবা। মেয়ের সম্মান বাঁচাতে একটুখানি হলেও লড়াই কোরো তুমি। একটু সাহসী, প্রতিবাদী হও। কিন্তু তুমি তো সেটা পারবে না। যদি পারতে, অনেক বছর আগে মায়ের কথা ভেবে একটু হলেও কঠিন হতে। অথচ তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছো। কবে সুস্থ জীবনে ফিরবে তুমি? কবে সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নিতে পারবে? এমন দিন আদৌ কি আমাদের জীবনে আসবে, বাবা?’

***

মিশকাতের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। দুঃশ্চিন্তায় কেঁদে গাল ভাসিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। তার সব চিন্তা অনাগত বাচ্চাটাকে নিয়ে। যে বাচ্চাকে নিয়ে এত স্বপ্ন, এত আকাঙখা, এত আবেগের জন্ম, সেই বাচ্চা যদি হয় উসমান ওয়াজেদের মতো, তাহলে কী হবে? এতদিন মনে এই ভয় দানা বাঁধলেও মুখফুটে কাউকে কিছু বলার সাহস পায়নি। কারও কাছে নিজের দুর্বলতা ও মনের ভয় প্রকাশ করেনি। শুধু মনে হয়েছে, যে আসতে চলেছে সে আল্লাহপ্রদত্ত এক নেয়ামত। অথচ এখন, এই শেষ মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্তটাই ভুল। যদি কোনোভাবে সন্তান বিকৃত মস্তিষ্কের হয়, তাহলে কী হবে? কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো ফুলে গেছে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো উপায়ই সে খুঁজে পাচ্ছে না।

উসাইদ এসে বউকে এত ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে কাঁদতে দেখে পাশে বসে বলল,
-‘শরীর খারাপ লাগছে?’

মিশকাত জবাব দিল না। কয়েক সেকেন্ড স্থিরচিত্তে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। উসাইদ আবারও বলল,
-‘শরীর খারাপ লাগলে বোলো, হসপিটালে নিয়ে যাব।’

-‘একটা কথা বলি?’

পাংশুমুখে অনুমতি নিয়ে চুপ করে গেল মিশকাত। ভয়ের এই কথাটা উচ্চারণ করতেও ভয় লাগছে তার। উসাইদ বোধহয় বুঝল। বউয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

-‘বোলো।’

-‘যদি আমাদের সন্তানও এরকম হয়, কী করবে তুমি?’

-‘এরকম মানে? কীরকম?’

-‘ওইযে, বাবার মতো। মানে, অসুস্থ। মেন্টালি সিক হয় যদি?’

নিজের সন্তানকে নিয়ে এই ভাবনাটা প্রথমদিকে খুব করে নিজের মনের ভেতর প্রশ্নের ছড়াছড়ি দিয়ে আটকে রেখেছিল উসাইদ। দিনের সবটুকু ভাবনাই থাকত, অনাগত বাচ্চাকে কেন্দ্র করে। তার বাবার যা মানসিক অবস্থা, এরকম যদি তার সন্তান হয়, তবে কী করবে? আবার নিজেদের দিকে তাকালে, নিজেকে বা উজমা-ঊষাকে দেখলে ভয় দূর হয়ে যেত। মনে হতো, দূর সবাই কি আর এক হয়? সবসময় দু’হাত তুলে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করত, একটা সুস্থ ও নেক সন্তানের। যে তার ঘর আলো করে আসবে। এতদিন মনে এইভেবে সাহস দিয়ে আসছিল যে, আল্লাহ তো নিশ্চয়ই সব জানেন। তিনি যা করবেন, ভালো বুঝেই করবেন। এজন্য ভয়কে এতবেশি পাত্তা দেয়নি। আজ স্ত্রীর কথাতে আবারও সেই একই ভয়, একই দুঃশ্চিন্তা ঘিরে ধরল তাকে। জানতে চাইল,

-‘তুমি কি চাও, অসুস্থ হলে তাকে ফেলে দিতে অথবা কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে?’

‘ছিঃ’ বলে উসাইদের মুখের ওপর হাত রাখল মিশকাত। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,
-‘যেমনই হোক, ও আমার সন্তান। এতগুলো দিন, এতগুলো মাস তাকে গর্ভে নিয়েছি, অনাথ আশ্রমে দেয়ার জন্য? এতটাও পাষাণ আমি হতে পারব না কোনোদিন।’

-‘তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন?’

-‘এই পরিস্থিতি অনেক ভয়ানক, উসাইদ। সামলানো কী যে যন্ত্রণার সেটা তোমাদের ভাই-বোনকে দেখলেই বোঝা যায়। আমি ভয় পাচ্ছি, যদি এরকম সিচুয়েশন আসে, আমি সামলাতে পারব কি-না। অসুস্থ জেনে নিজের সন্তানের প্রতি আমি যদি রুড হয়ে যাই, তাহলে তো সমাজের দশজন তাকে এই সমাজে ঠাঁই-ই দিবে না।’

-‘ঠিক তাই। বাবা অসুস্থ, তাই বলে আমরা কি বাবাকে ফেলে দিতে পেরেছি? সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, চিকিৎসা দেয়ার, সুস্থ করার। সম্পূর্ণ সুস্থতার মালিক আল্লাহ। এত চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে আমাদের। তবুও তো আমরা বাবাকে ত্যাগ করিনি। যা বাবার বেলার পারিনি, তা সন্তানের বেলায় কী করে করব? তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছ। যা-ই হোক, যেমনই হোক, সন্তানটা আমাদের। তাকে পরিপূর্ণ সুস্থ জীবন দেয়ার দায়িত্বও আমাদের। আমাদের যতটুকু করণীয় আমরা ততটুকু অবশ্যই করব।’

মনে কিঞ্চিৎ সাহস পাওয়াতে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো, মিশকাত। আলগোছে স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলল,
-‘আমি খুবই দুঃখিত। অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথায় এনে ফেলেছি। আর এমন হবে না।’

নিঃশব্দে বউয়ের কপালে অধর ছুঁলো উসাইদ। খানিকক্ষণ চুপ থেকে অভয় দিয়ে বলল,
-‘ভয় পেও না। সব ঠিকঠাক হবে ইনশা’আল্লাহ।’

***

একদিনে এত মানসিক চাপ আর সহ্য হচ্ছে না উজমার। প্রথমে সাকিব, এরপর শামীম, শেষে উসমান ওয়াজেদ নিজে। নিজেকে ও পরিবারকে নিয়ে এত ঝুটঝামেলা কিচ্ছুই ভালো লাগে না আর। জীবনটাকে দুর্বিষহ মনে হয় শুধু। তবুও জীবন সুন্দর, এটা মেনে নিয়ে দিন অতিবাহিত করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে উজমা। গোটা দিনের অশান্তি ও ক্লান্তিকে একটুখানি বিশ্রাম দিতে রাতের খাবারের পর ঔষধ খেয়ে ঘুমোনোর চিন্তাভাবনা করছিল। এজন্য সবাইকে খাইয়ে নিজেও তাড়াতাড়ি খেতে বসেছে সে। কিন্তু খাওয়া আর হলো না। টেবিলের একপাশে থাকা তার পারসোনাল ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। স্ক্রিনে চোখ দিয়েই একরাশ বিরক্তি এসে ভর করল মনে। পুরো দিন ও রাতটা এবার আতঙ্ক ও যন্ত্রণার মনে হলো তার। হাতের চাপে রিসেন্ট কল আসা নম্বরটা ব্লকলিস্টে ফেলে দিল। ঊষা বোনের এই কাণ্ড নীরবে দেখল শুধু। কিছু বলল না। চুপচাপ খাবার খেয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর আবারও আরও একটা নম্বর থেকে কল এলো। অপরিচিত নম্বর দেখে কোনোকিছু না ভেবেই খাবার প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে ফোন রিসিভ করল উজমা। সেই ক্ষণে ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি অসহায় কণ্ঠে বলল,

-‘পাঁচ মিনিট আপনার সাথে কথা বলতে চাই, উজমা। প্লিজ, কল কাটবেন না।’

উজমা শুধু শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘স্যরি। রং নম্বর।’

ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি আওয়াজ তুলল সাকিব। বলল,
-‘প্লিজ, উজমা। পাঁচ মিনিট সময় দিন আমাকে। কথা দিচ্ছি, আমি আপনাকে বিরক্ত করব না, খারাপ কথাও শোনাব না। শুধু নিজের দিক থেকে কিছু কথা ক্লিয়ার করব।’

-‘বলেছি না, এটা রং নম্বর? কথা কানে যাচ্ছে না আপনার? কেন বার বার একই কথা বলছেন? অসভ্যতা করার আর জায়গা পান না, না? নিরুপায় মেয়েমানুষ দেখলে কথা বলার জন্য জিহ্বা এত লাফালাফি করে কেন আপনাদের? কন্ট্রোলে রাখতে পারেন না নিজেদের?’

একসঙ্গে এত কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল উজমা। লাইন বিচ্ছিন্ন করে এই নম্বরটাও ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিল। তারপর শান্তিতে একগ্লাস পানি খেল। ঊষা বোনের এই রাগ ও মেজাজ দেখে বলল,

-‘আশ্চর্য! তুমি তো বড্ড অদ্ভুত মেয়ে আপু।’

বোনের কথার অর্থ ধরতে পারল না উজমা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ঊষা বলল,
-‘না মানে, তুমি হাসলে সুন্দর লাগে, রাগলে সুন্দর লাগে, আবার কাঁদলেও সুন্দর লাগে। ইশ, আমি যদি ছেলে হতাম, যদি তোমার রক্তের কেউ না হতাম, নির্ঘাত তোমার প্রেমে পড়তাম।’

উজমার মেজাজটার দফারফা ঘটে গেছে এমনিতেই। সারাদিনের এত অশান্তিতে এখন তার মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। ঊষার কথায় সেই যন্ত্রণা টনটন করে বেড়ে উঠল। রাগে-দুঃখে বলল,

-‘উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা খাবি না, ঊষা। দিব একটা চড়। খাওয়া শেষ, এখন যা এখান থেকে।’

খাওয়া শেষে, রান্নাঘর গুছিয়ে, সবার সাথে আড্ডা দিতে বসেও শান্তি পেল না উজমা। অপরিচিত নম্বর থেকে একটার পর একটা কল আসছে। রিসিভ করে সাকিবের কণ্ঠ শোনা মাত্রই কল কেটে সেটা আবার ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিচ্ছে। এভাবে একটার পর একটা নম্বর ব্ল্যাকলিস্টে ফেলতে ফেলতে অধৈর্য হয়ে গেল। তবুও সাকিব থেমে থাকল না। নিজের কাছে যতটা নম্বর ছিল, সবকিছু দিয়ে একাধারে উজমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যেতে লাগল। বিরক্ত হতে হতে একসময় উজমা আর নিজের সিমটাই রাখল না ফোনে। সিম বের করে রান্নাঘরে এসে, গ্যাস অন করে উত্তপ্ত আগুনে ছেড়ে দিল সেটা। টেলিভিশন দেখতে বসে দুই বন্ধু উজমার এই কাজটা খুব ভালোমতো লক্ষ্য করল। ফারশাদ বলল,

-‘তোর বোন এত রাগী, বোঝাই যায় না।’

উসাইদ মুচকি হেসে বলল,
-‘অকারণে কেউ বিরক্ত করলে ও এমনই করে।’

-‘ওই ছেলেটা কী চাইছে এখন? কেন বার বার বিরক্ত করছে?’

-‘সেটা সে-ই ভালো জানে।’

-‘তুই কী ভাবছিস এখন? কী করবি?’

-‘দেখি, মামা-মামীর সাথে কথা বলতে হবে। কী করব এটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।’

ফারশাদ একবার ভেবেছিল, উসাইদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। কিন্তু উজমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে থেমে গিয়েছে। এইমুহূর্তে এসব যদি বলে, মেয়েটা ধরেই নিবে কেউ তাকে করুণা করছে। একটা মানুষের অনুভূতি ও তার একান্তই গোপন চাওয়ার খবর সে টেরই পাবে না। আগে সরাসরি উজমার সাথে কথা বলে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে, এরপর বিয়ের প্রস্তাব দিবে। কারও মনে জোর করে জায়গা করে নেয়ার আগে, তার মনের যেকোনো পরিস্থিতি বুঝে ওঠা জরুরী। হোক সেটা পজেটিভ বা নেগেটিভ। জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া যায় না। যদি কখনও উজমার মনে সে জায়গা করে নিতে পারে, তাহলেই মুখ খুলবে। তার আগে নয়। ততদিন নিজের মনের এই অনুভূতিটা একান্তই নিজের থাক, সেটাই ভালো। ভেবেচিন্তে বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-‘টেনশন নিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

উসাইদ কিছু বলল না। ফারশাদ কথা ঘুরাতে বলল,
-‘আচ্ছা, মুনাইম স্যারের বাসার ঠিকানা আছে তোর কাছে? ভাবছিলাম একবার দেখা করব।’

-‘আছে তো। স্যারের সাথে আমার মাঝেমধ্যে দেখা হয়। কবে যেতে চাস?’

-‘আগামীকালই যাই?’

-‘ঠিক আছে। কালই যাব। এখন যা, ঘুমিয়ে পড়।’

উসাইদ চলে গেলেও ফারশাদ বসে রইল। টেলিভিশনের দিকে তার নজর নেই। তার নজর উজমার দিকে। থমথমে ওই মুখটায় আজ যেন রাজ্যের অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে। এই মেয়েটাকে এইভাবে দেখতে তার ভালো লাগছে না। অশান্ত মনে হচ্ছে চারপাশ। মেয়েটা একটু প্রাণখুলে হাসুক, তাহলেই তো তার শান্তি। সে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। দু’চোখ ভরে, তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখল। এই একপাক্ষিক দেখা ও মনের টালমাটাল অবস্থা সামলানোর ধৈর্য কতদিন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে কে জানে! বড়ো অসময়ে মন কারও মায়ায় পড়ল। কারও হাসি, কারও কান্না, রাগ-অভিমান সবকিছুই মনে জায়গা করে নিল নিমিষেই। কী এক অদ্ভুত মোহমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল মন। বেখেয়ালি মন এত দ্রুত কীভাবে কারও মায়ায় পড়ে গেল? মন নিজেই কি তা বুঝেছিল কোনোকালে – এইভাবে, হুট করে, অচেনা একটা মেয়েকে দেখে, সেই মেয়ের হাসি-কান্নার মাঝে নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর সবচেয়ে চমৎকার পন্থা সে খুঁজে পাবে?

গ্যাস অফ করে বসার ঘরে এসে চমকে গেল উজমা। ফারশাদের অমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কোনো অর্থই সে খুঁজে পেল না। শুধু বুঝল, ওই দুটো চোখে মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে। যেমনটা গতকাল রাতে ছিল। হুটহাট এই দৃষ্টি বড্ড লজ্জার হয়ে দাঁড়াল। মেহমানকে জেগে থাকতে দেখেও সে ঘুমোতে চলে যাবে, যুক্তিটা ঠিকঠাক মিলাতেও পারল না। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,

-‘আপনি এখনও এখানেই বসে আছেন কেন?’

-‘ডিউটি পালন করছি।’

স্পষ্টকণ্ঠে উত্তর দিল ফারশাদ। উজমা বলল,
-‘কীসের ডিউটি?’

-‘চোর-ডাকাত আসতে পারে। তাদের সাথে কুস্তি খেলতে হবে তো। জ্যান্ত একটা মানুষ এসে যেভাবে আপনাকে আঘাত করল, আমি তো ভয় পাচ্ছি ভীষণ। চোর-ডাকাত এসে যদি একেবারে মেরে ফেলে! তখন কী হবে?’

-‘মজা নিচ্ছেন? এই সিচুয়েশনটা আপনার কাছে খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে?’

দু’দিকে মাথা নেড়ে সিরিয়াস কণ্ঠে ফারশাদ বলল,
-‘আমাকে আপনার এতটাই পাষণ্ড মনে হচ্ছে? আপনার দুঃখে আমি হাসব, মজা নিব?’

-‘তাই তো করছেন বলে মনে হচ্ছে।’

উজমার রক্তাক্ত মুখ তখন হৃদয়কে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছিল তার। সরাসরি শামীমকে কিছু বলতে পারছিল না, কিছু কর‍তে পারছিল না, কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা মানুষের অসহায়ত্ব দেখতে হচ্ছিল শুধু। এই ব্যথা যে কত ভয়ানক, সেটা উজমাকে কী করে বোঝাবে? কী করে বলবে,

-‘একটু হাসুন আপনি! আপনি না হাসলে আমার হৃদয়ে যে সারাক্ষণ ঝড়োহাওয়া বয়। সেই ঝড়োহাওয়া সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আমি আপনাকে এই রূপে, এই চেহারায় দেখতে চাই না কোনোদিন। আপনি এমন গোমড়ামুখে থাকবেন না, প্লিজ।’

প্রয়োজনীয় কথা নির্দিষ্ট সময়ে বলা হয়ে উঠে না। সেই সাহস বা মনের জোর সবাই পায় না। ফারশাদও পেল না। চুপ করেই রইল। উজমা মন খারাপের সুরে বলল,

-‘আমি আপনাকে আলাদা ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনিও অন্য সবার মতোই।’

-‘কী করে বুঝলেন?’

-‘এইযে, অন্যের দুঃখ ভারাক্রান্ত মুহূর্তেও হাসিঠাট্টা করার মতো আগ্রহ আপনি পেলেন। সেটাই বুঝিয়ে দিল। কাউকে না জেনে, তাকে এইভাবে বিদ্রুপ করাটা উচিত নয়। কোনো ব্যক্তিত্ববান ব্যক্তি জেনে-বুঝে এই কাজটা করবে না।’

ফারশাদ বুঝল, উজমা তাকে ভুল বুঝতে শুরু করেছে। সে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল,
-‘আমি আপনাকে বিদ্রুপ করব সেই সাহস আমার নেই, উজমা। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।’

ফারশাদের মুখ থেকে এই কথা শোনে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন মনে করল না উজমা। তাকে কিছু বুঝানোর ইচ্ছেও হলো না। মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। কয়েক’পা এগিয়ে রুমে যেতে চাইলে পিছন থেকে ফারশাদ বলল,

-‘কারও চোখের পানি মুছে দেয়ার অজুহাতে তাকে একটুখানি হাসানোর চেষ্টা করা যদি বিদ্রুপের শামিল হওয়ার পাশাপাশি বিরাট বড়ো অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমি সেই অপরাধে অপরাধী। যদি কোনোদিন মনে হয়, এই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য তাহলে সেদিন ক্ষমা করবেন। আর যদি তা না পারেন, আজীবন অপরাধী ভাবতে পারেন। এরজন্য আপনার ওপর আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না। আ’ম এ্যাক্সট্রিমলি স্যরি, স্যরি ফোর এভ্রিথিং।’

***

চলবে…