মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-০৮

0
85

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – আট

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

যে মেয়ে কোনোদিন কারও সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেনি, কাউকে চোখের পানি পর্যন্ত দেখায়নি, আজ তার মুখ দেখে মনের ভেতরের দুর্বলতা ও চোখের কোণে আটকে থাকা পানি কেউ দেখে ফেলল! তা-ও এইভাবে! ফারশাদের এই কথা মনে ও মস্তিষ্কে পৌঁছা মাত্রই সমস্ত শরীর জুড়ে ভয়াবহ রকমের ভয়মিশ্রিত অনুভূতির জোয়ার বয়ে গেল উজমার। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টের পেল, এই পুরুষের সামনে সে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না আর। ধৈর্য্য-শক্তি, মনোবল যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। মনের বেহাল অবস্থা সামলে নিয়ে ভারিক্কি মেজাজে উজমা বলে উঠল,

-‘আমার চোখের পানি মোছার দায়িত্ব আমি আপনাকে দেইনি মিস্টার।’

ফারশাদও একই সুরে বলল,
-‘কেউ স্বেচ্ছায় চোখের পানি মোছার দায়িত্ব কাউকে দেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না, উজমা। কিন্তু যখন পরিস্থিতি বেসামাল হয়, যখন ব্যক্তি নিজের ওপর থেকে ধৈর্য্য-শক্তি সাহস, হারিয়ে ফেলে তখনই অন্যের সামনে তার দুর্বল দিকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করে ফেলে। আপনিও ঠিক তাই করেছেন। গতকালও, আজকেও। পরপর দু’বার আমি আপনার চোখে পানি দেখেছি। তাই আমার কাছে ব্যাপারটা খারাপ লেগেছে। এই খারাপ লাগা থেকেই আমি চেয়েছি, আপনার চোখে পানি নয়, ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে থাকুক সবসময়।’

-‘আপনি চোখে বেশি দেখেছেন।’

-‘তাই মনে হচ্ছে আপনার?’

মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল উজমা। জবাব দিল না। মিথ্যে বলতে বাঁধছে আবার সত্য স্বীকার করতেও লজ্জা হচ্ছে। কেউ কেন তাকে এইভাবে নজরে রাখবে সবসময়? কেন তার চোখের পানি কেউ দেখে ফেলবে? কেন বুঝে ফেলবে মনের গোপন ঘরের যন্ত্রণা? জবাব না পেয়ে ফারশাদ আবারও বলল,

-‘আমি মনে করি, নিজের একান্তই দুঃখ-কষ্টগুলো যারা নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতে জানে, তারা প্রকৃত ধৈর্য্যশীলদের মধ্যে একজন। সেদিক থেকে আপনিও…।’

-‘বাজে বকবেন না, প্লিজ।’

চুপ থাকতে না পেরে সামান্য আর্তনাদ করে উঠল উজমা। ফারশাদ অবাক হলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘আমি বাজে বকছি?’

-‘অবশ্যই। আপনি আমাকে পুরোটা জানেন না, না জেনে আন্দাজে এতকিছু ভেবে ফেলছেন। এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

-‘আপনার কি ধারণা, কাউকে কিছু বলতে গেলে আগে তার সম্পর্কে অ্যা টু জেড জানতে হবে?’

-‘অফকোর্স। কারও সম্পর্কে পজেটিভ-নেগেটিভ কোনোকিছু বলার আগে অবশ্যই তাকে ভালোমতো জানা উচিত আপনার।’

-‘আপনার কথা ভুল নয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ব্যতিক্রমই বটে। যেমন ধরুন, আমার ক্ষেত্রেই। আমি আপনাকে জেনে নয়, বুঝে কথা বলতে চাই। কিছুক্ষণ আগে আমি আপনার সম্পর্কে যা বলেছি, সেটা আপনাকে জেনে বলিনি, বুঝে বলেছি। আমরা একজন মানুষ অন্য মানুষকে যতটা জানি, ততটা কিন্তু বুঝতে পারি না। এই কারণে অনেক সময় মুখ ও কথা দিয়ে সেই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাইছি?’

-‘কারও বাহ্যিক আচরণ দেখে তার ভেতরটা বুঝে ফেলা এত সহজ মনে হয় আপনার?’

-‘দেখুন, এতকিছু আমি জানি না। আর বুঝে ফেলব, এত ক্ষমতাও আমার নেই। সবার মন বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, সেটা আমি জানি। তবে এই দু’দিনে আপনাকে দেখে যতটুকু বুঝেছি, সেটুকুর ভিত্তিতে বলেছি। বাড়াবাড়ি কিছু বলে ফেললে আমি আসলেই দুঃখিত।’

এত যুক্তিতর্ক ভালো লাগছে না উজমার। ফারশাদের এই অদ্ভুত আচরণ, মন পড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা তার অবচেতন মনে ইতিমধ্যেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেসব প্রশ্ন তার দিকে ছুঁড়ে দিতেও কিঞ্চিৎ সংকোচবোধ হচ্ছে। সে এতদিন সবার কাছে মনের দুঃখ-কষ্ট চেপে রেখেছে। ভেবে এসেছে, মুখে সবসময় হাসি দেখলে মানুষ মানুষকে সুখী মানুষের একজন ভেবে বসে। তাকে দেখেও সবাই ভেবে এসেছে, সে আপাদমস্তক সুখী মানুষ। কিন্তু এই প্রথম, কেউ তার মুখের ভাবভঙ্গিতে বুঝে গেল, সে মুখে যা বলে ও করে, মনের ভেতর তার উল্টো চলে। ঠিক এই কারণেই ফারশাদের এতসব যুক্তিতর্ক মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না তার। জীবনে অসংখ্য পুরুষ মানুষের সাথে পরিচয় ঘটেছে। হসপিটালে অসংখ্য রোগীদের সাথে ভালোমন্দ কথাবার্তা হয়েছে, টানা দুই-তিনদিনের বেশি সময় রোগীদের সেবাশুশ্রূষা করে তাদেরকে জেনেছে, বুঝেছে। আবার অনিক, তাক্বদীম, কাইফ এই তিন বন্ধুর সংস্পর্শে থেকেও তার মনে হয়েছে, বাহ্যিক আচরণ দিয়ে ভেতরটা লুকিয়ে রাখা যায়। মনের মধ্যে যতই ঝড় চলুক, যতই ভাঙন হোক, কেউ সেইসব ঝড় ও ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না বলেই নিজেকে নিশ্চিন্ত মনে হতো এতদিন। অথচ আজ, দু’দিনের পরিচয়ে কোথা থেকে এসে একটা মানুষ তাকে বুঝিয়ে দিল, কাউকে কিছু বলতে গেলে জানতে নয়, বুঝতে হয়। এত সহজেই কেউ কেন তার মনের ভেতর বুঝে ফেলবে? এত ক্ষমতা কীসের জোরে হচ্ছে তার? এত আগ্রহই বা কেন? কীসের এত অধিকার? কীসের এত দায়বদ্ধতা? অসংখ্য প্রশ্ন মনে দানা বাঁধার পরও একটা প্রশ্নও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলতে পারল না উজমা। মনের এই তীব্র বেইমানীকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়ল। চোখদুটো ক্রমশ জ্বলে-জ্বলে উঠল। নিজের ওপরই রাগ হলো উজমার। জবাব না দিয়ে নীরবে পালিয়ে যেতে চাইল। পিছন থেকে আবারও ফারশাদ তাকে আটকে দিল,

-‘শুনুন।’

না চাইতেও দাঁড়াল উজমা। তবে পিছু ঘুরল না। ওড়নার প্রান্ত আঙুলের সাহায্যে প্যাঁচাতে শুরু করল। ফারশাদ দু’পা এগোলো। ট্রাউজারের পকেট থেক টিস্যুর প্যাকেট বের করে তা থেকে একটা টিস্যু উজমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘আমি বোধহয় আপনাকে কাঁদিয়ে ফেললাম। এটা নিন। চোখ মুছে ফেলুন জলদি। দেখতে খারাপ লাগছে।’

প্রচণ্ড রাগ হলো উজমার। জল টলমল চোখে ফারশাদের দিকে ফিরল। কণ্ঠে তীব্র রাগ জমিয়ে রেখে টিস্যু হাতে নিয়ে সেটা আবার ফারশাদের ডানহাতের ভেতর ঢুকিয়ে শক্ত মেজাজে বলল,

-‘এটা আপনার কাছেই রাখুন। আমার চোখের পানি এত সস্তা নয় যে, যারতার সামনে ঝরে পড়ে যাবে। আমি চোখের পানিকে কন্ট্রোল করতে পারি।’

উজমার হাতের চাপে ফারশাদ নিজের হাতে সামান্য ব্যথা পেয়েছিল, সেই ব্যথাতুর হাত ও মুখভরা হাসি নিয়ে সে একদৃষ্টিতে উজমার তাকিয়েই রইল। রাগে পুরোটাই জ্বলে উঠল উজমা। চোখের পানিকেও নিমিষেই কন্ট্রোল করে নিল। তা দেখে ফারশাদ হাসিমুখে বলল,

-‘অনেস্টলি, ইউ আর দ্য মোস্ট মিস্ট্রারিয়াস ওমেন আই হ্যাভ এ্যাভার মেট।’

মেজাজটা কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেল উজমার। হাত সরিয়ে ফারশাদের চোখের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-‘আপনি কিন্তু বেশি…।’

-‘লিসেন, বিউটিকুইন। আমি মিথ্যে কিছু বলছি না, আবার আপনার সাথে মজাও করছি না। আমি যা বলেছি, সত্যি বলেছি। লুক অ্যাট ইউওরসেলফ এন্ড ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট ইউ ওয়ান্ট।’

উজমা কঠিনচোখে চেয়ে থেকে বলল,
-‘কী বোঝাতে চান আপনি? আমি নিজেকে জানি না? বুঝি না?’

-‘অবশ্যই জানেন এবং বুঝেন। এজন্যই নিজেকে রহস্যের খাঁচায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। কারণ আপনি চান না, আপনার আপনিটাকে কেউ চিনে ফেলুক, বুঝে ফেলুক এবং আপনার চুপ থাকাকে আপনার দুর্বলতা ভাবুক। ক্লিয়ার?’

তর্কবিতর্কের ইতি টেনে দ্রুতপায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল ফারশাদ। উজমা দাঁড়িয়েই রইল। চেহারায় রাগ মিশে রইলেও চোখদুটোতে রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো। এই বিস্ময় দূর হতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল তার। উজমা বুঝতেই পারল না, একটা মানুষ তাকে এইভাবে যুক্তি দেখিয়ে নীরব করে দিল কীভাবে? কেন? এই লোকটার আসল সমস্যাটা কী? কী চায় সে?

***

সারারাত মাথা যন্ত্রণার কারণে ঘুম হয়নি উজমার। এপাশ-ওপাশ করে কোনোমতে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। সকালে বিছানা ছেড়ে সবার আগে উসমান ওয়াজেদের রুমে এসে দেখল, তিনি তখনও গভীরঘুমে আচ্ছন্ন। সবটাই ইনজেকশনের প্রভাবে হয়েছে। তিনি অসুস্থ দেখে এই রুমের দরজা সবসময়ই ফাঁক থাকে। সন্তানেরা বাবাকে নিয়ে ভয়ে থাকে দেখেই রাতে দরজা আটকিয়ে ঘুমোতে দেয় না। বলা যায় না, কখন কী হয়। ঘুমন্ত মানুষটাকে জাগানোর প্রয়োজন নেই দেখে, দরজা সামান্য ফাঁক রেখেই বাইরে এলো সে। রান্নাঘরের জানালা খুলে দিতেই হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। এখনও শীত ঝেঁকে বসেনি। তবে যথেষ্ট ঠাণ্ডা ও কুয়াশা আস্তরণে চারপাশ আবছা। দূরের সবকিছু ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। সূর্য্যিমামাও আজ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না। গুমোটবাঁধা এই পরিবেশই বলে দিচ্ছে, বৃষ্টি হবে। এই ঋতুদের যে আজকাল কী হয়েছে, ভেবে পায় না উজমা। যখন-তখন বৃষ্টি এসে বুঝিয়ে দেয়, সে বারোমাসি মেহমান। তার ঘোরাঘুরির শেষ নেই। সে সময়ে-অসময়ে আসবেই। কাউকে কিচ্ছুটি না বলে। অসময়ে আকাশের কান্নাকাটি খুব একটা খারাপ লাগে না উজমার। ভালোই লাগে। উপভোগ্য মনে হয়। কনকনে শীতে আচানক বৃষ্টি মন জুড়ে শীতলতার উষ্ণ চাদর বিছিয়ে দেয়। সেই চাদরে সর্বক্ষণ নিজেকে মুড়িয়ে রাখতে মন্দ লাগে না তার।

সকালের পুরো সময়টা জুড়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করছিল উজমা। ফারশাদ আজ ডানে-বামে তাকাচ্ছে না। সামনে যা পাচ্ছে, সেটা দিয়েই নাশতা শেষ করে নিচ্ছে। এইযে, সামান্য সবজি, রুটি, গোরুর গোশতের ঝুরঝুরে ভাজি, অবশ্য সেটা গতকাল রাতের খাবার থেকে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট গোশত থেকেই তৈরী করা। সবশেষে পাতলা লিকারের মশলাযুক্ত এক কাপ চা। এসব কি এই ছেলেটার জন্য যথেষ্ট? এরচেয়ে দামী খাবার দেয়ার মতো ক্ষমতা তো উজমা বা উসাইদের কারোরই নেই। পেটে না সইলেও এই বাড়িতে এটাই খেতে হবে। বড়োলোকের ছেলের জন্য দামী খাবার আর কী দিবে সে? ভেবে ভেবে উজমা অস্থির হয়ে উঠলেও নাশতাটা খুব তৃপ্তি নিয়েই শেষ করল ফারশাদ। বড়ো করে ঢেকুর তুলে পানি পান করে বলল,

-‘এখানে আসার পর খাওয়ার রুচি বেড়ে গেছে আমার। এত খাচ্ছি। ভয় হচ্ছে, ওজন বেড়ে যায় যদি!’

উসাইদ হাসতে হাসতে বলল,
-‘কী এমন খাচ্ছিস যে ওজন বেড়ে যাবে? তুই যা-ই খাচ্ছিস মেপে মেপে। রুটি খেলি একটা। গোশত নিলি এক চামচ। সবজি নিলি সেটাও এক চামচ। আর এক কাপ চা। এতটুকুতে ক্ষিধে মিটে? আমার তো মনে হচ্ছে, এইসব খাবার তোর পছন্দ হচ্ছে না দেখেই অল্প অল্প খাচ্ছিস।’

-‘যতটুকু খাচ্ছি, ততটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। অতিরিক্ত খেলে মোটা হয়ে যাব।’

-‘তাই বলে এত অল্প?’

-‘আচ্ছা, বাদ দেই। স্যারকে জানিয়েছিস, আমরা আজ তাঁকে দেখতে যাচ্ছি?’

-‘না, জানাইনি। স্যারকে সারপ্রাইজ দেব।’

-‘ওকে, তাহলে ওঠ। আর দেরী করলে বেলা বেড়ে যাবে।’

-‘তুই তৈরী হ, আমি আসছি।’

দুই বন্ধু চলে যাওয়ার পর মিশকাত ও ঊষাকে নিয়ে নাশতা শেষ করল উজমা। উসমান ওয়াজেদের খাবার তুলে রেখে দিল। আজ আর ভার্সিটিতে গেল না ঊষা। বাড়িতেই রইল। উজমার ডিউটি বিকেলে। আপাতত কোনো কাজ নেই কারও। তাই তিনজনে মিলে নিজেদের মতো গল্পগুজবে মেতে উঠল।

***

মুনাইম স্যারের বাসায় যাওয়ার আগে একটা শপিংমলে ঢুকল ফারশাদ ও উসাইদ। উদ্দেশ্য, স্যারের জন্য কিছু কেনাকাটা করা। ফারশাদের এখনও মনে আছে, শীতের প্রতিটি সকালে স্কুলের ক্যাম্পাসে সব সমবয়সী স্যারেরা মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি মনে করে স্যারের জন্য ব্যাডমিন্টন খেলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে ফেলল। বিল পে করতে গিয়ে বেখেয়ালিতে হাত ফসকে ক্রেডিট কার্ড পড়ে গেল নিচে। তাড়াহুড়ো করে সেটা তুলতে গিয়েই চোখ পড়ল শপিংমলের বাইরে একটা পার্কিং করা গাড়ির দিকে। তার মুখে মাস্ক। কেউ তাকে চিনতে পারছে না এখানে। এজন্য হৈ-চৈ হচ্ছে না। নয়তো নামকরা ক্রিকেটারকে কেউ এত সহজে ছাড়ে? হুট করেই কার্ডটা উসাইদের হাতে দিয়ে বলল,

-‘পেমেন্ট কর, আমি একটু আসছি।’

দৌড়ের ওপর রাস্তায় এলো ফারশাদ। বার কয়েক ‘তাহমীদ ভাইয়া, দাঁড়াও’ বলে ডাকও দিল। ব্যক্তিটি তার ডাক শুনলে তবে তো দাঁড়াবে? হন্যে হয়ে পার্কিংস্পট ও বাকি এড়িয়ায় দৃষ্টি রাখল। ইতিমধ্যেই মানুষটা গায়েব হয়ে গেল কী করে, বুঝে উঠতে পারল না। পুরো জায়গায় এদিক-ওদিক সবদিকে নজর দিয়ে হতাশ হয়ে কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। উসাইদ এসে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে গেল। হতাশাজনক গলায় বলল,

-‘এখানে একটু আগে তাহমীদ ভাইয়াকে একটা প্রাইভেট কারের সামনে দেখেছি।’

উসাইদ খুব অবাক হলো এই কথা শোনে। তাহমীদ এই শহরে কেন আসবে? সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আর ইউ শিওর?’

-‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ওটা তাহমীদ ভাইয়াই।’

-‘তুই ডাকিসনি কেন?’

-‘ডেকেছি, ভাইয়া হয়তো শোনেনি।’

-‘গাড়ি নম্বর দেখেছিস?’

-‘এতকিছু খেয়াল থাকে?’

চিন্তায় পড়ে গেল উসাইদ। কোনো উপায়ই খুঁজে পেল না। বলল,
-‘তুই কি ফারিশাবুকে দেখেছিস?’

দু’চোখ বন্ধ করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল ফারশাদ। বলল,
-‘না। তবে ভাইয়ার কোলে ছয়-সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছি।’

ফারিশা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাহমীদের হোস্টেল, কলেজ, হসপিটাল, এমনকি বাড়ির ঠিকানা বরিশালেও খোঁজ নিয়েছিল ফারশাদ। কোত্থাও বোন এবং তাহমীদের খোঁজ সে পায়নি। সে জানেও না, ফারিশা ও তাহমীদ একে-অন্যকে বিয়ে করেছিল কি-না। এতদিন পর তাহমীদকে দেখে ভেবেছিল, এইটুকু জিজ্ঞেস করবে, ‘ভাইয়া, আমার বুবু কোথায়? তুমি কি জানো, তোমার জন্য, তোমাকে ভালোবেসে, তোমার সম্মান বাঁচাতে বুবু ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে? তুমি কি জানো, আমার বুবু এখন কোথায় আছে, কেমন আছে?’ ভাগ্য তার সহায় হয়েও হলো না। একঝলকের জন্য তাহমীদের দেখা পেয়েও তার মুখোমুখি হতে পারল না। বড্ড যন্ত্রণা এসে চেপে বসল বুকে। হারিয়ে যাওয়া বুবুকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠল। সিদ্ধান্ত নিল, এখানকার প্রতিটা কোণায় কোণায় তল্লাশি চালাবে। যদি আবারও তাহমীদের দেখা পাওয়া যায়! যদি একবার জানা যায়, বুবু কোথায় আছে? এইটুকুর জন্য হলেও তাহমীদকে খুঁজে পাওয়া জরুরী। সে চিন্তিত মন নিয়েই আশেপাশে চোখ ফেলল। উসাইদ বলল,

-‘যাওয়া যাক?’

ফারশাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেও কিছু একটা কেনার বাহানায় আবারও মলে ঢুকল। বেরিয়ে এলো পনেরো থেকে বিশ মিনিট পর। ফিরে এসে বলল,

-‘স্যরি দোস্ত, একটা দরকারী জিনিস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।’

-‘কী?’

ফারশাদ একটা র‍্যাপিং পেপারে মোড়া চারকোণা ছোট্ট বক্স দেখিয়ে বলল,
-‘এটা।’

-‘কী এটা?’

-‘বললাম তো, দরকারী।’

বক্সটা পকেটে রেখে গাড়িতে উঠে বসল ফারশাদ। বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলল,
-‘লোকাল থানার সাহায্য নিব? যদি ওরা তাহমীদ ভাইয়ার খোঁজ দিতে পারে!’

-‘তুই কি নিশ্চিত, তাহমীদ ভাইয়া এখানেই? আর থাকলেও তার কাছে তুই বুবুর খবর পাবি?’

এই চিন্তা ফারশাদের মনেও এসেছিল। নিজের জন্মস্থানে যে ব্যক্তির ছায়া নেই, সে হয়তো জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য শহরে এসে ঘাপটি মারতে পারে। একটু সাচ্ছন্দ্য তো সবাই চায়। প্রাণভরে বাঁচতে চায়। কারও বেঁচে থাকা, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, এতে কোনো দোষ খুঁজে পায় না ফারশাদ। তার শুধু জানতে হবে একটা প্রশ্নের উত্তর। ফারিশা এখন কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরটা যদি পেয়ে যায়, এতগুলো বছর বোনকে ঘিরে যে যন্ত্রণার পাহাড় বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিল, তা থেকে সামান্য হলেও রেহাই পাবে। বোন বেঁচে আছে, সুখে আছে, ভালো আছে, এইটুকু জানার খুব প্রয়োজন তার। খুব প্রয়োজন। দুঃশ্চিন্তায় ঠিকমতো ভাবতেও ভুলে যাচ্ছে ফারশাদ। উসাইদ তাকে নিরুত্তর দেখে বলল,

-‘টেনশন নিস না, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।’

-‘পাব তো?’

-‘পাই বা না পাই, চেষ্টা তো করতে পারি।’

ওরা যখন মুনাইম স্যারের বাসায় পৌঁছাল, তখন বেলা এগারোটা। শীতের সকাল বলেই একটু দেরী করে বিছানা ছেড়েছেন মুনাইম হোসেন। রুমের জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে যখন দুটো টগবগে যুবক তার বাড়ির আঙিনায় পা ফেলেছে, অমনি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে তাঁর। চোখের সামনে ভাসছে ওদের শৈশব। তিনি অত্যন্ত খুশিমনে রুম ছেড়ে বেরোলেন। বসার ঘরের দরজা খুলে দিয়ে আগ্রহচিত্তে দুইবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বললেন,

-‘তোমাদের দেখে মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল আমার। এসো, এসো, ভেতরে এসো।’

দুইবন্ধু এগিয়ে এসে কদমবুসি করল। ফারশাদ বলল,
-‘আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার?’

মুনাইম হোসেন গালভরা হাসি দিয়ে বললেন,
-‘ক্রিকেট পাগল ছেলেকে আমি এত সহজে ভুলি কী করে? আমার ক্লাসে একটাই শাদ ছিল, যে কি-না ক্রিকেট খেলার জন্য ক্লাস ফাঁকি দিত। সে অবশ্য জানত না, তার সব ফাঁকিবাজি আমি আগে থেকেই বুঝতে পারতাম।’

ফারশাদ লজ্জামাখা একটা হাসি দিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। টুকটাক কথাবার্তা এগোনোর পর বলল,
-‘আমি ভাবতেই পারিনি, আপনি আমাকে এখনও মনে রাখবেন। এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, পারিবারিক চাপ, পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, সবকিছু নিয়ে অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। এখানে আসার সময়-সুযোগ হয়ে উঠেনি। এবার সুযোগ পাওয়াতে ভাবলাম, আপনাকে একনজর দেখে যাই। যদি কখনও আর সুযোগ না আসে? এজন্য।’

-‘আমি খুব খুশি হয়েছি, শাদ। উসাইদের সাথে আমার মাঝেমধ্যে হাট-বাজারে দেখা হয়। তোমার কথা জানতে চাইলে বলে, কোনো যোগাযোগ নেই। তোমরা এত ভালো বন্ধু ছিলে একসময়, এভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আলাদা হয়ে যাবে, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনী।’

এই কথার উত্তরে কিছু বলার মতো শব্দ ও বাক্য খুঁজে পেল না ফারশাদ। কেন যে দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর পথ দু’দিকে বেঁকে গিয়েছিল, সেটা আজও একটা প্রশ্ন ফারশাদের মনে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে উসাইদের দিকে তাকিয়ে রইল তার মনোভাব বোঝার আশায়। উসাইদও তাকাল। চোখাচোখি হলো দুই বন্ধুর। এরপর তাকে নীরব রেখে উসাইদ নিজেই বলল,

-‘ভাগ্যই একদিন আমাদের আলাদা করেছিল, স্যার। আবার ভাগ্যই আমাদের আজ এক করেছে।’

মুনাইম স্যার উপরনিচ মাথা নেড়ে বললেন,
-‘তোমাদের মধ্যে যোগাযোগ নেই, এটা শোনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমি খুশি হয়েছি, আবারও তোমাদের একসাথে দেখে। তোমরা মন থেকে একজন আরেকজনকে ভালো বন্ধু মানো, বিশ্বস্ত মানো, এজন্য নিয়তি আবারও তোমাদের এক হতে সাহায্য করেছে।

***

চলবে…