মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-০৬

0
51

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ছয়

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

হসপিটালের ডিউটি শেষ করে মিশকাতের সাথে প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছে উজমা। ফেরার পর থেকে দুঃশ্চিন্তায় পা ফেলতেও ভুলে গেছে মিশকাত। পায়ে পানি এসেছে ক’দিন ধরে। বেশি হাঁটাচলা করলে ফুলে যাচ্ছে আবার বেশিক্ষণ বসে থাকলেও পায়ের ফোলা আটকে রাখা যাচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শ বেশি বেশি পানি খাওয়া। আরও নানান কথা। ভাবীর এই সিচুয়েশন দেখে উজমাও ভীষণ ঘাবড়াচ্ছে। সবকিছু নরমাল তবুও ভয়ের শেষ নেই কারও। সে কোনো ধরনের রিস্ক নিতে চায় না। এজন্যই ডাক্তারের সাথে আগেভাগে আলাপ সেরে এসেছে। বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার আগে সিজারিয়ান অপশনে যাবে। এরজন্য অবশ্য হাতভরা টাকার দরকার। তাই আজ ফেরার পথে এটিএম বুথে গিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে জমানো কিছু টাকা হাতে এনে রেখেছে উজমা। যখনই টাকার দরকার পড়বে, কাজে লাগাবে এইভেবে।

উসাইদ বার বার মিশকাতকে বোঝাচ্ছে, তাকে সাবধানে হাঁটাচলা করতে বলছে। ভাই-ভাবীর এই করুণ অবস্থা দেখে এদিকে উজমা একা একাই প্রার্থনা করছে, কোনো ধরনের জটিল সমস্যা যেন না হয়। এরমধ্যেই উসাইদ বউকে বলল,

-‘তোমাকে কতবার বলেছি মিশকা, একটু সাবধানে হাঁটো। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, শেষমুহূর্তে তুমি বড়োসড়ো কোনো ঝামেলা বাঁধাবে। টেনশনে গলায় পানি নেই আমার।’

উসাইদের একশো এক সাবধানবাণী শুনতে শুনতে মিশকাত আহতস্বরে বলল,
-‘দুচ্ছাই, এত কথা বোলো না। ভালো লাগছে না। আমি তো সাবধানে পা ফেলছি-ই। এত জটিলতা থাকবে কে জানত! আর জীবনেও বাচ্চাকাচ্চা নেব না আমি। এই একটাকে টানতে গিয়েই জান শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার।’

দু’জনার এই রাগারাগির খণ্ডচিত্র দেখে উজমা বলল,
-‘খামোখা টেনশন করছ, ভাইয়া। ভাবীকেও অযথা কথা শুনাচ্ছ। ডাক্তার তো বলেছেন, ভয়ের কিছু নেই। এখনও আট থেকে দশদিন বাকি। তোমরা আগেভাগেই ঝগড়াঝাটি করে অহেতুক একে-অন্যের মাথা খাচ্ছ।’

এইটুকু বলে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ভাবী, যাও তো, রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এখানে থাকলে অকারণ রাগারাগি করবে। শেষে তোমাদের রাগ-অভিমান মিটাতে গিয়ে আমার সময় নষ্ট হবে।’

মুখভরা হাসি দিয়ে এক গ্লাস পানি খেল মিশকাত। ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। উসাইদ বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুই কি আমার বোন? মাঝেমধ্যে তোকে নিয়ে আমার এত কেন সন্দেহ হয়?’

-‘না তো, আমি তো তোমার বোন না। আমি হলাম তোমার বউয়ের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী। তাই তোমার চেয়ে তারদিকেই নজর দিই বেশি।’

বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গেল উসাইদ। উজমাও নিজের ঘরে এলো। প্রয়োজনীয় সবকিছু রেখে ফ্রেশ হলো আগে। বসার ঘরে তখন কেউ নেই। চারপাশে একনজর তাকিয়ে সোজা চলে গেল উপরে। সেখানে ছাদে বসে গল্প জমিয়েছেন উসমান ওয়াজেদ ও ফারশাদ। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পেল না সে। শুকনো কাপড়চোপড় নিয়ে আবারও নিজের ঘরে গিয়ে সেগুলো ভাঁজ করে রেখে দিল। ঊষার রুমে উঁকি দিয়ে দেখল বোন ঘুমাচ্ছে। তাকে আর বিরক্ত করল না। রান্নাঘরে এসে রাতে কী কী রান্না করবে, মনে মনে একটা হিসেব কষে নিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরের গেটে একাধারে শুধু লাতির আওয়াজ এলো। আচমকা প্রথম কয়েকটা আঘাত শোনে ভরকে গেল উজমা। পরপরই শোনা গেল,

-‘এই ইতরের বাচ্চা ইতর। বেরিয়ে আয়। তোর কতবড়ো সাহস দেখে ছাড়ব আমি। তোকে যদি জেলের ভাত না খাইয়েছি…।’

অনবরত গালি ও লাতির আওয়াজে অতিষ্ঠ উজমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হন্তদন্ত পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো উসাইদ। বোনের আতঙ্কিত মুখ দেখে জানতে চাইল,

-‘তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কে এইভাবে ধাক্কাচ্ছে?’

উজমা কিছু বলার আগেই আবারও গলার আওয়াজ শোনা গেল। উসাইদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দাঁত কটমট করে বলল,

-‘ওর সাহস হয় কী করে আমার বাড়িতে এসে, আমাকে গালিবকা দেয়ার?’

রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে উসাইদের। দাঁড়িয়ে থেকে এইসব গালিবকা হজম করতে পারল না সে। বাইরে এসে একহাতে গেট খুলে, অন্যহাতে শামীমের শার্টের কলার ধরে টেনে বাড়ির ভেতরে এনে ঝটপট গেট আটকে দিল। রাগতস্বরে জানতে চাইল,

-‘কী সমস্যা এখন বল। বাইরে দাঁড়িয়ে এত চিৎকার চেঁচামেচি কেন করছিস? এই অমানুষ, তুই জানিস না এটা ভদ্রপাড়া? জানিস না, এখানে ভদ্রলোকের সন্তানেরা বাস করে? তুই কি এখানকার সবাইকে তোর মতো পশু ভাবিস যে, গেটে লাতি মারছিস? তোর বাপের টাকায় কেনা বুঝি সব? আহাম্মক কোথাকার। জীবনে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না, না?’

সহসাই উসাইদের দিকে তেড়ে এলো শামীম। গলাটিপে ধরতে চাইল। উসাইদ শক্তহাতে তার হাত থামিয়ে দিয়ে বলল,
-‘গায়ে হাত দিবি না। ঝামেলাটা কী নিয়ে সেটা বলে চুপচাপ এখান থেকে চলে যা। নয়তো তোকে মেরে লাশ বানিয়ে দিতে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।’

রাগে উঠোনে লাতি মারল শামীম। বলল,
-‘তোর ওই নষ্টা বোনকে ডাক। সাকিবের গলায় ঝুলার এত তাড়া কেন ওর? বিয়ে ভাঙার পরও কোন মুখে উজমা ওর সামনে দাঁড়াল? বিয়ে ভাঙা নিয়ে কথা তো শুনিয়েছে আবার বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে গায়ে হাত উঠিয়ে এসেছে। তোর দামড়া বোনকে তুই সামলে রাখতে পারিস না? ওর শরীরে এত চুলকানি কেন?’

শামীমের এই লাগামছাড়া কথায় রাগ মাথায় চড়ে বসল উসাইদের। কোনোদিকেই তাকাল না আর। শক্ত হাতে শামীমকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,

-‘ও আমার বোন হয়, শামীম। ওর দিকে আঙুল তোলার আগে, নিজের দিকে তাকা একবার। আমাদের প্রত্যেকের শরীরে কিন্তু একই বংশের রক্ত বইছে। যার দিকে তুই নোংরা কালি ছুঁড়ে মারছিস, সম্পর্কে সে-ও তোর বোনই হয়। আমি তো কোনোদিন শাম্মা কিংবা উজমার মধ্যে পার্থক্য করিনি, তাহলে তুই কেন করছিস? যে কথা আমার বোনকে বললি, তা যদি তোর বোনকে বলি, শুনতে ভালো লাগবে?’

-‘আমার বোনকে তুই কেন এমন কথা বলবি? ও কি তোর বোনের মতো নষ্টা? দশব্যাটা নিয়ে ঘুরে? কখনওই না। তোর বোন তো…।’

উসাইদ থেমে থাকল না। প্রচণ্ড আক্রোশে বেশ কয়েকটা আঘাত করল শামীমকে। শামীমও ছাড় দিল না। হুটহাট শামীমের এই হিংস্র আচরণে দিক হারিয়ে ফেলল উসাইদ। বুঝতেই পারল না, শামীম কেন এখানে শাম্মাকে বা সাকিবকে টেনে এনে তার সাথে দ্বন্দ্ব করতে চাইছে। দু’জনের এই ঝগড়ায় ইতিমধ্যে ছুটে এলো উজমা। থামাতে চাইল দু’জনকে, কিন্তু পারল না। একা হাতে কোনোমতে নিজের ভাইকে শামীমের থেকে আলাদা করল আগে। উসাইদকে দূরে সরিয়ে শামীমকে সরাতে গেল। শামীম ক্ষ্যাপেটেপে অস্থির হয়ে উঠোনে থাকা বাঁশ হাতে নিয়ে উসাইদের মাথায় আঘাত করতে গেলে উজমা বাঁধা দিয়ে দাঁড়িয়ে শামীমকে আটকাতে চাইল। শক্তি দিয়ে পারল না। শক্ত হাতের শক্ত আঘাত মাথায় পড়াতে জোরেশোরে চিৎকার দিল উজমা। পরপরই মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। বোনের চিৎকারে দিশেহারা উসাইদ এবার তীব্র রাগে হিসহিসিয়ে উঠল। শামীমকে চড়, লাতি দিতে বাকি রাখল না। অসময়ে এই দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখে শ্বশুর, ননদ ও ফারশাদকে ডেকে আনল মিশকাত। উজমার রক্তাক্ত মাথা থেকে ভয়ে কাঁপতে শুরু করল সে। ঊষা ঘুমঘুম চোখে এসে বোনকে আগলে নিয়ে বারান্দায় বসল। ফারশাদ ছুটে এসে উসাইদকে থামাল। দু’জনকে জোরপূর্বক আলাদা সরিয়ে বলল,

-‘একটা মানুষ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে, সেদিকে কারও কোনো নজর নেই। এটা কোন ধরনের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা উসাইদ?’

উসাইদ গর্জে উঠে বলল,
-‘ওকে জিজ্ঞেস কর, ওর সাহস কী করে হয় আমার বোনকে আঘাত করার? কতক্ষণ ধরে যা-তা বলছে, অপমান করছে, আমার বোনকে অপমান করার দায়িত্ব কি আমি ওর হাতে দিয়েছি? অমানুষ একটা।’

শামীম নিজেও চেঁচিয়ে উঠল,
-‘যা সত্য তাই বলেছি। ভুল কিছু বলিনি আমি।’

দু’জনের ঝগড়াঝাটি থামাতে ফারশাদ বলল,
-‘আচ্ছা, বাদ দিন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি না করে, ঝামেলাটা কী নিয়ে হয়েছে, সেটা আগে আলাপ করুন। এরপর সমাধান করুন। যেকোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হলে সেটা আগে সমাধান করতে হয়, এভাবে গায়েপড়ে ঝগড়া করতে হয় না।’

উসাইদ পূণরায় বলল,
-‘ওর সাথে কোনো কথা নেই আর। এই অমানুষটাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বল। আমার বাড়ির সীমানায় আমি কোনো শত্রুকে দেখতে চাই না।’

-‘মাথা গরম করিস না, উসাইদ। ঠাণ্ডা মাথায় ভাব। কী হয়েছে সেটা তো জানতে চাইবি, না-কি?’

-‘তোর কী ধারণা, আমি জানতে চাইনি? আমি ওকে ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করেছি, ও উত্তর দেয়নি। উল্টাপাল্টা কথা বলে গায়ের জোর দেখিয়ে আমার বোনের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে এসেছে। কত বড়ো বেয়াদব। ওর বেয়াদবি আজ আমি ছোটাব।’

-‘উফফ, তুই ঘরে যা। দেখ, তোদের এই মারামারিতে কার ক্ষতি হয়েছে। উজমার ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট দরকার। কাছেপিঠে কোনো নার্সিংহোম আছে?’

শামীম নিজেও অসহায় চোখে উজমার দিকে তাকাল। সে এইভাবে আঘাত করতে চায়নি, কিন্তু কীভাবে যেন ভুলটা হয়ে গেল। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওই রক্তাক্ত মুখখানি দেখার ধৈর্য্য নেই তার। উসাইদ ছুটে এলো বোনের পাশে। হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলে উজমা ধীরস্থিরভাবে বলল,

-‘আমি ঠিক আছি, ভাইয়া। এই সামান্য কারণে নার্সিংহোম যাওয়ার দরকার নেই।’

উজমা কোথাও গেল না। রক্তাক্ত মাথা নিয়ে ঘরে এসে সোফায় বসল। যতটুকু আঘাত লেগেছে তাতে যে মাথা দু’ভাগ হয়নি, এই ভাগ্য। শামীম ফাঁক দিয়ে পালাতে চাইলে উসাইদ তাকে ধরেবেঁধে ঘরে নিয়ে এলো। ধাক্কা দিয়ে উসমান ওয়াজেদের পায়ের কাছে ফেলে বলল,

-‘দেখো বাবা, যাদের মুখের হাসির জন্য নিজের সহায়-সম্পত্তি একদিন দান করে এসেছিলে, আজ সে-ই পিঠপিছে ছুরি বসাতে চাইছে।’

উজমার বিয়ে ঠিকঠাক এটা শামীম মানতে পারেনি। পারিবারিক যত দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন, উজমা কিংবা ঊষার ওপর তার কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। তবে আচমকা বিয়ের খবর শোনে মনের ওপর বিশাল টনের পাথর পড়েছিল। সেই পাথরের আঘাতে নাস্তানাবুদ শামীম, দিক খুঁজে পাচ্ছিল না। কী করবে, কীভাবে কার কাছে সাহায্য চাইবে, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তার। চটজলদি সমাধান হিসেবে যা মাথায় এসেছে, সেটাই বলেছে। এইসব বলার উদ্দেশ্য ছিল উজমার বিয়ে ভেঙে দেয়া। এরপর বাবাকে সাথে নিয়ে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া। কিন্তু ঝামেলা বাঁধিয়েছে সাকিব। সে সবকিছু উজমাকে বলে দিয়েছে। নামও প্রকাশ করে ফেলেছে। যার কারণে সাকিবের মুখ থেকে সব শোনে মাথা গরম করে এখানে ছুটে এসেছে। কোনো কাজে অসৎ পন্থা অবলম্বন করার পরিমাণ যে কতটা ভয়াবহ, এখন সে তা টের পাচ্ছে। কিন্তু এতে লাভ কী? উজমা তো কলঙ্কিত হয়ে গেল। অথচ শামীম সেটা চায়নি। কাজটা আবেগের বশে করে ফেললেও এখন সে যথেষ্ট অনুতপ্ত। তবে কেউ যে তার মনের কথা বিশ্বাস করবে না আর এটা সে বুঝে গেছে। তাই নিজের মনের সুপ্ত চাওয়াকে গোপনেই পুঁতে ফেলে বলল,

-‘তোমরা আমাকে ভুল বুঝছ। উজমা নিজেই সাকিবের কাছে গিয়ে ওকে অপমান করে এসেছে।’

ঊষা যত্ন নিয়ে বোনের ড্রেসিং করে দিচ্ছিল। উজমা চুপচাপ বসে শামীমের কথা শুনছিল। এমন কথা শোনে সে বলল,
-‘কেন অপমান করেছি, সেটা বলেনি?’

অপরাধী মুখ নিয়ে উজমার দিকে তাকাল শামীম। উজমা বলল,
-‘কী হলো? চুপ করে আছো কেন? আর কিছু বলেনি?’

-‘সাকিব তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল।’

-‘কেন করেছে? সাকিব যা বলেছে, সব তো তোমার বলা কথা। তুমি কেন আমার নামে এই বদনাম রটিয়েছ?’

-‘এখন যদি আমি কিছু বলি, তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না, উজমা। তা-ই আমি আর কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না।’

-‘তুমি যদি একবার বলতে, সাকিবের সাথে তুমি শাম্মার বিয়ে দিতে চাও, আমি নীরবে সরে দাঁড়াতাম ভাইয়া। কোনো প্রতিবাদে যেতাম না। অথচ তুমি যা করলে…।’

-‘আমি আসলে…।’

-‘একটা সত্যি কথা কী জানো, ভাইয়া? তোমরা কোনোকালেই আমাদের ভালো চাওনি। যখন আমরা জয়েন ফ্যামিলিতে ছিলাম, মাকে সবাই নানাভাবে টর্চার করেছ। কখনও রান্না নিয়ে, কখনও খাবার-দাবার নিয়ে আবার কখনও ঘর-সংসারের নানান ঝামেলা নিয়ে। তোমাদের সুখের কথা ভেবেই মা কোনো প্রতিবাদ করেনি কোনোদিন। সব অধিকারকে মাটিচাপা দিয়ে ওই সংসারকে ত্যাগ করে ভাড়াবাসায় থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা। তবুও কেউ তোমাদের সুখে বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি। আজ যখন আমরা আলাদা থাকতে শিখেছি, বাঁচতে শিখেছি, তখন তোমাদের এত অসুবিধা হচ্ছে কেন, বলবে?’

-‘তুই ভুল ভাবছিস। তোরা সুখে থাকলে আমাদের কেন অসুবিধা হবে?’

-‘তাহলে এই মিথ্যে বদনাম কেন রটিয়েছ?’

-‘সবটাই কি মিথ্যে, উজমা? কিচ্ছু সত্যি না?’

দু’চোখ বন্ধ করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল উজমা। চোখ খোলে শামীমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘না, কিচ্ছু সত্যি না।’

-‘আমি কি ভুল জানি?’

শামীমের এই প্রশ্নে হতবাক হয়ে গেল উজমা। কী জানে শামীম, কতটা জানে? কী বুঝাতে চায় সে এসব বলে? একটা মানুষ নিজের সম্পর্কে কী ভুল জানে? নিজেকে কি সে ভুল চিনে? নিজের চাইতে তাকে কতটা চিনে বাইরের মানুষ? কতটা বুঝে? কেউ কিচ্ছু জানে না, বুঝেও না। এই কথার উত্তরে শুধু জানতে চাইল,

-‘কী জানো তুমি?’

দু’হাতে মুখ মুছল শামীম। ধীরপায়ে হেঁটে এলো উজমার সামনে। পাশাপাশি বসার কিংবা দাঁড়ানোর সাহস হলো না। খানিকটা দূরে থেকেই বলল,

-‘তোরা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতি, ওখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল কোনোদিন? খুব খারাপ কিছু ঘটেছিল তোর সাথে?’

হুট করে আকাশে বিদ্যুৎ চমকিয়ে মুহূর্তেই যে ভয়ানক বজ্রপাতের সৃষ্টি করে ঠিক সেরকমই একটা বজ্রপাত নিঃশব্দে, নীরবে, অতি গোপনে তছনছ করে দিল উজমাকে। হতবাক দৃষ্টি দিয়ে উসাইদের দিকে তাকাল। উসাইদ নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল,

-‘তুই জানিস কী করে?’

-‘শুনেছি।’

-‘ওহ, এই কারণেই তোর ধারণা হয়েছে উজমা নষ্টা? দুঃশ্চরিত্রা? খারাপ? চরিত্রহীন?’

শামীম কথা বলতে পারল না আর। উসাইদ দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলল,
-‘গ্রেট। অনেক খবরই জেনে গিয়েছিস তুই। এ-ও বুঝে গিয়েছিস, আমার বোন খারাপ। তাই তাকে আরও দশজনের কাছে খারাপ সাজাতে বদনাম রটিয়েছিস। বেশ করেছিস। এ-র মাধ্যমে আমরা আমাদের কাছের শত্রুকে চিনে নিলাম।’

-‘ব্যাপারটা এরকম নয়, উসাইদ। আমি আসলে…।’

কপালের উপরিভাগে যে অংশে আঘাত লেগেছে, সেখানে সেলাই না লাগলেও যথেষ্ট ব্যথা হচ্ছে। রক্তে একেবারে মাখামাখি অবস্থা। পুরো জায়গাটা ব্যথায় টনটন করার পাশাপাশি সমস্ত শরীরেও ব্যথা ধরিয়েছে। সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। আর নেয়া যাচ্ছে না। ধৈর্য্য হারিয়ে উজমা এবার চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-‘তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও, শামীম ভাইয়া। তোমার এই চেহারাটা আর দেখতে চাই না আমি। তুমি কোনোদিন আমার সামনে আসবে না। কোনোদিনও না।’

শামীম কোনোমতে উচ্চারণ করল,
-‘আ’ম স্যরি, উজমা। আমার ভুল হয়েছে।’

এখানে বসে থেকে এই মানুষটাকে সহ্য করার মতো মনোবল আর নেই উজমার। ব্যথাতুর শরীর নিয়ে চলে গেল নিজের রুমে। শামীম নিরুপায় হয়ে উসাইদকে বলল,

-‘যে কলঙ্ক আমি নিজে ছুঁড়েছি, তার দায় যদি নিজেই নিতে চাই, ক্ষমা পাব?’

উসাইদ বলল,
-‘কী বলতে চাস তুই?’

-‘আমি উজমাকে বিয়ে করতে চাই।’

এই কথায় কারও মনে কোনো প্রতিক্রিয়ার জন্ম না দিলেও ফারশাদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
-‘তুই ব্যাটা জাহান্নামে যা। তোর সাথে উজমার বিয়ে হবে না। আমি হতে দেব না। কোনোভাবেই না। আমার না হওয়া সম্পদের দিকে নজর দিচ্ছিস, না? তোর চোখদুটো আমি গিলে খাব। দেখে নিস।’

শামীমের এই অযৌক্তিক প্রস্তাব মেনে নেয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না উসাইদ। সে শুধু শক্তমুখে বলল,
-‘যে বাড়িতে আমার মা কোনোদিন সম্মানের সাথে ঘর-সংসার করতে পারেনি, সে বাড়িতে আমি আমার বোনকে পাঠানোর কোনো কারণই দেখছি না। ওর যদি সারাজীবন বিয়ে না-ও হয়, তবুও আমি আমার বোনকে তোর সাথে বিয়ে দেব না, শামীম।’

-‘আমি তো আমার ভুল স্বীকার করছি। তাহলে কেন দিবি না?’

-‘সম্পর্ক ভুল স্বীকার করে নিলেই সহজ হয় না, শামীম। যেকোনো একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তুই অলরেডি ধরে নিয়েছিস, উজমা অপবিত্র, খারাপ। সত্য-মিথ্যা যাচাই করিসনি। ওর ওপর তোর এমনিতেও আর বিশ্বাস নেই। ওকে কলঙ্কিত করতে দু’বার ভাবিসওনি তুই। গায়ে হাত তুলে আবার রক্তাক্ত করেছিস। যার কাছে আমার বোনের ইজ্জতের দাম নেই, জীবনের দাম নেই, তার কাছে আমি বোনকে তুলে দেব, এতটাও বোকামি আমার দ্বারা হবে না। প্রয়োজনে বোন চিরকাল আমার কাছে থাকবে, তবুও তার সম্মান নষ্ট করছে, এমন কারও হাতে আমি ওকে তুলে দিতে পারব না। তুই চলে যা।’

-‘তুই একবার আমার দিকটা ভাববি না?’

-‘তখন ভাবতাম, যদি তুই সম্মানের সাথে ওকে আমার কাছে চাইতি।’

উপায়ন্তর না পেয়ে উসমান ওয়াজেদের হাত ধরে তার কাছে উজমাকে ভিক্ষা চাইতে শুরু করল শামীম। উসমান ওয়াজেদ কিছুই বললেন না। শামীমের কথা তিনি একদিকে শুনছেন, আরেকদিকে বের করে দিচ্ছেন। মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁর চেহারার ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসছে না। নির্বিকার এই ভাবটা সহ্য হলো না শামীমের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলে যাচ্ছি, চাচ্চু। যদি কোনোদিন উজমার বিয়ে হয়, সেটা আমার সাথেই হবে। অন্য কোথাও আমি ওর বিয়ে হতে দেব না। আজ রক্তাক্ত করেছি, অন্যদিন জানে মেরে ফেলব।’

ফারশাদ জানে, সে এই পরিবারের আপন কেউ না। কিন্তু মন একবার কারও মায়ায় ডুবে গেলে, তার কারও না হয়েও সেই মানুষটার অপমান, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করা যায় না। উজমার ওপর উড়ে আসা এই অপমান ও কলঙ্ক তার সহ্যের বাইরে চলে গেল। ধৈর্য্য হারিয়ে একটা সময় প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘এটা কোন ধরনের প্রস্তাব, শামীম ভাই? যার সম্মানের ছিঁটেফোঁটা মূল্য আপনার কাছে নেই, তাকে কেন বিয়ে করবেন আপনি? আমি আপনার অনুভূতিকে অসম্মান করছি না। কিন্তু আপনি ভেবে দেখুন, এতকিছুর পরেও আপনার কাছ থেকে এই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়া কতটুকু সহজ? আপনি নিজে হলে নিশ্চয়ই এত সহজে এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারতেন না।’

শামীম রেগেমেগে বলল,
-‘আমি কী মানব, কী মানব না, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে এখানে নাক গলাতে কে বলেছে? কে আপনি এই পরিবারের? কেউ না। আপনি একজন বাইরের লোক। বাইরের লোক হয়ে আপনি কেন এত মাথা ঘামাচ্ছেন? আমাদের ব্যাপারটা আমাদেরকেই বুঝে নিতে দিন।’

-‘হ্যাঁ, আমি বাইরের লোক। এখানে কথা বলাটা আমার সাজে না। কিন্তু ঘরের লোক হয়েও আপনি যা করেছেন, তা কি আপনার সাজে? নিশ্চয়ই না। যা আপনি করলে ঠিক, তা আমি বললে ভুল হবে কেন?’

ফারশাদের চোখের সামনে তুড়ি বাজাল শামীম। আঙুল নাড়িয়ে বলল,
-‘হিরো সাজতে চাইছেন, তাই না? এত সহজ? আমিও দেখে নিব, উজমার বিয়েটা হয় কী করে! আমার সামনে দিয়ে যার হাত ধরে ও এই বাড়ি ছাড়বে, তাকেসহ লাশ বানিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দেব।’

চট করে শামীমের হাতের আঙুল ধরে ফেলল ফারশাদ। খানিকটা জোর দিয়ে মুচড়ে দিল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘হাতটা নিচে রাখুন। সব জায়গায় গলাবাজি খাটে না, এটা মাথায় রেখে চলবেন। আমি চাইলে এক্ষুণি আপনাকে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেটা করব না। তবে আপনি যা করেছেন, সেই হিসাবটা অবশ্যই চুকাবেন। দেখব কবে, কখন, কীভাবে আপনি উজমার বিয়ে ঠেকান।’

-‘আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন আপনি?’

-‘অফকোর্স।’

-‘ওকে, তৈরী থাকুন। খুব শীঘ্রই উজমার বিয়ে আমার সাথে হবে।’

-‘আচ্ছা। দাওয়াত দিবেন নিশ্চয়ই?’

ফারশাদের এই ঠাণ্ডা মাথার কথা শোনে রেগেমেগে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল শামীম। ফারশাদ শুধু হাসল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখল, দুঃশ্চিন্তায় তার আধমরা অবস্থা। এরকম সিচুয়েশনে বন্ধুকে কীভাবে সান্ত্বনা দেয়া উচিত, জানা নেই তার। সে শুধু জানে, শামীমের মতো নোংরা মন-মানসিকতার মানুষের নোংরা ছোবল ও ঘৃণিত দৃষ্টি থেকে উজমাকে বাঁচাতে হবে। আর সেটা যেকোনোভাবে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।

***

চলবে…