মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-০৯

0
61

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – নয়

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

দুপুরের শেষভাগে হসপিটালের নির্দিষ্ট নিয়মে যে ডিউটি শুরু হয় উজমার, সেটা রাত আটটায় শেষ হয়। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটা সিএনজি নিলে, তাদের এলাকার মূল সীমানায় আসতে সময় লাগে পনেরো মিনিট। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি পর্যন্ত পায়ে হাঁটার রাস্তা আরও দশ মিনিটের মতোই। রিজার্ভ ছাড়া, লাইনের গাড়ি এইদিকে আসে না বলেই ওইটুকু রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়। রাস্তাটা আবার বালির। তারউপর কনক্রিট ও বালির আস্তরণ থাকায় বৃষ্টিবাদলের সময়ে কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে যায় না। যথেষ্ট সুন্দর থাকে রাস্তাটা। প্রতিদিনের মতো ডিউটি শেষ করে বাড়ির রাস্তায় আসতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। একে তো রাত, ঠাণ্ডা আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও। একা চলার অভ্যাসের কারণে এসব পরিস্থিতিতে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে সে। গাড়ি থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকাল। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির মাত্রা বোঝার চেষ্টা করল। যখন দেখল, বৃষ্টি তুলনামূলক কম তখন মুচকি হেসে চাদরটা গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে গুটি গুটি পা ফেলে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল। উজমার একটা বদভ্যাস হচ্ছে, বৃষ্টি এলে সুযোগ পেলে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেজা। সঙ্গে ছাতা থাকার পরও সেটা ব্যবহার না করে ব্যাগের ভেতর রেখে দেয়। খুব বেশি প্রয়োজন দেখলে তাহলেই এর যথাযোগ্য ব্যবহার করে। আজ যেহেতু বৃষ্টি কম, ছাতা প্রয়োজন নেই মনে করে সেটা ব্যাগের মধ্যেই রেখে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছিল সে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্কুল ও গ্রামের ঈদগাহ পের হয়ে যখন এই এলাকার স্থানীয় মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল, হুট করেই টের পেল, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা-ও ছাতাসমেত। যার কারণেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা সে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারছে না। হাঁটা থামিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়ে পিছনে ফিরেই চমকে গেল উজমা। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-‘সামান্য ভদ্রতা নেই আপনার মধ্যে? এভাবে এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন? আপনি এখানে কী করছেন? আমাকে ফলো কেন করছেন?’

নির্লজ্জের মতো হাসল সাকিব। বলল,
-‘আপনি ভিজে যাচ্ছিলেন!’

-‘তো?’

-‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’

-‘এতে নিশ্চয়ই আপনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ছাতাটা সরান। অসহ্য লাগছে।’

উজমার রাগ ও বিরক্তি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ছাতা নিজের দিকে টেনে নিল সাকিব। বলল,
-‘আমি জানি, আপনি আমার ওপর এখনও রেগে আছেন।’

-‘তা-ও কেন এসেছেন? এখানে নিশ্চয়ই আপনার কোনো আত্মীয় নেই!’

-‘আপনার ফোন বন্ধ পাচ্ছি, উজমা। কিছু কথা বলার ছিল আমার।’

-‘প্রথমত, এটা রাস্তা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনার সাথে এভাবে কথা বলাটা অশোভনীয়। দ্বিতীয়ত, আপনি এমন কেউ নোন যে, আপনার সাথে আমাকে কথা বলতেই হবে। তৃতীয়ত, আমি আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।’

সাকিব অপরাধমুক্ত হওয়ার বাহানায় ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
-‘আমি আসলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। একে তো আপনাকে অসম্মান করেছি, আবার আপনাকে কষ্ট দিতে আপনারই কাজিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কিছু হয়তো আপনার মনে প্রভাব ফেলছে। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। সেজন্য…।’

কথা শেষ করতে পারল না সাকিব। উজমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বলল,
-‘আচ্ছা মানুষ তো আপনি। মেয়েদের এত বোকা আর সরল-সহজ কেন ভাবেন আপনারা?’

-‘সরল-সহজ ভাবিনী, উজমা। আপনি কতখানি কঠিন ও শক্ত মনের মানুষ সেটা আমি বুঝে গিয়েছি। আপনার এমন অদ্ভুত ব্যবহারই আমাকে আরও অপরাধী বানিয়ে দিয়েছে।’

উজমা সত্যি সত্যি ভীষণ বিরক্ত হলো সাকিবের এই আচরণে। একজনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আরেকজনের সাথে ক্ষমা চাওয়ার বাহানায় এত নাটকীয় কাহিনী সাজানোর কোনো মানেই খুঁজে পেল না। তার কেবল মনে হলো, সাকিব তাকে কথার দ্বারা দুর্বল করতে নেমেছে। একটু নরম করে কথা বলে, সদ্য ভাঙা মনের ক্ষতটাকে আরও গভীর করতে চাইছে। শত হলেও সাকিব সেইসব পুরুষদের আওতায় পড়ে, যারা নারীর মনকে ফেলনা ভেবে বারেবারে আঘাত দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পায়। সে কঠিন গলায় দুটো কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মাত্র। ঠিক সেই সময়ই মন্দির লাগোয়া পিছনের বাড়ির অন্নপূর্ণা ছাতা মাথায় দৌড়াতে দৌড়াতে তার দিকেই এগিয়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে অন্নপূর্ণা বলল,

-‘দিদি, তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়িতে এসো। বৌদি খুব অসুস্থ। আমি তোমাকে আনতে তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, রাস্তায় বেরিয়ে দেখি তুমি এদিক থেকে ফিরছ। চলো না আমার সাথে।’

উজমা কিছু বলার আগেই একহাতে তাকে টানতে টানতে নিজেদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল অন্নপূর্ণা। উজমা নিজেও সুযোগ পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পিছনে তাকানোর ইচ্ছে হলো না আর। সে-ও দ্রুতপায়েই এগোলো রোগী দেখার উদ্দেশ্য।

***

অন্নপূর্ণার বড়ো ভাই অরুণ দাস প্রবাসী। বিয়ে করেছে, দেড় বছর আগে। আগে একটা কসমেটিকসের দোকানে বেচাকেনা করত। সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতেই মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে মাস তিনেক আগে। তখনও অরুণের স্ত্রী অঞ্জলি জানত না সে গর্ভবতী। পরে অবশ্য ডাক্তার দেখিয়ে জেনেছে। এখন এই মাঝামাঝি সময়ে এসে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেখিয়েছে তার, যার কারণে ডাক্তার আর বাড়ি দৌড়াদৌড়ি চলছে। বাড়িতে বুঝদার আর কেউ নেই। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অরুণের মা মণিদীপার এই ছোট্ট সংসার। স্বামী নেই। সংসার দেখাশোনা করে রাখবে, এমন বাড়তি কেউ নেই। সব ঝড়ঝাপটা তিনি ও মেয়ে অন্নপূর্ণাই সামলায়। সে এখন চঞ্চল কিশোরী, পাশাপাশি একমাত্র বৌদির এই বিপদের সময়ের বিশ্বস্ত সঙ্গীও বটে। অঞ্জলির শারিরীক অবস্থা হাঁটতে হাঁটতে জেনে নিল উজমা। বাড়িতে পা রাখতেই মণিদীপা দৌড়ে এলেন উজমার দিকে। শুকনো একটা গামছা দিয়ে বললেন,

-‘ভিজে একী অবস্থা মা! ঠাণ্ডা লাগবে তো।’

উজমা হাসিমুখে উত্তর দিল,
-‘কিছু হবে না, কাকীমা। অভ্যাস আছে। কই, বৌদি কই?’

-‘বিশ্রাম নিচ্ছে। ভেতরে এসো।’

যেকোনো অসুস্থতার সময়ে মণিদীপা উজমাকে খুব ভরসা করেন। কখনও কোনো প্রয়োজন পড়লে, বিপদ দেখলে চট করে মেয়েকে দিয়ে ডাক পাঠান। উজমা বাড়িতে থাকলে কারও ডাকে সাড়া দিবে না, তা হয় না। প্রয়োজনে নিজের কাজ সে ফেলে আসতে রাজি। তবুও কাউকে অসুস্থ অবস্থায় কাতরাতে দেখতে রাজি না। রুমে প্রবেশ করে উজমা দেখল, অঞ্জলি একপাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে। পুরো শরীর তার লেপ দিয়ে মোড়া। সে পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে বলল,

-‘কী অবস্থা বৌদি? এত ঘনঘন অসুস্থ হও কেন তুমি? তোমাকে না বলেছি, টেনশন ফ্রি থাকতে। বাড়ালে তো নিজেরই ক্ষতি। এখন সামলাবে কে? দাদা তো দেশে নেই। তোমাকে নিয়ে ছুটতেও পারবে না।’

অঞ্জলি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল,
-‘আর বোলো না। নিজের শরীরের এই অবস্থা দেখে মনে আর জোর পাই না।’

-‘তা বললে তো হবে না। তোমাকে সবকিছুর আগে ভাবতে হবে, তুমি একটা প্রাণকে নিজের অভ্যন্তরে আগলে রেখেছ। অবশ্যই সময়ে-অসময়ে তার খেয়াল রাখা উচিত তোমার। তুমি অসুস্থ হলে, তারও ক্ষতি। এটা ভুলে যাও কেন?’

ম্লানমুখে উজমার সব কথা শোনে নিশ্চুপে আধশোয়া হয়ে বসল অঞ্জলি। উজমা অন্নপূর্ণাকে ডেকে বলল,
-‘এ্যাই, পূর্ণা। রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন দেখি তো।’

অন্নপূর্ণা আলমারি থেকে রিপোর্ট বাড়িয়ে দিল উজমার দিকে। উজমা সেটা দেখল, ঔষধ চেক করল। সাথে রক্তশূণ্যতার কারণটাও দেখে নিল। নিজের ব্যাগে থাকা বাড়তি কেনোলা বের করে সেটা অঞ্জলির হাতে গেঁথে শরীরে দ্রুত রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে এমন একটা ইনজেকশন সেলাইনে প্রবেশ করিয়ে সেটা বিছানার স্ট্যান্ডের সাথে আটকে অঞ্জলির হাতে পুশ করে দিল। এরপর আবার অন্নপূর্ণাকে বলল,

-‘সেলাইন শেষ হলে নিজে খুলতে না পারলে আমাকে কল করবি। যত রাতই হোক, আমি আসব। ঠিক আছে?’

-‘আচ্ছা। চলো, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’

অন্নপূর্ণা সঙ্গে যাবে দেখে মনে বেশ সাহস পেল উজমা। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, সাকিব নামক খচ্চর লোকটা এখনও ওখানে আছে। যেভাবে পিছু নিয়েছে। কী চায়, বোঝা কঠিন। এসব মানুষকে খুব ভালোভাবে চিনে উজমা। এক শামীমই তার কত প্রমাণ দিল। শামীমের কথা মনে হতেই ঘৃণায় গা ঘুলিয়ে উঠল উজমার। তড়িঘড়ি বিদায় জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। মণিদীপা তাকে আটকে দিয়ে বললেন,

-‘খালি মুখে যেতে হয় না, মা। কিছু মুখে দিয়ে যাও।’

-‘কাকীমা, এখন কিছু খাব না। হসপিটাল থেকে ফিরছি মাত্র। দেরী হলে ভাবী টেনশন করবে। আজ যাই, অন্যদিন অনেককিছু খেয়ে খাব।’

দোনোমোনো মন নিয়ে বারান্দায় এলো উজমা। বৃষ্টি মাত্রা ছাড়িয়েছে। এতক্ষণ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও এখন বেশ শব্দ করে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বাড়ি খাচ্ছে। এই ভারী বৃষ্টি দেখে উজমা বলল,

-‘পূর্ণা, তোর আসার দরকার নেইরে। তুই বৌদির খেয়াল রাখ। আমি একাই চলে যাব।’

-‘ভয় পাবে না তো?’

-‘আরেহ্, দূর। ভয় কেন পাব? তোর এখন বৌদির কাছে থাকা জরুরী। তুই ভেতরে যা। প্রয়োজন পড়লে কল করবি অবশ্যই।’

ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে ঘর ছেড়ে ধীরপায়ে রাস্তায় এলো উজমা। মন্দিরের কিছু অংশ পেরিয়ে মোড় ঘুরতেই সাকিবকে রাস্তার একটা টং দোকানে দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেল। ছেলেটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে তা-ও আবার হিন্দুবাড়ির দিকে চোখ গিলে রেখেছে। এখন সামনে যাওয়া মানে, যেচে বিপদ ঘাড়ে নিয়ে নাচা। এমন উটকো ঝামেলা কেন যে জীবনে জড়িয়ে গেল, ভেবে পেল না উজমা। সাত-পাঁচ ভেবে বাসায় কল করল। মিশকাতকে বলল,

-‘ভাবী, ভাইয়াকে একটু মন্দিরের পিছনের দিকে আসতে বোলো। আমি ওখানেই আছি। সামনে সাকিব যেচেপড়ে ভাব জমাতে চাইছে। আমার এত বিরক্ত লাগছে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’

-‘তোর ভাই তো এখনও ফিরেনি। আচ্ছা, দাঁড়া দেখছি। তুই ওখানেই থাক। ওই ঝামেলাটার সামনে যাওয়ার দরকার নেই।’

ফোন রেখে এবার দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল উজমা। সে ভুলেই গিয়েছিল, মুনাইম স্যারের বাসা থেকে ফেরার পথে নিজের অফিসে ছুটি ম্যানেজ করতে গিয়েছে উসাইদ। নিশ্চয়ই বস আজ একগাদা কাজ দিয়েছে। বেচারা, ভাইটা। শান্তি পেল না। গড়িমসি করতে করতে উজমা সিদ্ধান্ত নিল, অন্নপূর্ণাদের বাড়িতেই ফিরে যাবে। কিন্তু মিশকাত যে তাকে এখানেই থাকতে বলল। উপায়ন্তর না পেয়ে দূর থেকে সাকিবকে নজরে রাখতে গিয়ে অপেক্ষা শুরু করল সে। কখন লোকটা সরবে আর কখন সে শান্তিতে এই রাস্তা ধরে বাড়ি পৌঁছাবে।

***

-‘এ্যাক্সকিউজ মি, উজমা। আপনি কি এখানে আছেন?’

দোকান থেকে সাকিব মন্দিরের সামনে এসে রাস্তায় নজর রাখছিল দেখে, ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল উজমা। আচমকা এই আওয়াজটা বজ্রপাতের মতোই শোনালো। ‘কে’ বলে ভয়ে পিছনে ফিরতেই বেহুঁশের মতো ধাক্কা খেল কারও সাথে। হাতের ছাতা ফেলে দিয়ে কোনোকিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় কারও বুকের কাছটায় খামচে ধরল। ফারশাদ নিজেও এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না মোটেও। তার হাতের টর্চটা হাত ফস্কে পড়ে গেল। বৃষ্টির পানিতে ধুয়েমুছে যাচ্ছে সবটাই। ভেজা মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া টর্চের আবছা আলোয় ফারশাদকে দেখে অবাক হয়ে বলল,

-‘আপনি!’

কথা আটকে গেল উজমার। দ্রুত সরে এলো দূরে। মিশকাতকে কী বলল, আর সে কী করল! তার আতঙ্কিত মনের জড়ানো স্বর শোনে ফারশাদ বলল,

-‘হ্যাঁ, আমি। ভাবী পাঠালেন। আপনি ঠিক আছেন?’

-‘জি, ঠিক আছি।’

ভিজেটিজে একাকার উজমা। ইচ্ছাকৃত ভেজা ও অনিচ্ছায় ভেজা, দুটোর মধ্যে তফাৎ অনেক। এইমুহূর্তে তার যা অবস্থা সেটা অনিচ্ছাকৃতই। ফারশাদ ডানে-বামে তাকিয়ে দেখল, সাকিব তাদের থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে। হয়তো দেখেছে, হয়তো না। নিজের বিরক্তি ও রাগ কোনোকিছুই প্রকাশ করল না। এই একেকটা পুরুষকে দেখে তার নিজেরই রাগ হচ্ছে। নিশ্চয়ই উজমার মনের অবস্থাও তার চেয়ে আরও ভয়ংকর। সে উজমার ভয়মিশ্রিত চেহারা ও ভেজা শরীর দেখে আড়চোখে সাকিবকেও দেখল। বদমাশ লোকটা যেন গিলে খেতে বসেছে। ইচ্ছে হলো, এক ঘুষি দিয়ে নাকমুখ পাঠিয়ে দিক এভাবে তাকিয়ে থাকার দোষে। অন্ধকারের মাঝে এভাবে তাকানোর কী! উজমাকে পুরোটা দেখা না গেলেও চারিদিকের বাড়িঘরের যত আলো আছে, সেটুকুতে দুটো মানুষের অবস্থান ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। নিজের বেখেয়ালি, বোকামির জন্য নিজেকে একগাদা বকাবকি করে ভেজা চাদরটা শরীরে ভালোমতো প্যাঁচানোর চেষ্টা করল উজমা। কষ্টে তার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। এরকম বেইজ্জতি তার কখনওই ভালো লাগে না। নিজেকে যখনই এরকম পরিস্থিতিতে দেখে, তখনই খুব অসহায় লাগে। তার গুটিসুটি ভাব দেখে ফারশাদ নিজের গায়ে জড়িয়ে থাকা ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট উজমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘এটা গায়ে জড়ান।’

উজমা দ্বিরুক্তি করল না। কেন যেন তার মনে হলো, এইমুহূর্তে তার ভেজা শরীর ঢেকে রাখতে এই জ্যাকেটটা চমৎকার কাজে দিবে। সে হাত বাড়িয়ে জ্যাকেট নিয়ে দ্রুত নিজের গায়ে জড়িয়ে বলল,

-‘আমাকে তো বাঁচিয়ে দিলেন, আপনি কী করবেন?’

-‘অসুবিধা নেই।’

ফারশাদের শরীরে তখনও ফুলহাতা টি-শার্ট। এর কারণে ঠাণ্ডা পরিবেশেও সে যথেষ্ট মানিয়ে নিতে পারছে। উজমা তখনও ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল দেখে ফারশাদ তাকে অভয় দিয়ে বলল,

-‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আসুন আমার সাথে।’

কোনোকিছু না ভেবেই ডানহাত বাড়িয়ে দিল ফারশাদ। উজমা স্তব্ধ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-‘আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? আমি একা চলে যেতাম।’

-‘আপনি একা পথ চলতে জানেন, সেটা আমি জানি উজমা। ভাবীর মুখ থেকে আপনার এখানে আটকে থাকার কথা শোনে মনে হলো, আমার এখানে আসা উচিত।’

উজমা হাত ধরল না, তবে খুব সাবধানে ছাতার নিচে এসে দাঁড়াল। নিজের ছাতা খুঁজতে গিয়ে দেখল, ওটা একটা বেড়ার সাথে কুস্তি খেলছে। ইতিমধ্যে বাতাসের তীব্র ঝড়ঝাপটায় উপরের অংশ বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করল সে। ফারশাদ উজমাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে নিজে ছাতার নিচ থেকে বেশ খানিকটা সরে গেল। এতে গায়ে গা লাগবে না, হাতে হাত লাগবে না, আর তারজন্য কারও সংকোচে পা ফেলতেও হবে না। সে যেভাবে হাঁটছিল, অর্ধেক ভিজে গেছে তাতে। উজমার সেদিকে খেয়াল নেই। সেই ভীতিকর চোখমুখ নিয়ে সাকিবকেই নজরে রাখতে ব্যস্ত ছিল। হুট করে তার কী হলো কে জানে! সাকিবের অমন লোলুপ দৃষ্টি দেখে সে হাত বাড়িয়ে ফারশাদের টি-শার্ট ধরে একেবারে কাছাকাছি এনে দাঁড় করিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘ভিজে যাচ্ছেন।’

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসি আড়াল করল ফারশাদ। সে উজমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা সাকিবকে ভয় দেখানোর জন্যই ইচ্ছে করে তাকে কাছে নিয়ে এসেছে, যেন ওই ব্যাটা বুঝতে পারে, সে এখন আর কারও দিকে তাকানোর মুডে নেই। যথেষ্ট নিরাপদে ও নির্ভয়ে আছে। হাসি লুকিয়ে বলল,

-‘ক্ষতি নেই, আপনি নিরাপদ থাকুন।’

-‘আমার জন্য কেউ ভিজেটিজে জ্বর বাঁধাবে, সেটা আমি চাইছি না, প্লিজ।’

-‘সত্যিই চাইছেন না, আপনার জন্য কেউ অসুস্থ হোক?’

-‘আশ্চর্য, এখানে মিথ্যের কী আছে?’

-‘ঠিক মিথ্যে নয়। তবে আপনি চাইছেন না, সাকিব আপনাকে একা বা ভীতু ভাবুক। কেউ আপনার সাহস হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটুকু বোঝাতেই আমাকে কাছে টেনেছেন। সুযোগ পেয়ে আপনি আমাকে ইউজ করছেন, উজমা।’

এমন স্বার্থপর ভাবনা উজমার মনে কখনও আসেনি। সে তো শুধু এতটুকু চেয়েছে, কাউকে তার পাশে দেখে সাকিব নিজে থেকে সরে যাক। আবার, তারজন্য কেউ ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাক। অন্যকে ভুগিয়ে নিজে কখনও স্বস্তি খুঁজে নিতে চাইছিল না উজমা। এজন্যই ফারশাদকে ছাতার নিচে টেনে আনা। এর মানে কী এই যে, সে তাকে ব্যবহার করছে? অপমানে মনের ভেতর বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল উজমার। যেভাবে টি-শার্ট ধরে কাছে টেনেছিল, সেভাবেই দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,

-‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’

আচানক ধাক্কায় ফারশাদ অবাক হয়ে গেল। সামান্য টলে গিয়েছিল সে, তবে পড়ে যায়নি। পা স্লিপ খেয়েছিল একটু। রাগ হোক কি অভিমান কোনো এক বিচিত্র কারণে ইচ্ছে করেই উজমার পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। নিজের হাতের মুঠোয় উজমার হাত চেপে ধরে বলল,

-‘ভাবীকে কথা দিয়েছি, আপনাকে নিরাপদে ঘরে নিয়ে যাব। এই সামান্য কাজের কারণে আপনি এখন আমার দায়িত্ব হয়ে গেছেন। আমাকে আমার কাজটা করতে দিন। নয়তো খুব খারাপ হবে।’

হাত ছাড়াতে গাইগুই শুরু করল উজমা। ফারশাদের শক্তির সাথে পেরে উঠল না। একসময় সাকিবের দৃষ্টিসীমার বাইরে এসে মোড় পেরিয়ে বাড়ির সীমানায় পা রেখে হাতের বাঁধন ঢিলে করে ফারশাদ বলল,

-‘আমার দায়িত্ব শেষ। ঘরে যান। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছেন আপনি।’

উজমা ফ্যালফ্যালিয়ে তাকাল। মুখে কথা আসছে না তার। হাত-পা ইতিমধ্যে ঠাণ্ডায় জমে গেছে। বৃষ্টি তাকে আজ এত নাজেহাল অবস্থায় ফেলে দিবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। তাকে ওভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারশাদ দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে বলল,

-‘আজকের কিছু মুহূর্ত একটুবেশিই সুন্দর ছিল, তাই না?’

গতকাল রাতে ফারশাদের কথায় সে নিশ্চিত ছিল, এই ছেলেটা তার ওপর রেগে আছে। যার কারণে, সকালে তার সাথে কোনোপ্রকার টু-শব্দটিও করেনি। যদিও কথা বলার জন্য মুখিয়ে ছিল না সে। সাধারণ ভদ্রতা থেকেই ভেবেছিল, ফারশাদ রেগে থাকতে পারে। অথচ আজকে তার আচরণে একফোঁটা রাগও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছুক্ষণ আগের করা এই লোকটার প্রত্যেকটা কাজ ও একটা মেয়ের অসহায় অবস্থায় তাকে আগলে নেয়ার মাঝে যে আন্তরিকতা, মহানুভবতা ও মানবিক দায়িত্ববোধ দেখেছে, সেটাই তাকে মুগ্ধ করেছে। এই মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। বন্ধুবান্ধব ও ভাই বাদে, এমন কোনো পুরুষ আসেনি জীবনে, যে তাকে একজন নারী ভেবে সম্মান দেখিয়ে কথা বলেছে। কিছুক্ষণ আগের করা সামান্য মান-অভিমানের খণ্ডচিত্র দিব্যি ভুলে গেল উজমা। পুরো কথার অর্থ না বুঝে আনমনা স্বরে বলল,

-‘আমার কাছে বৃষ্টি সবসময়ই সুন্দর।’

-‘আমি বৃষ্টির কথা বলছি না।’

-‘তাহলে?’

-‘সবকিছু।’

-‘সবকিছু বলতে?’

ঠোঁট মুড়ে হাসল ফারশাদ। এই অনর্থক হাসির কোনো কারণ খুঁজে পেল না উজমা। হুঁশে ফিরে এবার রেগে গেল সে। বলল,

-‘খামোখা এত হাসছেন কেন আপনি? এভাবে হাসার মতো কী বললাম?’

মনে মনে অন্তহীন কিছু প্রার্থনা রবের নিকট আওড়ে দিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘এইমুহূর্তে আপনাকে সাক্ষী রেখে সৃষ্টিকর্তার কাছে আবারও দামী একটা সম্পদকে খুব করে নিজের জন্য চেয়ে নিলাম। যদি কোনোদিন সেই দামী সম্পদটা আমি পেয়ে যাই, তাহলে এমন অনেক মুহূর্তকে খুব করে আমার জীবনে চাইব। যেন জীবনের একদম শেষপ্রান্তে গিয়েও বুঝতে পারি, একটা রাত জীবনে এসেছিল, যে রাতে আমার মন বুঝতে শিখেছে, কিছু মুহূর্ত জীবনে অনেক দামী। এই দামী মুহূর্তগুলো চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে হলে সময়ের যথাযথ মূল্য দিতে হবে। নয়তো, এই রাত, এই সামান্য মুহূর্ত আমাকে যা দিয়েছে, তার দ্বিগুণ কেড়ে নিবে।’

এই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মুহূর্তে কী ঘটেছিল, সেটা পূণরায় কল্পনা করতে গিয়েই আপাদমস্তক কেঁপে উঠল উজমা। অপরাধীর ন্যায় মাথানিচু করে বলল,

-‘ভুল কিছু ভাববেন না, প্লিজ। তখন ইচ্ছাকৃতভাবে আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরিনি, আবার ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাকে ব্যবহারও করিনি। এটা একটা দুর্ঘটনা।’

ফারশাদ সরাসরি কথা বলতে চেয়েও থেমে গেল। উজমা এখনও ব্যাপারটা বুঝেনি। সে ধরে নিয়েছে, ফারশাদ তখনকার কথাতেই রেগে গিয়েছে। এজন্য সব মুহূর্তকে একটা সাময়িক দুর্ঘটনা ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছে। উজমার কাছে এটা দুর্ঘটনা হলেও ফারশাদের কাছে বিরাট কিছু। অমূল্য রতন হাতের মুঠোয় পাওয়ার মতো দামী কিছু। তাই সে নিজের অনুভূতি চেপে গিয়ে উজমাকে তার বিবেকের কাছে পরিশুদ্ধ রাখতে নির্ভার মনে বলল,

-‘আসলেই। সেদিন রাতের মতো এটাও একটা দুর্ঘটনা। তবে যাই হোক, সাকিব কিন্তু বেশ ধাক্কা খেয়েছে। তার মুখটা একবার দেখেছিলেন আপনি? ফাটা বেলুনের মতো চুপসানো! আহ্, বেচারা।’

বলতে বলতে উচ্চস্বরে হেসে ফেলল ফারশাদ। হাসির দরুন সে কথাই বলতে পারছে না। উজমা নিজেও সামান্য হেসে কথা এড়িয়ে বারান্দায় পা রেখে বলল,

-‘থ্যাংক ইউ।’

কখনও কাউকে প্রয়োজনে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করে না উজমা। এখনও করল না। ধন্যবাদ দিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেল ঠিকই, তবে ফারশাদের মনের ভেতর ভালোবাসার সকল অনুভূতিকে জাগিয়ে তার হৃদয়কে তোলপাড় করে দিয়ে গেল। হাসি থামিয়ে উজমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড়াল,

-‘প্রয়োজনের সময় যাকে কাছে টেনে নিলেন, প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতেই তাকে এত দূরে ঠেলে দিলেন কীভাবে, উজমা? নিজের বেলায় ষোলো’আনাই ঠিক থাকলেন আর আমার বেলায় স্বার্থপর হয়ে গেলেন। এটা আপনি ঠিক করলেন না।’

***

চলবে…