মেঘের_খামে_উড়োচিঠি পর্ব-১০

0
49

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – দশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

দুটোদিন খুব খারাপ কাটল উজমার। একেবারে ঘরবন্দী অবস্থা। কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, কখনও একফালি রোদ্দুর, আবার কখনও ঘনকালো অন্ধকারে চারপাশ থমথমে হয়েছিল। শুধু ডিউটির সময় হসপিটালেই যেতে পেরেছে। আজ একটু রোদ উঠেছে। পরিবেশটাও সুন্দর। সকালে অল্প কুয়াশা ঝরলেও নয়টার পর রোদের ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আকাশটাও পরিষ্কার। উজমার আজকের ডিউটি আবার রাতে। শেষ হবে ভোরে। হসপিটালের ক্যানটিনে নাশতা খেয়ে ফিরতে ফিরতে সকাল সাতটা বেজে যাবে। রাত দশটায় ডিউটি শুরু হলেও সে নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়বে। যেহেতু ঠাণ্ডা, তাই আগেভাগে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিল। বিয়ে উপলক্ষে ছুটি নেয়ার কথা ছিল। ভেবেছিল, আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে প্রথম সপ্তাহ ছুটিতেই কাটাবে। কিন্তু সেটা হওয়ার নয়। যা হবে না, তা নিয়ে আর ভাবনা সাজে না।

সকালটা এমনিতেও সুন্দর ছিল আজকের। দশটার পর তো সেটা আরও সুন্দর হয়ে উঠল। বাড়ির আঙিনায় মামা-মামীকে দেখে আনন্দে চোখের কোণে পানি চলে এলো উজমার। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বড়ো মামীকে। আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,

-‘কতদিন পর তোমায় দেখলাম, মামীমা। তুমি আমাদের ভুলেই গেছো, না?’

মায়ের ভাগের আদর-শাসন দেয়ার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে আর কারও থাকে না। তবুও উজমার বড়ো মামী মিনারা খাতুন উজমা, ঊষা ও উসাইদকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবেসে এসেছেন। বিপদে-আপদে ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন। উজমা নানাবাড়ি অনেক দূরে। এই শহরে নয়। বাংলাদেশের আরও এক কোণে, রাজশাহীর নাটোরে। যার কারণে সময়ে-অসময়ে মামা-মামীকে চাইলেও কাছে পায় না কেউ। তবে তিনি দু’মাস অন্তর-অন্তর মৌলভীবাজারে এসে ওদের সবাইকে দেখে যান। ক’টাদিন এখানে থেকে যান ওদের সাথে আত্মার সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার খাতিরে। কিছুদিন আগে উজমার বড়ো মামা বিয়ের আলাপ-আলোচনায় থাকলেও মিনারা খাতুন আসতে পারেননি। এখন বিপদ শোনে ও উজমার সম্মান ও কষ্টের কথা ভেবে ছুটে এসেছেন, মা মরা মেয়েটাকে একনজর দেখতে। মায়াভরা মুখের আহ্লাদী ও বেদনামিশ্রিত স্বরে তিনি নিজেও দুর্বল হয়ে পড়লেন। উজমাকে আগলে নিয়ে বললেন,

-‘তোদের ভুলে থাকা কি সম্ভব বল? আমি তো তোর মামাকে প্রায়ই বলি, একবার নিয়ে যাও আমাকে। তোর মামার আর ব্যস্ততা শেষ হয় না। বৌমা কোথায়? শরীর ভালো আছে?’

-‘হ্যাঁ, ভালো আছে।’

বড়ো মামা মোরশেদ জামানকে সালাম দিয়ে মামা-মামী দু’জনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল উজমা। মিশকাত ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করে ভদ্রমহিলার পাশে বসল। ঊষা ভার্সিটিতে। উসাইদ ও ফারশাদ থানায় গিয়েছে। মূলত তাহমীদকে খোঁজার একটা ছোট্ট চেষ্টা এটা। বাড়ির অন্য সদস্যদের না দেখে মোরশেদ জামান জানতে চাইলেন,

-‘ঘর তো একেবারে ফাঁকারে মা। আমি বেশিক্ষণ বসব না। আমাকে বিকেলের মধ্যেই ফিরতে হবে। তোর বাবাকে ডাক তো একটু। উসাইদকেও বাড়ি ফিরতে বল।’

-‘সেকী মামা, এত জলদি কীভাবে ব্যাক করবেন? আজ এখানেই থেকে যান, আগামীকাল সকালে রওনা দিবেন।’

মিশকাতের কথা শোনে মোরশেদ জামান কেবল দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন। পড়ালেখার জন্য ওয়াহিদা জামান সিলেট শহরে এসেছিলেন নিজের আপনজনদের ছেড়ে। সেই সুবাদে সিলেট শহরে থাকা-খাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠে তার। এরপর উসমান ওয়াজেদের সাথে পরিচয়, ভালোবাসা, বিয়ে ও সংসার সবটাই হয়ে যায় পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে। বোনকে সচ্ছল অবস্থায় দেখার যতখানি চেষ্টা ছিল নিজের মধ্যে, সবটুকু চেষ্টাকে যথাযোগ্য স্থানে ব্যবহারও করেছেন। বিয়ে হয়ে গেলেও সংসার জীবনে বোনকে সুখী দেখতে পারেননি তিনি। তাকে পড়াশোনা করানো, ডাক্তার বানানো, ভালো একটা বাসা খুঁজে দেয়া, এমনকি বোনকে ও বোনের সন্তানদের ভালো রাখতে, স্বামী-সংসারে টিকিয়ে রাখার জন্য কত সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, নিজেও। আজ যখন বোনের সবকিছু হলো, তখন বোনটাই আর রইল না। পিছনের সময়টুকু মনে পড়লে বুকের ভেতর শব্দহীন যন্ত্রণা এক হয়ে বুঝিয়ে দেয়, তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ। ব্যর্থতার স্মৃতি আগলে নিয়ে মনমরা মন নিয়েই বললেন,

-‘বাচ্চারা বাড়িতে একা। কেউ-ই যদি না ফিরি, ওরা মন খারাপ করে বসে থাকবে।’

-‘ওরা কি আর ছোটো আছে মামা? সবাই যে যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে। আপনি খামোখাই ওদের জন্য চিন্তা করছেন। একদম ভাববেন না। আপনি আগামীকালই যাবেন। প্লিজ…।’

এই মায়াবী চেহারার মেয়েটার অনুরোধসূচক বাক্য শোনে মোরশেদ জামান বললেন,
-‘আচ্ছা, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে সবাইকে ডাকো।’

মেহমানদের বসিয়ে উজমা বেশিক্ষণ দেরী করল না, চট করে ডেকে আনল বাবাকে। ভাইকেও কল করে জানিয়ে দিল। যা টেনশনে পড়েছে উসাইদ, এইমুহূর্তে মামা-মামী’ই ভরসা।

***

এই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে, সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি উজমা। নিজের ক্ষেত্রে তো একদমই না। মোরশেদ জামান এসেছেন মূলত উজমাকে ক’দিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে রাখবেন বলে। উসাইদ ফেরার পর এ কথা তিনি জানিয়েছেন মাত্র। কোনোকিছু সিদ্ধান্ত না নিলেও উজমা কেন যেন মামার এই কথাতে সায় দিতে পারেনি। বিয়ে ভেঙেছে তো কী হয়েছে? তার তো ইজ্জত নষ্ট হয়নি! হ্যাঁ, দশজনের সামনে একটু নিন্দেমন্দ শুনতে হচ্ছে, এটা তো সয়ে নেয়া যাচ্ছে। মানুষজনের বাজে কথা থেকে বাঁচতে ও বাজে ইঙ্গিত থেকে বাঁচতে সে কেন লুকোবে? কোথাকার কোন সাকিবের এত বড়ো সাহস হবে না-কি যে, দ্বিতীয়বার তার সামনে এসে দাঁড়াবে? এজন্য মামার নেয়া এই সিদ্ধান্তকে নিজের যুক্তি ও কাজের অজুহাত দিয়ে ঠেলে দিল উজমা। বলল,

-‘মামা, সাধারণ একটা বিয়েই তো ভেঙেছে! এটা নিয়ে তোমরা এত কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার তো কষ্ট হচ্ছে না। আমি হাসছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, নিজের কাজ করছি। কাউকে বিরক্ত করছি না, কারও সুখের পথের বাঁধাও হচ্ছি না। তবু কেন লোকের গায়ে এত চুলকানি হবে, বোলো তো? যে মানুষ বাজে বলার সে আমাকে সামনে যা বলবে, আড়ালেও তা-ই বলবে। আমি লুকিয়ে পড়লে তার মুখ বন্ধ হবে না। অযথা মানুষের কানাঘুঁষা শোনে কেন আমি নিজের আপনজনদের ছেড়ে দূরে থাকব? আমি যাব না, মামা। প্লিজ। আমাকে জোর কোরো না। আমাকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকলে সে মাথাব্যথার ঔষধ খাক। আমি কেন খাব? আজাইরা।’

ঝামেলা বাঁধিয়েছে সাকিব। সে তার হবু শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উজমার নামে নানান কথা রটিয়েছে। সেই বৃষ্টিভেজা রাতে কী কী ঘটেছে, ফারশাদ কীভাবে পুরোটা রাস্তা উজমাকে আগলে নিয়ে এসেছে, সবকিছু একটু ইনিয়েবিনিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে শাম্মার কাছে বলেছে। আর শাম্মা বলেছে শামীমকে। ব্যস। তাতেই লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেছে। শামীম এখন উপায় খুঁজছে, উজমাকে কীভাবে, কত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা যায়। এজন্য গত দু’দিন ধরে এই এলাকায় তার আসা-যাওয়া বেড়েছে, লোকের কাছে বাজে বলাও বেড়েছে। মোটকথা, উজমাকে ছোটো করতে যা যা করণীয়, তা-ই করছে। উসাইদ এসব কথা কারও সাথে শেয়ার করেনি। শুধু বোনকে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছে আর বড়ো মামাকে জানিয়েছে যে,

-‘মামা, শামীম এরকম একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে। আমি এখন কী করব?’

এই কথা শোনে মোরশেদ জামান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ক’দিনের জন্য হলেও উজমাকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। এতেই উজমা বেঁকে বসল। নিজের দিক থেকে একশো এক যুক্তি দেখাতে শুরু করল। যে যাই বলুক, সে কারও কথায় কান দিতে নারাজ একেবারে। কোনোমতেই তাকে রাজি করানো যাচ্ছে না দেখে মিশকাতও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলল,

-‘মামা তো ভুল কিছু বলছেন না। বিয়ে যেহেতু হচ্ছে না, তারমানে তুই এখন ছাড়া হাত-পা। নিজের মনের শান্তির জন্য হলেও সপ্তাহ খানেক ওখানে থেকে আয়।’

লাফিয়ে উঠল উজমা। বলল,
-‘অসম্ভব। কে বলেছে আমার ছাড়া হাত-পা? তোমার কিন্তু শরীর খারাপ। হাতে গোনা দু’চার দিন বাকি। এই সময়ে আমি বেড়াতে যাব? ছিঃ। এত স্বার্থপর হতে পারব না ভাবী। যে যা-ই বলুক, আমি কারও কথা কানে নেব না।’

-‘কিন্তু, এসব তো তোর মনের ওপর প্রভাব ফেলছে।’

-‘কোনো প্রভাব ফেলছে না। মিছে ভয় পাচ্ছ তোমরা। আমি ঠিক আছি, ভাবী। ভালো আছি।’

এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে একবার নিজের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে, সহজে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছ’পা হতে চায় না। এখনও কারও কথাই সে শুনল না। তার এক কথা, মিশকাত ও বাবাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। এতে যদি লোকে নিন্দেমন্দ বলে, বলুক। তাতে তার কী? কেউ খারাপ বললেই তো, তার গায়ে ফোস্কা পড়ছে না। অগত্যা উজমার কথাই মেনে নিতে হলো মোরশেদ জামানকে। তিনি হার মেনে নিয়ে বললেন,

-‘ঠিক আছে, তুই থাক তোর মতো। তবে কেউ যদি তোর ক্ষতি করতে স্বেচ্ছায় তোর সাথে ঝগড়া বাঁধাতে আসে, কিংবা ইনিয়েবিনিয়ে বাজে কথা বলে তোকে অপরাধী সাজাতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আমি নিজে কোর্টে গিয়ে মামলা করব। একদম নির্ভয়ে থাকবি। কাউকে ভয় পাবি না, কারও কাছে মাথা নত করবি না। মনে রাখবি, সম্মান দেয়া ও নেয়ার ক্ষমতা কেবল আল্লাহরই আছে। তিনি চাইলেই তুই সম্মানিত হবি, তিনি চাইলেই অপমানিত।’

***

মামা-মামীর সাথে গল্পগুজব ও আড্ডা-আলোচনায় পুরো দিন কেটে গেল আনন্দে। সন্ধ্যার দিকেই বিপদ এসে হাজির হলো বাড়িতে। শামীম তার বাবা-চাচা ও বোনকে নিয়ে এসেছে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে। উসাইদ তো ওকে দেখা মাত্রই একগাদা বকে দিয়েছে। সেইসব বকা কানে না নিয়ে নির্লজ্জের মতো মোরশেদ জামান ও মিনারা খাতুনকে ভুলানোর চেষ্টায় নানান কথা সাজাচ্ছে। এটা-ওটা বলে তাদের মন জয় করতে নাটকীয় সুরে নিজের করা অন্যায়ের কারণে ক্ষমাও চেয়েছে। মোরশেদ জামানের মতে, ‘এক গাছে ফল এলে ঢিঁল ছুঁড়ে দশজনে।’ এতে দোষের কিছু না। বিয়ের প্রস্তাব আসতেই পারে। তবে কথা হচ্ছে, পাত্র কেমন ও তার আচার-আচরণ, ব্যবহার, পরিবার এসব কেমন, এগুলো দেখে এগোনো। এখানে পাত্রেরই যেহেতু সমস্যা আছে, চরিত্রেও দোষ আছে, মনটাও নোংরা, সেক্ষেত্রে জেনে-বুঝে ঘরের মেয়েকে এমন কোনো কাপুরুষের হাতে তুলে দেয়া উচিত নয়। তাই তিনি খুব স্পষ্টভাবে পাত্রের বাবা সাজ্জাদ ওয়াজেদকে বললেন,

-‘দেখুন, ভাইজান। আপনি প্রস্তাব দিয়েছেন, শোনে আমরা খুশি হয়েছি। তবে আপনার ছেলের হাতে আমি আমার বোনের রেখে যাওয়া আমানতকে তুলে দিতে পারব না। যদি আপনার ছেলে, ওর সামান্যতম অপমান বুঝত, ওকে সম্মান দিত, তাহলে আমি নির্দ্বিধায় এই বিয়েতে হ্যাঁ বলতাম। যেখানে সম্মান নেই, সেখানে আমি হ্যাঁ বলতে পারছি না। মনে কষ্ট নিবেন না।’

সাজ্জাদ সাহেব নিজেও উজমাকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী নোন শুধু ছেলের অহেতুক চেঁচামেচি সহ্য করতে পারেননি বলেই এসেছেন। অতীতে যে নারীকে ভাইয়ের জন্য মেনে নেননি, আজ তারই মেয়েকে ছেলের জন্য চাইবেন, এটা কল্পনাতীত ভাবনাই। কিন্তু শামীম তো হতচ্ছাড়া। সে উজমাকে হাতছাড়া কর‍তে রাজি নয়। মোরশেদ জামানের কথায় সাজ্জাদ সাহেব কোনোকিছু না বললেও বিষধর সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে উঠল শামীম। গলায় রাগ, জোর ও দাম্ভিকতা টেনে বলল,

-‘উজমা আমার চাচাতো বোন। ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন আমার চাচ্চু। আপনি মাঝখানে আসবেন না, প্লিজ।’

শামীমের এই বেয়াদবি কথা সহ্য হলো না উসাইদের। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘তোর এত বড়ো সাহস, তুই মুরব্বি মানুষকে অপমান করিস, তা-ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে? ভদ্রতার খাতিরে ঘরে ঢুকতে দিয়েছি, নয়তো তোর মতো কুকুরকে আমি এখানে একমিনিটও সহ্য করতাম না।’

গালাগালি, তর্কবিতর্ক, চিৎকার-চেঁচামেচির একপর্যায়ে সাজ্জাদ ওয়াজেদের ছোটো ভাই, উজমার ছোটো চাচা জমশেদ ওয়াজেদ গলা হাঁকিয়ে উজমাকে ডাকলেন। এতক্ষণ নিজের রুমে শাম্মার সাথে গল্প করছিল উজমা। যদিও গল্পগুজবের ইচ্ছে নেই। তবুও ভদ্রতা রক্ষার্থে চাচাতো বোনকে একটু সঙ্গ দেয়া বৈ আর কিছু না। চড়া গলার এই আওয়াজে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে কাঁপতে শুরু করেছে উজমা। শামীমকে তার বিরক্ত লাগছে, রাগও হচ্ছে। এই অমানুষ এত বাড়াবাড়ি করবে জানা ছিল না তার। সাড়া দিতে, চুপ করে মামার পাশে এসে দাঁড়াল। জমশেদ ওয়াজেদ শান্তস্বরে বললেন,

-‘তুমি হয়তো শুনেছ, আমরা কেন এসেছি! যে যাই বলুক, তুমি তোমার মতামতটা আমাদের জানিয়ে দাও, মা। আমরা তোমার কাছেই উত্তর শুনতে চাইছি।’

ছোটো চাচার কথার জবাবে উজমা মুখ নামিয়েই বলল,
-‘আপনি চিন্তা করবেন না, ছোটো চাচ্চু। যদি কোনোদিন বিয়ে নামক বন্ধনে জড়ানোর সৌভাগ্য আমার না-ও হয়, তবুও আমি আপনাদের ছেলের পায়ের তলায় গিয়ে নিজের সম্মান নষ্ট করব না। আমাকে মাফ করবেন।’

শামীমের মেজাজে তখন আগুন জ্বলে উঠল। সে তেড়ে এলো উজমার দিকে। দু’হাতে তার বাহু চেপে ধরে বলল,
-‘একবার আমার কথা ভাব, উজমা। আমি তোকে ভালোবাসি। বিশ্বাস কর।’

তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে চেয়ে উজমা উত্তর দিল,
-‘যে ভালোবাসা কারও মন ছোঁয়ার আগে শরীর ছোঁয়, সে ভালোবাসার কোনো মূল্য আমার কাছে নেই। তোমার এই সস্তা ভালোবাসার বুলি আমাকে শুনিও না। আমি জানি, ভালোবাসা বলতে তুমি কী বুঝো। শেষবার বলছি, এরপর আর এখানে এসো না। প্রয়োজনে আমি গলায় দঁড়ি দেব, তা-ও তোমার মতো নোংরা পুরুষের সামনে নিজের এত বছরের বেঁধে রাখা মনকে অপমানিত হতে দেব না।’

উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একছুটে নিজের রুমে চলে গেল উজমা। শাম্মাকে বের করে দিয়ে ঠাস করে দরজা আটকাল। নিজেদেরকে বিপদ থেকে বাঁচাতে সন্তানদের নিয়ে সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গেলেন সাজ্জাদ ওয়াজেদ ও জমশেদ ওয়াজেদ। বলা যায় না, এই মেয়ে সত্যি সত্যিই গলায় দঁড়ি দিয়ে তাদেরকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। যা সাহস এই মেয়ের। রীতিমতো জ্বলন্ত আগুন। একবার জ্বলতে শুরু করলে সহজে নিভতে চাইবে না।

***

-‘উজমা, দরজা খোল। কী করছিস ভেতরে? তোর ভাই ডাকছে তোকে। বাইরে আয়, সোনা। ওরা কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। এভাবে টেনশন দিস না আমাদের।’

‘আসছি’ বলেও রুমের ভেতরেই রইল উজমা। বাইরে এলো না। উসাইদ, ঊষা, মিশকাত কারও ডাক কানে নিল না সে। ফারশাদ নিজেও এই আসরে উপস্থিত ছিল। তাহমীদকে খুঁজতে গিয়ে পেরেশানির শেষ নেই তার। পুরোদিন ছোটাছুটি করেও কোনো লাভ হলো না। যে মানুষের কোনো ছবি নেই, যোগাযোগ নম্বর নেই, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তাকে আর কীভাবে খুঁজে বের করা সম্ভব জানা নেই তার। তবে চেষ্টার কমতি নেই তারমধ্যে। শত হলেও বোনকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ওই মানুষটা শেষ অপশন। এইটুকুকে যদি সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে ফারিশার খোঁজ এই জীবনে পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না তার। বোনকে নিয়ে এই দুঃশ্চিতার পর নিজের জীবনে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা ও ভালোবাসার মানুষকে নিয়েও আরেকদফা দুঃশ্চিন্তা শুরু হলো। সে বাইরের মানুষ বলেই এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। যা-ই বল তো, তাতেই সবাই তার কথাগুলোকে অহেতুক ও অযৌক্তিক বলেই ব্যাখ্যা করত। এজন্য কারও পারিবারিক আলাপ-আলোচনায় ভুল করেও প্রবেশ করতে চায় না। এটা তার শিক্ষায়ও নেই, রুচিতেও নেই। কিন্তু যখন প্রশ্নটা হয়, একান্তই ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে কেন্দ্র করে, তখন নিজেকে কীভাবে গুটিয়ে রাখা যায় আর কতক্ষণই বা চুপ থাকা যায়, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা করতে পারল না ফারশাদ। এজন্য চুপ থাকাকেই সে ঠিক বলে ধরে নিয়েছে। তাই শামীমের সামনে কোনোপ্রকার টু-শব্দও করেনি। বুঝিয়ে দিয়েছে, সে একজন অতিথি মাত্র। কিন্তু এখন, এইমুহূর্তে, উজমার এই দরজা বন্ধ করে রুমের ভেতরে বসে থাকাটা তার ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তুরে শীতল হাওয়ার মতো যে ভালোবাসা সমস্ত চেতনায় কম্পন জাগিয়ে এসেছে, সে ভালোবাসাকে এতদ্রুত বিদায় জানাতে খুব ভয় হচ্ছে তার। মেয়েটা যদি ভুল কিছু করে ফেলে, এটা ভেবেই অস্থির লাগছে। কখনও নিজেকে এত অসহায় মনে হয়নি তার। অথচ কাউকে কিছু বলতে পারছে না। মনের এই জটিল অবস্থা সামলে ওঠার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। এতটুকু সময়েই সে নিজেকে সর্বোচ্চ অসহায় ও নিঃসঙ্গ হিসেবে আবিষ্কার করল। তার এই চিন্তিত মুখবয়ব কেউ খেয়াল করছে না। সবাই একাধারে উজমাকে ডেকে চলেছে। ভেতর থেকে উজমাও বলছে,

-‘আরেহ্ বাবা আসছি তো। এত ডাকাডাকি করছ কেন? আমি কি সুইসাইড করতে এসেছি না-কি। আশ্চর্য!’

উজমার এই কথায় মিশকাতের গলা শুকিয়ে এলো। টেনশন বেড়ে যেতে লাগল। সে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘তাহলে এতক্ষণ ধরে ভেতরে করছিস কী? চিন্তা হয় না আমাদের?’

-‘তৈরী হচ্ছি, ভাবী। হসপিটালে যাব।’

এই বাক্যে কিছুটা হলেও শান্তি পেল মিশকাত। তবে উসাইদ শান্ত হলো বলে বোঝা গেল না। সে বোনকে ডেকে বলল,
-‘উল্টাপাল্টা কিছু মাথায় আনিস না, উজমা। আমরা আছি তো তোর পাশে। লোকে যতই বাজে কথা বলুক, আমি জানি তুই কেমন। পুরো পৃথিবীর লোকজন যদি তোকে বাজে কথা বলে, তবুও আমি এসব কথা বিশ্বাস করব না। আমার কাছে তুই এখনও ছোটোবেলার মতোই পবিত্র, সুন্দর ও সৎ। বিশ্বাস কর।’

দরজা খুলে চোখ গরম করে সবার দিকে তাকাল উজমা। তাকে পরিপাটি হয়ে আসতে দেখে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উসাইদ চট করে জড়িয়ে ধরল বোনকে। আলতো করে মাথায় চুমু দিয়ে বলল,

-‘ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তো। এমন করে দরজা আটকায় কেউ? আমাকে টেনশনে রাখতে ভালো লাগে না?’

ভাইয়ের পাংশু মুখটার দিকে তাকিয়ে ঝলমলিয়ে হেসে উঠল উজমা। ভাইকে জড়িয়ে থেকে বলল,
-‘আমি এতটা ছোটো ও দুর্বল মনের নই, ভাইয়া। আমি যথেষ্ট স্ট্রং। নিজেকে ও তোমাদের আমি ভীষণ ভালোবাসি। কারও বাজে কথায় আমি দুর্বল হয়ে গিয়ে নিজের ক্ষতি করে ফেলব, এমনসব ভুল ভাবনা ও ভয়কে মনে জায়গা দিও না। আমি ঠিক থাকব, সবসময়।’

কথা বলতে বলতে আরেকজোড়া চিন্তিত ও ভয়মিশ্রিত চোখ দেখে খানিক সময়ের জন্য থমকে গেল উজমা। তার মনে হলো, সে ভুল দেখছে। ওই দুটো চোখ কি কথা বলা চোখ যে, নিষ্পলক চাহনি দিয়ে কিছু বলে দিতে সক্ষম? চোখ বন্ধ করে গভীর করে শ্বাস নিয়ে ভাইকে ছেড়ে স্বাভাবিক হলো উজমা। বলল,

-‘আসছি।’

-‘সাবধানে যাবি।’

মাথা নেড়ে বাবা ও মামা-মামীর কাছে এসে বিদায় নিল উজমা। সকালে আসবে জানিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে আবারও পিছনে ফিরল। কোনো এক অজানা কারণে ফারশাদের মন পড়ে ফেলার বড্ড লোভ হলো তার। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। খুব বেশিক্ষণ তাকানোর সাহস সে পেল না। শান্ত চোখে তিন সেকেন্ড সময় ব্যয় করে কিছু একটা বলতে চাইল, অথচ সেটাও সম্ভব হলো না। গত দু’দিন ধরেই ফারশাদের বলা ‘সবকিছু সুন্দর’ এইটুকুর হিসাব মেলাতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছে উজমা। বার বার মনে প্রশ্ন জাগছে। সেইসব প্রশ্নকে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ব্যবহার করতে পারছে না বলে আরও অস্বস্তি বাড়ছে। ঠিক কেন, কী, কতটুকু সুন্দর বলে আখ্যায়িত করেছিল লোকটা এটাই বোধগম্য হচ্ছে না। তার হিসাবে মিলছে না। এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে, সে যখন ভয় পেয়ে ফারশাদের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাকে খামচে ধরেছিল, তখন ফারশাদের চেহারায় বড্ড অস্বস্তি লুকিয়েছিল। সে খামচে ধরলেও ফারশাদ তাকে ছোঁয়নি বরং ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং পর্যাপ্ত স্পেসও রেখেছিল। কোনো অপ্রীতিকর, অস্বস্তিকর মুহূর্ত নিশ্চয়ই তার কাছে সুন্দর নয়। এখানে ‘সবকিছু সুন্দর’ বলতে অন্যকিছু বুঝিয়েছে ফারশাদ। সেই অন্যকিছুটা কি এটাই বুঝতে পারছে না। দু’দিন ধরে তাহমীদকে খোঁজার চেষ্টা তারমধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে, এবং বাড়িতেও সে কম থাকছে, যার কারণে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তার জ্যাকেটটাও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। যে পুরুষের কাছে সে দুর্বল মুহূর্তেও সম্মানের ছিল, তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবতেও খারাপ লাগছে। অথচ সাকিব কীসব রটাল! শাম্মা না বললে তো জানা হতো না তার। একটা মানুষের সুন্দর ও চমৎকার দিককে কত সহজেই নোংরা দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে ফেলল সবাই! ভাই-ভাবী ও মুরব্বি মানুষের সামনে এই প্রসঙ্গ টেনে আনতে তার সংকোচ হচ্ছে। আবার এই দুটো চোখের ভাষা বুঝতে গিয়েও তার মনে হচ্ছে, ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর না চাইতেও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে ধরা দিচ্ছে। নিজের মনের এই অহেতুক ভাবনায় বিরক্ত উজমা দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি প্রকাশ করে দৌড় দিল। কোনোদিকেই তাকাল না আর। সব রাগ, মেজাজ গিয়ে পড়ল মিশকাতের ওপর। এই মেয়েটা পাঠানোর আর মানুষ পেল না? রাতবিরেতে ফারশাদকেই কেন পাঠাল?

উজমা চলে যাওয়ার পর মামা-মামী ও বাবাকে নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসল উসাইদ। যদিও এখানে উসমান ওয়াজেদের প্রয়োজন নেই বললেই চলে, তবুও বাবা। তাকে ছাড়া সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। উসাইদ মাত্রই তার মামাকে প্রশ্ন রেখেছিল, কী করবে! বোনের মান-সম্মান তো আর রইল না। সমাজের সামনে সে কলঙ্কিত হয়েই গেল। সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কিছু বলার আগেই ফারশাদ বলল,

-‘যদি অনুমতি দিস তো, আমি কিছু বলতাম।’

-‘কী?’

ফারশাদকে নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে শামীম যত বাজে কথা বলেছে, সবকিছু সে বন্ধুকে বলেনি। কারণ সে তার বন্ধুকে বিশ্বাস করে। আর মিশকাতও ওই মুহূর্তে নিরুপায় ছিল বলেই ফারশাদকে পাঠিয়েছিল। মেয়ে মানুষ দেখলে সাকিবের লোভ ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে এটা বুঝতে পেরেই ওইদিন রাতে ঊষাকে সে পাঠায়নি, পাঠিয়েছে ফারশাদকে। ঔষধ খেয়ে উসমান ওয়াজেদ গভীরঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। এতে মিশকাতের কোনো দোষ নেই, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা অন্যায়। এজন্য সে মিশকাতের এই কাজকে ভুল ভাবতে পারেনি ও দোষের কিছুও ভাবেনি। তাই প্রশ্ন করেই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল সে। ফারশাদ বলল,

-‘যদি বলি, আমি উজমাকে বিয়ে করতে চাই, এটা কি খুব বেশি অবাঞ্ছিত আবদার হয়ে যাবে?’

***

চলবে…