মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-০৫

0
432

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_০৫
#আয়াত_আফরা

বিকেল গড়িয়ে রাত নেমেছে।ড্রয়িং রুমে রাখা বিশাল টিভিটার সামনে আধা ঘন্টা হলো বসে আছে সব চাকরানীরা।কোনো একটা হিন্দি সিরিয়াল চলছে টিভিতে।

“তুম মুঝে ক্যায়সে ছোড় সাকতেহো দীপ?ইয়ে তুমনে আচ্ছা নেহি কিয়া!”

শব্দগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে আসে তন্দ্রার কানে।সে টিভির সামনে যায়নি।সারাদিনের ধকলে মাথাটা ধরেছে তার।নীলাদ্রি ফেরেনি।ফিরবে কিনা সেটাও জানায়নি।সেটা নিয়ে কারো বিশেষ মাথা ব্যথাও নেই।নীলাদ্রি ফিরলে সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে।এই বুঝি কোনো ভুল করে ফেললো তারা,এই বুঝি স্যার হুঙ্কার দিলেন!তবে নীলাদ্রি না থাকলে সেসব নিয়ে চিন্তাই থাকেনা কোনো চাকরানীর।যেমন এখন তারা সিরিয়াল দেখছে।নীলাদ্রি থাকলে কি এমন দেখতে পারতো? যদিও নীলাদ্রি প্রায় সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে থাকে।কত রাত যে সে ঘরের বাইরে কাটায় তারও কোনো ইয়ত্তা নেই।তার দাদু বেঁচে থাকতে অবশ্য দাদুর টানেই ঘরে ফিরত রাতে।কিন্তু এখন তো সেই শিকলও ছিড়েছে।

তন্দ্রা নীলাদ্রির কক্ষ থেকে নিয়ে আসা বইটা খুলে।পড়তে তার বেশ ভালো লাগে।তার কাছে যে বইগুলো আছে সেগুলো সে এতবার করে পড়েছে যে তার কোন পৃষ্ঠায় কি আছে সেটাও ভালোভাবে বলে দিতে পারে।তার খুব শখ ছিল একটা বিশাল ঘর থাকবে তার,যার একটা কামরা জুড়ে কেবল বই আর বই থাকবে।ছোটবেলায় যখন সে মাইশা দিদির বইগুলো পড়তে যেত তখন মামী রাগ করে তার হাত থেকে বই কেড়ে নিত।সে নাকি ছিড়ে ফেলবে সেগুলো।কিন্তু সে বইগুলো আলতো হাতে ছুতো।আর ছিড়ত মাইশা দি।তবুও মামী দি’কে কিছুই বলতোনা।শুধু তাকেই মারতো।এখন পুরোনো কথাগুলো মনে করে খারাপ লাগেনা তন্দ্রার।কেমন যেন একটা কষ্ট হয়।শত হোক সেই বাড়িতে তার আপন মানুষ ছিলো।কিন্তু এখানে? সবাই যেন তার পর।যার ভরসায় সে এই বাড়িতে এসেছিল সে তার মুখ অবধি দেখেনি।আচ্ছা এটা কি সত্যিই নীলাদ্রি স্যারের কোনো শখ ছিলো? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে?নীলাদ্রি স্যার কি তাকে টাকা দিয়ে কিনে এনেছেন?সে যে কাগজে সই করলো।কিসের কাগজ ছিল সেটা?তন্দ্রা মুভিতে দেখেছে এভাবে মেয়েদেরকে বিক্রি করে দেয়া হয় টাকার বিনিময়ে,ছলনা করে।তাহলে কি তার মামা মামী তাকে নীলাদ্রি স্যারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন?এবার স্যার তার সাথে কি করবে? কোনো খারাপ কাজ যদি….কি ভয়ঙ্কর! ভাবতেই বুকটা ছেৎ করে উঠে তন্দ্রার।

এমন সময় বাড়ির বাইরে বেশ কয়েকটা গাড়ি থামার শব্দ হয়।নীলাদ্রি স্যার ফিরে এসেছেন।বুকের ভেতরে ভয়টা যেনো ক্রমাগত হাতুড়ি মারতে থাকে।স্যার না এলেই বোধহয় ভাল হত।পরক্ষনেই সম্বিত ফিরে পায় তন্দ্রা।কি ভাবছে সে! স্যার মোটেও তেমন নয়।আর তাছাড়াও তেমন কিছু যদি হতো তাহলে স্যার এখনো একবার তাকে নিজের কাছে ডাকেন নি কেন?না স্যার নিশ্চই এমন মানুষ নন।নিজেকে সান্তনা দেয় তন্দ্রা।সে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে হলঘরের দিকে উঁকি দেয়।সেদিক থেকে আসা টিভির শব্দ ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে।বিনতি এবং অন্য চাকরানীরা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।বাড়ির প্রধান দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছে নীলাদ্রি।তার চলনে নির্দিষ্ট একটা ভঙ্গিমা আছে। অনেকটা সিংহের মতো ছন্দে পা ফেলে সে।যেন পা দিয়ে চিহ্নিত করে, “এই পা রাখলাম,এটা আমার সীমানা।এখানে আমি যা বলবো সেটাই শেষ কথা।”

হালকা কোঁকড়া চুল কপালে এসে পড়েছে নীলাদ্রির।ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নেই।মুখে নেই দয়ার লেশমাত্র।এই প্রথমবার নীলাদ্রিকে বাস্তবে দেখছে তন্দ্রা।আগে কেবল দেখেছিলো ম্যাগাজিনের পাতায়।নীলাদ্রিকে দেখে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার জানায় তন্দ্রা।সে কি কোনো দিক দিয়ে নীলাদ্রির যোগ্য?কোথায় সিংহ আর কোথায় পিঁপড়ে।কেন যে গতকাল নীলাদ্রিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল সে!নীলাদ্রির দুপাশে রয়েছে বালু আর তৌসিফ।যেনো নীলাদ্রির বডিগার্ড।যদিও নীলাদ্রির বডিগার্ডের কোনো প্রয়োজন আছে বলে তন্দ্রার মনে হয়না।নীলাদ্রি চলার সময় এদিক ওদিক তাকায়না।সরাসরি উদ্দেশ্য বা গন্তব্যের দিকে যায়।আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা।ঘরের কোথায় কে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত না করে সরাসরি সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে।নীলাদ্রি ঘরে চলে যেতেই সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।এতক্ষনে ঘরের গুমোট আবহাওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো।

নীলাদ্রি ঘরে গিয়েই কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে।রুমের এসি বন্ধ আছে।তবুও ঘরের বাতাস অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা।তবে সেটা প্রাকৃতিক।সে লক্ষ্য করে ঘরের জানালাটা খোলা।কে খুলেছে জানালা? সে তো চাকরানীদের নিষেধ করে দিয়েছে এই ঘরের জানালা যাতে না খোলা হয়। নীলাদ্রি একটু অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করে।তাই সে চায়না তার ঘরের জানলা খোলা হোক।কখনো কেউ খুলেও না।তবে আজ কে খুললো? তবে কি নতুন কেউ আজ ঘর পরিষ্কার করেছে?এমন সময় তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় রিডিং টেবিলের পাশে থাকা বুকশেলফটার দিকে।কি ব্যাপার,বুকশেলফটা খালি খালি কেন লাগছে?সে এগিয়ে যায় সেটার দিকে।আর এক ঝলক দেখামাত্রই বুঝে যায় এখান থেকে কোনো বই সরানো হয়েছে।সাথে সাথেই চিনচিনে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে আগ্নেয়গিরির আকার ধারণ করে।বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠে নীলাদ্রি,

“বিনতি! এই বিনতি।”

বিনতি তখন নীলাদ্রির জন্য খাবার টেবিল সাজাচ্ছিলো।হঠাৎ তার হুঙ্কার শুনে ভয়ে এক মুহুর্ত জমে যায় সে।গত কয়েক বছরে এমন হুঙ্কার সে বহুবার শুনেছে।কিন্তু ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।নীলাদ্রি চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আসে,

“বিনতি!”

বিনতি দৌড়ে নীলাদ্রির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।কি জানি কি ভুল হয়েছে। নীলাদ্রি আবার গর্জন করে উঠে,

“আমার বুকশেলফ থেকে বই কে সরিয়েছে?কার এত সাহস যে আমার বুকশেলফ থেকে বই নিয়েছে?”

বিনতি ভয়ে ভয়ে বলে,
“আপনার বুকশেলফ থেকে কে বই সরাবে স্যার?” কথাটা বলতেই তার মনে পড়ে আজ তো ওই নতুন মেয়েটা নীলাদ্রির ঘর গুছিয়েছে।তাহলে কোথাও ও সরায়নি তো?
“স্যার আপনি যে নতুন চাকরানীকে নিয়ে এসেছিলেন আজ ও আপনার রুম গুছিয়েছে।হয়তো একটু ভুল করে ফেলেছে।আমি এখুনি ওকে জিজ্ঞাসা করে আসছি।”

বিনতি ছুটে যায় তন্দ্রার কাছে।নীলাদ্রির হুঙ্কার তন্দ্রার কানেও পৌঁছেছিল।তবে কিসের জন্য নীলাদ্রি এত চিৎকার করছে সেটা বুঝতে পারেনি।সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।হঠাৎ বিনতিকে তার ঘরে ছুটে আসতে দেখে তার হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়।তাহলে কি সেই কোনো ভুল করলো? বিনতি এসে তন্দ্রাকে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“স্যারের বই কোথায়?”

তন্দ্রা অস্ফুটে বলে,
“ওই বই তো সরিয়ে ফেলতে… ”

কিন্তু তার পুরো বাক্য শোনার ধৈর্য্য তখন ছিলোনা বিনতির।সে আবার তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করে,

“বই কোথায় স্যারের?”

তন্দ্রা নীলাদ্রির কক্ষ থেকে নিয়ে আসা বইটা ভয়ে ভয়ে হাতে তুলে নিতেই বিনতি সেটাকে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আবার ছুটে বের হয়ে যায় তার ঘর থেকে।এক ছুটে বিনতি বইটা নিয়ে হাজির হয় নীলাদ্রির সামনে।নীলাদ্রি বইটা বিনতির হাত থেকে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে।বইটাকে ঠিকঠাক দেখে তার রাগ একটু কমে।সে বিনতিকে গম্ভীর স্বরে বলে,

“ওই মেয়ের এত সাহস কি করে হয় আমার বই সরানোর?”

বিনতি মিনমিন করে বলে,
“স্যার নতুন মেয়ে তো,তাই ভুল করে ফেলেছে।এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।ওকে এরপর সব ভালো করে শিখিয়ে দেবো।”

“আমার ঘরের জানালাগুলো কি ও খুলেছে?”

বিনতি এই সম্পর্কে কিছুই জানতোনা।সে যা কি না বলবে ভেবে পায়না। নীলাদ্রি থমথমে গলায় বলে,

“পরেরবার যেন এমন ভুল না হয়।নয়তো এ বাড়ি থেকে ওই মেয়ের লাশ বেরুবে।কথাটা ওকে বুঝিয়ে দিয়ো।”

“জি স্যার।স্যার আপনার খাবার তৈরী আছে।”

“আমি খাবোনা।তোমরা খেয়ে নাও”

বইটাকে নিয়ে নীলাদ্রি তার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। নীলাদ্রি চলে যেতেই বিনতি তন্দ্রার ঘরে গিয়ে বলে,

“তুমি স্যারের ঘর থেকে বই নিয়েছিলে কেন?”

তন্দ্রা ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়,
“ঐযে ওটা পুরোনো বই ছিলো তাই… ”

“যা করেছো করেছো,তবে এরপর আর কখনো আমাকে না জিজ্ঞাসা করে স্যার এর ঘর থেকে কিছু সরাবেনা।আজ যে বইটা সরিয়েছিলে সেটা স্যারের দাদুর ছিল।তাই সেই বইটা স্যার অতিরিক্ত যত্ন করে রাখে।যদি বইটার কিছু হতো তাহলে স্যার তোমাকে আর জীবিত ছাড়তেন না।”

বিনতি বেরিয়ে যায় তন্দ্রার ঘর থেকে।তন্দ্রার মনেহয় এইমাত্র বাড়িতে একটা প্রবল ঝড় উঠেছিল।তার চারপাশটা কেমন যেনো দুলতে থাকে।সে তো ইচ্ছে করে বই সরায়নি। সৃষ্টি দি-ই তো তাকে বলেছিল বইটা সরাতে।এখানে তার কি দোষ?কিন্তু সৃষ্টি দি জেনেশুনে তাকে বইটা কেন সরাতে বলবে? নাকি ভুলে বলেছে? হয়তো বলতে চেয়েছিলো পুরোনো বই সরাবেনা ভুল করে অন্য কিছু বলে ফেলেছে। ভাগ্যিস সে বইটা ফেলে দেয়নি!

*******

রাত প্রায় দেড়টা হবে।সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।কেবল জেগে আছে নীলাদ্রি।রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে সে ভাবছে তার পরবর্তী ডিলের ব্যাপারে।নতুন প্রজেক্টটার চিন্তায় এমনিতেই তার ঘুম আসছেনা।এমন সময় তার চোখ যায় রিডিং টেবিলে পরে থাকা সেই বইটির দিকে।আপন খেয়ালে বইটা হাতে তুলে নেয় সে।বইটা দাদুর খুব প্রিয় ছিল।সবসময় পড়তো এটা।তবে নীলাদ্রি এটা পড়েনি।পড়ার তেমন সময়ও হয়ে উঠেনি তার।যেটুকু সময় পড়ার জন্য বরাদ্দ থাকে তার প্রায় পুরোটাই ব্যায় হয়ে যায় বিজনেস ম্যাগাজিন আর রিপোর্টস পড়তে পড়তে।ওই মেয়েটা কেন এই বইটা সরিয়েছিলো? ভুলে? বইটা খুলে সে।পৃষ্ঠাগুলো একে একে উল্টাতে উল্টাতে এক পৃষ্ঠায় চোখ আটকে যায় তার।চোখ আটকাতোনা যদিনা সেখানে দুটো চরণের নিচে দাগ দেয়া থাকতো।নীলাদ্রি এই বই দাগানোটা একদমই পছন্দ করেনা।সে বই একদম নতুন রাখতে পছন্দ করে।নতুন বইয়ের গন্ধটাও বেশ পছন্দ তার।কবিতার দাগানো চরণগুলো একমনে উচ্চারণ করে নীলাদ্রি,

“আমি ভালবাসি যারে,
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে?”

কে দাগিয়েছে চরণদুটো? ওই মেয়েটা? চরণদুটো পড়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য মনেহয় নীলাদ্রির।খুব আপন কারো কথা মনে পরে তার।তার দাদুর? হয়তো তাই।একমাত্র দাদুই ছিলো তার আপনজন।ছোটবেলায় বাবা মা মারা যাবার পর দাদুই তাকে বড় করেছেন।আগলে রেখেছেন বুক দিয়ে।কিন্তু শেষকালে ওই মানিক হালদারের জন্য মৃত্যুশয্যায় তার কাছেও যেতে দেন নি নীলাদ্রিকে।সে কি ভুলে যাবে সবকিছু? কখনোই না।প্রতিশোধ সে নেবেই।ওই মেয়েকে সে তিলে তিলে মারবে। নীলাদ্রি তার গিটারটা হাতে তুলে নেয়।বেলকনির উঁচু রেলিঙে গিয়ে বসে গিটারে সুর তুলে।

রাতের বুক চিরে সেই গানের সুর গিয়ে পৌঁছায় আরেক বিনিদ্র মানবীর কানে যেটা জানতেও পারেনা নীলাদ্রি।

চলবে….