মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-০৬

0
400

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_০৬
#আয়াত_আফরা

সকালে একটা পরিষ্কার সালোয়ার কামিজ পরে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় তন্দ্রা।এ বাড়িতে এখনো পার্মানেন্ট কোনো কাজ পায়নি সে।যে যেই কাজ ধরিয়ে দেয় সে সেটাই করে।বিনতিকে কাল রাতে বলে রেখেছিলো ভার্সিটি যাবার ব্যাপারটা।প্রথমে বিনতি নিলাদ্রি স্যার কি ভাববে সেটা নিয়ে একটু কথা শোনালেও পরে রাজি হয়েছে।আজকে স্যারের ঘর গুছানোর কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে তন্দ্রা।তবে রাতের খাবারটা তাকেই রান্না করতে হবে।ভার্সিটির জন্য তৈরী হতে হতে সেটাই ভাবছিলো তন্দ্রা।কি রান্না করবে সে? আজ কি স্যার বাড়িতে ডিনার করবেন?তাহলে হয়তো তিনিই মেন্যু ঠিক করে দেবেন।আর যদি কিছু না বলেই বেরিয়ে যান?তবে কি রান্না করবে সে?বিনতি দি যেটা বলে দেবে সেটা? কিন্তু সে এ বাড়িতে নতুন এসেছে।কিছু স্পেশাল রান্না না করলে কিভাবে চলবে?যাইহোক দেখা যাবে সময়কালে।তাড়াতাড়ি হাতঘড়িটা হাতে গলিয়ে ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তন্দ্রা।দ্রুত পা বাড়ায় গেটের দিকে।সে খেয়াল করেনা উপর থেকে তার দিকে বাইনোকুলারের মতো ফোকাস হচ্ছিল এক জোড়া চোখ।

“বিনতি,পুষ্পা!”

বিনতি রান্নাঘরে রাধুনীদের নির্দেশনা দিচ্ছিলো।এত সকালে স্যারের হুঙ্কার শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠে তার।কবে জানি এই হুঙ্কার শুনেই হার্টফেল করে মারবে সে।নীলাদ্রি তখনো ডেকে চলেছে,

“বিনতি,পুষ্পা,বিনতি!”

বিনতি হাতের কাজ ফেলে এক ছুটে হাজির হয় নীলাদ্রির সামনে।ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়,

“স্যার পুষ্পা তো নেই ,আমাকে বলুন না কি বলবেন।”

নীলাদ্রি গম্ভীর গলায় বলে,
“একটু আগে গেট দিয়ে কোন মেয়েটা বেরুলো?”

“ও,আম্,ও তো স্যার ঐযে কাল যে নতুন চাকরানীটা এসেছিলো ওই বেরুলো।”

“কেন?”

“ও নাকি ভার্সিটিতে পড়ে।সেখানেই যাবে।”

“যাও ওকে নিয়ে এসো।আজ ওর কোথাও যাওয়া হবেনা কড়া গলায় আদেশ দেয় নীলাদ্রি।”

“কে..কেন স্যার? ও তো সব কাজ শেষ করেই….”

এই প্রথমবার স্যারের আদেশের সামনে কেন প্রশ্নটা করে বিনতি।নীলাদ্রি আবার গর্জন করে উঠে,

“তোমাদের কার কি কাজ শেষ করেছে কি করেনি সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি?আমি বলছি আজ ও কোথাও যাবেনা মানে যাবেনা।যাও ওকে নিয়ে এসো।যাও!”

বিনতি পড়ি মরি করে ছুটে যায় তন্দ্রাকে নিয়ে আসতে।তন্দ্রা তখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো।বিনতি এসে তার এক হাত চেপে ধরে টেনে গেটের ভেতর নিয়ে আসে।মুখে কিছু না বলে তাকে নিয়ে যায় ঘরের ভেতর।নীলাদ্রি ততক্ষনে নিজের ঘরে চলে গেছে।তন্দ্রা বিনতির এমন আচরণে বেশ অবাক হয়।কাল তো সে বিনতি দি কে বলেছিল সে ভার্সিটি যাবে।বিনতি দি তো তখন অনুমতি দিয়েছিলেন।তবে এখন কেন যেতে দিচ্ছেননা?তন্দ্রা বিস্মিত হয়ে বিনতিকে জিজ্ঞাসা করে,

“বিনতি দি,তুমি আমাকে টেনে আনলে কেন?
আমি তো ভার্সিটি যাবো।”

বিনতি তাকে সরাসরি জবাব দেয়,
“তুমি আজ কোথাও যাবেনা।নীলাদ্রি স্যারের অর্ডার।”
কথাটা বলেই তন্দ্রার মুখ থেকে আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে চলে যায় বিনতি।

******

ওয়াশরুমে কাপড় কাঁচছিল তন্দ্রা।একটু আগে সৃষ্টি এসে নীলাদ্রি স্যারের একগাদা কাপড় ছুড়ে দিয়ে গেছে তার মুখে।স্যারের আদেশ কাপড়গুলো হাতে কাচতে হবে।ওয়াশিং মেশিন ব্যাবহার করা যাবেনা।তন্দ্রার হাতে কাপড় কাচার অভ্যাস আছে।ও বাড়িতে তো আর ওয়াশিং মেশিন ছিলনা।তাই মামা, মামী আর মাইশা দির সব কাপড় তাকে হাতেই কাচতে হতো। নীলাদ্রির প্যান্ট কাচতে গিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে নোটের একটা ব্যান্ডেল পায় তন্দ্রা।ভাগ্যিস সে এটা দেখে নিয়েছিল।নয়তো সাবান পানিতে ভিজিয়ে ফেললে কি অনর্থই না হতো!তন্দ্রা টাকাগুলো শুকনো জায়গায় রেখে আবার কাপড় কাচতে থাকে।এমন সময় সেখানে বিনতি এসে বলে,

“তন্দ্রা তোমাকে নীলাদ্রি স্যার ডাকছেন।”

কথাটা শুনে তন্দ্রার বুকে একটা চাপা ভয় পুঞ্জীভূত হতে থাকে।সে বিনতিকে জিজ্ঞাসা করে,

“কেনো বিনতি দি?”

“সে আমি জানিনা।”

“ঘরে কি স্যারের সাথে আর কেউ আছেন?”

“কেনো বলতো?”

“না মানে……..”

কেনো সে ভয় পাচ্ছে সেটা বিনতিকে বলেনা তন্দ্রা। তবে বিনতি সেটা বুঝে ফেলে তন্দ্রার চোখ দেখে। সে নরম গলায় বলে,

“স্যারের সাথে আরো অনেকে আছে। তাছাড়াও স্যার তোমাকে তার মিটিং রুমে ডেকেছেন,শোবার ঘরে নয়।”

কথাটা নিজের কাছেও যেনো কেমন নোংরা শোনায় বিনতির ।এত বছর সে এই বাড়িতে কাজ করছে কখনো স্যারের চরিত্র নিয়ে কোনো বাজে কথা সে শোনেনি।অনেক মেয়েরাই স্যারের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্যারের চরিত্রে কেউ একটা আচড় পর্যন্ত দিতে পারেনি।তন্দ্রা বিনতির দিকে একটা টাকার ব্যান্ডেল বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“এটা কি তুমি স্যার কে দিয়ে দেবে? স্যারের কাপড় কাচতে গিয়ে পেলাম।”

বিনতি প্রথমে একটু অবাক হয়। স্যারের পকেটে প্রায় প্রতিদিনই টাকা থাকে। তবে সেই টাকা আর স্যার অবধি পৌঁছায়না।

“তুমি যখন স্যারের কাছে যাচ্ছ তাহলে তুমিই দিয়ে এসো।”

“ঠিক আছে।”

“আর হ্যাঁ শোনো, নীলাদ্রি স্যারের সামনে ওখানে থাকা আর কাউকে স্যার বলে সম্বোধন করবে না।সেট খুব দৃষ্টিকটু দেখায়।মনে থাকবে?”

মাথা হেলিয়ে চলে আসে তন্দ্রা।কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল ঠিক করে নেয়। হাজার হোক পুরুষের সামনে যাচ্ছে।

মিটিং রুমটা চার তলায়।এ বাড়িতে একটা লিফট আছে।প্রায় সবাই ব্যাবহার করে।তবে নীলাদ্রি বাড়িতে থাকাকালীন সময় ওটা করো ব্যাবহারের অনুমতি নেই।নীলাদ্রি গতকাল আর একটা নতুন নিয়ম বেধে দিয়েছেন।তন্দ্রা এই লিফট ব্যাবহার করতে পারবেনা।তাকে সিঁড়ি দিয়েই উঠানামা করতে হবে।তন্দ্রা বুঝতে পারছে না কেনো নীলাদ্রি স্যার তার সাথে এমন করছেন।তার অপরাধ কোথায়?তবে কি স্যার কালকের ব্যাপারটার জন্য এখনো রেগে আছেন? কেনো ডেকেছে তাকে? তাকে কি এবার শাস্তি দেবেন? তন্দ্রা ভয়ে ভয়ে মিটিং রুমের দরজায় কড়া নাড়ে।ভেতর থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে, ‘ কাম ইন ‘ ।
তন্দ্রাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে নীলাদ্রি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার রহমানকে বলে,

“মেয়েটি ঘরে ঢুকলেই স্টপওয়াচটা চালু করবে।”

মিস্টার রহমান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। তন্দ্রা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে।ঘরে ঢুকতেই এসির ঠান্ডা হাওয়া হাড় কাপিয়ে দেয় তার।কি ভীষণ ঠান্ডা হয়ে আছে কক্ষটা।ঘরের ভেতরটায় একটা সুইট বাল্ব জ্বলছে।তাতে আবছা দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর চেহারা।তন্দ্রার সামনে একটা কিং সাইজের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নীলাদ্রি।পরনে একটা সাদা টি শার্ট,জ্যাকেট আর নীল জিন্স।তার দুপাশে দাড়িয়ে আছে বালু আর তৌসিফ।ঘরে আরেকজন পুরুষ দাড়িয়ে আছে।তাকে তন্দ্রা চেনেনা।তবে কাল একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল।পুরুষটির এক হাতে ধরা আছে কিছু ফাইল আর অন্য হাতে একটা স্টপওয়াচ।

এই প্রথম নীলাদ্রি আর তন্দ্রা মুখোমুখি হয়েছে।প্রথম দিন স্বামীর মুখোমুখি দাড়াবে ভেবে তন্দ্রার মনে আনন্দ আর লজ্জার যে অনুভূতিটা হয়েছিল আজ তার সবটা জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে ভয় আর আতঙ্ক।নীলাদ্রি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তন্দ্রার দিকে।তন্দ্রা ভয়ে ভয়ে নীলাদ্রির দিকে টাকার ব্যান্ডেলটা বাড়িয়ে দেয়,

“স্যার আপনার টাকা। আপনার কাপড় থেকে পেয়েছি।”

নীলাদ্রি বেশ বিব্রত হয়।তার পকেটে প্রায় সবসময়ই টাকা থাকে।কাপড় ধুতে দেয়ার সময় সে কখনো সেগুলো বের করতে ভুলে যায় তো কখনো ইচ্ছে করেই বের করেনা।তবে এর আগে কখনো কেউ তাকে এভাবে টাকা ফিরিয়ে দেয়নি। হালদারের মত লোভী মানুষের মেয়ে এমন নির্লোভ হয় কি করে? একটা সন্দেহের তীর আঘাত করে নীলাদ্রির মনে।

নীলাদ্রি টাকাগুলো নেয় না দেখে তন্দ্রা ব্যান্ডেলটা নীলাদ্রির সামনে থাকা টি-টেবিলের উপর রেখে দেয়। টি-টেবিলটায় রাখা আছে কিছু কাগজ।তন্দ্রা টাকা রাখার জন্য উবু হতেই নীলাদ্রি সেই কাগজগুলোর উপর একটা কলম ছুড়ে দিয়ে তন্দ্রার উদ্দেশ্যে বলে,

“সাইন করো।”

প্রথমটায় তন্দ্রা হকচকিয়ে যায়।এগুলো কিসের কাগজ?সেদিন সে না জেনে না বুঝে একটা কাগজে সাইন করে দিয়েছে।আজ আবার নীলাদ্রি আরেকটা কাগজে সাইন করে দিতে বলছে।তাহলে নীলাদ্রিও কি তাকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে?সর্বনাশ, নারী পাচারকারী! তন্দ্রা আমতা আমতা করে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞাসা করে,

” স্যার কিসের কাগজ এগুলো?”

নীলাদ্রির হয়ে উত্তর দেয় বালু,
“ভাইয়ের আদেশের উপর কখনো কেউ প্রশ্ন করে না।সাইন করতে বলছেন সাইন করো।”

তন্দ্রা আর কিছু না বলে সাইন করে দেয়।এদের সামনে সে একটা কলের পুতুল মাত্র।নীলাদ্রি যেভাবে চাবি ঘোরাবে তাকেও সেভাবেই চলতে হবে।সাইন করা হয়ে গেলে নীলাদ্রি মিস্টার রহমানকে স্টপওয়াচটা বন্ধ করতে ইশারা করে।সেটা অবশ্য খেয়াল করেনা তন্দ্রা।সাইন করার পর নীলাদ্রি তাকে বলে,

“টাকাগুলো নিয়ে যাও।আমার কাপড় ধোয়ার জন্য এটা তোমার পারিশ্রমিক।”

তন্দ্রা ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানায়।এতে ক্রুদ্ধ হয়ে তৌসিফ তার দিকে এগিয়ে যেতেই নীলাদ্রি তাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় আর তন্দ্রাকে চলে যেতে ইশারা করে।তন্দ্রা মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।তন্দ্রা চলে যেতেই নীলাদ্রি চেয়ার থেকে উঠে মিস্টার রহমানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

” কতক্ষন লেগেছে?”

“এক মিনিট ঊনষাট সেকেন্ড স্যার।” মিস্টার রহমানের কন্ঠে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।

নীলাদ্রি মুচকি হাসে,
“বলেছিলাম না ওই মেয়ের থেকে সম্পত্তি লিখিয়ে নিতে আমার জাস্ট দু মিনিট লাগবে?যদি এই স্টপ ওয়াচে দুই মিনিটের থেকে এক সেকেন্ডও বেশি হতো তাহলে প্রথম লাশটা পড়ত ওই মেয়ের আর দ্বিতীয় লাশটা পড়ত……”,
নীলাদ্রি মিস্টার রহমানের কলার ঠিক করে, “দ্বিতীয় লাশটা কার হতো বুঝে নাও।”

একটা নিষ্ঠুর হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় নীলাদ্রি। মিস্টার রহমান ঢোক গিলে নিজের শুকনো গলা ভিজিয়ে নেন।আজ বড় বাঁচা বেচে গেছেন তিনি।আর দু সেকেন্ড বেশি হলেই তার লাশ বেরুতো এই ঘর থেকে।আজ দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিতে হবে।

চলবে………