মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-৭+৮

0
460

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_০৭
#আয়াত_আফরা

বিকেল থেকেই রান্না নিয়ে ব্যাস্ত আছে তন্দ্রা।স্যার আজও বেরিয়েছেন।ফিরবেন কিনা বলে যান নি।রাতে ডিনার করবেন কিনা সেটাও জানাননি। তবে খাবার তো তৈরি করে রাখতেই হবে।কি রাধবে সেটা ভাবতে ভাবতেই সকাল কেটেছে তার।বিনতি দি-ও আলাদা করে কিছু বলে দেন নি।তাই চিন্তাটা একটু বেশি ছিল। তন্দ্রা ঠিক করে ফ্রাইড রাইস,মিন্ট চিকেন,শাহী পনির,ফিশ কাটলেট আর ডাল রান্না করবে।বিনতি দি-কে জানিয়েছে।বিনতি দিও সম্মতি জানিয়েছেন।রান্নার মধ্যে কয়েকবার এসে দেখেও গিয়েছেন তন্দ্রা একা সব করতে পারছে কি না।সাহায্য করতেন চেয়েছিলেন।কিন্তু তন্দ্রা হাত দিতে দেয়নি।দুদিনের মধ্যে তন্দ্রার ভালো লেগে গেছে মানুষটাকে।কেমন যেনো মায়া আছে তার মধ্যে।গত রাতে তন্দ্রাকে সাথে নিয়ে ডিনার করেছেন।ঘুমানোর সময় পাতলা কাঁথাটা পরিবর্তন করে নিজ থেকেই একটা ভারী কাঁথা দিয়ে গিয়েছিলেন।এ বাড়িতে একমাত্র বিনতি দি-ই তার খবর রাখে।অন্য কেউ তো ফিরেও তাকায়না।

সব রান্না শেষ করতে করতে নয়টা বেজে গেল।এখনো নীলাদ্রি ফিরে আসেনি।তন্দ্রার চিন্তা হচ্ছে।আদৌ নীলাদ্রি আজ রাতে বাড়ি ফিরবে তো? না ফিরলে তার এত আয়োজন সব বৃথা যাবে।সব রান্না শেষ করে তন্দ্রা হাত মুখ ধুতে তার ঘরে গেল।এর মধ্যে বিনতি রান্না ঘরে গিয়ে দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা।হাত মুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় তন্দ্রা।এমন সময় গত রাতের মত বাড়ির বাইরে গাড়ি থামার আওয়াজ পায় সে।নীলাদ্রি ফিরেছে তাহলে।নীলাদ্রি বিনতিকে খাবার সাজাতে আদেশ দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।বিনতি খাবার সাজাতে যেতেই তন্দ্রা তাকে থামিয়ে দেয় ,

“আমি সব করে দিচ্ছি বিনতি দি।”

পুরো টেবিল সুন্দর করে গুছিয়ে নীলাদ্রি, বালু আর তৌসিফের জন্য খাবার সাজিয়ে দেয় তন্দ্রা।তারা তিনজন একসাথেই ডিনার করে সবসময়।বিনতির কাছ থেকে তন্দ্রা জেনেছে তারা তিনজন ভাইয়ের মতো।নীলাদ্রি ওদের দুজনকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে।যদিও কবে কি করে ওরা নীলাদ্রির জীবনে এল সেটা জানে না বিনতি।খাবার সাজিয়ে টেবিলের মাঝখানে একটা বড় ক্যান্ডেল আর এক গুচ্ছ গোলাপ রাখে তন্দ্রা।টেবিলে গুছানো শেষ হয়ে যেতেই বিনতি এসে বললো,

“এবার তুমি ঘরে চলে যাও।আমিই স্যারকে সার্ভ করবো।তুমি রেস্ট নাও।”

তন্দ্রা বুঝতে পারে নীলাদ্রিদের কাছ থেকে তন্দ্রাকে দূরে রাখতে চাইছে বিনতি। ঈর্ষায় নয়, ভালোবাসায় আর ভয়ে।মা যেমন তার যুবতী মেয়েকে আড়াল করে রাখতে চায় সমাজের কুনজর থেকে ঠিক তেমনি আশঙ্কায় বিনতি আড়াল করে রাখতে চাইছে তন্দ্রাকে।তন্দ্রা কথা না বাড়িয়ে চলে আসে নিজের ঘরে।একটু পরেই নীলাদ্রিরা ডিনার করতে আসে।টেবিলের মাঝখানে ক্যান্ডেল আর গোলাপ দেখে একটু অবাক হয় নীলাদ্রি।তবে মুখে কিছু প্রকাশ না করে খেতে বসে।বালু একটু রসিকতা করে বলে,

“বাহ ক্যান্ডেলাইট ডিনার।কিন্তু বউ প্রেমিকা ছাড়া ঠিক জমে না, কি বলো ভাই?”

নীলাদ্রিকে একটু চোখ টিপে হেসে উঠে বালু আর তৌসিফ।কিন্তু নীলাদ্রির শীতল চোখে চোখ পড়তেই চুপ হয় যায় দুজন।বালুর মনেহয় বউ বা প্রেমিকার প্রসঙ্গটা পছন্দ হয়নি নীলাদ্রির।তাই সে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।

একটু খাবার মুখে দিতেই অবাক হয় নীলাদ্রি।স্বাদটা কেমন যেনো ভিন্ন মনে হচ্ছে।এমন নয় যে এসব তার বাড়িতে আগে রান্না হয়নি।তবে আজকের খাবারগুলোর স্বাদ আগের চেয়েও ভালো।নীলাদ্রি বিনতিকে জিজ্ঞেস করলো,

“খাবারটা কে বানিয়েছে?”

বিনতির মনে হলো হয়তো খাবারটা ভালো হয়নি।সে ভীত গলায় বললো,
“কেনো স্যার ,ভালো হয়নি?”

“হ্যাঁ,বেশ ভালো হয়েছে।কে বানিয়েছে?”

বিনতি এবার খুশি হয়,
“ঐযে স্যার নতুন চাকরণী,ওই বানিয়েছে।”

কথাটা কানে যেতেই খাবার চিবানো বন্ধ হয়ে গেলো নীলাদ্রির।গলায় একটু খাবার আটকে গিয়েছে। কাঁশতে থাকে সে।বিনতি ,বালু আর তৌসিফ ভয় পেয়ে যায়।বিনতি তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিল,

“কি হলো স্যার?এই নিন পানি।”

নীলাদ্রি এক ঢোক পানি খেয়ে কাশি থামায়।হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর ঠাস করে রেখে সামনে থাকা খাবার থালাটা ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে।মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে যায় সেটা।টুকরো টুকরো কাঁচ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।উত্তেজনায় দাড়িয়ে যায় বালু আর তৌসিফ। নীলাদ্রি চিৎকার করে উঠে, –

“এসব কোনো খাবার হলো? এত জঘন্য খাবার আমি জীবনেও খাইনি।”

বিনতি ভীষণ অবাক হয়।একটু আগে যে খাবারকে নীলাদ্রি ভালো বলছিলো এক মুহুর্তে সেটা খারাপ হলো কি করে!

“তুমি জানোনা আমি খাবারে বেশি তেল মশলা পছন্দ করি না।এত তেল কেনো খাবারে?”

বিনতি মিনমিনে গলায় বললো,
“স্যার, স্যার নতুন মেয়ে তো ভুল হয়ে গেছে।আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।”

“কিসের নতুন মেয়ে,এত জঘন্য খাবার আমাকে খাওয়ানোর সাহস হলো কি করে ওর?”

“স্যার ওকে ক্ষমা করে দিন।কাল থেকে ও আর আপনার খাবার রান্না করবেনা।”

নীলাদ্রি কি ভেবে একটু শান্ত হয়।এরপর ভ্রু কুচকে বললো,
“না।কাল থেকে ওই আমার খাবার রান্না করবে।আমি যেটা বলবো সেটাই রান্না করবে।আর যদি খারাপ হয়….. ”

বাকিটুকু বুঝতে সেখানে উপস্থিত কারোরই খুব একটা অসুবিধা হয়না।নীলাদ্রি ক্রুর হাসি দিয়ে খাবার না খেয়েই চলে যায় সেখান থেকে।মনে মনে ভাবতে থাকে, দুদিনের মেয়ে। এসেই কিনা তার মন জয় করার চেষ্টা করছে!বেচারি,ভেবেছিলো তাকে রান্না করে খাইয়ে খুশি করবে।কিন্তু সেই মেয়ে তো জানেনা তার সব কষ্টের ফলস্বরূপ সে এই নীলাদ্রির কাছ থেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছুই পাবেনা।

খাবার বেশ ভালই লেগেছিল নীলাদ্রির।কিন্তু শত্রুর মেয়ের রান্না করা খাবার,যতই ভালো হোক সেটা গলায় কাঁটার মত বিধে।

******

নিজের ঘরে বসে দু হাঁটুতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল তন্দ্রা।নীলাদ্রির ছুড়ে ফেলে দেয়া প্লেটের শব্দ আর তার বলা প্রত্যেকটা কথা শুনতে পেয়েছে সে।তার রান্না তো খারাপ না।ও বাড়িতে তো সেই রান্না করতো।কিন্তু কখনো তো কেউ খারাপ বলেনি।আর আজ কিনা নীলাদ্রি স্যার খাবার থালা ছুড়ে ফেলে দিলেন।কত আশা নিয়ে স্যারের জন্য খাবার বানিয়েছিল সে।ভেবেছিল তার রান্না খেয়ে স্যার হয়তো খুশি হবেন।স্যারকে একটু খুশি দেখার জন্য সারাদিন এত পরিশ্রম করলো সে।অথচ স্যার……..
খাবার খারাপ হলে মুখে বললেই তো পারতেন, ‘খারাপ হয়েছে,এ খাবার খাবোনা’।ছুড়ে ফেললেন কেনো? তার রান্না কি এতটাই খারাপ? বিনতি ঘরে ঢুকে তন্দ্রাকে ওই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে তার মাথায় হাত দেয়।কিন্তু তন্দ্রার সেই স্পর্শ অনুভূত হয় না।বিনতি এবার কথা বলে,

“এই একটু আঘাতে ভেঙ্গে পড়লে হবে? এ বাড়িতে যখন এসেছিস আরো অনেক কিছু সহ্য করতে হবে যে।”

তন্দ্রা এবার খেয়াল করে বিনতিকে।সে মুখ তুলে কান্নার বেগ চেপে বলে,

” সত্যি কি আমার রান্না এত খারাপ হয়েছিল বিনতি দি?”

“না রে তোর রান্না খারাপ হয়নি।স্যারের মাথা গরম ছিল।তাই সেই রাগ খাবারের উপর ঝেড়েছেন।”

“দরকার হতো আমার উপর রাগ ঝারতেন।কেনো খাবার ছুড়ে ফেলে দিলেন? খাবার যে খোদার রহমত।ও কি ছুড়ে ফেলতে আছে বিনতি দি?”

বিনতি কি বলবে ভেবে পায়না।এ বাড়িতে থেকে অনেক সহ্য করেছে সে।বুঝে গেছে মনিবের সব কথায় যুক্তি খুঁজতে হয় না।কিন্তু এ যে দুদিনের মেয়ে।একে কি দিয়ে বোঝাবে সে এসব?

******

অফিসে মাথা চেপে ধরে বসে ছিল নীলাদ্রি।একটু আগে একটা মিটিং শেষ হয়েছে।বড় বড় কয়েকটা পার্টি এসেছিল।কিন্তু করো সাথেই আশানুরূপ ডিল ফিক্সড হচ্ছেনা।সবাই তাদের প্রোডাক্ট কিনতে চায় কিন্তু কেউ নির্ধারিত প্রফিট দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছেনা নীলাদ্রির। একটা নিজস্ব ব্র্যান্ড দাড় করানোর ইচ্ছা আছে তার।সেটার জন্য জায়গাও সিলেক্ট করতে হবে।একটা সিক্রেট মিশনেও যেতে হবে ওকে।কোন দিক যে সামলে উঠবে বুঝতে পারছে না সে।এমন সময় তার শিডিউল নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে তুলয়।

“স্যার, মিস্টার শর্মার সাথে আপনার যে মিটিং টা আছে……. ”

নীলাদ্রিকে মাথা চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে কথা শেষ করেনা সে।তুলয় সুন্দরী লাস্যময়ী।তবে সৌন্দর্য দেখে তাকে কাজে নেয়নি নীলাদ্রি।তুলয়ের যথেষ্ট দায়িত্ববোধ আছে।নীলাদ্রিকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে তুলোয় উদ্বিগ্ন স্বরে বললো ,

“স্যার মিটিং কি ক্যান্সেল করবো?”

“না প্রয়োজন নেই।শুধু সময়টা একটু পিছিয়ে দাও।”

“আমার মনেহয় আপনার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।”

“হ্যাঁ আপাতত একটু বিশ্রামের দরকার আছে।তবে মিটিং ক্যান্সেল করার প্রয়োজন নেই।আমি মিস্টার শর্মাকে কথা দিয়েছি।আর এই নীলাদ্রি কখনো কথার খেলাপ করেনা।”

“কিন্তু স্যার একদিন পিছিয়ে দিলে তেমন কিছু একটা হবে বলে মনে হয়না।আপনি চাইলে আজকের দিনটা ছুটি করে আমরা একটু আলাদা সময় কাটাই? আমাদের মত?”
তুলোয় নীলাদ্রির হাতে উষ্ণ আলিঙ্গন করে।

নীলাদ্রি তুলয়ের ইশারা বুঝে এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে দাড়িয়ে যায়।

“তুলয় আশকারা দিয়েছি বলে আস্পর্ধা দেখিও না।শর্মার সাথে মিটিং টা এক ঘণ্টা ডিলে করো।আমি লাঞ্চ করেই মিটিংয়ের জন্য বেরুব।আর রিসোর্টের জন্য জায়গা সিলেক্ট করতে বলেছিলাম,করেছ?”

তুলয় বিগত প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায়না।

“হ্যাঁ স্যার,কিরণপুরে একটা জায়গা আছে।সামনে লেক আর পেছনে পাহাড় দেখা যায়।ওখানে রিসোর্ট করলে অনেক প্রফিট হবে।কিন্তু স্যার….”

” কিন্তু কি?”

“ওই জায়গার মালিক জায়গাটা দিতে চাইছেনা।তবে আমরা যদি টাকার অঙ্কটা বাড়িয়ে দেই তাহলে হয়তো রাজি হবে।”

“ওই জায়গার মালিকের সাথে আমার কথা হয়েছে।ওখানে সে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করতে চায়।তবে টাকার জন্য করতে পারছেনা।এক কাজ করো ব্যাংক থেকে ওর অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করো আর আমাদের কিছু লোককে ওখানে পাঠাও।আমি চাই হসপিটালটা তৈরি হোক আর সেটা ঠিকমতো হলো কিনা আমাদের লোক তদারকি করুক। রিসোর্টের জন্য অন্য জায়গা দেখ।”

“কিন্তু স্যার…..”

তুলয়ের পরবর্তী শব্দের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় নীলাদ্রি। তুলয় মুখ বেকিয়ে দাড়িয়ে থাকে।অতগুলো টাকা এমনি এমনি দিয়ে দিলো? এই পুরুষকে সে কিছুতেই হাতের মুঠোয় আনতে পারছে না।না কথায় আর না রূপে।এ যেনো তার সংযমের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে।নীলাদ্রি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর নীলাদ্রির ড্রয়ারে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করে তুলয়।কিন্তু বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজির পরও প্রত্যাশিত জিনিসটা না পেয়ে বিরক্ত হয় সে।

“নীলাদ্রি চৌধুরী, হয় তুমি আমার হবে নতুবা তোমার সমস্ত গোপনীয়তা আমি বাইরের দুনিয়াকে জানিয়ে দেবো।শুধু একটা প্রমাণের অপেক্ষা।”

চলবে…….

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_০৮
#আয়াত_আফরা

সকালে তাড়াহুড়া করে ভার্সিটির জন্য বেরুচ্ছিলো তন্দ্রা।গত কয়েকটা ক্লাসে স্যারের খামখেয়ালির জন্য যেতে পারেনি।আজকের ক্লাসটা কোনোভাবে মিস করা চলবেনা।না খেয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু বিনতিদির জোরাজুরিতে খেতে হলো।বিনতির মধ্যে একটু একটু করে যেন মায়ের রূপ দেখতে পাচ্ছে তন্দ্রা।ব্রেড ,কলা আর দুধ খেয়ে দ্রুত বাড়ির প্রধান দরজার সামনে এসে থমকে দাড়ালো সে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাইবেরিয়ান হাস্কি।সেটাকে দেখে প্রথমে চমকে গিয়েছিলো তন্দ্রা।সাদা আর হালকা কালো লোমে প্রাণীটাকে ভদ্র দেখালেও তার মুখের অভিব্যক্তি খুব একটা সুবিধাজনক নয়।কুকুরটির গলায় একটা বেল্ট বাঁধা।তার শেষ প্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি।ও কুকুরটি তাহলে নীলাদ্রি স্যারের!এতক্ষনে হাঁপ ছাড়লো তন্দ্রা।কুকুরটিকে তো নীলাদ্রি স্যার ধরেই রেখেছেন।আর কোনো ভয় নেই তাহলে।এই দেশে একটা সাইবেরিয়ান হাস্কি পোষা চাট্টিখানি কথা নয়।একমাত্র নিলাদ্রীর মতো বড়লোকরাই পারে।ওরা কুকুরের পেছনে কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে আর ওদিকে পথশিশুরা না খেতে পেয়ে মারা যায়।ওদের দেখার মতো কেউ নেই।একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো তন্দ্রার বুক চিরে।নীলাদ্রি তন্দ্রার আপাদমস্তক একবার জরিপ করে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

বেরুনোর সময় নীলাদ্রির সামনে পড়বে সেটা আশা করেনি তন্দ্রা।নীলাদ্রি বরাবরই এই সময় জিম করে, মর্নিং ওয়াকে যায়।তবে আজ যে এত তাড়াতাড়ি ফিরলো? আর এই কুকুরটাকেই বা কোথা থেকে নিয়ে এলো? গত দুদিন তো এটাকে নীলাদ্রির সাথে দেখেনি তন্দ্রা।

“কি হলো চুপ কেনো?”

“স্যার আসলে আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম।”

“আমার পারমিশন নিয়েছ?”

“না মানে বিনতিদি-কে… ”

“তোমার মনিব কে?বিনতি না আমি?”

“জি আপনি।”

“তাহলে আমাকে জানাওনি কেনো? কেনো?” গর্জে উঠে নীলাদ্রি।

তন্দ্রা নিরুত্তর থেকে।তাকে নিরুত্তর দেখে নীলাদ্রি মিটিমিটি হেসে বললো,

“যাও।”

তন্দ্রা বিস্মিত হলো।নীলাদ্রি তাকে এত সহজে যেতে দিচ্ছে!

” ধন্যবাদ স্যার।” খুশিতে গদগদ হয়ে নীলাদ্রিকে ধন্যবাদ জানালো তন্দ্রা।

নীলাদ্রির কুকুরটি ততক্ষনে দাঁত খিঁচাতে শুরু করেছে।হাস্কি শ্রেণীর কুকুরদের ব্যাপারে তন্দ্রা জানে।এরা খুব একটা আক্রমণাত্মক হয়না।তাই তন্দ্রা ধীরে ধীরে সেটার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো।কুকুরটিও একটু একটু করে ঘাড় ঘুরাতে লাগলো তন্দ্রার দিকে।হঠাৎ কুকুরটির ঘেউ ঘেউ শব্দে তন্দ্রা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো কুকুরটির বেল্ট খসে পড়েছে নীলাদ্রির হাত থেকে।সে এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। কুকুরের বেল্টটি ভুলবশত ছুটে গিয়েছে, না নীলাদ্রি ইচ্ছা করেই ছেড়ে দিয়েছে সেটা বুঝতে পারলোনা তন্দ্রা।বোঝার সময় সে পেলোনা।কুকুরটি আবার ডেকে উঠে তাড়া করলো তন্দ্রাকে।তন্দ্রা ভয়ে সেটার থেকে দূরে পালাতে লাগলো।কিন্তু কুকুরটিও এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়।সে তন্দ্রার ওড়নার নাগাল পেয়ে এক টানে সেটা কেড়ে নিলো দাঁত দিয়ে।তন্দ্রা ঘরের এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগলো কুকুরটির হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। জিনিসপত্রের খোঁচা লেগে জামার কয়েক জায়গা ছিড়ে গেলো।আঁচড় লাগলো গায়ে।কিন্তু নীলাদ্রি কোনোভাবে কুকুরটিকে থামানোর চেষ্টা করলোনা।সে যেন এই খেলায় মজা পাচ্ছে।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলো বিনতি। এসেই প্রথম ধাক্কায় হতবাক হয়ে গেল সে।ছেঁড়া জামাকাপড় আর দেহে আঁচড়ের দাগ নিয়ে সারাঘরে দৌড়াচ্ছে তন্দ্রা।তার পেছনে তাড়া করছে নীলাদ্রির প্রিয় কুকুর ‘লিও’।তন্দ্রা হাঁপাচ্ছে।নীলাদ্রি ঠায় দাড়িয়ে আছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। তার না আছে কোনো চিন্তা আর না কোনো ভ্রূক্ষেপ।যদি কুকুরটি তন্দ্রার উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাহলে? বুক কেঁপে উঠলো বিনতির।সে দৌড়ে গিয়ে নীলাদ্রির পায়ে পড়লো,-

“স্যার,দয়া করে লিওকে থামতে বলুন।ও মেরে ফেলবে বেচারিকে।”

নীলাদ্রি বেশ বিরক্ত হলো।
“সসসসস্ চুপ করো।দেখছো না কুকুর বিড়ালের খেলা চলছে।জাস্ট এঞ্জয়।”

তন্দ্রা দৌড়ে চলেছে এদিক থেকে ওদিক। ধাক্কা খাচ্ছে সোফা,চেয়ার, টেবিলের সাথে। জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ঘরের একটা থামে মাথা ঠুকে গেলো তন্দ্রার। “ওহ!” দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো সে।হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে টাটকা রক্তের উষ্ণ স্রোত।কুকুরটি তখন তন্দ্রার সামনে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো উপস্থিত হয়েছে। অবশেষে তার শিকার আহত।এতে যেন সে বেশ মজা পেলো।দুবার জোরে ঘেউ ঘেউ করে দুলকি চালে এগুতে লাগলো তন্দ্রার দিকে। তন্দ্রা দেখতে পেলো যমদূতের মতো তার দিকেই এগিয়ে আসছে কুকুরটি।কাছে আরও কাছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে মৃত্যুর প্রহর গুনতে শুরু করলো তন্দ্রা।সে জানে নীলাদ্রি স্যার এ কুকুরকে থামাবেন না।তার মৃত্যু নিশ্চিত! কুকুরটি দুপা পিছিয়ে এসে তন্দ্রার উপর ঝাপিয়ে পড়তেই যাবে এমন সময় পেছন থেকে নীলাদ্রির গম্ভীর গলা ভেসে এলো,

“লিও! লিও কাম হিয়ার বেব।দেটস্ রোটেন ফুড।কাম কাম।”

নীলাদ্রির গলা পেয়ে কুকুরটি শান্ত হয়ে এগিয়ে গেল তার কাছে।নীলাদ্রি কুকুরটির গলা ঘাড়ের লোমশ অংশে হাত বুলিয়ে দিলো।তন্দ্রা তার ছেঁড়া জামাকাপড় আর মাথা চেপে ধরে কোনোরকমে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।নীলাদ্রি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে বসলো।তার মুখে ফুটে উঠলো কৃত্রিম দুঃখের ভাব।

” ইস কি অবস্থা!খুব লেগেছে তাইনা?”

তন্দ্রার চোখের কোণে জল জমতে শুরু করেছে। ঠোঁট চেপে কোনক্রমে কান্নার বেগ রোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।

“মিস কাজের মেয়ে,আমার লিওর কাছ থেকে দূরে থাকবেন।নয়তো ও আপনাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।হাহ্ পুওর গার্ল।”

মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কুকুরটিকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো নীলাদ্রি।

তন্দ্রার শরীরের অনেক অংশ অনাবৃত হয়ে গেছে।বিনতি একটা কাপড় এনে দ্রুত ঢেকে দিলো তাকে।তন্দ্রা তখনও ভয়ে কাঁপছে।মানুষ এমনও হয়?জীবনে নিষ্ঠুরতা সে অনেক দেখেছে।কিন্তু এ পুরুষ যে তার সব সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

“তুই কে বলতো?”

বিনতির শীতল গলা শুনে চমকে উঠলো তন্দ্রা। বিনতি দি হঠাৎ তাকে এই প্রশ্ন কেন করছেন? তন্দ্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বিনতির দিকে।

“তুই কে? তুই কি এমন অপরাধ করেছিস যার জন্য স্যার তোর পিছনে এভাবে পড়ে আছেন? স্যার তো কাউকে অযথা শাস্তি দেন না।তাহলে তোর সাথে এমন করছেন কেন?কি করেছিস তুই?”

বিনতি দি! বিনতি দি তাকে সন্দেহ করছে? সে ভেবেছিলো অন্তত বিনতি দি তাকে বোঝে।কিন্তু….

“তুমি বিশ্বাস করো বিনতি দি আমি কিচ্ছু করিনি।আমি জানিনা কেন স্যার এমন করছেন।আমি কিচ্ছু জানিনা,কিচ্ছু না।”

কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তন্দ্রা।বিনতি বোঝে এমন কঠোরভাবে তন্দ্রার সাথে কথা বলা তার উচিত হয়নি।এমনিতেই মেয়েটা মানসিক আঘাত পেয়েছে।

“আচ্ছা কাঁদিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তন্দ্রা কান্নাভেজা গলায় বললো,
“বিনতি দি আমার মনেহয় স্যার চান না যে আমি ভার্সিটিতে যাই।তাই প্রতিদিন আমাকে বাধা দিয়ে চলেছেন।”

“কিন্তু স্যার কেন এমনটা চাইবেন? তিনি নিজেই তো একজন শিক্ষিত মানুষ। আর উনি একটা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডোনেশনও দিয়ে থাকেন।”

“সেসব আমি জানিনা দি।তুমি তো দেখতে পাচ্ছো প্রতিদিন কোনো না কোনো গোল বাঁধিয়ে স্যার আমাকে ভার্সিটি যেতে বাধা দিচ্ছেন।”

” তন্দ্রা যদি তোর ধারণা সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমি হলপ করে বলতে পারি তোর আর কখনো ভার্সিটি যাওয়া হবেনা।স্যার যেটা একবার ভেবে নেন সেটা না করা অবধি থামেন না।”

বিনতির কথায় ভয় পেয়ে গেলো তন্দ্রা।একমাত্র পড়ালেখাকে সম্বল করেই তো সে বেঁচে আছে।এখন যদি এটাকেও তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তাহলে কি নিয়ে বাঁচবে সে?

“কি বলছো বিনতি দি! কিছু একটা করো।আমি পড়ালেখা করতে চাই।দয়া করে স্যারকে একটু বুঝিয়ে বলো।”

“আমি বললে স্যার শুনবেন না।তোকেই স্যারের থেকে পারমিশন নিতে হবে।হয়তো প্রথম দিন তু্ই স্যারের পারমিশন না নিয়ে বেরিয়েছিলি বলে স্যার রেগে আছেন।তবে তুই যদি একবার স্যারকে বুঝিয়ে বলিস তাহলে হয়তো স্যারের রাগ আর থাকবেনা।”

তন্দ্রা কিছুক্ষন ভাবে।সত্যিই কি তার এই ভুলের জন্য নীলাদ্রি তাকে শাস্তি দিচ্ছে? অন্যায়ের শাস্তি মেনে নেয়া যায়।কিন্তু অপরাধ না জেনে সারাজীবন শাস্তি বয়ে বেড়ানোটা কি আদৌ সম্ভব?

********

পরদিন বেশ রাতে অফিস থেকে ফিরলো নীলাদ্রি। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো।কোটটা খুলে হাতে নিয়েছে সে।তন্দ্রা ড্রয়িং রুমে টিভির উপরের ধুলো ঝাড়ছিলো।তার দেহের যন্ত্রণা খানিক কমেছে।বিনতি দি মলম লাগিয়ে দিয়েছিল কাল রাতে।কুকুরটিকে আপাতত কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা তন্দ্রা।বিনতির থেকে জেনেছে কুকুরটি নীলাদ্রির ছায়াসঙ্গী।ছোটবেলা থেকে তার সাথেই আছে।দুদিন আগে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ভ্যাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আজ সকালে স্যার নিয়ে এসেছেন।

তন্দ্রা ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে একবার চোরা চোখে তাকালো নীলাদ্রির দিকে।নীলাদ্রি ফোনে কিছু একটা ঘাটছিল আর ঘরে ঢুকছিল। তার খুব কাছাকাছিই ছিল তন্দ্রা।নীলাদ্রি তার দিকে একবার ফিরেও তাকালোনা।বিনতিকে স্মুদির হুকুম দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।তন্দ্রা সারাদিন নীলাদ্রির জন্যই অপেক্ষা করেছে।নীলাদ্রির হুকুম শুনে তড়াক করে কিচেনে এসে বিনতিকে বললো,

“বিনতি দি স্মুদিটা আমি বানাই?”

সৃষ্টি তখন নীলাদ্রির জন্য স্মুদি বানানোর প্রিপারেশন নিচ্ছিলো।তন্দ্রার এই প্রস্তাব শুনে সে একটু বিরক্ত হলো।সাথে রাগও হলো তার।তবে সেসব প্রকাশ না করে সে বাধা দিয়ে বললো,

“না না বিনতি দি।ও বানাতে পারবে না।কি বানাতে কি বানাবে, পরে স্যার আমাদের ঝাড়বেন।”

“না সৃষ্টি দি আমি বানাতে পারবো।আমি খুব ভালো স্মুদি বানাই।”

বিনতি বুঝতে পারলো তন্দ্রা কেন স্মুদি বানাতে চাইছে।তাই সে সৃষ্টকে থামিয়ে দিলো,

“আঃ সৃষ্টি, ও বানাতে চাইছে তুই কেন নিষেধ করছিস? ও বলছে তো বানাতে পারবে।তুই স্যারের জন্য খাবার টেবিল সাজা যা।”

“থ্যাংক ইউ বিনতি দি” তন্দ্রা খুশি হয়ে সৃষ্টির থেকে ব্ল্যান্ডারটা নিয়ে স্মুদি বানাতে চলে গেলো।

সৃষ্টির রাগ এবার মাত্রা ছাড়ালো। সে সরাসরি এসে বিনতিকে বললো,

“কি ব্যাপার বিনতি দি,তুমি আজকাল ওই মেয়ের পক্ষ নিয়েই বেশি কথা বলছো দেখছি?”

“আরে পক্ষ নেয়ার কি হলো,ও যখন বলছে ও ভালো বানাতে পারে তখন ওই বানাক না।স্যারের খুশি হওয়া নিয়েই তো কথা।”

“বাহ তাহলে তুমি বলতে চাইছো আমি এতোদিন স্যারকে খারাপ স্মুদি খাইয়েছি?আমি স্মুদি বানাতে পারি না?”

“আরে সৃষ্টি তুই রাগ করছিস কেন?আমি তা কখন বলেছি?”

“তুমি ওই মেয়েটাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিচ্ছনা?”

“দেখ সৃষ্টি ও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।একটু তো প্রশ্রয় দিতেই হবে।দেখিসনি কেমন বাচ্চাদের মতো।কি মায়া লাগে মেয়েটাকে।ছোটদের একটু আধটু প্রশ্রয় দিতে হয়।”

“হ্যাঁ তোমার নিজের কোনো বাচ্চা নেই তো তাই যাকে দেখো তাকেই তোমার মায়া লাগে।যত্তসব!”

সৃষ্টির কথাটা শুনেই বিনতির সাথে সেখানে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়।বিনতিকে সৃষ্টি এমন কথা বলতে পারে সেটা কারোর ধারণাতেই ছিলোনা।প্রিয়া তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল,

“সৃষ্টি এসব তুই কি বলছিস?বিনতিদির সন্তান না থাকলেও উনি আমাদের তো বোনের মতো আগলে রেখেছেন।মায়ের মতো স্নেহ করেছেন।আর তুই ….”

বিনতির চোখের কোণে জল জমে উঠলো।বিয়ের বিশ বছর কেটে যাওয়ার পরও তার কোনো সন্তান হয়নি।তাই বাজা অপবাদ দিয়ে তার স্বামী তাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিলো।বাপের বাড়িতেও তাকে আর গ্রহণ করলোনা।সহায় সম্বলহীনার মতো যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলো তখন নীলাদ্রির দাদু পূর্বোত্তম চৌধুরী তাকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন।সেই থেকে সে এখানেই আছে।ভালোই আছে।পূর্বের সব কথা সব স্মৃতিকে এক পাশে সরিয়ে ভালোই ছিলো সে।কিন্তু আজ সৃষ্টির বলা কথাগুলো যেন সেই স্মৃতির কাগজগুলোতে এক বিন্দু আগুনের স্ফুলিঙ্গের মত আঘাত করলো।চোখের সামনেটা জলে ঝাপসা হয়ে এলো তার।

********

অরেঞ্জ স্মুদি নিয়ে নীলাদ্রির দরজার সামনে দাঁড়ালো তন্দ্রা।ভয়ে আর উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে তার।নীলাদ্রিকে কি কি বলবে কিভাবে বলবে সেটা মনে মনে আরেকবার রিহার্সাল দিয়ে নিলো সে।

“কুল তন্দ্রা কুল।তুই যাবি আর সরাসরি স্যারকে কথাটা বলে দিবি।ভয়ের কিচ্ছু নেই।অল ইস ওয়েল।”

নিজেকে সাহস দেয় তন্দ্রা।সে নিশ্চই পারবে।তাকে পারতেই হবে।এটা তার সারা জীবনের ব্যাপার।কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজায় টোকা দিলো তন্দ্রা।ভেতর থেকে ভরাট পুরুষালি গলা ভেসে এলো,

“হু ইজ দেয়ার?”

কন্ঠটা শুনেই তন্দ্রার সাহস যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো।কি বলতে এসেছিল কি ভাবছিল সব গুলিয়ে ফেললো সে।

“আই সে হু ইজ দেয়ার?” ভেতর থেকে এবার একটু ধমকের স্বর ভেসে এলো।

তন্দ্রা সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো, “স্যার আপনার স্মুদি ।”

“কাম ইন।”

ভেতর থেকে পারমিশন পেয়ে তন্দ্রা দরজাটা হাল্কা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তন্দ্রার এত ভয় করছিলো যে তার মনে হচ্ছিল সে হয়তো ভাইভা এক্সাম দিতে যাচ্ছে।আর ভেতরের ব্যাক্তিটা হলো তার পরীক্ষক।যদিও ভাইভা হলে যেতেও সে এত ভয় কখনো পায়না।মেঝের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো তন্দ্রা।মেঝেতে কিছু পড়ে আছে কি না বোঝার উপায় নেই।রুমের ভেতরে সুইট বাল্ব জ্বলছে।তার আলোতে চারিদিক ভাসা ভাসা দেখা যায়।নীলাদ্রিকে ঘরের ভেতরে কখনো উজ্জ্বল আলোতে দেখেনি তন্দ্রা।সব সময় অন্ধকার আর আধো অন্ধকার ঘরে থাকে সে।কক্ষটা থাকে প্রচন্ড রকম ঠান্ডা।কি জানি আলোর সাথে কি শত্রুতা তার।

তন্দ্রা ভেতরে ঢুকে দেখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় চেঞ্জ করছে নীলাদ্রি।তার কোট শার্ট পড়ে আছে বিছানায়।সবেমাত্র প্যান্ট চেঞ্জ করে একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে।শার্টের বোতাম এখনো খোলা।তার মধ্যে দিয়ে বুক আর অ্যাবস্ দৃশ্যমান।তন্দ্রার বেশ অস্বস্তি হয়।কোনো পুরুষকে এভাবে আগে দেখেনি সে।চোখ নামিয়ে নিলো তন্দ্রা।নীলাদ্রি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে খেয়াল করলো তন্দ্রাকে।একটু অবাক হলো সে।তন্দ্রা স্বেচ্ছায় তার কক্ষে আসবে সেটা ভাবতে পারেনি নীলাদ্রি।তন্দ্রা টি-টেবিলের উপর স্মুদির গ্লাসটা রাখলো।

“তোমাকে বিনতি পাঠিয়েছে?”

প্রশ্নটা ভেসে আসে নীলাদ্রির পক্ষ হতে।সে কাপড় চেঞ্জ করে এসে বসেছে তন্দ্রার সামনে থাকা সোফাটায়।স্মুদির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিলো সে। ভালো লেগেছে কি না তার মুখের অভিব্যক্তি দ্বারা বুঝতে পারলোনা তন্দ্রা। তন্দ্রা ডানে বায়ে ঘাড় নাড়ালো,

“না স্যার।”

“তাহলে তুমি স্বেচ্ছায় আমার ঘরে এসেছো?”

“জি স্যার।”

এভাবে স্বেচ্ছায় কেবল স্মুদি দেয়ার জন্য মানিক হালদারের মেয়ে যে তার ঘরে আসেনি সেটা নীলাদ্রি আন্দাজ করে নিলো।

“আমি ঘরে থাকাকালীন সময় কেউ আমার কামরার দিকে আসার সাহস পায়না তুমি জানো?”

“আমিও কি শখ করে এসেছি নাকি?নেহাত পারমিশন নিতে হবে।নাহলে জীবনেও এমুখো হতাম না” মনে মনে ভাবে তন্দ্রা।

নীলাদ্রির কথার কোনো জবাব দেয়না সে।নীলাদ্রি প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য ব্যাতিব্যাস্তও নয়।সে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বিজনেস ম্যাগাজিন পড়তে শুরু করলো।ট্রে হাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো তন্দ্রা।তার দিকে আর ফিরেও তাকালোনা নীলাদ্রি।যেন এখানে তন্দ্রা উপস্থিতই নেই।তন্দ্রা বুঝতে পারে তাকে সরাসরি ইগনোর করছে নীলাদ্রি।এখানে তার উপস্থিতি নিষ্প্রয়োজন।কিন্তু যে করেই হোক আজ যে তাকে নিলাদ্রীর থেকে পারমিশন নিতেই হবে।এভাবে রোজ ক্লাস কামাই করলে তো ভার্সিটি থেকেই বের করে দেয়া হবে তাকে।তখন কি করবে সে?
কি ব্যাপার নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তো সে অনেকবার প্রাকটিস করেছে।তাহলে এখন নীলাদ্রির সামনে এসে কিছু বলতে পারছেনা কেন?পেটের কথা ঠোঁটের কাছে এসেই আটকে যাচ্ছে।তার ঠোঁটগুলোকে যেনো সুঁই সুতো দিয়ে সেলাই করে দিয়েছে নীলাদ্রি।

প্রায় আধা ঘন্টা পর নীলাদ্রি বিজনেস ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রাখলো।স্মুদির গ্লাসটা অবশেষে খালি হয়েছে।তন্দ্রা তখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে।নীলাদ্রি তাকে দেখেও দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করলোনা।

“আচ্ছা তোমার নামটা যেন কি?”

ওপাশের তাক থেকে একটা কাঁচের বোতল নিয়ে এসে টি-টেবিলের উপর রাখলো নীলাদ্রি।তন্দ্রা বুঝতে পারলোনা সেই বোতল কি থাকতে পারে।মদ কি? তেমনি তো মনে হচ্ছে বোতলটাকে দেখে।

“আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছি,তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?” এবার ধমকের স্বরে প্রশ্নটা তন্দ্রার দিকে ছুড়ে দেয় নীলাদ্রি।

তন্দ্রা একটু ঘোরের মধ্যে ছিল।নীলাদ্রির ধমক শুনে হুশ ফিরে। সর্বনাশ! স্যার কি রাগ করলেন?সে তো প্রশ্ন শুনতে পায়নি।কি জিজ্ঞাসা করেছেন স্যার?

“না,না স্যার।সে দুঃসাহস আমার নেই।”

“আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছি।”

“কি স্যার?”

“কোন দুনিয়ায় থাকো তুমি?” ক্রুদ্ধ হয় নীলাদ্রি। “নাম কি তোমার?”

“তন্দ্রা।”

“পুরো নাম কি?”

“রোদেলা তাসনিম তন্দ্রা।”

নামটা শুনে একটু খটকা লাগে নীলাদ্রির। মানিক হালদারের মেয়ের নামে কোনো সারনেম নেই!কিন্তু সে তো দাদুর কাছ থেকে শুনেছিলো এই মানিক হালদার নাকি তার সারনেমটা নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস।তার মেয়ের নামের সাথে সে সারনেম যুক্ত করবেনা সেটা কি করে হয়?

“তুমি মানিক হালদারের মেয়ে?”

চুপ থাকে তন্দ্রা।মামী মাকে কথা দিয়ে এসেছে এ বাড়ির কাউকেই সে সত্যিটা জানাবেনা।এমনকি নীলাদ্রীকেও না।সে উপর নিচে মাথা নাড়লো।নীলাদ্রি বোতলের তরলটা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে একটা হাত সোজা রেখে সোফার উপর হেলান দিয়ে বসলো।

“তুমি কি জানো তোমার সাথে আমার কি সম্পর্ক?”

নীলাদ্রির প্রশ্নটা তন্দ্রার মনকে উদাস করে।প্রথম দিন ও বাড়ি থেকে যে সম্পর্কের রেশ ধরে এ বাড়ির দরজায় সে এসেছিলো দরজা পেরুতেই সেই সম্পর্কটা চোখের পলকে বদলে গিয়েছিল।অদ্ভুত লেগেছিল তন্দ্রার।যে মানুষটাকে সবচেয়ে আপন ভেবেছিল সে মানুষটাই নিমিষে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিলো।সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

” জি স্যার।”

“বলতো আমি তোমার কে?” মিটিমিটি হাসে নীলাদ্রি।

“মনিব”

“ইউ এর রাইট।আমি তোমার মনিব।তুমি কি জানো এক্সাক্টলি কত টাকা দিয়ে আমি তোমাকে কিনেছি?”

তন্দ্রা নীলাদ্রি আর তার মামার মধ্যে হওয়া ডিলের ব্যাপারে কিছুই জানতোনা।এমনকি তাকে দেয়া কাবিনের কাগজও সে খুলে দেখেনি। সে ঘাড় নাড়ে।

“না স্যার।”

“পাঁচ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ।পাঁচ কোটি তোমার বাবাকে দিয়েছি।আর পঞ্চাশ লক্ষ তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করেছি।পঞ্চাশ লক্ষ টাকা তোমাকে যে…আপ্ কি যেন বলে….কাবিননামা ,হ্যাঁ কাবিননামাতে লিখা ছিল।আশা করি তুমি দেখেছো?”

তন্দ্রা সে কাগজ খুলেও দেখেনি।এমনকি কোন একাউন্টের কথা নিলাদ্রি বলছে সে সেটাও জানেনা।তার তো ব্যাংকে কোনো একাউন্ট নেই।তার টাকাই নেই তো ব্যাংকে একাউন্ট দিয়ে কি করবে? সে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীলাদ্রির দিকে। নীলাদ্রি হাতে ধরা গ্লাসের তরলটাকে আনমনে গোল গোল ঘুরাচ্ছে।তন্দ্রার দিকে কোনো নজর নেই তার।তন্দ্রাকেযেন সে বাধ্য হয়েই সহ্য করছে।

“সেই হিসাবে তুমি আমার ক্রীতদাসী।তোমাকে আমি পুরোপুরিভাবে কিনে নিয়েছি।তোমার চিন্তা, চেতনা,বুদ্ধি এমনকি তোমার ইচ্ছাগুলোকেও।তুমি কি জানো আমি এখন তোমার সাথে যা-তা করতে পারি কোনো আইনও আমাকে আটকাতে পারবে না।”

নীলাদ্রির কথা শুনে ভয় পেল তন্দ্রা।তার মানে মামা তাকে বিক্রি করে দিয়েছে! অবশেষে তার মামা? যাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলো সে কিনা বিস্বাসঘাতকতা করলো!

“স্যার আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।শুধু আমাকে পড়তে দিন।আমি অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় পৌঁছেছি।”

এবার আর কথাটা চেপে রাখতে পারলোনা তন্দ্রা।এখন কথাটা না জানালে হয়তো আর কখনো বলা হয়ে উঠবেনা।

“তাতে আমার লাভ? ডান চোখের ভ্রুটা একবার উপরে তুলে নীলাদ্রি। তোমার পেছনে আমি কেন টাকা খরচ করবো? এমনিতেই তুমি আমার ক্রীতদাসী।অনেক টাকা দিয়ে কিনেছি তোমাকে।খামোকা আরও টাকা ঢালতে যাবো কেন?”

তন্দ্রা বুঝে কথাটা নেহাত অযৌক্তিক নয়।নীলাদ্রি স্যার তো এমনিতেই অনেক টাকা দিয়ে কিনেছেন তাকে।এখন তার পেছনে টাকা ঢালা মানে বাজে খরচ।কিন্তু সে তো পড়তে চায়।এতদূর এসে কি সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? তন্দ্রা নীলাদ্রির পায়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে,

“স্যার দয়া করুন।আমাকে পড়তে দিন।এর বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন তাই দেব।”

“আমাকে দেয়ার মতো তোমার কাছে কি আছে? তোমার দেহ?”

কথাটা বলে নিজেই একটা শক খায় নীলাদ্রি।এসব কি বলছে সে!এমন কথাতো সে কখনো বলেনা।এমনকি ভাবেওনা।নারী মানে দুর্বলতা।সে কোনো নারীকে নিয়েই ভাবতে চায়না।তুলয়ের মতো সুন্দরীদের যেখানে সে ফিরিয়ে দিয়েছে সেখানে কিনা এক সামান্য দাসীকে…! ছিঃ!

নীলাদ্রির কথায় হতবুদ্ধি হয়ে যায় তন্দ্রা।এতক্ষনে তার ভেতর বিন্দু বিন্দু ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে।সে তো নীলাদ্রির ক্রীতদাসী।তন্দ্রা নিজেই তো তার দাসত্বের কাগজে সই করেছে।এখন নীলাদ্রি তার সাথে যা খুশি তাই করতে পারে।কেউ আটকাতে পারবেনা নীলাদ্রিকে।কিন্তু তার কি হবে? ভাবতেই বুকটা শিউরে উঠলো তন্দ্রার।নীলাদ্রি নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে গলায় গাম্ভীর্য এনে বললো,

“আমি তোমাকে পড়তে দেবো না।তোমার মত একটা দাসীর পেছনে টাকা খরচ করার কোন মানেই হয়না।”

চলবে….