মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-১১+১২

0
454

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_১১
#আয়াত_আফরা

অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে নীলাদ্রি।কেবিনটা এসির হাওয়ায় অতিরিক্ত রকম ঠান্ডা হয়ে আছে।এই ঠান্ডাটাতেও নীলাদ্রির কপালে ঘাম দেখা যাচ্ছে।এটা তার অতিরিক্ত স্ট্রেসের লক্ষণ।সে তার সামনে থাকা টেবিলে ল্যাম্পটা বারবার জ্বালাচ্ছে নেভাচ্ছে।কামরার আলো খুবই কম।নীলাদ্রির সামনে দাড়িয়ে আছে বালু আর তৌসিফ।তারা জানেনা নীলাদ্রি তাদের কেনো ডেকে পাঠিয়েছ।ঠান্ডায় তাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।কিন্তু নীলাদ্রির কোনো ভাবান্তর নেই।মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার এর চেয়েও বেশি ঠান্ডা ঘরের প্রয়োজন।এমন সময় দরজায় দুবার টোকা পড়লো,

“আসব স্যার?”

“হ্যাঁ এসো।”

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো জুলফিকার।ভেতরে ঢুকতেই তার হাড় কাঁপিয়ে দিল ঠান্ডা হাওয়া।সে দাঁতে দাঁত চেপে কোনরকমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।বালু আর তৌসিফকে দেখে জুলফিকার নিজেদের মধ্যে কি যেনো চোখাচোখি করলো।জুলফিকার গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“স্যার আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?”

নীলাদ্রি এবার টেবিল ল্যাম্পটাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো।সরাসরি তাকালো জুলফিকারের দিকে।তার চোখের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল বাকি তিনজন।ক্রুরতা আর হিংস্রতা মিশে আছে সেই দৃষ্টিতে।যেনো এখনি ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ করে দেবে তাদের।নীলাদ্রি হাতের উপর হাত রেখে তাদের তিনজনকে খানিকক্ষণ দেখে নিল।প্রথম কথাটা সে বললো জুলফিকারের উদ্দেশ্যে।

“জুলফিকার সাহেব।”

“জি স্যার।”

“তুমি আমাদের আন্ডারে কত বছর কাজ করছ?”

“তা প্রায় স্যার আপনার দাদুর আমল থেকে। ত্রিশ বছর তো হবেই।”

“ত্রিশ বছর।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীলাদ্রি। তার মানে তুমি আমার দাদুর খুব বিশ্বস্ত লোক ছিলে।”

“জি স্যার তা তো ছিলাম।”

“আর আমার?”

“সে আর বলতে স্যার! আমি যে আপনার নুন খেয়েছি।সারাজীবন আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো।”

“হুঁ।আর আমার জানামতে তুমি বেশ বিচক্ষণ ব্যাক্তি।অ্যাম আই রাইট অর আই অ্যাম রাইট?”

জুলফিকার মাথা নিচু করে স্মিত হাসলো।
“তা স্যার যা আপনি ভাববেন।”

“এই তোমরা তিনজন ,আমার খুব বিশ্বস্ত আর আমার জানামতে খুবই বিচক্ষণ ব্যাক্তি।তাহলে তোমরা কি করে ভুল করলে?”

নীলাদ্রির শান্ত গলায় করা এই প্রশ্নটা তাদের কারোরই বোধগম্য হলো না। জুলফিকার জিজ্ঞাসা করলো,
“কি ভুল স্যার?”

“কি ভুল!আবার জানতে চাইছো কি ভুল?” চিৎকার করে উঠলো নীলাদ্রি।
“তোমাদের বিশ্বাস করে আমি ছোট্ট একটা কাজ দিয়েছিলাম।আর তোমরা সেটাও করতে পারলে না!”

বালু বললো,
“ভাই আমরা কিছু বুঝতে পারছি না ।আপনি কোন ব্যাপারে কথা বলছেন?”

“বুঝতে পারছো না তাইনা।এক্ষুনি বুঝিয়ে দিচ্ছি।শিশির কাম ইন।”

নীলাদ্রির গলা পেয়ে কেবিনে ঢুকে এলো শিশির।তার মুখ থমথমে।

“শিশির যা তুমি আমাকে বলেছো ওটা এদেরও একটু বলো।এরা কিছুই বুঝতে পারছে না।”

নীলাদ্রির আদেশ পেয়ে শিশির বলতে শুরু করলো,

“নীলাদ্রি স্যার আমাকে আদেশ দিয়েছিল ওই মানিক হালদারের ব্যাপারে খবর নিতে।আমি খবর নিয়ে জানতে পারলাম ওদের একটাই মেয়ে,তার নাম মাইশা হালদার।এ ছাড়া একটা কাজের মেয়ে ছিল।তার নাম ছিল তন্দ্রা।”

“কাজের মেয়ে!” নীলাদ্রি আর শিশির ছাড়া বাকি তিনজন চমকে উঠলো।

“হ্যাঁ কাজের মেয়ে।হালদারের প্রতিবেশীরা তো তাই বললো।ওই মেয়ে নাকি হালদার আর হালদার বউকে মামা মামী বলে ডাকতো।তবে সত্যিই তারা ওর মামা মামী ছিল কিনা তা তারা জানেনা। ছোটবেলায় মেয়েটাকে নাকি কোথা নিয়ে এসেছিল মানিক হালদার।এরপর থেকে ওরাই বড় করেছে।তবে কাজের মেয়ের মত।কিছুদিন আগে ওই মেয়েটাকে ওরা বিয়ে দিয়ে দেয়।আর বিয়ে দেয়া হয়….”

“ডেম ইট।” শিশিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাতের কাছে থাকা কাঁচের পেপারওয়েটটা মেঝেতে সজোরে ছুড়ে ফেলে নীলাদ্রি। “বুঝেছ তো?বোঝা হয়ে গেছে এবার?আমি তোমাদের উপর ভরসা করেছিলাম।তাই নিজে যাইনি।বলেছিলাম ওই মানিক হালদারের মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য ।আর তোমরা কিনা নিয়ে এলে কাজের মেয়েকে!”

মাথা নিচু করলো জুলফিকাররা।

“তোমরা আমাকে বলেছো ভাই এখানে সাইন করুন, আমি করেছি।দেখার প্রয়োজন মনে করিনি কার অ্যাকাউন্টে কার নামে টাকা ট্রান্সফার হচ্ছে।এমনকি এটাও জানতে চাইনি যে মেয়েকে আমি নিয়ে আসতে বলেছি তার নাম কি।মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার নাম কি ,ও বলেছিল, তন্দ্রা।আমি ভেবেছিলাম ও আচ্ছা তাহলে মানিক হালদারের মেয়ের নাম তন্দ্রা।কোনো সন্দেহ করিনি।আমি তোমাদের নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করতাম।আমি ভেবেছিলাম আমাদের দেহ চারটা কিন্তু প্রাণ একটাই।আমার একটা চোখ নয় আট আটটা চোখ।কিন্তু ওই মানিক হালদার আমার এই আট চোখকেই ফাঁকি দিয়ে দিল!আমার প্রথম দিনই ওই মেয়েকে সন্দেহ হয়েছিল যখন ওই মেয়ে একটা নোংরা শাড়ি পরে আমার মহলে এন্ট্রি নিয়েছিল।কিন্তু আমি সন্দেহ করতে চাইনি।কারণ আমার জহুরিরা তাকে নিয়ে এসেছিল।তারা কি জহরতের জায়গায় কয়লা নিয়ে আসবে?কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।ভুল!”

একটানা কথাগুলো বলে একটু দম নেয়ার জন্য থামলো নীলাদ্রি।এরপর চেয়ার থেকে উঠে পড়ে হাক দিল,
” রুডলফ,কেভিন!”

কেবিনে প্রবেশ করলো দুজন ষন্ডামার্কা জোয়ান তাগড়া লোক।তাদের দেখে তৌসিফ বললো,

“ভাই এদের কি দরকার?আমাদেরকে বলুন না……

“শাট আপ।জাস্ট…শাট আপ।”তৌসিফের দিকে আঙুল তুলে তাকে থামিয়ে দিল নীলাদ্রি।তোমরা আমার অনেক উপকার করেছ।এবার এদেরকেও একটু উপকার করতে দাও।”

রুডলফ আর কেভিনকে ইশারা করে নীলাদ্রি বললো,
“যাও ওই মানিক হালদারের পুরো পরিবারকে তুলে নিয়ে এসো।আমার সামনে হাজির করো ওদের।”

“স্যার…..” নীলাদ্রির কথায় বাধা দিলো শিশির।

“কি হয়েছে?”

“স্যার ওই মানিক হালদার তার পুরো পরিবার নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে।কোথায় গেছে সেটা তার প্রতিবেশীরাও জানেনা।”

“বাহ চমৎকার!”
দাঁতে দাঁত চেপে বললো নীলাদ্রি।রাগে তার ফর্সা চেহারা লাল হয়ে গেছে।
“যাও ওদের খুঁজে বের করো।ওরা যদি পাতালেও লুকিয়ে থাকে সেখান থেকে খুঁজে বের করো ওদের।আমি ওদের টুকরো টুকরো করে ফেলবো।যাও!”

“ওকে স্যার।”

নীলাদ্রি কথায় সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো রুডলফ আর কেভিন।নীলাদ্রি ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। বালু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“এখন ওই মেয়েটার কি করবেন ভাই?”

“সংসার করবো।”খেঁকিয়ে উঠলো নীলাদ্রি।
“বিয়ে তো করিয়ে দিয়েছো।সংসার তো করতে হবে তাই না?ওই মানিক হালদার আমাকে একটা রাস্তার পাপ গছিয়ে দিয়েছে আর তোমরাও মহানন্দে ওকে নিয়ে এসেছ।”

জুলফিকার আমতা আমরা করে বললো,
“স্যার রাস্তার পাপ বলছেন কেনো?হয়তো সত্যিই ও মানিক হালদারের ভাগ্নী।”

“সে ও যাই হোক না কেনো ছিল তো হালদার বাড়ির কাজের লোকই। অনেকবার,অনেকবার আমি ওই মেয়ের থেকে সত্যিটা জানতে চেয়েছি।সুযোগ দিয়েছি।কিন্তু ও বলেনি।এমন একটা ভাব করে থাকে যেনো ওর মতো সিধে সাধা আর কেউ নেই!”

“তো এখন কি করবেন ভাই?”

“কি করবো মানে?”

“না মানে ভাই ওই মেয়েটার ব্যাপারে কিছু।মানে এখন কি ডিভোর্স বা ওই জাতীয় কিছু করার ব্যাবস্থা করবো?”

“ডিভোর্স হ্যাঁ?মুক্তি?এত সহজে!হাহ্। ওই মানিক হালদারকে আমার চেনা আছে।ও আমার দাদুকেও ঠকিয়েছে।ওর রক্তেই আছে প্রতারণা।কিন্তু ওই সামান্য দু পয়সার মেয়ের এতো সাহস কি করে হয় যে আমার বাড়িতে আমাকেই ঠকাতে চলে এলো!”

“ভাই আমার মনেহয় ওরা ওই মেয়েকে টাকার লোভ দেখিয়েছিল।মানে আপনার অনেক টাকা আছে এই লোভ দেখিয়েই ওদের মেয়ের জায়গায় ওকে বিয়েতে রাজি করিয়েছিল।”বললো তৌসিফ।

“টাকা!টাকার লোভে বাঘের গুহায় এসে ঢুকেছে।এই নীলাদ্রি চৌধুরীর পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছে ও।এবার দেখ ওর সাথে আমি কি কি করি! অনেক সময় দিয়েছি সত্যিটা স্বীকার করার।করেনি। হাউ ডেয়ার শি ইজ! ক্ষোভ হতাশায় চিৎকার করে উঠলো নীলাদ্রি,

“হাউ ডেয়ার ইউ তন্দ্রা, হাউ ডেয়ার ইউ!”

*********

“তন্দ্রা ,এই তন্দ্রা,তন্দ্রা।”

তন্দ্রাকে জোরে জোরে ডাকছিল বিনতি।তন্দ্রা তখন একটা ছোট্ট চরুইপাখিকে খাবার দিচ্ছিল।রোজ ওই চড়ুইটা এসে বসে তার ঘরের জানালায়।সে থেকে বেশ ভাব হয়েছে তাদের।তন্দ্রাকে দেখে এখন আর পালিয়ে যায় না চড়ুইটা।এটাও যেনো বুঝে গেছে তন্দ্রার আশ্রয় তার জন্য নিরাপদ।তবে এখন বিনতির গলা পেয়ে খাওয়া ফেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো পাখিটি। তন্দ্রা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো,

“কি হয়েছে বিনতি দি ডাকছো কেনো?”

“তোর তো এখন কোনো কাজ নেই তাইনা?যা তো দেখি এই জিনিসগুলো কিনে নিয়ে আয়।ফুরিয়ে গেছে।চাকর বাকর কে কোথায় আছে কাউকে পাচ্ছিনা।যা না একটু।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। দাও লিস্টটা আমাকে দাও।”

তন্দ্রা বিনতির হাত থেকে ফর্দটা হাতে নেয়।বেশ কিছু মুদিখানার পণ্যের নাম লেখা আছে তাতে।

“শোন এ টাকাটা তোর।” তন্দ্রার হাতে একশো টাকার একটা নোট গুজে দেয় বিনতি।

“সেকি বিনতি দি তুমি আবার আমাকে টাকা দিচ্ছ!তুমি তো আমাকে একদম বিগড়ে দেবে।আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি যে টাকার লোভ দেখিয়ে বাজারে পাঠাবে।”

“হুঁ তুই বাচ্চাই।এ টাকা দিয়ে চকোলেট কিনে নিস।” হাসে বিনতি। “সাবধানে যাবি আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। এদিক ওদিক কোথাও যাবিনা কিন্তু।”

“আচ্ছা দি কোথাও যাবো না,করো সাথে যাবো না।সোজা বাড়ি টু গ্রসেরি শপ ,গ্রসেরি শপ টু বাড়ি।”

বিনতিকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো তন্দ্রা।অনেকগুলো গ্রসেরি শপ আশেপাশে থাকলেও নীলাদ্রির বাড়ির বাজার হয় শহরের সবচেয়ে বড় গ্রসেরি শপ থেকে।সেটা বাড়ি থেকে আধা ঘন্টার পথ।তখন পড়ন্ত বিকেল।তন্দ্রা সিদ্ধান্ত নিলো হেটেই শপে যাবে।বাড়িতে ফেরার এত তাড়া নেই। ডিনার তৈরী করে রেখে এসেছে।নীলাদ্রি আসবে দেরিতে।তাই হাতে অঢেল সময় আছে।

তন্দ্রা জিনিসপত্র কেনা শেষ করে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে।সূর্য আরেকটু হেলে পড়েছে।শহরের এই এলাকাটা বেশ উন্নত এবং পরিপাটি।সকালে কোলাহলপূর্ণ থাকলেও বিকালে এলাকাটা থাকে দেখার মত।

রাস্তায় এখন গাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে।হাঁটতে বেড়িয়েছে মানুষজন।মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।রাস্তার পাশে রমরমিয়ে চলছে চাওমিন, ফুচকা আর ঝালমুড়ির দোকানগুলো।বাহারি ফুল আর মনিহারি দোকানগুলো জায়গাটার শোভা আরও বৃদ্ধি করেছে।তন্দ্রা এসবের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো।বাতাসের সাথে খেলা করছে তার চুল।একটা সস্তা লাল সালোয়ার কামিজ পরেছে সে।তবে এই সস্তা দামের কাপড় যেনো তন্দ্রার দেহের ছোয়ায় অসাধারণ হয়ে উঠেছে। কাঁধে ঝুলছে একটা পাটের ব্যাগ।তাতে আছে একটু আগে কেনা জিনিসগুলো।অপূর্ব লাগছে তন্দ্রাকে দেখতে।স্বল্পতার মধ্যে নারী যে কত সুন্দর হতে পারে তারই যেনো প্রমাণ দিচ্ছে তন্দ্রা।সে রাস্তার ধারে থাকা মনিহারি দোকানে গিয়ে একজোড়া ঝুমকো তুলে নিয়ে সেটা কানে পড়ে তাকে কেমন লাগছে দেখার চেষ্টা করলো।কিন্তু চুলের জন্য বারবার আটকে যাচ্ছিল সেগুলো।তাই সে তার ব্যাগটা একপাশে রেখে নিজের চুলগুলো একদিকে সরিয়ে দোকানের একপাশে থাকা ছোট্ট আয়নার সামনে গিয়ে ঝুমকো পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো।এমন সময় তার মনে হলো কেউ যেনো তাকে অনুসরণ করছে।ঠিক তার পেছনেই এসে দাড়িয়েছে কেউ।চকিতে পেছনে ফিরলো সে।কিন্তু সেখানে কেউ নেই।মনের ভুল ভেবে যেই আবার উল্টো দিকে ঘুরল এমন সময় তার ব্যাগটা নিয়ে ছুট দিল একটা ছোকরা বয়সী ছেলে।

“এই আমার ব্যাগ!”

তন্দ্রা ঝুমকো ফেলে পিছু নিলো ছেলেটার।কিন্তু তার সাথে কি তন্দ্রা পারে?মুহুর্তে কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। তন্দ্রা রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো।কি করবে সে এখন! এত টাকার জিনিস ছিল ওতে।তার পার্স আর ফোনটাও ছিল।সবচেয়ে বড় কথা বিনতি দি কে কি জবাব দিবে?ভয়ে দুশ্চিন্তায় চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো তন্দ্রা।কিছুই মাথায় এলোনা তার।সে মাথা নিচু করে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই যাচ্ছিলো এমন সময় বেখেয়ালে পা ফেলার জন্য ইটের টুকারায় হোঁচট খেল তন্দ্রা।আর একটু হলে রাস্তায় পড়েই যাচ্ছিলো এমন সময় তাকে শক্ত করে ধরে নিলো দুটো হাত।তন্দ্রা ঘটনার আকস্মিকতায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল।উত্তেজনা কেটে গেলে চোখ খুলতেই সে অবাক হয়ে গেলো।তাকে দুহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে সেদিনের রাস্তায় দেখা হওয়া সেই পুরুষটি! পুরুষটি তাকিয়ে আছে একদম তন্দ্রার চোখের দিকে।তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়ের সাথে কেমন যেনো একটা ছেলেমানুষী হাসির ছোঁয়া।

বিস্ময়টা কাটিয়ে তন্দ্রা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ইভানকে। তখনই তন্দ্রা লক্ষ করলো ইভানের কাধ থেকে ঝুলছে তার ব্যাগটা। ব্যাগটাকে দেখে যারপনাই খুশি হলো তন্দ্রা।

” আমার ব্যাগ!” আনন্দে অস্ফুটে তন্দ্রার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো কথাটা।

এতক্ষণে ইভানের চমক ভাঙলো,
“ওহ আপনার ব্যাগ।”

ইভান ব্যাগটা এগিয়ে দিল তন্দ্রার দিকে।

“আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব!”

“ধন্যবাদ তো আমার আপনাকে দেয়া উচিত।”

“কেনো বলুন তো?”

” আমাকে চোর না ভাবার জন্য।”

“আপনাকে কেনো চোর ভাববো?” ব্যাগটা কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে বললো তন্দ্রা।”আমি তো চোরকে দেখেছি।”

“না ভাবতেই পারতেন যে আমিই হয়তো চুরি করিয়ে আবার ফেরত দিয়ে হিরো সাজতে এসেছি।”ভ্রূ নাচিয়ে বললো ইভান।

“আমার মনে হয় আপনি একটু বেশিই মুভি দেখেন।” হাসলো তন্দ্রা।

“মুভি না দেখলেও একটা কথা ভেবে দেখলাম।আমাদের কেমিস্ট্রিটা কিন্তু মুভির মতোই শুরু হচ্ছে।”

“কেমিস্ট্রি!”

“হ্যাঁ।দেখুন না কাল দেখা হলো, আজ আবার দেখা হলো।”

“ওটা কাকতালীয় ব্যাপার।”

“কিছু কাকতালীয় ব্যাপার বারবার ঘটে।আর আমি চাই আমাদের এই কাকতালীয় ঘটনাটাও বারবার ঘটুক।”

“আপনি হেঁয়ালি করছেন।”

“বাই দা ওয়ে আমি ইভান।আপনি?” ইভান তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলো তন্দ্রার দিকে।

তন্দ্রা তার হাত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মুচকি হেসে বললো,
“আমি তন্দ্রা।”

“তন্দ্রা! খুব সুন্দর নাম।আপনি কোথায় থাকেন?”

তন্দ্রা তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললো,
“আমি আসি ,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলেই বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলো তন্দ্রা।

“আরে দাড়ান দাড়ান দাড়ান।” ইভান তন্দ্রার পথ আটকে দাঁড়ালো।”ঠিক আছে বাড়ির কথা না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না।তবে আপনার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে।”

“কি জিনিস?”তন্দ্রা ব্যাগের মধ্যে সবকিছু চেক করলো।না সব তো ঠিক থাক আছে।
“কি জিনিস আছে আপনার কাছে?”

ইভান মুচকি হেসে মুন্সীকে ডাকলো।মুন্সী একটু দূরেই দাড়িয়ে ছিলো।ইভানের গলা শুনে দৌড়ে এসে তার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিলো।ইভান প্যাকেটটা তন্দ্রার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“নিন।”

“কি আছে এতে?”

“নিজেই দেখে নিন।”

তন্দ্রা প্যাকেট খুলে দেখে অবাক হয়ে গেলো।হুবহু তার সেদিনের কেনা কাঁচের চুড়িগুলো তাকে ফেরত দিচ্ছে ইভান।

“এগুলো আপনি….।”

“আমার জন্য নষ্ট হয়েছিলো ফেরত তো আমাকেই দিতে হতো।”

তন্দ্রা ঘাড় নেড়ে বললো,
“এর কোনো দরকার ছিল না।”

“সাহেব ফুল নেবেন?ম্যাডাম ফুল লাগবে?”

বাচ্চাকণ্ঠ শুনে ইভান আর তন্দ্রা দুজনেই তাকিয়ে দেখলো একটা বাচ্চা ফুলওয়ালি তাদের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ফুল নেয়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে।তন্দ্রার কাছে ফুল কেনা মনে বিলাসিতা।সে বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“না বাবু ফুল নেব না।তুমি অন্য কারো কাছে বিক্রি করো।”

বাচ্চাটি হতাশ হয়ে চলেই যাচ্ছিল এমন সময় তাকে ডাকলো ইভান।

“আমি ফুল কিনবো।এই গোলাপগুলো দাও।”

বাচ্চাটি হাসিমুখে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল ইভানের দিকে।ইভান ফুলগুলোর জন্য অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করলো বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটির মুখে ফুটে উঠলো নির্মল হাসি।

“ধন্যবাদ সাহেব।” বাচ্চাটি কপালে একবার হাত ঠেকিয়ে চলে গেলো।

বাচ্চাটি চলে যেতেই ইভান ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল তন্দ্রার দিকে।

“ফ্লাওয়ার ফর ফ্লাওয়ার।”

তন্দ্রা আশেপাশে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।
“আমি আসি।”

তন্দ্রা ফুলগুলো না নিয়েই ইভানের পাশ কাটিয়ে চলে এলো।ইভান তন্দ্রার সাথে পা ফেলে এগুতে এগুতে বললো,

“আর দশ মিনিট অপেক্ষা করে গেলে একটা দারুন জিনিস দেখতে পেতেন।”

“দুঃখিত আমার এত সময় নেই।ভালো থাকবেন।”

তন্দ্রা দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে।বাড়িতে বিনতি দি নিশ্চই দুশ্চিন্তা করছে।
ইভানের হাত আবার চলে এলো বুকের বাম পাশটায়। হৃৎপিন্ডটা দ্রুত চলছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাস ইভানের চুল ছুঁয়ে ছুটে গেল তন্দ্রার গমন পথের দিকে। দূর থেকে স্থানীয় একটা গানের সুর ভেসে আসছে। ইভান পাশে দাড়িয়ে থাকা মুন্সীকে বললো,

“লেট’স ফলো হার।”

মুন্সী ইভানের কথায় খুশি হয়ে পা বাড়াতেই যাচ্ছিল কিন্তু ইভান তাকে থামিয়ে দিল।

“এভাবে কেউ ফলো করে।ও আমাদের দেখে ফেলবে তো।”

“তাহলে স্যার?মুখোশ পড়বো?”

“এতটাও সতর্ক হতে বলিনি।একটু আড়াল থেকে সাবধানে ফলো করতে হবে।”

তন্দ্রাকে ফলো করে ইভানরা এসে দাড়ালো নীলাদ্রির বাড়ির সামনে।তন্দ্রা তাদের দেখতে পায়নি।সে আপন মনে ঘরের ভেতর চলে গেলো।মুন্সী বাড়িটাকে ভালো করে দেখে বললো,

“স্যার এটাতো নীলাদ্রি চৌধুরীর বাড়ি!”

“নীলাদ্রি চৌধুরী?”

“হ্যাঁ স্যার আপনার একমাত্র কম্পিটিটর।”

“তাহলে ও নীলাদ্রির বাড়িতে থাকে।”

“স্যার উনি কি নীলাদ্রির বোন নাকি?মানে নীলাদ্রির সাথে উনার সম্পর্কটা কি?”

“না মুন্সী।ও নীলাদ্রির বোন হতে পারেনা। নীলাদ্রির বোন কখনো এত সস্তা দামের চুড়ি কিনবেনা।”

“তাহলে কি স্যার, চাকরানী!”

“হবে হয়তো।”

“যাহ!তাহলে এই মেয়েও হাত থেকে গেলো।”

“কেনো বলো তো?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো ইভান।

“কেনো আবার,ও তো একজন সামান্য চাকরানী।ওর সাথে কি আপনার বিয়ে হবে স্যার?”

“যে মুহূর্তে সে আমার মনের চৌকাঠে পা রেখেছে সেই মুহূর্ত থেকে আমার সবকিছু ওর হয়ে গেছে।ও যেই হোক আমার ওকেই চাই।বাই হুক অর বাই ক্রোক।”

চলবে…..

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_১২
#আয়াত_আফরা

“দুম দুম দুম”

প্রধান দরজায় তীব্র কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো তন্দ্রার।রাত তখন বারোটা হবে।এত রাতে কে এলো?হাই তুলতে তুলতে তার মনে হলো নীলাদ্রি স্যার তো ফেরেননি।তাহলে এখন কি উনিই ফিরে এলেন?বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।সবার ধারণা ছিল হয়তো স্যার আজ ফিরবেন না।তন্দ্রা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খোলার জন্য গুটি গুটি পায়ে প্যাসেজের মাথায় আসতেই বিনতি তাকে থামিয়ে দিল।দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তারও ঘুমটা ভেঙে গেছে।বিনতি তন্দ্রাকে সেখানেই দাড়াতে বলে নিজে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।দরজা খুলতেই বাইরে থেকে একটা গলা শুনতে পেলো তন্দ্রা,

“দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? সরো।”

গলাটা তৌসিফের।বিনতি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।সে সরে দাড়ালে ঘরে ঢুকলো বালু আর তৌসিফ।তাদের সাথে নীলাদ্রি ।নীলাদ্রিকে দেখে চমকে উঠলো তন্দ্রা।এ কি অবস্থা তার! সে যেনো আর নিজের মধ্যে নেই।পা টলছে,চুল এলোমেলো।তার দুই হাত বালু আর তৌসিফের কাঁধে।চোখগুলো অর্ধনীমিলিত। স্যার মদ খেয়েছেন!

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো তন্দ্রা।নীলাদ্রিকে এমন অবস্থায় আগে দেখেনি সে।ভয়ে তন্দ্রা প্যাসেজের আরো কোণায় সরে দাঁড়ালো।কিছুতেই যাতে নীলাদ্রির চোখ না পরে তার উপর।বালু আর তৌসিফ নীলাদ্রিকে ধরে উপরে তার ঘরে নিয়ে গেলো।

“ভাই আপনি এখন বিশ্রাম করুন।”

নীলাদ্রিকে সোফায় বসিয়ে দিলো বালু আর তৌসিফ। নীলাদ্রি তাদের সরিয়ে আবার উঠে দাড়ালো।দুবার মাথা ঝাকি দিয়ে ভালো করে চোখ মেলার চেষ্টা করে বললো,

“গো,গেট মাই ওয়াইফ।”

বালু আর তৌসিফ দুজনে একবার চোখাচোখি করলো। বালু নীলাদ্রির কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

“ব্রো ইউ আর ড্রাংক।এখন রেস্ট নিন।কাল যা খুশি করবেন নাহয়।”

নীলাদ্রি এক ঝটকায় বালুর হাত সরিয়ে দিলো তার কাঁধ থেকে।

“ওহ ইউ জাস্ট শাট আপ।কল হার। নাও।”

বালু বুঝলো নীলাদ্রিকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা।সে নিচে চলে এলো । বিনতি তখন সবে দরজা বন্ধ করছিল।বালু তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“ওই মেয়েটা কোথায়?”

বিনতি বুঝতে পারলো না তাকে কার কথা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।

“কোন মেয়েটা বালু জি?”

“ঐযে নতুন যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন স্যার।”

বিনতি সভয়ে তাকালো তন্দ্রার দিকে।তন্দ্রা তখনও জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। বিনতির দৃষ্টি অনুসরণ করে বালুর চোখ পড়ল তন্দ্রার উপর।সে তন্দ্রাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।তন্দ্রা প্যাসেজের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে বিনতির পাশ ঘেঁষে দাড়ালো।বালু তাকে একবার ভালো করে দেখে নিল।চোখে তার স্নেহের দৃষ্টি।যে দৃষ্টিতে ভাই তার বোনকে দেখে,যে দৃষ্টিতে কোনো পাপ নেই,আছে পবিত্রতা আর নির্মল ভালোবাসা।

“ভাই তোমায় ডাকছেন।”

কথাটা শুনে ভয়ে কুকড়ে গেলো তন্দ্রা।একটু আগে নীলাদ্রির যে রূপ সে দেখেছে তাতে এখন নীলাদ্রি তাকে খু’নও করে ফেলতে পারে।এমনিতেই তার উপর নীলাদ্রির এত রাগ।তন্দ্রা সভয়ে তাকালো বিনতির দিকে।বিনতি ঢোক গিলে বালুকে বললো,

” বালু জি,এখন না গেলে হয়না?মানে স্যার তো এখন সজ্ঞানে নেই।যদি কিছু একটা হয়ে যায়!”

বালু বিনতির কথার জবাব না দিয়ে তন্দ্রার মাথায় হাত রাখলো,

“ভয় পেয়ো না।ভাই যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন।কিছুই হবেনা। হয়তো একটু বকাঝকা করবেন।আর যদি এখন না যাও তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবেন।তাই ভালো এটাই হবে কেনো ডাকছেন দেখে এসো গিয়ে।”

বালু আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।বিনতি বুঝলো আর তন্দ্রাকে আটকে লাভ নেই।নয়তো আরো বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তন্দ্রাকে।তাই সে তন্দ্রাকে সাহস দিয়ে নীলাদ্রির কক্ষে যেতে বললো। তন্দ্রাও বুঝলো তার আর কিছুই করার নেই।সে মন শক্ত করে নীলাদ্রির ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

নীলাদ্রির ঘরের দরজা হাট করে খোলা।বাইরে থেকেই ভেতরটা দেখা যাচ্ছে।নীলাদ্রি বিছানার উপর বসে তার গিটারে টুং টাং শব্দ তুলে গান গাইছে,

“আমাকে আমার মত থাকতে দাও,
আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।”

তবে সেটা গান বলে মনে হচ্ছেনা।কেবল একটার পর একটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে।তন্দ্রা খোলা দরজার পাল্লার গায়ে দুবার নক করলো।নীলাদ্রি এতক্ষণে লক্ষ করলো তন্দ্রাকে।সে গিটারটা এক পাশে ফেলে এগিয়ে এলো তন্দ্রার কাছে,

“ও মিস তন্দ্রা চৌধুরী। কাম ইন ডিয়ার। কাম কাম।”

নীলাদ্রি হাত ধরে তন্দ্রাকে ভেতরে নিয়ে এলো।তন্দ্রা নীলাদ্রির কাজ কর্মের কোন মাথা মুণ্ড বুঝতে পারছে না।নীলাদ্রি তন্দ্রাকে ভেতরে এনে সশব্দে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলো।দরজা আটকানোর শব্দে তন্দ্রার বুকটাও কেঁপে উঠলো।এবার কি হবে তার সাথে?

নীলাদ্রি ধাক্কা দিয়ে তন্দ্রাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানায়।তন্দ্রা নরম বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ল।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসলো সে।ভয়ে তার হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে।গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে।নীলাদ্রি এগিয়ে আসছে বিছানার দিকে।তার চোখ দেখে তন্দ্রা বুঝতে পারলো না সে কি চাইছে।তন্দ্রা বালিশ চেপে ধরে বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো।নীলাদ্রি তার জ্যাকেটটা একপাশে ছুড়ে ফেলে ধপ করে শুয়ে পড়ল তন্দ্রার কোলে।

তন্দ্রা প্রচন্ড বিস্মিত হলো।তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নীলাদ্রি।দৃষ্টি সরাসরি তার মুখের দিকে।নীলাদ্রি কি করতে চাইছে তা বোধগম্য হচ্ছেনা তন্দ্রার।সে বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে।

“তন্দ্রা!”

“জি,জি স্যার।”

নীলাদ্রির আচমকা ডাকের জবাবে গলাটা কেঁপে গেলো তন্দ্রার।

“মানুষ কেনো খারাপ হয় বলো তো?”

তন্দ্রা নীলাদ্রির প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেলনা।নীলাদ্রির চেহারায় এখন কোনো হিংসা নেই,ক্রুরতা নেই নিষ্ঠুরতা নেই।সেখানে আছে নির্মলতা আর প্রশান্তি।যেনো চাঁদের উপর থেকে সরে গেছে রাহুগ্রাস।

“তন্দ্রা তুমি জানো আমার মা বাবা কোথায়?”

তন্দ্রা কোনো উত্তর দিল না।নীলাদ্রি বাচ্চাদের মত খোলা জানালা দিয়ে বাইরে জ্বলতে থাকা তারাগুলোর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করলো,

“ওই তারায় চলে গেছে। কত দূরে তাইনা?”

তন্দ্রা, নীলাদ্রিকে থামালোনা।নীলাদ্রি তন্দ্রার জবাব নিয়ে চিন্তিতও নয়।সে এক মনে কথা বলতে লাগলো।যেনো কথা বলার জন্যই একজন মানুষকে সে খুঁজছিল এতদিন।

“তুমি জানো তন্দ্রা আমার বাবা মা কিভাবে সেখানে গিয়েছে?”

ঘাড় নাড়লো তন্দ্রা। সে জানে নীলাদ্রির বাবা মা বহু আগে মারা গিয়েছেন। তবে কি করে সেটা সে জানেনা।

“জানোনা।আমি জানি।আমি দেখেছি।আমি দেখেছি কিভাবে একটা মস্ত ব্রাউন গাড়ি এসে মুহূর্তেই পিষে দিয়েছিলো তাদের।আমার চোখের সামনেই।আমি কিছু করতে পারিনি।র’ক্তে ভিজে গিয়েছিল রাস্তা।আমি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আমাকে যেতে দেয়নি।ওরা আমার বাবা মাকে একটা বড় অ্যাম্বুলেন্সে করে মর্গে পাঠিয়ে দিল। পুলিশ এলো কেস নিল।কিন্তু ওই গাড়ির মালিক এত বড়লোক ছিল যে সে টাকা দিয়ে কেসটা বন্ধ করে দিল।ওরা বললো আমার বাবা মা নাকি নিজ ইচ্ছায় ওই গাড়ির সামনে সু’ইসাইড করতে গিয়েছিল।আমি অনেক বলতে চেয়েছি এসব মিথ্যে কিন্তু একটা ছয় বছরের বাচ্চার প্রলাপ বলে ওরা সব উড়িয়ে দিল।আমার দাদু আর বাবা মিলে তখন সবে আমাদের কোম্পানিটা দাড় করাচ্ছিলো। এত টাকা দাদুর কাছে তখন ছিলোনা যে কেসটা রি-ওপেন করাবে।কেসটা ধামাচাপা পড়ে গেলো গাড়ির মালিকের টাকার পাহাড়ের নিচে।”

এতটুকু বলে একটু থামলো নীলাদ্রি।যেনো শুকনো গলা ভিজিয়ে নিতেই তার এই থামা।তন্দ্রা তার পুরোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলো।তার মামা বলেছিল তন্দ্রার বাবা মাও নাকি একটা পাহাড়ি রাস্তায় কার দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল।তন্দ্রা তাদের সাথে ছিলোনা বলে সে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল।আচ্ছা সব অভাগাদের বাবা মা কি অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়?

নীলাদ্রি দু মিনিট চুপ থেকে তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করলো,

“আচ্ছা তন্দ্রা তোমার কি বন্ধু আছে?আমি জানি আছে।ওই মেয়েটা তাইনা?আমি দেখেছি ওকে।খুব ভালো বন্ধু তোমরা।”

তন্দ্রা অবাক হলো।নীলাদ্রি তাসনোভাকেও দেখেছে? ও কি সর্বক্ষণ তার উপর নজর রাখছে? কিন্তু কেনো?একজন সামান্য চাকরানীর উপর নজর রাখার তার কি প্রয়োজন?

“আমারও একটা বন্ধু ছিল। রণেত। আমরা বন্ধু কম ভাই বেশি ছিলাম।কি ট্যালেন্টেড ছিল ছেলেটা। ব্রেইন খুব শার্প ছিল।কি দারুন ছবির আঁকতো সে। আমরা স্কুলে সবটা সময় একসাথে কাটাতাম।এমনকি স্কুলের বাইরেও বিকেলে একসাথে খেলতাম,হাঁটতে যেতাম।জানো একদিন ওই কিং কং মুভিটা দেখার পর আমরা দুজন আকাশের একটা বিশাল মেঘকে কিং কং-য়ের সেই বিশাল গরিলাটার সাথে তুলনা করেছিলাম।”

আপন মনেই হেসে উঠলো নীলাদ্রি।দৃষ্টি তার শূন্যে মিলিয়েছে।যেনো অতীতের ঘটনাগুলো এখনো দেখতে পাচ্ছে সে।

“রণেত কখনো কারো কোনো ক্ষতি করতোনা।অন্যদিকে আমি ছিলাম ওর ঠিক উল্টো।হয় যেচে কুকুরের পেছনে লাথি দিতাম নয় ট্রাফিক অমান্য করে সাইকেল ছুটিয়ে দিতাম রাস্তার মধ্যে দিয়ে।আর আমার ছায়াসঙ্গী হওয়ার ফলস্বরূপ আমার সাথে বিপদে পড়ত রণেত।শেষে অবশ্য ওই মাফ চাইতো বা পরিস্থিতি সামাল দিতো।আমি ছিলাম একরোখা।না কারো কাছে মাফ চাইতাম আর না ওর কথায় কান দিতাম।কিন্তু অত ভালো ছেলেটাকেও একদিন স্কুল গেটে একদল কালো মুখোশ পরা লোক শ্যুট করে দিলো।ঠিক এইখানে এই জায়গায়।”

কপালের মাঝ বরাবর হাত রেখে নীলাদ্রি তন্দ্রাকে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা করল।

“আমি ওর এত কাছে দাড়িয়ে ছিলাম যে ওর মাথা থেকে ছিটকে র’ক্ত মগজ এসে আমার মুখে লাগলো।উঃ কি উষ্ণ র’ক্ত! মনে হচ্ছিল আমার মুখটা যেনো ঝলসে যাবে।রণেত একবার চিৎকার করারও সুযোগ পেলো না।আমার সামনে তার প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।আমি তাকে ধরিনি।একবারও জাগানোর চেষ্টাও করিনি।আমি ঠায় দাড়িয়ে ছিলাম যতক্ষণ না পুলিশ আর আমার দাদু আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল।”

“স্যার কারা মেরেছিল তাকে?”

“শুনেছিলাম ব্যাবসায়িক শত্রুতার জের ধরেই নাকি ওর বাবার শত্রুরা ওকে হ’ত্যা করেছিল।দু একটা পাতি গুন্ডা জেলে গেলেও আসল অপরাধীদের পুলিশ ধরেনি।কারণ ওদের অনেক টাকা ছিল।তাই রণেতের কেসটাও ওর কবরে ওর সাথেই মাটি চাপা পড়ে গেলো।”

তন্দ্রা সেই ঘটনার বিভৎসতা কল্পনা করে চোখ বন্ধ করলো।উঃ কি নৃশংস ঘটনা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছে নীলাদ্রি!

“তন্দ্রা তুমি রাস্তা ঘাটে বাচ্চাদের দেখতে পাও?সেই কোমল সুন্দর মুখগুলো,সেই পবিত্র প্রণোচ্ছল চেহারা?”

“হ্যাঁ স্যার।আমার তো বাচ্চাদের খুব ভালো লাগে।”

এখন তন্দ্রার আর ভয় করছেনা নীলাদ্রিকে।অশান্ত সমুদ্র যেনো শান্ত হয়ে একটা স্রোতহীন নদী হয়ে গেছে।

“জানো তন্দ্রা সেদিন আমিও দেখেছিলাম।তবে প্রাণোচ্ছল ছোটফটে বাচ্চা নয়।রাস্তার ধারে ডাস্টবিনের পাশে জ্ঞান হারিয়ে পরে থাকা র’ক্তাক্ত দুটো বাচ্চা।বয়স আমার কত ছিল তখন, চৌদ্দ কি পনেরো হবে।ওদেরও তাই ছিল।মাছি ভনভন করছিল ওদের চারপাশে।একটা ছেলে আবার জ্ঞান ফিরেও পেয়েছিল।তবে তখন তার দেহের ক্ষতের জ্বালা থেকে পেটের জ্বালা বেশি ছিল।সে ওই ডাস্টবিনের থেকেই নষ্ট বাসি নোংরা খাবার তুলে খেতে শুরু করেছিল।আমি আর সহ্য করতে পারিনি।দাদুকে বলে ওদের হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।খাবার দিয়েছিলাম।আর আশ্রয় দিয়েছিলাম।তুমি জানো ওই সেদিনের বাচ্চাগুলো কারা ছিল?”

তন্দ্রা ঘাড় নাড়লো। নীলাদ্রি মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“বালু আর তৌসিফ।ওরা আজ অনেক বড় হয়েছে তাইনা? সেদিন ওদের যারা মেরে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল ওদের সম্রাজ্য আমি গুড়িয়ে দিয়েছি।একটু সময় লেগেছিল বটে তবে আমি পেরেছি।তন্দ্রা আমি রাস্তার ছেলে থেকে হঠাৎ সাফল্যের চূড়ায় উঠে আসিনি ঠিকই কিন্তু আমি অনেক দেখেছি।আমি দেখেছি কি করে আমার দাদুর বিজনেস পার্টনার তাকে ধোঁকা দিয়েছিল।আমি দেখেছি কি করে আমাদের দুঃসময়ে আমাদের কাছের মানুষরা গা ঢাকা দিয়েছিল। প্রতারণা করেছিল,ঠকিয়েছিল।আমি এসবের মধ্যেই বড় হয়েছি।এই যে প্রাসাদ প্রতিপত্তি দেখছো সব আমি আর দাদু মিলে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি।এসব একদিনে পাওয়া গুপ্তধন নয়। অযত্নলদ্ধ নয়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীলাদ্রি।সেই নিঃশ্বাসে যেনো তার বুকে জমে থাকা কষ্ট গুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো।

“তন্দ্রা!”

তন্দ্রা তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত নীলাদ্রির কথা শুনছিল।তার দৃষ্টি ছিল জানালার বাইরের অসীম আকাশের দিকে। নীলাদ্রির বলা কথাগুলো তার কর্ণকূহরে প্রবেশ করে হৃদয়ে আঘাত করছিল।তবে নীলাদ্রির দিকে তার কোনো খেয়াল ছিলনা । খেয়াল করলে দেখতে পেত ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে নীলাদ্রির মুখভঙ্গি।তার শান্ত চেহারায় আবার দেখা দিচ্ছে কুটিলতা,বিদ্বেষ!

“তন্দ্রা তুমি জানো আমি সবচেয়ে বেশি কাকে ঘৃনা করি?”

নীলাদ্রির দিকে না তাকিয়েই অস্ফুটে জবাব দিলো তন্দ্রা,
“কাকে স্যার?”

হঠাৎ তার গলায় সে প্রচন্ড চাপ অনুভব করলো।সভয়ে তাকিয়ে দেখলো নীলাদ্রি দুহাতে চেপে ধরেছে তার গলা।চেহারায় নিষ্ঠুরতা স্পষ্ট।এ যেনো একটু আগের সেই শান্ত নীলাদ্রিই নয়।

“প্রতারণাকারীদের তন্দ্রা,প্রতারণাকারীদের!আমি ধোঁকাবাজদের একদম পছন্দ করিনা।একদম না।”

তন্দ্রার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।সে কোনমতে ফ্যাঁশফ্যাশে গলায় বললো,

“স্যার,ক..কি করছেন! ছা…ছা ছাড়ুন আমাকে।আমি কি করেছি?”

“তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছো তন্দ্রা।প্রতারণা করেছে।ইউ আর এ চিটার।এ লায়ার।”

নীলাদ্রির হাতের আঙ্গুলগুলো দৃঢ়ভাবে বসে যাচ্ছিলো তন্দ্রার গলায়।তন্দ্রা তার গলা থেকে নীলাদ্রির হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছিল। নীলাদ্রি তাকিয়ে ছিল তন্দ্রার মুখের দিকে।একদৃষ্টে।
একি! মেয়েটার মুখ হঠাৎ এত মায়াবী দেখাচ্ছে কেনো? এই মেয়েটা একটা প্রতারক।তাহলে ওর চেহারায় শয়তানি ভাবটা নেই কেনো? এত সরল কেনো দেখাচ্ছে ওর চেহারা? নীলাদ্রি ড্রিঙ্কস করেছে বলেই কি তার এমন মনে হচ্ছে? নাকি সে কখনো ভালো করে তাকায়ই নি মেয়েটার মুখের দিকে? নীলাদ্রির হাত ধীরে ধীরে আলগা হয়ে এলো।সে ছেড়ে দিল তন্দ্রার গলা।ধাক্কা দিয়ে তন্দ্রাকে ফেলে দিল দরজার দিকে।নিজে বসে পড়ল ঘরের কোণের একটা দেয়াল ঘেষে।
তন্দ্রা তখন ভয়ে কাঁপছে।সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা রাক্ষসটা তাকে ছেড়ে দিয়েছে।নীলাদ্রি প্রচন্ড ক্ষোভে হতাশায় দুহাতে মাথা চেপে চিৎকার করে উঠলো,

“গেট লস্ট তন্দ্রা, গেট লস্ট!ইউ আর এ ফ্রড, চিটার! আই হেইট ইউ তন্দ্রা।আই হেইট ইউ।জাস্ট গেট লস্ট!”

********

সজোরে একটা পাঞ্চ খেয়ে বক্সিং রিংয়ের এক পাশে ছিটকে পড়লো ইভান।মুখ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তার।রোপগুলো শক্ত করে চেপে ধরলো সে। বক্সিং রিংয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সুন্দরী মাঝবয়সী মহিলা দ্রুত এগিয়ে এসে রিংয়ের ভেতরে দাড়িয়ে থাকা ইভানের প্রতিপক্ষ পুরুষটিকে বললেন,

“কি শুরু করেছো আবিদ?ছেলেটাকে মেরে ফেলবে নাকি?”

পুরুষটি তার হাতের নীল গ্লাভসগুলোতে পরস্পর ঘুষি মেরে বললেন,
“নীলিমা,আমাদের মধ্যে এসো না।আমি আমার ছেলেকে শিখাচ্ছি কি করে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে হয়।”

“ডিসগাস্টিং।”

নীলিমা ইভানকে তোলার জন্য তার কাছে যেতেই ইভান থাকে থামিয়ে দিল।মুখে লেগে থাকা রক্ত মুছে নিজেই উঠে দাড়ালো ইভান।নিজের প্রতিপক্ষের দিকে ইশারা করে বললো,

“কাম অন ডেড।”

এবার আবিদ খান এগিয়ে যেতেই ইভান তার পেটে আর মুখে পাঞ্চ মেরে তাকে ফেলে দিল।ইভান আবার একটা পাঞ্চ মারতেই যাচ্ছিল আবিদ খান তাকে হাত দিয়ে থামতে ইশারা করে বললেন,

“ওয়েল ,আমি হার মানছি।দেট ওয়াজ রিয়েলি বিলো দা বেল্ট। ”

“দেটস্ নট ডেড।”

হেসে উঠলো বাবা ছেলে। ইভান আবিদ খানের দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তুললো।কিন্তু সোজা হয়ে উঠে দাড়িয়েই আবিদ খান দুটো আপারকাট পাঞ্চ মেরে ফেলে দিলেন ইভানকে। ইভান আচমকা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। তার বেশ লাগলো এবার।নাক দিয়ে কিছুটা রক্ত বেরিয়ে এলো।নীলিমা চিৎকার করে উঠলো,

“ইটস চিটিং আবিদ!”

আবিদ খান স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করে ছেলেকে টেনে তুলে বললেন,
” প্রতিপক্ষকে কখনোই বিশ্বাস করতে হয়না।সে যতই দুর্বল হোক না কেনো।”

নীলিমা এবার রিংয়ের মধ্যে উঠে এলেন।
“যথেষ্ট হয়েছে।প্রতিদিন মাঝরাতে এসব মারামারি না করলে মন ভরেনা তোমাদের?”

আবিদ খান হাসলেন,
“নীলিমা এই রাত ছাড়া আমাদের বাবা ছেলের সময় থাকে কোথায়?”

“তাই বলে এসব ছাইপাশ খেলতে হবে?ক্রিকেট আছে , ফুটবল আছে,টেনিস আছে ওগুলো খেললেও তো হয়।”

ইভান নীলিমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ওহ মম,বক্সিং তো আমি তোমার জন্যই শিখছি তাইনা?”

“আমার জন্য?”

“ইয়াহ মম।মনে করো যেনো বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে, এমন সময় হারে রে রে রে রে।” হেসে উঠলো ইভান।

নীলিমা কপট রাগ করে বললেন,
“হ্যাঁ আমি জানি তো এসব তুই মায়ের জন্য শিখছিস না বউয়ের জন্য শিখছিস।”

“ওহ কাম অন মম, এর মধ্যে বউ এলো কোথা থেকে?”

নীলিমাকে নিয়ে ইভান এতক্ষণে নিজের ঘরে এসেছে।

“হ্যাঁ সেটাই বউ এলো কোথা থেকে?বউ তো আসবেও না।তুই যা শুরু করেছিস।গত দু বছর ধরে তোর জন্য পাত্রী দেখছি।তোর কাউকে মনে ধরলে তো বউ আসবে। সত্যি করে বলতো, তুই কোনো মেয়েকে ভালবাসিস কি না।”

ইভান নিজের মায়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে তার দু-কাঁধে হাত রাখলো,
“ভালোবাসি তো মম।”

“সত্যি!” উচ্ছসিত হন নীলিমা।”কেমন দেখতে মেয়েটা?”

ইভান একটু চিন্তা করে বললো,
“উজ্জ্বল ফর্সা দেহ,হরিণীর মত চোখ, ভ্রমরকৃষ্ণ কেশ, গোলাপ কুড়ির মত ঠোঁট।জাস্ট লাইক এ ম্যানেকুইন।”

“রিয়েলি!কে সেই মেয়ে? কি নাম তার?” নীলিমা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

ইভান তার মায়ের চিবুকে হাত রেখে মুচকি হাসলো,
“অ্যান্ড দা গার্ল ইজ মিসেস নীলিমা খান।মাই কিউট মাম্মি।”

“ইভান!আমি একটা সিরিয়াস টপিকে কথা বলছি।” ঝাঁঝের সাথে বললেন মিসেস নীলিমা।

“মম রাত বারোটার সময় কে সিরিয়াস টপিকে কথা বলে, বলতো?”

“হ্যাঁ তাই,তোর রাত বারোটার সময় বক্সিং করার টাইম আছে কিন্তু এই মায়ের কথা শোনার টাইম নেই।ভালো খুব ভালো।”

মুখ বেঁকিয়ে দাড়ান মিসেস নীলিমা। ইভান বুঝলো তার মা রাগ করেছে।তাই সে মায়ের হাত ধরলো,

“মম ,আচ্ছা শোন কোনো মেয়েকে আমার মনে ধরলে তো আমি তোমাকেই জানাবো সবার আগে তাইনা?”

“হ্যাঁ সেই অপেক্ষাতেই তো চাতক পাখির মত বসে আছি।জানিনা আমার কপালে কি লেখা আছে।” ঝঙ্কার দিয়ে ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মিসেস নীলিমা।

“আরে মম,আরে শুনো তো মাই সুইটহার্ট মম!”

ইভানের ডাকে ফিরেও তাকালেন না মিসেস নীলিমা। ইভান মনে মনে হাসলো।

“মম খুব শীঘ্রই আমি তোমার পুত্রবধূকে নিয়ে আসবো।কিন্তু কি করে যে নিয়ে আসি,তোমার ভাবি পুত্রবধূ তো তোমার মতই আমার কথায় পাত্তা দেয় না।পুরুষ হয়ে যে কি ঝামেলায় পড়লাম!

ইভান আয়নার সামনে দাড়ালো।আয়নার ওপারে ইভানের কল্পনায় ভেসে উঠলো একটা মুখ।সে তন্দ্রা!

“তন্দ্রা,আমি জানিনা তোমার মনে কে আছে,কি আছে।কিন্তু আমার মনে কেবল তুমি আছো।শুধু তুমি।”

ইভান হাত রাখলো আয়নার উপর।মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে এলো ইভানের কল্পনার আয়নায় থাকা তন্দ্রার চেহারা।

চলবে……….