মেঘে ঢাকা তারা পর্ব-১৩

0
477

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#পর্ব_১৩
#আয়াত_আফরা

কিচেনে পেঁয়াজ কুচিকুচি করতে করতে কাঁদছিল তন্দ্রা।বারবার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছিলো।আজ তন্দ্রার ভার্সিটির হলিডে।ভার্সিটি যাবার ঝামেলা নেই।তাই সকাল সকাল তাকে রান্না ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।অন্য রাধুনিরাও রান্না করছে।অনেকের রান্না একসাথে করার মেলা হ্যাপা।নীলাদ্রি স্যার সম্ভবত বেরিয়েছেন।কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।তাই তন্দ্রার মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে।

‘কালকের ঘটনা হয়তো নীলাদ্রি স্যার ভুলেই গেছেন।’

ভাবলো তন্দ্রা।হয়তো তার মনেই নেই কাল রাতে নেশায় বুদ হয়ে কি কি বলেছে তন্দ্রাকে।তন্দ্রার গলায় এখনও নীলাদ্রির আঙুলের দাগ রয়েছে।রাতে বেশ ব্যাথা করছিল তন্দ্রার।এখন কমেছে।দাগ দেখে বিনতি কি হয়েছে জিজ্ঞাসাও করেছিল।কিন্তু তন্দ্রা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।বারবার জিজ্ঞাসা করে বিরক্ত হয়ে অবশেষে বিনতি হাল ছেড়ে দিয়েছে।তন্দ্রা ফিশ ফ্রাই করছিল।চুলার আঁচটা মিডিয়ামে এনে ফ্রাইপ্যানে তেল ঢেলেছে পাঁচ মিনিট হলো।পেঁয়াজ কাটা শেষ করে সেটা তেলে ছাড়তেই যাচ্ছিল এমন সময় বিনতি এসে বললো,

“তন্দ্রা,যা স্যারের ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে আয়।”

কথাটা শুনে সৃষ্টি একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো বিনতির দিকে।কিন্তু বিনতি কাউকে কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করলোনা।সে সার্ভেন্টদের প্রধান।এখানে তার কথাই শেষ কথা।তন্দ্রা চুলার আঁচটা একটু বাড়িয়ে নিয়ে বললো,

“এইতো ফিশটা ফ্রাই করে যাচ্ছি বিনতি দি।”

“না এখনি যা।ফিশ আমি ফ্রাই করে নিচ্ছি।”

“আচ্ছা বিনতি দি।”

তন্দ্রা ঝাড়ু বালতি নিয়ে নীলাদ্রির ঘরের দিকে চলে গেলো।যেহেতু স্যার নেই তাই কোনো ভয় নেই।তন্দ্রা নীলাদ্রির ঘরের দরজায় টোকা দিল।কিন্তু ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলোনা।

“যাক বাব্বা রাক্ষসটা ঘরে নেই।”

দরজাটা খুলে উঁকি দিয়ে দেখলো মেঝেটা।না কোনো কাঁচ নেই।কাল মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে ছিল নীলাদ্রি। কাঁচ না ভাঙারি কথা।তন্দ্রার কখনো ইচ্ছা করে এ ঘরের সব কাঁচের জিনিসগুলো লকারে ভর্তি করে চাবি গায়েব করে দিতে।তাহলে এই রাক্ষসটা আর ভাঙার জন্য কিছু খুজে পাবে না।কিন্তু পরক্ষণেই ভাবনা উল্টে যায় তার।এমন করলে হয় স্যার পুরো লকারটাই ভেঙে ফেলবে নয় নতুন কাঁচের জিনিস কিনে আনবে।এর কি টাকার অভাব আছে নাকি?দরজাটা একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে খুললো তন্দ্রা।আর দরজাটা খুলেই ভেতরের দৃশ্য দেখে জমে গেলো সে।

ভেতরে বিছানার উপর শুয়ে আছে নীলাদ্রি!রাক্ষসটা তাহলে বের হয়নি!মাতাল হয়ে বেলা অবধি পরে পরে ঘুমুচ্ছে।

একটা চাপা অভিমান বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো তন্দ্রার।বিনতি দি সব জেনেশুনেও তাকে এ ঘরে পাঠালেন।নীলাদ্রি শুয়ে আছে উপুড় হয়ে।দেহের উপরের অংশ পুরো ন’গ্ন নিচের অংশ ব্লাঙ্কেট দিয়ে ঢাকা।একটুও নড়াচড়া নেই দেহের। নিঃশ্বাসের শব্দ আসছেনা। বেঁচে আছে তো?তন্দ্রা বিছানার পাশে মেঝেতে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে নেয় নীলাদ্রিকে।চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে দুবার পরীক্ষা করে। সত্যি ঘুমাচ্ছে তো?বলা যায়না কখন আবার জেগে উঠে কি করে বসে।লিও ঘুমিয়ে আছে তার জন্য নির্দিষ্ট মখমলের গদির উপর। কাল রাতে এটাকে দেখেনি তন্দ্রা।কি জানি কোথায় ছিল।ভালোয় ভালোয় নিঃশব্দে কাজ শেষ করে এ ঘর থেকে কেটে পড়তে হবে।

তন্দ্রা মেঝে ঝাড়ু দিয়ে মুছলো।বেলকনিতে গিয়ে গাছগুলোতে পানি স্প্রে করলো। সুইমিং পুলের আশপাশটা পরিষ্কার করলো।শেলফের বইগুলো মুছলো সাথে সব আসবাপত্রও।সব কাজ শেষ।এখন শুধু একটা কাজই বাকি। নীলাদ্রির বিছানা গুছানো।কিন্তু বিছানার মালিক যে স্বয়ং বিছানায় শুয়ে আছেন।তন্দ্রা একটু ভাবলো।স্যার উঠলে পরে নাহয় আরেকবার এসে বিছানা গুছিয়ে দেয়া যাবে।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তন্দ্রা।অবশেষে মুক্তি! রাক্ষসটা টেরও পায়নি। তন্দ্রা সতর্কতার সাথে ঘর থেকে বেরুতেই যাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে গম্ভীর গলা শোনা গেলো,

“কোথায় যাচ্ছ?”

তন্দ্রা এক মুহূর্তে থেমে গেলো।পেছন ঘুরে দেখলো নীলাদ্রি উঠে বসেছে।চোখে তার ঘুম ঘুম ভাব।তন্দ্রা বললো,

“স্যার আমি আসলে আপনার ঘর পরিষ্কার করতে এসেছিলাম।”

“হ্যাঁ তো পরিষ্কার না করে কোথায় যাচ্ছ?”

” স্যার পরিষ্কার করা শেষ।”

“কোথায় পরিষ্কার করেছ?আমি তো সব নোংরা দেখেতে পাচ্ছি।”

“আপনার তো চোখই নোংরা।”মনে মনে বললো তন্দ্রা।মুখে বললো,
“স্যার আমি মাত্র সব পরিষ্কার করলাম।”

“হয়নি,আবার পরিষ্কার করো।আমার চোখের সামনে।”

“কিন্তু স্যার….”

” সসসহহহহ্ যা বললাম তাই করো।” ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে তন্দ্রাকে চুপ করতে বললো নীলাদ্রি।

তন্দ্রা বালতির জল পাল্টে আবার ঘর মুছতে লেগে গেলো।নীলাদ্রি ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার চালু করলো।জল পড়ার আওয়াজ পেলো তন্দ্রা।সেই জলের নিরন্তর ধরা বয়ে চলেছিল নীলাদ্রির দেহের উপর দিয়ে।
নীলাদ্রির ঘরটা বিশাল।সেটা একবার তন্দ্রা মুছেছে।এখন আবার মুছতে হচ্ছে।আজ যে কোমরের কি অবস্থা হবে কে জানে! তন্দ্রা ঘর মোছা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো নীলাদ্রি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হয়ে আসছে ওয়াশরুম থেকে।তন্দ্রাকে উঠে দাড়াতে দেখে সে বললো,

“কি ব্যাপার কি মুছেছো?কিছুই হয়নি।আবার মোছ।তোমার মন কোথায় পরে আছে?”

“স্যার মেঝে তো পরিষ্কার হয়ে গেছে।”

“কিসের পরিষ্কার হয়েছে?এসব সাবান পানি দিয়ে মুছলে পরিষ্কার হয় নাকি?তুমি জানো না মেঝেতে কত জার্মস থাকে। ডিস-ইনফেক্ট দিয়ে পরিষ্কার করো।”

তন্দ্রা আবার ওয়াশরুমে গিয়ে বালতির জল পরিবর্তন করলো।জলে ডিসইনফেক্ট মেশাতে মেশাতে তন্দ্রা ভাবলো,

“এই বাড়িতে ওই রাক্ষসটাই সবচেয়ে বড়ো জার্মাস।ভয়ের ইনফেকশন ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বাড়িতে।”

তন্দ্রা আবার ঘর মুছতে লাগলো। নীলাদ্রি সোফায় বসে ল্যাপটপে কি যেনো ঘাটছিল।মাঝে মধ্যে তার চোখ ঘুরে যাচ্ছিল তন্দ্রার দিকে।সারাদিন শুয়ে বসে খাওয়া না!এবার বুঝবে কাজ করতে কেমন লাগে। তন্দ্রা ঘর মুছে সুইমিং পুলের দিকটা মুছতে লাগলো।আজ মনে হচ্ছে সারাদিন এই রাক্ষস তাকে দিয়ে ঘর মোছাবে।কাল থেকে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে কি না কে জানে! নীলাদ্রি ল্যাপটপ থেকে মুখ সরিয়ে দেখলো সামনে তন্দ্রা নেই।বুঝলো ওপাশে সুইমিং পুলের দিকটা পরিষ্কার করছে।সে ভেবেছিল সামনে থাকলে ড্রিঙ্কসের বোতলটা দিতে বলবে।ওদিকে আছে দেখে নিজের ল্যাপটপ রেখে উঠে গেলো বোতল আর গ্লাস নেয়ার জন্য।

মোছা শেষ করে উঠে দাড়াতে যেতেই তন্দ্রা টের পেল ব্যাপারটা।তার পায়ে ঝিম ধরে গেছে।কোমর সোজা করতেও কষ্ট হচ্ছে।সে কোনমতে উঠে দাড়াতে যেতেই ভেজা মেঝেতে পা পিছলে গেল তার।পিছনেই সুইমিং পুল।সেখানেই সে পড়তে যাচ্ছিল এমন সময় তার হাত টেনে ধরলো নীলাদ্রি।ভয়ে আর উত্তেজনায় তন্দ্রার চোখ বড়বড় হয়ে গেছে।পেছনে সুইমিং পুল সামনে নীলাদ্রি।দুটোই বিপজ্জনক।তবে এ মুহূর্তে সুইমিং পুলটা তার জন্য বেশি বিপজ্জনক। নীলাদ্রির কোনো ভাবান্তর নেই।সে তন্দ্রাকে নিজের দিকেও টানছেনা আবার পেছনে ধাক্কাও দিচ্ছেনা।তার দৃষ্টি পেছনের দেয়ালে থাকা নায়াগ্রা ফলসের চিত্রকর্মটির দিকে নিবদ্ধ।তির তির করে সময় কাটতে লাগলো।তন্দ্রার মনে ভয়ের রেসের ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করেছে।সে অস্ফুটে বললো,

“স্যার!”

আর সাথে সাথেই তার হাত ছেড়ে দিল নীলাদ্রি।যেনো সে এতক্ষণ তন্দ্রার মুখের কথা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল।তন্দ্রা গিয়ে পড়লো সুইমিং পুলের জলে।সে সাঁতার জানতো না।বার কয়েক জল থেকে উঠে আসার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো।নাকানি চুবানি খেতে খেতে পুলের মাঝ বরাবর চলে গেলো তন্দ্রা।নীলাদ্রি দাড়িয়ে দাড়িয়ে মজা দেখছিলো।তন্দ্রার ছটফটানি তার ভালই লাগছিলো দেখতে।

এই মেয়ে কি ড্রামা করছে নাকি?যাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে বাঁচায়?এমন ড্রামা তার সাথে এর আগেও একবার করেছে তুলয়।এই মেয়েও একই ড্রামা শুরু করেছে মনে হচ্ছে।কিন্তু একসময় তন্দ্রা ছটফট করতে করতে জলে তলিয়ে যেতে লাগলো।নীলাদ্রির হুশ ফিরলো এবার।তন্দ্রা সত্যিই সাঁতার জানেনা!

ভাবনাটা মাথায় আসতেই এক মুহুর্ত দেরি না করে নীলাদ্রি ঝাপিয়ে পড়ল জলে।প্রতিশোধ সে নিতে চায়।তবে খুন করে নয়।দ্রুত পানি থেকে সে তুলে আনলো তন্দ্রাকে।তন্দ্রা অচেতন হয়ে গেছে।নীলাদ্রি তার বুকের কিছুটা নিচে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।কিছুটা পানি বেরিয়ে এলো। নীলাদ্রি নিজের হাতের আঙ্গুল নিয়ে এলো তন্দ্রার নাকের কাছে।নিঃশ্বাস নিয়মিত পড়ছে না। এবার! আরো বেশ কয়েকবার বুকে চাপ দিল নীলাদ্রি।কাজ হচ্ছেনা।এবার কি মুখে মুখ লাগিয়ে নিঃশ্বাস দিতে হবে নাকি! অসম্ভব।এ মেয়ের মুখে সে কখনোই মুখ লাগাবেনা।দরকার হলে অন্য কাউকে ডেকে এ কাজ করতে বলবে কিন্তু সে জীবনেও করবেনা।কিন্তু কাকে ডাকবে এখন!

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নীলাদ্রি কাশির শব্দ পেলো।তন্দ্রা চোখ মেলেছি।ঘোর ঘোর ভাবটা কেটে যেতেই তন্দ্রা দেখলো নীলাদ্রি তার বুকে হাত রেখে চিন্তিত মুখে বসে আছে।বিষয়টা আন্দাজ করে তন্দ্রা এক ঝটকায় নীলাদ্রির হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো।এতক্ষণে নীলাদ্রির সম্মোহিত ভাবটা কেটে গেলো।সে একবার নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালো।এরপর তার চোখ গেলো তন্দ্রার দিকে।তন্দ্রাও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।একে অপরের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে গেল দুজন।চোখ নামিয়ে নিলো তারা।তন্দ্রা দেখলো নীলাদ্রির সাদা শার্ট ভিজে তার দেহের সাথে লেগে আছে।তার মধ্য দিয়ে দেহের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট দেখে যাচ্ছে।তার মানে নীলাদ্রি নিজে জলে ঝাঁপ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে এনেছে!নিজেই ফেলেছে আবার নিজেই তুলেছে। ঢং!

নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে রাগ হলো তন্দ্রার।সে তার ভিজে ওড়নাটা নিজের ভিজে কাপড়ের চারিদিকে জড়িয়ে নিলো।নীলাদ্রি তার অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠে নিজের চুলগুলো ঝাড়তে শুরু করলো।তন্দ্রা আমতা আমতা করে বললো,

“স্যার আমার জামা কাপড় ভিজে গেছে।”

নীলাদ্রি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তন্দ্রার দিকে।
“জামা কাপড়সহ পানিতে পড়লে জামা কাপড় তো ভিজবেই, এটা আবার ঘটা করে বলার কি আছে?”

“না মানে স্যার যদি আমাকে ঘরে যেতে দিতেন ,কাপড়গুলো পাল্টে নিতাম আরকি।”

নীলাদ্রি ব্যাঙ্গ করে বললো,
“একেই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি।তুমি এই ভেজা কাপড় পরে নিচে যাবে।তুমি জানো নিচে কত পুরুষ সার্ভেন্ট কাজ করছে?”

তন্দ্রা বুঝতে পারল নীলাদ্রি কি বোঝাতে চাইছে।কিন্তু এখনও তো সে ভেজা কাপড় নিয়ে একটা পুরুষের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।নীলাদ্রি তার রুমে থাকা ল্যান্ডফোনটা নিয়ে ডায়াল করলো।ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হতেই সে বললো,

“বিনতি,তন্দ্রার এক সেট শুকনো কাপড় উপরে পাঠিয়ে দাও।ও পানিতে পড়ে গিয়েছিল।”

পাঁচ মিনিট পরেই তন্দ্রার কাপড় নিয়ে নীলাদ্রির ঘরের সামনে হাজির হলো প্রিয়া।প্রিয়া দেখতে পেলো নীলাদ্রির কাপড়ও ভিজে জবজব করছে।ব্যাপারটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলনা তার।নীলাদ্রি প্রিয়ার হাত থেকে তন্দ্রার কাপড় নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।তন্দ্রা তখন ঠান্ডায় কাঁপছিল।এক তো ভেজা কাপড় তার উপর এসি চলছে।নীলাদ্রি তন্দ্রার দিকে কাপড়গুলো ছুঁড়ে দিল।

“যাও আমার ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে কাপড় পাল্টে এসো।আর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটু বুদ্ধি খরচ করো।”

সিদ্ধান্ত বলতে যে নীলাদ্রি একটু আগে তন্দ্রার নিজ ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টানোর সিদ্ধান্তটাকে বুঝিয়েছে সেটা তন্দ্রা বেশ বুঝতে পারলো।সে চুপচাপ কাপড় নিয়ে ঢুকে পড়লো নীলাদ্রির ওয়াশরুমে। ছিটকিনিটা ভালো করে বন্ধ করে নিল।একবারের জায়গায় তিনবার চেক করলো ভালো করে বন্ধ হয়েছে কি না।বলা তো যায়না ওই রাক্ষস যদি ঢুকে পড়ে! ভালো করে ওয়াশরুমে নজর বুলালো তন্দ্রা।কোনো গোপন ক্যামেরা লাগানো নেই তো?ভালো করে দেখে নিল পুরো ওয়াশরুম।সাবধানের মার নেই।দেখে শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে সে শাওয়ার চালু করলো।ভালো করে ঘষে ঘষে সে তার দেহ পরিষ্কার করতে লাগলো। ছিঃ ছিঃ আজ তার দেহে এভাবে পরপুরুষের হাত পড়েছে।এ পাপ কতবার ধুলে যাবে!

তন্দ্রা ওয়াশরুম ঢুকলে নীলাদ্রির স্নান করতে নেমে গেলো সুইমিং পুলে। সে ঘষে ঘষে তন্দ্রার শরীরের ঘৃণ্য স্পর্শ তার দুহাত থেকে ভালো করে পরিষ্কার করতে লাগলো।আজ অনন্যোপায় হয়ে তাকে এই কাজ করতে হয়েছে।নয়তো জীবনেও সে ওই মেয়ের দেহে এভাবে হাত দিতনা সে।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে তন্দ্রা দেখলো নীলাদ্রি সুইমিং পুলে স্নান শেষ করে কাপড় পাল্টাচ্ছে।সে চোখ ঘুরিয়ে নিল।নীলাদ্রি কাপড় পাল্টে টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে এসে বসলো সোফার উপর। তন্দ্রা এসে দাড়ালো তার সামনে।এখন সে যেতে চায়।কিন্তু নীলাদ্রি না বললে সে যেতে পারছেনা।নীলাদ্রি মেঝের দিকে ভালো করে চোখ বুলালো।তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করলো,

“হে পরম করুণাময়! এ যেনো আবার ঘর মুছতে না বলে।”

নীলাদ্রি মেঝেটা ভালো করে দেখে অস্ফুটে বললো,
“জার্মস!”

“হ্যাঁ জার্মস! জার্মস যা ছিল সেগুলো তো আপনার প্রতিদিনের চিৎকার শুনে শুনে কানের পর্দা ফেটে আগেই মারা গেছে।আর জার্মস আসবে কথা থেকে?” মনে মনে বললো তন্দ্রা।

নীলাদ্রি টি-টেবিলে উল্টানো কাঁচের দুটো গ্লাস সোজা করে রেখে বললো,

“হু।মেঝেটা ভালই পরিষ্কার হয়েছে।যাও আজকের মত তোমার ছুটি।”

তন্দ্রার মুখে এবার হাসি ফুটে উঠলো।তার সারা শরীর খুব ব্যাথা করছে।বিশেষ করে কোমরটা ধরেছে।সে ঝাড়ু পোছা হাতে নিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাড়ালো।সেখানে টান টান হয়ে শুয়ে আছে নীলাদ্রির কুকুর লিও! এটাকে পেরিয়ে সে কি করে বেরুবে? তন্দ্রা কোনমতে সেটার পাশ কাটাতে যেতেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো কুকুরটা।তন্দ্রা ভয়ে দু পা পিছিয়ে এলো।অন্য কোনো উপায় নেই দেখে সে থমথমে মুখে আবার এসে দাড়ালো নীলাদ্রির কাছে।নীলাদ্রি একটা গ্লাস তরল দ্বারা পূর্ণ করছিল।তন্দ্রাকে ফিরে আসতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকালো,

“কি ব্যাপার ফিরে এলে যে?”

“আসলে স্যার লিও শুয়ে আছে দরজার সামনে।ওটাকে একটু সরে আসতে বলুন না।”

একটা চাপা হাসির রেখা ফুটে উঠে নীলাদ্রি ঠোঁটে।
“আমি আমার বেবকে কেনো সরতে বলবো? ও ওখানে আরামে শুয়ে আছে।তুমি ওকে ডিঙিয়ে বেরিয়ে যাও।”

“স্যার এটা সম্ভব না। অধৈর্য্য হয়ে বললো তন্দ্রা।

“ওকে কুল।আমি ওকে ওখান থেকে সরতে বলবো তবে আমার একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত স্যার?”তন্দ্রা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

তাকের উপর সাজানো সারি সারি কাঁচের বোতলের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট বোতলের দিকে আঙুল দেখিয়ে নীলাদ্রি বললো,

“ওটা নিয়ে আসো।”

তন্দ্রা বোতলটা নিয়ে এলো।সে বুঝতে পারল না কি চলছে নীলাদ্রির মনে।নীলাদ্রি বোতলের ঘন সবুজ তরলটা একটা খালি গ্লাসে ঢেলে তন্দ্রার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“পান করো।”

তন্দ্রা চমকে উঠলো। কি এটা! নীলাদ্রি তন্দ্রাকে চমকাতে দেখে বললো,

“এমন ভাব করছো যেনো বিষ ঢেলে দিয়েছি?এটা বিষও না মদও না। ড্রিংক ইট।”

“কিন্তু এটা কি স্যার?”

“আই সে ড্রিংক ইট।এক নিঃশ্বাসে শেষ করো এটা নয়তো….”

তন্দ্রা গ্লাসটা উঠাতেই সেটার থেকে একটা বিজাতীয় গন্ধ পেলো।সে আবার তাকালো নীলাদ্রির দিকে।নীলাদ্রি শকুনের দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।তন্দ্রা নাক চেপে ধরে পান করতে লাগলো তরলটা। তরলটা মুখে যেতেই তন্দ্রার চেহারা বদলে গেলো।কি তেঁতো! অত তেঁতো জিনিস জীবনেও খায়নি তন্দ্রা।কিন্তু নীলাদ্রির ভয়ে সেটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করতে হলো তন্দ্রাকে।তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো নীলাদ্রি।তন্দ্রা ধপ করে গ্লাসটা রাখলো টি-টেবিলে।তার মুখের মানচিত্র বদলে গেছে।নীলাদ্রি কোনমতে তার হাসি কন্ট্রোল করে বললো,

“ইজ ইট বেটার?”

তন্দ্রা দাঁত চেপে বললো,
“নো স্যার, বিটার! কি তেঁতো!”

নীলাদ্রি হাসলো।
“এখন থেকে রোজ তোমাকে এই বিটার থেরাপি দেবো।”

কথাটা শুনে মুখ বেঁকিয়ে দাড়ালো তন্দ্রা।নীলাদ্রি ডাকলো,

“লিও,বেব কাম হিয়ার।”

নীলাদ্রির গলা পেয়ে লিও এগিয়ে আসতে লাগলো।তন্দ্রার মনে হলো সেটা যেনো তার দিকেই এগিয়ে আসছে।সে ভয় পেয়ে পেছোতে লাগলো।সে এতটাই বেখেয়াল ছিল যে আচমকা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নীলাদ্রির উপর। নীলাদ্রিও এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না।তার হাতে ধরা ড্রিঙ্কসের গ্লাস থেকে ড্রিঙ্কস ছলকে পড়লো মেঝেতে।তন্দ্রা দুহাতে নীলাদ্রির শার্টের কলার ধরে তার বুকের উপর মাথা রেখে আছে। তড়িৎবেগে ভাবতে হলো নীলাদ্রিকে।সে তার কলার ছাড়াতে যেতেই তার হাত পড়ল তন্দ্রার হাতে।সম্বিত ফিরে পেলো তন্দ্রা।সে নীলাদ্রির বুক থেকে মাথা তুললো।নীলাদ্রি জোর করে তন্দ্রার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল তার শার্ট।লিও এসে বসেছে তন্দ্রার বিপরীত পাশে নীলাদ্রির পায়ের কাছে।তন্দ্রা উঠে দাড়িয়ে ঝাড়ু পোছা আর বালতি নিয়ে কোনমতে ছুটে পালিয়ে এলো নীলাদ্রির ঘর থেকে।

নিচে আসতেই তন্দ্রাকে ঘিরে ধরলো সব চাকরানীরা।তারা প্রিয়ার মুখ থেকে আগেই সব ঘটনা জানতে পেরেছিলো।তবুও সেটা তারা তন্দ্রার মুখ থেকে শুনতে আগ্রহী।

“কি হয়েছিল কি হয়েছিল?” উত্তেজিত কন্ঠ ভেসে এলো এক পাশ থেকে।

“স্যার তোমার সাথে কি করেছিলেন?”

“তোমাকে কি স্যারই পানি থেকে তুলেছিলেন?”

একের পর এক প্রশ্নবাণে তন্দ্রাকে জর্জরিত করে তুললো সব চাকরানীরা।এমন সময় ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো এক যুবতী।বয়সে তন্দ্রার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে।চাকরানীদের পোশাক পরে আছে সে।কিন্তু তন্দ্রা এর আগে তাকে এ বাড়িতে দেখেনি।সে তন্দ্রার কাছে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“তুমি তন্দ্রা?”

“আপ..হ্যাঁ আমি তন্দ্রা।”

“তুমিই তো সে না যার প্রতি স্যার একটু বেশি কনসিয়াস?”

“আমি কিছু বুঝলাম না।”

“তোমাকে দিয়ে তো স্যার বেশি কাজ করান তাইনা? স্যার তোমার পেছনে লেগে থাকেন,তোমার উপর নজর রাখেন তাইনা?”

মেয়েটা কথাগুলো ভুল বলেনি। স্যার তো সত্যিই তার উপর বেশি খবরদারি করেন।
“হ্যাঁ।”

“একদম সিরিয়ালের মত!”

“মানে?”

“আরে সিরিয়ালে দেখো নি গরীব ঘরের মেয়ে বড়লোক বাড়িতে কাজ করতে আসে।কিন্তু মালিক সেই মেয়েকে একদম পছন্দ করতে পারে না।সবসময় তাকে দিয়ে বেশি খাটায়।হেনস্থা করে।কিন্তু শেষে সেই মেয়েকেই বিয়ে করে নেয়।”

তন্দ্রা হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইলো।এসব কি বলছে মেয়েটি।নীলাদ্রি স্যার আর তার মধ্যে এসব কিছু তো সে কল্পনাও করতে পারেনা।

“বলোনা বলোনা তোমাদের কেমিস্ট্রি কেমন চলছে?” আগ্রহী হয়ে তন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করলো মেয়েটি।

তন্দ্রা কি বলবে ভেবে পায় না।সবাই তার দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।এমন সময় তাদের সরিয়ে এগিয়ে এলো বিনতি।

“ধেৎ তন্দ্রা ওর কথায় কান দিসনা তো।সিরিয়াল দেখে দেখে ওর মাথার সব পোকা নড়ে গেছে।”

“আরে দিদি কি বলছো।সিরিয়াল তো তুমিও দেখো তাইনা?” বললো মেয়েটি।

“হ্যাঁ ভাই দেখি।তবে তোর মত না।বুঝলি পুষ্পা এতদিন তুই বাড়ির বাইরে ছিলি বাড়িটায় শান্তি ছিল।”

“তোমার তো সেই দিদি আমাকে ঘর থেকে তাড়ানোর মতলব।”

“আরে। যা তো মেলা বকিস না।তন্দ্রা তুই পানিতে পড়লি কি করে?”

“আমি তোমার সাথে কথা বলবোনা বিনতি দি। স্যার আছে জেনেও তুমি আমাকে ওই ঘরে পাঠালে?”

“স্যারের আদেশ তন্দ্রা।এখন থেকে স্যারের ঘর তোকেই পরিষ্কার করতে হবে।”

“কি!” আঁতকে উঠলো তন্দ্রা। “আমি মরে যাবো বিনতি দি।আজকে তিনবার আমাকে দিয়ে ঘর মুছিয়েছে ।আমার কোমরটা মনে হচ্ছে ভেঙেই গেলো।”

তন্দ্রা তার কোমরে হাত দিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোমরের ব্যাথাটা যেনো এর মধ্যেই অনেকটা কমে গেছে।কি করে কমলো? ওই তেঁতো জিনিসটা খাওয়ার কারণে নাকি?কি ছিল ওটা?

“ঠিক আছে চল আমি ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।”

তন্দ্রাকে তার ঘরে টেনে নিয়ে গেলো বিনতি।তন্দ্রা তাকে কিছু বলার সুযোগই পেলো না।

চলবে………

#মেঘে_ঢাকা_তারা
#বোনাস_পার্ট
#আয়াত_আফরা

তন্দ্রা ছুটে বেরিয়ে যেতেই নীলাদ্রির ঘরে প্রবেশ করলো বালু আর তৌসিফ।নীলাদ্রি কাঁচের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলো।বালু তাকে জিজ্ঞাসা করলো,

“মেয়েটা এমন করে ছুটে বেরিয়ে গেলো কেনো ভাই?”

নীলাদ্রি তাদের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল,
“ভয় পেয়েছে।”

“কেনো ভয় পেয়েছে?”

এবার নীলাদ্রি সরাসরি তাকালো বালুর চোখের দিকে।একটু চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললো,
“কারণ আমি ভয় দেখিয়েছি।”

বালু সেই ব্যাপারে আর কথা বাড়ালো না।তৌসিফ গলা নামিয়ে বললো,

“ভাই রাজনগরের কেসটার কথা আপনার মনে আছে?”

নীলাদ্রি ম্যাগাজিনটা রাখলো,
“ট্রিপল মার্ডার কেস?”

“জি ভাই।ওই কেসে একটা সাক্ষী ছিল না?”

“ধনঞ্জয়?”

“হ্যাঁ ভাই,ওই ব্যাটা বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।”

“কি নিয়ে?”

“ওই কোর্টে যাওয়া নিয়ে।”

“হুম।যা বলেছিলাম সব ভুলে গেছে মনেহয়।”

“কি করবো এখন?”

“কি করবে সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?তুলে আনো।দেখি তো ওর দাঁতে কি পরিমান বিষ জমেছে।”

“ওকে ভাই।”

বালু আমতা আমতা করে বলল,
“ভাই আরেকটা খবর আছে।”

“কার ব্যাপারে?”

“ওই মেয়েটার ব্যাপারে।আসলে ওর মামীর এক পাড়াতুত বোন শহরের বাইরে ছিল।সে কাল ফিরেছে।তার থেকেই একটা খবর জানতে পারলাম তন্দ্রার ব্যাপারে।”

“ওই মেয়েটাকে ফাঁসিয়ে আমার সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছিল, এটাই তো জানতে পেরেছো তাইনা?”

নীলাদ্রির কথায় বালু আর তৌসিফ চমকে উঠলো।

“ভাই আপনি কি করে জানলেন?”

নীলাদ্রি দাড়িয়ে তাদের দুজনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোমরা হচ্ছো আমার খবর জানার একটা মাধ্যম।একমাত্র মাধ্যম নও।অনেক খবর তোমাদের ফাঁকফোকর গলেই আমার কানে চলে আসে।”

“তার মানে তো ভাই ওই মেয়েটা নির্দোষ।”

“হুঁ।”

“তাহলে ওকে ছেড়ে দেয়া যায়না ভাই?মনে মুক্তি দেয়া যায়না?”

নীলাদ্রি মুচকি হাসলো।
“বালু আমি জানি তুমি মেয়েটাকে বোনের মত দেখো।কিন্তু ওর মুক্তির যে এখনও সময় আসেনি।”

“কিন্তু কেনো ভাই?যা হয়েছে এতে ওর তো কোনো দোষ ছিলনা।”

নীলাদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“কিছু বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অনেক সময় মঙ্গলজনক হয়।অনেকে সেটা বুঝতে পারেনা।যারা পারেনা তারা বন্ধন ছিন্ন করে খুব বড় বিপদে পরে।তুমি কি চাও ওই মেয়ের সাথেও তাই হোক?”

বালু মাথা নাড়ল।তার নীলাদ্রির উপর বিশ্বাস আছে।

“আর ওই ব্যাপারটা কি করবো ভাই?”

“কোন ব্যাপারটা?”

“তন্দ্রার উপর কি আর নজর রাখতে হবে?”

“না আর দরকার নেই।ওর সম্পর্কে আমি এখন লেস ইন্টারেস্টেড।”

“ঠিক আছে ভাই।”

“আর শোনো সবাইকে জানিয়ে দাও আজ বিকালে আমি কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা ভাই।”

বালুরা বেরিয়ে যেতেই নীলাদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ওর উপর আর নজর রাখতে হবেনা।ওর খেয়াল রাখার জন্য এবার নতুন কেউ চলে এসেছে। আর যা হয়ে চলেছে সেটা নজর রেখেও বা কে আটকাতে পারবে?

*******

পরদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল তন্দ্রা।মনটা যে তার কি ফুরফুরে লাগছে!কিছুদিন নীলাদ্রি বাড়িতে থাকবেনা।এর চেয়ে বড় সুখবর আর কি হতে পারে।বাড়িতে গিয়ে রাক্ষসটার মুখ আর দেখতে হবেনা।কেউ ধমক দিতেও আসবেনা।ওটার নজর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবেনা।

“এই তন্দ্রা শোন শোন।”

পেছন থেকে তাসনোভার গলা পেল তন্দ্রা।তন্দ্রা দাড়িয়ে গেল।তাসনোভা তার সামনে হাজার টাকার পাঁচটা নোট নাচিয়ে বললো,

“দেখ কি পেয়েছি!”

“অত টাকা কোথায় পেলি?”

“একটা কনটেস্টে পার্টিসিপেট করেছিলাম।সেটা জিতে গেছিইইইইই।” আনন্দের সাথে বললে তাসনোভা।

“বাহ দারুন!”

“চল আজ পার্টি হবে।”

“কোথায় যাবো?”

“লোটাস জিনজারে।”

“নো ওয়ে তাসনোভা। তুই জানিস ওটা কত দামী রেস্টুরেন্ট?”

“জানি বলেই তো বলছি।আমার অনেক সখ ছিল ওখানে যাবো।কিন্তু টাকা ছিলনা।এখন টাকা পেয়েছি।”

“তাই বলে এভাবে টাকা উড়াবি?”

“বারে টাকা তো উড়ানোর জন্যই।যে টাকা দিয়ে নিজের ইচ্ছেই পূরণ করতে পারবোনা সে টাকা আবার টাকা কিসের?চল চল চল ।”

তন্দ্রাকে জোর করে লোটাস জিনজার রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো তাসনোভা।মেন্যু কার্ডটা মেলে ধরে তাসনোভা বললো,

“কি অর্ডার করি তন্দ্রা বলতো?”

তন্দ্রা তাসনোভার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে নিলো,
“তুই ট্রিট দিচ্ছিস তাই আমি ডিসাইড করবো কি খাব ওকে?”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

কার্ড দেখে তো তন্দ্রার চক্ষু চড়কগাছ।এত দাম!তন্দ্রা অনেক খুজে মেনু কার্ডের সবচেয়ে কমদামী দুটো খাবার বের করে তাসনোভাকে দেখলো,

“আমার এগুলো চাই।”

তাসনোভা একটু ভ্রু কুঁচকে চাপা স্বরে বললো,

“ঠিক জানতাম তুই কমদামী খাবারগুলো বের করবি।তোর আর অর্ডার দিতে হবে না।আমিই দিচ্ছি। এক্সকিউজ মি!”

ওয়েটার এসে দাড়ালো তাদের টেবিলের সামনে।

“ইয়েস ম্যাম।”

“দুটো স্পাইসি রামন। ক্রিসপি চিলি চিকেন,আর আইসক্রিম।”

“ভাইয়া আইসক্রীম একটা।” তন্দ্রা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো।

মেন্যুতে আইসক্রীমের দাম সে দেখেছিলো। এই তাসনোভার কোনো বুদ্ধি নেই।এক দিনে সব টাকা উড়িয়ে দেবে।ওয়েটার অর্ডার লিখে নিয়ে চলে গেলো।

“এই তন্দ্রা একটা কেনো বললি?প্রতিদিন কি আসবো নাকি এখানে?”

“প্রতিদিন আসার মত আপনার কাছে টাকাও থাকবেনা ম্যাডাম।আপনি তো একদিনেই সব টাকা উড়িয়ে দিচ্ছেন।একটাই শেয়ার করবো।”

তাসনোভা চুপচাপ মেনে নিলো তন্দ্রার কথা।যথাসময়ে খাবার হাজির হলো।দুজনে রামন আর চিকেন শেষ করার পর হাত বাড়ালো আইসক্রীমের দিকে। আইসক্রীমের উপর একটা চেরি দেয়া। তাসনোভা বললো,

“দেখ তন্দ্রা, চেরি কিন্তু আমার।”

“সেটি হচ্ছেনা” নিজের চামচ এগিয়ে দিলো তন্দ্রা। “চেরিটা আমার পেটেই যাবে।”

দুজন চেরিটাকে নেয়ার জন্য টানাটানি শুরু করতেই তন্দ্রার চামচ থেকে আইসক্রীম সুদ্ধু চেরিটা গিয়ে পড়লো পাশের টেবিলে থাকা একজন পুরুষের উপর।

“ওহ্ শিট!”
পুরুষটি তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়িয়ে তন্দ্রার থেকে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের কোট পরিষ্কার করতে লাগলো। তন্দ্রা দ্রুত খাবার ফেলে পুরুষটির কাছে গেলো।

“আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি।আমার এমন কোনো ইন্টেনশন ছিল না।ভুল করে হয়ে গেছে।প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি খুবই দুঃখিত!”

এবার পুরুষটি তার অপরাধীকে দেখার জন্য তার দিকে মুখ ফেরাতেই তন্দ্রা চমকে উঠলো।এ তো ইভান! ইভানও তন্দ্রাকে দেখে থ হয়ে গেলো।আবার দেখা হলো। তন্দ্রা আবার বললো,

“আই অ্যাম ভেরি সরি।আমি আসলে খেয়ালই করিনি।প্লীজ ফর্গেভ মী!”

ইভানের কানে তখন তন্দ্রার কোনো কথাই ঢুকছেনা।সে মুগ্ধ হয়ে তন্দ্রাকে দেখছে।তন্দ্রা একটা সাদাকালো রাউন্ড ড্রেস পড়েছে।চুলগুলো নেমেছে কোমরে।হাতে ইভানের দেয়া সেই চুড়িগুলো।ইভান একদৃষ্টিতে তাকায় তন্দ্রার দিকে।তন্দ্রা ইভানের চোখের সামনে হাত নেড়ে বললো,

“আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমি কি বলছি?”

“হা..হ্যাঁ হ্যাঁ শুনছি।”

“আমি আপনার কাপড় পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”

তন্দ্রা একটা টিস্যু তুলে নিলো ইভানের শার্ট পরিষ্কার করার জন্য।তার মনে ভয় হচ্ছে।ইভানের এত দামী কাপড় সে নষ্ট করে ফেললো।যদি আবার কিনে দিতে বলে।তন্দ্রা ইভানের কোট মুছতে যেতেই ইভান তাকে আটকে দিলো।

“এর প্রয়োজন নেই মিস তন্দ্রা।তাহলে আমাদের আবার দেখা হলো!”

তন্দ্রা চুপ করে রইলো।

“বলেছিলাম না কিছু কাকতালীয় ব্যাপার বার বার ঘটে।তবে আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে এটা কাকতালীয় কি না।”

“মানে?”

“মানে হয়তো উনি চাইছেন আমরা এক হয়ে যাই।”

ইভান উপরের দিকে ইশারা করলো।তন্দ্রা ইশারায় মর্ম বুঝে বললো,

“মিস্টার ইভান এটা কো-ইনসিডেন্ট।”

“তো মিস তন্দ্রা আমরা কি কাল আলাদাভাবে দেখা করতে পারি?”

“আপনি কি আমাকে ডেটে যেতে বলছেন?”

“যদি ভাবেন তাহলে তাই।আর কালকের ডেটটা ডেটের জন্য পারফেক্ট।”

“দুঃখিত আমি আসতে পারবোনা।”

“চেষ্টা তো করতে পারেন।”

“সম্ভব না মিস্টার ইভান।”

তন্দ্রা দ্রুত তার ব্যাগটা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।পেছন থেকে ইভানের কন্ঠ ভেসে এলো,

“আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো মিস তন্দ্রা।”

তাসনোভা বিল পরিশোধ করে তন্দ্রার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো।

” তন্দ্রা ও ইভান ছিল না?”

“হ্যাঁ ওর নাম ইভান।তুই কি করে জানলি?”

“আরে ওকে চিনবনা!ও তো শহরের নামকরা বিজনেস ম্যান।জানিস ও দু দুবার জুনিয়র বিজনেসম্যান অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে।”

“তাই নাকি।আমার জানা ছিলো না।”সহজ গলায় বললো তন্দ্রা।

“ও তোকে ডেটের জন্য বলছিলো?”

“হ্যাঁ।”

“তুই না করে দিয়েছিস!”

“হ্যাঁ তাসনোভা।”

“তুই কি করেছিস তোর ধারনা আছে?ওর জন্য কত মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তুই কিনা এভাবে রিজেক্ট করলি?এমন সুযোগ কিন্তু বারবার আসেনা তন্দ্রা।”

“আমার চাইও না এমন সুযোগ।আমার এমন ছেলে পছন্দ নয় তাসনোভা।আমার পছন্দ একদম সিম্পল,সাধাসিধা,এলিগেন্ট ছেলে।আর বড়লোকরা এমনিতেই অহংকারী হয়।তাই আমার তাদের পছন্দ নয়।”

“বাহ তাদের টাকা আছে তারা অহংকার করবেনা?”

“করুক না আমার তো আপত্তি নেই।আমার এমন ছেলে পছন্দ নয়।বুঝেছিস এবার?”

“তন্দ্রা তুই না হাবা ছিলি হাবাই রইলি।” তাসনোভা রাগ করে নিজের রাস্তায় পা বাড়ালো।

তন্দ্রা বাড়ির দিকে চললো।বাড়িতে যাবার দুটো পথ।একটা সরাসরি।আরেকটা শর্টকাট।সরাসরি লম্বা রাস্তা ধরেই তন্দ্রা প্রতিদিন যেত।তবে আজ ভাবলো শর্টকাট নেয়া যাক।এ পথে সে আগে আসেনি।একবার দেখেও নিতে পারবে রাস্তাটা। তাই সে শর্টকাট ধরে চলল বাড়ির উদ্দেশ্যে।শর্টকাট রাস্তা একটু নির্জন।খুব বেশি লোক এদিক দিয়ে আসেনা।কারণ লম্বা রাস্তাটা শহরের মধ্য দিয়ে গেছে।সেদিকে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করার সুবিধাটা বেশি।তন্দ্রা গুনগুন করে রাস্তা ধরে হাঁটছিলো।কি যে আনন্দ হচ্ছে তার। নীলাদ্রির চেহারা আজ দেখতে হবে না।এমন মনে হচ্ছে যেনো আকাশে উড়ে চলেছে। রাস্তাটা খুব নির্জন।আগে আসেনি বলে বুঝতে পারেনি। চারিদিকে গাছের সারি।তার মধ্যে দিয়ে আলোটাও কম আসছে। সাবধানে পা ফেলছিল তন্দ্রা।আশেপাশে যা ঝোপঝাড়।বলা যায়না রাস্তার মধ্যে সাপও চলে আসতে পারে।

একটু সামনে এসেই থমকে দাড়ালো তন্দ্রা।লুকিয়ে পড়ল একটা গাছের আড়ালে।সামনে দাড়িয়ে আছে একটা এসইউভি। গাড়িটাকে খুব চেনাচেনা লাগলো তন্দ্রার।কোথায় যেনো দেখেছে।হ্যাঁ এটা তো নীলাদ্রির গাড়ি! কিন্তু এটা এখানে কেন?একটু পর বালু আর তৌসিফকে দেখতে পেলো তন্দ্রা।তারা একটা মাঝবয়সী লোককে মারধর করতে করতে গাড়িতে তুলছিলো।গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ওটা কে বসে আছে?মুখ স্পষ্ট নয়।তবে হাবভাব দেখে তন্দ্রার ধারণা হলো ওটা নীলাদ্রি। নীলাদ্রি স্যার এখানে? কিন্তু উনি তো শহরের বাইরে গিয়েছিলেন।তাহলে এখানে আসবেন কি করে? আর কাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা।লোকটাকে দেখে তো খুব একটা খারাপ মনে হচ্ছিল না।

নীলাদ্রি স্যার তাহলে কিডন্যাপার! লোকটাকে কিডন্যাপ করেছেন! কিন্তু কেনো? উনার তো অনেক টাকা আছে।তাহলে একটা সামান্য লোককে কেনো কিডন্যাপ করবেন?

গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তন্দ্রাকে কেউ দেখতে পেলো না।লোকটাকে তুলে নিয়ে নীলাদ্রি তাদের নিজ গন্তব্যের দিকে গাড়ি চালালো। তন্দ্রা কিছুক্ষণ ভাবলো।না না তার চোখের সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ওরা তুলে নিয়ে গেলো আর সে চুপ থাকবে?কখনোই না। এটা তার পুলিশকে জানাতেই হবে।তন্দ্রা ছুটে গেলো কাছের থানায়।

“ইন্সপেক্টর ইন্সপেক্টর!”

ইন্সপেক্টর প্রণবেন্দ্র নাথ তখন সবে দুপুরের খাবারটা মুখে তুলছিলেন এমন সময় তন্দ্রার হাক ডাক শুনে তার বিষম খওয়ার জোগাড়।

“ইন্সপেক্টর কিছু করুন।ওরা ওই লোকটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলো!”

ইন্সপেক্টর এক গ্লাস জল খেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি একটু শান্ত হোন।কে কাকে তুলে নিয়ে গেলো?”

“স্যার স্যার ঐযে ওখানে…. ”

কথাটা বলে একটু থামলো তন্দ্রা।নীলাদ্রি যে লোকটাকে তুলে নিয়ে গেছে সেটা কি জানাবে ইন্সপেক্টরকে? না জেনে শুনে বলাটা কি ঠিক হবে? হতেও তো পারে এর মধ্যে অন্য কিছু আছে।না থাক নীলাদ্রির নামটা এখন না বলাই ভালো।

“কি হলো ম্যাডাম?কে কাকে কিডন্যাপ করেছে।”

“ঐযে স্যার আসলে ঐযে তালতলার রাস্তাটা আছে না ওখানে আমি দেখলাম করা যেনো একটা লোককে জোর করে গাড়িতে তুলে নিলো।”

“ম্যাডাম এভাবে আমরা কি করে বুঝবো?কে তুলে নিলো আপনি কে তাকে দেখেছেন?বা কাকে তুলে নিয়েছে আপনি কি তাকে চিনেন?”

তন্দ্রা ঘাড় নাড়ল।
“ব্যাস তাহলে আমরা কিভাবে কেস নেব?”

“কিন্তু ওরা যে জোর করে লোকটাকে তুলে নিলো।”

“আরে ম্যাডাম হতেও তো পারে ওরা বন্ধু।একজন ট্যুরে যেতে রাজি হচ্ছেনা তাই অন্যরা জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।”

“কিন্তু লোকটা যে কাঁদছিল।”

” ম্যাডাম শুধু চোখের জলের উপর ভিত্তি করে কি কেস নেয়া যায়?আপনি যা বললেন শুনে রাখলাম।পরে যদি তেমন কোনো রিলেটেড কেস পাই তাহলে আপনাকে ডেকে নেব।এখন যান।”

তন্দ্রা মন খারাপ করে বেরিয়ে এলো।নীলাদ্রি স্যার এত খারাপ! উনি যে এত নিচে নামতে পারেন তা তো ধারণাই ছিলনা তন্দ্রার।শহরের বাইরে যাবেন বলে গা ঢাকা দিয়ে এসব করছেন! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসও করতোনা তন্দ্রা।

বাড়ি ফিরে না খেয়ে শুয়ে রইলো তন্দ্রা।বিনতি কয়েকবার ডাকলো।কিন্তু তার কথার কোনো সাড়া দিলোনা সে।

চলবে………