রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
359

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat

❝একটা পাখি, দুইটা পাখি, তিনটা পাখি।❞

নীল-চিরকুটের পুরোটা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই একটি মাত্র লাইন। ধ্রুব ছোঁ মেরে আরশির হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে টেবিলের ঠিক মাঝখানে রাখলো। নীল সহ বাকি সবাই মাথা ঝুঁকে ভীষণ কৌতুহলী চোখে চিরকুটের দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ জোড়া চোখ গুলোতে খেলা করছে কৌতূহল। চোখ ছোট ছোট করে বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে চিরকুটটা দেখেও কেউ কিছু বুঝতে পারলো না। সুপ্তি তার বোকাসোকা চেহারা নিয়ে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল-

“বইয়ের মাঝে চিরকুট আসলো কিভাবে? আর এখানেও সেম রৌদ্র ভাইয়ের বলা কথা লেখা কি করে?”

ধ্রুব কিছু বলবে তার আগেই নীল বেশ উত্তেজনা নিয়ে বলল-

“ভাই তুমি তো বললা লাইব্রেরিতে এসে সব বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু এখন তো আরও গুলিয়ে ফেলছি সব কিছু। রৌদ্র ভাইয়ের বলা কথা এই বইয়ের মাঝে আসলো কি করে??”

ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। মুখে বিরক্তির রেশ টেনে নিয়ে বলল-

“আমাকে বলার সুযোগ না দিলে বলবো কি করে!”

“আচ্ছা আমরা আর কিছু বলবো না। আপনি এবার সব কিছু বুঝিয়ে বলুন তো তাড়াতাড়ি। আমার মাথায় সব প্যাঁচ লেগে আছে।”

কাসফিয়ার কথার পরমুহূর্তেই আদ্রাফ বিষন্ন গলায় বলল-

“তোর একার না আমাদের সবার মাথাতেই প্যাঁচা লেগেছে।”

“এই তোরা চুপ করে থাকতে পারলে থাক না হলে আমার দুচোখের সামনে থেকে বিদায় হ।”

ধ্রুবর ধমকে সবাই চুপসে গেল। ভদ্র ভাবে চুপ করে বসে আছে। আরশি চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সবার কান্ডকারখানা দেখিছে। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না তাদের। সব কিছু বলার পর সবার রাম ধমক খেয়ে তার হজম করতে হবে। তাই এখন চুপচাপ শান্ত মেয়ে হয়ে বসে আছে।

“তোদের সবারই তো একটা প্রশ্ন ছিলো আদ্রলিকা কেন প্রতিদিন এই লাইব্রেরিতে আসে! কেন লাইব্রেরিতে আসলে ওর মন খারাপ থাকে!! তাহলে শোন তোদের এইসব প্রশ্নের উত্তর হলো এই চিঠি। আর এই চিঠিদাতা অন্য কেউ নয় তোদের রৌদ্র ভাই। আর এই বইয়ের মাধ্যমেই তারা দুজন চিঠি আদান-প্রদান করে যাচ্ছে এতদিন ধরে।”

ধ্রুব কথায় সবাই চমকে একসাথে “কিইইই” বলে চেচিয়ে উঠলো। সবাই বিস্ফোরিত চোখে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব আস্তে-ধীরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু বলল। সব কথা শোনার পর এক একজনের চোয়ালে ঝুলে পরেছে। আফসোসে তাদের চেহারা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেছে। নীলা থমথমে গলায় বললো-

“সবই বুঝলাম কিন্তু এই পাখি গুলোর রহস্য কি?”

(যারা পাখির ধাঁধা বোঝেনি তাদের জন্য আজ এই অংশটুকু বারিয়ে লিখছি। আশাকরি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।)

নীলার প্রশ্নে ধ্রুব এক ঝলক আরশির দিকে তাকালো। স্মিত হেসে বলল-

“হুমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাসের বই আছে ‘আঙুল কাটা জগলু’ সেখানেই একটা চিঠিতে সাংকেতিক ভাষায় এই ধাঁধাটা ছিল। একটা পাখি মানে একটা অক্ষর, চারটা পাখি মানে চারটা অক্ষর আর তিনটা পাখি মানে তিনটা অক্ষন। যার মানে দাঁড়ায় i love you.”

ধ্রুবর কথা শুনে সবার চেহারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। নীল ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম হতাশা নিয়ে আফসোসের সহিত বলল-

“আমাদের সামনে হাসতে হাসতে আশুরে আই লাভ ইউ বইল্লা গেলো আর আমরা কি-না কিছুই বুঝতে পারলাম না!! বলদের মতো আকাশের দিকে তাকাইয়া কি আমরা সবাই তাহলে ভালোবাসা খুঁজতাছিলাম!! মানে কি বলমু আমি। ইচ্ছা করতাছে পানি দিয়ে এইসব উপন্যাসের বই চুবাইয়া চুবাইয়া খাই। মানে ভাই ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এহন পাখি গুলারেও ছাড় দিলো না লেখকরা?? এহন যদি কোনো মাইয়া আইসা আমারে বলতো ‘নীল একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি’ তখন কি হইতো?? আমি তো জীবনেও বুঝতাম না যে মাইয়া আমারে ভালোবাসার কথা কইছে। দেখা যাইতো মাইয়া আমার উত্তর না পাইয়া শেষমেশ বাচ্চা পোলাপান হইয়া সংসারও কইরা ফেলছে। আর আমি এই সব পাখি নিয়াই বইসা থাকতাম।”

নীলের ভাষা পালটে যাওয়া বলে দিচ্ছে সে এখন হতাশার গভীর অতলে গহ্বরে ডুবেছে। নিজের বোকামীতে সে এখন নিজের উপর ভয়াবহ ক্ষিপ্ত। নীলের কথায় আরশি আর ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলেও বাকি সবার মুখে এখনো উদাসীনতা।

——————————

“দোস্ত যাই রে।”

কাসফিয়া আর আদ্রাফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার ডান পাশের মোড়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলো সুপ্তি। কাসফিয়া আর আদ্রাফ কিছুক্ষন স্থির চোখে চেয়ে রইলো। আদ্রাফ একটা রিকশা থামিয়ে বলল-

“উঠে বস।”

কাসফিয়া মিহি কন্ঠে বলল-

“আমি একা যেতে পারবো তুই রিকশা নিয়ে চলে যা।”

“এত বেশি কথা বলছিস কেন? যা বলেছি তা কর। চুপচাপ রিকশায় উঠে বস। আমি তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই আম্মুর কাছে যাবো অফিসে।”

আদ্রাফের কাঠ কাঠ গলার স্বর শুনে কাসফিয়া কিছু বলল না। বিনাবাক্য ব্যয়ে রিকশায় উঠে বসলো। আদ্রাফ আর কাসফিয়া পাশাপাশি বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, হাসি নেই। নেই আগের মতো কোনো অনুভূতি। আদ্রাফ নির্বিকার স্বাভাবিক থাকলেও কাসিফয়ার মনে চলছে যুদ্ধ। অসহ্য তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পরছে পুরো বুক জুড়ে। কেন হলো এমনটা তার সাথে? কিসের জন্য তাদের মাঝে বিচ্ছেদ হয়েছে! তার বিয়ের জন্য! অন্য কারো ভাগ্যে তার নাম লিখা ছিল তাই? যদি তাই-ই হয়ে থাকে তাহলে কেন আজ সেই বিয়েটা ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গেছে!! কেন অপেক্ষা করতে হচ্ছে ডিভোর্স পেপারের জন্য!! এ কেমন নিয়তির নির্মম পরিহাস! না পেলো ভালোবাসার মানুষকে আর না পেলো স্বামী-সংসার। যার জন্য বিয়েতে রাজি হয়েছিলো শেষে কি-না সেই মানুষটাও তাকে এতিম করে দিয়ে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন তো হয়নি যখন আদ্রাফ আর সে রিকশা ঘুরে পুরো শহর চুষে বেরিয়েছে। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি নদীর তীর ধরে হেঁটেছে। হাস্যজ্বল প্রেমিকার মতো আদ্রাফের কাছে নানান রকম বায়না করেছে। কি সুন্দর ছিলো সেই প্রথম প্রেমের গল্পটা। আর আজ যেন তাদের গল্পটা একদমই ভিন্ন। গল্পের চরিত্র গুলোর মাঝে আকাশ-পাতাল সমান দুরত্ব। কিন্তু আদ্রাফ কেন এখনো আগের মতোই তার কেয়ার করে! এমনটা হওয়া উচিত না। তাকে তো কিছুদিন পরেই ডিভোর্সি মেয়ে হিসেবে গন্য করা হবে। কাসফিয়া মনে মনে নানানরকম জল্পনাকল্পনা করে নিজেকে শক্ত করে তুললো।

“তুই এমন কেন করছিস আদ্রাফ! আগের সব কিছু ভুলে যা। অতীত আঁকড়ে ধরে বসে থাকিস না। তোর পুরোটা জীবন সামনে পরে আছে।”

কাসফিয়ার কথায় আদ্রাফের মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। আগের মতোই নির্লিপ্ততা দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। দৃষ্টি সামনের ব্যস্ত রাস্তায় রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বলল-

“আমার লাইফে আমি কি করবো না করবো সেটা নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে কাসফি। আমার ভালোটা আমি বুঝে নিবো। আগে নিজের ভালোটা না বুঝলেও এখন খুব বুঝতে পারি।”

———————————

“আমি কি আরুকে কিছুক্ষণের জন্য ধার নিতে পারি!!”

রৌদ্রর কন্ঠস্বর শুনে আরশি সহ সবাই পেছন ফিরে তাকালো। রৌদ্র দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মনকাড়া হাসি ঝুলে আছে। বাতাসে কৃষ্ণচূড়া গাছের ঝিরিঝিরি পাতা গুলো বৃষ্টির মতো ঝরে পরছে। আরশি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। ধ্রুব বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ রৌদ্রর দিকে চেয়ে খানিকটা আদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল-

“ধার দিবো ঠিক আছে কিন্তু একটা শর্তে। ওকে যেভাবে নিয়ে যাবেন ঠিক সেভাবেই আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। আমার শর্ত না মানলে কি হবে তা তো খুব ভালো করেই জানেন।”

রৌদ্র মুচকি হেসে বলল-

“সব কিছুতেই শর্ত!! যাইহোক ভয় নেই আমি আমার শর্ত মানতে রাজি। আরু চলো আমার সাথে।”

রৌদ্র শেষের কথাটা আরশির দিকে চেয়ে বলল। আরশি এখনো বসে আছে। রৌদ্রর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই আরশি উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে রৌদ্রর দিকে এগিয়ে গেল। রৌদ্র সবার দিকে চেয়ে হাসি দিয়ে বলল-

“আমরা আসছি। চিন্তা করো না কেউ।”

রৌদ্র চলে যাচ্ছে আরশিকে নিয়ে। নীল ওরা নিজেদের বিস্ময় কাটিয়ে চেচিয়ে উঠলো-

“রৌদ্র ভাই শুনুন।”

রৌদ্র বিস্মিত হয়ে পেছন ফিরে তাকালো। আদ্রাফ, নীল সহ সবাই বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একসঙ্গে চেচিয়ে বলে উঠলো,

“একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি রৌদ্র ভাই।”

সবাই একসাথেই দু-হাত মিলিয়ে লাভ সেপ করে রৌদ্রকে দেখালো। ধ্রুব মিটমিটিয়ে হাসছে সবার কান্ড দেখে। রৌদ্র হকচকিয়ে উঠছে। অপ্রস্তুত হয়ে একবার আরশির দিকে আরেকবার আদ্রাফদের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেমানুষ হয়েও এই মুহূর্তে ভয়ংকর লজ্জায় তার মুখের রঙ পালটে যেতে শুরু করেছে। অস্থির হয়ে আশেপাশে নজর দিলো। ভার্সিটির অল্প কিছু মানুষ তাদের দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র আরেক মুহুর্তে দেরি না হড়বড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। আরশি ধ্রুবদের তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে রৌদ্রর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“মিস আরু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।”

রৌদ্রর গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে আরশি নিজেকে সামলিয়ে নেয়। নাক ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল-

“কি ঠিক হচ্ছে না!”

“সেই কখন থেকে ঠোঁট চেপে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছো। আর এখন আমাকেই জিজ্ঞেস করছো কি ঠিক হচ্ছে না!!”

রৌদ্রর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরশি শব্দ করে হেসে ফেলে। খুব কষ্টে এইটুকু সময় নিজের হাসিটাকে কন্ট্রোল করে রেখেছিল আরশি। কিন্তু শেষমেশ আর সম্ভব হলো না। রৌদ্র হতাশ চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-

“অদ্ভুত! পাগলের মতো এভাবে হাসছো কেন!”

আরশি হাসি থামিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিলো। হাসার ফলে চোখের কোণে পানি জমে গেছে। ক্লান্ত গলায় বলল-

” আপনার লাজুক চেহারাটার কথা ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছে রোদ। নিজের ফাঁদেই পা দিয়েছেন আপনি।”

আরশি আবারও হাসছে। রৌদ্র বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে তার রুদ্রাণীর দিকে। আরশি নিজের অজান্তেই রৌদ্রকে ‘রোদ’ বলে সম্মোধন করেছে। আরশির মুখে প্রথম নিজের নাম শুনে রৌদ্র পুরো মন জুড়ে ভালো লাগার স্রোত ভয়ে গেল। মুগ্ধ চোখে আরশির হাসি দেখছে। এই হাসির খিলখিল শব্দেই তো সে তার রুদ্রাণীকে পেয়েছে। রৌদ্রর মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার রুদ্রাণীর কথা ভেবে।

—————————

পুরনো ব্রিজের উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র আর রুদ্রাণী। মাঝখানে হাত দুয়েক দূরত্ব। দুজনেই চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। বাতাসের ঝাপটায় গাছের পাতা গুলো নেড়েচেড়ে উঠলেই একমুঠো রোদ এসে উঁকি দিচ্ছে আরশি মুখের উপর। রোদের উজ্জ্বল আলোয় তার চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে আসে। কখনো আবার হাত উঁচু করে চোখ দুটোকে আড়াল করে ফেলে। খানিকটা বিরক্তবোধ করছে। তবুও স্থির দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। রৌদ্র আড়চোখে তার রুদ্রাণীর প্রতিটি ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করছে। আরশির শ্যামবর্ণা গাল দুটো রোদের আলোয় হাল্কা লালআভা হয়ে আছে। উন্মুক্ত করে রাখা চুলগুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। যার কারণে আরশির বিরক্তির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বেড়ে চলছে। আচমকাই আরশি রৌদ্র দিকে ফিরে তাকালো। ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-

“এখানে কি আমাকে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য এনেছেন!!”

রৌদ্র হাসলো। সে তো এটাই চাচ্ছিলো তার রুদ্রাণী যেন আগে কথা বলা শুরু করে। রৌদ্র ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল-

“দরকার পরলে তা-ই করবো। কাকতাড়ুয়া বানিয়ে সারাক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবো আমার সামনে। তোমার কোনো আপত্তি আছে!!”

রৌদ্রর রসিকতায় আরশির রাগ হলো। চোখমুখ শক্ত করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“এই মুহুর্তে আপনার এসব রসিকতার কথা শোনার মুড আমার মোটেও নেই। শুধু শুধু রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কেন আমাকে?”

“তুমি কিছুটা ফর্সা হয়ে যাচ্ছো তাই ভাবলাম রোদে পুড়িয়ে আগের মতো শ্যামলতা বানাবো তোমাকে।”

আরশির ভ্রু কুঞ্চিত করে রৌদ্র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। রৌদ্র কি তার সাথে মজা করছে?? এসব রসিকতা করার জন্য সবার সামনে থেকে নিয়ে এসেছে তাকে?? আরশির কন্ঠস্বরকে গম্ভীর করে বলল-

“আপনি থাকুন আপনার রসিকতা নিয়ে আমি যাচ্ছি।”

আরশি পা বাড়ালো। রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিয়েই রৌদ্র তার হাত ধরে ফেলে। আরশি ঘাড় বাকিয়ে তাকালো রৌদ্রর হাসিমাখা মুখটার দিকে।

“অনেক তো হয়েছে রাগ-অভিমান, ঝগড়াঝাটি। চলো না এবার একে অপরকে একটুক্ষানি ভালোবাসি। সকল অস্বস্তি জড়তা ভুলে এবার না হয় দু’জন দু’জনার প্রেমে পরি। খুব কি ক্ষতি হবে রুদ্রাণী! খুব বেশিই কি লজ্জা পাবে তুমি??”

আরশির রাগ ফুস করে যেন কোথাও উধাও হয়ে গেল। রৌদ্র কথায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। চারদিক থেকে ভয়াবহ লজ্জায় আঁকড়ে ধরেছে তাকে। লজ্জারুণ চেহারায় মাথা নিচু করে অস্বস্তিতে ঘনঘন চোখে ঝাপটাচ্ছে। রৌদ্রর হাতের মুঠোয় তার হাত বন্দী থাকায় হয়তো হাত কচলানোর সুযোগ পাচ্ছে না। হাত ছাড়ানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিটুকুও এখন নিজের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না। রৌদ্রর কথার প্রতিত্তোরে তার কি বলা উচিত তা নিয়ে ভাবছে। নিজের সবটুকু বুদ্ধি দিয়ে ভেবেও কোনো জবাব খুঁজে পেল না। অসহায় হলো তার মস্তিষ্ক। রৌদ্র আরশির অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো। খানিকক্ষণ সময় পার হতেই নরম গলায় আরশিকে ডাক দিলো,

“আরু!!”

আরশি মাথা তুলল তাকালো। ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু করে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো রৌদ্র শান্ত শীতল চোখ দুটোতে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মনকাড়া হাসি। রৌদ্রকে কিছু বলতে না দেখে আরশি আবারও তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রৌদ্র শীতল কন্ঠে থেমে থেমে বলল-

“এই যে, শোনো না রুদ্রাণী!! ভালোবাসি তোমায়। ভীষণ ভালোবাসি।”

আরশি থমকালো। হার্টবিট মনে হচ্ছে কয়েকটা মিস হয়ে গেল বোধহয়। নিঃশ্বাস যেন গলাতেই আটকে আসছে। অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব করলো রৌদ্রর কথা বলার ভঙ্গিতে। রৌদ্র কি ভালোবাসি বলেছে না-কি তার ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা চেয়ে আবদার করেছে!! অনুরোধ করছে!! রৌদ্রর হাতের মুঠো শক্ত হলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে আরশির ডান হাত। বরাবরের মতোই শীতল কন্ঠে বলল-

“অদেখা ভাবে ভালোবেসেছি তোমাকে। তুমি কে! দেখতে কেমন! কোনো কিছু না জেনেশুনেই মন দিয়ে ফেলেছি তোমাকে। শুধু তোমার কন্ঠস্বর আর হাসির শব্দ শুনেই মুগ্ধ হয়েছি তোমাতে। তোমার এই হাত কখনো ছাড়বো না। শুধু একবার তোমার রোদকে মেনে নাও। সারাজীবনের জন্য তোমার রোদ হয়েই থাকবো। আমার সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসবো। আগলে রাখবো। তার বিনিময়ে জাস্ট একটুক্ষানি ভালোবাসা দিলেই হবে।”

আরশি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দৃষ্টিতে দেখছে। রৌদ্রকে ঝাপসা মনে হচ্ছে। তার চোখ দুটো ভিজে আসছে। কিন্তু কেন!! ভালোবাসা পাওয়ার সুখে না-কি অন্য কিছু! রৌদ্রর ফোন বেজে উঠেছে। আরশির হাত ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন করে সামনে আনলো। রিসিভ করে ছোট করে বলল-

“ব্রিজের এখানেই আছি।”

ফোন কেটে আবারও পকেটে খুঁজে রাখলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নির্বানের বাইক এসে ব্রিজের সামনে থামলো। মাথা থেকে হেলমেট খুলে আরশিকে দেখেই মুচকি হাসলো। হাতে করে দুটো বড় বড় পার্সেল জাতীয় কিছু এনে একটা রৌদ্রর কাছে দিয়ে বলল-

“এই নে তোর জিনিস।”

রৌদ্র পার্সেলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। আরশি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কিছু বলে উঠবে তার আগেই নির্বান আরশির সামনে হাটু গেড়ে বসলো। নির্বানের কাজে আরশি হকচকিয়ে উঠেছে। খানিকটা পেছন গিয়ে বিস্মিত চোখে নির্বানের দিকে তাকালো। নির্বানের মুখে অদ্ভুত সুন্দর হাসি। কোকরা চুলগুলো এলোমেলো। নীল রঙের শার্ট গায়ে জড়ানো। সুদর্শন এক যুবক। নির্বান পার্সেলটা আরশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-

“প্রথম যেদিন তোমাকে ওই ছেলে গুলোকে ঝাড়তে দেখছিলাম। সেদিনই মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মতো বাঘিনী দেখে কেউ মুগ্ধ না হয়ে থাকতেই পারবে না। যখন রৌদ্রকে ধুয়ে দিলে তখনই আরেক দফা ক্রাশ খেয়েছি তোমার। প্লিজ বোন আমার বাঘিনী থেকে এবার আমার ক্রাশ ভাবি হয়ে যাও৷ তুমি বললে আমার বন্ধুটা তোমার জন্য বাঘ থেকে বিড়াল হতেও রাজি। এই নাও এইটা তোমার জন্য ক্রাশ ভাবি।”

আরশি হতভম্ব। সেই সাথে রৌদ্র নিজেও। নির্বান এমন উদ্ভট কাজ করবে সেটা রৌদ্র জানতো না। নির্বান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আরশির হাতে পার্সেলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল-

“তাড়াতাড়ি খুলে দেখো। আমার যেতে হবে।”

আরশি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নির্বানের কর্মকান্ড সব তার মাথার দশ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে। নির্বানের তাড়া দেওয়ায় আরশি পার্সেলটা খুলল। একটা ছবির ফ্রেম। বেশ বড় ফ্রেম। ছবিতে রৌদ্রর এক পাশ দেখা যাচ্ছে। রৌদ্রর দৃষ্টি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক সবুজ রঙের শাড়ি পড়া রমনীর দিকে। সেটা আর কেউ নয় আরশি নিজেই। সেই পূর্নিমা রাতের-ই ছবি এটা।

“ছবি তোলা আমার শখের একটা কাজ। দুষ্টুমি করে রৌদ্রর ছবি তুলে ছিলাম। তার মাঝে যে তুমিও এসে পরবে জানা ছিলো না। ঠিক তখনই রৌদ্র আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে তোমার ছবি তুলেছিলো। আমি কিছুদিন আগে ছবি গুলো দেখতে গিয়েই খেয়াল করলাম রৌদ্রর ছবির মধ্যে তোমাকেও দেখা যাচ্ছে। রৌদ্রকে বলিনি ছবিটার কথা। ভেবেছিলাম এই ছবিটা আমি তোমাকে দিবো৷ যাইহোক এখন আমি আসি। আর রৌদ্র সরি ছবিটা তোকে এই ক’দিন দেখাইনি তাই।”

নির্বান একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই হড়বড়িয়ে চলে গেলো। আরশি আর রৌদ্র দুজনেই নির্বানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নির্বানের বাইক দৃষ্টির বাহিরে যেতেই দু’জন একই সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেশ কিছুটা সময় পর আরশি মিহি কন্ঠে বলল-

“এখন আমাদের যাওয়া উচিত। অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেছে।”

রৌদ্র আরশির দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল-

“তুমি যাও আমি এগুলো নিয়ে আসছি।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো৷ রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা দূর যেতেই অভ্যাসগত কারণে থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ রৌদ্র তাকে ডাক দিচ্ছে না। কিন্তু কেন!! আরশি কৌতূহলি হয়ে পেছন ফিরে তাকালো। রৌদ্র মুচকি হেসে ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।

“আমি তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছি তাই না রুদ্রাণী!!”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে মিনমিনিয়ে বলল-

“না মানে সব সময় আমাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে দেন তো…”

আরশিকে থামিয়ে দিয়েই রৌদ্র বলল-

“মে আই!!”

আরশি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো রৌদ্র দিকে। মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রৌদ্র আরশি জড়িয়ে ধরলো। আরশি হতভম্ব। মুর্তির ন্যায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে করে তার হাত দুটো আপনা-আপনি-ই রৌদ্র পিঠে চলে গেল। রৌদ্র আরশিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-

“আজ থেকে তুমি আমার। রুদ্রাণী শুধু মাত্র তার রৌদ্রর। তুমি আমার। শুধু এবং শুধুই আমার রুদ্রাণী।”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat

আরশি বিদ্যুৎ ঝাটকা খাওয়ার মতো ছিটকে রৌদ্র থেকে দূরে সরে আসলো। অপ্রস্তুত হয়ে এলোমেলো হাতে ব্যাগের ভেতর ফোন খুঁজতে লাগলো। ফোন বেজেই চলছে। ফোন হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করল-

“আদ্রলিকা কোথায় তুই? টাইম দেখেছিস ক’টা বাজে! তিনটা বেজে যাচ্ছে।”

ধ্রুবর তেজি কন্ঠে আরশি ইতস্তত করে বলল-

“দশ মিনিটের মধ্যেই আমি আসছি।”

ধ্রুব কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। অস্বস্তিবোধ করছে তার। কি বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না। তার আদরে বড় হওয়া মেয়েটা আজ ভালোবাসার মানুষ পেয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই কত ছোট ছিলো। স্কুলের ছেলেরা কিছু বললেই কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে এসে বিচার দিতো। দিন যাচ্ছে। মেয়েটা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। ভালোবাসতে শিখে গেছে। ভালোবাসার মানুষের সাথে একান্ত কিছু মুহুর্তে কাটাতে শুরু করেছে। এখন তার সেই ছোট্ট আদ্রলিকা নেই। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরশি আর ধ্রুব দুজনেই চুপচাপ। কয়েক মিনিট পেরুতেই ধ্রুব নিরবতা ভাঙে শান্ত গলায় বলল-

“সাবধানে আসিস আদ্রলিকা।”

আরশি মিহি কন্ঠে পর পর দুবার ‘হুম হুম’ বলতেই কল ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ধ্রুব ফোন রেখে দিয়েছে। আরশি কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্র অপলক তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। ছোট্ট করে জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল-

“ধ্রুব চিন্তা করছে হয়তো। চলো এবার যাওয়া যাক।”

আরশি মাথা ঝাকিয়ে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে। কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই লজ্জায় বার বার নুয়ে যাচ্ছে। লজ্জাবতী গাছের মতো গুটিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্র আরশিকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।

—————————

“এই নাও তোমার আমানত।”

দুপুরের শেষ৷ শান্ত শীতল সূর্যটা আলস ভঙ্গিতে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। পুরো ভার্সিটি ফাঁকা। আশেপাশে বড়জোর চার-পাঁচজন স্টুডেন্ট পাওয়া যাবে। ক্লাস শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ধ্রুব একা একা বসে আছে ভার্সিটির পেছন দিকটায়। রৌদ্রর গলার স্বর শুনে ধ্রুব মাথা তুলে পাশ ফিরে তাকালো। রৌদ্র আর আরশি দাঁড়িয়ে আছে। সে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পকেটে ফোন রেখে ক্লান্তিমাখা ভঙ্গিতে বলল-

“সেই কখন থেকে একা একা বসে অপেক্ষা করছি। সেদিকে কি কোনো খেয়াল আছে আপনাদের!”

আরশি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ধ্রুব পাশে এসে দাঁড়ালো৷ ধ্রুব ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে৷ রৌদ্র গলা খেকরিয়ে বিনয়ের ভঙ্গিতে বলল-

“দেরি করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু নির্বান আসতে দেরি করেছিল তাই তোমাকে অপেক্ষা করাতে হয়েছে।”

ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল-

“আচ্ছা তাহলে এখন যাচ্ছি। চল আরু।”

ধ্রুব আরশির হাত ধরে হাঁটা শুরু করবে তখনই রৌদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল-

“এই গুলো নিয়ে যাও।”

ধ্রুব কৌতুহলী চোখে তাকালো রৌদ্র দিকে। রৌদ্র পার্সেল দুটো ধ্রুবর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ধ্রুব ভ্রু কুঞ্চিত করলো। চোখ ছোট ছোট করে পার্সেলের দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“এইগুলো কি?”

“আরুর গিফট। একটা নির্বান দিয়েছে আর অন্য আমার পক্ষ থেকে। বাসায় যেয়ে দেখো এখন না।”

——————————

“কেমন আছিস? আন্টি কেমন আছেন?”

আদ্রফের প্রশ্নে কাসফিয়া নরম গলায় বলল-

“হুম ভালো আছে। তোদের কি খবর? আন্টি কি করছে?”

“এই তো ভালো। আম্মুকে নিয়ে কিছুক্ষন আগেই অফিস থেকে আসলাম।”

আদ্রাফের কথায় কাসফিয়া ছোট করে ‘অহহ’ বলে চুপ করে রইলো। আদ্রাফ নিরবতা ভাঙে বলল-

“তোদের ব্যবসার কি অবস্থা?”

“আম্মু আর ছোট মামা মিলে সামলাচ্ছে। যাইহোক হঠাৎ করে ফোন করলি যে! কোনো দরকার ছিলো?”

কাসফিয়ার কথায় খানিকটা অপমানবোধ করলো। এখন কি তাকে কথা বলার জন্যেও কারণ দেখাতে হবে? কাসফিয়ার কাছে সে এতটাই পর গেছে!! আদ্রাফ রাগে কঠিন গলায় বলল-

“এখন কি কল করার জন্যেও তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে?? আমাদের সম্পর্কটা কি তোর কাছে এতটাই তুচ্ছ হয়ে উঠেছে কাসফি! আমি মানছি আগের মতো আমাদের সম্পর্ক নেই। কিন্তু একজন কাছের বন্ধু হিসেবে তো খোঁজখবর নিতেই পারি। যেমনটা আমাদের সম্পর্ক হওয়ার আগে ছিলো সেভাবে তো থাকতেই পারি আমরা।”

কাসফিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। ফোন নিয়ে বারান্দায় এসে নিম্নস্বরে বলল-

“আমি কৈফিয়ত চাইনি আদ্রাফ। তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।”

আদ্রাফ কিছু বলার আগেই তার মা এসে রুমে উপস্থিত হলেন। আদ্রাফের কাছে এসে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কার সাথে কথা বলছে। আদ্রাফ স্বাভাবিক ভাবেই বলল-

“কাসফির সাথে।”

আদ্রাফের আম্মু হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললেন-

“দে আমার কাছে। অনেকদিন হলো মেয়েটার সাথে কথা হয়না।”

আদ্রাফ বিনাবাক্য ব্যয়ে তার মা’র দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। উনি ফোন হাতে নিয়েই অভিমানী কন্ঠে কথা বলা শুরু করলেন-

“কেমন আছিস রে মা? আমাকে তো ভুলেই গেছিস। আগের মতো তোরা কেউ-ই এখন বাসায় আসিস না।”

আদ্রাফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে তার মা’কে। তাদের সম্পর্ক এমন না হলেও পারতো। ভিন্ন হতে পারতো তাদের গল্পটা। একটু চুপ করে থাকার ফলে আজ সব কিছুই লন্ডবন্ড হয়ে গেল। যাকে ভালো রাখার জন্য চুপ করে ছিল তার জীবনটাই এখন বিষাদে ছেয়ে গেছে। আদ্রাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল- “বাকিটা জীবন আর চুপ করে থাকবো না। লড়াই করবো। ভালো থাকা আর ভালো রাখার লড়াই।”

————————————

“আরু একটু বারান্দায় আসবে?”

ফোন রিসিভ করতেই রৌদ্রর আকুতিভরা কন্ঠ ভেসে আসলো। আরশি অবাক হলো। ধরফরিয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসে। বিস্মিত হয়ে চোখ গোলগোল করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। আটটা বেজে দশ মিনিট। এই সময় হুট করে এই কথা বলার কি মানে!

“আরু শুনছো!! প্লিজ একটু বারান্দায় আসো।”

আরশি শুকনো ঢোক গিলে থমথমে গলায় প্রশ্ন করে,

“কিন্তু এই সময় বারান্দায় কেন?”

“তুমি আসো তারপর বলছি।”

আরশি থমথমে পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশ অন্ধকার। রাস্তার পাশের লাইটটা নষ্ট তাই অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই অন্ধকার মনে হচ্ছে। আরশি বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাস্তায় নজর বুলিয়ে নেয়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করলো,

“বারান্দায় কেন আসতে বলেছেন??”

আরশির প্রশ্নের সাথে সাথেই নির্বানের বাইক এসে থামলো। নির্বানের পেছন থেকে রৌদ্র নেমে এসে আরশির বারান্দা বরাবর দাঁড়ালো। বাইকের হেডলাইটের আলোয় পুরো রাস্তা আলোকিত হয়ে আছে। রৌদ্র তৃষ্ণার্তা চোখে আরশির দিকে চেয়ে বলল-

“দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে তাই চলে আসলাম।”

আরশি হতভম্ব। বাকরুদ্ধ। বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। পর পর কয়েক বার চোখের পাতা ঝাপটিয়ে আবারও তাকালো। রৌদ্রর এক হাত পকেটে গুজে রাখা। অন্য হাতে ফোন ধরে রেখেছে। হাসি হাসি মুখ নিয়ে স্থির চেয়ে আছে তার দিকে। আরশি আমতা-আমতা করে বলল-

“আপনি মানে আপনারা কি করছেন এখানে? কেউ দেখে ফেললে!”

রৌদ্র হাসলো। আরশির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই নির্বান হেলমেট খুলে রৌদ্র পাশে এসে দাঁড়ালো। চুল গুলো ঠিক করে। হাত নাড়িয়ে আহ্লাদে গদগদ করে উচ্চ গলায় বলল-

“হাই ক্রাশ ভাবি। কেমন আ…….”

রৌদ্র ঝট করে নির্বানের মুখ চেপে ধরে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে চাপা কন্ঠে বলল-

“কি করছিস কি তুই নির্বান! শা’লা তোর কি পুরো মাথা গেছে নাকি! এভাবে চেচাচ্ছিস কেন? এলাকার মানুষ দিয়ে মার খাওয়ার ইচ্ছে জেগেছে তোর!”

আরশির অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে। নির্বানের কাজে অস্থিরতার সঙ্গে বার বার আশেপাশে তাকাচ্ছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। তার বাবা, ভাই, ধ্রুব সবাই বাসায় আছে। যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে আজকেই তার প্রেম শহীদ হবে।
নির্বান অনেক চেষ্টার পর রৌদ্রর হাত মুখ থেকে সরালো। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে আহত গলায় বলল-

“তোর প্রেমে সাহায্য করতে এসেছিলাম। আর দেখছি তুই আমাকেই শ্বাসরুদ্ধ করে মারার প্ল্যান করছিস। উফফ একটুর জন্য বেঁচে গেছি।”

“তুই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে চেচামেচি করছিস কেন?”

রৌদ্রর রাগী কন্ঠকে নির্বান পাত্তা দিলো না। উত্তেজিত হয়ে আবেগী কন্ঠে বলল-

“ক্রাশ ভাবিকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তো ইচ্ছে করছে খুশিতে এইখানে ডান্স শুরু করে দেই।”

নির্বানের কথা শুনে রৌদ্র সরু চোখে তার দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“প্রেম কি আমি করছি নাকি তুই! তোকে তো দেখে মনে হচ্ছে তুই প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে পাগল প্রেমিক হয়ে গেছিস।”

“ধুর শা’লা। তুই কি বুঝবি আমার অনুভূতি। বন্ধু প্রেম দেখা তো নিজের প্রেমের থেকেও বেশি আনন্দের। আর বন্ধু যদি হয় তোর মতো তাহলে তো খুশিতে আত্মহারা হওয়ারই কথা।”

রৌদ্র ভ্রু কুচকালো। ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল নির্বানের দিকে-

“আমার মতো মানে কি!”

“তোর মতো নিরামিষ আর গম্ভীর মানুষ কোনো মেয়ের প্রেমে পরতে এটা তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর আমার ভাবিকে যে কত সাধনার পর পাওয়া হলো সেটা তো আমি আর তুই জানি।”

চলবে..