রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
401

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“যা হয়েছে আমার জন্য হয়েছে এখানে সিনিয়রের কোনো দোষ নেই ধ্রুব। বরং আমার জন্যই প্রথম থেকে ওনার সাথে ওই বদমাশ ছেলেগুলোর ঝামেলা হচ্ছে। তুই ওনাকে ভুল বুঝছিস।”

আরশির বেশ নম্রতা সহকারে ধ্রুবর উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলল। ধ্রুব শান্ত চাহনিতে আরশির কথা গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। ছোট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“আচ্ছা তোর কথাই মানলাম। কিন্তু এই ছেলে তোকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলো কেন? আর তুই-ই বা কোন বিশ্বাসে ছেলেটার সাথে ডেং ডেং করে নাচতে নাচতে চলে গেলি!”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। ধ্রুবর কথা শুনেই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো বিকেলের কথা মনে পরে গেল। হাই স্পিডে মাথার মধ্যে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু’ কথাটা চরকির ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। আরশির ভাবনা অসহায় হলো। নিরুত্তর এলোমেলো মন নিয়ে থমকে বসে রইলো সে। কোনো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না কথাটা কি রৌদ্র সত্যি সত্যিই বলেছে নাকি সে নিজেই ভুল শুনেছে।

“চুপ করে আছিস কেন উত্তর দে।”

ধ্রুবর গাম্ভীর্যপূর্ন কথায় আরশির হুশ ফিরলো। কিছুটা নেড়েচেড়ে বসে আমতা-আমতা করে বলল-

“আসলে সিনিয়রের কি যেন দরকার ছিলো তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই তো ঝামেলা হয়ে গেল। আসলে সিনিয়র তো এতোদিন আমাদের অনেক হেল্প করেছে তাই ওনাকে সরাসরি না করতে পারিনি যাওয়ার জন্য।”

ধ্রুব চোখে ছোট করে তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। শাসনের সুরে বলল-

“তুই একটা মেয়ে। যথেষ্ট বড়ও হয়েছিস। নিজেকে কিভাবে সেফ রাখবি তার দায়িত্ব তোর নিজের উপর। আমাদের দেশে মেয়েদের অবস্থা আশাকরি তোর অজানা নয়। আজ পর্যন্ত আমি কখনো তোকে একা চলাফেরা করতে দেইনি। এই কয়দিন একা ছেড়েছি তাই বলে এই না যে তুই মুক্ত পাখির মুখে উড়ে বেড়াবি। তুই নিজেকে মুক্ত পাখি ভাবলেও আমাদের এই দেশ কোনো খোলা আকাশ নয়। এই শহরে প্রতিটা অলিগলিতে কিছু হায়নার দল থাকে। তুই নিজেও আজ সেই নিকৃষ্ট মানুষদের মুখোমুখি হয়েছিস। তোকে নিয়ে আমাদের সকলেরই ভয়। তোর হাতের এই টুকু ব্যথায় সকলের কি অবস্থা হয়েছে তা তুই নিজের চোখের দেখেছিস। ছোট মা যদি সত্যি কথা জানতো তাহলে তোকে ঘরেই বসিয়ে রাখতো।”

আরশি চুপ করে ধ্রুবর কথা শুনছে। ধ্রুব খানিকক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় আবারও বলে উঠলো-

“আচ্ছা যাইহোক। এখন বস আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। খেয়ে তারপর ঘুমাবি।”

ধ্রুব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার অপর পাশের ছোট টেবিলের উপর থেকে ওষুধ আর পানি নিয়ে এসে আরশির দিকে এগিয়ে দিলো। আরশি নিঃশব্দে ওষুধ আর পানি হাতে নিয়ে খেয়ে নিলো। ধ্রুব আরশির হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে বলল-

“এখন শুয়ে পর। আমি আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করে আসছি।”

আরশি খানিকটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“আসছি মানে! তুই আমাদের বাসায় থাকবি আজ!”

ধ্রুব আরশির কথার জবাব দিলো না। বালিশ ঠিক করে আরশি আলতো করে ধরে শুয়িয়ে দিয়ে বলল-

“মাঝরাতে হাতের ব্যথা বাড়তে পারে। আমি একটু পর পর এসে দেখে যাবো। তবুও যদি বেশি খারাপ লাগে তাহলে আমি ডাক দিস। আমি শাকিলের রুমেই থাকবো। আর হ্যাঁ কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে নিজে না উঠে আমাকে বা অন্য কাউকে ডাক দিলেই হবে। হাত বেশি নাড়াচাড়া করিস না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

আরশি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বাধ্য বাচ্চার মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলল। ধ্রুব আর কোনো কথা বলল না। আরশির মাথা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

——————————

ব্যস্ত ভার্সিটি। চারপাশ স্টুডেন্টদের কথাবার্তা আর হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানুষ। একজনের নির্লিপ্ত চাহনি খুব মুগ্ধ হয়ে অন্যজনের অস্বস্তি হওয়া লক্ষ্য করছে। দু’দিন পর একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে রৌদ্র আর তার রুদ্রাণী উরফে তার না-হওয়া প্রেমিকা। আরশির অস্বস্তির কারণ রৌদ্র খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলে এই মুহুর্তে তাদের মাঝের নিরবতা ভাঙতে চাচ্ছে না। আরশি নিজের অস্বস্তি ভাব কাটিয়ে বড় করে শ্বাস নিলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বিনীত ভঙ্গিতে বলল-

“ওই দিনের জন্য সরি। আমার জন্য আপনাকে ঝামেলায় পরতে হলো। আর তার উপর ধ্রুব কোনো কিছু না বুঝেই আপনাকে ভুল বুঝেছে। ওর হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।”

রৌদ্র তার ভাজ করে রাখা হাতের বাঁধন খুলে দিলো। শার্টের হাতা ঠিক করে আগের মতোই আরশির দিকে তাকালো। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল-

“আচ্ছা ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু অন্যের হয়ে তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো এটা ঠিক মেনে নিতে পারলাম না।”

আরশি খানিকটা অপরাধবোধ অনুভব করলো। সেই সাথে রৌদ্রর গাঁ ছাড়া ভাবে খানিকটা বিরক্তও হলো। আরশি তার দৃষ্টি নামিয়ে মিহি কন্ঠে বলল-

“আসলে আমি…”

“আমি সরি। আপনাকে ভুল বুঝেছি তার জন্য সরি। এখন নিশ্চয়ই মেনে নিতে কোনো অসুবিধে নেই!”

আরশির কথার মাঝেই ধ্রুব পাশ থেকে গম্ভীর গলায় কথা গুলো বলল। রৌদ্র আর আরশি দুজনেই ঘাড় বাকিয়ে ধ্রুব দিকে তাকালো। ধ্রুবর তার গম্ভীর চাহনিতে রৌদ্রর দিকে তাকালো। তার চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল-

“আমি মেনে নিলাম আমার ভুল ছিল। কোনো কিছু না বুঝে আপনাকে ওসব বলা ঠিক হয়নি। সে জন্য আমি দুঃখিত। আশাকরি এখন থেকে আমাদের মধ্যকার সকল ঝামেলার সমাপ্তি এখানেই ঘটবে।”

রৌদ্র কিছু বলছে না। সে আগের মতোই গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে আরশি অসহায় দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকালো। রৌদ্রর এমন ব্যবহার কিছুটা অপমানজনক মনে হচ্ছে আরশির কাছে। ধ্রুবর মুখ গম্ভীর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে পকেটে দু’হাত গুজে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল-

“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাদের ভুলের জন্য মাফ করে দিলাম। এমনিতেও আমি কিছু মনে করিনি।”

“কিন্তু কিছুটা ভুল আপনারও ছিলো।”

ধ্রুবর কথায় আরশি আর রৌদ্র কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকালো। রৌদ্র তার কৌতূহল প্রকাশ না করে গম্ভীর গলায় বলল-

“আমার ভুল!! কি ভুল ছিল সেটা বললে একটু উপকার হতো। জুনিয়রদের কাছেও কিছু শিখে ভুল শুধরে নেওয়ার সৌভাগ্য আর ক’জনেরই বা থাকে!”

রৌদ্র গাঁ জ্বালানো কথায় আরশির শুকনো ঢোক গিললো। ধ্রুব আর রৌদ্রর মধ্যেকার এই শীতল কথা-কাটাকাটির পাঠ চুকে যাওয়ার জন্য মনপ্রাণ থেকে দোয়া করে যাচ্ছে আরশি। তাদের মধ্যের এই চাপা রাগের কারণ আরশি কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছে না। ধ্রুব আগে থেকেই রৌদ্রকে পছন্দ করে না সেটা আরশি জানে। পছন্দ না করার কারণও আছে। ভার্সিটিতে সিনিয়র হিসেবে তার আলাদা ক্ষমতা দেখানো। যেকোনো বিষয়ে সব সময় তার নাক-গলানোর স্বভাব। যদিওবা তার এই কাজ গুলো ভালো জন্যই করা হয়। তবে কিছু কিছু সময় সেটা অনেকেরই তিক্ততার কারণ হয়ে যায়। আগে রৌদ্রকে নিয়ে তার সমস্যা না থাকলেও আরশির সাথে করা রৌদ্রর বাজে ব্যবহার আর ভুল-বোঝাবুঝির পর ধ্রুবর অপছন্দের তালিকায় রৌদ্রর নাম জায়গায় দখল করে ফেলেছে।

“আদ্রলিকাকে আপনার সাথে একা নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। ওখানে আদ্রাফ ওরা অনেকেই ছিলো তাদেরকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া অথবা কোনো দরকার থাকলে তাদের সামনেই বলা উচিত ছিল। এরপর থেকে আদ্রলিকার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবেন অনুরোধ করছি। আমি চাইনা এর পর আদ্রলিকার কোনো ক্ষতি হোক।”

ধ্রুবর কথায় রৌদ্রর চোয়ালে শক্ত হয়ে গেল। চাহনি হলো তীক্ষ্ণ তীরে মতো। তীরের মতোই তীক্ষ্ণ গলায় বললে ফেলল অসহনীয় কিছু অনুচিত কথা। যা হয়তোবা বলা উচিত ছিলো না।

“যাক তাহলে সিনিয়র হয়ে জুনিয়রদের কাছে প্রেমিকাকে কিভাবে আগলে রাখতে তা শিখে ফেললাম। তবে ভবিষ্যতে কাজে আসবে কি-না জানিনা। যাইহোক ওইদিন যেভাবে হুমকি দিলে তারপর আর মনে হচ্ছে না তুমি থাকতে তোমার প্রেমিকার কোনো ক্ষতি হবে।”

রৌদ্রর তাচ্ছিল্য ভরা কথা গুলো বলতে দেরি হলো তবে ধ্রুবর রাগ তরতর করে মাথায় উঠতে দেরি হলো না। শান্তশিষ্ট স্বভাবের ধ্রুব এবার তীব্র রাগে ভয়ংকর হয়ে উঠলো। আরশি কোনো কিছু ভেবে ওঠার আগেই ধ্রুব তেড়ে এসে রৌদ্র শার্টের কলার নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো। রাগে জ্বলজ্বল করে ওঠা চোখ দুটোর দৃষ্টি রৌদ্র নির্বিকার তাচ্ছিল্য ঘেরা চোখ দুটো রাখলো। রাগে ফুসতে ফুসতে চাপা কন্ঠে বলল-

“আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আরেকটা আজেবাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। আপনার নিকৃষ্টতর মানসিকতা আপনার কাছেই রাখুন। আপনার এই নিচুস্তরের মনমানসিকতা দিয়ে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রকার মন্তব্য করার আগে দশবার ভেবে নিবেন।”

আরশি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁক লাগছে৷ কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! আরশি দ্রুত ধ্রুবর হাত ধরে রৌদ্রর থেকে দূরে আনার চেষ্টা করতে করতে উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“ধ্রুব প্লিজ ছাড়ো। কি করছিস এসব? মাথা ঠান্ডা করো। আশেপাশে মানুষ আছে।”

আরশি তুই তুমি সম্মোধন করা নিয়ে কথা গুলিয়ে ফেলছে। উত্তেজনার ফলে ধ্রুবকে পুরোপুরি তুমি করেও বলতে পারছে না। রৌদ্র দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুবর কাজে তার রাগ হচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে বেশ মনোযোগ দিয়ে ধ্রুব আর আরশিকে দেখছে। ধ্রুব রাগান্বিত চোখে আরশির দিকে তাকালো। আরশির আগের মতোই রৌদ্রর কলার থেকে ধ্রুবর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বরাবরই তার কাঁটা হাতের জন্য ব্যর্থ হচ্ছে।

“ধ্রুব প্লিজ প্লিজ।”

আরশি অসহায় কন্ঠে আকুতি মিনতি করে যাচ্ছে। ধ্রুব আরশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আরশির হাতের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই রৌদ্রর কলার ছেড়ে দিয়ে আরশির হাত ধরে বলল-

“ব্যথা পাবি তো। তোকে বলেছিলাম তো এই হাত নাড়াচাড়া করতে না। এখনো তো পুরোপুরি ঘা শুকায়নি। তবুও কেন এই হাতে চাপ দিচ্ছিস?”

রৌদ্রর প্রচন্ডরকম ভাবে চমকালো। এই মুহুর্তে চমকানোই হয়তো তার জন্য স্বাভাবিক ছিলো। রাগান্বিত ধ্রুব হঠাৎ করেই আরশির হাতের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে পরলো। কিছুটা উত্তেজিত হয়েই আরশির হাত উল্টেপাল্টে দেখতে ব্যস্ত হয়েছে। রাগে জ্বলজ্বল করে ওঠা চোখ দুটো মুহুর্তেই আরশির চিন্তায় মগ্ন হয়ে বরফ শীতল হয়ে পরলো। রৌদ্র নামক এই নির্বিকার অস্তিত্বটার উপর কিছুক্ষণ আগেই ধ্রুব নামক মানুষটা ভয়ংকর রেগে ছিল তা ভাবা এইমুহূর্তে খুবই তুচ্ছ একটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। আদোও কি এটা সম্ভব!! ভয়াবহ রাগ কি নিমিষেই বরফশীতল হয়ে যাওয়া সম্ভব!! রৌদ্র ভাবছে। তার খুব করেই জানতে ইচ্ছে করছে ঠিক কি পরিমাণ এই মানুষ তার আদ্রলিকা নিয়ে চিন্তা করে। একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে তাকে নিয়ে সামান্য চিন্তায় সকল রাগ নিমিষেই গায়েব হয়ে যেতে পারে। ঠিক কতটুকু ভালোবাসালেই নিজের সব কিছু বলে তার প্রতি মশগুল হয়ে পরতে পারে। আদোও কি এই মানুষটার ভালোবাসার পরিমান বুঝতে পারা তার সাধ্যের মধ্যে আছে??

“ছাড় আমার হাত। তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আশেপাশে কত মানুষ সেদিকে খেয়াল আছে?”

ধ্রুব ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল। আরশির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল-

“তুই কথার জগাখিচুরি পাকিয়ে ফেলছিস। সেদিকে তোর খেয়াল আছে?”

“খেয়াল রাখতে হবে না চলো এখন।”

আরশি ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাটা বলেই ধ্রুব হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার আগে ধ্রুব রৌদ্রর দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললো-

“আদ্রলিকা আমার প্রেমিকা কিনা তার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে চাচ্ছি না। তবে আদ্রলিকার অভিভাবক হিসেবে ওকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব।”

আরশি টানতে টানতেই ধ্রুবকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। রৌদ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। ধ্রুবর কথার মানেটা ঠিক বুঝতে পারছে না সে। অভিভাবক মানে কি!! অস্পষ্ট ভাবে ‘হাসবেন্ড’ উচ্চারণ করলো রৌদ্র। আরশি আর ধ্রুব খানিকটা দূরে যেতেই রৌদ্র উচ্চস্বরে আরশিকে ডেকে উঠলো-

“রুদ্রাণী!”

আরশি থমকে দাঁড়ালো। সেই সাথে থমকালো ধ্রুব নিজেও। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“রুদ্রাণী”

আরশি চমকে পেছন ফিরে তাকালো। রৌদ্র থমথমে পায়ে আরশির দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। আরশি রৌদ্রর চোখের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,

“আপনি চিঠির রৌদ্র?”

“যদি বলি হ্যাঁ তাহলে কি বিশ্বাস করবে!”

আরশি কিছু বললো না। ঘোর লাগা চোখে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে আছে আগের মতোই। ধ্রুব ক্ষীণ গলায় বলল-

“আপনি লাইব্রেরিতে আদ্রলিকার জন্য চিঠি রেখে আসতেন?”

“হ্যাঁ। আদ্রলিকা মানে আরুর ছবিটাও আমি নিজেই তুলেছিলাম। বইয়ের মাঝে ছবিটাও আমিই রেখেছিলাম।”

রৌদ্রর কথায় আরশি সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“আপনি আগে থেকেই জানতেন আমি আদ্রলিকা? আপনি সব জেনেশুনেই আমার সাথে এই চিঠির খেলা খেলেছেন!”

“নাহ আগে থেকে তোমাকে চিনতাম না আর এটাও জানতাম না যে কে ছিলো সেই ছবির মেয়েটা। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোমাদের দেখেছিলাম কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি তুমিই ছিলে চিঠির আদ্রলিকা।”

“তাহলে জেনেছেন কখন?”

ধ্রুবর প্রশ্নে রৌদ্র সহজ গলায় বলল-

“ভার্সিটির ফাংশনের দিন জেনেছিলাম। আরুর কন্ঠে গান আর তোমার মুখে আদ্রলিকা নাম শুনে।”

আরশির এবার খানিকটা ভড়কে উঠলো। শক্ত গলায় বলল-

“এতদিন বলেননি কেন? আর নিয়মিত চিঠিই বা দিয়ে যাচ্ছেন কেন?”

“এতদিন নিজের পরিচয় দেওয়াটা ঠিক মনে হয়নি। তোমার সাথে আমার সব সময়ই কথা-কাটাকাটি লেগে থাকতো তার উপর আমার চিঠির কথা বললে হয়তো বিষয়টা আরও বিগড়ে যেতো। তবে আমি চিঠিতে যা বলেছি সবটাই নিজের মন থেকে বলেছি। আর দু’দিন আগে বিকেলে যা বলেছি সেটাও ভেবেচিন্তেই বলেছি।”

রৌদ্র কথায় আরশির মনে রাগ, লজ্জা আর অস্বস্তির সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হলো। অজানা নতুন এক অনুভূতি। যেই অনুভূতির সাথে আগে কখনো পরিচিত হয়নি। নির্বিকার ভঙ্গিতে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর শীতল চাহনি। নির্লিপ্ত চেহারায় খোচাখোচা দাঁড়ি। হাল্কা বাতাস কপালের কাছে আছড়ে পড়া চুল গুলো নড়ছে। চোখের বড় বড় পাপড়িগুলো হয়তো কোনো প্রতিত্তোরে অপেক্ষায় ঘন ঘন পলক ফেলছে। অদ্ভুত ভাবেই এই মুহুর্তে রৌদ্রর প্রতিটা জিনিস তার কাছে চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় লাগছে। রৌদ্র গায়ে জড়ানো ধুসর রঙের শার্ট। ধুসর রঙ আরশির পছন্দের তালিকায় না থাকলেও একমুহূর্তে বড্ড বেশিই ভালো লাগছে এই রংটা। আরশি কিছু না বলেই পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা দূর যেতেই যথারীতি থমকে দাঁড়ালো। তবে রৌদ্র সব সময়ের মতো আজ পেছন থেকে আরশিকে ডাক দেয়নি। সব সময়ের মতো বলেনি ‘আরু দাঁড়াও। যেভাবে আছো সেভাবেই দাঁড়াও’ তবুও আরশি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেন দাঁড়িয়েছে তা সে নিজেও জানে না। কয়েক সেকেন্ড পাড় হতেই আবারও হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে একটাই গান গাইতে ইচ্ছে করছে তার।

“বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা।
কারা যে ডাকিলো পিছে!
বসন্ত এসে গেছে…”

আরশি নিজের প্রতিই বিরক্ত হলো। এই গান গুনগুনিয়ে গাইছে কেন সে? এখন তো বসন্তকাল না। তাহলে কেন এই গান বার বার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কি সত্যিই বাতাসে প্রেম বইছে! সত্যিই কি নতুন প্রেমের রঙিন বসন্ত শুরু হয়েছে! চারপাশে কি প্রেম প্রেম গন্ধে মৌ মৌ করছে??

“চলুন আমার সাথে।”

ধ্রুব ক্লান্ত গলায় রৌদ্রর উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই গম্ভীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো। রৌদ্র আরশির যাওয়ার পথে আহত দৃষ্টিতে একঝলক তাকিয়েই ধ্রুবর পেছন পেছন যেতে লাগলো। কিছু না বলেই আরশির এভাবে চলে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না। তাহলে কি রুদ্রাণী তার উপর রাগ করেছে? তার রুদ্রাণীর মনে কি সত্যিই কোনো অনুভূতি নেই!!

—————————

টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসে আছে ধ্রুব আর রৌদ্র। ধ্রুব সরু চোখে রৌদ্রর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র মাথা নিচু করে কফির মগের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে ধোঁয়া ওঠানো কফি দেখছে। ধ্রুব নিরবতা ভাঙে শান্ত গলায় খুবই সহজ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করল-

“আদ্রলিকাকে ভালোবাসেন?”

ধ্রুবর প্রশ্নের জবাবে রৌদ্র কিছুক্ষন নিরুত্তর চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব তার প্রশ্নের উত্তের জন্য অপেক্ষা করছে। খুব আগ্রহ নিয়েই জানতে চাচ্ছে রৌদ্রর উত্তর। অবশেষে রৌদ্রর মুখ খুললো। নিম্নস্বরে বলল-

“হ্যাঁ ভালোবাসি।”

“ভালোবাসি কথাটা বলতে এতো সময় লাগলো কেন? আর এভাবে মিনমিনিয়ে চোরের মতো কেন বলছেন?”

রৌদ্রর হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে ধ্রুবর তীক্ষ্ণ চোখের দিকে। ধ্রুবর প্রশ্নে সে কি জবাব দিবে সেটাই ভাবছে। ধ্রুব আবারও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

“ভালোবাসায় কি জোর নেই না-কি নিজের ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই কোনটা!! তবে যাইহোক এই মুহুর্তে আমি আপনার জুনিয়র হিসেবে আপনার সাথে কথা বলছি না। আমি কথা বলছি আদ্রলিকার অভিভাবক হিসেবে। আদ্রলিকার ব্যপারে আমি বরাবরই সোজাসাপ্টা এবং সিরিয়াস ভাবেই কথা বলতে পছন্দ করি। তাই আশাকরি আপনিও আমার সব কথার সোজাসাপ্টাই উত্তর দিবেন।”

রৌদ্র অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

“আমার ভালোবাসার উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। কিন্তু… ”

রৌদ্র থেমে গেল। ধ্রুব আর আরশির সম্পর্কটা নিয়ে তার মনে প্রচন্ড কৌতুহল। সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে৷ কিন্তু কোথাও যেন একটা বাধা পরছে। কৌতুহল মেটানোর ইচ্ছে থাকলেও মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারছে না। ধ্রুব তো তাকে বলেই দিয়েছে সে আরুর অভিভাবক। তাই হয়তো প্রশ্ন করাটা তার কাছে অনুচিত মনে হচ্ছে। ধ্রুব রৌদ্র চুপসে যাওয়া দেখে হাল্কা হেসে বলল-

“আমার আর আদ্রলিকার সম্পর্ক নিয়ে কনফিউজড তাই তো?? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে শুনুন। আপনি যা ভাবছেন আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সম্পর্কের কি নাম সেটাও আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি আমি আদ্রলিকাকে খুব ভালোবাসি। আর সবার ভাষ্যমতে আমিই আদ্রলিকার অভিভাবক।”

রৌদ্র একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সব কিছু শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেও মন থেকে পুরো পুরি ভাবে কৌতুহলভাব যায়নি।

“চিঠির মানুষটাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার৷”

“কেন?”

রৌদ্র বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। ধ্রুব কফির মগে এক চুমুক খেয়ে শান্ত গলায় বললো-

“একটা মানুষ আদ্রলিকার সামান্য একটা ছবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, ছবিটাকে আগলে রেখেছেন তাই মনে হচ্ছিলো মানুষটার কাছে হয়তো আদ্রলিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা ছবিটা লাইব্রেরিতে কি করে আসলো?”

রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে বলল-

“ছবিটার প্রতি আমি নিজেও খুব বিরক্ত হয়েছিলাম একটা সময়। সারাক্ষণ ছবিটা সাথে নিয়ে ঘুরতাম। শাড়ি পড়া কোনো মেয়ে দেখলে ছবিটার সাথে মেলানোর চেষ্টা করতাম৷ কিন্তু প্রতিবারই নিরাশ হতাম। এক্সামের সময় পড়াশোনায় মন বসাতে পারতাম না তাই একদিন বিরক্ত হয়েই লাইব্রেরিতে ওই বইয়ের মধ্যে ছবিটা রেখে চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ছবিটার কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিবো। কিন্তু যা চেয়েছিলাম তার বিপরীত হলো। ছবিটার চিন্তায় আমার মন অনেক বেশিই ছটফট করছিল। তাই বাধ্য হয়েই লাইব্রেরিতে এসেছিলাম ছবিটা নিতে৷ কিন্তু লাইব্রেরিতে এসে বই আর ছবি কোনটাই পাইনি। তাই নির্বানের কথা মতো সেই জায়গায় একটা চিরকুট লিখে গিয়েছিলাম। আর সেই একটা চিরকুটের মাধ্যমেই আমি ছবির আসল মানুষটাকে পেয়েছি।”

“আপনি কি সত্যি সত্যিই আদ্রলিকাকে ভালোবাসেন?”

ধ্রুবর প্রশ্নে রৌদ্র মনকাড়া একটা হাসি দিয়ে বলল-

“আদ্রলিকাকে ভালোবেসেছি অদেখা ভাবে। আদ্রলিকার হাসতে হাসতে গান গাওয়া শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। একটা ছবি আর সেই পূর্নিমা রাতের কয়েক মিনিটের কিছু স্মৃতি নিয়েই কয়েকবছর ধরে আদ্রলিকাকে ভালোবেসে যাচ্ছি। আরুকে আদ্রলিকা রূপে দেখে আবারও নতুন করে মুগ্ধ হয়েছি। আরও তীব্রভাবে ভালোবাসেছি। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।”

ধ্রুব টেবিলে উপর দু’হাতে তুলে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো-

“আমি আদ্রলিকার অভিভাবক। আমার অনুমতি ছাড়া আদ্রলিকা কিংবা ওর ফ্যামিলি কেউ-ই কিন্তু আপনার সাথে সম্পর্কটা মেনে নিবে না। এমনকি আদ্রলিকা যদিও আপনাকে পছন্দ করে থাকে তবুও আমার অনুমতি ছাড়া এক পা-ও আগাবে না। আমার অবস্থানটা বুঝতে পারছেন??”

রৌদ্রর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“কি বলতে চাচ্ছো?”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমার একটা শর্ত আছে।”

রৌদ্র ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু করে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো-

“শর্ত! কিন্তু কিসের শর্ত?”

“আদ্রলিকা বা তার ফ্যামিলি তখনই আপনাকে মেনে নিবে যখন আমি রাজি থাকবো। তাই আপনার উচিত সবার আগে আমাকে মানানো। আর আমার সকল শর্ত মেনে নেওয়া।”

ধ্রুবর কথায় রৌদ্র ছোট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেললো। নিজের মধ্যে এই মুহুর্তে কিছুটা নার্ভাসনেসের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে। তার ভয়ে ভার্সিটিতে কোনো বখাটে ছেলে র‍্যাগিং কিংবা আজেবাজে কাজ করতে পারে না আজ কি-না সে নিজেই জুনিয়র এক ছেলের কথার প্যাঁচে মিইয়ে যাচ্ছে!! রৌদ্র ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে উদ্ভট ধরনের জল্পনা কল্পনা করছে। এই যেমন-
“তার ঠিক সামনেই গম্ভীরমুখে বসে আছে আরশির বাবা। আর সে আরশিকে বিয়ে করার জন্য ওনার কাছে নানানভাবে আকুতি মিনতি করছে। তার না-হওয়া শ্বশুর মশাইকে ইমপ্রেস করার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অবশেষে তার না-হওয়া শ্বশুর মশাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সেই নেমে নেওয়ার পেছনেও রয়েছে অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার মতো কিছু শর্ত।”
হায়, কি নির্মম সেই কল্পনা! রৌদ্র নিজের কল্পনায় নিজেই বিরক্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ানোর ইচ্ছেটাকে গিলে ফেলে উদাস গলায় বললো-

“হুম বলো। কি কি শর্ত মানতে হবে।”

ধ্রুব নিশ্চুপ বসে রইলো। দুজনের মধ্যেই এখন পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। পরিস্থিতি গম্ভীর থেকেও গম্ভীরতর হচ্ছে।

“আদ্রলিকার সাথে আমার সম্পর্কের কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই। হয়তো আমাদের সম্পর্কটা নাম দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই আদ্রলিকাকে চিনি। ছোট বেলার পাগলামো আর জেদের বশেই আদ্রলিকাকে শাকিলের কাছ থেকে কিনেছিলাম। এই পুরোটা বিষয়ই ছিলো একটা ছোট অবুঝ বাচ্চার বায়না অথবা জেদ। আমার জেদের জন্যই আদ্রলিকাকে সব আমি নিজের কাছে রাখতাম। আমাদের পরিবারও আমার এই জেদটাকে মেনে নিয়েছে। প্রথম প্রথম আদ্রলিকা আমার কাছে একটা খেলনার মতোই ছিলো। খুব প্রিয় একটা খেলনা কিংবা পুতুলের মতো। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম তখন আদ্রলিকার প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠলাম। আদ্রলিকার জন্যই আমি ছোট্ট বয়সেই যথেষ্ট দায়িত্বশীল একটা ছেলে হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করি। কখনো ভাইয়ের মতো দায়িত্ববান পুরুষ কখনো বা মা’য়ের মতো মমতাময়ী হয়েই ছিলাম ওর কাছে। ব্যপারটা হাস্যকর হলেও সত্যি আমি আদ্রলিকা নিজের বাচ্চার মতই বড় করেছি। আমার আর আদ্রলিকার দুনিয়াটা একদমই ভিন্ন সেটা আমাদের পরিবার কিংবা ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই জানে।”

ধ্রুব থামলো। রৌদ্র শীতল চাহনিতে ধ্রুবকে দেখছে। ধ্রুবর বলা প্রতিটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। ধ্রুবর সব কথাই তার কাছে সচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার মনে হচ্ছে। সেদিন বিকেলে দেখা ধ্রুবর চিন্তা রুপ আর হসপিটালের বাহিরে খুব সুন্দর করে আরশির চুলে খোপা করে দেওয়া দেখেই রৌদ্র বুঝেছে ধ্রুব আরুর প্রতি ঠিক কতটা যত্নশীল আর দায়িত্ববান। ধ্রুব নিচের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলা শুরু করলো-

“হয়তো আমাদের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আদ্রলিকা আমার কাছে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা শুধু মুখের ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার বয়সের ছেলেরা হয়তো আড্ডা দিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বেশ হৈ-হুল্লোড় করে দিন কাটায়। কিন্তু আমি নিজেকে দেখি আদ্রলিকার অভিভাবক হিসেবে। যার কাধে আছে ছোট্ট আদ্রলিকাকে আগলে রাখার দায়িত্ব। কিভাবে আদ্রলিকার সকল ইচ্ছে, আবদার পূরণ করা যায় সেই চিন্তা। আমি সাথে না থাকলে আদ্রলিকা নিজেকে সামলিয়ে সাবধানে থাকতে পারবে কি-না এসবই আমার মাথায় ঘুরে যখন আমি কোথাও যাই। আজ যখন দেখলাম আদ্রলিকার পাশে আমাকে দেখে আপনি জেলাস। ঠিক তখনই আমি উপলব্ধি করলাম আমার মনের ভয়টাকে। ভবিষ্যতে আদ্রলিকার লাইফ পার্টনার আমাকে আদ্রলিকার পাশে ঠিক কি নজরে দেখবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আদোও কি আমাকে আদ্রলিকার পাশে সহ্য করবে কিনা তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম।”

ধ্রুব মাথা নিচু করে রেখেছে। তার গলার স্বর জড়িয়ে আসছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠছে ধিরে ধিরে। রৌদ্র হাল্কা হেসে বলল-

“চিন্তা করো না। আমি কখনো আরুকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিবো না। আরুর উপর তোমার অধিকার ঠিক আগের মতোই থাকবে। আর আমি আরুকে তোমার মতো করে আগলে রাখতে পারবো কি-না জানি না। তবে নিজের জায়গা থেকে আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই আরুকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো।”

রৌদ্র কথায় ধ্রুব নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-

“পারসোনালি আমি আপনাকে তেমন একটা পছন্দ করতাম না। তবে চিঠির মানুষটা সব সময়ই আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো। যে ছেলে আদ্রলিকার একটা ছবিকে এতো বছর ধরে আগলে রেখেছে সেই ছেলেটা নিসন্দেহে আমার আদ্রলিকাকে খুব ভালোবাসে।”

রৌদ্র সশব্দে হেসে উঠলো। ডান হাতে চুল গুলো পেছনে ঢেলে দিয়ে বলল-

“ভাগ্যিস নির্বানের কথায় চিঠি লেখা শুরু করেছিলাম। নাহলে তো আমার কোনো চান্সই ছিলো না।”

রৌদ্র খানিকটা সময় চুপ থেকে মলিন কন্ঠে বলল-

“কিন্তু আরু!! আরু কি আমাকে পছন্দ করে? ও হয়তো আমার উপর রাগ করে আছে। তাই তো তখন কিছু না বলেই চলে গেল।”

রৌদ্র কথায় ধ্রুব ঝংকার তুলে হাসতে লাগলো। আশেপাশের কয়েক জোড়া কৌতুহলী চোখ ধ্রুবর দিকে স্থির। রৌদ্র ভ্রু কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধ্রুবর হাসি দেখছে। ধ্রুব আশেপাশে মানুষদের তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে ফেললো। ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে খানিকটা রসিকতার ভঙ্গিতে বলল-

“আদ্রলিকা রাগ করে যায়নি। লজ্জার কারণে আপনার সামনে থাকতে অস্বস্তিবোধ করছিলো তাই চলে গেছে।”

“সত্যি?”

রৌদ্র সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো। ধ্রুব বরাবরের মতোই শান্ত গলায় বলল-

“আদ্রলিকার প্রতিটা মুভমেন্ট আমার আগে থেকেই জানা থাকে। আদ্রলিকার কোনো বিষয় আমার চোখ কখনো এড়াতে পারেননি। আর আদ্রলিকা চিঠির মানুষটার প্রতি কতটা দূর্বল সেটা শুধু আমিই জানি। আমি দেখেছি আদ্রলিকার পাগলামি। প্রতিদিন চিঠির আশায় লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকা। বইটার প্রতিটা পাতায় পাতায় চেক করা। চিঠি না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া। সব কিছুর সাক্ষী আমি। প্রায় এক বছর পরেও আপনার চিঠি পেয়ে খুশি হয়নি। অভিমান করেছিলো চিঠির উত্তর আসতে দেরি হওয়ায়। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে মানুষ তার উপরেই অভিমান করে যাকে মানুষ ভালোবাসে।”

——————————

“ভালো আছেন ভাইয়া?”

নির্বান চমকে পেছন ফিরে তাকালো। নীলাকে দেখেই তার বুক ধুকপুক ধুকপুক করে লাফানো শুরু করেছে। নির্বান মেকি হাসি দিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলল-

“জ্বি জ্বি ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?”

“অদ্ভুত তো আপনি আমাকে দেখলে ভয় পান কেন? আরু, সুপ্তি কাসফি সবাইকেই তো তুমি করে বলেন। কিন্তু আমার সাথে এমন করেন কেন?”

নীলার ঝাঁঝালো কণ্ঠে নির্বানের সকল সাহস হাওয়া মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিনমিনিয়ে বলল-

“আমি কাউকে ভয় পাইনা। কিন্তু আপনাকে দেখলে আমার হার্ট দূর্বল হয়ে পারে। যদি হার্ট অ্যাটাক ফ্যাটাক করে মারা যাই তাই একটু ভয় পাই।”

“আমি কি দেখতে এতোটাই ভয়ংকর!”

নীলা মলিন মুখে বোকাদের মতো প্রশ্ন করলো। নীলার প্রশ্ন শুনে নির্বান ঠোঁট চেপে হাসলো। পকেটে দু’হাত গুজে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো-

“ভয়ংকরের থেকেও ভয়াবহ। যাইহোক বাহিরে ঘুরাঘুরি না করে ক্লাসে যান।”

নির্বান কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করলো। নীলা নির্বানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে।

“কিরে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে তুই এখানে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

কাসফিয়ার কন্ঠ শুনে নীলা পেছন ফিরে তাকালো। ক্ষীণ স্বরে বলল-

“এমনি। চল যাই এখন।”

—————————

মধ্য দুপুর। শান্তশীতল সূর্যকে ঢেকে আছে কালো মেঘ। চারপাশ অন্ধকার করে শীতল ঠান্ডা হওয়া বইছে। ক্লাস শেষে আরশি আর তার বাকি সব ফ্রেন্ড এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে ধ্রুবর জন্য। আচমকাই কোথা থেকে রৌদ্র আর নির্বান এসে হাজির হলো তাদের সামনে। আরশি রৌদ্রকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরে তাকায়। রৌদ্র আরশি সামনে এসে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলল-

“তোমার সাথে আমার কথা আছে আরু।”

আরশি কিছু বলল না। রৌদ্র কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে রইলো৷ রৌদ্র আবারও বলল-

“শুধু শুধু আমার উপর রাগ করে থেকো না আরু। আমি মানছি আমার কিছুটা ভুল ছিলো। আমার পরিচয়টা আগেই বলার উচিত ছিল। তার জন্য আমি সরি। কিন্তু তুমি এভাবে ইগ্নোর করছো কেন আমাকে?”

আরশি এবারও কিছু বললো না৷ রৌদ্র আরশির কাছে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে বাঁকা হেসে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল-

“ওকে রুদ্রাণী কিছু বলবে না তো! ঠিক আছে বলতে হবে না। তোমাকে আজকের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা ভুলে যেওনা রুদ্রাণী শুধুমাত্র তার রৌদ্রর কাছেই আসবে। অভিমান আজ না হয় কাল তো ভাঙবেই। আজ যাচ্ছি। ভালো থেকো।”

রৌদ্র নির্বানকে নিয়ে গেইটের দিকে চলে যাচ্ছে। হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে খানিকটা উচ্চস্বরে বলল-

“রুদ্রাণী!!”

আরশি কৌতুহলী চোখে রৌদ্র দিকে তাকালো। রৌদ্র আকাশের দিকে আঙুল উঁচু করে বলল-

“ওই যে দেখো রুদ্রাণী একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি।”

কথাটা বলেই রৌদ্র হাসতে হাসতে চলে গেল। আরশি লজ্জায় মাথা নুয়ে রেখেছে। অস্বস্তিতে হাত কাচলাচ্ছে৷ আদ্রাফ, নীল, কাসফিয়া, সুপ্তি আর নীলা সবাই অবাক হয়ে আকশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাড় বাকিয়ে বাকিয়ে পুরো আকাশে পাখি খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই পাচ্ছে। রৌদ্র কথা গুলোও কিছুই বুঝতে পারেনি।

“তোদের সবার ঘাড় ভেঙে যাবে তবুও পাখি খুঁজে পাবিনা। এই পাখি সেই পাখি না রে ভাই। এই পাখির মানে অনেক কিছু। যার জন্য বলা হয়েছে শুধু সে-ই বুঝেছে তোদের মতো মাথা মোটাদের এইসব বোঝার ক্ষমতা নেই।”

ধ্রুবর কথায় সবাই ড্যাবড্যাব করে তার দিকে আছে। ধ্রুবর কথার মানেও কিছুই বুঝতে পারছে না। আর অন্য দিকে আরশি ধ্রুবর কথায় যেন আরও লজ্জায় পরে গেল। লজ্জার আক্রমণে ছটফটিয়ে উঠেছে আরশি। অস্থির চোখে বার বার আশেপাশে তাকাচ্ছে। আরশির লজ্জা দেখে ধ্রুব মুচকি হাসলো।

“কিসের পাখির কথা বলছো ভাই? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর রৌদ্র ভাই-ই বা কি সব বলে গেল?”

নীল প্রচন্ড কৌতুহল নিয়েই প্রশ্ন করলো। নীলের সাথে সাথে বাকি সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে।

চলবে…