রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-৪+৫+৬

0
490

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“ছোট মা শাকিল কোথায়?”

বাসায় এসে শাকিলকে ড্রয়িং রুমে না দেখে প্রশ্নটা করলো ধ্রুব। আরশির মা রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন-

“রুমে রেস্ট নিচ্ছে, তোরা গিয়ে দেখ যা।”

(আরশিদের পাশের বাসাটাই হচ্ছে ধ্রুবদের। ছোট্ট থেকেই শাকিল, ধ্রুব আর আরশি একসাথে বড় হয়েছে। শাকিল ধ্রুবর থেকে এক বছরের বড় আর আরশি থেকে চার বছরের। তবুও তাদের মধ্যে বেস্টফ্রেন্ডের মতো সম্পর্ক। দু পরিবারের মধ্যেও খুব ভালো সম্পর্ক। ধ্রুব আরশির বাবা-মা’কে ছোটমা আর ছোট বাবা বলে ডাকে। আরশি আর শাকিল ধ্রুবর বাবা-মা’কে ডাকে বড়মা আর আর বড় বাবা বলে।) আরশি আর ধ্রুব দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে শাকিলের রুমে গেল। দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই দেখলো শাকিল চোখবুঁজে শুয়ে আছে। ধ্রুব আর আরশি একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। দুজনেই মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে হামলে পরলো শাকিলের উপর। ধ্রুব শাকিলের উপর উঠে শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল-

“শালা একে তো আমাদের না জানিয়ে এসেছিস আর এখন আরামসে পরে পরে ঘুমাচ্ছিস হারামি!”

শাকিল ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠলো। ধ্রুবর দিকে চোখ বড় বড় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘাড় বাকিয়ে আরশির দিকে তাকালো। আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে শাকিলের দিকে। শাকিল নির্মল হাসি দিয়ে বলল-

“কেমন আছিস আশু? আর ধ্রুব তুই কেমন আছিস?”

আরশি গম্ভীরতার সাথে শাকিলের কাছে আসলো। আচমকাই ডান হাত দিয়ে শাকিলের চুল টেনে ধরে বলল-

“সয়তান, কুত্তা তুই এই ক’দিন আমাদের সাথে কথা বলিসনি কেন? আর দেশে আসবি সেটাও তো আগে বললি না।”

শাকিল চুলে হাত দিয়ে চোখমুখ খিচে বলল-

“ব্যথা পাচ্ছি তো আশু। প্লিজ বোন আমার চুল ছাড়।”

“আরু.. এই শালারে একদম ছাড়বি না বলে দিচ্ছি। দু’বছরের মাইর পাওনা আছে।”

ধ্রুব এখনও শাকিলের উপর বসে শাকিলের কলার চেপে ধরে আছে। শাকিল ধ্রুবর হাত ধরে ধ্রুবকে উলটে অন্য পাশে ফেলে দেয়। শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল-

“আমাকে বার বার শালা বলছিস কেন ধ্রুব! আমি তোর সম্বন্ধী হলেও হতে পারি তবে শালা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”

শাকিলের কথায় ধ্রুব আর আরশি বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে দুজনেই নাক ছিটকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শাকিল ওদের দুজনের কান্ড দেখে সশব্দে হেসে দেয়। আরশি খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“হাসাহাসি বাদ দিয়ে বল এই কয়দিন আমাদের সাথে কথা বলিসনি কেন!”

শাকিল বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো। কোলের উপর একটা বালিশ নিয়ে সহজ গলায় বলল-

“কেন আবার তোদের সারপ্রাইজ দিবো তাই। আর দেশে ফিরবো এইজন্যেও অনেক ঝামেলা ছিলো তাই ব্যস্ততায় তেমন একটা কথা বলার সময় ছিল না।”

————————

রাত প্রায় দশটা। ডিনার শেষে আরশি রুমে ফিরে আসলো। হঠাৎ করেই স্টাডি টেবিলের পাশে টানানো একটা ছবির দিকে চোখ যায়। নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ছবিটায় ধ্রুব আর শাকিল দুপাশ থেকে আরশিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে তোলা এই ছবি। সেন্টমার্টিন দ্বীপের কথা মনে পরতেই যেন মাথার মধ্যে চিঠির সেই অচেনা মানুষটার স্মৃতির আগমন ঘটলো। টেবিলের ডয়ার থেকে অচেনা মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া শেষ চিঠিটা নিয়ে আবারও দেখতে লাগলো আরশি।

“দুঃখিত আজ আর আপনাকে প্রিয় সম্মোধন করতে পারছি না।

আপনি কে সেটা আমি জানি না। তবে আপনি যে-ই হোন না কেন এই ছবিটা নিয়ে কোনো প্রকার মজা অথবা মিথ্যা কথা আমি মোটেও পছন্দ করবো না। আপনার কাছে হয়তো ছবিটা সামান্য মনে হচ্ছে তবে আমার ক্ষেত্রে ভিন্ন। এই ছবি আর ছবির মানুষটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর হ্যাঁ এই ছবি সম্পর্কে কোনো কৈফিয়ত আপনাকে দেওয়ার প্রয়োজন আমি মনে করছি না।

ইতি,
অচেনা একজন

পুনশ্চঃ আপনি যদি সত্যিই এই ছবির আদ্রলিকা হয়ে থাকেন তাহলে আপনার নিশ্চয়ই জানার কথা এই ছবিটা কোথায় তোলা হয়েছে!”

সেদিন এই চিঠি পড়ার পর ধ্রুব থমথমে গলায় আরশিকে বলল-

“এই আদ্রলিকা! এই লোকটা কি তোকে ঠান্ডা মাথায় অপমান করলো কি-না বুঝতে পারছি না।”

আরশি নির্বাকের মতো চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। চিঠির মানুষটার প্রতি তার রাগ হচ্ছে না-কি এই ছবিটাকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ভালো লাগা কাজ করছে সঠিক বুঝতে পারছে না। আরশি ধ্রুবর কথার কোনো জবাব না দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি উত্তর লিখতে লাগলো।

প্রিয় অচেনা একজন,

আমার কথা হয়তো আপনার বিশ্বাস করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে চিন্তা নেই আমি আপনার সমস্যা দূর করে দিচ্ছি।

প্রায় একবছর দুমাস আগে পুরো পরিবারসহ সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়েছিলাম। পানিতে আমার সব জামাকাপড় ভিজে যাওয়ায় বড়মার সবুজ রঙের সুতি শাড়ি পরতে হয়েছিল। সেদিন পূর্নিমার রাত ছিল। যতটুকু মনে পড়ছে ওই সময়টায় আমি ফ্রেন্ড আর ভাইয়ের সাথে গান গাচ্ছিলাম। আপনি কখন, কীভাবে আর কেন এই ছবি তুলেছেন সেটা আমার জানা নেই। এখন নিশ্চয়ই আমার কথা বিশ্বাস করতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না!

বিঃদ্রঃ আপনি কেন আমার এই ছবিটাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। আর কেনই বা এতদিন আগের ছবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন আপনি?

ইতি,
আপনার ছবির আদ্রলিকা।

আরশি চিঠিটা লিখে বরাবরের মতোই বইয়ের মাঝে রেখে দেয়। তবে তার দু’দিন পর আরশি লাইব্রেরিতে গিয়ে লাইব্রেরিটা বন্ধ দেখতে পায়। লাইব্রেরির মালিক অসুস্থ হয়ে পরায় দেশের বাহিরে চলে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। আরশি প্রায় ধ্রুবর সাথে এই লাইব্রেরিতে এসে দেখে যেত লাইব্রেরি খুলেছি কি-না। সেই ছবি আর অচেনা মানুষটার কথা ভাবতে না চাইলেও মাঝে মাধ্যে হুটহাট করেই গভীর ভাবনায় পরে যেত ওই চিঠি গুলো নিয়ে। আগের চিঠি গুলোই বার বার পড়তে ইচ্ছে করতো। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি কাজ করতো চিঠি গুলোর প্রতি। প্রায় দুমাস পর আরশি লাইব্রেরিটা খোলা দেখতে পায়। তবে সেদিন বইয়ের মাঝে কোনো চিঠি পায়নি। আর আরশির লেখা চিঠিটাও বইয়ের মধ্যে ছিল না। সেদিন থেকেই আরশির অপেক্ষা প্রহর গুনা শুরু হয়েছে। আরশির মনে প্রবল আস্থা ছিল সেই অচেনা মানুষটা তার চিঠির উত্তর দিবে। সেদিনের পর এগারো মাস কেটে গেছে তবে আরশি এখনো তার চিঠির কোনো উত্তর পায়নি। ধ্রুব নানাভাবে আরশিকে বুঝিয়েছে যেন চিঠির জন্য অপেক্ষা না করে৷ তবুও আরশি চিঠির জন্য অপেক্ষা করা বন্ধ করেনি। আর ধ্রুব নিজেও বেশ কৌতুহলী সেই চিঠির মানুষটাকে নিয়ে। সে নিজেও প্রায় সময় একা একা লাইব্রেরিতে গিয়ে চিঠির খোঁজ করে কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়। ধ্রুব কেন বার বার চিঠির খোঁজ করে সেটা সে নিজেও জানে না। শুধুই কি মানুষটার প্রতি কৌতূহলের কারণে না-কি আরশির বিষন্নতা আর উদাসীনতা দেখে!

————————

ভার্সিটিতে এসেই আরশির সাথে সর্বপ্রথম রৌদ্রর মুখোমুখি হলো। রৌদ্রকে দেখেই আরশির হাসিমুখে কাঠিন্য ভাব এসে পরেছে। আরশি ধ্রুবর পেছন পেছন রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে তখনই রৌদ্রর পাশ থেকে নির্বান উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“কেমন আছো বাঘিনী?”

নির্বানের উদ্ভট কথায় আরশি আর ধ্রুব ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। রৌদ্র নিজেও নির্বানের কথায় বিস্মিত হলো। আরশি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“আমাকে বলছেন?”

নির্বান আরশির দিকে একটু এগিয়ে আসলো। অমায়িকভাবে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-

“হুম হুম তোমাকেই তো বলছি। কেমন আছো?”

আরশি চোখেমুখে বিরক্তি ভাব এনে বলল-

“আমি কেমন আছি সেটা না হয় পরে বলবো। আগে আপনি বলুন আমাকে বাঘিনী কেন ডেকেছেন?”

“তুমি তো কোনো বাঘিনী থেকে কম না। ওইদিন যেভাবে ছেলে গুলোকে ধমকাচ্ছিলে আমি তো দেখেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

নির্বান ভয়াতুর কন্ঠে বলল কথা গুলো। নির্বানের কথার ভংগিমা দেখে রৌদ্র হাল্কা হাসলো। রৌদ্রর হাসি দেখে আরশির মাথায় রাগ উঠে যায়। আরশি ক্ষিপ্ত গলায় বললো-

“দেখুন শেষ বারের মতো বলছি আমাকে এসব আজেবাজে নামে ডাকাডাকি করবেন না। আরেকবার যদি এসব শুনেছি তাহলে…”

আরশির কথার মাঝেই রৌদ্র নির্বানের কাধে হাত রেখে বলল-

“দোস্ত এই এ্যাংরি বার্ডের সাথে লাগতে যাস না। যে কোনো সময় তোকে ওনার রাগ দিয়ে ঝলসে দিতে পারে।”

আরশি রাগান্বিত চোখে তাকালো রৌদ্রর দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-

“আপনি কিন্তু ইচ্ছে করে আমার সাথে লাগতে আসছেন। প্রথম দিন থেকে শুরু করেছেন অসভ্যের মতো ফালতু কথা বলা।”

“দেখলি তো নির্বান ওনার রাগ সব সময় নাকের ডগায় এসেই থাকে। তাই তো তোকে সাবধান করছিলাম।”

আরশি রেগেমেগে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ধ্রুব আরশির হাত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল-

“আরু চল এখান থেকে।”

ধ্রুব আরশিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নির্বান আরশির রাগ দেখে হেসেই যাচ্ছে। তবে রৌদ্র ধ্রুব আর আরশির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো।

“আদ্রলিকা শোন এই ছেলেটা থেকে দূরে থাকবি। তুই ওনার সাথে বেশি কথা বলবি এটা আমার পছন্দ না।”

আরশি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“তোর আবার কি হলো হঠাৎ করে?”

ধ্রুব গম্ভীর গলায় বললো- “কিছু হয়নি তবে এই ছেলের থেকে দূরে থাকবি। এই ছেলেটা সব কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে। আগে তো প্রায় সময়ই দেখতাম এটা ওটা নিয়ে ভার্সিটিতে ঝামেলা করত। হঠাৎ করেই কয়েকমাসের জন্য ভার্সিটি থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। আমি তো ভেবেছিলাম ভার্সিটি থেকে চলে গেছে তবে আবার কোথা থেকে এসে হাজির হলো কে জানে! তবে যাই হোক এই ছেলের থাকে দূরে থাকবি মনে থাকে যেন।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ধ্রুব আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ক্লাসে চলে যায়।

চলবে…

(#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কাসফি কি হয়েছে তোর? এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন?”

আরশি সরু চোখে কাসফিয়ার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল। কাসফিয়া খানিকটা নেড়েচেড়ে বসে কৃত্রিম হাসি দিলো। কাসফিয়া জবাব দেওয়ার আগেই পাশ থেকে নীলা ফটাফট করে বলে উঠলো-

“সেই কখন থেকেই দেখছি কাসফি গাল ফুলিয়ে রেখেছে। কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছি কিন্তু কিছুই বলছে না।”

আরশি সুপ্তির কাধে হাত দিয়ে চোখের ইশারায় উঠতে বলল। সুপ্তি উঠে দাঁড়াতেই আরশি কাসফিয়ার পাশে বসে পরলো। কাসফিয়ার কাধে হাত রেখে বিনয়ের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল-

“সত্যি করে বলতো তোর কি হয়েছে? কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের সাথে শেয়ার কর।”

কাসফিয়া মাথা নিচু করে মলিন কন্ঠে বলল-

“আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করেছে আরু।”

আরশি, সুপ্তি আর নীলা তিনজনই বিস্ফোরিত চোখে কাসফিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাসফিয়ার চোখ পানিতে চিকচিক করছে। মাথা নিচু করে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে খুব নিখুঁতভাবে। আরশি ফুস করে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-

“আদ্রাফ জানে এই কথা! আর তুই বাসায় আদ্রাফের কথা বলিসনি!”

কাসফিয়া কোনো জবাব দিলো না। ডানে-বামে হাল্কা করে মাথা নাড়ালো। কাসফিয়ার অন্য পাশ থেকে নীলা উত্তেজিত হয়ে বলল-

“এখন কি হবে রে আরু?”

আরশি চুপ করে রইলো। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে কাসফিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-

“হঠাৎ করেই আংকেল এভাবে তোর বিয়ে ঠিক করলো কেন কাসফি?”

“আব্বুর বয়স হয়েছে বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকে। এইজন্যই আব্বুর ভয় হচ্ছে যদি আমার বিয়ে দেওয়ার আগেই ওনার কিছুর হয়ে যায়। আর ছেলে তো আমাদের পরিচিতই। আব্বুর বিজনেস পার্টনারের ছেলে। আমাকে ওনারা আগে থেকেই চিনে তাই দেখাদেখি না করে একদম বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেলেছে।”

কাসফিয়া উদাসীন গলায় কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুপ্তি চোখেমুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে বলল-

“কাসফি শোন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই তুই আংকেলকে আদ্রাফ আর তোর সম্পর্কের কথা জানিয়ে দে। এটাই ভালো হবে।”

“আমি আব্বুকে বলার চেষ্টা করেছি সুপ্তি। কিন্তু আব্বুর অসুস্থতার কথা ভেবে আর কিছুই বলেতে পারিনি। আর আব্বুকে বললেও আব্বু যদি আদ্রাফকে মেনে না সেই ভয়ে বার বার বলতে যেয়েও বলতে পারি না।”

কাসফিয়ার চোখে জমে থাকা নোনাজল এবার উপচে বেরিয়ে আসলো। ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আরশি অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল-

“কাসফি কি করছিস! কান্না করিস না প্লিজ। আমরা সবাই আছি তো। দেখিস একটা না একটা পথ বেরিয়ে আসবে। আর আদ্রাফকে বললে আদ্রাফ হয়তো কিছু একটা করে ম্যানেজ করতে পারবে।”

আরশি,সুপ্তি আর নীলা নানান কথা বলে কাসফিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই আদ্রাফ আর নীল আরশিদের খুঁজতে খুঁজতে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকটায় আসে। ওদেরকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে নীল ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো-

“কিরে তোরা এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছিস কেন?”

নীলের কথা আরশি, নীলা ওরা ঘাবড়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আরশি কিছু বলতে নিলেই কাসফিয়া আরশির হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় থামিয়ে দেয়। কাসফিয়া নীলের নীলের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে বলল-

“কই না তো। এসব বাদ দিয়ে বল তোরা এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

আদ্রাফ কাসফিয়ার দিকে অপলকভাবে চেয়ে রইলো। কাসফিয়া কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে সেটা আদ্রাফের বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয়নি। কাসফিয়ার চেহারার এমন বিষন্ন হাল দেখেই আদ্রাফের মাথায় চিন্তা ঢুকে গেল। তবুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কাসফিয়া নিজে থেকেই তাকে এসে বলবে সেই আশায় আদ্রাফ স্বাভাবিক হয়ে রইলো।

————————

হঠাৎ করেই চারপাশ অন্ধকার করে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির পানির ছিটায় আরশির জামা প্রায় আধভেজা অবস্থা। ভার্সিটির ঠিক সামনের বন্ধ দোকানে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। চোখেমুখে ভয়ংকর বিরক্তি। রাগ আর শীতে দুটো মিলিয়ে আরশির শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। চোখ ছোট ছোট করে অস্থিরতার সাথে ভার্সিটির গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। এই মুহূর্তে ধ্রুবকে বৃষ্টির পানিতে চুবিয়ে মারার প্রবল ইচ্ছে মনে পুষিয়ে রেখেছে আরশি। ক্লাস শেষ হয়েছে আরও পনেরো মিনিট আগে। সবাই চলে গেছে অথচ ধ্রুব এখনো আসছে না। আরশি এবার অধৈর্য হয়ে ধ্রুবকে কল করলো। কিন্তু রিং হওয়ার সাথে সাথে ধ্রুব কল কেটে দিল। আরশির রাগ এবার সপ্তম আকাশ ছুঁয়েছে। আবারও কল করবে তার আগেই টুং করে মেসেজ আসলো। আরশি মেসেজ ওপেন করতেই ধ্রুবর বড় একটা মেসেজ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। সেই সাথে কতগুলো সেড ইমুজি।

“সরি সরি সরি দোস্ত রাগ করিস না প্লিজ প্লিজ। হঠাৎ করেই এক্সট্রা ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি কিছুই জানতাম না সত্যি বলছি। আমি এখন ক্লাসে বসে আছি স্যার লেকচার দিচ্ছে তাই তোর কল কেটে দিয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে মেসেজ দিচ্ছি তোকে। তুই কষ্ট করে আজ একা একা চলে যা দোস্ত। বৃষ্টি হচ্ছে সাবধানে যাস আর না হলে শাকিলকে বল এসে নিয়ে যেতে। আবারও সরি বলছি। বাসায় গেলে যা শাস্তি দিবি মাথা পেতে মেনে নিবো প্রমিজ।”

মেসেজটা পড়াই আরশি একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে। রাস্তা তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো কিন্তু কোনো খালি রিকশা পাচ্ছে না। আরও কিছুটা সময় চলে গেলো রিকশার অপেক্ষায় কিন্তু রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে আরশির সামনে এসে একটা রিকশা থামলো। আরশি সরু চোখে তাকিয়ে রিকশায় বসে থাকা মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করছে। নীল রঙের পলিথিন দিয়ে মানুষটার শরীর ডেকে রাখা। একটু পরেই মানুষটা মাথা সামনে এনে ডান দিকে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো। মানুষটার চেহারা দেখেই আরশির বিরক্তিতে কপাল কুচকে ফেললো।

“মিস আরু আপনি চাইলে আমি রিকশাটা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি।”

শান্ত গলায় কথা গুলো বলল রৌদ্র। বৃষ্টির শব্দে আরশি রৌদ্রর কথা ঠিক মতো শুনতে পেলো না৷ আরশি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলল-

“কি বললেন? বুঝতে পারছি না আপনার কথা। জোরে বলুন।”

রৌদ্র এবার কিছুটা চেচিয়ে বলে উঠলো-

“বলেছি আপনি চাইলে আমার সাথে আসতে পারেন। এখন কোনো রিকশা পাওয়া যাবে না।”

“অসম্ভব, আমি ভুলেও আপনার সাথে যাবো না। আপনি চলে যান। আমি আমারটা ম্যানেজ কিরে নিবো।”

আরশি কটক্ষ গলায় দ্রুততার সঙ্গে কথা গুলো বলল। রৌদ্র ভ্রু কুচকে গম্ভীর গলায় বলল-

“দেখুন মিস আরু এটা তর্ক করার সময় না। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন ভিজে যাচ্ছেন। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যাবেন। আপনার ভালোর জন্যই বলছি রিকশায় উঠে বসুন।”

আরশি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আশেপাশের নজর দিলো। কোনো খালি রিকশা দেখা যাচ্ছে না। আরশিকে ইতস্তত করতে দেখে রৌদ্র নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-

“আমি আপনাকে খেয়ে ফেলবো না মিস আরু। আপনার মতো বাঘিনীকে খাওয়ার সাধ্য আমার নেই। আপনার ভাগ্য ভালো তাই আমি আমার লাইফ রিস্কে রেখে এমন বাঘিনীকে রিকশায় জায়গা দিচ্ছি।”

রৌদ্র কথায় রিকশাওয়ালা লোক মুখ চেপে হেসে উঠলো। আরশি এবার নাক ফুলিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললো-

“আপনার কি সব সময় আমাকে এসব আজেবাজে কথা না বললে ভালো লাগে না!”

“সেটা পরে বলছি এখন রিকশায় উঠুন। দেখুন আপনার জন্য আমরা দুজনও ভিজে যাচ্ছি।”

আরশি রিকশাওয়ালার দিকে তাকালো। লোকটার মাথায় একটা পলিথিন দেওয়া। পুরো শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা ভদ্রতার সাথে বলল-

“আপা ভাইজান যখন এত করে বলছে আপনি উঠে পরেন। বৃষ্টি কমতে অনেক দেরি হইবো।”

আরশি আর কথা না বাড়িয়ে রিকশায় উঠে পরে। প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে রিকশার এক পাশে চেপে বসেছে। রিকশার ঝাকুনিতে রৌদ্রর শরীরের সাথে শরীরের লেগে যাওয়ায় আরশির অস্বস্তির পরিমান বেড়েই চলছে। নীল রঙের পলিথিনের নিচে হাত রাখা হাত অনবরত কচলাচ্ছে। রৌদ্র আড় চোখে বার বার আরশির দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ করে আরশির মেসেজটোন ভেজে উঠলো। আরশি সাইড ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে দেখলো ধ্রুব মেসেজ দিয়েছে।

” আরু কোথায় তুই?”

আরশি ছোট করে মেসেজের রিপ্লাই দিলো- “রিকশায়।”

একটু পর আবারও টুং করে মেসেজটোন ভেজে উঠলো। আরশি আবারও ইনবক্স ওপেন করে দেখল-

“সরি আরু আমার জন্য তোকে এই বৃষ্টির মধ্যে একা একা কষ্ট করে যেতে হচ্ছে। এবারের মতো মাফ দে। আর হ্যাঁ ভুলেও কিন্তু বাসায় যেয়ে আব্বুর কাছে বারিয়ে চারিয়ে বিচার দিবি না বলে দিচ্ছি। হুমকি দিচ্ছি না’রে জান অনুরোধ করছি না। লাভ ইউ আদ্রলিকা। তুই না আমার জান প্রান আদ্রলিকা বিল্লি। আমার কথাটা রাখিস আদ্রলিকা।”

আরশি ধ্রুবর মেসেজ পড়ে ফিক করে হেসে দিলো। রৌদ্র এবার আড় চোখে আরশির দিকে তাকালো। আরশি ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে। রৌদ্র এবার চোখমুখ শক্ত করে ফেলে।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“মিস আরু!”

আরশি কৌতুহলী চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র সামনের দিকে ফিরে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল-

“আপনার যদি হাত-পা ভাঙ্গার ইচ্ছে না থাকে তাহলে এদিকে চেপে বসুন। রিকশা থেকে পরে আপনার হাত-পা ভেঙে গেলে তার দ্বায় কিন্তু আমি নিতে পারবো না।”

রিকশার একদম সাইডে চেপে বসায় রৌদ্র এই মহান বক্তৃতা দিয়েছে সেটা বুঝতে আরশির অসুবিধে হয়নি। আরশি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। সত্যিই সে একদম সাইডে বসেছে। একটু ঝাকুনি খেলেই হয়তো রিকশা থেকে উল্টে রাস্তায় পরবে। আরশি দুরুদুরু বুক নিয়ে রৌদ্রর দিকে চেপে বসলো। রৌদ্রর সাথে একই রিকশায় বসায় অস্বস্তিতে মিইয়ে যাচ্ছে আরশি। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন কোনো মধুর সুরের সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করছে। রিকশা চলছে। সেই সাথেই চলছে দুজনের মাঝে নিরবতার প্রতিযোগিতা। এক সমুদ্র নিস্তব্ধতার মাঝেই পুরো রাস্তা অতিক্রম করেছে দুজন। আরশির বাসার কাছে রিকশা আসতেই আরশি উৎকন্ঠা হয়ে বলল-

“আমি এখানেই নামবো। মামা রিকশা থামান।”

রিকশাওয়ালা রিকশা থামানোর সাথে সাথেই আরশি রিকশা থেকে নেমে গেল। ব্যাকুলতার সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু টাকা বের করে রিকশাওয়ালার হাতে দিলো। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য মাথার উপর সাইড ব্যাগটা ধরে রাখলো। কিন্তু এতে কোনো লাভ হলো না। মুহুর্তেই আরশির শরীর ভিজে একাকার অবস্থা।

“আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে এখানে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন সিনিয়র সিটিজেন।”

আরশি রৌদ্রর উদ্দেশ্যে চেচিয়ে চেচিয়ে কৃতজ্ঞতার বানী দিয়েই একপ্রকার দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেল। রৌদ্র নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষন আরশির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এই চাহনিতে আরশির প্রতি রাগ প্রকাশ পাচ্ছে না-কি অন্য কিছু সেটা বোঝার ক্ষমতা কারও নেই। রৌদ্র ছোট্ট করে একটা উদাস নিঃশ্বাস ফেলে রিকশা চালাতে বলল।

—————————

বৃষ্টি হওয়ায় আজও আরশিদের বাসায় সব সময়ের মতো আড্ডার আসর জমেছে। সেই সাথে নানানরকম খাবারের আয়োজন। শাকিল আর আরশি সোফায় বসে ফোন টিপছে আর মাঝেমধ্যে একজন আরেকজনকে খোঁচা দিচ্ছে। পাশের সোফায় বসে আছে আরশি আর ধ্রুবর বাবা। খুব মনোযোগ দিয়ে টিভিতে খবর দেখছে আর একে অপরের সাথে সেই খবর নিয়ে টুকটাক কথা বলছে। আরশি আর ধ্রুবর মা রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ করে কলিংবেল বেজে উঠলো। শাকিল দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই ধ্রুব চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রয়িংরুমে আসলো। ধ্রুবকে দেখে ধ্রুব বাবা গম্ভীর গলায় বললেন-

“ধ্রুব তুই কোথায় ছিলি? তোর জন্য মা আজ বৃষ্টিতে ভিজে একা একা বাসায় এসেছে।”

(ধ্রুব বাবা শাহরিয়ার সাহেবের মা ছোট বেলায় মারা যায়। আর তার নিজেরও কোনো মেয়ে নেই। তাই তিনি আরশিকে সব সময় মা বলে ডাকেন। কখনো আরশির নাম ধরে ডাকেন না।) ধ্রুব আড় চোখে আরশির দিকে তাকালো। আরশির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সে নিজের মতোই ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ধ্রুব ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে লাগল-

“বাবা আমার এক্সট্রা ক্লাস… ”

ধ্রুবর কথার মাঝেই আরশির হাঁচি আসলো। ধ্রুব কথা থামিয়ে ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু করে আরশির দিকে তাকালো। আরশি টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুখ মুছেতে লাগলো৷ শাহরিয়ার সাহেব উদ্বিগ্ন গলায় আরশিকে বলল-

“কিরে মা তুই দেখি ঠান্ডা বাধিয়ে ফেলেছিস!” কথাগুলো বলেই উনি ধ্রুবর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। কঠিন গলায় বললেন- “তোকে দিয়ে একটা কাজও ঠিকমতো হয় না। মেয়েটার খেয়াল রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলাম সেটার মধ্যেও এতো হেয়ালি!”

আরশি এবার ঠোঁট চেপে হাসলো। ধ্রুব কটমট করে আড় চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বললো-

“বাবা আমার এক্সট্রা ক্লাস ছিলো।”

আরশির বাবা আদিব হাসান বিরক্তির সুরে বললেন-

“কি শুরু হয়েছে এখানে! ধ্রুব তুই যা তো গিয়ে ভেজা জামাকাপড় চেঞ্জ কর।”

ধ্রুব মুখ অন্ধকার করে শাকিলের রুমে চলে যায়। পরক্ষণেই আরশি ফিক করে হেসে দিয়ে বলল-

“বাহ! বড় বাবা তুমি তো ধ্রুবকে একদম ভেজা বিড়াল বানিয়ে দিলে।”

আরশির কথা শুনে ধ্রুবর বাবা শব্দ করে হেসে উঠলো। শাকিল ভ্রু জোড়া কুচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-

“তুই তো দেখি খুব ডেঞ্জারাস মহিলা আশু।”

আরশি দাঁত কেলিয়ে শাকিলের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বলল-

“মহিলা হবে তোর বউ। আমি হলাম ছোট্ট একটা নিষ্পাপ মেয়ে। ভদ্রভাবে কথা বলতে শিখ হারামি।”

শাকিল চোখমুখ খিঁচে চাঁপা কন্ঠে বলল- “ফাজিল আগে তুই শিখ বড় ভাইদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়।”

আরশি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হেলেতে দুলেতে নিজের রুমে চলে গেল।

——————————

“আশু বাবা বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে ফেলেছে। দু’দিন পরেই বিয়ে। আজ ভার্সিটি থেকে এসেই দেখলাম বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। এখন আমি কি করবো আশু? আর বাবাকেই বা কিভাবে আদ্রাফের কথা বলবো?”

আরশি ফোন রিসিভ করতেই কাসফিয়া এক দমে কথা গুলো বলল। কাসফিয়ার ধরে আসা গলায় কথা গুলো শুনে আরশির মনে বিষন্নতার কালো ছাঁয়া ছেয়ে গেল। কাসফি আর আদ্রাফের ভালোবাসা গত দু’বছর ধরে দেখে আসছে আরশি। একই বয়সের হয়েও সম্পর্কে কতটা ম্যাচুরিটি ছিল। ঝগড়াঝাটি, মান-অভিমান যতকিছুই হয়েছে দিন শেষে ঠিকই একে অপরের ভালোবাসার কাছে ধরা দিয়েছে। কখনো একে অপরকে ছেড়ে যাওয়া কথাও বলেনি। আর আজ এই মধুর ভালোবাসার সম্পর্কটাই অনিশ্চিত! হঠাৎ করেই এমন হয়ে যাবে এটা তো কেউ কল্পনাও করেনি।

“আদ্রাফকে বলেছিস!”

আরশি প্রশ্নে উত্তরে কাসফিয়া ছোট করে উত্তর দিল-

“হুম কিছুক্ষণ আগেই বলেছি।”

“আদ্রাফ কিছু বলেনি?”

“নাহ, চুপচাপ ফোন রেখে দিয়েছে।”

————————

প্রায় আধঘন্টা ধরে আরশি লাইব্রেরির একটা টেবিলে চুপ করে বসে আছে। সামনেই টেবিলের উপর একটা বই খুলে রাখা। অথচ আরশির দৃষ্টি আর মনোযোগ কোনোটা-ই বইয়ের দিকে নেই। ধ্রুব আরশির পাশের চেয়ার বসে আছে। একটু পর পর আরশির দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। এই প্রথম আরশি লাইব্রেরিতে এসে বইয়ের মাঝে চিঠির সন্ধান না করে চুপচাপ বসে আছে। কাসফিয়ার বিয়ের ঝামেলাতেই আরশির মাথা থেকে চিঠির কথা বেরিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আরশির মনে শুধু তার প্রানপ্রিয় বন্ধুদের অনিশ্চিত নতুন জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা। ঘন্টা খানেক আগেই কাসফিয়ার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। কারও সাহস হয়নি কাসফিয়ার বাবাকে আদ্রাফের কথা বলার। এমনকি আদ্রাফ নিজেও এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বুঝে গেছে তাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না। সমবয়সী, বেকার ছেলের হাতে কোনো বাবাই তার মেয়েকে তুলে দিবেন না। আদ্রাফ হাসিমুখেই কাসফিয়ার বিয়েতে উপস্থিত ছিল। সব বন্ধুদের মুখেই ছিলো কৃত্রিম হাসি। কারও মনের মধ্যে ছিল চাপা কষ্ট, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার তীব্র হাহাকার, আর্তনাদ। আবার কারও মনে ছিল বন্ধুদের হারিয়ে ফেলার ভয়। কাসফিয়াকে বিদায় দেওয়ার পর থেকেই আরশি চুপ করে আছে। শুধু আরশি না তার সব ফ্রেন্ডদেরই একই অবস্থা৷ কাসফিয়াও কেমন যেমন নির্জীব হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানি পরছে না, কথা বলছে না যেন এক প্রানহীন কাঠের পুতুল। আর আদ্রাফ! আদ্রাফ তো কাসফিয়ার কবুল বলার আগ মুহুর্ত থেকেই গায়েব। ফোনে করেও পাওয়া যায়নি তাকে।

“আদ্রলিকা! দেখবি না আজ বইয়ের মধ্যে চিঠি আছে কি-না!”

আরশি ক্লান্ত চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো। আরশির এই ক্লান্ত চোখ দুটো যেন চিৎকার করে বলছে সে ক্লান্ত, প্রতিদিন চিঠির অপেক্ষা করতে করতে সে বড্ড বেশিই ক্লান্ত। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-

“আচ্ছা তুই বসে থাক আমিই গিয়ে দেখছি চিঠি আছে কি-না।”

ধ্রুব কথা গুলো বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আবারও আরশির দিকে একপলক তাকালো। আরশির মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সে আগের মতোই মনমরা হয়ে বসে আছে। ধ্রুব চলে গেল লাইব্রেরির একদম শেষের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই ধ্রুব উত্তেজিত কণ্ঠে চেচিয়ে উঠলো-

“আদ্রলিকা চিঠি।”

চলবে…