রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-১০+১১+১২

0
456

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১০(স্পেশাল)
#Saiyara_Hossain_Kayanat

মনের মধ্যে হাজারো সংকোচ আর অস্বস্তি নিয়ে বসে আছি আরশি। তার বাম পাশের চেয়ারেই ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে ফোনে গেমস খেলছে। আরশি থমথমে চোখে ধ্রুবর ডান হাতে পরা ঘড়ির দিকে তাকালো। আটটা বাজতে আরও পনেরো মিনিট বাকি। আরশি ধ্রুব দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল-

“ধ্রুব! তুই কি দয়া করে তোর গেমস খেলা বন্ধ করবি!”

ধ্রুবর কোনো প্রতিক্রিয়া আরশি লক্ষ্য করলো না। সে আগের মতোই গেমস খেলে যাচ্ছে। তার আশেপাশে এই ফোন ছাড়া অন্য কিছুর উপস্থিতি সে লক্ষ্য করেছে কিনা আরশির সন্দেহ। মনে হচ্ছে এই পুরো জায়গায় ফোনটা ছাড়া আর কিছুই ধ্রুবর নজরে পরছে না। আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। চোখ-মুখে শক্ত করে কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“তুই কি আমার কোনো কথা শুনছিস!”

এবারও ধ্রুবর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আরশি ধ্রুবর দিকে জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে নেয় উল্টো দিকে। কয়েক মিনিট পর ধ্রুব আগের ভঙ্গিতে বসেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“একে তো সকাল সকাল আমাকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে এখানে ঘন্টা খানেক সময় ধরে বসিয়ে রেখেছিস। এখন আবার তুই নিজেই গাল ফুলিয়ে ফেললি!”

আরশি ধ্রুবর দিকে না তাকিয়েই শক্ত গলায় বলল-

“তোকে তো দেখে মনে হয় না তুই আমার সাথে এখানে এসেছিস। তোর এই ফোন ছাড়া দুনিয়াতে আর কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে।”

ধ্রুব ফোনটা অফ করে টেবিলে রেখে শান্ত গলায় বলল-

“এখানে বসে আছি প্রায় পঞ্চাশ মিনিট। এতক্ষনে তুই আমার ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিস এগারো বার। আমার গেমসের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছিস ছয়বার। নিজের চুল গুলো ঠিক করেছিস তিনবার। আর হাত কচলাচ্ছিস অনবরত। এখন বল আর কিসের প্রতি নজর রাখতে হবে!”

আরশি আড় চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব অমায়িকভাবে হাসলো। হাসির ফলে বাঁকা দাঁতটা স্পষ্ট দেখাচ্ছে। ধ্রুবর হাসিতে যেন তার চোখ দুটোও হাসছে।

“এতো ভাব নিতে হবে না। আমি জানি তোর স্মৃতিশক্তি প্রখর। আচ্ছা ভিতরে যাবি না-কি এখানে বসেই অপেক্ষা করবো!”

ধ্রুব একটু কাত হয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে দিকে তাকালো। এখনো রেস্টুরেন্টের ভেতরে পরিষ্কারের কাজ চলছে। রেস্টুরেন্ট খোলার সময় হলো সকাল আটটা। আরশি আর ধ্রুব এসেছে সাতটায় তাই তাদের দুজনের জন্য বাহিরের টেবিল গুলো পরিষ্কার করে জায়গা দেওয়া হয়েছে।

“এখনও ভেতরের কাজ শেষ হয়নি। এখানেই বসে থাক আরও কিছুক্ষণ।”

আরশি কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইলো। ধ্রুব আবারও ফোনে গেমস খেলা শুরু করেছে।

——————————

“ভাই তোর কি আমার শান্তি সহ্য হয়না! সকাল সকাল এসব কি শুরু করেছিস বল তো! চেনা নেই জানা নেই অচেনা একটা মেয়ের জন্য এখানে আসা কি ঠিক হলো! যদি মেয়েটা না আসে তখন কি করবি?”

ক্লান্ত গলায় একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে নির্বান। ঘুমে যেন চোখ মেলে তাকাতেই তার অসুবিধে হচ্ছে। রৌদ্র নির্বানের কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করেই হেঁটে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের কাছে আসতেই দাঁড়িয়ে পরলো। সামনের ডান পাশের টেবিলে বসে থাকা মানুষ দুটোর কথা শুনেই থমকে দাঁড়িয়েছে রৌদ্র। মানুষ দুটোর পেছন সাইড দেখা যাচ্ছে।

“আরু আমার খুব খিদে পেয়েছে। এখনো তো এক কাপ কফিও দিয়ে গেলো না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে!”

আরশি চোখ ছোট করে ধ্রুবর দিকে তাকালো। একটা মেকি দিয়ে বলল-

“ওহ-হো এমন হবে জানলে তো আমি আগেই তোমার জন্য বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসতাম।”

আরশির ত্যাড়া কথা শুনে ধ্রুব সরু চোখে আরশির দিকে চেয়ে রইলো। নির্বান পেছন থেকে রৌদ্রকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

“কিরে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন!”

রৌদ্র নির্বানের দিকে এক নজর তাকিয়ে গম্ভীর পায়ে ভেতরে চলে গেল। পেছন পেছন নির্বানও যাচ্ছে। আরশি এক ঝলক তাকালো সেদিকে রৌদ্রকে দেখতে না পেলেও নির্বানের একপাশ দেখতে পেরেছে। তবে আরশি সেটা নিয়ে তেমন কোনো পাত্তা দেয়নি। এখন আর রেস্টুরেন্ট আগের মতো ফাঁকা নেই। অল্পকিছু মানুষ এসেছে এতক্ষনে। নির্বানকেও তাদের মত ভেবেই সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না।

কেন যেন ধ্রুব আর আরশিকে এক সাথে দেখলেই রৌদ্রর মুখের ভাবভঙ্গিমা বদলে যায়। স্বাভাবিক থেকেই হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে যায়। তার এই পরিবর্তনের কারণ রৌদ্র নিজেও জানে না। রৌদ্র ভেতর এসে রেস্টুরেন্টের একদম কর্নারের টেবিলে বসলো। তার সামনেই নির্বান টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রৌদ্র বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসে আছে। একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার জানালা দিয়ে বাহিরে বসে থাকা আরশি আর ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছে। রৌদ্রর চোখেমুখে কোনো ভাব প্রকাশ পাচ্ছে না। কেমন যেন নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে বসে অপেক্ষা করছে অচেনা একটা মেয়ের জন্য।
ধ্রুব কফির মগে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এখনো কেউ আসছে না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবি আরু!”

আরশি মলিন মুখ তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আরশির মাথায় হাত রেখে সহজ গলায় বলল-

“মন খারাপ করিস না আদ্রলিকা। লোকটা হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেনি।”

আরশি গম্ভীর গলায় বলল-

“লোকটা হয়তো আমাকে বোকা বানানোর জন্যই এমন করেছে। আমারই ভুল হয়েছে অচেনা একজনের কথায় বিশ্বাস করে সকাল সকাল এখানে অপেক্ষা করা।”

আরশি উঠে দাঁড়ালো। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আবার গম্ভীর গলায় বলল-

“যাইহোক এসব বাদ দে। এখন বাসায় চল। দেরি হচ্ছে।ভার্সিটিতে যেতে হবে তো আবার।”

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এসব নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। সে ভালো করেই জানে আরশি এখন এই বিষয়টা ইগ্নোর করতে চাচ্ছে। আরশি ধ্রুবকে উঠতে না দেখে ধ্রুবর শার্টের হাতা ধরে টেনে বলল-

“আরে ভাই চল না।”

ধ্রুব তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে টাকা বের করে বিলের সাথে রেখেই উঠে দাঁড়ালো।

“সত্যিই চলে যেতে চাচ্ছিস!”

আরশি ভ্রু কুচকে তীক্ষ চাহনি নিক্ষেপ করলো ধ্রুবর দিকে। আরশি কিছু না বলেই ধ্রুবর শার্টের হাতা ধরে টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। রৌদ্র সরু চোখে তাকিয়ে আছে আরশি আর ধ্রুবর দিকে। নির্লিপ্ত চোখ দুটোতে রাগের আভাস ছেয়ে গেছে৷ নির্বান মাথা তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলল-

“কিরে আসছে তোর আদ্রলিকা?”

রৌদ্র ঘড়ির দিকে তাকালো। আটটা পঞ্চাশ বাজে। রৌদ্রর কপালে গভীর ভাজ পরলো। নিরাশাজনক চাহনিতে নির্বানের দিকে চেয়ে বলল-

“হয়তো কোনো কারণে আসতে পারছে।”

“তোর কি মনে হয় তোর চিঠি পেয়ে অচেনা একটা মেয়ে ড্যাংড্যাং করে তোর সাথে দেখা করতে এসে পরবে! মেয়েটা তো চিঠি দিয়ে জানায়ও নি আসবে কি-না। আমার মনে হয়না মেয়েটা তোর চিঠিকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে।”

বিজ্ঞ মানুষদের মতো ভাব নিয়ে কথা গুলো বলেই নির্বান দু হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে নিল। চেয়ারের গাঁ এলিয়ে দিয়ে রৌদ্রর প্রতিত্তোরে অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্র কফির মগের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শীতল গলায় বলল-

“আমার চিঠিকে গুরুত্ব না দিলে এতদিন পরেও কিভাবে চিঠির উত্তর পেলাম! আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করতো বলেই তো আমি চিঠির উত্তর পেয়েছি। আজ হয়তো কোনো কারণে এখানে আসতে পারেনি। তবে আমার মনে হচ্ছে এখানে না আসার কারণটা অবশ্যই আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিবে।”

নির্বান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-

“এই বয়সেও তোর এমন পাগলামি ঠিক মানাচ্ছে না দোস্ত।”

রৌদ্র ভড়ে গিয়ে বলল-

“তোদের সবার চোখে কি আমাকে বয়ষ্ক লোক মনে হয়!”

“তোদের সবার মানে কি বলতে চাচ্ছিস!”

রৌদ্র দাঁড়িয়ে পকেটে এক হাত গুজে দিয়ে বলল-

“কিছু না। বিলটা দিয়ে আয়।”

কথাটা বলেই রৌদ্র হাঁটা শুরু করলো। নির্বান বেকুবের মতো তাকিয়ে থেকে আহত গলায় বলল-

“তোর জন্য এত কষ্ট করে আসলাম এখানে। তুই নিজেই কফি খেলি আর এখন আমাকে বলছিস বিল দিতে! এটা কিন্তু ঠিক না দোস্ত।”

“বেশি কথা না বলে বিল দিয়ে আয়। না হলে আমি একাই চলে যাবো।”

—————————

“আদ্রলিকা একটু আমার সাথে চল তো।”

ধ্রুব কথাটা বলেই রাস্তার পাশের একটা ফুলের দোকানের দিকে চলে গেল। আরশি বিস্মিত হয়ে ধ্রুবর সাথে গেল। ধ্রুব বেলি ফুলের একটা গাজরা কিনে আরশির হাতে ধরিয়ে দিলো। আরশি কৌতুহলী চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। ধ্রুব আরশির নাকে হাল্কা টান দিয়ে বলল-

“বলদের মতো তাকিয়ে আছিস কেন!”

“এগুলো কিনে দিলি কেন!”

ধ্রুব সামনের রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল-

“এত সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার কারণটা নিশ্চয়ই ছোট মাকে বলা যাবে না। তাই বাসায় যেয়ে বলবি আমার সাথে ফুল কিনতে বেরিয়েছিলি। আর আজকে তো শাড়ি পরবি শাড়ির সাথে নিশ্চয়ই ফুল লাগবে তাই না!”

আরশি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল-

“বাহ তুই তো সত্যিই খুব বুদ্ধিমান ধ্রুব। আমি তো এসব কিছুই ভেবে রাখিনি। আসার সময় তো আম্মু ঘুমিয়ে ছিল কিন্তু এখন তো গেলেই পুলিশের মতো জেরা শুরু করবে।”

আরশির কথায় ধ্রুব হাসলো।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কোথায় গিয়েছিলি সকাল সকাল?”

ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই শাকিলের গম্ভীর গলা শুনেই থামকে গেল আরশি। হঠাৎ করেই আরশির মনে ভয় ঢুকে গেল। ভয়টা অবশ্য শাকিলের জন্য না। এই প্রথম চুপিচুপি একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল বলেই এই ভয়ের সৃষ্টি। খুব অচেনা একজন। যাকে আগে কখনো দেখেনি। তবুও তার ছোট্ট একটা চিঠি পেয়ে গিয়েছিল দেখা করতে। কিন্তু ফিরেছে নিরাশ হয়ে। আরশির মন ঘন-কালো মেঘে ঢেকে গেছে এই মুহূর্তে। এই কালো মেঘ হলো মনখারাপের মেঘ। আরশির মন খারাপ হচ্ছে মানুষটার দেখা না পাওয়ায়। হঠাৎ করেই মানুষটাকে দেখার তীব্র ইচ্ছে আরশির মনে হানা দিলো। আরশিকে চুপ থাকতে দেখে শাকিল কন্ঠে খানিকটা কাঠিন্যতা আর সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“কথা বলছিস না কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।”

আরশি তার ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শাকিলের দিকে তাকালো। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলবে তার আগেই ধ্রুব ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“উফঃ আরু মনে করে ফুলগুলো নিয়ে আসবি তো না-কি! আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিস আর আমি তো ভুলে ফুল গুলো নিয়েই বাসায় চলে গিয়েছিলাম।”

শাকিল আর আরশি ভ্রু কুচকে ধ্রুবকে দেখছে। আরশির মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ধ্রুব আর আরশিকে দেখে জিজ্ঞেস করলো-

“সকালে রুমে ছিলি না। কোথায় গিয়েছিলি তোরা!”

ধ্রুব টেবিলের উপর ফুল গুলো রেখে শাকিলের পাশে বসলো। ছোট করে শ্বাস ছেড়ে উদাস কন্ঠে বলল-

“তোমার মেয়ে আমাকে শান্তি দিয়েছে সেটা কখনো দেখেছো! সকাল সকাল বাসায় যেয়ে আমাকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে বলল গাজরা লাগবে। ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান সবাই শাড়ি পরবে। তাই শাড়ির সাথে নাকি ওর গাজরাও পরতে হবে। এখন তোমরাই বলো এতো সকালে কি কোনো ফুলের দোকান খোলা থাকার কথা! কত হাঁটাহাঁটি করে অবশেষে একটা ফুলের দোকান খোলা পেয়েছি।”

আরশি অবিশ্বাসের চোখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব কতো সুন্দর বিনা সংকোচে সত্য-মিথ্যা দুটো মিলিয়ে কথা বলছে।

“তোর গাজরা লাগবে সেটা আগে বললেই তো আমরা রাতে নিয়ে আসতাম।”

শাকিলের কথার সাথে সায় দিয়ে আরশির মা কটক্ষ গলায় বলল-

“শাকিল তো ঠিকই বলছে। তোর ফুল লাগলে রাতেই বলতে পারতি। সকাল সকাল এভাবে না বলে যাওয়ার কি দরকার ছিলো। তার উপর আবার ধ্রুবকেও তোর পেছন পেছন ঘোরালি।”

আরশি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছে না। ধ্রুব সব কিছু সামলিয়ে নিবে বলেই তার বিশ্বাস।

“আর বলো না ছোট মা। মহারানী নাকি একদমই ভুলে গিয়েছিল ফুলের কথা। স্বপ্নের মধ্যে ফুল দেখেই ওনার মনে পরেছে। তবে এতে ওর কোনো দোষ নেই। দোষ তো তোমারই। তুমিই ওকে পেটে নিয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওনি। তাই এমন একটা মাথা মোটা মেয়ে হয়েছে তোমার পেটে।”

“তুই ঠিকই বলেছি ধ্রুব আরশি পেটে থাকতে আমি কিছুই খেতে পারিনি। সব কিছুতেই অনিহা ছিল আমার…..”

আরশির মা বিষন্ন গলায় নানানরকম আফসোসের বানী প্রকাশ করতে বসে পরলেন সোফায়। এটা তার সব সময়কার অভ্যাস। আরশি তার মা’র কথায় কান দিলো না। ধ্রুবর দিকে তীরের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই হনহনিয়ে রুমে চলে গেল।

————————

আদ্রলিকা!! এইইইই আদ্রলিকা তাড়াতাড়ি আয়।”

আরশিদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে চেচিয়ে ডাকছে ধ্রুব। কালো রঙের মধ্যে লাল সুতোয় ডিজাইন করা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। সামনের চুল গুলো খানিকটা অগোছালো। বার বার ঘড়িতে টাইম দেখছে আবারও চেচিয়ে উঠছে। অবশেষে আরশি বেরিয়ে আসলো। আরশিকে দেখেই ধ্রুবর চেচামেচি বন্ধ হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে আরশির দিকে চেয়ে আছে। লাল রঙের জামদানী শাড়ি পরেছে আরশি। চুলগুলো খুলে রাখা। মুখে কোনো মেকআপ নেই। হাল্কা লিপস্টিক আর কাজল। ব্যস এইটুকুতেই আরশিকে মোহনীয় লাগছে। ধ্রুব আরশিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বলল-

“ফুল কোথায়?”

আরশি কপাল চাপড়ে বলল- “উফঃ তোর চেচামেচিতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আরেকটু দাঁড়া আমি আসছি।”

আরশি দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে আসলো। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল-

“এবার সব কিছু ঠিক আছে তো!”

ধ্রুব কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বুকের বা পাশে হাত রেখে শীতল গলায় বলল-

“হায়! শ্যামলতা আমি তো তোমার লাল শাড়ির মায়ায় জড়িয়ে গেলাম। তোমার কাজল কালো হরিণী চোখের গভীরতায় হারিয়ে গেলাম আমি। তোমার খোলা চুলে আটকে রাখা গাজরার সাথে যে আমার মনটাও আটকে গেছে শ্যামলতা। আমার হৃদয় ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে এই শ্যামলতার মুগ্ধতায়।”

আরশি ড্যাবড্যাব করে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুবও শীতল চাহনিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই ধ্রুব আর আরশি এক সাথে নাক ছিটকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধ্রুব মুখ বিকৃতি করে বলল-

“ছিঃ ছিঃ ওয়াক থু। চল চল তাড়াতাড়ি চল। এমনিতেই দেরি হয়েছে অনেক।”

আরশি ধ্রুবর পিঠে সজোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল-

“একদম বাজে কথা বলবি না হারামি। চল এখন।”

আরশি হাঁটা শুরু করলো। ধ্রুবও হাসতে হাসতে আরশির পেছন পেছন হাঁটছে।

———————————

“কিরে নীলা আর সুপ্তি কই?”

নীল পেছন ফিরে আরশির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিম্ন স্বরে বলল-

“ওরা ওয়াশরুমে গেছে। সাজগোজ করেছে হয়তো।”

“আচ্ছা তাহলে তোরা এখানে থাক আমি ওদের কাছে যাচ্ছি।”

আরশি কথাটা বলেই পা বাড়াতে নিলেই ধ্রুব শাসনের সুরে বলল-

“বাহিরে কিন্তু অনেক মানুষ সাবধানে যাস। আর হ্যাঁ ভালো করে শাড়িটা সামলিয়ে রাখিস। শাড়িতে পেচিয়ে আবার উলটে পরিস না।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে অডিটোরিয়াম থেকে চলে গেল। ধীর পায়ে সাবধানে দোতালায় চলে আসলো। কিন্তু দোতলার ওয়াশরুম বন্ধ দেখে তিনতলায় চলে আসলো। এখানেও মেয়েদের ওয়াশরুমে খুঁজে কোনো মানুষ দেখলো না। চারতলা যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে যেতেই রৌদ্র ছেলেদের ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আরশিকে দেখে ডাক দিল-

“এই যে মিস আরু এদিকে আসুন।”

বাহিরের চেচামেচি আর গানের শব্দে আরশি রৌদ্রর ডাক শুনতে পেল না। সে নিজের মতোই শাড়ির কুচি ধরে নিচের দিকে চেয়ে সাবধানতার সাথে হেঁটে যাচ্ছে। রৌদ্র এবার উচ্চস্বরে ডাকে উঠলো-

“এই যে শুনছেন মিস আরু!”

আরশি থমকালো। দৃষ্টি তুলে সামনের দিকে চেয়ে খুঁজতে লাগলো কে ডাকছে।

“কষ্ট করে একটু ডান পাশেও ঘাড় বাকিয়ে খুঁজুন মিস আরু।”

আরশি তাকালো। রৌদ্রকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত অবস্থা তার দিকে এগিয়ে আসলো আরশি। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল-

“ডেকেছেন কেন আমাকে?”

রৌদ্র দু’হাত সামনে এগিয়ে দিয়ে সহজ ভঙ্গিতে বলল-

“পাঞ্জাবির হাতা গুলো একটু উপরে তুলে দিন তো।”

আরশি বিস্মিত হলো। গোলগোল চোখে হাত দুটোর দিকে চেয়ে রৌদ্রর মুখের দিকে তাকালো। তার মুখের ভাবভঙ্গি বরাবরের মতোই স্বাভাবিক, বিকার হীন। আরশি ক্ষীণ গলায় বলল-

“মানে! কি বলছেন! আমি বুঝতে পারছি না।”

“আমি যা বলেছি অতিসহজ এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেছি। এখানে তো না বোঝার মতো কিছুই নেই মিস আরু।”

“আমি কেন আপনার পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করে দিবো? আপনি নিজে করুন।”

আরশি গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বলেই চোখের চাহনি কঠিন করলো। রৌদ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দু’হাতের আঙুল গুলো ছড়িয়ে আরশির মুখের সামনে এনে বলল-

“ভালো করে দেখুন আমার হাতে আঠা লেগে আছে। তাই এখানে হাত ধুতে এসেছি। কিন্তু হাতে আঠা লেগে থাকায় পাঞ্জাবির হাতা উপরে তুলতে পারছি না। আর আশেপাশে তেমন কেউ নেই তাই বাধ্য হয়ে আপনাকেই ডাক দিলাম।”

আরশি রৌদ্রর হাত মুখের সামনে থেকে সরিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। ক্লান্ত গলায় বলল-

“আচ্ছা বুঝেছি।”

রৌদ্র কিছু না বলে আবারও হাত এগিয়ে দিলো আরশির দিকে। আরশি কথা না বারিয়ে সুন্দর মতো রৌদ্রর পাঞ্জাবির হাতা কনুইয়ের কাছাকাছি পর্যন্ত উঠিয়ে দিলো। রৌদ্র ওয়াশরুমের ভেতরে গিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে হাত ধুতে ধুতে উচ্চ গলায় বলল-

“আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারছি না। কারণ আপনাদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্যই আমার এই অবস্থা হয়েছে।”

আরশি গম্ভীর কন্ঠে বলল-

“লাগবে আপনার ধন্যবাদ আমি আসছি।”

“আরেকটু অপেক্ষা করুন।”

আরশি বিরক্ত হয়ে বলল- “কেন?”

রৌদ্রর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল- “দরকার আছে তাই।”

রৌদ্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আরশির কাছে এসে দাঁড়ালো। আরশি সরু চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল-

“কিসের দরকার আছে?”

রৌদ্র কিছু বলল না। ধীর পায়ে আরশির একদম কাছে এগিয়ে আসলো। রৌদ্রকে এতটা কাছে আসতে দেখে আরশি আমতা-আমতা করে জড়ানো কন্ঠে বলল-

“কি করছেন আপনি?”

আরশির প্রশ্নে রৌদ্র মুখ দিয়ে ‘টু’ শব্দও বের করলো না। নিঃশব্দে আরশির দিকে ঝুঁকে মাথার পাশ দিয়ে পেছনে আরশির চুলের দিকে তাকালো। আরশির মাথার দু’পাশে হাত দিয়ে ঝুলে থাকা গাজরাটা ঠিক করতে লাগলো। রৌদ্রর এহেন কাজে আরশি মুর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রর আরশির গাজরা ঠিক করে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

“গাজরা পরে যাচ্ছিলো ঠিক করে দিলাম। কষ্ট করে আপনাকে ধন্যবাদ বলতে হবে না। আমি নিজেই ধন্যবাদের পাওনা মিটিয়ে নিতে পারি।”

আরশি আগের মতোই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। হয়তো এই পরিস্থিতিতে তার কথা গুলো গলাতেই আটকে আছে। রৌদ্র আরশির আঁচল তুলে নিজের হাত মুছতে লাগলো। আরশি এবার আরেক দফা বিস্মিত হলো। রৌদ্রর এমন উদ্ভট কাজে আরশির অবাকের পরিমাণ যেন আকাশ ছুঁই ছুঁই। রৌদ্র হাত মোছা শেষে শান্ত গলায় বলল-

“হিসাব বরাবর। ধন্যবাদের বিনিময়ে আমি আপনার কাছ থেকে এই সামান্য একটু সাহায্য নিয়ে নিলাম। এবার আপনি আসতে পারেন।”

‘আসতে পারেন’ কথাটা শুনতে দেরি তবে আরশির অস্বাভাবিক হতে দেরি হলো না। অস্থিরতার সাথে আরশি হন্তদন্ত হয়ে সামনের দিকে যেতে নিলেই রৌদ্র ভাবলেশহীন ভাবে বলল-

“উল্টো দিকে যাচ্ছেন তো।”

আরশি আরেকটু অস্বস্তিতে পরে গেল। পেছন ঘুরে চারতলার সিড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। রৌদ্র আরশির দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চেচিয়ে উঠে বলল-

“যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়ান মিস আরু।”

আরশি কৌতুহলী চোখে পেছন ফিরে রৌদ্র দিকে তাকালো। রৌদ্র নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“আমার দিকে না সামনের দিকে ঘুরেই দাঁড়ান।”

আরশি কিছু না বুঝে কপাল কুচকে রৌদ্রর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। রৌদ্রর কথা মতো সামনের দিকে ফিরে দাঁড়ালো। রৌদ্র সরু চোখে আরশিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আরশির শাড়ি, কোমড় পর্যন্ত খোলা চুল দেখেই রৌদ্রর চোখের সামনে তার রুদ্রাণীর ছবিটা ভেসে উঠলো। কেন কেন খুব মিল পাচ্ছে তার রুদ্রাণীর সাথে। আরশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তিতে আরশির মুখ ফ্যাকাসে বর্নের আসছে।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১২
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“রুদ্রাণী!”

আরশির দিকে চেয়ে আনমনেই অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করল রৌদ্র। আরশি এখনও থমথমে চেহারায় রৌদ্রর ঠিক উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রৌদ্র কি করতে চাচ্ছে সেটা বোঝা আরশির বোধগম্য নয়। আরশি কোনো প্রকার নড়াচড়া না করেই ক্ষীণ গলায় বলল-

“আমি কি এখন যাবো!”

রৌদ্র কোনো কথা বলল না। হনহনিয়ে আরশির পাশ কেটে সিড়ি দিয়ে নিচে চলে গেল। রৌদ্র হাঁটতে হাঁটতে বুকে হাত দিয়ে মনে মনে নিজেকেই বলতে লাগলো- “এসব কি ভাবছি আমি! অনেক শাড়ি পরা মেয়েদের চুলই তো এই রকম তাই বলে কি সবাই আমার রুদ্রাণী না-কি! রুদ্রাণী কোথায় তুমি! তোমার ছবি দেখতে দেখতে আমার এই তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো এখন সব মেয়েদের মাঝেই শুধু তোমাকে খুঁজে বেড়ায়। আমি বোধহয় তোমায় দেখতে পাওয়ার আশায় উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি। রুদ্রাণী নামক অসুখে তীব্র ভাবে আক্রান্ত হয়ে গেছে এই রৌদ্র।”

আরশি হতবাক হয়ে চেয়ে আছে সিড়ির দিকে। “আমাকে এভাবে দাঁড় করালেন কেন! আর কোনো কিছু না বলে চলেই বা গেলেন কেন উনি?” আরশি মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলো। সিড়িতে কয়েক জোড়া পদধ্বনির শব্দে আরশির হুশ ফিরলো। কৌতুহলী চোখে ওপরে সিড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই নীলা আর সুপ্তির দেখা পেল। আরশিকে দেখে নীলা উৎকন্ঠা হয়ে বলল-

“এই আশু! এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখানে? নীল সেই কখন ফোন দিয়ে বলল তুই না-কি আমাদের কাছেই আসছিস। তাই তো আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন দেখি তুই এখানে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস।”

নীলা আর সুপ্তি আরশির পাশে এসে দাঁড়ালো। আরশি বিধ্বস্ত গলা বলল-

“তোদের খুঁজছিলাম। নিচতলা থেকে শুরু করে এখানের সব গুলো ওয়াশরুম খুঁজেছি। আর কিছু করছিলাম না।”

সুপ্তি কপাল কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“এভাবে কথা বলছিস কেন!”

আরশি হকচকিয়ে উঠে বলল- “কই কিছু না তো। নিচে চল। ধ্রুব ওরা অপেক্ষা করছে।”

নীলা আর সুপ্তির প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করেই আরসি থমথমে পায়ে নিচে যেতে লাগলো। নীলা আর সুপ্তি আরশির দিকে চেয়ে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ছাড়লো।

—————————

“আদ্রাফ তুই???”

অডিটোরিয়ামে এসে ধ্রুবর পাশে আদ্রাফকে বসে থাকতে দেখে খানিকটা চমকে গেল আরশি। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ ম্লান হাসি দিয়ে বলল-

“আমাকে এখানে আশা করিসনি তাই না!”

আরশি মলিন মুখ করে বলল- “হুমম”

আদ্রাফ তাদের পেছনের সারির চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল-

“তোরা সবাই বস তাড়াতাড়ি না হলে জায়গায় পাবি না পরে।”

আরশি, নীলা আর সুপ্তি বসে পরলো। বেশ কিছুক্ষন সময় পাড় হয়ে গেল চুপচাপ বসে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে। হঠাৎই আরশি আদ্রাফের পিঠে খোঁচা দিল। আদ্রাফ ভ্রু বাঁকিয়ে আরশির দিকে চেয়ে চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো-

“কি হয়েছে! খোঁচাখুঁচি করছিস কেন?”

আরশি আদ্রাফের দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল-

“চল না বাহিরে যাই।”

“উফ আশু ফাজলামো করিস না তো। চুপচাপ বসে বসে নাচ দেখ।”

আরশির আদ্রাফের পাঞ্জাবির কলার হাল্কা টানতে টানতে বিনয়ের ভঙ্গিতে বলল-

“গানের শব্দে মাথা ব্যথা উঠে যাচ্ছে। শুধু শুধু এখানে বসে না থেকে চল আমরা বাহিরে গিয়ে আড্ডা দেই।”

আদ্রাফ কিছু একটা ভেবে ধ্রুব আর নীলকে নিম্নস্বরে বলল-

“ভাই আশু এখানে থাকতে চাচ্ছে না।”

ধ্রুর হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লো। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“আমি জানতাম এই মাইয়া কখনোই পুরো অনুষ্ঠান দেখতে পারবে না। আচ্ছা চল বাহিরেই যাই।”

আদ্রাফ, ধ্রুব আর নীল উঠে দাঁড়ালো। তাদের কে দেখে আরশিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঝট করে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বলল-

“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ জান্টুসরা। চল চল বাহিরে চল।”

সবাই অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসলো। ভার্সিটির পেছনের দিকের পুরনো আম গাছের বাগানে আসলো। সবাই এক সাথে ঘাসের উপর গোল হয়ে বসলো।

“আচ্ছা হঠাৎ করে আমাদের কাউকে না জানিয়ে ভার্সিটিতে আসলি ব্যাপার কি? আমরা তো ভেবেছিলাম তোকে আর দেখতেই পাবো না।”

সুপ্তির কথায় সবাই বিস্ময় নিয়ে আদ্রাফের দিকে চেয়ে রইলো। আদ্রাফ নিচের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বিষন্ন গলায় বলল-

“এই কিছুদিন রুমের মধ্যে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি। আম্মু খুব চিন্তা করছিলো আমাকে দেখে। বার বার এটা ওটা জিজ্ঞেস করতোই। তারপর একদিন ঠিক করলাম আমি বিদেশ চলে যাবো। ওখানের পড়াশোনা করবো তার পাশাপাশি না হয় পার্ট-টাইম জবও করবো। তারপর হঠাৎ করেই মনে হলো..”

আদ্রাফ থামলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুটা নেড়েচেড়ে বসলো। আরশি উত্তেজিত হয়ে বলল-

“সত্যিই বিদেশ চলে যাবি? তার মানে তুই কি আজকে আমাদের সাথে শেষ দেখা করতে এসেছিস!”

আদ্রাফ নিঃশব্দে হাসলো। সবাই তাদের চোখ জোড়ায় কৌতূহল আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে।

“তারপর হঠাৎ করেই আম্মুর কথা আর তোদের কথা মনে পরলো। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি তাই বলে কি সেই শোকে কাতর হয়ে বন্ধু গুলোকেও হারিয়ে ফেলবো না-কি! যত কিছুই হয়ে যাক কিন্তু তোদেরকে অবহেলা করার সাধ্য আমার নেই। তোরা তো সব সময়ই আমার পাশে ছিলি তাহলে আমি কি করে তোদের থেকে দূরে থাকতে পারি বল।”

সবাই সিক্ত চোখে তাকিয়ে আদ্রাফের কথা শুনছে। সকলের চোখে খুশির ঝলক। আচমকাই নীল ধ্রুবকে এক পাশ থেকে চেপে জড়িয়ে ধরে বলল-

“এই না হলো আমাদের বন্ধুত্ব। এই বুদ্ধিমান মাথাটা আগে কই আছিলো? শালা জানিস এই কয়দিন আমরা তোকে কতটা মিস করছি! আমরা তো চুপচাপ আসতাম ক্লাস করে আবার চুপচাপ চলে যাইতাম। কোনো হাসিঠাট্টা, আড্ডা কিছুই ছিলো না।”

কথা গুলো বলেই আদ্রাফের গলা পেচিয়ে ধরলো নীলের হাতের মাঝে। আদ্রাফ নীলের হাত ছাড়ানো চেষ্টা করতে করতে মিনতির সুরে বলল-

“ভাই ভাই প্লিজ ছাড়। ব্যথা পাচ্ছি রে ভাই। আমার ভুল হইছে আমি শিকার করতাছি কিন্তু আমার ঘাড়টাকে রেহাই দে ভাই।”

“শালা লেডিস নে এবারের মতো ছাইড়া দিলাম।”

নীল আদ্রাফকে ছেড়ে দিতেই আদ্রাফ গলায় ঘষতে লাগলো। আদ্রাফ আর নীলের মারামারি দেখে বাকি সবাই হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আরশি সিক্ত গলায় বলল-

“আবারও আমরা সবাই এভাবে আড্ডা দিতে পারবো ভাবিনি।”

কেউ কিছু বলল না। সকলের মুখে তৃপ্তিদায়ক হাসি। তবুও কোথাও যেন কাসফিয়ার অভাব রয়েই গেছে।

——————————

“আদ্রলিকা একটা গান গা তো।”

দূর থেকে এই কথাটা কানে ভেসে আসতেই রৌদ্র চমকে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে নামটা কি ঠিকই শুনেছে কি না। রৌদ্রকে চমকে দিয়ে আবারও একই নাম ভেসে আসলো-

“উফফ আদ্রলিকা গান গা না প্লিজ। এখানে তো আমরা আমরাই অন্য কেউ তো নেই।”

রৌদ্র চোখে কৌতূহলের তারা খেলে গেল। ধীর পায়ে বাগানের মাঝখানটা’য় আসলো। আরশি আর তার বন্ধুদের দেখে আরেক দফা চমকে উঠলো রৌদ্র। অপলক দৃষ্টিতে আরশির দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলক ফেলা যেন এই মুহূর্তের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে রৌদ্রর। আরশি অসহায় মুখ করে বলল-

“আচ্ছা আচ্ছা গান গাইবো। কিন্তু আমাকে নিয়ে মজা করতে পারবি না।”

ধ্রুব আরশির মাথায় হাত রেখে আস্বস্ত করে বলল-

“ওকে আমরা কোনো মজা করবো না তোর গান নিয়ে। এবার গান গা। আমরা সবাই এক হয়েছি সেই খুশিতেই এই গান।”

আরশি মাথা দুলালো। গলা খেকরিয়ে সুর তুলে গান গাওয়া শুরু করলো-

পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিক
সবাই বলে করছো ভুল আর
তোরা বলিস ঠিক
তোরা ছিলি তোরা আছিস
জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে আর কি লাগে?

আরশি এই কয়েক লাইন গেয়েই খিলখিল করে হেসে উঠলো। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসছে আরশি কান্ড দেখে। এটা আরশি সব সময়কার অভ্যাস৷ কন্ঠ সুন্দর হলেও আরশি গান গাইতে পারে না। কয়েক লাইন গেয়েই হেসে উঠে। গান গাওয়া আরশির কাছে সুড়সুড়ির মতোই মনে হয়। গান গাইবে আর হাসবে না এটা হয়তো আরশির জন্য অসম্ভব কিছু। রৌদ্র বড় একটা আম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে আরশি গান শুনছে। এটাই তো সেই কিশোরীর কন্ঠ, যার গানের গলা আর হঠাৎ করেই গানের মাঝে খিলখিল করে হেসে ওঠা দেখে রৌদ্রর হৃদ স্পন্দন থমকে গিয়েছিল। মুগ্ধ হয়েছিল মেয়েটার মধুর কন্ঠে। মন হারিয়েছিলো গানের মেয়েটার খিলখিল করে হেসে ওঠা দেখে।

আরশি হাসি কোনো রকম থামিয়ে আবারও গান গাওয়া শুরু করলো। আরশির দেখাদেখি আদ্রাফও গান গাইয়তে লাগলো।

সুসম্পর্ক, দুঃসম্পর্ক, আত্মীয়-অনাত্মীয়
শত্রু-মিত্র, রক্ত সম্পর্কে কেউ বা দ্বিতীয়
সৎ-অসৎ, দূরের-কাছের, বৈধ-অবৈধ
হাজারও এসব সম্পর্ক ভাঙ্গে
থাকে বন্ধুত্ব

তোরা ছিলি তোরা আছিস
জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে আর কি লাগে?

ধ্রুব আদ্রাফ আর আরশির কাধে হাত রেখে সুর তুলে গাইতে লাগলো-

কিছু কথা যা যায়না বলা কাউকে
কিছু কাজ যা যায়না করা সহজে
কিছু আচরণ মানে না কেউ সামনে
কিছু জায়গা যায় না যাওয়া চাইলেই
সবই হয় যদি তোরা থাকিস সেখানে

বন্ধু বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে আর কি লাগে?
বন্ধু বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে আর কি লাগে?

গান শেষ হতেই সবাই এক সাথে চেচিয়ে উঠলো। ধ্রুব উঠে পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল-

“এবার একটু কিছু খাওয়া দরকার৷ ক্যান্টিনে চল সবাই আজকে আমি খাওয়াবো।”

সবাই উঠে চলে যেতে লাগলো। আদ্রাফ, নীল আর ধ্রুব সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। নীলা আর সুপ্তিও যাচ্ছে কিন্তু আরশি শাড়ি ঠিক করতে করতে পেছনেই রয়ে গেল।

“এই যে মিস আরু শুনছেন!”

আবারও রৌদ্রর ডাক শুনে আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ধ্রুব ওরা অনেকটা সামনে চলে গেছে। আরশি তাদের দিকে একটু তাকিয়ে ডান দিকে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো। রৌদ্রর দাঁড়িয়ে আছে। তবে এবার খুব অন্যরকম লাগছে। সব সময়ের মতো গম্ভীরতা আর নির্লিপ্ততা দেখা যাচ্ছে না তার মুখে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। ঠোঁটের কোণেও অদ্ভুত রকমের হাসি ঝুলে আছে।

“আপনার কন্ঠ এতো বাজে কেন? আমি তো ভেবেছিলাম কোন কাক ডাকছে কিন্তু এখানে এসে দেখি আপনি গান গাচ্ছেন।”

আরশি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। রৌদ্রর কথায় রাগ করবে নাকি কান্না করবে বুঝতে পারছে না। রৌদ্রকেও কিছু বলতে পারছে না। ইচ্ছে করছে নিজের কপালেই চাপড় দিতে। কেন এই লোকটার ডাকে বার বার ফিরে তাকায়! নিজের উপরেই রাগ লাগছে আরশির।

“আপনার সাথে একটা কথা ছিল মিস আরু।”

চলবে…

(হ্যাপি রিডিং। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️🧡)