রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-১৩+১৪

0
442

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আচ্ছা আপনাকে একটা কথা বলি মিস আরু!”

চারপাশ অন্ধকার করে আসছে। ঝলমলে আকাশ হঠাৎ করেই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। হাল্কা শীতল বাতাস বইছে। দূর থেকে স্টুডেন্টদের হৈচৈয়ের শব্দ ভেসে আসছে। গাছের পাতা গুলো ঝিরিঝিরি শব্দ করে নড়ছে। আরশির শাড়ির আঁচল হেলেদুলে বেশ আনন্দের সাথে উড়ছে। চুল গুলো বার বার মুখের ওপর এসে পরছে। আর আরশি প্রতিবারই মুখে বিরক্তি ভাব এনে চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রৌদ্র তার নিখুঁত চোখে আরশির এই ছোট ছোট ভঙ্গিমা গুলো দেখছে। আরশির মুখের এই বিরক্তিভাব দেখেও যেন বার বার মুগ্ধ হচ্ছে রৌদ্র। মুগ্ধ হবার-ই কথা এই প্রথম সে তার রুদ্রাণীকে মন ভরে দেখছে। তার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটোকে শান্ত করছে।

“কি কথা বলুন।”

আরশির কাঠাকাঠ গলার স্বরে রৌদ্রর হুশ ফিরলো। তার অবাধ্য চোখ দুটোর দৃষ্টি নামিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে ছোট করে একটা শ্বাস নিলো। আরশি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর মুখের দিকে। লোকটার ভাবভঙ্গি ঠিক বুঝতে পারছে না সে। অদ্ভুত আচরণ করছে। রৌদ্র মাথা তুলে স্বাভাবিক গলায় বলল-

“আপনার সাথে কি জ্বিন আছে?”

রৌদ্রর প্রশ্নে আরশির চোখদুটো আপনাআপনি বড় হয়ে গেল। ভয়ংকর কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“মানে!! হঠাৎ এমন অদ্ভুত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

রৌদ্র দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে সহজ গলায় বলল-

“গানের মাঝে যেভাবে হাসছিলেন মনে হচ্ছিলো জ্বিন আপনাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তাই কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম।”

আরশি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রর শান্তশিষ্ট, নির্লিপ্ত, শুদ্ধতম মুখটার দিকে। এই সুন্দর ভদ্র দেখতে ছেলেটার ভেতর থেকে যে এত-এত-এত্তো সয়তানি মার্কা কথাবার্তা বের হয় তা যেন আরশির বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে। আচমকাই আরশির মাথার মধ্যে ধপধপ করে রাগের শিখা জ্বলে উঠ। গর্জে উঠলো রৌদ্রর উপর,

“আপনি তো ভারি অসভ্য লোক। আমি আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আপনার লজ্জা করে না এত বড় হয়েও জুনিয়রদের সাথে নির্লজ্জের মতো ফাজলামো করতে!”

“আর তোমার ভয় করে না এত ছোট হয়ে সিনিয়রদের উপর বাঘিনীর মতো গর্জে উঠতে!”

আরশি রাগে ফুসতে ফুসতে বলল-

“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার।”

রৌদ্র হাল্কা হাসলো। আরশি ঘুরে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই রৌদ্রর ডাক শুনতে পেল,

“মিস আরু দাঁড়ান। পেছনে ঘুরতে হবে না। যেভাবে আছেন সেভাবেই দাঁড়ান।”

আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কোনো নাড়াচাড়া করছে না। রৌদ্র আরশির দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। পাঞ্জাবির হাতা গুলো উপরের দিকে তুলতে তুলতে আরশিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিছুটা সামনে গিয়েই স্থির হয়ে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে আরশির দিকে ফিরে শান্ত গলায় বলল-

“অসুখ হয়েছে আমার। ভেবেছিলাম অসুখটা কমে যাবে কিন্তু এখন দেখছি এই অসুখে আরও তীব্র ভাবে আক্রান্ত হচ্ছি আমি।”

রৌদ্র সামনের দিকে ফিরে আবারও হাঁটতে লাগলো। বুকে হাত দিয়ে আনমনেই বলল-

“তুমি নামক অসুখ এবার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। সারাজীবন এই অসুখেই আক্রান্ত থাকতে চাই রুদ্রাণী।”

আরশি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর যাওয়ার দিকে। রৌদ্রর এসব উদ্ভট কথার কোন কারণই আরশির মাথায় ডুকছে না। সব কিছু যেন মাথার দশ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে। জগাখিচুরি পাকিয়ে ফেলেছে আরশির মাথায়।

—————————

বিকেলের শেষ। চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঘিরে আছে। আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টির আগমন ঘটেছে। গাছপালা লন্ডবন্ড করে দিয়ে ঝড়ো বাতাস বইছে। ভার্সিটির সামনের দোকানটার নিচেই দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর ভালো মতো পেচিয়ে রেখেছে শীত থেকে রক্ষার জন্য। পানির ছিটায় শাড়ির নিচের দিক ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। অস্থির হয়ে বার বার রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভার্সিটির অন্য গেইটের সামনে থেকে রৌদ্র আর নির্বান রিকশায় উঠেছে। রিকশা এই দিকটায় আসতেই রৌদ্র রিকশা থামাতে বলল-

“মামা একটু রিকশাটা থামাও তো।”

রিকশা থেমে গেল। রৌদ্র সরু চোখে দোকানের দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টির বেগ বেশি থাকায় সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আরশিকে দেখেই তার কপালে ভাজ পড়ে গেল। নির্বান রৌদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। আরশিকে দেখতে পেয়েই উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“আরে ওইটা তো বাঘিনী। তোর আদ্রলিকা।”

রৌদ্র গম্ভীর ভাবে ‘হুমম’ বলল। আরশির কাছে যাওয়ার জন্য মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু তা আমলে আনার আগেই আরশির সামনে এসে একটা রিকশা থামলো। ধ্রুব রিকশা থেকে নেমে দ্রুত দোকানের নিচে আসলো। ডান হাতে মাথায় চুল ঝাড়ছে ধ্রুব। আরশি গাল ফুলিয়ে বলল-

“সেই কখন থেকে একা একা দাঁড়িয়ে আছি। একটা রিকশা খুঁজতে তোর এতক্ষণ লাগে!”

ধ্রুব কোনো কথা না বলে হাতের শপিং ব্যাগ থেকে একটা পিংক কালারের তোয়ালে বের করলো। তোয়ালেটা আরশির শরীরে পেচিয়ে দিয়ে বলল-

“তুই ভিজে যাবি সেজন্য এটা কিনতে গিয়েছিলাম তাই একটু দেরি হয়েছে।”

আরশি সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“তুইও তো ভিজে গেছিস।”

“আমার কথা চিন্তা করতে হবে না। বৃষ্টিতে ভিজে আমার অভ্যাস আছে। তুই তাড়াতাড়ি চল।”

আরশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ধ্রুব আরশিকে এক পাশে থেকে জড়িয়ে ধরলো। অন্য হাত আরশির মাথার উপর রাখলো বৃষ্টির থেকে রক্ষার জন্য। ধ্রুব তাড়াতাড়ি করে আরশিকে রিকশায় তুলে দিল। ধ্রুব নিজেও উঠে নীল রঙের পলিথিন দিয়ে ভালো করে শরীর ডেকে নিল। ডান হাত আরশির সামনে দিয়ে নিয়ে রিকশার হুডে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে নিজের দিকের পলিথিন সামলে রাখছে। রিকশা চলতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিকশা রৌদ্রর দৃষ্টির বাহিরে চলে গেল। রৌদ্রর মুখের ভঙ্গিমা পালটে গেছে। চোয়ালে শক্ত হয়ে গেছে। চোখদুটোতে গম্ভীরতার আভাস। নির্বান রৌদ্রর দিকে চেয়ে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল-

“মামা রিকশা চালাও।”

——————————

বাসায় এসেই আরশি জ্বরে আক্রান্ত হলো। টানা দু’দিন ধরে জ্বরে বিছানায় পরে আছে। লাইব্রেরি আর ভার্সিটি কোথাও যাওয়া হয়না। এমনকি রুম থেকেও বের হতে পারেনি। এই দু’দিন আরশির সাথে সাথে ধ্রুব নিজেও সব কিছু থেকে ছুটি নিয়েছে। সারাক্ষণ আরশির খেয়াল রেখেছে। অস্থির হয়ে এটা ওটা করা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ঠিক যেমনটা ছোট থেকে করে আসছে। আরশির এক বছর বয়স থেকে এই বিশ বছর পর্যন্ত ধ্রুব নিজেই আরশির সকল খেয়াল রেখেছে। আরশিরা এই বাসায় আসার পর থেকেই ধ্রুব আরশিকে সারাক্ষণ নিজের কাছে রেখেছে। স্কুলের পর ছুটে সবার আগে আরশির কাছে আসতো। আরশির সাথে খেলা করা, নিজ হাতে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব কিছুই দিন দিন তার দায়িত্বের মধ্যে পরে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে একজন অভিভাবকের মতো সব দিক দিয়ে আরশিকে সামলানো শুরু করেছে। বাসায়, স্কুলে, বাহিরে সব জায়গায় আরশির কোনো প্রয়োজনে ধ্রুব সবার আগে এগিয়ে এসেছে। এতে আরশি কিংবা ধ্রুব কারোর পরিবারের কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। তাদের সবার মাঝে সম্পর্কটা আরও গভীর হয়েছে ধ্রুবর এই পাগলামির কারণে। আরশিও ধ্রুবকে যথেষ্ট সম্মান করে। যে কোনো কিছু করার আগে ধ্রুবর কাছে পারমিশন নিয়ে নেয়। সব কিছু শেয়ার করে ধ্রুবর কাছে।

আজ খুব সকাল সকাল আরশির ঘুম ভেঙেছে। আড়মোড়া ভেঙে চোখ কচলিয়ে সোজা হয়ে বসলো। বিছানা থেকে নামতে নিবে তখনই মেঝেতে নজর পরলো। শাকিল আর ধ্রুব মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে আছে। আরশি মুচকি হাসলো। আরশির জ্বর হয়েছে বলে ধ্রুব দুদিন ধরে এই বাসাতেই থাকে আরশির রুমে। আর শাকিলকেও জোর করে এখানেই রেখেছে। আরশি ধীরে ধীরে কয়েকবার ডাক দিলো। কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। তাই খানিকটা জোরে চেচিয়ে উঠলো-

“ভাইয়ায়ায়ায়া… তোরা ঘুম থেকে ওঠ।”

ধ্রুব আর শাকিল দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। শাকিল হামি দিয়ে উঠে আরশির কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো-

“জ্বর নেই। ধ্রুব ভাই আমার, এবার আমাকে একটু শান্তি দে। দু’দিন ধরে মেঝেতে থেকে ওর সেবা করতে করতে আমি নিজেই বাঁকা হয়ে গেছি। এবার আমাকে আমার মতো থাকতে ভাই প্লিজ। অনুরোধ রইলো। আমাকে একটু বিশ্রাম করতে দে আর তুই নিজেও নে।”

শাকিল বিরবির করতে করতে হেলেদুলে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল। আরশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে শাকিলের দিকে। ধ্রুব আড়মোড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আরশির কপালে হাত রেখে বলল-

“জ্বর বিদায় নিয়েছে এবার আমিও বিদায় নেই।”

ধ্রুব চলে যেতে নিলেই আরশি বলল-

“লাইব্রেরিতে যাবো এখন।”

ধ্রুব ঘাড় বাকিয়ে আরশির দিকে চেয়ে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“এখনই যাবি? লাইব্রেরি খুলবে এখন?”

“আমরা রেডি হয়ে যেতে যেতে খুলে যাবে পাক্কা।”

ধ্রুব চোখ কচলিয়ে চোখ বড় বড় করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল-

“আমি রেডি হচ্ছি তুইও ফ্রেশ হয়ে নে।”

——————————

“ধ্রুব তুই যে দিন দিন এমন পাগলামি করছিস এটা কি ঠিক হচ্ছে?”

আরশির মা ডাইনিং টেবিলে ধ্রুবকে নাস্তা দিতে দিতে চিন্তিত গলায় বললেন। ধ্রুব প্লেট ঠিক করে আরশির মা’র দিকে চেয়ে বলল-

“কি হয়েছে ছোট মা? আমি পাগলামি কখন করলাম!”

ধ্রুবর কথায় উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ধ্রুবর পাশের চেয়ারে বসে ধ্রুবর হাত ধরে বললেন-

“দেখ ধ্রুব আমরা সবাই জানি তুই আরশিকে নিয়ে অনেক চিন্তা করিস কিন্তু তোর নিজের দিকটাও তো খেয়াল রাখতে হবে। তোরও তো দু’দিন ধরে জ্বর। গতপরশু রাতে আরশির রুমে গিয়ে দেখলাম তুই জ্বরে কাঁপছিস। শাকিলকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল শাকিল না-কি তোকে বলেছে ওর রুমে গিয়ে ঘুমাতে কিন্তু তুই যাসনি। মেঝেতেই শুয়ে ছিলি।”

“আহহ ছোট মা বাদ দাও এসব। আদ্রলিকা শুনলে আবার অস্থির হয়ে পরবে।”

আরশির মা রুটি ছিড়ে ধ্রুবর মুখে তুলে দিয়ে বলল-

“জানিস ধ্রুব মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আরশির মা না তুই-ই আরশি সব। আরশির মা,বাবা, বড় ভাই বোন সবার দায়িত্ব-ই তুই একা পালন করছিস। আমি তো শুধু আরশিকে পেটেই নিয়েছি আর বাকি সব তো তুই-ই করছিস।”

ধ্রুব খাবার চিবাতে চিবাতে হেসে দিয়ে বলল-

“আমি যে ছোট বেলা আমার মাটির ব্যাংক ভেঙে জমানো সব টাকা শাকিলকে দিয়ে এই বিড়ালটাকে কিনে নিয়েছিলাম তুমি ভুলে গেছো!”

আরশির মা হেসে দিলো। শাকিল টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে এগিয়ে এসে বলল-

“ভালোই করেছি আরশিকে তোর কাছে বিক্রি করে। আমাদের দায়িত্বটা একটু কমেছে। আম্মুও বেঁচেছে ওর যত্ন নেওয়ার কাজ থেকে।”

শাকিলের কথায় আরশির মা আর ধ্রুব আবার হেসে উঠলো। আরশি ডাইনিং রুমে এসে বলল-

“কি নিয়ে হাসছো তোমরা?”

“তোকে ধ্রুবর কাছে বিক্রি করে যে ওই টাকা দিয়ে আমি আইসক্রিম খেয়েছিলাম। সেই কথাই মনে পরলো সবার।”

শাকিলের কথায় আরশি রেগে শাকিলের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বলল-

“তোর মতো ভাই এই দুনিয়াতে আরেকটা আছে কিনা সন্দেহ। ছিঃ কেমন ভাই তুই নিজের ছোট বোনকে বিক্রি করে আইসক্রিম খাস! ভাই নামের কলঙ্ক তুই।”

আরশি শুনে শাকিল আর ধ্রুব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। আরশির মা তাদের হাসি দেখে তৃপ্তিদায়ক হাসি দিয়ে বলল-

“সবাই বস আজ আমি তোদের সবাইকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবো।”

“খাইয়ে দিবে কি অলরেডি একজনে খাইয়ে দিচ্ছো।”

আরশি আড় চোখে ধ্রুব দিকে তাকিয়ে বলল। ধ্রুব হেসে দিয়ে বলল-

“কারণ ছোট মা আমাকে বেশি ভালোবাসে তাই আমাকে আগে খাওয়াচ্ছে।”

ধ্রুবর কথায় আরশি গাল ফুলিয়ে ফেলল। আরশির মুখ দেখে সবাই আবার হেসে উঠলো।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আদ্রলিকা চিঠি!”

ধ্রুব বইয়ের মাঝে চিঠি পেয়েই চেচিয়ে উঠলো। আরশি চেয়ারে বসা অবস্থায় ঘাড় বাকিয়ে ধ্রুবর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন গলায় বলল-

“এই বজ্জাত পোলা। চিঠি পেলেই কি প্রতিবার ‘আদ্রলিকা চিঠি’ বলেই চেচামেচি করতে হবে না-কি! তুই কি মানুষদের ঢাকঢোল পিটিয়ে শোনাতে চাচ্ছিস যে আমরা এখানে বই পড়তে না চিঠি আদান-প্রদানের জন্য আসি!”

ধ্রুব এক হাতে বইটা নিয়ে অন্য হাতে মাথা চুলকাতে লাগলো। একটা বোকা হাসি দিয়ে আরশি দিকে এগিয়ে আসলো। আসেপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল-

“সরি জান ভুল হয়ে গেছে।”

আরশি দু হাত আড়াআড়ি ভাজ করে গম্ভীরমুখে বলল-

“হুম হয়েছে। চিঠি পড় এখন।”

ধ্রুব চেয়ারে বসে তপ্ত শ্বাস ফেলে। আরশির দিকে বইটা দিয়ে বলল-

“তোর চিঠি তুই পড়।”

আরশি কথা বাড়ালো না। চিঠি বের করলো। খানিকটা অবাক হলো চিঠি দেখে। অবাক হওয়ার কারণ আজ নীল রঙের কাগজে চিঠি লিখেছে।

প্রিয় রুদ্রাণী,

শুনেছি রাগলে না-কি মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে। জানি না আমাকে দেখতে না পেয়ে তোমার রাগ হয়েছিল না-কি ঘৃণা। যদি রাগ অথবা অভিমান হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আমার এই চিঠিটা তোমার হাতে পৌঁছাবে। আর যদি ঘৃনা জন্মে যায় তাহলে হয়তো এই বইয়ের ধারের কাছেও আর আসবে না।

সকাল সকাল উঠেছিলাম তোমার সাথে দেখা করতে আসার জন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছলাম। সেখান থেকে সাড়ে নয়টার পর ছাড়া পেয়েছি। যদিও আমি এসেছিলাম দশটা বাজে কিন্তু তোমাকে পাইনি। আমার বোকামি দেখে আমার নিজেরই লজ্জা করছে। রুদ্রাণী কি আর আমার জন্য এতক্ষন অপেক্ষা করবে না-কি! যাইহোক আমার কথা রাখতে না পাড়ায় আমি খুবই লজ্জিত আর দুঃখিত। হয়তোবা প্রকৃতি চাচ্ছে না আমাদের এখন দেখা হোক। আমরা না হয় প্রকৃতির ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করি। ঠিক সময় আসলেই হয়তো আমাদের দেখা হবে।

বিঃদ্রঃ রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী তুমি। কোনো একজনের হৃদয় ঘায়েলের দায়ী তুমি বুঝলে!

ইতি
রৌদ্র

আরশি ধ্রুবর দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“একজনের হৃদয় ঘায়েলের জন্য আমি কেন দায়ী দায়ী হবো?”

ধ্রুব চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে বলল-

“ভুল বলেছে লোকটা। তুই একজনের না বরং অনেক জনের হৃদয় ঘায়েলের জন্য দায়ী।”

“ফাজলামো করিস না তো।”

“আচ্ছা করলাম না ফাজলামো। যা করার তাড়াতাড়ি কর। ক্লাসের জন্য দেরি হচ্ছে।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে চিঠির প্রতিত্তোর লিখতে শুরু করলো। ধ্রুব গালে হাত দিয়ে আরশির চিঠি লেখা দেখছে। চিঠি লেখা শেষ হতেই ধ্রুব আরশির থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নেয়। তাড়াতাড়ি চিঠিটা ভাজ করে বইয়ের মাঝে রেখে আগের জায়গায় রেখে আসলো। আরশিকে তাড়া দিয়ে বলল-

“তাড়াতাড়ি আয় আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি ক্লাসের।”

————————————

“এখন কি অবস্থা তোর? আজকে আসার কি কোনো দরকার ছিল? আরেকদিন রেস্ট নিলে ভালো হতো না!”

নির্বান চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো রৌদ্রকে। রৌদ্র ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে নজর রেখে সহজ গলায় বলল-

“কিছুই তো হয়নি। জাস্ট একটু হাত কেটেছে। এর জন্য এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই।”

“শুধু শুধু মারামারি করতে গেলি কেন? তুই তো কখনো এমন মারামারির ঝামেলায় জোড়াস না রৌদ্র।”

নির্বানের সন্দিহান কন্ঠে রৌদ্রর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে আগের মতোই চেয়ার গা এলিয়ে বসে আছে। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে পুরো ক্যান্টিনে নজর বুলালো। স্টুডেন্টরা আড্ডা দিচ্ছে আর চেচামেচি করছে। সামনের টেবিলের ছেলে গুলো একটু বেশিই চিল্লাচিল্লি করছে। পাশের টেবিলের মেয়ে গুলো বিরক্ত হচ্ছে তা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রৌদ্র বা হাতে টেবিলের উপর আঘাত করলো। আচমকা এমন শব্দ সবাই কৌতুহলী চোখে তাদের টেবিলের দিকে তাকালো। রৌদ্র গাম্ভীর্যের সঙ্গে সামনের টেবিলের ছেলে গুলোকে বলল-

“বিশৃঙ্খলা না করে সুন্দর ভাবে আড্ডা দাও। আশেপাশের মানুষ যেন তোমাদের চিল্লাচিল্লিতে বিরক্তবোধ না করে সেটা মাথায় রেখো।”

ছেলে গুলো মাথা নিচু করে ফেলেছে। বিনয়ের ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে সামনের দিকে ফিরে গেল। মেয়েগুলোর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। নির্বান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে চেয়ে আছে। গতকাল থেকে রৌদ্রর কাছে মারামারি করার কারণ জানতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছে না। রৌদ্র নির্বানের দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“ওদিন যে আরশির কাছে মাফ চাওয়ার জন্য ছেলে গুলোকে শাসিয়ে ছিলাম মনে আছে!”

“হুম আমিও তো ছিলাম তোর সাথে।”

“ওদেরই বড় ভাই ক্ষেপে ছিল আমার উপর। তাদের ছোট ভাইদের না-কি আমরা অপমানিত করেছি তাই গত পরশু রাতে রাস্তায় আমাকে একা পেয়ে ভয় দেখাতে এসেছিল। বেশি বারাবাড়ি করছিল তাই একপর্যায়ে হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেছে।”

নির্বান ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে। উদাস গলায় বলে,

“এখন তো বোধহয় আরও ক্ষেপেছে তাই না!”

“খেপারই কথা। শুনেছি একটার না-কি হাত ভেঙেছে। তাই হাত ঠিক না হওয়া অব্দি রিলেক্সে থাক।”

রৌদ্রর নির্লিপ্ততা দেখে নির্বানের কপালে গভীর ভাজ পরলো। রৌদ্র সেটা পাত্তা দিলো না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“বাঘিনীকে দেখেছিস এই দু’দিন?”

“নাহ। হয়তো ভার্সিটিতে আসেনি। আসলে তো দেখতামই। আচ্ছা তুই ওকে বলছিস না কেন তুই যে চিঠির লোক।”

রৌদ্র সোজা হয়ে বসলো। টেবিলের উপর হাত রেখে শীতল গলায় বলল-

“তোর কি মনে হয় আমার পরিচয় জানার পর আরুর রিয়েকশন কেমন হবে!”

নির্বান কোনো উত্তর দিলো না। রৌদ্র হাল্কা হেসে বলল-

“আরু যদি আমার পরিচয় জানে তাহলে আমাকে আর চিঠিই দিবে না।”

“এমনটা ভাবার কারণ কি?”

“তুই তো দেখিস নাই ভাই। প্রথমদিন থেকে ওর সাথে ঝগড়া লেগেই আছে। অবশ্য দোষটা আমারই ছিলো। যাইহোক আগের কথা বাদ দেই। আরু আমার উপর সব সময় যেভাবে ক্ষেপে থাকে, যদি আমার চিঠির কথা শোনে তাহলে সব গুলো চিঠি এনে আমাকে পানিতে গুলিয়ে খাওয়াবে।”

নির্বান শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল-

“তুই বাঘ হলে ও হলো বাঘিনী। কেউ কারও থেকে কম না তোরা।”

“ভাইরে ভাই এই মেয়ের এতো সাহস কিভাবে? আমি সিনিয়র মানুষ তবুও আমাকে কথায় কথায় ডিটারজেন্ট ছাড়া ধুয়ে দেয়।”

রৌদ্র ঠোঁট উলটে অসহায় মুখ করে বলল। নির্বান রৌদ্রর মুখের ভঙ্গিমা দেখে হেসে কুটিকুটি। নির্বান কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল-

“আচ্ছা আরশিকে তোর পরিচয় বলবি কবে?”

রৌদ্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল-

“সময় হলেই বলবো।”

———————————

“এই যে শুনছেন মিস আরু!”

রৌদ্রর কন্ঠ শুনে আরশি পেছনে তাকালো কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। আবারও রৌদ্রর কন্ঠ ভেসে আসলো-

“ডান পাশে তাকান মিস আরু।”

আরশি তাকালো। তাকে দেখে বরাবরের মতোই ভ্রু কুচকে ফেললো। রৌদ্র পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বেঞ্চিতে বসে আছে। রৌদ্র বা হাতের আঙুল দিয়ে ইশারায় আরশিকে কাছে আসতে বললো। আরশির ভ্রু জোড়া আগের থেকেও কিছুটা কুচকে এলো। বিরক্তি ভাব নিয়ে রৌদ্রর দিকে এগিয়ে আসলো। রৌদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল-

“ডেকেছেন কেন বলুন।”

“বসুন।”

আরশি বসলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে রৌদ্রর কথা শুনতেই পায়নি। রৌদ্র আবারও বলল-

“এখানে বসুন।”

আরশি দু হাত ভাজ করে কঠিন গলায় বলল-

“এটা পার্ক না যে আপনার সাথে বসে প্রেম করবো।”

রৌদ্র মনে মনে বিব্রতবোধ করলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলল-

“পার্ক হলে বুঝি আমার সাথে বসে প্রেম করতেন?”

আরশি ভড়কে উঠলো৷ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

“আজেবাজে কথা না বলে বলুন ডেকেছেন কেন।”

“তেমন কিছু না। গত দু’দিন কি ভার্সিটিতে আসেনি?”

আরশি সরু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। ছোট্ট করে উত্তর দিল- “নাহ, অসুস্থ ছিলাম।” কথাটুকু বলতেই রৌদ্রর হাতের দিকে নজর গেল। ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে রাখা। কিছুটা জায়গায় রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। কপালের দিকেও একটু জায়গায় চামড়া লালচে বর্ণের হয়ে আছে। আরশি রৌদ্রর আরেকটু সামনে এসে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“হাত কেটেছে কিভাবে? আর কপালেও তো দাগ দেখা যাচ্ছে। আপনি ঠিক আছেন তো?”

আরশির প্রশ্নের বিনিময়ে রৌদ্র অদ্ভুত এক হাসি উপহার দিলো। আরশি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল-

“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আর আপনি হাসছেন?”

রৌদ্র উঠে দাঁড়ালো। আরশির মুখোমুখি হয়ে বলল-

“বাহ আমাকে নিয়ে খুব অস্থির হয়ে পরেছেন দেখিছি!”

আরশি হকচকিয়ে উঠলো। কিছুটা পেছনে গিয়ে ইতস্তত করে বলল-

“এমনি কৌতুহল মেটাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি আসছি এখন।”

আরশি পেছন ফিরে চলে যাবে তখনই রৌদ্র বলল-

“দাঁড়ান মিস আরু। যেভাবে আছেন সেভাবেই দাঁড়ান।”

আরশি দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্র মুচকি হাসলো। আরশিকে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়ে আবারও পেছন ফিরে তাকালো। আরশির চোখে চোখ রেখে শীতল কন্ঠে বললো-

“রোগমুক্ত করার ওষুধ-ই যখন অসুখের কারণ হয়ে যায় তখন কি করা উচিত মিস আরু?”

আরশি চোখ গোল করে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছে না। মনে মনে প্রশ্নটা আওড়াতে লাগলো। রৌদ্র সশব্দে হেসে স্থান ত্যাগ করলো। আরশি এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ধ্রুবর ডাকে আরশির হুশ ফিরলো। দ্রুত পায়ে হন্তদন্ত হয়ে ধ্রুব দিকে ছুটে গেল। আরশি ধ্রুবর কাছে আসতেই ধ্রুব গম্ভীর গলায় বলল-

“ওই ছেলেটার থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম আরু।”

আরশি মাথা নিচু করে মলিন মুখে বলল-

“এমনিতেই হালচাল জিজ্ঞেস করছিল।”

ধ্রুব আরশির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শান্ত ভঙ্গিতে বলল-

“এখন থেকে সাবধানে থাকবি। আমার ক্লাসের কয়েকজনের কাছে শুনলাম ছেলেটা না-কি দু একদিন আগে মারামারি করে ঝামেলা পাকিয়েছে। একজন নাকি হাত ভেঙে হসপিটালে ভর্তি। আর ছেলেটার হাতেও নিশ্চয়ই ব্যান্ডেজ দেখিস?”

ধ্রুবর কথায় আরশি খানিকটা চমকে উঠলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে মাথা দুলালো। ধ্রুব ক্যান্টিনের দিকে যেতে যেতে বলল-

“তাড়াতাড়ি চল। আদ্রাফ ওরা বসে আছে তোর জন্য।”

আরশি কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। কিছুটা দূর যেতেই হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করল-

“আচ্ছা ধ্রুব রোগমুক্ত করার ওষুধ-ই যখন অসুখের কারণ হয়ে যায় তখন কি করা উচিত?”

ধ্রুব থমকে দাঁড়ালো। ঘাড় বাকিয়ে আরশির দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। মুখ বিকৃতি করে বলল-

“এসব কি আওলা জাওলা কথা বলছিস? কথার কোনো আগামাথা খুঁজে পাচ্ছি না।”

আরশি অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল-

“এমনি মজা করছি।”

চলবে…