রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
441

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

ঘুমের মধ্যে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে আরশির। কিন্তু গভীর ঘুমে থাকায় চোখ মেলে তাকানো সম্ভব হলো না। আরশির ঘুম ভাঙলো শাকিলের কন্ঠস্বরে। কাকের মতো কর্কশ গলায় চেচিয়ে যাচ্ছে অনর্গল।

“এই আশু! জলদি ঘুম থেকে ওঠ। দশটা বাজে। তোর ক্লাস আছে তো। তাড়াতাড়ি ওঠে পর।”

আরও কিছুক্ষণ চেচামেচি করার পর শাকিল চুপ হলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না আরশিকে এক প্রকার টেনে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল। আরশি চোখমুখ কুচকে অন্ধকার করে রেখেছে মুখ। ভয়ংকর বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে শাকিলের দিকে। শাকিল আরশির দৃষ্টিকে পাত্তা দিলো না। বিছানায় আরশির পাশে আধশোয়া অবস্থায় বসলো। আরশিকে এক হাতে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

“কিরে ওঠ না..”

আরশি বালিশের পাশ থেকে ফোন নিলো। ফোন অন করতেই আরশির তীক্ষ্ণ চাহনিতে শাকিলের দিকে তাকালো। কঠিন গলায় বলল-

“আটটা বেজে পাচঁ মিনিট আর তুই বললি দশটা বাজে। তোর কি কোনো কাজ নেই! সকাল সকাল আমার পেছনে লেগেছিস কেন?”

শাকিল কিছু বলল না। আরশিকে বোকা বানিয়ে খুব মজা পেয়েছে সেটা তার মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আরশি ভালো করে শাকিলকে খেয়াল করতেই বিস্ময় নিয়ে বলল-

“আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিস কেন? আর এত সাজগোজ করে আছিস যে! কি ব্যাপার? কোথাও যাবি না-কি!”

শাকিল উঠে বসলো। পা ভাজ করে আড়াআড়ি করে বসেছে। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে সহজ গলায় বলল-

“বাহিরে গিয়েছিলাম। এই মাত্র আসলাম।”

আরশি শাকিলের দিকে ঘুরে সোজা হয়ে বসলো। খানিকটা চমকে গিয়ে বলল-

“বাহিরে গিয়েছিলি! কিন্তু কেন?”

“ধ্রুবকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলাম। সকাল সাড়ে ছয়টার ট্রেন ছিল।”

শাকিল যতটা সহজ ভঙ্গিতে কথাটা বলেছে ততটা সহজ আরশির কাছে মনে হলো না। ক্ষীণ স্বরে বলল-

“মানে! ধ্রুব কোথায় গেছে?”

আরশির কণ্ঠস্বর বদলে যেতে দেখে শাকিল গম্ভীর গলায় বলল-

“শোন আশু এখন আবার কান্নাকাটি শুরু করিস না বলে দিলাম। তুই এখন আর ছোট নেই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। আর ধ্রুবরও তো আলাদা একটা জীবন আছে। তোকে নিয়ে তো আর সারাক্ষণ পরে থাকলে তো আর চলবে না তাই না!”

আরশি কিছু বলল না। থমথমে চেহারায় মাথা নিচু করে বসে আছে। শাকিল বিছানা থেকে উঠে শান্ত গলায় বলল-

“আচ্ছা মন খারাপ করিস না বোন আমার। এই ক’দিন আমাকে না হয় ধ্রুব জায়গাটা আমাকে দে।”

“লাগবে না। তুই যা আমি ফ্রেশ হবো।”

আরশির গম্ভীর কন্ঠ শুনে শাকিল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরশি বিছানা থেকে উঠেতে গিয়েই বালিশের পাশে একটা পিংক কালারের কাগজ দেখতে পেল। আরশি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো ধ্রুব হ্যান্ড রাইটিং। এবার আরশির টনক নড়ে উঠলো। ভোর বেলা তাহলে ধ্রুব এসেছিল এই রুমে! ধ্রুবই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল! আরশি সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে চিরকুটের লেখা পড়তে লাগলো-

“আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে তাই না আদ্রলিকা! শোন বাচ্চা রাগ করিস না। তোকে বলিনি কারণ তুই মন খারাপ করবি তাই। আর আমি তোর মন খারাপ দেখে যেতে পারবো না তাই লুকিয়েছি। এ নিয়ে চারবার হলো তোকে একা রেখে আমি কোথাও যাচ্ছি। প্রতিবারই তুই খুব কান্নাকাটি করেছিস আর আমাকে তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু এবার অনেকদিনের জন্য যাচ্ছি। তুই বড় হয়েছিস তাই নিজেকে সামলিয়ে নিস। যদিও তুই আমার কাছে বাচ্চাই থাকবি সব সময়। তবুও বলছি নিজের খেয়াল রাখিস। আমি এক মাসের মধ্যেই এসে পরবো। তুই তো জানিসই আব্বু গ্রামে গেছে এতিমখানার কাজের জন্য। হঠাৎ করেই আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাই আমাকেই গ্রামে যেতে হচ্ছে। এতিমখানার কাজ শেষ হতে দু এক মাস তো লাগবেই।

আর এই চিরকুট রেখে যাচ্ছি কারণ তুই আমার ফোন রিসিভ করবি না সেটা আমি জানি। তোর রাগ কমলে তুই নিজে থেকে আমাকে ফোন দিস। মনে থাকে যেন আমার কথা গুলো।”

আরশি চিরকুটটা পড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তার রাগ করা উচিত হবে না তাই রাগ হচ্ছে না। ধ্রুব শুরুতেই তাকে বাচ্চা বলেছে। সেটা দেখেই আরশির মন কিছুটা ভালো হয়েছে। যখন আরশি রাগ করে থাকে তখনই ধ্রুব খুব আদুরে কন্ঠে আরশিকে বাচ্চা বলে ডাকে। এই মানুষটার সামনে আরশি সব সময় নিজেকে একটা বাচ্চাই মনে করে। যার কাছে একটু বায়না করলেই তার থেকে হাজার গুন বেশি ভালোবাসা উপহার পাওয়া যায়। আরশি চিরকুটটা রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। বেশখানিকটা সময় পর ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলো। শাকিল আরশিকে দেখে বলল-

“তুই চাইলে আমি তোকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসতে পারি। ধ্রুব নামক বিশাল হৃদয়বান মানুষটার পদে কয়েকদিনের জন্য নিযুক্ত হতে পারি।”

আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে শক্ত গলায় বলল-

“আগে তুই নিজে হৃদয়বান হয়ে নে তারপর আসিস এই অনুরোধ নিয়ে।”

শাকিল বিরবির করে বলল-

“আমি কি কম হৃদয়বান না-কি!”

“হুম আপনি খুব হৃদয়বান। আপনার এতো বড় হৃদয় যে আইসক্রিমের জন্য নিজের বোনকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।”

আরশি দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ে কথা গুলো বলল। তবে আরশির কথা শুনেই শাকিল হেসে ফেলেল। এতটাই হাসছে যে মনে হচ্ছে আরশি কোনো জোক্স শুনিয়েছে তাকে। আরশির মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। আরশির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন-

“ধ্রুব তোর জন্য আইসক্রিম কিনে দিয়ে গেছে। তবে দিনে একটার বেশির খেতে না করেছে।”

আরশি স্বাভাবিক হলো। আনন্দে মুখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে তার। শাকিল ঠোঁট উলটে বিষন্ন গলায় বলল-

“তোদের ভালোবাসা দেখলে আমার অনেক হিংসা হয় রে আশু। তোর কত্তো সুবিধা দেখেছিস! সবাই তোকে মাথায় তুলে রাখে। আর আমাকে!”

শাকিল শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবারও উদাসী হয়ে বলল-

“আর আমাকে তো সব সময় টোকাই পোলাপানের ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে আফসোসও হয় কেন যে তোর জায়গায় আমি হলাম না! আহহ আমার জীবনটা ধ্রুবহীন তেজপাতা।”

শাকিলের হায় হুতাশা দেখে আরশি মুখ চেপে হাসি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু তা আর হলো না শাকিলের শেষের কথাটুকু শুনেই হাসিতে ফেটে পরলো। শাকিল আর তার মা-ও হাসছে।

——————————

ক্লাসের মাঝে নির্বান এসে উপস্থিত হলো। আরশি খেয়াল করেনি। নীলা আরশির পাশেই বসে আছে। কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করছে নির্বানের চাহনিতে। নির্বান তাদের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসলো। নীলার দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরশির দিকে তাকালো।

“ভাবি আপনাকে ডাকছে।”

আরশি বিস্ফোরিত চোখে নির্বানের দিকে তাকাতেই নির্বান বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো। আমতা-আমতা করে বলল-

“না মানে বাঘিনী তোমাকে বাঘ ডাকছে। ধুর কি বলছি। তোমাকে রৌদ্র একটু দেখা করতে বলেছে।”

আরশি চোখ গোল গোল কতে নির্বানের কর্মকাণ্ড দেখছে। নির্বানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে তাকে। কিন্তু কেন? আরশি মনের প্রশ্ন মনে রেখেই স্বাভাবিক গলায় বলল-

“আচ্ছা আমি আসছি।”

আরশির কথা শুনে নির্বান এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে লাগলো। মাঝখানের একটা বেঞ্চের সাথে ধাক্কাও খেল। নীলার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। নীলা আর আরশি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। পেছন থেকে নীল ক্ষীনস্বরে বলল-

“আবার কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস নাকি এমনিতেই ডাকছে!”

“তোর কি ধারণা আমি সব সময় ঝামেলা পাকাই!”

নীল সরু চোখে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল-

“তা তো সব সময়ই।”

“কিছু বললি!”

“না রে ভাই কিছু বলি নাই। যা গিয়ে দেখ কেন ডেকেছে।”

আরশি কথা বাড়ালো না। চুপচাপ গম্ভীর পায়ে বেরিয়ে গেল। নির্বান দাঁড়িয়ে আছে উল্টো দিকে ফিরে। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আরশি নির্বানের পাশে এসে বলল-

“ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন তো!”

নির্বান অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-

“হুম চলো আমার সাথে।”

—————————

ক্যান্টিনের একটা টেবিলে জায়গায় দখল করে মুখোমুখি বসে আছে আরশি আর রৌদ্র। রৌদ্র পলকবিহীন চেয়ে আছে তার রুদ্রাণীর দিকে। তবে সেদিকে আরশির কোনো খেয়াল নেই। আরশি এই মুহুর্তে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার চিন্তার বিষয়বস্তু হলো রৌদ্রর করা প্রশ্ন- “রোগমুক্ত করার ওষুধ-ই যখন অসুখের কারণ হয় তখন কি করা উচিত?”

আরশি অনেক ভেবে চিন্তেও কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। রৌদ্র টেবিলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে নিম্নস্বরে বলল-

“কি হলো উত্তর জানেন না তাই তো!”

আরশি থমথমে চেহারায় রৌদ্রর দিকে তাকালো। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। রৌদ্র বাঁকা হেসে চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দিলো। দু হাত ভাজ করে দাম্ভিকতার সঙ্গে বলল-

“তো কি করবেন এখন! আমি যা বলবো সেটাই তো মানতে হবে আপনার।”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে চটপটিয়ে বলল-

“না না তা হবে কেন!”

রৌদ্র মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-

“আপনি নিজেই তো কিছুক্ষণ আগে বলেছেন আপনি খুকুমণি না। আপনি যেহেতু খুকুমণি না তাহলে তো আমার প্রশ্নের উত্তর জানার কথা।”

“আপনি তো জানেন তাহলে আপনি বলুন এটার উত্তর কি হবে।”

রৌদ্র কফির কাপে চুমুক দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-

“আপনার মতো খুকিমনিদের এই প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার নেই।”

আরশির রাগ তরতর করে মাথায় চড়ে বসলো। টেবিলে হাল্কা আঘাত করে বলল-

“আপনার এসব ফালতু কথা শোনার সময়ও আমার নেই।”

আরশি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাগে গজগজ করে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল।

“মামা টাকা রাখেন।”

ক্যান্টিনে মালিক পেছন ফিরে আরশিকে দেখে পান খাওয়া লাল লাল দাঁত বের করে হাসলেন। পান চিবুতে চিবুতে বললেন-

“তোমার টেকা দেওন লাগবো না মা।”

“কেন?”

আরশি চমকে প্রশ্ন করলো। লোকটি এক গাল হেসে বললেন-

“ধ্রুব বাজান বইলে গেছে যেন তোমার কাছে থেইক্কা টেকা না নেই। বাজনে অগ্রিম টেকা দিয়ে গেছে।”

আরশি ছোট্ট করে ‘ওহহ’ বলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসলো। রৌদ্র চোয়ালে শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। আরশির কাছাকাছি আসতেই আরশির হাত ধরে ফেলল। আরশি থমকে দাঁড়ালো। ঘাড় বাকিয়ে হাতের দিকে একবার তাকিয়ে রৌদ্রর মুখের দিকে তাকালো। কঠিন গলায় বললো-

“কি করছেন এসব? হাত ছাড়ুন আমার।”

আরশি অস্থিরতার সাথে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিছু কিছু কৌতুহলী চোখ তাদের দিকেই স্থির। রৌদ্র আরশির হাত ধরে ভার্সিটির পেছনের দিকে নিয়ে আসলো। কৃষ্ণচূড়া গাছের এখানে এসেই আরশির হাত ছেড়ে দিল। খানিকটা ঝুঁকে আরশির মুখোমুখি হয়ে শান্ত গলায় বললো-

“প্রথম দিন ভুলবশত হাত ধরেছিলাম। কিন্তু আজ নিজের ইচ্ছেতেই ধরেছে।”

আরশি পাশ কেটে যেতে নিলেই রৌদ্র আরশির হাত ধরে ফেলে। এক হাত আরশির পেছনের গাছে রেখে অন্য হাতে আরশির বা হাত ধরে রেখেছে। আরশি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-

“আরেকটু নড়াচড়া করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে দিচ্ছি।”

আরশি স্থির হলো। রৌদ্রর এতটা কাছে আসায় অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। মনে মনে খানিকটা ভয়ও করছে কিন্তু ভয়টা প্রকাশ করতে চাচ্ছে। আরশি ইতস্তত করে বলল-

“এমন করছেন কেন আমার সাথে?”

“আগে তুমি বলো সব সময় আমার সাথে রেগে রেগে কথা বলো কেন! কি করেছি আমি? সব সময় আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াও কেন?”

আরশি হকচকিয়ে উঠলো। রৌদ্র আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে। সত্যিই রেগেছে এবার।

চলবে…

(রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কি চান আপনি? এমন করছেন কেন আমার সাথে?”

আরশি অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো রৌদ্রকে। রৌদ্র অদ্ভুত চাহনি নিক্ষেপ করে আছে আরশির দিকে। এখনো আরশির হাত ধরে রেখেছে। ঠোঁট হাল্কা প্রসারিত করে আরশির মুখের দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসলো। আরশি হকচকিয়ে উঠেছে। অস্বস্তিতে মাথা নুয়ে ফেললো। রৌদ্র শীতল গলায় বলল-

“তোমাকে চাই।”

আরশি চমকালো। বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। আমতা-আমতা করে বলল-

“মানে? কি বলছেন এসব!”

রৌদ্র বাঁকা হেসে আরশির হাত ছেড়ে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। ডান হাতে নিজের চুল গুলো পেছনে ঢেলে দিয়ে বলল-

“ক্লাস শেষে তোমাকে এখানে দেখতে চাই।”

“কিন্তু কেন?”

“কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ ক্লাসে যাও। আর হ্যাঁ আমি অপেক্ষা করা পছন্দ করি না। কথাটা মাথায় রেখো।”

আরশি মাথা দুলালো। রৌদ্রকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। কথা গুলো যেন গালায় দলাপাকিয়ে আছে। গলা দিয়ে বের হতে চাচ্ছে না। আরশি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে হাত কচলাচ্ছে। রৌদ্র চোখ ছোট ছোট করে বলল-

“এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে! আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না!”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। মাথা তুলে হড়বড়িয়ে বলল-

“না না তা না। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”

আরশি যাওয়ার জন্য হন্তদন্ত হয়ে পেছন ফিরে যেতে নিলেই গাছের সাথে কপালে বারি খেল। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে কয়েক পা পিছিয়ে আসলো রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র মিটমিটিয়ে হাসছে। আরশি পেছন ফিরে রৌদ্র দিকে এক পকল চেয়ে কপাল দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা দূর যেতেই সব সময়ের মতো রৌদ্র ডাক শোনা গেল।

“মিস আরু দাঁড়ান।”

আরশি দাঁড়িয়ে গেল। রৌদ্র পকেটে হাত গুজে আরশিকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল-

“প্রশ্নের উত্তর গুলো পাইনি। পরের বার যেন পেয়ে যাই।”

রৌদ্র চলে গেল। আরশি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে বড্ড অদ্ভুত লাগছে। এমন পাগলাটে ব্যবহার করছে কেন? আর সে নিজেই বা চুপ করে ছিল কেন? তার হাত ধরেছে অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি কেন?
আরশির মাথা এলোমেলো লাগছে। কপাল থেকে হাত নামিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এখন আর ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। আরশি থমথমে পায়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। চোখে-মুখে পানি ছিটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আরও বিশ মিনিট বাকি ক্লাস শেষ হতে। একা একা বিরক্ত লাগছে। ফোন বের করে কাসফিয়াকে ভিডিও কল দিল। পর পর কয়েকবার রিং বাজার পর কাসফিয়া ফোন রিসিভ করলো। মেয়েটার চেহারা বিবর্ণ হয়ে আছে। প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে কেমন যেন প্রাণহীন লাগছে। নির্লিপ্ত মুখে মলিন হেসে বলল-

“কেমন আছিস আশু?”

“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

আরশির চিন্তিত গলায় প্রশ্ন গুলো শুনে কাসফিয়া মিহি কন্ঠে বলল-

“আমিও খুব ভালো আছি। তুই ক্লাস না করে বাহিরে কি করছিস?”

“তুই আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছিস কাসফি। সত্যি করে বল তুই কেমন আছিস। ওখানে কি কোনো প্রব্লেম হচ্ছে তোর!”

কাসফিয়া চুপ করে রইলো। কোনো জবাব দিলো না। আরশি আবারও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো-

“কথা বলছিস না কেন! আমার কাছে কথা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছিস না। সত্যি করে বল কিছু হয়েছে কি-না। ভাইয়া কিছু বলেছে!”

কাসফিয়া খানিক্ষন চুপ থেকে নিম্নস্বরে বলল-

“তেমন কিছু হয়নি আশু। বিজনেসের অবস্থা বেশি ভালো না তাই সবাই একটু মন খারাপ করে থাকে। আর আব্বুর অবস্থাও তেমন ভালো না।”

আরশি নিচের দিকে চেয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। কাসফিয়ার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল-

“বিয়ে করে তুই খুব পালটে গেছিস কাসফি। কথা লুকানো শিখে গেছিস। অন্য সকলের কথা ভাবা শুরু করেছিস। সবাইকে ভালো রাখতে শিখে গেছিস। সব কিছুই তো শিখে গেছিস।”

কাসফিয়া থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“এসব বলছিস কেন আশু?”

আরশি আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“তোর গালে কিসের দাগ? আর ফুলে আছে কেন গাল!”

কাসফিয়া অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। তাড়াতাড়ি করে ডান গাল হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো। হাসার চেষ্টা করে ইতস্তত করে বলল-

“আর বলিস না রে আশু। কিছুক্ষণ আগে নাস্তায় গরুর মাংস খেয়েছিলাম। তাই এলার্জিতে গাল লাল হয়ে গেছে চুলকিয়ে।”

“আমাকে কি তোর এতটাই বোকা মনে হয় যে, কোনটা এলার্জি আর কোনটা থাপ্পড়ের চিহ্ন সেটা আমি বুঝবো না!”

আরশির কঠিন বাক্যে কাসফিয়া আর কোনো মিথ্যে কথা বলার সাহস পেলো না। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো লুকানোর জন্য মাথা নুয়ে রেখেছে। আরশি আবারও শক্ত গলায় বলল-

“কবে থেকে চলছে এসব? আর কেন-ই তোর গায়ে হাত তুলেছে! প্রতিটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দে কোনো প্রকার বিনীতা করা ছাড়া।”

কাসফিয়া মাথা নিচু করেই জড়ানো কন্ঠে বলতে লাগলো,

“কিছুদিন আগেও একদিন তুচ্ছ কারণেই উনি আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম হয়তো রেগে আছে কোনো কারণে তাই এমন করেছে। কিন্তু আজ জানতে পারলাম আব্বুর বিজনেসে লস হচ্ছে তাই উনি সব সময় রেগে থাকেন। উনি আর ওনার বাবা সকালে বলছিলেন যে, আমাদের বিজনেসের জন্যই না-কি এই বিয়েটা করেছেন। আমি শুনে ফেলেছি তাদের কথা। এই কথা সত্যি কি-না জিজ্ঞেস করেছিলাম। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে গায়ে হাত তোলেন।”

অগোছালো ভাবে ধরে আসা গলায় কথা গুলো বলল কাসফিয়া। চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। গালে চার আঙুলের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাল হয়ে হাল্কা ফুলে আছে। মাথায় ঘোমটা টেনে গাল ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছে।

“আংকেল এসবের কিছু জানে?”

“না না আব্বুকে এসবের কিছুই জানে না। এমনিতেই আব্বুর শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। বিজনেসে লস হচ্ছে আর এখন যদি জানতে পারে তার বিশ্বস্ত বিজনেস পার্টনার টাকার লোভে তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে তাহলে কি হবে ভাবতে পারছিস! তোর কাছে রিকুয়েষ্ট করছি আশু একথা কাউকে বলিস না প্লিজ।”

আরশি আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার দিকে। মেয়েটার জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা ভাবতেই তার বুক কেঁপে উঠছে। একের পর এক আঘাত পেয়েই যাচ্ছে মেয়েটা। একা একা কিভাবে সামলাচ্ছে সব কিছু! কিভাবে কাটাবে বাকিটা জীবন?

“কিরে কথা বলছিস না কেন!”

কাসফিয়ার কথায় আরশির হুশ ফিরলো। ক্ষীণ গলায় বলল-

“এখন রাখছি রে কাসফি। ভালো থাকিস। আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে কোনো দ্বিধাবোধ ছাড়াই আমাকে কল দিস।”

কাসফিয়ার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই আরশি কল কেটে দিলো। সাথে সাথেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রুজল মাটিতে পরলো। আরশির ফোন বেজে উঠলো। ঝাপসা চোখে ফোনের স্কিনে দিকে তাকালো। আরশি চোখের পানি মুছে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করলো। সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে অভিমানী কন্ঠ ভেসে আসলো-

“তুই সত্যিই খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না আদ্রলিকা! একবারও তো আমাকে কল করলি না। আগে কোথাও গেলে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় কল দিতি।”

“ক্লাসে ছিলাম আমি। আর তোর কাছে আমি সব সময় ঠিক আগের মতোই আছি আর সারাজীবন এরকমই থাকবো।”

ধ্রুব চুপ করে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“তোর কি কিছু হয়েছে আদ্রলিকা? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কোনো কারণে কি তোর মন খারাপ!”

আরশির মলিন মুখে হাসলো। এই মানুষটা সব সময় তার মন খারাপের কথা বুঝে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না, প্রকাশ করতে হয় না। একজন মা যেভাবে সন্তানের চোখ মুখ দেখলে তাদের মনের অবস্থা বুঝে যায়। ধ্রুবও ঠিক সেভাবেই তার মনের অবস্থা বুঝে ফেলে। কি অদ্ভুত সম্পর্ক তাদের।

“কিছু হয়নি। বড় আব্বু কেমন আছে?”

“বেশি ভালো না। শরীর দূর্বল। প্রেশার বেড়ে গেছে।”

“আচ্ছা তুই নিজের আর বড় আব্বুর খেয়াল রাখিস। ফোন রাখছি এখন। ক্লাসে যাবো।”

আরশি একনাগাড়ে কথা গুলো বলে ফেলল। ধ্রুবকে এখন কোনো কিছু বলে চিন্তায় ফেলতে চাচ্ছে না। ধ্রুব গম্ভীর গলায় বলল-

“শোন আরু। তুই এতটাও বড় হয়ে যাসনি যে আমার কাছে তোর মন খারাপের কথা লুকিয়ে রাখতে পারবি। যাইহোক আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করবো। তুই নিজের খেয়াল রাখিস। আর হ্যাঁ মন খারাপ করিস না।”

ধ্রুব ফোন রেখে দিলো। আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাসের জন্য চলে গেল।

——————————

“আশু তুই ঠিক আছিস তো!”

আদ্রাফের চিন্তিত গলা শুনে আরশি ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো। আচ্ছা আদ্রাফ কাসফির কথা জানলে কি করবে! এমনিতেই তো কতো কষ্ট পাচ্ছে। এখন যদি জানে তার ভালোবাসার মানুষটি ভালো নেই তখন কি হবে? কাসফিয়ার ভালো জন্যই তো আদ্রাফ চুপ করে ছিল। বিয়ে তো কোনো বাধা দেয়নি। যদি এসব কিছু জানে তাহলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে তো!

“কিরে ভাবুক রানী। তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছে আদ্রাফ। তুই কথা না বলে ড্যাবড্যাব করে ওকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস কেন!”

নীলের কথায় আরশি তীক্ষ্ণতার সাথে তার দিকে তাকালো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-

“এতো ফালতু কথা বলিস কিভাবে তুই?”

“কিভাবে আবার বলবো! মুখ দিয়েই বলি সবার মতো।”

আরশি জ্বলন্ত চোখ দেখে নীল চুপসে গেল। আরশির পাশ থেকে নীলা বলল-

“আশু তুই এইর গরুর কথা বাদ দে তো। চল এখন। স্যার সেই কখন চলে গেছে আর তোরা এখনো বসে বসে ঝগড়া করছিস।”

নীলা আর সুপ্তি উঠে দাঁড়ালো। আরশি সাইড ব্যাগ নিয়ে দাঁড়াতেই আদ্রাফ বলল-

“আশু তুই নীলকে সাথে করে নিয়ে যা৷ আমার একটু কাজ আছে আম্মুর অফিসে। তাই আমার চলে যেতে হবে।”

আরশি ভ্রু জোড়া কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“নীলকে কোথায় নিয়ে যাবো?”

“কোথায় আবার নীল তোকে বাসায় পৌঁছে দিবে। আজ তো ধ্রুব ভাই নেই।”

আদ্রাফের কথায় আরশি গম্ভীর গলায় বললো-

“ধ্রুব নেই তাই বলে কি ধ্রুবর কাজ তোদের সবার ভাগাভাগি করে নিতে হবে না-কি!”

নীল ক্ষীণ গলায় বললো-

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আর এমন মুখ গোমড়া করেই বা আছিস কেন?”

আরশি কিছু বলার আগেই সুপ্তি জ্ঞানী মানুষের মতো বলল-

“আরে এমন করছিস কেন তোরা সবাই! ভাইয়া নেই বলেই হয়তো ওর মন খারাপ। আম্মু কোথাও চলে গেলে তো আমারও মন খারাপ হয়। এখানে এতো কথা প্যাচানোর কি আছে! শুধু শুধু ওকে রাগাচ্ছিস।”

নীল সরু চোখে তাকিয়ে বলল-

“ধ্রুব ভাইয়ের সাথে তোর মা’র কি জোড়া আজব!”

আরশি বিরক্ত হয়ে বলল-

“এই তোরা সবাই চুপ থাক তো। তোরা তোদের মতো যা। আমি একা একাই যেতে পারবো। আর একটা কথাও বলবি না কেউ। যত্তসব হারামির দল।”

আরশি রাগে গজগজ করে চলে গেল। ক্লাস থেকে বের হতেই নির্বানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।

চলবে….

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আচ্ছা ভাইয়া এখানে আসলে সব সময় আপনাকে এতো নার্ভাস মনে হয় কেন?”

আরশির প্রশ্নে নির্বান অপ্রস্তুত হাসি হাসলো। ডান হাতে মাথা চুলকে মিনমিনিয়ে বলল-

“কই! নাহ তো, তেমন কিছু না। চলো চলো রৌদ্র অপেক্ষা করছে।”

নির্বান আরশিদের ক্লাসের দিকে এক ঝলক তাকালো। তার অশান্ত চোখ দুটো যেন কিছু একটা খুঁজচ্ছে। আরশি সরু চোখে নির্বানের দিকে চেয়ে আছে। নির্বান আরশির চাহনি লক্ষ্য করতেই বোকা হেসে অগোছালো পায়ে হাঁটা শুরু করলো। আরশি দ্রুত পায়ে নির্বানের কাছে গিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। কিছুটা সময় পর আরশি সহজ গলায় নিম্ন স্বরে বলল-

“ভাইয়া শুনুন! আপনার কোনো কথা থাকলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।”

নির্বান স্থির দাঁড়ালো। ঘাড় বাকিয়ে বিস্মিত চোখে আরশির দিকে তাকালো। আরশি আবারও মাথা দুলিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলল-

“সত্যি বলছি। আপনার কোনো প্রব্লেম হলে আমাকে বলতে পারেন। আমি আপনাকে সাহায্য করবো।”

“হঠাৎ করে আমার সাহায্য করতে চাচ্ছো। ব্যাপার কি!”

নির্বানের সন্দিহান কন্ঠে আরশি ভ্রু কুচকালো। সামনে তাকিয়ে খানিকটা দূরে বসে থাকা রৌদ্র দিকে দৃষ্টি দিলো। রৌদ্র ফোন টিপছে। এখনো তাদের দু’জনকে খেয়াল করেনি। আরশি দৃষ্টি সরিয়ে নির্বানের দিকে এগিয়ে আসলো। ফিসফিস করে বলল-

“তেমন কোনো ব্যাপার নেই ভাইয়া। সত্যি কথা বলতে আপনাকে আমার ভালো লাগে। আপনি…!

আরশির কথার মাঝেই নির্বান বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো। কাশতে কাশতে বুকে হাল্কা আঘাত করে খানিকটা পিছিয়ে আসলো। চোখ বড়বড় করে তোতলাতে তোতলাতে বলল-

“কি বলছো!!”

আরশি ফ্যালফ্যাল নির্বানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখ অন্ধকার করে কয়েক সেকেন্ড পর বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“উফঃ আমাকে কথা তো শেষ করতে দিন। আমার কথার মাঝে কেউ ব্যাঘাত ঘটালে আমি সব গুলিয়ে ফেলি। যাইহোক শুনুন, আপনাকে আমার ভালো লাগে কারণ আপনি আপনার ওই অসভ্য ফ্রেন্ডের মতো না। আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় আপনি খুব ভদ্র, ডিসেন্ট একটা ছেলে। তবে আমাদের ক্লাসে আসলেই কেন যেন আপনি খুব নার্ভাস হয়ে যান। তাই জানতে চাচ্ছিলাম আপনার কোনো প্রব্লেম হয়েছে কি-না।”

নির্বান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আরশির এমন সংকোচহীন কথা শুনে মনে মনে হাসলো। বাঘিনী মেয়ের এমন রূপ দেখে আরেক দফায় মুগ্ধ হলো। নির্বান স্বাভাবিক ভাবে বলল-

“সেটা না হয় অন্য একদিন বলবো। এখন তুমি বলো আমার অসভ্য ফ্রেন্ড মানে রৌদ্রকে তোমার অপছন্দ কেন?”

আরশি আগের থেকেও গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল-

“ওনাকে আমার পছন্দ না কারণ উনি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে অথচ ওনার মাথায় বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই। সবার সামনে হিরো সাজতে চায়। কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই ওই দিন আমার উপর রাগ দেখিয়েছে। আচ্ছা ধরলাম আমিই ওই ছেলেদের র‍্যাগিং করছিলাম তাই বলে কি উনি একটা অচেনা মেয়ের হাত ধরে ধমকা ধমকি করবে না-কি!!”

নির্বান হতাশ গলায় বলল-

“আমিও মানছি ওইদিন রৌদ্রর ভুল ছিল। কিন্তু ওটা একটা ভুলবোঝাবুঝির কারণে হয়েছে।”

আরশি গাল ফুলিয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“উনি সব সময়ই আমার সাথে অসভ্যতামি করে। ওইযে দেখুন কিভাবে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আমাকে গিলে ফেলবে। ওনার কাছে যেতেই শুরু করবে ওনার গাঁ জ্বালানো কথাবার্তা। আমার কথা মিলিয়ে নিয়েন হুহ্।”

নির্বান সশব্দে হাসলো। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে রৌদ্রর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আরশি নির্বানের পেছন হাঁটতে হাঁটতে বলল-

“এই যে ভাইয়া শুনুন না!”

“হুম বলো আরু।”

“আমি কিন্তু আপনাকে নিজের ফ্রেন্ড মনেই করে কথা গুলো বলেছি। আপনি প্লিজ ওনাকে এসব কিছু বলবেন না। আমার অনুরোধ রইলো প্লিজ।”

আরশির আকুতিভরা কন্ঠে নির্বান হাসতে হাসতে বলল-

“আচ্ছা আচ্ছা বলবো না। ভয় পেয়ও না।”

“এতক্ষণ ধরে কি কথা হচ্ছিলো! আমি যে এখানে অপেক্ষা করছি সেটা কি মাথায় ছিলো না!”

রৌদ্রর গম্ভীর কন্ঠে আরশি তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না। নির্বানের কাছের এসে ফিসফিস করে বলল-

“দেখেছেন তো শুরু হয়ে গেছে।”

নির্বান আবারও হেসে ফেলল। আরশি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র ভ্রু কুচকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাদের দুজনকে দেখে যাচ্ছে। কিছুটা খটকা লাগছে নির্বান আর আরশির আচরণে। রৌদ্র উঠে দাঁড়ালো। পকেটে ফোন রেখে সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল-

“নির্বান তুই এভাবে হাসছিস কেন? আর এতক্ষণ কি কথা বলছিলি তোরা?”

নির্বান হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। রৌদ্রর প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বলল-

“আমার এখন যাওয়া উচিত। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।”

রৌদ্রর সম্মতির অপেক্ষা না করেই নির্বান স্থান ত্যাগ করলো। আরশি স্মিত হাসলো। রৌদ্রর এখনো অবাক চোখে নির্বানের যাওয়ার পথে চেয়ে আছে। মিনিট পেরুতেই রৌদ্রর ফোনের মেসেজ টন বেজে উঠলো। রৌদ্র ফোন নিয়ে স্কিনে নির্বানের মেসেজ দেখে ভ্রু কুঞ্চিত অবস্থা ইনবক্স ওপেন করলো-

“ভাই সুযোগ দিলাম৷ দয়া করে সুযোগটা কাজে লাগাইছ। আর হ্যাঁ অসভ্য লোক না হয়ে প্রেমিক পুরুষ হওয়ার চেষ্টা কর। তুমি বাঘ হলে তোমার প্রেমিকা বাঘিনী হবে এটাই স্বাভাবিক। তুমি প্রেমিক পুরুষ হও দেখবে বাঘিনী ধিরে ধিরে প্রেয়সী হয়ে উঠবে। হ্যাভ এ নাইছ ডেট।”

রৌদ্র চোখ ছোট ছোট করে আরশির দিকে দৃষ্টি দিলো। আরশির চোখ দুটোয় কৌতুহল খেলা করছে।রৌদ্র শান্ত গলায় বলল-

“চলো আমার সাথে।”

রৌদ্র হেঁটে যাচ্ছে ভার্সিটির পেছনের গেইটের দিকে। আরশি কিছুক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো। গেইটের বাহিরে আসতেই দেখলো রৌদ্র রিকশা থামিয়ে রেখেছে। আরশি কাছে আসতেই রৌদ্র বলল-

“রিকশায় ওঠুন।”

“কেন কোথায় যাবো আমি?”

আরশি চমকে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র গম্ভীর গলায় বলল-

“আপনি এতো প্রশ্ন করেন কেন মিস আরু?”

আরশি বিনাবাক্য ব্যয়ে মুখ গোমড়া করে রিকশা উঠে বসলো। আরশির পাশেই রৌদ্র বসলো। রিকশা চলছে। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না। আরশি ছটফটিয়ে উঠেছে। বার বার রৌদ্রর দিকে তাকাচ্ছে। রৌদ্র নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার পাশেই যে আরশি নামক একটা জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে সেদিকে যেন তার কোনো খেয়ালই নেই। অবশেষে আরশি নিজের বিস্ময় কাটাতে না পেরে প্রশ্ন করেই ফেলল-

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা তো ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।”

রৌদ্রর নির্বিকার ভঙ্গিতে আরশির রাগ উঠে গেল। কঠিন কঠিন বাক্য মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তিক্ততার সাথে কথা গুলো ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করছে রৌদ্রর দিকে। কিন্তু আরশি হতাশ হলো। সে পারছে না রৌদ্রকে রাগ দেখাতে। কি হয়েছে তার? এমন হচ্ছে কেন! কেন কিছু কঠিন বাক্য শুনিয়ে দিতে পারছে না রৌদ্রকে?

“রিকশাতে-ই বসে থাকবেন নাকি মাটিতে একটু পা রাখবেন?”

আরশির হুশ ফিরলো। ভাবলেশহীন চোখে তাকালো রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে নেমে গেল। বিস্মিত চোখে আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো। নির্জন একটা জায়গা। গাছপালায় ঘেরা কোনো জঙ্গল মনে হচ্ছে। রৌদ্র হাঁটছে তার পেছন পেছন আরশিও যাচ্ছে। কিছুটা সামনে যেতেই একটা পুরনো ব্রিজ দেখতে পেল। শুকিয়ে আসা ছোট্ট একটা খালের উপর পুরনো জর্জরিত শেওলা পরা একটা ব্রিজ। আরশি ধীর পায়ে ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। পায়ের নিচে খসে পড়া সিমেন্ট গুলো শব্দ করে চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। কালচে ধুসর রঙের রেলিঙে শেওলা পরে আছে। আরশি রেলিঙে হাত রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর বাতাসের ঝাপ্টায় গাছের পাতাগুলো নেচে ওঠার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। শীতল বাতাস বইছে। পুরো শরীরে যেন ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। রৌদ্র শব্দহীন পায়ে আরশির পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আরশির বন্ধ করে রাখা চোখ দুটোর দিকে। বেশ কিছুক্ষন পর আরশি চোখ মেলে তাকালো। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“এখানে নিয়ে আসলেন কেন!”

রৌদ্র চোখ ফিরিয়ে নিল। সহজ গলায় বলল-

“সব সময় সব কিছুর কারণ জানতে না চেয়ে মুহুর্তটাকে উপভোগ করতে শিখুন।”

আরশি কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে শেষ সময়। গাছের পাতাগুলোর ছায়ায় যেন রোদের তীর্যক রশ্মি লুকোচুরি খেলছে। আরশির মুখের উপর এসে পরেছে একমুঠো রোদ। মুক্তোর মতো ঝকঝক করছে চোখ দুটো। রৌদ্র ঘোর লাগা চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার রুদ্রাণীর দিকে।

“আমার উপর সব সময় রেগে থাকার কারণ কি? আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা আছে বলে তো মনে হয় না মিস আরু।”

আরশির প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আরশির অগোচরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

“রাগ ছিলো কিন্তু এখন আর নেই। আপনার সাথে কখনো সহজ ভাবে কথা হয়নি। সব সময় গাঁ জ্বালানো কথাই হয়েছে তাই রেগে থাকতাম।”

আরশি বেশ নম্র কন্ঠে কথা গুলো বলল। রৌদ্র হাল্কা হেসে বলল-

“ঝগড়াঝাটি করার মতো ছেলে আমি নই তবুও কেন যেন আপনার সাথে দেখা হলেই কথা কাটাকাটি হয়ে যতো। যাইহোক যা হওয়ার হয়েছে। আপনাকে ধন্যবাদ আর সরি।”

আরশি বিস্মিত হয়ে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল-

“ধন্যবাদ আর সরি কেন!”

রৌদ্র উল্টো হয়ে রেলিঙের হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। ঘাড় বাকিয়ে আরশির দিকে চেয়ে বলল-

“সরি কারণ প্রথম থেকেই আমার ভুল ছিল যার কারণে আপনার রাগ উঠেছে। আর ধন্যবাদ বললাম আমাকে বিশ্বাস করে আমার সাথে এখানে আসার জন্য।”

রৌদ্রর মুখে সরি শুনে আরশি আনন্দিত গলায় বলল-

“বাহ আপনি সরি বলতে পারেন দেখছি!”

আরশি ঘুরে দাঁড়াতে নিলেই খসে পরা সিমেন্টের টুকরো গুলোয় পা পিছলে তাল হারিয়ে ফেলে। উল্টো দিকে পরে যেতে নিলেই আরশি চিৎকার দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। মাটিতে পরে যাওয়ার আগেই রৌদ্র আরশির হাত ধরে ফেললো। আরশির হাত ধরে এক টান দিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ফেলে। আরশি অপ্রস্তুত হয়ে রৌদ্রর হাত আরও শক্ত করে ধরে। অন্য হাতে রৌদ্র বুকের দিকের শার্ট খামচে ধরেছে। আরশি পিটপিট করে চোখ খুলেই রৌদ্রর চোখাচোখি হলো। অদ্ভুত রকমের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রৌদ্রর তার দিকে। হঠাৎ করে আরশির ফোন বেজে উঠলো। আরশি হকচকিয়ে উঠে ছিটকে দূরে সরে যায়। হড়বড়িয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে না দেখেই রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই অপরপ্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠে ভেসে আসলো-

“আরু তুই তাড়াতাড়ি আমার কাছে আয়।”

চলবে…