রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-১৮+১৯+২০

0
439

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

পুরো বাড়ি ঘিরে আছে শোকের ছায়া। কারো চোখে অশ্রুর স্রোত আর কারো নিস্তব্ধ চাহনি। মানুষের কান্না আহাজারির মধ্যেও শোনা যাচ্ছে কাকের করুণ সুরের ডাক। বারান্দার রেলিঙে বসে থাকা দাড় কাক দুটো বেশ কিছুক্ষন ধরেই ডেকে যাচ্ছে। সব সময়ের মতো এই ডাকে নেই কোনো কর্কশতা। মৃত্যুর শোকে কাকটা-ও যেন শোকাহত হয়ে পড়েছে। তার এই করুণ ডাক যেন সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর দুঃসংবাদ।

“দোস্ত চল জানাযার সময় হয়ে যাচ্ছে।”

নীলের কথায় সবাই স্থির চোখে তার দিকে তাকালো। নীল আর শাকিল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে জড়ানো সাদা পাঞ্জাবি। আর মাথায় সাদা রঙের টুপি। সময় যেন চোখের পলকেই চলে যাচ্ছে। এই তো কয়েকঘন্টা আগেই তো মানুষটা কথা বলছিলো আর এখন কি-না তার জানাযা পড়ানো হবে!! জীবন নামক রেলগাড়ীতে কখন কার যাত্রাপথের সমাপ্তি ঘটে যায় তা হয়তো কারও জানা নেই। আদ্রাফ, রৌদ্র আর নির্বান নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শাকিল থমথমে পায়ে আরশির কাছে এগিয়ে এসে আলতো করে মাথায় রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ম্লান কন্ঠে বলল-

“আরু সবার খেয়াল রাখিস।”

আরশি কিছু বলল না। মাথা তুলে অশ্রুভেজা চোখে তাকালো শাকিলের দিকে। শাকিল তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল। রৌদ্র আরশির দিকে চেয়ে ধীর গতিতে চোখের পলক ফেলে। এই চাহনি সব সময়ের মতো সাধারণ নয়। এই চাহনিতে ছিল সান্ত্বনা আর আশ্বস্ত করার আশ্বাস। আদ্রাফ অপলক তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার দিকে। এই মুহুর্তে তাকে জীবন্ত কোনো মানুষ মনে হচ্ছে না। পাথরের মুর্তির ন্যায় থম মেরে বসে আছে। কোনো প্রকার নাড়াচাড়া ছাড়া প্রায় দু’ঘন্টা ধরে এভাবেই বসে আছে। কান্না করছে না আর চোখ দিয়ে পানিও পড়ছে না। নীল আদ্রাফের কাধে হাত রাখলো। আদ্রাফ দৃষ্টি সরিয়ে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো। একে একে ড্রয়িং রুমের সব পুরুষ মানুষ বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে। আরশি চেয়ার ছেড়ে উঠে কাসফিয়ার পাশে সোফায় বসলো।

“কাসফি!”

আরশি কাসফিয়ার কাধে হাত রাখতেই কাসফিয়া কান্নায় ভেঙে পরলো। সুপ্তি আর নীলা কাসফিয়ার আম্মুর রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। আরশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালো। নীলা মলিনমুখে ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো। যার মানে এখনোও কাসফিয়ার আম্মুর জ্ঞান ফিরেনি। কাসফিয়ার বাবা হার্ট এট্যাকে করে মারা গেছেন কয়েক ঘন্টা হলো। এর পর থেকেই কাসফিয়ার মা’র কান্না করতে করতেই এই বিধ্বস্ত অবস্থা। অতিরিক্ত কান্নার ফলে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে।কাসফিয়া আরশিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে। আরশি, নীলা আর সুপ্তি সোফায় বসে কাসফিয়ার কান্না থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাসফিয়া কান্নারত অবস্থায় জোরালো কন্ঠে বললো-

“জানিস আশু আব্বু আমাকে কিছুক্ষণ আগেই ফোন করে বলেছিলো আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি আব্বুর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি রে আশু।”

কাসফিয়ার কথায় সকলের চোখ ভিজে আসলো। কাসফিয়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা তাদের জানা নেই। খুব কাছের মানুষের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠা অতটাও সহজ নয় যে সামান্য সান্ত্বনার বানীতেই সব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
কাসফিয়া পুরোপুরি ভেঙে পরেছে। একের পর এক ঝড় এসে লন্ডবন্ড করে দিচ্ছে তার জীবন। এতো আঘাত পেয়ে যেন ভেতর ভেতর ভেঙেচুরমার হয়ে যাচ্ছে।

———————————

ড্রয়িংরুমের এক কোণে রৌদ্র আর নির্বান দাঁড়িয়ে আছে। আরশি ধীর পায়ে তাদের কাছে আসলো। আরশিকে দেখে নির্বান নম্রমুখে বলল-

“আমি বাহিরে আদ্রাফ ওদের কাছে যাচ্ছি।”

আরশি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্বানের দিকে। নির্বান চলে গেল। রৌদ্র ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। দুহাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে কাসফিয়াদের আত্মীয়স্বজন গিজগিজ করছে। একদল মানুষ চুপচাপ বসে আছে। কারো বা চোখে পানি চিকচিক করছে। আরেকদল মানুষ আফসোসের সুরে কাসফিয়ার বাবাকে নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। আরশি ড্রয়িংরুমে একঝলক তাকিয়ে রৌদ্রর আড়ালে এসে দাঁড়ালো। বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল-

“অনেক রাত হয়েছে আপনার এখন যাওয়া উচিত।”

রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল-

“তুমি এখানেই থাকবে?”

“নাহ। ভাইয়ার সাথে চলে যাবো কিছুক্ষন পর।”

রৌদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আরশির দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বলল-

“তুমি ঠিক আছো তো আরু!”

আরশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ম্লানমুখে বলল-

“হুম ঠিক আছি। তবে কাসফি আর আন্টির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। যাইহোক আপনাকে ধন্যবাদ আমার সাথে এখানে আসার জন্য। আর নির্বান ভাইয়াকেও আমার পক্ষ থেকে থ্যাংকস জানিয়ে দিয়েন।”

রৌদ্র মাথা দুলিয়ে শান্ত গলায় বললো-

“আচ্ছা তাহলে যাচ্ছি। তুমি নিজের আর বাকি সবার খেয়াল রেখো।”

আরশি চোখের ইশারায় সম্মতি জানালো। রৌদ্র জোরালো শ্বাস ফেলে চলে গেল।

———————————

সকাল প্রায় ন’টা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদ যেন ধরা দিতে চাচ্ছে না।গুমোট একটা পরিবেশ। আজ কেন যেন ঘুম থেকে উঠেই চিঠির কথা মনে পরলো আরশির। তাই সকালের নাস্তা করেই চিঠি নিয়ে বসে পরলো চিঠি পড়ার জন্য। আজ থেকে আরও পাঁচদিন আগে পেয়েছিলো চিঠিটা। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে চিঠিটা খুলে আর পড়া হয়নি। ধ্রুবর চলে যাওয়া আর কাসফিয়ার আব্বুর আকস্মিক মৃত্যু। সব মিলিয়ে চিঠি পড়ার মানসিকতা একদমই ছিলো না।

প্রিয় রুদ্রাণী,

একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি।

বিঃদ্রঃ আজ আর বেশিকিছু লিখলাম না। আমার ধারণা ধাঁধাটা তুমি বুঝে যাবে।

ইতি
রৌদ্র

আরশি চিঠিটা পড়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। লজ্জায় আরশির শ্যামবর্ণা গাল দুটো হাল্কা লাল আভা ধারণ করেছে ধিরে ধিরে। আরশি হার্টবিট যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে। হঠাৎই যেন এক দমকা হাওয়ায় আরশি মনটাকে এলোমেলো করে দিলো। আরশি তার বিস্ফোরিত চোখে আবারও নীল চিরকুটটা দেখলো। আরশি জানে এই ধাঁধাটার মানে কি। ছোট থেকেই খুব বই প্রেমি ছিল সে। উপন্যাস পড়া যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বড় হওয়ার সাথে সাথেই। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস খুব বেশিই প্রিয় আরশির। হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাসের মধ্যেই এই ধাঁধাটা ছিলো। আরশি টেবিল থেকে নীল রঙের একটা কাগজ নিলো। আজ কেন যেন তার খুব ইচ্ছে করছে নীল রঙের কাগজে চিঠি লিখতে। এই ইচ্ছের কারণ তার নিজেরও অজানা। আরশি কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠি লিখতে শুরু করলো।

প্রিয় রৌদ্র,

❝একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি।❞ এই ধাঁধার উত্তর তিনটা হতে পারে। আমি কোনটা ভেবে নিবো?

ইতি
রুদ্রাণী

আরশি চিঠিটা লিখে মুচকি হাসলো৷ আজ প্রথম আরশি নিজেকে রুদ্রাণী লিখে সম্মোধন করেছে। আরশি সাইড ব্যাগ নিয়ে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। বাসা থেকে দশ মিনিটের দূরত্ব।

“কিরে আশু কই তুই? আমরা তোর বাসার মোড়ে অপেক্ষা করছি।”

লাইব্রেরি থেকে বের হতেই নীলের ফোন আসলো। আজ সবার একসাথে কাসফিয়ার বাসায় যাওয়ার কথা। আরশি দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল-

“পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি আসছি৷”

নীল বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“আচ্ছা জলদি আয়।”

নীল ফোনে কেটে দিলো। আরশি ব্যাগে ফোন রেখে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। প্রায় দশ মিনিট পর আরশি বাসার মোড়ে এসে পৌঁছালো। সুপ্তির কাধে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-

“সরি সরি দেরি হয়ে গেল। চল এখন।”

“আরেকটু অপেক্ষা কর সবাই আসুক তারপর।”

আদ্রাফের কথা আরশি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। নীল, আদ্রাফ, নীলা আর সুপ্তি সবাই তো এখানে আছে। তাহলে আর কার কথা বলছে? আরশির ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু করে বলল-

“সবাই তো আছেই আর কার জন্য অপেক্ষা করার কথা বলছিস?”

“অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা এসে পরেছি।”

আরশি হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকালো৷ নির্বান দু’হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা দূরেই রৌদ্রকে দেখা যাচ্ছে। আরশি অবাক হয়ে বলল-

“আপনারাও যাবেন আমাদের সাথে?”

“কেন আমরা গেলে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?”

রৌদ্রর কন্ঠ শুনে আরশি সরু চোখে তার দিকে তাকালো৷ নির্বানের পাশে দাঁড়িয়ে রৌদ্র আবারও বলে উঠলো-

“কি হলো বলছো না যে!”

আরশির চাহনি এবার তীরে মতো তীক্ষ্ণ হলো। নির্বান রৌদ্রর পেটে গুতা দিয়ে চোখের ইশারায় চুপ করিয়ে দেয়। আদ্রাফ বিনয়ের সাথে বলল-

“আরে ভাইয়া কি বলছেন এসব। সমস্যা হবে কেন! চলুন এখন। যে কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে।”

কেউ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো৷ আরশি একটু পর পর রৌদ্রর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে সবার সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে আরশি তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে অথচ তাতে রৌদ্রর মাঝে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। আদ্রাফ আর নীলের সাথে অল্প সময়েই যেন ভাব জমিয়ে ফেলেছে নির্বান আর রৌদ্র। রৌদ্রর ব্যবহারে আরশি অবাক না হয়ে পারছে না।

——————————

“তোমাকে আমার সাথে বাসায় নিতে পারবো না কাসফিয়া।”

আবির খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাটা বলল। আবিরের কথায় কাসফিয়া নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। কাসফিয়ার মা বিস্ময় হয়ে বললেন-

“এ কথা কেন বলছো বাবা?”

আবিরের পাশ থেকে তার বাবা গম্ভীর গলায় বললেন-

“শুনুন ভাবি আমি রেজাউল ভাইয়ের বিজনেস পার্টনার ছিলাম। ওনার জন্যই এই সম্পর্কটা হয়েছে। এখন যেহেতু উনিও নেই আর ব্যবসাও ঠিক পরিস্থিতি নেই তাই শুধু শুধু এই সম্পর্ক রেখে কোনো লাভ নেই।”

কাসফিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। এমনটাই হয়তো হওয়ার ছিল। কাসফিয়ার মা অবিশ্বাসের সুরে বললেন-

“এসব কি বলছেন ভাই! ব্যবসায় লস হয়েছে আজ নাহয় কাল আবার ঠিক হবে। আর আপনার ভাই নেই বলে কি হয়েছে! বিয়ে তো কাসফি আর আবিরের মধ্যে হয়েছে। আপনার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তাদের সম্পর্ক কেন নষ্ট হবে!”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“মানে কি বলতে চাচ্ছেন আপনারা! ওদের টাকা আর বিজনেসের জন্যই কাসফির সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন?”

আরশির তীক্ষ্ণ গলা শুনে সবাই দরজার দিকে তাকালো। আরশিসহ বাকি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কাসফিয়া চোখ তুলে আদ্রাফের দিকে দৃষ্টি দিলো। আদ্রাফ চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি ছাড়া বাকি সবার চেহারায় থমথমে ভাব চলে এসেছে। এখানে এসেই এসব কথা শুনতে হবে সেটা তাদের সবার ধারণার বাহিরে ছিল। আবিরের বাবা আরশির প্রশ্নের জবাবে কিছু বললেন না। কাসফিয়ার মা’র দিকে তাকিয়ে দাম্ভিকতার সাথে বললেন-

“দেখুন ভাবি, আমি এসব নিয়ে কোনো প্রকার ঝামেলা কর‍তে চাচ্ছি না। আমাদের পক্ষ থেকে যা বলার আমরা বলে দিয়েছি। সময় মতো আমরা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।”

কাসফিয়ার মা এবার খানিকটা তেঁতে উঠলেন। কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বললেন-

“ঝামেলা করতে চাচ্ছেন না মানে!! বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কটাকে কি কোনো ছেলেখেলা পেয়েছেন আপনারা? যখন ইচ্ছে বিয়ে করবে আর যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিবে। টাকার প্রতি আপনাদের এতোই লোভ যে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করার আগে একবারও ভাবেননি।”

“আমি ওইদিনই আংকেলকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম ডিভোর্সের কথা। আংকেলও চাননি এই সম্পর্কটা থাকুক। উনি বলেছিলেন কাসফিকে উনি নিজেই নিয়ে আসবে কিন্তু তার আগেই তো মারা গেলেন।”

আবির খুব সহজ ভঙ্গিতে বলে ফেলল কথাটা। মানুষটার মৃত্যুতে তার মধ্যে কোনো প্রকার খারাপ লাগার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। কাসফিয়া কঠিন চোখে তাকালো আবিরের দিকে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আবিরের দিকে।

“আব্বুর মৃত্যুর দিন দুপুরের দিকে আপনার সাথে আব্বুর কথা হয়েছিলো?

আবির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল-

” হ্যাঁ হয়েছে।”

কাসফিয়ার চোখ দুটো পানিতে ঝলঝল করে উঠলো। তার কানে স্পষ্ট ভেসে উঠছে তার বাবার সাথে বলা শেষ কথা গুলো। সেদিন মধ্যদুপুরে কাসফিয়া তার বাবার কল পেয়ে খানিকটা বিস্ময় নিয়েই ফোন রিসিভ করেছিল।

“হ্যালো বাবা! তুমি হঠাৎ এই অবেলায় ফোন করলে যে! তুমি ঠিক আছে তো?”

অপরপাশ থেকে রেজাউল হক অভিমানী কন্ঠে বললেন-

“নিজের মেয়েকে ফোন দিতে কি বেলা অবেলা দেখে ফোন দিতে হবে!”

“উফঃ আব্বু তুমি ভুল বুঝছো।”

কাসফিয়া খানিকটা রাগ নিয়ে বলল। রেজাউল হক মেয়ের রাগী কন্ঠ শুনে স্মিত হেসে বললেন-

“আচ্ছা এসব বাদ দে। এখন বল তো তুই কেমন আছিস মা’

কাসফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে স্বাভাবিক গলায় বলল-

“আমি খুব ভালো আছি আব্বু, তুমি কেমন আছো?”

রেজাউল হক চুপ করে রইলেন। মেয়ের মিথ্যে কথায় বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। কাসফিয়ার ডাকে রেজাউল হক স্বাভাবিক হয়ে বললেন-

“আমি আছি একদম ফিটফাট।”

তিনি খানিকটা সময় চুপ থেকে আবারও বললেন-

“তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে মা। আমি তোকে আনতে গেলে তুই আসবি তো আমার সাথে!”

কাসফিয়া হতভম্ব হয়ে রইলো তার বাবার কথা শুনে। বাচ্চারা বড়দের কাছে যেভাবে চকলেট চেয়ে আবদার করে ঠিক সেভাবেই তার বাবা তার কাছে আবদার করছে। একজন বাবা তার সন্তানকে একটুখানি দেখার জন্য এভাবে আবদার করছে এই ব্যাপারটা কাসফিয়ার কাছে যতটা সুখের মনে হচ্ছে ঠিক ততটাই কষ্টের মনে হচ্ছে। কাসফিয়া শান্ত গলায় বলল-

“তোমার কষ্ট করে আসতে হবে না আব্বু। আমিই কাল সকালে চলে আসবো তোমার কাছে।”

“আচ্ছা এখন তাহলে রাখছি।”

রেজাউল হক ফোন রেখে দিলেন। তার ঠিক দশ মিনিট পরই আবার কল আসলো একই নাম্বার থেকে। তবে এবার আর কোনো আবদার করার জন্য ফোন আসেনি। এবার ফোন এসেছে আবদার করার মানুষটার মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে।

কাসফিয়া ধীর পায়ে আবিরের কাছে এগিয়ে আসলো। আবির তার ভ্রু যুগল ঈষৎ কুচকে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পরক্ষণেই ড্রয়িং রুমের সকলকে অবাক করে দিয়ে কাসফিয়া সজোড়ে আবিরের গালে চড় বসিয়ে দিলো। সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার দিকে। কাসফিয়ার ডাগর ডাগর চোখ দুটোতে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। আবিরের প্রতি ঘৃণা যেন উপচে পরছে তার চোখ দিয়ে। আবির গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকেই আবিরের বাবা দাঁড়িয়ে তেজি কন্ঠে বললেন-

“এই মেয়ে এসব কি করছো? আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস কিভাবে হলো তোমার!”

কাসফিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল-

“আপনাদের সামনেই আপনার ছেলে আমার গায়ে দু’বার হাত তুলেছে তখন আপনাদের সাহস হয়েছিল কিভাবে? আমার সাথে যা হওয়ার হয়েছে আমি চুপ করেছিলাম। আপনাদের জন্য আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। এই জন্য আমি কখনো আপনাদের ক্ষমা করবো না। আপনারা খুব ভালো করেই জানতেন আব্বু এর আগেও হার্ট অ্যাটাক করেছিল। তারপরও কিভাবে আপনারা আব্বুকে মানসিক চাপ দিলেন? আপনাদের মধ্যে কি বিন্দু পরিমাণ মনুষ্যত্ব বোধটুকুও নেই? এতটা নিম্নশ্রেণীর মানুষ কিভাবে হলেন আপনারা?”

কাসফিয়া চিৎকার করে প্রশ্ন করছে আবির আর তার বাবাকে। আবির ফুসতে ফুসতে রেগেমেগে কাসফিয়ার দিকে তেড়ে যেতে লাগলো ঠিক তখনই রৌদ্র এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। আদ্রাফ আর নীল পেছন থেকে আবিরকে ধরে রেখেছে। রৌদ্র অতি শান্ত গলায় বলল-

“একই ভুল বার বার করে পাড় পেয়ে যাবেন তা কিন্তু ভাবা ঠিক নয়। মৃত বাড়িতে এসে এসব কথা বলছেন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ বলতে কিছু নেই। তবুও বলছি যদি আপনাদের মধ্যে একটুখানিও মনুষ্যত্ববোধ থেকে থাকে তাহলে চুপচাপ ভদ্র ভাবে এখান থেকে চলে যান।”

আবির এখনো রক্তচক্ষু নিয়ে কাসফিয়ার দিকে চেয়ে আছে। আরশি রৌদ্রর পাশে এসে কঠিন গলায় বলল-

“আপনারা এখন আসতে পারেন। আর হ্যাঁ ডিভোর্সের কথা বলেছেন সেটা না হয় সময় হলেই পেয়ে যাবেন। দয়া করে এখন যান এ বাড়ি থেকে।”

আদ্রাফ পেছন থেকে আবিরের শার্টের কলার ধরে দরজার দিকে ধাক্কা দিলো। আবিরের বাবা তার ছেলে ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাসফিয়ার মা আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করে যাচ্ছেন। তার মেয়ের জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এমনিটা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি। মানুষ গুলো এত তাড়াতাড়ি রঙ বদলে ফেলবে তা যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। কাসফিয়া তার মা’র দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। রৌদ্র ইশারায় আরশিকে কাসফিয়ার কাছে যেতে বলল।
কাসফিয়া মেঝেতে বসে অঝোরে কান্না করছে। আরশি কাসফিয়ার কাছে এসে বলল-

“দোস্ত প্লিজ কান্না করিস না। তুই এভাবে ভেঙে পরলে আন্টিকে সামলাবে কে? আন্টি খুব কান্না করছে কাসফি৷ তুই প্লিজ নিজেকে শক্ত কর। আন্টির কাছে গিয়ে ওনাকে একটু সামলা দোস্ত। এখন তো তোকেই এই পরিবারটা সামলাতে হবে। তুই-ই যদি এভাবে ভেঙে পরিস তাহলে কিভাবে হবে?”

কাসফিয়া হিচকি তুলতে তুলতে অস্পষ্ট ভাবে বলল-

“সব আমার জন্য হয়েছে আশু। আমার জন্যই আব্বু আজ আমাদের কাছে নেই। আমার কথা ভেবেই আব্বুর এই দশা হয়েছে। সব কিছুর জন্য শুধু আমিই দায়ী।”

আরশি গম্ভীরমুখে বলল-

“আজেবাজে কথা বলিস না তো কাসফি। তুই নিজেকে কেন দোষী ভাবছিস! যারা এসবের জন্য দায়ী তারা নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে। এখন চল আন্টির কাছে। তোকে এভাবে ভেঙে পরতে দেখলে উনি আরও বেশি কষ্ট পাবেন।”

আরশি কাসফিয়ার চোখমুখ মুছে দাঁড় করালো। কাসফিয়া হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। আরশির সাথে ড্রয়িং রুমে চলে আসলো। কাসফিয়ার আম্মু সোফায় বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। সুপ্তি আর নীলা তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কাসফিয়া সোফার কাছে আসতেই সুপ্তি উঠে দাঁড়ালো। কাসফিয়া তার মা’র পাশে বসলো। তিনি তার মেয়েকে দেখে সাথে সাথেই শক্ত করে বুকে আগলে নিলেন। কান্না জড়িত গলায় বললেন-

“আমাদের মাফ করে দিস মা। আমরা ভুল মানুষের হাতে তোকে তুলে দিয়েছিলাম। আমাদের একটা ভুলের জন্যই তোর জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। মাফ করে দিস তোর ব্যর্থ মা-বাবাকে।”

“এখানে তোমার আর আব্বুর কারোই ভুল নেই মা। আমার ভাগ্যেই হয়তো এসব কিছু লেখা ছিলো। শুধু শুধু তুমি নিজেকে দোষী মনে করো না। বাবাকে হারিয়েছি এখন আর তোমাকে হারাতে পারবো না। আমার জন্য হলেও তুমি নিজেকে সামলিয়ে নাও মা। তোমার মেয়ের আর কিছু হারানোর মতো শক্তি নেই মা।”

——————————

“আদ্রাফ তুই একটু কষ্ট করে কাসফিকে বাসায় পৌঁছে দিস।”

আরশির কথায় আদ্রাফ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো৷ কাসফিয়া নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি কাসফিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল-

“এসব নিয়ে এতো চিন্তা ভাবনা করিস না কাসফি। এবার যা হওয়ার আইনি ভাবেই হবে। এখন তুই নিশ্চিন্তে বাসায় যা। আন্টির আর নিজের খেয়াক রাখিস।”

কাসফিয়া মৃদুস্বরে হুম বলল। আবির আর তার বাবার নামে মামলার সকল পাঠ চুকিয়ে সবেমাত্র থানা থেকে বের হয়েছে আরশি, রৌদ্র, আদ্রাফ আর কাসফিয়া৷ নীলা আর নীল কাসফিয়ার বাসায় তার আম্মুর সাথেই রয়ে গেছে। নির্বানের কিছু জরুরি কাজ থাকায় তাকে কিছুক্ষণ আগেই চলে যেতে হয়েছে।
আদ্রাফ কাসফিয়াকে নিয়ে রিকশা করে চলে গেল। আরশি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-

“আপনিও চলে যান। বাসায় যেয়ে রেস্ট নিন। সকাল থেকেই তো আমাদের সাথে এখানে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছেন।”

রৌদ্র নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“আমি তোমার সাথেই যাচ্ছি।”

“আমার সাথে যাবেন মানে! আপনি আপনার বাসায় যান আমি আমার বাসায় যাবো।”

আরশি বিস্মিত হয়ে বলল। রৌদ্র হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামিয়ে বলল-

“আমার একটু জরুরী কাজ আছে। তোমার বাসা পাড় হয়েই যাবো তাই আমার সাথেই চলো আমি তোমাকে তোমার বাসায় সামনে নামিয়ে দিয়ে তারপর যাবো।”

আরশি সরু চোখে কিছুক্ষণ রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলো। রৌদ্র মুচকি হেসে আরশির পাশে উঠে বসলো।

—————————

“আমাকে ক্ষমা করে দিস কাসফি।”

আদ্রাফের কথায় কাসফিয়া চমকে তার দিকে তাকালো। এতদিন পর আদ্রাফ তার সাথে কথা বলছে দেখেই খানিকটা চমকে উঠেছে। কাসফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে নিম্নস্বরে জিজ্ঞেস করলো-

“ক্ষমা কিসের জন্য আদ্রাফ?”

চলবে….

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২০
#Saiyara_Hossain_Kayanat

মাঝ রাস্তায় আসতেই রৌদ্র রিকশা থামিয়ে নেমে পরলো। আরশি খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল-

“কি হলো এখানে নামলেন কেন আপনি?”

রৌদ্র কিছু বলল না। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

“রিকশা থেকে নেমে এসো আরু।”

আরশি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রর শান্তশীতল মুখশ্রীতে। আরশিকে নড়াচড়া করতে না দেখে রৌদ্র আরশির হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে দাঁড় করালো। রৌদ্রর কাজে আরশির বিস্ময়ের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আরশির হাত ছেড়ে দিয়ে রৌদ্রর পাশের একটা রেস্টুরেন্টের দিকে যেতে যেতে বলল-

“মুর্তি মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে চলো।”

আরশি তার হতভম্ব ভাব কাটিয়ে দ্রুত পায়ে রৌদ্রর পেছন পেছন যেতে লাগলো। রৌদ্রর থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব থাকায় আরশি উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো-

“এই যে শুনছেন!”

রৌদ্র থমকালো। নির্বিকার ভঙ্গিতে পেছন ফিরে আরশির দিকে তাকালো। আরশি দ্রুত পায়ে রৌদ্রর কাছে এসে বলল-

“এখানে নিয়ে আসলেন কেন আমাকে?”

“আমি কি তোমার হাসবেন্ড হই!”

রৌদ্রর নির্লিপ্ত কণ্ঠে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আরশি হকচকিয়ে উঠলো। অপ্রস্তুত হয়ে অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করল-

“জ্বি? মানে!”

“জ্বি, মানে এসব বলে তোতলাচ্ছো কেন! যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও।”

রৌদ্র কাঠকাঠ গলায় বলল। আরশি অপ্রস্তুত গলায় ইতস্ততভাবে বলল-

“নাহ আপনি কেন আমার হাসবেন্ড হবেন!”

রৌদ্র ডান হাতে কপালের কাছে লেপ্টে থাকা চুল গুলো পেছনে ঢেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“আমি যদি তোমার হাসবেন্ড না-ই হয়ে থাকি তাহলে তুমি কেন বার বার বিয়ে করা বউয়ের মতো ‘এই যে শুনছেন’ বলে আমাকে ডাক দাও?”

রৌদ্রর কথায় আরশি হেবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তার কথার প্রতিত্তোরে কি বলা উচিত বা কেমন রিয়েক্ট করা উচিত কিছুই যেন আরশি বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল-

“চলুন, কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিলেন!”

রৌদ্র স্মিত হেসে রেস্টুরেন্টের ভেতর যেতে যেতে বলল-

“দুপুরের তো কিছু খাওনি সেদিকে কি খেয়াল আছে তোমার?”

রৌদ্রর কথা শুনেই আরশি অনুভব করলো তার প্রচুর খিদে পেয়েছে। ব্যস্ততায় খাওয়া দাওয়ার কথা একদমই ভুলে গিয়েছিল।

———————————

“ক্ষমা চাচ্ছিস কিসের জন্য আদ্রাফ?”

আদ্রাফ কিছুটা সময় নিয়ে অনুতপ্তের গলায় বলল-

“আমি যদি তখন তোর বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো আজ তোকে এই পরিস্থিতিতে দেখতে হতো না।”

কাসফিয়া মলিন হাসি দিয়ে বলল-

“তোর তো কোনো দোষ নেই আদ্রাফ। তুই তো আমার ভালোর কথা ভেবেই চুপ করেছিলি। শুধু শুধু নিজেকে দোষী ভাবিস না।”

“কিন্তু… ”

আদ্রাফকে থামিয়ে দিয়ে কাসফিয়া নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-

“যা হওয়ার হয়ে গেছে এটাই আমার ভাগ্যে ছিলো। আমি চাই না এসব নিয়ে কেউ নিজেকে দোষী মনে করুক। আর হ্যাঁ অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। অতীতের কথা ভেবে বর্তমানটা নষ্ট করিস না। তোর পুরো জীবন সামনে পরে আছে সেটা নিয়ে ভাব।”

আদ্রাফ আর কোনো কথা বলার সাহস পেলো না। দুজনেই চুপচাপ বসে থেকে পুরো রাস্তা পাড় করে দিলো।

———————————

“প্রিয় রুদ্রাণী,

উত্তর তো সেটাই হবে যা ভেবে তোমার মুখ লজ্জায় লাল হয়েছিল। যেই উত্তরটার কথা ভেবে তুমি নিজেকে রুদ্রাণী বলে মেনে নিয়েছো। ধাঁধার মানে তো সেটাই হবে যা মনে করে তুমি আমায় নীল চিরকুট দিয়েছো রুদ্রাণী। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলে নিশ্চয়ই তাই না!

আমি যদি সঠিক ভেবে থাকি তাহলে এই মুহূর্তে আমার চিঠি পড়ে তোমার মুখশ্রীতে আবারও লালচে আভা ফুটে উঠেছে।”

আরশি চিঠি পড়া বাদ অপ্রস্তুত হয়ে দু হাত দিয়ে গাল ঢেকে স্থির বসে রইলো। চিঠিটা পড়ে নিজের অজান্তেই আরশি নিজেকে লজ্জার চাদরে মুড়িয়ে নিচ্ছে। আরশি বড় বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় কিছুটা সময়ের মধ্যেই। চিঠিটা সামনে নিয়ে আবারও পড়তে শুরু করল।

“গালে হাত দিয়েছিলে নিশ্চয়ই! এতক্ষণ লাগে নিজেকে স্বাভাবিক করতে? তুমি আসলেই একটা পিচ্চি বাচ্চা। যাইহোক ঘাবড়ানোর কিছু নেই আমি তোমার আশেপাশে নেই। এমনিতেই অনুমান করে লিখলাম। যদি আমার কথা গুলো মিলে যায় তাহলে বুঝে নিও রৌদ্র পুরোপুরি ভাবে তার রুদ্রাণীকে অনুভব করতে পেরেছে। আর যদি না মিলে তাহলে!!

তাহলে আর কি নদীতে লাফ দিয়ে তোমার নামে শহীদ তো হতে পারবো না। বরং তার চেয়ে ভালো আরও কিছুটা সময় নিয়ে তোমায় অনুভব করার চেষ্টা করবো। আমার কথায় তুমি হাসছো তাই-না রুদ্রাণী! আচ্ছা হাসো সমস্যা নেই। তোমাকে হাসলেই বড্ড বেশি মানায়।”

ইতি
রৌদ্র

আরশি সত্যি সত্যিই হাসছে। চিঠিতে লেখা প্রতিটা লাইনই মিলে গেছে। আরশি একটা নীল রঙের কাগজ নিয়ে বড় বড় করে লিখলো,

প্রিয় রৌদ্র,

আপনি আস্তো একটা পাগল। অসভ্য একটা লোক।

ইতি
রুদ্রাণী

আরশি চিঠিটা বইয়ের মাঝে রেখে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসলো লাইব্রেরি থেকে। তার ঠিক পেছন থেকেই রৌদ্র লাইব্রেরিতে ঢুকলো। রৌদ্রর পেছন থেকে নির্বান আরশিকে দেখে বলল-

“দোস্ত ও-ই যে আরশি যাচ্ছে।”

রৌদ্র নির্বানের কাছে এসে ঘাড় বাকিয়ে ডান পাশের রাস্তায় তাকালো। আরশিকে যেতে দেখে রৌদ্র মুচকি হেসে আবারও লাইব্রেরির ভেতরে চলে গেল।

———————————

[কাসফিয়ার আব্বুর মৃত্যুর বিশদিন পাড় হয়ে গেছে। মৃত্যুর শোক কাটিয়ে কাসফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। আবারও ভার্সিটিতে আসা শুরু করেছে। আদ্রাফের সাথে বাকি সবার মতোই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। কাসফিয়ার ব্যবহারে আদ্রাফের মন কিছুটা ক্ষুন্ন হলেও মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করছে না।
রৌদ্র আর নির্বানের সাথেও তাদের সবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ তবে নির্বান এখনও আগের মতোই নার্ভাস হয়ে পরে নীলার কাছে আসলে। আরশি সাথে রৌদ্রর সম্পর্কটাও এই কিছুদিনে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
রৌদ্র আর রুদ্রাণীর চিঠির আদান-প্রদান চলছে নিয়মিত। নিজেদের অনুভূতি গুলোকে খুব সুন্দর করেই স্বস্তির সাথে একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। প্রতিদিনই চিঠির নিচে লেখা থাকছে “একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি” এই একটা ধাঁধার মাধ্যেই তারা দুজন আটকে আছে। চিঠি পড়ে লজ্জায় নুয়ে পরা, কখনো বা মুচকি মুচকি হেসে ওঠাই চিঠির মানুষটার প্রতি আরশির অনুভূতির জানান দিচ্ছে।]

প্রায় দশ মিনিট ধরে আরশি আর তার বন্ধুরা ফুচকার জন্য অপেক্ষা করছে। বিকেলে সবাই এক সাথে বেরিয়েছে ফুচকা খাওয়ার জন্য। তবে দোকানে এসেই সবাই আশাহত হলো। ফুচকা এখনো তৈরি হয়নি। আদ্রাফ আর নীল ফুচকা খাওয়ার জন্য হার মেনে নিলেও নীলা, সুপ্তি, কাসফিয়া আর আরশি ঠায় বসে আছে। তারা এই দোকান থেকে ফুচকা না খেয়ে কিছুতেই যাবে না। নীল চোখে মুখে ভয়ংকর রকমের বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল-

“ওই ভিক্ষুকের দল!! তোরা জীবনে কখনো ফুচকা খাসনি?”

“না খাইনি”

কাসফিয়ার ত্যাড়া কথায় আদ্রাফ অবাক হয়ে বলল-

“ওরে বাটপারের দল। তিনদিন আগেই তো আমার পকেট খালি করে তোরা ফুচকি খাইলি। আর এখনই কিনা অশিকার করছিস?”

আরশি আদ্রাফের মাথায় চাপড় দিয়ে বলল-

“বেশি কথা বলিস না তো। আমরা এখান থেকেই ফুচকা খাবো এটাই আমাদের শেষ কথা।”

“ফুচকা পরে খাবে আরু। এখন একটু আমার চলো।”

রৌদ্র কন্ঠস্বর শুনে সবাই পেছন ফিরে তাকালো। রৌদ্র দু’হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই নির্বান। আড় চোখে বার বার নীলার দিকে তাকাচ্ছে। আরশি উঠে দাঁড়ালো। বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“আপনার সাথে কোথায় যাবো?”

রৌদ্র আরশির প্রশ্নের উত্তর দিলো না। আদ্রাফ আর নীলের দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-

“তোমাদের ফ্রেন্ডকে একটু ধার নিচ্ছি। তার বদলে আমার ফ্রেন্ডকে বন্ধক রেখে যাচ্ছি তোমাদের কাছে। চিন্তা করো না।”

রৌদ্র কথায় সবাই হেসে উঠলো। তবে আরশি আর নির্বার বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্র দিকে চেয়ে আছে। আরশি কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই রৌদ্র তার হাত ধরে বলল-

“বেশি কথা বলো না আরু। জরুরি কাজ আছে তাড়াতাড়ি চলো।”

রৌদ্র আরশিকে নিয়ে যেতে যেতে সবার উদ্দেশ্যে বলল-

“আমরা ওইদিকটায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো।”

রৌদ্র হাতের ইশারায় পাশের পুকুর পাড়টা দেখিয়ে বলল। নির্বান আহত দৃষ্টিতে রৌদ্রর যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।

————————
বিকেলের শেষ সময়। পশ্চিম আকাশে সূর্যের রক্তিম আভার ছড়াছড়ি খেলা হচ্ছে। পুকুর পাড়ে এক পাশে আরশি আর রৌদ্র দাঁড়িয়ে আছে। আরশি মুখ অন্ধকার হয়ে আছে।

“এখানে নিয়ে আসলেন কেন আমাকে? কতক্ষণ ধরে ফুচকার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর আপনি আমাকে খাওয়ার সুযোগ না দিয়েই এখানে নিয়ে আসলেন।”

আরশি প্রচন্ড আফসোসের সাথে বলল কথা গুলো। রৌদ্র প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। পশ্চিম আকাশের দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন পর রৌদ্র শীতল কন্ঠে বললো-

“আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু।”

চলবে.