রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-২১+২২+২৩

0
366

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু।”

খুব সহজ এবং সাবলীল বাংলা ভাষায় বলা স্পষ্ট এই চারটা শব্দ শুনে আরশি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। নিজের বিস্ময়টাকে নিজের মাঝেই বিলীন করে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে রৌদ্রর দিকে তাকালো। অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর শান্ত,শীতল নির্বিকার ওই মুখের দিকে। মানুষটাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার মুখ দিয়েই এই অপ্রত্যাশিত বাক্যটি বের হয়েছে। সে ব্যস্ত, খুব মনোযোগ দিয়েই মুগ্ধ চোখে পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্য দেখতে ব্যস্ত। সত্যি সত্যিই কি মুগ্ধ চোখের এই নিশ্চুপ মানুষটা এই কথা বলেছে!! না-কি তার কল্পনার অদৃশ্য কোনো মানব তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলেছে “আমি তোমাকে ভালোবাসি আরু” আরশি ভাবছে। খুব গভীরভাবেই ভাবছে। শুধু ভাবা পর্যন্তই তার মস্তিষ্ক আটকে আছে। তার ভাবনার কোনো সঠিক কূল-কিনারা এখনো বের করতে পারেনি।

“ভাই ও-ই যে ওই মেয়েটাই ছিলো।”

অপরিচিত কন্ঠ শুনে আরশি পেছন ফিরে তাকালো। তিনটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একজনকে আরশি চিনতে পেরেছে। ওইদিনের বখাটে ছেলেটাই যে কি-না তাকে আর সুপ্তিকে বাজে ইঙ্গিত করে কথা বলেছিল। আরশি তীক্ষ্ণ চোখে ছেলে গুলোর দিকে চেয়ে আছে। রৌদ্রর সেদিকে খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি এখনো আগের মতোই দূর আকাশের দিকে নিস্তব্ধ। রৌদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে শীতল কন্ঠে বলল-

“ভালোবাসি রুদ্রাণী।”

রৌদ্রর কথায় কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কয়েক সেকেন্ড পরমুহূর্তেই আরশির চেচিয়ে ওঠা কন্ঠস্বর শোনা গেল।

“ছাড়ুন আমার হাত।”

রৌদ্র পেছন ফিরে তাকালো। আরশি তার থেকে খানিকটা পেছনে। একটা ছেলে আরশির হাত ধরে রেখেছে। কিছুটা দূরেই আরও দুইটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র খুব ভালো করেই চিনেছে ছেলে গুলোকে। সে জানতো ছেলে আবারও আসবে ঝামেলা করতে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়িই সেই সময়টা এসে পরবে সেটা রৌদ্র ভাবে নি। আরশি ছেলেটার কাছ থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শক্তপোক্ত পুরুষালী দেহের কাছে তার নরম-সরম শরীরের জোর বরাবরই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। রৌদ্র রাগান্বিত হয়ে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। কপালের রগ গুলো ফুলে চামড়ার ভেতর থেকে ভেসে উঠেছে। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে আগুন চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো। রাগে ফুসতে ফুসতে আরশির কাছে এসে এক ঝাটকায় ছেলেটাকে দূরে সরিয়ে দিলো। আরশিকে নিজের পেছনে আড়াল করে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছেলেটার ডান গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। ছেলেটা নিজের তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা দূরে ছিটকে পরেছে। রৌদ্র আরশির দিকে না তাকিয়েই শান্ত গলায় বলল-

“পেছনে যাও আরু।”

আরশির কেঁপে উঠল। রৌদ্র শান্ত শীতল কন্ঠ এই মুহুর্তে বড্ড অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এ যেনো ঝড়ের আগের শান্ত শীতল পরিবেশ। রাগে ভয়ংকর হয়ে ওঠা রৌদ্রর মুখে এই ছোট্ট কথাটাও কেন যেন আরশির ভয়ের কারণ হয়ে উঠলো। আরশি কোনো নাড়াচাড়া না করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্র আরশির দিকে তাকালো না। রক্তচক্ষু নিয়ে সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটি রৌদ্রকে দেখে তার মধ্যে ছোট ছেলেটা দৌড়ে পালিয়ে গেল৷ রৌদ্র ঝুঁকে মাটিতে পরে যাওয়া ছেলেটার কলার ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালো। ছেলেটার শার্টের কলার ধরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো রৌদ্র-

“সেদিনও বলেছিলাম ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে কিন্তু আমার কথা শুনলি না। তোর সাহস কি করে হলো ওর গায়ে হাত দেওয়ার!”

রৌদ্র আবারও চড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার ডান গালে। রাস্তার পাশের ছেলেটাও এবার রৌদ্রর উপর হামলে পরলো। আরশি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাকরুদ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছে রৌদ্রর সাথে ছেলেগুলোর মারামারি। আরশি আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। রৌদ্রর পেছন থেকে একটা ছেলে তার৷ গলা চেপে ধরে আছে। আরশি দ্রুত তাদের কাছে গিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আকুতিভরা টলটলে চোখে তাকিয়ে বলল-

“প্লিজ আপনারা থামুন। ওনাকে ছাড়ুন প্লিজ।”

রৌদ্র ছেলেটার হাত গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বললো-

“আরু তুমি যাও এখান থেকে।”

আরশি রৌদ্রর কথা কোনো আমলেই নিলো না। হাতাহাতির এক পর্যায়ে একটা ছেলে আবারও আরশির কাছে আসলো। আরশির হাত ধরে টানাটানি করছে। হঠাৎই ছেলেটা আরশিকে ধাক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার পাশে ছিটকে পরছে আরশি। ঝোপের সাথে লেগে আরশির হাতের কিছুটা অংশ কেটে রক্ত বেরিয়ে আসলো।

“আদ্রলিকা তুই ঠিক আছিস তো?”

দূর থেকে আরশিকে মাটিতে পরে যেতে দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে চেচিয়ে উঠলো ধ্রুব। ধ্রুবর পেছন পেছন নীল আর বাকি সবাই আসছে। রৌদ্রর সাথে ছেলে দুটোর ধস্তাধস্তি দেখে নির্বান, নীল আর আদ্রাফ দৌড়ে সেদিকে যাচ্ছে। কিন্তু তার আগেই ছেলে দুটো রৌদ্রর থেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেল। নির্বান রৌদ্রর কাছে এসে উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“কিরে এই অবস্থা হলো কি করে? কে ছিলো ওরা?”

নির্বানের প্রশ্নের জবাবে রৌদ্র কিছু বলল না। থমথমে পায়ে আরশির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ধ্রুব অস্থির হয়ে আরশির পাশে বসলো। আরশির গালে হাত দিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করছে ধ্রুব-

“কি হয়েছে তোর বল আমাকে। তুই ঠিক আছিস তো!!”

আরশির চোখ দিয়ে পানি পরছে। ভয়ের চোটে কপাল ঘেমে চিকচিক করছে। সারা মুখে ছাড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘামে লেপ্টে থাকা চুল। শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ভয়াতুর চোখে রৌদ্রর দিকে চেয়ে আছে আরশি। রৌদ্র নাক দিয়ে রক্ত পরছে। হাতের কিছু অংশের চামড়া ছিলে রক্ত বের হচ্ছে। রৌদ্র তার দিকেই এগিয়ে আসছে। রৌদ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে আরশি ভয়ে ধ্রুবর শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। ধ্রুবর সাদা শার্ট আরশির রক্তে ভিজে রক্তলাল হয়ে যাচ্ছে। রৌদ্রর দিকে এক ঝলক তাকাতেই ধ্রুবর টনক নড়ে উঠলো। আরশি রক্ত ভয় পায়। ছোট থেকেই রক্ত দেখলে আরশি অস্বাভাবিক হয়ে পরে। ধ্রুব আরশির চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে দু’হাতে গাল আগলে নিয়ে বলল-

“আদ্রলিকা আমার দিকে তাকা বলছি। আমার চোখে দিকে তাকা।”

আরশির কান পর্যন্ত ধ্রুবর কোনো কথাই পৌঁছালো না৷ আগের মতোই রৌদ্র দিকে তাকিয়ে অনবরত কেঁপে যাচ্ছে।

ধ্রুব এবার ধমক দিয়ে উচ্চস্বরে বলল-

“আদ্রলিকা আমি তোকে কিছু বলছি শুনতে পাচ্ছিস!! তাকা আমার দিকে।”

আরশি হকচকিয়ে ক্লান্ত চোখে ধ্রুব দিকে তাকালো। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে নিঃশব্দে বাচ্চাদের মতো ডুকরে কেঁদে উঠলো। ধ্রুব শক্ত করে আরশিকে জড়িয়ে ধরলো৷ আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-

“আদ্রলিকা ভয় পাস না আমি আছি তো। দেখি তোর হাত দেখা তো আমাকে।”

আরশি এখনো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মুখ গুজে আছে ধ্রুবর বুকে। রৌদ্র থমকে দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়। ধ্রুব আর আরশির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্লিপ্ত শান্তশীতল তার চাহনি। অনুভূতি শূন্য সেই দুটি চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়েছে তার মনে। এই ঝড় লন্ডবন্ড করে দিচ্ছে রৌদ্রর সকল অনুভূতি। পিষে ফেলছে তার হৃদয়টাকে। বুকে ব্যথা অনুভব করছে রৌদ্র। তীব্র অসহ্যকর ব্যথা। কিসের ব্যথা এটা!! ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া হৃদয়ের ব্যথা! না-কি ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য একটা ছেলের বুকে দেখার মতো এই তিক্ত মুহুর্তটার জন্য এই ব্যথা। নির্বান তার কৌতুহলী চোখ দুটো ধ্রুবর দিক থেকে সরিয়ে আহত দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্রর নির্লিপ্ততা দেখে নির্বান তপ্ত শ্বাস ফেলে। ধ্রুব রুমাল বের করে ঘাড় বাকিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আরশির হাত বাধতে বলল। নীল রুমালটা নিয়ে ধ্রুবর কথা মতো আরশির হাতের কাটা জায়গায় বেধে দিলো। ধ্রুব আরশিকে দাঁড় করিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-

“এই দেখ আদ্রলিকা রক্ত নেই। ভয় পাস না।”

আরশির মাথা তুলে তাকালো না। ধ্রুব আরশিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ডান হাতের আঙুল রৌদ্রর দিকে উঁচু করে শান্ত গলায় বললো-

“আদ্রলিকা থেকে দূরে থাকবেন। এবার ভালো ভাবে বলছি। কিন্তু নেক্সট টাইম আদ্রলিকার কিছু হলে আমি আপনাকে ছাড়বো না। আর হ্যাঁ এটা ভাববেন না যে আপনি বড় বলে আপনাকে ছাড় দিয়ে দিবো। আদ্রলিকার ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কাউকেই ছাড় পাবে না মনে রাখবেন।”

ধ্রুব আরশিকে নিয়ে রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। রৌদ্রসহ বাকি সবাই ধ্রুবর ঠান্ডা হুমকি শুনে স্তব্ধ হয়ে আছে। নীল আদ্রাফ, নীলা, কাসফিয়া আর সুপ্তি সবার চেহারা ফেকাসে হয়ে গেছে। এর আগে কখনো ধ্রুবকে এভাবে হুমকি দিতে দেখেনি তারা কেউ-ই। সুপ্তি, নীলা আর কাসফিয়া দ্রুত পায়ে ধ্রুবর পেছন পেছন হাঁটা শুরু করলো। আদ্রাফ রৌদ্রর সামনে এসে বিনীত ভঙ্গিতে বলল-

“এখানে কি হয়েছে তা আমরা জানি না তবে যতটুকু বুঝতে পারছি এতে আপনার কোনো দোষ নেই। ধ্রুবর ভাইয়ের কথা গুলোর জন্য সরি। আসলে ধ্রুব ভাই আশুকে নিয়ে অনেক বেশি পজেসিভ তাই কিছু না ভেবেই আপনাকে ভুল বুঝে ফেলেছে। কিছু মনে করবেন ভাইয়া। ধ্রুব ভাই এমনিতে খুব ভালো। আশুকে খুব ভালোবাসে তাই ওর কোনো ক্ষতি সহ্য করতে পারে না।”

আদ্রাফ একনাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। নীল আদ্রাফের হাতে টান দিয়ে নিম্ন স্বরে বলল-

“তাড়াতাড়ি চল না হলে আমাদের কপালেও শনিরদশা লেগে যাবে।”

আদ্রাফের উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলেই নীল নির্বানের তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“নির্বান ভাই আপনি ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যান। আমরা এখন যাচ্ছি”

নির্বান মাথা ঝাকালো। নীল আর আদ্রাফ দৌড়ে চলে যাচ্ছে ধ্রুবর উদ্দেশ্যে। রৌদ্র মুর্তির ন্যায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। কানের মধ্যে শুধু আদ্রাফের বলা কথা গুলোই বাজচ্ছে। “ধ্রুব ভাই আশুকে নিয়ে অনেক বেশি পজেসিভ।” “আশুকে খুব ভালোবাসে” এই বাক্য দুটো মনে পরতেই রৌদ্রর চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। নির্বান রৌদ্রর কাধে হাত রেখে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল-

“রৌদ্র তুই ঠিক আছিস তো!”

রৌদ্রর মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হচ্ছে না। নির্বান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌদ্রর বাহু ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল-

“চল হসপিটালে। নিজের হাল দেখেছিস কি হয়েছে!”

“ধ্রুবর ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে নির্বান।”

রৌদ্র ভাবলেশহীন ভাবেই বলল কথাটা। নির্বান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মুহূর্তে রৌদ্রকে কিছু বলার ভাষা তার কাছে নেই।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২২
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“ধ্রুবর ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা নিতান্তই তুচ্ছ মনে হচ্ছে নির্বান।”

নির্বান তার হতাশ চোখে রৌদ্রর দিকে খানিক্ষন নিশ্চুপ চেয়ে রইলো। ছোট করে শ্বাস ফেলে শান্ত ভাবে বলল-

“এমটা কেন ভাবছিস তুই রৌদ্র! তুই আরুর জন্য কতটা পাগলামি করেছিস তা শুধু আমিই জানি। একটা অদেখা, অজানা মেয়েকে খোঁজর জন্য কতটা উদাস ছিলি দু’বছর। তোর মতো ম্যাচিউর একটা ছেলে এই যুগে চিঠি দেওয়া নেওয়ার মতো পাগলামিতে দিনের পর দিন মেতে ছিলি। তবুও কেন এসব বলছিস তুই?”

রৌদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে পকেট থেকে রুমাল বের নাকের রক্ত মুছলো। অগোছালো চুল গুলো আঙুলের সাহায্যে ঠিক করে সরল গলায় বলল-

” ধ্রুবর চোখ দুটো দেখেছিস! আরুর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা উপচে পরছিল ওর চোখ দুটো দিয়ে। আরুকে এই অবস্থায় দেখে কতটা অস্থির হয়ে পরেছে দেখেসিনি! এই ছেলেটাকে গত তিন-চার বছর ধরে ক্যাম্পাসে দেখছি আমরা। কখনো কারো সাথে বেয়াদবি কিংবা উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেছি!!”

রৌদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্বানের দিকে। নির্বান হাল্কা করে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। রৌদ্র আবারও শান্ত গলায় বলতে লাগল-

“এই ছেলেটা-ই আজ আমাকে হুমকি দিয়ে গেল। ঠান্ডা মাথায় খুব সুন্দর করেই হুমকি দিয়েছে। তবে চোখে ছিল হিংস্রতা। রাগে চোখ দুটো হিংস্র বাঘের মতো ছিলো তবুও নিজেকে আরুর সামনে স্বাভাবিক রেখেছে। নিজেকে সকল পরিস্থিতিতে সামলিয়ে রাখার মতো খুব সুন্দর একটা গুন আছে ছেলেটার মধ্যে। কিন্তু পরের বার হয়তো আরুর জন্য ও কোনো কিছু করতেই দ্বিধাবোধ করবে না। হয়তো নিজের জান দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। ওর চোখ দুটো অনেক কিছুই প্রকাশ করে নির্বান।”

“কিন্তু আরু..”

রৌদ্র নির্বানের কথার মাঝেই বলে উঠলো-

“একটা ছেলেকে কতটা ভরসা করলে ভয়ে তার বুকে মুখ গুজে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে পারে বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই। নাকি সব বুঝেও আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছিস?”

নির্বান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। সে নিজেও বুঝতে পারছে ধ্রুব আর আরুর সম্পর্কটা খুব ভরসা কিংবা ভালোবাসার। নির্বান স্বাভাবিক হয়ে রৌদ্রর পিঠে হাল্কা থাপ্পড় মেরে বলল-

“এসব চিন্তাভাবনা বাদ দে। তোর ভালোবাসার শক্তি প্রবল হলে তোর ভালোবাসার মানুষ তোর হবেই। এখন হসপিটালে চল। নিজের কি অবস্থা করেছিস সে খেয়াল কি আছে?”

নির্বান রৌদ্রকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। রৌদ্রর কাধে হাত দিয়ে এক প্রকার ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে।

——————————

“আদ্রলিকা কিছু বলছিস না কেন? এতদিন পর আমাকে দেখেও চুপ করে থাকবি!”

হসপিটালের কেবিনে মাথা নিচু করে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে আরশি। একটু পর পর হিচকি তুলে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। চোখমুখ ফ্যাকাসে বর্নের হয়ে আছে। চোখের কোণে লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া পানির কালচে দাগ। ডান হাতে ব্যান্ডেজের কিছুটা জায়গায় রক্ত লেগে আছে। ধ্রুবর কথায় আরশি নিরুত্তর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। ধ্রুব চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। গায়ে জড়ানো সাদা শার্টে লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে খয়েরী বর্ন ধারণ করেছে। ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আরশির কপালের কাছের চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে উদাসীন গলায় বলল-

“তুই এখন বড় হয়েছিস আদ্রলিকা। সামান্য রক্ত দেখে ভয়ে এভাবে চুপ হয়ে গেলে চলবে! নিজেকে একটু শক্ত কর তা নাহলে এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় চলবি কি করে! আচ্ছা যা তোর কথা বলতে হবে না। আমি যাচ্ছি। তুই থাক।”

ধ্রুব অভিমানী কন্ঠে কথা গুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আরশি ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ম্লান কন্ঠে বলল-

“নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় চলার জন্য তুই তো পাশে আছিস-ই।”

ধ্রুব হাল্কা হাসলো। আরশির নাকে আস্তে করে টান দিয়ে বলল-

“বিয়ে হয়ে গেলে কি করবি! আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবি?”

“দরকার হলে তা-ই করবো।”

আরশি খুব সহজ গলায় বলল কথাটা। ধ্রুব ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু করে বলল-

“আর আমি মরে গেলে কি করবি? তখন কিভাবে থাকবি!”

আরশি অপলক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হঠাৎ করে মুখে কাঠিন্যে ভাব নিয়ে শক্ত গলায় বলল-

“যান এখান থেকে। আদ্রাফকে নিয়ে আসুন আমি বাসায় যাবো।”

ধ্রুব কথা বাড়ালো না। তার কথায় আরশি রেগেছে। খুব বেশিই রেগেছে। তাই তো তুই থেকে ডিরেক্ট আপনিতে চলে গেছে। এখন আর একটা শব্দ মুখ বের করলেই আরশির রাগ জ্বলন্ত শিখার রূপ নিবে। আরশি কখন কেমন ব্যাবহার করবে, কি করলে রেগে যাবে, কখন কি পদক্ষেপ নিবে এসব কিছুই ধ্রুবর মুখস্থ। ছোট থেকে এই পর্যন্ত আরশির প্রতিটা মুহুর্ত সে নিখুঁতভাবে মনে রেখেছে। ধ্রুব ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নীল, কাসফিয়া, সুপ্তি আর নীলা চলে গেছে অনেক আগেই। আদ্রাফ বিল, আর ওষুধের জন্যই বাহিরে গেছে। প্রায় দশ মিনিট পর ধ্রুব আদ্রাফকে নিয়ে কেবিনে আসলো। আদ্রাফ আরশির সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো-

“কিরে কেমন আছিস এখন? হাতে ব্যথা আছে?”

আরশি গম্ভীর গলায় বলল-

“নাহ নেই। চল এখন।”

আরশির এলোমেলো চুল গুলো হাত খোপা করার চেষ্টা করেও ব্যান্ডেজের জন্য পারলো না। বিরক্ত হয়ে চুল না বেধেই বেড থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ধ্রুব ধরতে আসলেও আরশি ধ্রুবকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটা শুরু করলো৷ পায়ে কিছুটা ব্যথা পাওয়া খানিকটা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটছে। আদ্রাফ চোখের ইশারায় ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলো আরশির কি হয়েছে। ধ্রুব আদ্রাফের কানের কাছে এসে ফিসফিয়ে বলল-

“একটু জ্ঞান দিচ্ছিলাম। তুই জানিসই তো আদ্রলিকা কেমন!”

আদ্রাফ হাল্কা হেসে বলল- “আচ্ছা আমি দেখছি।”

আদ্রাফ আরশিকে ধরে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো। রাত প্রায় আটটা। চাঁদ, তারা বিহীন ফাঁকা আকাশে কালো মেঘ জমেছে। শীতল হাওয়া বইছে। সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয় আলোকিত রাস্তাঘাট। রাস্তার একপাশে আদ্রাফ আরশিকে দাঁড় করিয়ে বলল-

“ধ্রুব ভাই আপনি আশুকে একটু ধরুন। আমার এখন যেতে হবে। আম্মুকে অফিস থেকে নিয়ে যেতে হবে। আশু তুই নিজের খেয়াল রাখিস। আমি এখন আসি।”

আদ্রাফ একনাগাড়ে কথা গুলো বলে জোর করে আরশির হাত ধ্রুবর হাতে দিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে ধ্রুব কানে ফিসফিস করে বলল-

“নাও ভাই এবার তোমাকে সুযোগ করে দিলাম। তুমি তোমার এই বিড়ালের বাচ্চাটার রাগ ভাঙাও আমি গেলাম।”

আদ্রাফ আর দেরি না করে হড়বড়িয়ে উল্টো পথে চলে গেল। আরশি গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একটুও নড়ছে না। আর কথাও বলছে না।

“হয়েছে এবার চল। আর রাগ করে থাকতে হবে না।”

“আপনি আমার হাত ছাড়ুন আমি একাই চলতে পারবো।”

আরশির কঠিন গলায় ধ্রুব অসহায় মুখ করে মিনমিনিয়ে বলল-

“এতদিন পর আসলাম তবুও তুই এমন করছিস! আরে ভাই ভুল হয়েছে আমার। এবারের মতো মাফ করে দে। এই দেখ কানে ধরলাম।”

ধ্রুব আরশির এক কান ধরে মলিন মুখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। ধ্রুব জানে আরশি একটু পরেই ফিক করে হেসে দিবে। ঠিক তাই হলো আরশি কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আচমকাই ফিক করে হেসে দিলো। ধ্রুবর পেটে কনুই দিয়ে গুতা মেরে বলল-

“হারামি ছাড় আমার কান।”

ধ্রুব পেটে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ‘আহহ’ শব্দ করেই আরশির কান ছেড়ে দিলো। আরশি ক্ষীণ গলায় বলল-

“আচ্ছা চল এখন। অনেক রাত হয়ে গেছে। তোর ছোট মা তো একবার বকবক শুরু করলে আর থামবেই না।”

ধ্রুব আরশিকে ছেড়ে দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল-

“আমি থাকতে এতো চিন্তা কিসের! তুই নিশ্চিন্তে থাক।”

ধ্রুব আরশির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরশির চুল গুলো খুব সুন্দর করে তার নিখুঁত হাতে খোপা করে দিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“রেডিমেড বাচ্চার রেডিমেড মা হওয়ার দায়িত্ব পালন করছি। তোকে বড় করতে করতে আমি মেয়েদের সব কাজেই দক্ষ হয়ে গেছি।”

আরশি শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল-

“ভালোই হয়েছে তোর বউয়ের জন্য সুবিধা হবে।”

ধ্রুব ভ্রু কুচকে আরশির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জোড়ালো শ্বাস ফেলল। হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা থামিয়ে আরশিকে রিকশা তুলে নিজেও বসে পরলো।
দূর থেকে দু জোড়া আহত চোখ আরশি আর ধ্রুবকে দেখে যাচ্ছে। রৌদ্রর চোখ দুটো চিকচিক করছে। সোডিয়ামের আলোয় চোখের পানি মুক্তার মতো চকচক করে উঠছে। রৌদ্র চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিলো। চোখের জল লুকিয়ে পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। রৌদ্র কপালে আর হাতে ব্যান্ডেজ করা। ক্লান্ত চোখে নির্বানের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক ভাবে বললো-

“চল যাওয়া যাক।”

নির্বান মাথা দুলালো। রৌদ্রকে এভাবে দেখে তারও খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কি -ই বা করবে তার একমাত্র বন্ধুর জন্য!

——————————

“কিরে তোর হাতে কি হয়েছে আরু! আর চোখমুখ এমন লাগছে কেন? হাত কেটেছে কিভাবে?”

দরজা খোলার সাথে সাথেই শাকিল একেরপর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। আরশি কিছু বলছে না চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করছে। শাকিল অস্থির হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল-

“কথা বলছিস না কেন! কি হয়েছে? ধ্রুব,তুই বলতো কি হয়েছে। তুই তো ফোন দিয়ে বললি তুই আরুর সাথেই আছিস। তাহলে এসব কি করে হলো!”

শাকিল ধ্রুবর দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ধ্রুব বিরক্ত হ্যে শাকিলকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সামনে সরিয়ে দিলো। আরশিকে ধরে ভেতরে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দিলো। কন্ঠে বিরক্তির সুর টেনে বলল-

“দেখছিস আদ্রলিকার শরীর ভালো না তবুও ভেতরে আসতে না দিয়ে হ্যাবলার মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছিস।”

শাকিল দরজা লাগিয়ে আরশির পাশে বসে উত্তেজিত হয়ে বলল-

“আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বল কি হয়েছে। আরু ব্যথা পেয়েছে কিভাবে?”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

বিধস্ত এক বিষন্ন হৃদয় নিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলছে রৌদ্র। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় খানিকটা দূর দূর ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রৌদ্র মাথা নিচু করে দৃষ্টি পিচঢালা রাস্তায় দিয়ে রেখেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে তার ছায়ার খেলা দেখছে। কিছুটা সময় ছায়া সাথে সাথেই চলছে আবার কিছুটা সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। দুইটা ল্যাম্পপোস্টের মাঝামাঝি আসলেই ছায়াটা মিলিয়ে যায়। আর যখন ল্যাম্পপোস্টের বাতির নিচে থাকে তখন ছায়াটা একদম তার সাথে মিলে যাচ্ছে। নির্বান থমথমে পায়ে রৌদ্রর পেছন পেছন হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও হতাশ দৃষ্টিতে রৌদ্রকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরছে। বেশ খানিকটা সময় পর নিরবতা ভেঙে নির্বান বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল-

“আহহ! রৌদ্রর এসব কি শুরু করেছিস বলতো! তুই কি ছোট্ট বাচ্চা যে অবুঝের মতো এমন বাচ্চামো করছিস?”

রৌদ্র বিস্ময় নিয়ে নির্বানের দিকে ফিরে তাকালো। নির্বানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল-

“কি করেছি আমি?”

নির্বানের চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ক্ষীণ গলায় বলল-

“নিজের ছায়াকে এতো মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে আজব!!তোর কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে তুই পাগল যাচ্ছিস।”

“তাই না-কি!!”

রৌদ্র নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটুকু বলেই আবারও হাঁটা শুরু করলো। নির্বান স্থির দাঁড়িয়ে সরু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা নতুন হাঁটা শিখে গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে খুব নিখুঁতভাবে, মনোযোগ দিয়ে। নির্বান দ্রুত রৌদ্রর সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটোতে কৌতুহল খেলা করছে। বিষন্ন গলায় বলল-

“দোস্ত তুই কি তোর না-হওয়া প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেলি! তোর না-হওয়া প্রেমিকার জন্য দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিস না তো!! এরকম উদ্ভট আচরণ করছিস কেন ভাই?”

নির্বানের কথা শেষ হতে আচমকাই রৌদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে রৌদ্রর চোখ ভিজে আসছে। নির্বান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। নির্বানের চোয়ালে ঝুলে পরেছে। রৌদ্রর অবস্থা দেখে তার চেহারার রঙ উড়ে গেছে। ফ্যাকাসে বিবর্ণমুখে রৌদ্রর দিকে চেয়ে মৃদু গলায় বলল-

“ভাই এবার কিন্তু আমার ভয় করছে। তোর এমন অদ্ভুত ব্যবহার দেখে ভয়ে আমার প্রাণপাখি উড়ে চলে যেতে চাচ্ছে। তোর পায়ে পরি ভাই তুই একটু স্বাভাবিক আচরণ কর।”

নির্বানের কথায় রৌদ্র হাসির পরিমাণ আরও দ্বিগুণ হলো। এই মুহূর্তে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে নির্বানের কথা গুলো। রৌদ্র স্বাভাবিক হওয়ার পরিবর্তে তার উল্টোটা-ই হচ্ছে। রৌদ্র অস্বাভাবিক ভাবে হেসেই যাচ্ছে। আর নির্বান তার থমথমে চেহারা নিয়ে রৌদ্রর হাসি দেখছে। খানিকক্ষণ সময় পর রৌদ্র নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-

“তোর কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। আর কি যেন বললি আমার না-হওয়া প্রেমিকার জন্য দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি!! কিন্তু আরু তো আমার চিঠির প্রেমিকা। আমার অদেখা রুদ্রাণী। এই রৌদ্রর দ্বীপের রুদ্রাণী।”

নির্বান রৌদ্রর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে চটপটিয়ে বলল-

“তাই তো!! আমি তো একদমই ভুলে গিয়েছিলাম এই ব্যপারটা। আচ্ছা আরু আর ধ্রুবর মধ্যে যদি সম্পর্ক থেকেই থাকে তাহলে আরু তোকে কেন চিঠি দেয়? আর সেদিন রেস্টুরেন্টে তো আরুর সাথে ধ্রুবও তোর জন্য মানে চিঠির রৌদ্রর জন্য অপেক্ষা করছিলো।”

রৌদ্র নির্বানের শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল-

“আমাকে চিঠি দেওয়ার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ হতে পারে কৌতূহল। হয়তো কৌতুহলবশত আমার সাথে চিঠির মাধ্যমে কথা বলে। আর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে অনুভূতি। আরুর মনে আমার প্রতি কোনো অনুভূতি আছে বলেই হয়তো আমাকে চিঠি লিখে।”

“তোর কি মনে হয়! আরুর মনে তোর জন্য কোনো অনুভূতি আছে?”

রৌদ্র পকেটে হাত গুজে ধীর পায়ে হাঁটাতে হাঁটতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-

“এই মুহুর্তে আমি কনফিউজড আমাদের চিঠি আদান-প্রদানের মাঝে আরুর কোনো অনুভূতি আছে কি-না। তবে আমি এতটুকু বুঝতে পারছি আরু আর ধ্রুবর সম্পর্ক খুব মজবুত। দুজনের চোখেই একে অপরের জন্য ভালোবাসা ঝকঝকে পরিষ্কার সাদা কাগজের মতো স্পষ্ট। হয়তো আমি আরুর মনে জায়গায় পাবো নয়তো তাদের এই মজবুত ভালোবাসার পাচিলের নিচে পিষে যাবো। ভেঙে চুরমার হবো নিজের স্বেচ্ছায়।”

নির্বান কিছু বলল না। চুপচাপ রৌদ্রর সাথে হেঁটে যাচ্ছে। আজ হয়তো রৌদ্র পুরোটা পথ হেঁটেই পাড় করবে।

——————————

শাকিল আরশির হাত ধরে নেড়েচেড়ে দেখছে। আরশি তার হতভম্ব মুখ নিয়ে বসে আছে। শাকিল আরশির গাল ধরে এপাশ ওপাশ দেখে আরশির পুরো শরীরে নজর বুলিয়ে নিলো। অস্থির কন্ঠে বলল-

“তোর এমন বিধস্ত অবস্থা কি করে হলো আরু!!”

শাকিল ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আবারও উত্তেজিত হয়ে বলল-

“তোর গায়েও তো রক্ত ধ্রুব। তোরা দয়া করে বলবি আমাকে কি হয়েছে! চুপ করে আছিস কেন ভাই? তোদের কি কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে না-কি অন্য কিছু!!”

ধ্রুব চোখমুখ কুচকে বিরক্তি মাখা কন্ঠে ধমকের গলায় বলল-

“চুপ থাক ভাই। দয়া করে একটু চুপ থেকে আমাদের উদ্ধার কর। মানুষ রূপি ছাগল কোথাকার। আমাদেরকে কথা বলার সুযোগ না দিলে বলবো কি করে! তুই একাই বক বক করে যাচ্ছিস। যত্তসব মেন্টাল পাব্লিক।”

শাকিল চুপসে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে রইলো। ধ্রুবর কন্ঠ শুনে আরশির মা ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলেন। আরশির হাতে ব্যান্ডেজ দেখে তিনিও উত্তেজিত হয়ে পরলেন। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। ধ্রুব এবার নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। আরশি মুখ বিকৃতি করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে আছে। শাকিলের মুখেও এবার বিরক্তি ভাব এসে পরেছে। খানিকটা সময় পর ধ্রুব ক্লান্ত গলায় বলল-

“তোমাদের জন্য আমাদের দুজনকে এবার বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। আদ্রলিকা উঠে আয় তো আমার কাছে।”

ধ্রুব হাতের ইশারায় আরশিকে তার কাছে আসতে বলল। আরশিও বাধ্য মেয়ের মতো শাকিল আর তার মা’য়ের মাঝ থেকে উঠে ধ্রুবর কাছে আসলো। ধ্রুব মিহি কন্ঠে বললো-

“আমি সারাদিন জার্নি করে খুব ক্লান্ত ছোট মা। আর আদ্রলিকারও শরীর ভালো না। তোমাদের কি উচিত হচ্ছে আমাদের সেবা না করে এভাবে একের পর এক প্রশ্ন করে বিব্রত করা!! বাসায় আসার সময় আদ্রলিকা হোঁচট খেয়ে পরে গিয়েছিল। ঝোপঝাড়ের উপরে হাত পরায় হাত কেঁটে গেছে। আর কিছু হয়নি। আর কোনো প্রশ্ন করো না প্লিজ ছোট মা। এখন আদ্রলিকাকে একটু ফ্রেশ করিয়ে রেস্ট নিতে দাও। আমি শাকিলের রুমে গেলাম। গোসল করবো। শেষ বারের মতো বলছি আর কোনো প্রশ্ন না করে আদ্রলিকাকে রেস্ট নিতে দাও।”

ধ্রুব ক্লান্ত মাখা গলায় একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই শাকিলের রুমে চলে গেল। আরশি, শাকিল আর তার মা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর কোনো প্রশ্ন না করে আরশিকে রুমে নিয়ে গেল।

——————————

রাত সাড়ে দশটা। হঠাৎই খোলা দরজায় টোকা পরলো। আরশি আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে৷ বিস্ময় নিয়ে দরজার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই ধ্রুবর কন্ঠ ভেসে আসলো-

“আরু আমি কি রুমে আসবো!”

আরশি খানিকটা চমকালো। ধ্রুবর কন্ঠস্বর গম্ভীর। সিরিয়াস মুডে আছে তাই তাকে আরু বলে ডাকছে। আরশি নিজের বিস্ময় ভাব নিজের মাঝেই কাটিয়ে উঠে বলল-

“আমার রুমে আসতেও তোর পারমিশন নিতে হয়! আগে জানতাম না।”

ধ্রুব গম্ভীর পায়ে আরশির কাছে আসতে আসতে বলল-

“আগে নেই নি কিন্তু এখন নিচ্ছি কারণ তুই তো এখন খুব বড় হয়ে গেছিস। নিজের মন মতো চলছিস। যা ইচ্ছে হয় করছিস। নিজের ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছিস। কিন্তু তুই এতো বুদ্ধিমান হওয়ার পরেও এই হাল হলো কেন তোর?”

ধ্রুব আরশির পায়ের কাছে বসলো। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশি মাথা নিচু করে রেখেছে। মিনমিনিয়ে মলিন কন্ঠে বললো-

“এভাবে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলছিস কেন!”

“কেন আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না! কত করে বুঝিয়েছি নিজের খেয়াল রাখতে। যেহেতু আমি তোর সাথে নেই তোর কি উচিত ছিলো না কোনো কিছু করার আগে ভেবেচিন্তে করার?? আমি তোকে বলেছিলাম ওই ছেলেটার থেকে দূরে থাকতে। তার সংস্পর্শে থাকা ঠিক না। ছেলেটা এর আগেও মারামারি করেছে। তোকে বলিনি আমি একথা!!”

ধ্রুবর কঠিন বাক্যে আরশি মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। ধ্রুবর গায়ে জড়ানো ধুসর রঙের টিশার্ট আর কালো প্যান্ট। সিল্কি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গাল ভর্তি ঘন দাঁড়ি। হয়তো এই ক’দিনের ব্যস্ততায় এই হাল হয়েছে। ব্রাউন কালারের শান্ত শীতল চোখ দুটো এই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার দিকে। বাঁকা গেজ দাঁত বের করে সব সময়ের মতো মুখে হাসিও নেই।

“তুই ভুল বুঝছিস ধ্রুব। এখানে ওনার কোনো দোষ নেই। ছেলে গুলোর ঝামেলা তো আমার সাথেই। ভার্সিটির প্রথমদিন যে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করেছিলাম তার জন্যই এমন হয়েছে। আমার জন্যই ওনার সাথে ছেলেগুলোর মারামারি হয়েছে। এতে ওনার কোনো দোষ নেই।”

ধ্রুব ভ্রু জোড়া কুচকে ফেললো। নির্বিকার ভঙ্গিতে আরশির দিকে চেয়ে আছে।

চলবে…