শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৩

0
477

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৩
#সামিয়া_মেহেরিন

দরজা খুলে ছাদের সেই লোকটাকে দেখে অবাকের শেষ সীমানায় বন্যা। ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে বন্যা। মনে মনে ভাবছে লোকটা কি কোনোভাবে কাল রাতের ঘটনা খালামণিকে জানাতে এসেছে। খালু-খালামণি তাকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসে। তারা যদি জানতে পারে এমন কাজ করতে গিয়েছিলাম তাহলে খুব কষ্ট পাবে।

বন্যাকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা দুষ্টু হেসে বন্যার কানের কাছে নিজের মুখ এনে ফিসফিস করে বলে
-আমি বুঝি দেখতে এতটাই সুদর্শন যে আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে চাচ্ছেন, মিস? খেতে চাইলে খেতে পারেন আমার আপত্তি নেই।

লোকটা নিজের মুখ সরিয়ে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। এদিকে তার কথায় বন্যা লজ্জায় লাল-নীল হতে শুরু করছে। কি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে ভাবতে ভাবতে কানে আসে মহিমা বেগমের গলার স্বর।
-কে এসেছে রে, বন্যা?

মহিমা বেগম আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বন্যার দিকে এগিয়ে এলেন। লোকটাকে দেখে মহিমা বেগম এক গাল হেসে বললেন
-আরে, আদিত্য তুমি!

আদিত্য নামের লোকটা হালকা হেসে জবাব দেয়।
-জি আন্টি। বাজারের ব্যাগটা দিতে এলাম।

-বাজারের ব্যাগ!
মহিমা বেগম প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকালেন। মাজহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে আসতে বললেন
-আর বলো না! বয়স হয়েছে এখন আর বোঝা টানতে পারি না। বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আস্তে-ধীরে উপরে উঠছিলাম এমন সময় আদিত্যর সাথে দেখা। ওই নিয়ে এলো ব্যাগটা।

আদিত্য হালকা হেসে মহিমা বেগমে দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-আন্টি, ব্যাগটা কোথায়..

আদিত্যর বলা শেষ হওয়ার আগেই মহিমা বেগম আফসোসের সুরে বলে ওঠেন
-দেখেছো কাণ্ড! ছেলেটা কতক্ষণ ধরে ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এদিকে আমরা গল্প জুরে দিয়েছি।

বন্যা এগিয়ে গিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে মিনমিনে গলায় বলে
-দিন, আমাকে দিন আমি নিয়ে যাচ্ছি।

-আপনি পারবেন?
বন্যা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকায়। আদিত্য তার দৃষ্টি দেখে বলে
-না মানে, আপনার যে টিকটিকির মতো শরীর তাতে ভারি ব্যাগ তুলতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

বন্যার রাগ লাগছে খুব। শেষ পর্যন্ত কিনা তাকে টিকটিকি উপাধি দেয়া হলো! বন্যা জোর দিয়ে বলল সে পারবে। তাই আদিত্যও আর দ্বিরুক্তি করলো না। ব্যাগটা বন্যার হাতে ধরিয়ে দিল।
বন্যা কোনোরকমে ব্যাগটা তুলে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে হাঁপাতে লাগল। লোকটা ঠিকই বলেছিল এত ভারি ব্যাগ তোলা তার সাধ্যি না।

মহিমা বেগমও রান্নাঘরে গেলেন। ব্যাগ থেকে সব বাজার বের করতে করতে বলতে লাগলেন
-জানিস তো আদিত্য ছেলেটা না আমার আর তোর খালুর খুব পছন্দের। যেমন সুন্দর ওর ব্যবহার, চালচলন তেমনি পড়ালেখায় ভালো। আমাদের চারতলায় ব্যাচেলর থাকে। গত দুই বছর ধরে দেখছি পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ নিজেই চালায়। আজকালকার ছেলেমেয়েদের দেখেছিস কতোটা চালচুলোহীন। আর সেখানে ওকে দেখ ওর নামে একটা বাজে কথা বলার সাধ্যি কারো আছে বলে মনে হয় না।
বন্যা চুপ করে তার খালামণির কথাগুলো শুনে।

সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে বসে মুখে খাবার পুড়ছেন বারেক সাহেব ও তার স্ত্রী জামিনী বেগম সাথে টুকটাক এটা ওটা নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে জামিনী বেগমের বন্যার বিষয়টা মাথায় আসে।
-বন্যাকে যে মহিমা নিয়ে গেল এবার তার কি করবে বললে না তো।

বারেক সাহেব বিরক্তি নিয়ে জামিনী বেগমের দিকে তাকান।
-ওই মেয়ের নাম আমার সামনে নেবে না বলে দিলাম। আফাজ সাহেব কত টাকাগুলো টাকা দিতে চেয়েছিলেন তার হিসেব আছে? কিন্তু ওই মেয়েকে দেখো বিয়ের দিন ড্যাংড্যাং করতে করতে চলে যাবে। পরের বাড়ি কতদিন থাকতে পারে আমিও দেখবো। মহিমা আর মাযহার কতদিন ওকে টেনে বেড়াতে পারে দেখে নেব।

জামিনী বেগম কথার মাঝে বলে ওঠেন
-তা নাহয় হবে কিন্তু কতগুলো টাকা হাতছাড়া হয়ে গেল। তার কি হবে?
বারেক সাহেব একটু চিন্তা করে আবার বললেন
-দেখি আফাজ সাহেবের সাথে আবার একটু কথা বলে সব মিটমাট করা যায় কিনা।

জায়ান এতক্ষণ ডাইনিং টেবিলে বসে চুপচাপ তার খাবার খাচ্ছিলো আর মা-বাবার কথাগুলো শুনছিল। এবার আর সে চুপ করে থাকতে পারলো না। গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করলো।
-বাবা, তুমিতো শুধু ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে চেয়েছিলে। হয়েছেও তাই। বন্যা চলে গেছে। এখন ও যেখানে আছে যেভাবে আছে থাকুক না।

জামিনী বেগম তেঁতে ওঠেন।
-থাকলেই হলো! কতোগুলো টাকা আমার হাতছাড়া হয়ে গেল। টাকা হলো ঘরের লক্ষ্মী। আর তোর এতো বন্যার জন্য দরদ উতলে উঠছে কেন রে?

জায়ান বিরক্তি নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে খাবার রেখে উঠে যায়। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করে উপরওয়ালা যেন তার মা-বাবার এই লোভী স্বভাবটা চিরতরে মুছে দেয়। বাবা-মার লোভের শিকার যেন ওই সরল মেয়েটা না হয়।

শুক্রবার দুপুর। কেমন যেন ভ্যাপসা গরম পড়েছে। বন্যা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। উদ্দেশ্য তাদের বাসা। তার পেছন পেছন মাযহার সাহেব আসছেন।
আজ বন্যা তার খালুর সাথে গিয়েছিল ভার্সিটি ভর্তির সব কার্যক্রম শেষ করতে। ভাগ্যিস ভর্তির তারিখ শুক্রবারেই পরেছিল। ঢাকার রাস্তাঘাট এখনো সে চিনে উঠতে পারেনি। শুক্রবার বলে মাযহার সাহেবের ছুটি ছিল বিধায় তিনিই বন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাটাও চিনিয়ে দিয়ে এসেছেন।

বন্যা ঘরে এসে আগে বাথরুমে ঢুকলো গোসল করতে। এটা তার অভ্যাস। বাইরে থেকে এলে আগে তার গোসল করতেই হবে।
গোসল শেষে তোয়ালে দিয়ে চুল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে বন্যা। হাতে এক বালতি সদ্য ধোয়া জামাকাপড়। গতকাল আলসেমি করে জামাকাপড় না ধুয়েই বেরিয়ে এসেছিল। তাই আজ দুই দিনের জামাকাপড় একদিনে ধুতে হলো। বালতি হাতে পা বাড়ালো ছাদের উদ্দেশ্যে। তাদের বাসার বারান্দার অবস্থান এমন যে সূর্যের আলো আসেই না। ভেজা কাপড়চোপড় শুকানোতো দূরের কথা। দুই-তিনদিন গেলে তবে সে কাপড় শুকায়। কিন্তু এভাবে কাপড় শুকানোয় কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ আসে জামাকাপড় থেকে।

চৌকাঠ পেরিয়ে ছাদে পা দিতে তার কানে আসে টুংটাং শব্দ। হঠাৎ আসা শব্দে সে চমকে যায়। হাতে থাকা বালতিটা হাত ফসকে পড়ে যায়।
বালতি পড়ার আওয়াজ কানে যেতে আদিত্য তার গিটারে শব্দ তোলা বন্ধ করে বন্যার দিকে তাকায়।
বন্যা এই মুহূর্তে আদিত্যকে এখানে আশা করেনি। এতদিনে সে অনেকটাই আন্দাজ করে ফেলেছে লোকটা কখন ছাদে আসে। আর সেই সময়গুলোতে সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে ছাদে না আসার। তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল আজ শুক্রবার। আদিত্যর ছুটির দিন। দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ছাদে এক কোণায় সামান্য ছায়ায় বসে গিটার বাজাবে নয়তো ছাদে তার লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করবে।

বন্যার ইচ্ছে করছে এক ছুটে ছাদ থেকে চলে যেতে। কিন্তু তার বেচারা জামাকাপড় গুলোর কি হবে!
পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে নিচের দিকে তাকায় বন্যা। উপরওয়ালাকে হাজার হাজার শুকরিয়া জানায়। বালতিটা উল্টে পড়েনি, সোজা হয়েই আসে। যদি উল্টে টরতো তাহলে আবার তাকে সবগুলো ধুতে হবে।
আদিত্যর দিকে একপলক তাকিয়ে শুকনো ঢোক গেলে বন্যা। কাঁপা কাঁপা হাতে বালতিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যায়। একটা একটা করে কাপড় নিয়ে ছাদে টাঙানো রশিতে মেলে দেয়। আড়চোখে আদিত্যর দিকে তাকায়। লোকটা এখনো সেই আগের মতোই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বন্যার ইচ্ছে করছে হয় লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে নয়তো আল্লাহ যেনো তাকে উসাইন বোল্টের মতো দৌঁড়ানোর গতি দান করে।
আদিত্য ঠিকই বন্যার মনোষ্কামনা টের পায়। বন্যা দিকে তাকিয়ে তার সেই বিখ্যাত ঠোঁট কামড়ে হাসা হাসি হাসছে সে।
——–
ভার্সিটির প্রথম দিনটা বন্যার বেশ ভালো কাটলো। তার সবচেয়ে ভালো লাগছে এটা ভেবে যে তার একমাত্র বান্ধবী আরোহীও তার সাথে একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।
আজ মাযহার সাহেব নিজে বন্যাকে ভার্সিটি নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার নিয়েও এসেছিন।
বন্যা ঘরে এসে বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে। ভার্সিটি যাওয়ার আগে গোসল করে গিয়েছিল তাই দ্বিতীয়বার আজ আর গোসল করলো না। আজ সকাল থেকে তার গলায় কেমন খুশখুশ করছে তাই দ্বিতীয়বার গোসলের সাহসটা দেখাতে চাইল না।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সময় তার চোখ যায় জানালার বাইরে। বাইরে কাঠফাটা রোদ উঠেছে। হুট করে বন্যার মাথায় এলো সকালে সে ছাদে ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে এসেছিল। ইশ্, কাপড়ের রং বোধহয় এতক্ষণে জ্বলে গেছে।
বন্যা আর অপেক্ষা না করে ছুটলো ছাদের দিকে। ছাদে গিয়ে এক এক করে সব কাপড় রশি থেকে নামিয়ে নিজের কাধে রাখতে শুরু করে। এমন সময় কোথা থেকে আগমন ঘটলো আদিত্য নামক মানুষটার।

আদিত্য বন্যাকে একপলক আপাদমস্তক দেখে দিল এক ধমক।
-আপনি কি পাগল হয়েছেন, বৃষ্টিকন্যা? এই তপ্ত দুপুরে আপনি ছাদে এসেছেন খালি পায়ে?

হঠাৎ হওয়া কথার আক্রমণে বন্যা চমকে আদিত্যর দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই বন্যা চোখ সরিয়ে সর্বশেষে থাকা তার ওড়নাটা নামানোর উদ্দেশ্যে এক পা এগিয়ে আসতেই ‘আহ’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে।

বন্যা যেখানে পা রেখেছিল সেখানেই পড়ে ছিল একটা অর্ধমৃত মৌমাছি। বিধায় মৌমাছির হুল ফুটলো বন্যার পায়ে।
আদিত্য আরো একপ্রস্থ ধমক দিয়ে এগিয়ে এসে বন্যার পায়ে হাত দিতে নিলে বন্যা সঙ্গে সঙ্গে কাচুমাচু হয়ে সরে আসে। আদিত্য চোখ গরম করে বন্যার দিকে তাকায়। বন্যা তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে যত দ্রুত পারা যায় প্রস্থান করলো।

এদিকে আদিত্য বন্যাকে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমাটা ডান হাতে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে আপন মনে বিরবিরায়।
-পালিয়ে যাচ্ছেন তো, যান। প্রণয়ের অনলে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করতে চাচ্ছেনতো, বেশ করুন। আমিতো আমার বৃষ্টিকন্যার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে পারি না। তবে যেদিন আমি পালিয়ে যাব সেদিন আপনিও বিরহের আগুনে পুড়বেন, বৃষ্টিকন্যা।

চলবে!