শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৪

0
417

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৪
#সামিয়া_মেহেরিন

গ্রীষ্মঋতু তার তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। বর্ষার আগমনে গ্রীষ্মের বিবর্ণ প্রকৃতি হয়ে উঠছে সজল ও কোমল। প্রকৃতি এখন মত্ত হয়েছে সময়ে অসময়ে পৃথিবীর বুকে জল বর্ষণে। তেমনি এক বর্ষণমুখর দিন। নীল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হাতে নীল রঙা কাঁচের চুরি হাতে বৃষ্টিবিলাসে মত্ত শ্যামাকন্যা। দুই হাত উঁচু করে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। অনতিদূরে বৃষ্টিকন্যার অগোচরে তার প্রেমিক পুরুষ দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শ্যামাঙ্গী তরুণীকে ছুঁয়ে দিচ্ছে নিবিড়ভাবে। যা প্রেমিকের মনে জন্ম দেয় নিষিদ্ধ কিছু বাসনার। সে ঈর্ষান্বিত হয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর প্রতি।
এদিকে বৃষ্টিকন্যা সে তো বৃষ্টিবিলাসে প্রমত্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমিক যে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তা কি সে বুঝে না!

মাযহার সাহেব ও মহিমা বেগম আজ তাদের গ্রামে গিয়েছেন। মাযহার সাহেবের বড় ভাইয়ের অসুস্থতার কথা জানার পরপরই তারা রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। বন্যা তাদের ঢাকার বাসাতেই রয়ে গেল। তার ভার্সিটি আছে।
ভার্সিটি থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। দুপুরের ও রাতের খাবার একবারে বানিয়ে রাখলো। একার জন্য আর কতটুকুই রান্না করা লাগে।

রান্না শেষ করে ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। কিছুক্ষণ দুচোখ বন্ধ করে সেভাবেই পড়ে রইল।
হঠাৎ জানালা গলে আসা দমকা বাতাসে তার শরীরে কাঁপন ধরে ওঠে। চোখ মেলে জানালার দিকে তাকায়। আকাশে কাজল-কালো মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় হয়তো বর্ষণ শুরু হবে।

বন্যা তপ্তশ্বাস ফেলে হাঁটা ধরলো ছাদের উদ্দেশ্যে। ছাদে গিয়ে প্রথমেই চোখাচোখি হলো আদিত্যর সাথে। বন্যা আগে থেকেই জানতো এমন কিছুই হবে। এখন সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগের মতো আদিত্য মানুষটাকে দেখামাত্রই পালাই পালাই করে না সে। কারণ সে বুঝে গিয়েছে যতই সে পালাই পালাই করুক মানুষটা তার পিছু ছাড়ছে না।

পালাই পালাই স্বভাবটা গেলেও আদিত্যকে এড়িয়ে যাওয়া স্বভাবটা এখনো যায় নি বন্যার। আসলে আমরা এমনই যতক্ষণ একজন মানুষ আমাদের আগে পিছে ঘুরতে থাকে আমরা তাকে মূল্য দেই না। কিন্তু মানুষটা যখন হারিয়ে যায় তখন আমার ঠিকই বুঝি সেই মানুষটার গুরুত্ব আমাদের জীবনে কতটা। বন্যাও কি তবে আদিত্যর হারিয়ে যাওয়ার পরই বুঝবে আদিত্য মানুষটা তার অজান্তেই তার জীবনে কতটা জায়গা দখল করে নিয়েছে!

সবসময়ের মতো আজও বন্যা কাপড় উঠাতে ব্যস্ত আর আদিত্য হাতে গিটার নিয়ে একদৃষ্টিতে তার বৃষ্টিকন্যাকে দেখতে মত্ত।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। আদিত্য এখনো তার জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। বন্যার কাপড় তোলা শেষ। নিচে নেমে আসতে গিয়েও থেমে গেল। একপলক আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো। আজ বেশ বৃষ্টি নামবে। কিন্তু মানুষটা এখনো এভাবে বসে আছে কেন? বাসায় যাবে না? মানলাম তার বৃষ্টি পছন্দ কিন্তু তাই বলে এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজবে?

বন্যা কিছুক্ষণ আপন মনে আমতা আমতা করতে থাকে। কি করবে সে? আদিত্যকে জিজ্ঞাসা করবে? তার কি করা উচিত?
নিজের মনের সাথে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে বন্যা নিজের মনকে ধাতস্থ করে নেয়। কয়েকমুহূর্তের জন্য নিজের সকল সংকোচ মাটিচাপা দিয়ে প্রশ্ন করেই বসে।
-আপনি বাসায় যাবেন না? বৃষ্টি নামবে তো!

আদিত্য বন্যার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে যায়। চোখে চোখ পড়তেই বন্যা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। আদিত্যর এই চোখের গভীরতায় একবার ডুব দিলে আর বের হতে পারবে বলে তার মনে হয় না।

বন্যা আদিত্যর প্রতিউত্তরের আশায় চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মানুষটার কোনো প্রতিউত্তর নেই। বন্যা চোখ উঠিয়ে আদিত্যর দিকে তাকায়। আবারো তাদের চোখাচোখি হয়। মুহূর্তেই বন্যা তার দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। ছাদের মেঝের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে রিনরিনে গলায় আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলে
-বৃষ্টি নামবে, বাসায় যান। এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজবেন না। জ্বর বাঁধবে।

বন্যা চলে গেল। আদিত্য তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। মেয়েটার তার দিকে খেয়াল আছে তাহলে।
বন্যা ঘরে এসে কাপড়গুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখে। হুট করে তার চোখ যায় ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। মিউয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। হরিণীর ন্যায় টানাটানা চোখ তার। চোখের পাতাগুলো অতিদীর্ঘ। গোলগাল চেহারা, খাড়া নাক। মুখের গড়ন মন্দ না। তবে রংটা একটু চাপা। বন্যা আপন মনে বিরবির করে। সে আদিত্যর চোখে যেমন মায়াবী আসলেই কি সে মায়াবী। নাকি শাবাবের মায়ের ভাষ্যমতে কুৎসিত। নাহ সে কুৎসিত না। আল্লাহ তায়ালার কোনো সৃষ্টিই কুৎসিত না। তাহলে মানুষ কেন মানুষের মধ্যে সুন্দর-কুৎসিত ভেদাভেদ সৃষ্টি করে?

গিটারের টুংটাং আওয়াজ কানে আসাতে বন্যার ধ্যান ভাঙে। ডানদিকে ফিরে দুপা এগিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। মানুষটা তার মানে বন্যার কথা শোনেনি। এই অসময়ে ছাদের ক্ষুদ্র ছাউনির নিচে বসে গিটার বাজাতে ব্যস্ত সে। এরপর যে জ্বর উঠবে তখন কি হবে? তীব্র অভিমানে বন্যা নিজেকে ধাতস্ত করে সে আর মানুষটার সাথে কথা বলবে না। কখনো না।

চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে জুঁই ফোনে অনলাইন শপিং করতে ব্যস্ত। এটা তার নিত্যদিনকার কাজ। রোজ রোজ ওয়েবসাইট গুলোতে ঘুরে ড্রেস-গহনা করতে থাকবে। প্রয়োজন ছাড়া সব কিনে আলমারি ভর্তি করে ফেলেছে। শাবাব তার এই কাজে বিরক্ত।
জুঁই যখন শপিং করতে ব্যস্ত তখন তার শাশুড়ি মা ওকে ডেকে পাঠান। জুঁই তার শাশুড়ি মাকে তোয়াক্কা না করে নিজের কাজে মন দেয়। কয়েকবার ডেকেও যখন জুঁইয়ের সাড়া পেলেন না বাধ্য হয়ে নিজেই এলেন জুঁইয়ের কাছে। ক্লান্তি নিয়ে বললেন
-জুঁই, কাজের মেয়েটা তিনদিন ধরে আসছে না। বাড়ির সব কাজ করতে করতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আজকের রান্নাটা তুমি করে নিও।

জুঁই অকপটে জবাব দেয়
-আমি করব রান্না? ওসব আমি পারব না। রান্না করলে ঘেমে যাবো। মুখ কালো হয়ে যাবে প্লাস নখ ময়লা হবে। আপনি পারলে করে নিন। নয়তো বাহির থেকে অর্ডার করে নিন।

-জুঁই তোমার শশুর বাইরের খাবার খেতে পারেন না।

জুঁই বিরক্তি নিয়ে রাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-এতে আমার কী করার আছে?

রাজিয়া বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চললেন রান্নাঘরের দিকে। কাচকে হিরা ভেবে যে ভুল করেছিলেন তারই মাশুল তাকে এখন দিতে হচ্ছে।
———
বন্যা গত আধাঘণ্টা যাবৎ আদিত্যদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর পর এদিক ওদিক পায়চারি করছে আর মনে মনে হাজার কল্পনা জল্পনা করছে। একবার ভাবছে গেটে নক করবে আবার ভাবছে না করবে না।
মানুষটার গত দুইদিন ধরে কোনো দেখা পায়নি বন্যা। গত দুইদিন ছাদেও আসেনি। তার ভার্সিটির সামনে রোজকার মতো একবার ঘুরঘুরও করেনি। নির্ঘাত সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে। বন্যা মনে মনে ভাবে জ্বর বাঁধিয়েছে তাকে আমার কি! আমিতো তাকে বারণ করেছিলামই। তিনিই আমার কথা না শুনে নাচতে নাচতে গিয়েছেন বৃষ্টিতে ভিজতে।
বন্যা চলে যেতে নিয়েও গেল না। তার মন সায় দিচ্ছে না। বেহায়া মন বারবার জানতে চাইছে মানুষটা কেমন আছে।

বন্যা পরপর দুটো বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজের মনকে ধাতস্থ করে নেয়। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে সে খেয়াল করল তার হাত অনবরত কাঁপছে। ঘেমে-নেয়ে একদম একাকার হয়ে যাচ্ছে সে। অদ্ভুদ তো! এমন কেন হচ্ছে তার? তবে কি তার মনে একটু একটু করে সর্বনাশা অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে?

কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চেপে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বন্যা। মিনিট দুয়েক পর খট আওয়াজ করে দরজা খুলে যায়। তবে দরজা আদিত্য খোলেনি। খুলেছে অন্য কেউ। বন্যার লোকটাকে চেনা চেনা লাগে। এই বিল্ডিংয়েই দেখেছে। বোধহয় আদিত্যর রুমমেট।

লোকটা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকায়। বন্যা কি বলবে বুঝে উঠতে পারে। তার সব কথা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
শত চেষ্টাতেও একটা শব্দ মুখ থেকে বের করতে না পেরে আশাহত হয় বন্যা। স্বভাব বশত ছুটে পালিয়ে আসে। ওদিকে আদিত্যর রুমমেট লোকটা হা হয়ে তাকিয়ে বন্যার যাওয়া দেখে। কি অদ্ভুত মেয়েটা!

চলবে!