শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৫

0
391

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৫
#সামিয়া_মেহেরিন

সকালবেলা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বন্যা বেরিয়েছিল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ভার্সিটি শেষে সোজা চলে যায় তার নতুন স্টুডেন্টকে টিউশনি পড়াতে। বন্যার মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। যার ক্রেডিট দিতে হবে তার নতুন স্টুডেন্টকে।
বন্যার স্টুডেন্ট মেয়েটির নাম মৌমিতা। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়েটার নাম যেমন মিষ্টি, কথাও বলে তেমন মিষ্টি মিষ্টি। আজ যতক্ষণ বন্যা তাকে পড়িয়েছে পড়ার ফাঁকে মজার মজার কথা বলে বন্যাকে হাসিয়ে ছেড়েছে।
মেয়েটার বাবা নেই। দুইবছর আগে একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সে আর তার মা একা একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে বন্যা বাসায় ঢুকলো। মহিমা বেগম তখন টেবিলে খাবার সাজাতে ব্যস্ত। বন্যাকে দেখে তাড়া দিয়ে বললেন জলদি গোসল করে খেতে আসতে।

বন্যা চটজলদি গোসল করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। প্রথমেই তার চোখ যায় জানালার দিকে। সুদূর অন্তরীক্ষে চলছে কাজল-কালো মেঘের মেলা। বন্যা মনে মনে শান্তির শ্বাস ছাড়ে। ভাগ্যিস আজ জামাকাপড় ধোয়নি আজ। নইলে এই বৃষ্টিতে শুকাতে দিতো কোথায়!

বন্যা ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে মহিমা বেগম সদর দরজার দিকে যাচ্ছেন। তাকে যেতে দেখে বন্যা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-খালামণি, ওদিকে কই যাও।

বন্যাকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহিমা বেগম বললেন
-আর বলিস না, আজ বাসার সব চাদর, পর্দা একসাথে ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়ে এসেছি। আকাশে কি মেঘ জমেছে দেখেছিস! সময় থাকতে গিয়ে নিয়ে আসি।

বন্যা দ্রুত পারময়ে এগিয়ে গিয়ে বলে
-তুমি থাকো খালামণি। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।

বন্যা মহিমা বেগমকে আর কিছু বলতে না দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। এদিকে মহিমা বেগম পিছু ডাকতে থাকেন।
-বন্যা, অনেকগুলো কাপড় ছাদে। তুই একা আনতে পারবি না মা।

কে শোনে কার কথা। ছাদের চৌকাঠ পেরোতেই চোখাচোখি হয় গিটার হাতে নিয়ে বসে থাকা আদিত্যর সাথে। লোকটা তিনদিনেই কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখের রং পালটে গেছে। আদিত্যর চোখে চোখ পড়তেই বন্যা সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। তীব্র অভিমানে আদিত্যর উপস্থিতি তোয়াক্কা না করে নিজ কাজে মন দেয়।
বন্যার অভিমানের বহিঃপ্রকাশ দেখে আদিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে। গিটার রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বন্যার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তবুও বন্যা তাকে পাত্তা দেয় না। তার দেখে আদিত্যর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে।

-কি হলো! কথা বলবে না আমার সাথে?
আদিত্য প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকায়। বন্যার কোনো হেলদোল না দেখে আদিত্য আবার শুধায়।
-বৃষ্টিকন্যা?

এবার বন্যা চোখ-মুখ কুচকে আদিত্যর দিকে একপলক তাকিয়ে আবার রশি থেকে থেকে কাপড় নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার কাজে আদিত্য হাসে। অভিমানের পাল্লাটা তাহলে একটু ভারী।

বন্যার বাম হাত ধরে হেচকা টানে বন্যাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। বন্যা রাগ নিয়ে মানুষটার দিকে তাকায়। বন্যার রাগ দেখে লোকটা হাসে। বন্যার চোখে পড়ে লোকটার ডান গালে পড়া টোলে। হলদে ফর্সা চেহারা তার। ঠোঁটগুলো কালচে। হয়তো সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। ডান গালের মাঝখানটায় কুচকুচে কালো তিল। হাসলে তিলের জায়গাটায়ই টোল পড়ে। তার চেহারার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হলো তার বাম চোখের ভ্রু।
বাম চোখের ভ্রুর ঠিক মাঝখানটায় একটা কাটা দাগ। যার কারণে ভ্রু দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছে।

-বৃষ্টিকন্যার অভিমান ভাঙাতে এই হীন প্রেমিক পুরুষকে কি করতে হবে শুনি।
আদিত্যর কথায় বন্যার ধ্যান ভাঙে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে
-অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করেছিলাম।

আদিত্য একগাল হাসে।
-বৃষ্টিতে না ভিজলে আর টানা দুইদিন জ্বরে না ভুগলে যে বুঝতেই পারতাম না বৃষ্টিকন্যার মনে আমি জায়গা পেয়েছি।

বন্যা কি বলবে বুঝতে পারে না। চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আদিত্য বন্যার কানের কাছে নিজের মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে।
-প্রেয়সীর অভিনিবেশ পেতে শুধু জ্বর কেন, দুরারোগ্য রোগ নিজের শরীরে পুষতেও দ্বিধা করব না বৃষ্টিকন্যা।

বন্যার শরীর কেঁপে ওঠে। এক ঝটকায় আদিত্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছাদ থেকে নামতে নেয়। আর ভাবে কি ভয়ানক লোকটার কথাবার্তা।
ছাদের চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই মাযহার সাহেবকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে বন্যা। এখানে কখন এসেছে সে? একটু আগের ঘটনা সে দেখে ফেলেনি তো?
বন্যা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে।
-খালু, আপনি ছাদে….

বন্যার বলা শেষ হওয়ার আগেই মাযহার সাহেব থমথমে গলায় বলেন
-তোমার খালামণি বলেছিল তুমি একা সব কাপড় আনতে পারবে না। তাই এসেছিলাম সাহায্য করতে।

রাতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুল বাঁধছিল বন্যা। আজ দুপুরের ঘটনাটা বারবার উঁকি দিচ্ছে তার মনে। একদিকে টানা তিনদিন পর আদিত্যর সাক্ষাৎ পেয়ে অশান্ত মন শান্ত হয়েছে। অপরদিকে বারবার মন কু’ গাইছে।
ঘরের দরজা হালকা ভিরানো ছিল। মহিমা বেগম মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। তার আগমনে বন্যার সম্ভিত ফেরে।

-বন্যা, তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। এদিকে আয়।
বলে মহিমা বেগম বিছানায় বসলেন। বন্যা হাতের চিরুনি রেখে এগিয়ে এসে মহিমা বেগমের সামনে বসে। মহিমা বেগম গম্ভীরতা বজায় রেখে বন্যাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-বন্যা তুই খুব ভালো করেই জানিস উপর তলায় ব্যাচেলররা ভাড়া থাকে। তবুও তুই কেন বারবার উপর তলা আর ছাদে ঘুরঘুর করিস।

মহিমা বেগমের প্রশ্নে বন্যা থমকে যায়। কাচুমাচু হয়ে বসে আমতা আমতা করতে শুরু করে। মহিমা বেগম বন্যার অস্থিরতা টের পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মুখে গম্ভীরতার ভাব সরিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলেন
-বন্যা, আমার কোনো সন্তান নেই। আর তোর মা তো নেই-ই আর যে বাবা আছে সে থাকা আর না থাকা সমানই। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি আর তোর খালু তোর বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি। এখন যদি কোনো অঘটন ঘটে তার দায়ভার কে নেবে বল। আশা করি আমার কথাগুলো তুই বুঝছিস।

বন্যা তার মিউয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে তার খালামণির দিকে তাকায়। মহিমা বেগম তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলেন
-আমরা তোর খারাপ চাই না বন্যা। তোর জন্য যেটা ভালো আমরা অবশ্যই সেটা করব। তোর বয়স কম। আবেগে গা ভাসিয়ে চলিস। এটা তোর দোষ না, বয়সের দোষ। শাবাব তোর সাথে কি করলো তা তো দেখলিই। আমি চাই না তুই দ্বিতীয়বার আবার একই ভুল কর। আর শেষ একটাই কথা বলব, এমন কোনো কাজ করিস না যাতে তোর মাথার ওপর থেকে খালামণি-খালুর ছায়াটা হারিয়ে যায়।
————

বর্ষণমুখর দিন। প্রকৃতি আপন নিয়মে তার তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে। সারাদিন বিরতিহীনভাবে পৃথিবীর বুকে ঝড়েছে আকাশকন্যার অশ্রুজল।
অপরাহ্নের শেষভাগ। আকাশ তার অশ্রুজলের বর্ষণ অবশেষে থামালো। অখণ্ড আকাশে কাজল-কালো মেঘের ছড়াছড়ি। তারই তলে প্রেমিক পুরুষ তার বৃষ্টিকন্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
আদিত্য তার গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার বৃষ্টিকন্যার দিকে। অপরদিকে বৃষ্টিকন্যার চোখে-মুখে অনুনয়ের আভাস।

বন্যা ভাঙা ভাঙা গলায় জোরপূর্বক কথাগুলো আওড়ায়।
-আমার অতীত মোটেও সুখকর ছিল না আদিত্য। আপনার কাছে আমার অনুরোধ নতুন করে আমার জীবনে অনাকাঙিক্ষত কোনো ঝড় তুলবেন না প্লিজ। আমার শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নেবেন না আদিত্য।

বন্যার গলা দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হয় না। আদিত্যকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত হেঁটে প্রস্থান করে। ওদিকে আদিত্য নির্বিকার।
বন্যার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে বলতে থাকে
-আপনার অতীতে-ভবিষ্যতে, ডানে-বায়ে, উপরে-নিচে কি আছে তা জানার প্রয়োজন নেই আমার বন্যা। আজ যে পরিবারের দোহাই দিয়ে আপনি চলে গেলেন সেই পরিবারের সামনে দিয়েই একদিন আমি আপনাকে নিয়ে আসব। আপনি শুধু আমার হবেন বৃষ্টিকন্যা। আমি কাপুরুষ নই বৃষ্টিকন্যা। ভালো যখন বেসেছি, শেষটায় ঠিকই আপনাকে নিজের করে নেব। আজকের এই বর্ষণমুখর দিনে তাণ্ডবলীলায় প্রমত্ত প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে প্রতীজ্ঞা করলাম আমার বৃষ্টিকন্যাকে আমি নিজের করে নেবই।

চলবে!