শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৬

0
403

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৬
#সামিয়া_মেহেরিন

নীল আকাশে শিমুল তুলোর মতো সাদা মেঘের লুকোচুরি। নদীর পারগুলোয় সাদা কাশফুলের মেলা বসেছে। ঝাঁক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে আকাশে মালার আকার ধারণ করে উড়ে চলে যায়।
পুরনো দালানটির ছাদে একজোড়া ধবধবে সাদা পায়রা একে অপরে মত্ত। পুরুষ পায়রাটি নিজের ঠোঁট দিয়ে তার প্রণয়িনীকে দানা খাওয়াচ্ছে।
অনতিদূরে নীরবে বসে পায়রা দুটিকে দেখে চলেছে বন্যা। মুখে তার ম্লান হাসি। প্রণয়ে প্রমত্ত পায়রা দুটিকে দেখে তার মনে উঁকিঝুঁকি দেয় অনাকাঙিক্ষত বিরহের দহন।

সেই বর্ষণমুখর দিনটির পর কেটে গেছে প্রায় দেড় মাস। দেড় মাসে মানুষটার সাথে দেখা হয়নি একবারো।
ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পরই আদিত্য বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে তা বন্যা জানে না। অবুঝ মন বারবার জানতে চায় প্রেমিক পুরুষের ঠিকানা। কিন্তু তরুণী তার মনের আবদার পূরণে নাচক করে দিয়েছে বহুদিন আগে।তবুও না চাইতেও প্রেমিক পুরুষকে নিয়ে কতো কল্পনা-জল্পনা করে বসে অবুঝ মন। তরুণী নিজের মনকে ধিক্কার জানায়। জোরপূর্বক নিজের মনকে বুঝ দিতে চায় আদিত্যর সান্নিধ্য সে চায় না।
————
বন্যা ভার্সিটি থেকে সোজা চলে যায় মৌমিতাকে পড়াতে। মৌমিতার পরীক্ষা চলছে। মৌমিতার মা বন্যাকে খুব করে অনুরোধ করেছে এই কটা দিন সে যেন মৌমিতাকে একটু বেশি সময় দেয়। মৌমিতা মেয়েটা পড়তেই চায় না। তবে বন্যাকে সে খুব পছন্দ করে। তাই বন্যার সামনে ভালো মেয়ের মতো বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।

আজ মৌমিতাকে একটু বেশিই সময় দিয়ে ফেলেছে বন্যা। রাত আটটা বেজে গেছে। মৌমিতাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গলি পার করলে তবে মেইন রোড। বন্যা দ্রুত পা চালিয়ে গলিটা পার করে।
চারিদিকে রাতের আঁধার। তারওপর আকাশে মেঘ ধরেছে। শরৎকালেও বৃষ্টি। বৃষ্টির আভাস পাওয়া মাত্র বন্যার কপার কুচকে যায়। দমকা বাতাস জানান দিচ্ছে খুব জোর ঝড় হবে।
বন্যা রাস্তায় এদিক ওদিক তাকায়। কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। রাস্তা ফাঁকা, শুনসান। ভেবেছিল রিকশা নিয়ে বাসায় পৌঁছাবে। কিন্তু রাস্তায় রিকশা, অটো, বাস কিছুই নেই। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে সবাই যে যার বাড়ি চলে গেছে।
বন্যার মনে উঁকিঝুঁকি মারে প্রণয়ের সেই দিনগুলো। সেদিনও প্রকৃতির রূপ এমনটাই ছিল। বিকেলবেলাতেও কালো মেঘের দরুন পৃথিবীতে নেমে এসেছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। বন্যা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা খুঁজছিল বাসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু রিকশার ‘র’ এরও সন্ধান মিলছিল না।

হঠাৎ কোথা থেকে আদিত্য তার বাইক নিয়ে হাজির। বন্যা তাকে দেখে মাথা নুইয়ে নিয়েছিল।
আদিত্য বন্যার উদ্দেশ্যে বলে
-বন্যা বাইকে ওঠো। ঝড় আসবে এক্ষুনি।

বন্যার কোনো হেলদোল ছিল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। তা দেখে আদিত্য আবার তাড়া দেয়।
-কি করছেন বন্যা? জলদি আসুন। ঝড় শুরু হয়ে গেলে আর বাসায় যাওয়া হবে না।

তবুও বন্যার মধ্যে কোনো হেলদোল না পেয়ে আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। আদিত্য চলে গেলে বন্যা আবার রিকশা খুঁজতে উদ্যত হয়।
কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা এসে তার সামনে দাঁড়ায়। রিকশাওয়ালা বন্যাকে তাড়া রিকশায় ওঠার জন্য।
সেদিন রিকশাটা বন্যার জন্য আদিত্যই এনেছিল। পুরোটা রাস্তা আদিত্য বন্যার রিকশার পেছন পেছন বাইক চালিয়ে বাসায় পৌঁছে।

অতীতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্যা। আর দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। বন্যা ফুটপাত দিয়ে যত দ্রুত গতিতে পারে হাঁটতে শুরু করে।
হুট করে কোথা থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে থামে তার পাশে। বন্যার মনোযোগ পাওয়ার জন্য ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা কয়েকবার হর্ণ বাজায়। বন্যা বিরক্ত হয়ে হাঁটা থামিয়ে গাড়িটার দিকে তাকায়।

চোখে সানগ্লাস পরে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে একটা লোক। বন্যা তার দিকে ফেরায় লোকটা একটা মিষ্টি হাসি দেয়। অন্য সময় হলে বন্যা হয়তো এতক্ষণে পেটে হাত চেপে হাসতে থাকত। লোকটা কিনা এই রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে সানগ্লাস পরে ডসে আছে। কিন্তু এখন তার হাসি আসছে না বরং ভয় করছে। বন্যা একবার চারপাশে চোখ বুলায়। নাহ কোনো মানুষের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।

-হ্যালো মিস, কোথাও যাচ্ছেন? আমি পৌঁছে দিয়ে আসব?
বন্যা কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরে। লোকটা তার গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে নিয়ে এসে বন্যার উদ্দেশ্যে আবার বলে
-আরে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমিও মানুষ, আপনিও মানুষ। শুধু পার্থক্য একটাই, আপনি মেয়ে আর আমি ছেলে। একটা রাত একসাথে কাটালে খুব বেশি ক্ষতি হবে না।
কথাটুকু বলে লোকটা বিশ্রী একটা হাসি দেয়। যা দেখে বন্যার গা গুলিয়ে আছে। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। হুট করে কানে আসে একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর।

-এই বন্যা! এতো রাতে তুই এখানে কি করছিস? জলদি আয় তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।

কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে বন্যা রাস্তার অপারে তাকায়। আরোহী একটা রিকশা থেকে তাকে ডাকছে। বন্যা আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। ছুটে গিয়ে রিকশায় উঠে বসে। রিকশাওয়ালা মামাকে তাড়া দেয়।

ওদিকে ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে তার পাশের সিটে বসা লোকটার উদ্দেশ্যে বলে
-মেয়েটাকে আমার চাই, তাহের।

তাহের নামের লোকটা বাঁকা হেসে বলে
-ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
———–

তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে বন্যা। আরোহী তাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে। আসার সময় বৃষ্টিতে কিছুটা ভিজে গিয়েছিল বিধায় একেবারে গোসলটাই সেরে ফেললো। আজকের ঘটনাটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মানুষ কতটা জঘন্য হতে পারে!

মহিমা বেগম দরজা ঠেলে বন্যার ঘরে আসেন। বন্যাকে চুল মুছতে দেখে বিছানায় বসতে বসতে বলেন।
-তুই জ্বর বাঁধিয়ে তবে ক্ষান্ত হবি তাই না রে? এই অসময়ে গোসল করলি?

বন্যা মহিমা বেগমের কথায় মুটকি হেসে তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বলে
-বৃষ্টিতে ভিজেই তো গিয়েছিলাম। তাই গোসলটা করেই নিলাম।

মহিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন
-হয়েছে হয়েছে। এখন এদিকে আয়। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

বন্যা বাধ্য মেয়ের মতো মহিমা বেগমের সামনে গিয়ে বসে।মহিমা বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
-বন্যা, তুই এটা বিশ্বাস করিস যে আমি আর তোর খালু যা করব তোর ভালোর জন্যই করব?

মহিমা বেগমের প্রশ্নে বন্যার কপালে ভাঁজ পড়ে। মহিমা বেগম তাকে হঠাৎ এমন প্রশ্ন করে বসল কেন? বন্যা তার প্রশ্নের জবাবে বলে -এখানে অবিশ্বাসের কী আছে খালামণি? তোমরা আমার জন্য এত কিছু করলে। আমি জানি তোমরা যা কিছু করবে তা আমার ভালোর জন্যই করবে।

– আমরা যদি তোর বিয়ে ঠিক করে থাকি তবে?

মহিমা বেগমের কথায় বন্যা হতভম্ব। এটা কি বলে ফেলল তার খালামণি? মহিমা বেগম আবার বলতে শুরু করেন।

-দেখ বন্যা আমরা জোর করব না তোকে। তুই যা চাইবি তাই হবে। আমরা শুধু একটা ছেলেকে তোর জন্য ঠিক করেছি। ছেলেটাকে আগে দেখে নে তোর ভালো লাগে কিনা। বিয়ের কথা নাহয় পরেই বলিস।

মহিমা বেগম একটু থেমে আবার বলেন
– ওনারা কাল তোকে দেখতে আসতে চাইছে। তুই এটা মনে করিস না যে আমরা তোর ওপর জোর দেখাচ্ছি। বিয়ে একজন মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিয়েটা তোর, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তোর ষোলআনা আছে। অতীতে কি হয়েছে না হয়েছে সব কথা ভুলে যা। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। আল্লাহ তোর কপালে শাবাবকে রাখেনি তার পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ আছে। আর আমার বিশ্বাস তোর জীবনে শাবাবের থেকেও ভালো একজন আসবে। এখন তুই বল তুই কি চাস। ওনাদের কি আসতে বলব?

বন্যা বিষয়টা এখনো হজম করে উঠতে পারে নি। তার মৌনতা দেখে মহিমা বেগম নিরাশ হন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতে নেন। তখনই বন্যার কণ্ঠস্বর তার কানে আসে।

বন্যা ছলছল চোখে তার খালামণির দিকে তাকিয়ে বলে
-খালামণি, আমি পড়ালেখা শেষ করতে চাই।

মহিমা বেগম হেসে বলেন
-হ্যাঁ শেষ করবি। মানা করেছে কে? ওনারা তো দেখতে আসছেন কেবল। তোর খালু ওনাদের সাথে কথা বলেছে বিয়ে হলে সাথে সাথে তুলে নেবেন না ওনারা। তোকে পড়ার সুযোগ দেবে বলেছে।

সূর্যোদয়ের আগ মুহূর্ত। ঝড়-বৃষ্টি থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কালো মেঘ সরে গিয়ে আকাশ হয়েছে পরিষ্কার। মেঘহীন আকাশে ধীরে ধীরে সূর্য তার আগমনের পূর্বাভাস দিয়ে চলেছে। ঝড়-বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডা মোটামুটি ঠাণ্ডা পরিবেশ বিরাজ করছে। তবুও বন্যা দরদর করে ঘেমে বিছানার চাদর ভিজাচ্ছে। ঘুমে বিভোর হয়ে ঠোঁট জোড়া নেরে কি যেন বিরবির করছে।
হুট করে ঘুম ভেঙে যায় বন্যার জড়সড় হয়ে উঠে বসে। আজ আবারও সেই স্বপ্ন দেখল। পিছু ছাড়ে না কেন স্বপ্নটা তার।

চলবে!