শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৭

0
399

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৭
#সামিয়া_মেহেরিন

ড্রইংরুমের সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে বন্যা। পরনে লাল রঙা কাতান শাড়ি। মহিমা বেগম তাকে বলেছিল বন্যাকে শুধু দেখতে আসবে। কিন্তু দেখতে এসে তারা কাবিনও করে ফেলেছে। এখন থেকে বন্যা বিবাহিত। আর তার বর! সে আর কেউ নয় বরং আদিত্য।
আদিত্যর সাথে তার মা, বাবা আর ছোট বোন এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বারেক সাহেব ও জায়ান এই বিয়েতে উপস্থিত ছিল। বারেক সাহেব বিরক্তি নিয়ে পুরো বিষয়টি হজম করে গেছেন। বিয়ে পড়ানো শেষ হলেই জায়ানকে নিয়ে তিনি চলে যান।

আদিত্য বন্যার সামনাসামনি সোফায় বসে মুচকি মুচকি হাসছে। বন্যা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না বিধায় আদিত্যর এই প্রাপ্তির হাসি তার চোখে পড়ল না। আর দেখতে এসে কাবিন পড়িয়ে ফেলার সম্পূর্ণ ক্রেডিট যায় আদিত্যর।
আদিত্যর মা দিশারী বেগম পরম স্নেহে নিজের বৌমার হাতে বালা পড়িয়ে দিয়ে বলেন
-আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। মিষ্টি একটা মেয়েকে আমার বৌমা বানিয়েছে।

রাতে বন্যাদের বাড়িতে থাকতে হয় আদিত্যকে। তার বাবা, মা, বোন সবাই চলে গেছে। শুধু তার যাওয়া হলো না। মহিমা বেগম আর মাযহার সাহেব আজকের দিনটা তাকে এ বাড়িতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করে বসেছিলেন। আদিত্য অবশ্য থাকতে চায়নি। যাওয়ার আগে আদিত্যর বোন অদিতি তার কানে ফিসফিস করে বলে গেছে
-কীরে বিয়ে হলো কি হলো না এখনই বউকে ভয় পাওয়া শুরু করেছিস? দারা বন্যা ভাবিকে দিয়েই তোকে জব্দ করতে হবে। তখন বুঝবে তুমি কত ধানে কত চাল।
কথাটুকু বলে আচ্ছামতো আদিত্যর গাল টেনে দিয়ে পালিয়েছে।

আদিত্য ভয় অবশ্য পাচ্ছেই। বিয়ের আগে বন্যার মতামত সে জানতে চায়নি। বিয়ের রাতেই বউ যদি তাকে স্বামী হিসেবে অস্বীকার করে! এতো কাঠখোর পুড়িয়ে বিয়ে করেও কিনা শেষমেষ বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে জীবন কাটাতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে আদিত্য বন্যার ঘরে প্রবেশ করে। বন্যা তখন আলমারিতে কি যেন খুঁজছে।
আলমারি থেকে মেরুন রঙের একপা থ্রিপিছ বের করে আলমারি আটকে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তখনই চোখাচোখি হয় আদিত্যর সাথে। বন্যা সাথে সাথে তার দৃষ্টি সরিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। অস্বস্তিতে কি করবে বুঝতে না পেরে চোখের দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নামিয়ে এদিক ওদিক চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
কিছুক্ষণ এভাবেই থেকে ধীর পায়ে হেঁটে আদিত্যকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমে চলে যায়।

পুরো সময়টায় আদিত্যর দৃষ্টি স্থির ছিল তার বৃষ্টিকন্যার দিকে। আর ঠোঁটে ঝুলছিল দুষ্টু হাসি। না জানি মেয়েটাকে অস্বস্তিতে ফেলে সে কি আনন্দ পায়!
বন্যা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে সে ঠোঁট কামড়ে হাসে। আপন মনে বিরবিরায়।
-বলেছিলাম না বৃষ্টিকন্যা, আপনাকে আমি নিজের করে নেব। আমার কথা আমি রেখেছি। আজ থেকে আপনি স্থায়ীভাবে আমার একান্ত ব্যক্তিগত হলেন। আজ থেকে আপনি মিসেস আদিত্য আয়মান।

সকাল সকাল আদিত্য বন্যাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তার নাকি অফিস আছে। বন্যা জানালার কাছে বিছানার কোণায় বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছে। এই জানালা দিয়ে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে থাকা ছোট্ট নদীটা দেখা যায়। বন্যা প্রায় সময়ই জানালার পাশে বসে নদীটার ঢোলঢোল পানির খেলা দেখে। আজও তাই করছে। তবে আজ তার মনোযোগ নদীর জলের দিকে নেই। সে ব্যস্ত নিজের জীবনের হিসাব কষতে।

একটা দিনে তার জীবনে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। এক অনাকাঙিক্ষত সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সে। আদিত্য নামটা তার জীবনের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বন্যার মনে প্রশ্ন জাগে এই সম্পর্কের পরিণতি কি আদেও সুখকর হবে। নাকি শেষটায় আবারও তাকে ভেসে বেরাতে হবে দহন যন্ত্রণার সাগরে।

প্রতিদিনকার মতো বন্যা ভার্সিটির সব ক্লাস শেষ করে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসে। রোজ আরোহীর সাথেই সে বাড়ি ফেরে। তবে আজ আরোহী তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় মজেছে। বন্যার এসব ভালো লাগে না। সবসময় সবার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে। তাই আরোহীর আশায় না থেকে সে একাই বাসায় চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।

ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসতেই বন্যার চোখমুখ কুচকে যায়। সূর্যের তীব্র আলোয় চোখ মেলে তাকানো কষ্টসাধ্য। তবুও কিছু করার নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এসব সহ্য করেই যেতে হয়।
বন্যা নিজের বা হাত চোখের একটু উপরে ধরে পিটপিট করে চোখ খুলে। আজকে যা গরম পড়েছে হেঁটে গেলে নির্ঘাত মাঝরাস্তায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে হবে। তাই বন্যা আশপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে উদ্যত হয়।

হুট করে একটা বাইক এসে তার সামনে ব্রেক দেয়। বন্যা বিরক্তি নিয়ে বাইকের লোকটার দিকে তাকায়। মানুষটাকে দেখে মুহূর্তেই তার সব বিরক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বন্যা জানে না এমনটা কেন হয়। শুধু এটুকু জানে এই মানুষটার ওপর সে রাগ-বিরক্তি নিয়ে এক মুহুর্তও থাকতে পারে না।

বন্যাকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদিত্য বন্যার উদ্দেশ্যে বলে
-আজ পুরোদিন কি এখানেই থাকার প্ল্যানিং করছেন বৃষ্টিকন্যা? চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।

আদিত্যর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতে বন্যার ধ্যান ভাঙে। আদিত্যর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তা দেখে আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কবে যে মেয়েটা তার সকল জড়তা ভুলে তাকে গ্রহণ করবে?

আদিত্য আবারও বলে।
-কি হলো বন্যা? চলুন।

বন্যা সেভাবেই কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বন্যার হেলদোল না দেখে এবার আদিত্য ভরাট গলায় বলে
-বন্যা আপনি এখন সম্পূর্ণই আমার। আপনি পরিবারের দোহাই দিয়ে আমাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই পরিবারকে সাক্ষী রেখেই কিন্তু আমি আপনাকে আপন করে নিয়েছি।

আদিত্যকে আর কোনো কথা ব্যায় করতে হয় না। বন্যা কাঁদো কাঁদো মুখে পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে আদিত্যর বাইকে উঠে বসে। মিহি সুরে ছোট্ট করে বলে-সরি।

বন্যার ওপর রেগে থাকার সামর্থ্য আদিত্যর আর নেই। ম্লান হেসে সে বাইক স্টার্ট দেয়।

অফিসের কাচের দেয়াল ভেদ করে সূর্যের সোনালি আলো পড়ছে শাবাবের চোখে-মুখে। শরতের মেঘহীন আকাশের সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তবুও শাবাব একদৃষ্টিতে সুদূর অন্তরীক্ষের পানে তাকিয়ে আছে।
বন্যার বিয়ের খবর সে কয়েক মুহূর্ত আগেই পেয়েছে। বিয়ের খবর জানার পর থেকেই এভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
বন্যাকে সে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। যে মেয়েটাকে নিয়ে আমৃত্যু ঘর করার কল্পনা-জল্পনা করে বসেছিল সে এখন অন্যকারো। আর সবথেকে নির্মম সত্য হলো নিজের দোষেই সে বন্যাকে হারিয়েছে। মায়ের বাধ্য সন্তান হতে গিয়ে প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলেছে সে। চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে।

বন্যাদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে বাইক থামায় আদিত্য। বন্যা ফট করে নেমে গিয়ে আদিত্যর দিকে ফিরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। মিনমিনে গলায় সুধায়।
-আপনি ভেতরে যাবেন না?

আদিত্য মুচকি হাসে। তবে হেলম্যাট পড়ে থাকায় তা বন্যার চোখে ধরা দেয় না।
-আজ আপনার কথা রাখতে পারলাম না বৃষ্টিকন্যা। অফিসে যেতে হবে। আজ আসি কেমন!

আদিত্য বাইক ঘুরিয়ে চলে যায়। যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্যা। দুদিন আগেও এই মানুষটার থেকে দূরে পালাতে চাইতো বন্যা। আর আজ!

চলবে!