শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৮

0
356

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৮
#সামিয়া_মেহেরিন

কাঠফাটা রৌদ্রের দ্বিপ্রহর। বন্যা ভার্সিটি ক্যামপাস থেকে বেরিয়ে আসছে। তার পেছন পেছন আরোহীও আসছে বন্যাকে জ্বালাতে জ্বালাতে।

-এই বন্যা! তোর কোন বর বাসায় তোর জন্যা অপেক্ষা করছে যে এত জলদি হাসছিল বলতো। একটু আস্তে যা না।

বন্যা আরোহীর কথা কানে না নিয়ে হাঁটতে থাকে। বন্যার বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকেই সে বন্যার পেছনে পরে আছে। আরোহীর গলার আওয়াজ আবারো বন্যার কানে আসে।
-ওই বন্যা, তুই বিয়ে করলি অথচ আমাকে একটু বললিও না। আচ্ছা ছাড়, না বললি। কিন্তু তোর বরের সাথে দেখাতো করাবি? এট লিস্ট একটা ছবি তো দেখাবি নাকি।

বন্যা হাঁটা থামিয়ে আরোহীর দিকে ফেরে। আরোহী বাচ্চাদের মতো চেহারা করে হাসে। তার সেই হাসি উপেক্ষা করে বন্যা আবার হাঁটা ধরে। ওদিকে আরোহীও তার দিকে তেড়ে এসে বলে
-এই এই আমার না তোর ভাবসাব একদম ভালো ঠেকছে না। বাই এনি চান্স, তোর বর কি ওই ভুরিওয়ালা, টাকলা এমন কেউ নাকি রে?

বন্যা পেছন ফিরে আরোহীকে চোখ রাঙানি দিয়ে আবার সামনে ফেরে। তখনই চোখ যায় তার থেকে দুই হাত দূরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্যর দিকে। আদিত্যকে দেখে বোধহয় পৃথিবীর সব জড়তা ভর করে বসে বন্যার ওপর। বন্যা মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আরোহী তার বকবক চালিয়েই যায়।

এদিকে আদিত্য তার হাতের দিকে কপাল কুচকে তাকায়। গলার স্বর একটু উঁচু করে বন্যার উদ্দেশ্যে বলে
-বন্যা আজ আমার দরকারি কাজ আছে। একটু জলদি আসুন প্লিজ।

বন্যা কি করবে ভেবে পায় না। এদিকে আরোহী বকবক করেই চলেছে ওদিকে আদিত্য তাকে ডাকছে। আদিত্যর কথা আরোহীর কানে পৌঁছাতে সে গর্জে ওঠে। তেড়ে এসে বলে
-হ্যালো মিস্টার, কি প্রবলেম আপনার? সাহস তো কম না আমার বান্ধবীকে বাজে প্রস্তাব দেন। আপনি কোন দেশের রাজা যে আপনি বলবেন আর বন্যা গটগট করে আপনার বাইকে উঠে যাবে।

আদিত্য আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আশপাশের মানুষ তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদিত্য অসহায় গলায় বলে
-নিজের বউকে বাইকে উঠানো কি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ?

আরোহী থতমত খেয়ে যায়। অসহায় দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকায়। বন্যা ইশারায় হ্যাঁ বুঝায়। আরোহী আমতা আমতা করে বলে
-সরি দুলাভাই আমি চিনতে পারিনি।

আদিত্য বন্যাকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। দুজনেই চুপচাপ। মাঝরাস্তায় এসে বন্যা মিনমিনে গলায় বলে
-আরোহীকে ওভাবে না বললেও পারতেন। কী ভাবলো কে জানে।

আদিত্য স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-আর আরোহী যে আমাকে গণপিটুনি খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করে ফেলেছিল তার বেলায়?

আদিত্যর কথার পিঠে বন্যা আর কিছু বলার মত খুঁজে পায় না বিধায় চুপ করে বসে থাকে।
বাসার সামনে বাইক থামালে বন্যা ফট করে নেমে আজও আদিত্যকে সুধায়।
-আপনি ভেতরে যাবেন না?

আদিত্য মুচকি হেসে বলে
-জীবনে জামাইআদর খাওয়ার অনেক সুযোগ পাবো। কিন্তু এখন অফিসে না গেলে আমার চাকরিটার দফারফা হয়ে যাবে।

বন্যা মিনমিনে গলায় বলে
-আপনি রোজ রোজ আসেন কেন? আমি একা বাসায় আসতে পারব।

আদিত্য ঘোর লাগা গলায় বলে
-বউটা যদি হারিয়ে যায়।
বন্যা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।
-আমি বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাবো।

বন্যার কথার পিঠে আদিত্য তাকে সুধায়
-তুমি আমার বউ?

আদিত্যর এহেন কথায় বন্যার ইচ্ছে করে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে। তাকে লজ্জা পেতে দেখে আদিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে। তার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
-আপনার জন্য আজ বোধহয় চাকরিটা চলেই যাবে।

বন্যা কোনো রকমে নিজেকে সামলিয়ে আদিত্যকে বিদায় দিয়ে বাসার ভিতরে চলে যায়।
———
অপরাহ্নের শেষ ভাগ। বন্যা বাসার পাশের নদীটার দিকে তাকিয়ে আছে। বাম হাতে পড়া ব্রেসলেটটা ডান হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। হুট করে হেসে দেয় সে। মানুষ বিনা কারণে হাসে হয় পাগল হলে, নইলে প্রেমে পড়লে। বন্যা কি তাহলে প্রেমে পড়েছে?
ব্রেসলেটটা তাকে বিয়ের রাতে আদিত্য পড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষটা বরাবরই স্পষ্টভাষী।
ব্রেসলেট পড়িয়ে দিয়ে সরাসরি তাকে বলেছিল
-বন্যা, আমি জানি বিয়েতে তোমার মতামত ছিল কিনা আমার জেনে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি আমার বৃষ্টিকন্যাকে পেতে এতটাই উন্মাদ হয়েছিলাম যে কারো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না।

অতঃপর আদিত্য মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলেছিল
-ভুল যখন করেছি শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই যতদিন না তুমি এই নতুন সম্পর্কে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছো, আমি নাহয় বিবাহিত ব্যাচেলর হয়েই থাকব।

‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ শব্দটা আপন মনে আউড়ে বন্যা হেসে দেয়। এমন সময় আগমন ঘটে মহিমা বেগমের। বন্যাকে একা একা হাসতে দেখে বলেন
-কিরে একা একা কি ভেবে হাসছিস?

বন্যার হাসি থেমে যায়। গালে ফুটে ওঠে লাল আভা। কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা শুরু করে। মহিমা বেগম তা দেখে হাসেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন
-বলেছিলাম না তোর জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোকে ভালো রাখবে, তোর অতীতকে ভুলিয়ে দিবে। আদিত্য তোকে খুব ভালো রাখবে দেখিস।

মহিমা বেগম খানিকক্ষণ থেমি আবার বলেন। বন্যা মনোযোগ দিয়ে তার সব কথা শোনে।
-ছেলেটা এক মাস আগে নতুন চাকরি পেয়েই তোর খালুর কাছে এসেছিল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তোর খালু তো না করে দিয়েছিল পরিবারকে না পাঠিয়ে নিজেই প্রস্তাব নিয়ে চলে এসেছে ভেবে। কারণ আদিত্যর সাথে ওর পরিবারের বোধহয় তেমন একটা বনিবনা নেই আর এটা তোর খালুর কানে গিয়েছিল । পরে আমিই তোর খালুকে বুঝিয়ে বললাম আদিত্যর মতো আর ছেলে হয় না।
———–
দ্বিপ্রহরের শেষভাগ। মেঘহীন আকাশে সূর্য খাড়াভাবে কিরণ ছড়াচ্ছে ধরণীতে। জানালা গলে আসা দমকা বাতাসে ঘুমন্ত বন্যার চুলগুলো তার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে। ঘুমের মধ্যেই বন্যা বিরক্তসূচক আওয়াজ করে।
আজ সে ভার্সিটি থেকে আগেই চলে এসেছে। আদিত্যর জন্য অপেক্ষা করেনি। তার অশান্ত মনে কেন যেন আজ মানুষটার কথা স্মরণই হলো না। হয়তো দীর্ঘ সময় পর অতীতকে নিজের সামনে দেখেছে বলে এমনটা হয়েছে।

আজ আরোহী জেদের কারণে আরোহীর সাথে একটা কফিশপে যেতে হয় বন্যাকে। কিন্তু সেখানে যে সে অতীতের সাক্ষাৎ পাবে তা হয়তো সে কল্পনাও করেনি। কফিশপে সে শাবাব আর জুঁইকে একসাথে দেখেছে।
বন্যা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে শাবাবের উপস্থিতি উপেক্ষা করার। নিজেকে বুঝানোর যে সে এখন আদিত্যর স্ত্রী। কিন্তু অবাধ্য মন কিছুতেই মানলো না। বন্যা সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে। বন্যার ফেকাশে মুখ দেখে মহিমা বেগম বারবার জিজ্ঞাসা করেন তার কি হয়েছে। তবে বন্যা তাকেও উপেক্ষা করে নিজের ঘরে চলে আসে। অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।

হঠাৎ ঘুমের ঘোরে বন্যার মনে হয় কেউ তার দিকে অনেকক্ষণ ধরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বন্যার অস্বস্তি হতে শুরু হয়। কিন্তু ঘুমে এতটাই প্রগাঢ় যে চোখ খুলতে মোটেই মন চাচ্ছে না। তবুও অস্বস্তি না কাটায় পিটপিট করে চোখ খোলে সে।

সামনের মানুষটাকে দেখে তার ঘুম জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। লাফিয়ে উঠে বসে সে। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে
-আদিত্য আপনি?

আদিত্য ঠিক তার সামনে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছে। যদিও বন্যার ওপর সে রেগে নেই। আসলে বন্যার ওপর সে রেগে থাকতে পারে না। তবুও মেয়েটাকে একটু শাসন করা দরকার।
আদিত্য গম্ভীর গলায় বলে
-তুমি এক মা চলে এসেছো কেন? আমিতো যেতামই তোমাকে নিতে। একটু অপেক্ষা করতে পারতে।

বন্যা কি বলবে বুঝতে পারে না। সে কীভাবে আদিত্যকে বলবে যে আজ সে শাবাবকে দেখেছে। নিজের প্রাক্তনকে দেখেছে। বন্যাকে চুপ থাকতে দেখে আদিত্য আবার প্রশ্ন করে।
-বাসায় আসার এত কীসের তাড়া ছিল?

মহিমা বেগমের আগমনে কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। মহিমা বেগম তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে বলেন
-দুজনের কাণ্ড দেখেছো! দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল অথচ দুজনের একজনেরও পেটে দানাপানি দেয়ার কথা মনে নেই। আর বন্যা, তুই আদিত্যর একটু খেয়াল রাখবি না বলতো। ছেলেটা সেই কখন এসেছে। অথচ এখনো মুখে কিছু তুললো না।

দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ধরে কফিশপে বসে আছে অদিতি। এতক্ষণে চার গ্লাস কফি সে সাবার করে ফেলেছে। অথচ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। বিরক্তিতে অদিতি চোখমুখ কুচকে ফেলে। মানুষটা কি সব জায়গায় এমন দেরি করে নাকি শুধু তার সাথে দেখা করতে বললেই এমন দেরি করে?
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি তার সামনে হাজির হলো। অদিতি তীব্র অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। তা দেখে তার প্রেমিক পুরুষ নিঃশব্দে হাসে। প্রেয়সীর গাল ফুলিয়ে থাকা দেখতে বেশ লাগছে তার। অদিতিকে কোনো কথা বলতে না দেখে সে প্রেয়সীকে সুধায়।

-আমি রাজশাহী থেকে এতদূর এলাম তোমার জন্য অথচ তুমি কথাই বলতে চাচ্ছো না অদি?এই দেখো কানে ধরেছি আর দেরি হবে না।

অদিতি আড়চোখে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দিকে তাকায়।
-হয়েছে হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। আমি বুঝে গেছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। একটুও ভালোবাসেন না।

মানুষটা অপরাধী গলায় প্রেয়সীর রাগ ভাঙাতে বলে
-বিশ্বাস করো অদি, রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। আমি সেই সকাল ৬টায় বাসে উঠেছি। আর এখন এসে পৌঁছালাম।

অদিতির অভিমানের পাহাড় বোধহয় গললো। মিষ্টি গলায় ছোট্ট করে বলে-হুম।

লোকটা অদিতির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-আচ্ছা অদি, আদিত্য আর বন্যার কী খবর বলো তো।

অদিতি লোকটার হাত জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রেখে বলে
-কি আর করবে। সবে বিয়ে করেছে। এখন বোধহয় চুটিয়ে প্রেম করতে ব্যস্ত।
অদিতির কথায় লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

চলবে!