সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-০২

0
549

#সম্পর্কের__দেয়াল
#দ্বিতীয়__পর্ব
|Writer_Anahita_Ayat|
আম্মুর উত্তর টা শুনে সব কিছু ধোঁয়াশা লাগল। এ যেনো বিশ্বাস ই করতে পারছি না! রিমি তো আমার বোন না। যাকে সেই ছোট বেলা থেকে নিজের আপন বোন বলে জেনেছি, বোনের মতো ভালোবেসে এসেছি এখন জানলাম সে আমাদের কেউ ই না! অবাক লাগছে ভীষণ!

‘আম্মু আমার সাথে মজা করছেন তাই না? যখন আমি ছোট্ট ছিলাম অল্প অল্প বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখে আসছি, রিমি কে কখনো কটু চোখে দেখেন নি। আমাকে যা পড়িয়েছেন রিমি কেউ তার বিপরীত না। রিমি রক্তের সম্পর্কের কেউ না বলে কখনো অবজ্ঞা করেন নি। তাহলে আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো সে….

‘যোগ্যতার থেকে বেশি কিছু পেলে মানুষ পশুর মতো আচরণ করে! কথাটা আদতে সত্য আজ প্রমাণ পেলাম। তোকে কিছু সত্যি কথা বলি যা এতোদিন গোপন রেখেছিলাম!
আজ থেকে প্রায় ১৯ বছর আগের কথা। তোর বয়স তখন ৪ বছর।তোর বাবা কাজের জন্য ঢাকার বাইরে যান। রাস্তার পাশে অসহায় ভাবে পড়ে থাকতে দেখেন একটা ১ মাস কি দেড় মাসের একটা বাচ্চা মেয়ে কে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ও সেই বাচ্চার বাবা মা কে তোর বাবা পায় নি। সেই বাচ্চাটি ছিলো রিমি। দেখতে টুকটুকে সুন্দর ছিলো চেহারার ছিলো অঢেল মায়া। তোর বাবা আমাকে কথাটা জানায়।আমি বলেছিলাম কোনো অনাথ আশ্রমে বা হাসপাতালে দিয়ে আসতে এতে করে যারা বাচ্চা খোঁজেন তারা নিয়ে যেতে পারবেন যেহুতু আসল বাবা মা কে পাচ্ছে না এটাই করা ভালো মনে‌ হয়েছিলো। এই অপরিচিত বাচ্চার একটা সুরাহার ব্যবস্থা ও হতো। কিন্তু তোর বাবা সেটা করে নি। তিনি বলেছিলেন, মারিয়া বাচ্চা টা কে আমরা রিধির সাথে বড় করবো। তোর বাবার উপর কথা বলতে পারিনি। রিমির মুখ দেখার পর আমি ও যেনো আর না করতে পারলাম না। সেদিন ই তোকে নিয়ে তোর বাবার কাছে চলে যাই। তোর নামের সাথে মিলিয়ে নাম দেই রিমি। তুই তখন অল্পস্বল্প কথা বলতে শিখেছিলি। আমরা বলেছিলাম এটা তোর ছোট বোন। হাসপাতাল থেকে কিনে এনেছি। তার পর থেকেই আমাদের কাছেই বেড়ে উঠে রিমি।
তখন যদি তোর বাবা ওকে ওখানেই রেখে আসতো তাহলে নির্ঘাত কোনো হিংস্র জানোয়ারেই খেয়ে নিতো। রাস্তা থেকে তুলে এনে মাথায় ঠাই দিয়েছি তাই তো এখন পায়ে কুড়াল মারল!’

নিথর হয়ে আছি। এসব কিছু শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আম্মু ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন। আমি অসহায় ভাবে আম্মু কে প্রশ্ন করলাম,

‘একটা বারের জন্য ও তো আমাকে এটা বললেন না!’

‘বলিনি কারণ তোদের একসাথে মিলমিশ দেখে ভেবেছিলাম এই অপ্রত্যাশিত ও অপ্রকাশিত সত্যি তোরা না জানাই ভালো! কিন্তু আজ বুঝলাম রক্তের সম্পর্ক কখনো বেঈমানি করে না করে তো বাকি রা!’

কথাটা এমন ভাবে গোপন থাকলো যে আশেপাশে কোনো কাক পক্ষির থেকে ও আমি কখনো শুনলাম না! আজব লাগছে। যাক সেসব কথা।

‘এখন আমি কি করবো আম্মু?’

‘তুই কি বলিস এখন আমি আসতাম? শুয়রের বাচ্চা টাকে চুলের মুঠি ধরে বের করে আনবো ওখান থেকে…

‘না না আম্মু এখন এটা করে আর কি হবে? পাভেল কে কি আমি ফেরাতে পারবো?’

‘বেয়াদব টা কে বের করতে পারলে পাভেলের সাথে সব খোলাখুলি কথা বলবি!’

‘শেষে কিনা অবৈধ সম্পর্কে জড়ালো ছিঃ ঘৃণায় আমার গা রিরি করছে…

‘পাভেলের দোষ আমি দিতে পারি না ছেলে মানুষ রুপের মোহে পড়ে গেছে। যত দোষ রিমির নিজের সৌন্দর্যে আকর্ষণ করে ভুলিয়ে ভালিয়ে এমন টা করেছে। নাহলে আমরা ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েই তো তোকে পাভেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম,,, আচ্ছা তোর শাশুড়ি ই বা কেমন?’

‘আম্মু উনার কোনো দোষ নেই। উনি এসব কিছুই জানেন না। আমি এখনো জানাই নি। আর আপনি বলছেন পাভেলের দোষ নেই? যে পুরুষ স্ত্রী ব্যতিত অন্য নারীর কাছে যায় সে কেমন পুরুষ? যে কিনা পরনারী তে আসক্ত! সে তো একটা কাপুরুষ তাই না? এই সংসার আমি করবো না। আমি মরে যাবো….

‘উল্টা পাল্টা কথা একদম বলবি না রিধি। আমি এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি আমি আসবো ওখানে!’

‘আম্মু এখন আব্বু কে ও কিছু জানাবেন না। আপনি আসুন মাথা ঠান্ডা রেখে কিছু করতে হবে। তাছাড়া এ বাড়িতেই আমার ভয় লাগছে। বিষ খাইয়ে আমাকে মেরে ফেলবে ওরা…

‘এতো বড় সাহস ওদের হয় নি। কলিজা ছিড়ে ফেলবো আমার মেয়ের কিছু হলে তুই ফোন রাখ…

আম্মু অনেক রেগে গেছেন। ফোন নিজেই কেটে দিলেন। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। কি করবো না করবো বুঝতে পারছি না!

হঠাৎ করে কারো আসার শব্দ পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াই। কেউ আমার রুমের দিকেই আসছে। পায়ের শব্দে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

‘রিধি কোথায় তুমি?’

তার মানে আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পাভেল ই আসছে। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার বৃথা চেষ্টা করলাম।

‘কি হলো রিধি? আছো তুমি?’

ওয়াশরুমে দৌড় দেই। তাড়াহুড়ো করে চোখে মুখে পানির ঝাপটা মেরে রুমে আসি। পাভেল লাগামহীন ভাবে ডেকেই যাচ্ছে।

‘দরজা ও বন্ধ আজব তো? কি হলো কথা বলছো না কেন?’

‘এ্ এ্ এই তো আমি! ওয়াশরুমে ছিলাম!’

দরজা টা খুলে দেই। পাভেল রুমে ঢুকলো। তার চেহারার একরাশ বিরক্তি মাখা। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতে ইচ্ছে হলো আমাকেই দেখলেই বুঝি বিরক্ত লাগে এখন? মনে মনেই আওড়ালাম। চোখ সরিয়ে নিলাম ঘৃণা হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছা করছে কষে কয়েকটা থাপ্পড় মারি। আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেই তুমি একটা কুৎসিত আর কাপুরুষ।

‘তোমাকে মা নিচে ডাকছে! যাও তাড়াতাড়ি’

‘ওহ আচ্ছা যাচ্ছি!’

(চরিত্র গুলো ভালো ভাবে ব্যখ্যা করতে ‘আমি’ অংশ টাকে বাদ দিয়ে। আলাদা আলাদা ভাবে তুলে ধরছি!)

রিধি রুম থেকে চলে যায়। পাভেল শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে কল্পনা করছে তার আর রিমির রোমাঞ্চকর মুহূর্ত গুলো। রিমিতেই যেনো সে মাতোয়ারা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আফসোস ও হচ্ছে কেন যে সে রি‌মি কে রেখে রিধি কেই কেন সে বিয়ে করতে গেলো কে জানে! হাসি পাচ্ছেএটা ভেবেই যে রিধি মেয়ে টা খুব বোকা। শুধু বোকা নয় একটা উন্নত প্রজাতির বোকা। পাভেল হো হো করে হেসে উঠল।

__________★

রিধি কে আসতে দেখে তার শাশুড়ি মা বললো,

‘এতোক্ষন কি কাজ করছিলি তুই?’

‘ইয়ে..‌‌.ম..

‘থাক আপু তো‌মার এতো মানে ‌মানে করতে হবে না!’

‘হ্যাঁ রিমি তুমি ঠিক ই বলেছো। তার চেয়ে বরং আমরা ৩ জন মিলে এক ম্যাচ লুডু খেলি আসো!’

‘না মা এখন খেলতে ইচ্ছে করছে না?’

‘ইচ্ছে করবে আসো তো!’

রিমির সাথে বসে খেলতে রুচি তে বাঁধছে রিধির, তাই খেলতে চাইছে না কিন্তু মার জন্য খেলতে এক প্রকার বাধ্য হলো সে। খেলা শুরু হলো। লুডু তে বরাবরের মতো বেস্ট খেলোয়ার রিধি। কিন্তু আজ সে হেরে গেলো। খেলায় মন না থাকায় এটা হয়েছে। রিমি তো সেই খুশি।

‘আপু আজ তোমার নাম ভাঙ্গলাম। বেস্ট প্লেয়ার কে হারিয়েছি আমি ইয়াহু। সব গোল তুমি খেয়েছো!’

রিমি হাসছে। রিধি ও স্মিত হাসলো আর মনে মনে বলল আমার নাম ভেঙ্গেছিস কাল আমার সংসার ও ভাঙ্গবি। এইতো!! ছিহ তুই বোন নামের দুশমন। তুই সমস্ত মেয়ে জাতির ই কলঙ্ক। রিধি এটাও ভাবছে শেষ পর্যন্ত কি সেই আসলে হেরে যাবে?

পাভেলের মা ভ্রুঁ কুঁচকে রিধির দিকে তাকান,,,
‘কি ব্যাপার বল তো রিধি আজ গোল খাওয়ানোর বদলে নিজে খেয়ে নিলি যে?’

‘আজকে আপুর ক্ষুধা বেশি লেগেছে তো তাই হিহিহি…

‘আসলে মা আমি তো প্রথমেই বলেছি খেলতে ইচ্ছে করছে না তাই…!’

‘অনিচ্ছা হলেই কি হারতে হয়?’

‘সেসব বাদ দিন না। একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি আজ রাতে আম্মু আসবেন বলছিলেন!’

‘কিহহহ…’

রিধির মুখে কথাটা শোনার পর রিমির হাসি যথ একেবারেই উধাও। ৩ জনের মধ্যে রিমি কে বেশি চমকাতে দেখে পাভেলের আম্মু আর রিধি তার দিকে তাকায়। রিমি সেটা বুঝতে পারে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল

‘ওহ আম্মু আসবে…কই আমাকে বললো না তো!’

‘আমাকে বলেছেন!’

পাভেলের আম্মু বললো,
‘তা তো ভালো কথা। দিনে চলে আসলে কি হতো বলতো এখন পথঘাট আর মানুষ জন যা খারাপ…

‘সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন বলে আসতে পারেননি। আমাকে নাকি দেখতে ও ইচ্ছা করছে তাই এখন আসবেন!'(মিথ্যা বলল যাতে রিমি কিছু বুঝতে না পারে)

‘আচ্ছা আল্লাহ ভরসা।!’

‘হুম!’

রিমি কে আর একা ছাড়লে না রিধি। তবে এটা বেশ লক্ষ্য করছে রিমির চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে আর ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। রিধি সব বুঝতে পেরে ও চুপ থাকলো।

আম্মু আসছে বলে ভালো কিছু রান্নার প্রয়োজন নেই কারণ সব রান্না করাই আছে। তবুও রিমি কে পাভেলের মায়ের কাছে বসিয়ে রেখে রিধি রান্না ঘরে যায়। হাতে কিছু উঠছে ও না। শরীর টা কেমন দুর্বল লাগছে রিধির।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো।রিধি অপেক্ষা করছে তার আম্মু আসার জন্য কিন্তু আসছে না। হঠাৎ করে মন ও কেমন কু ডাকছে আল্লাহ না করুক কোনো খারাপ কিছু হলো না তো। ভাবতে ভাবতে রিধির ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। রিধি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবছে কল রিসিভ করা ঠিক হবে কিনা। ভাবতে ভাবতে রিসিভ ও করলো তারপর ওপাশ থেকে সব কিছু শোনার পর রিধির হাত থেকে ফোন টা নিচে পড়ে যায়। রিধি ধপাস করে নিচে বসে পড়ে…. এ যেনো মাথার উপর আকাশ টাই ভেঙ্গে পড়লো কারণ……..

চলবে___________